গল্প:: সবুজ মোজার বাদামি ভাল্লুক - সেমিমা হাকিম


সবুজ মোজার বাদামি ভাল্লুক
সেমিমা হাকিম

মোজা জোড়া পেয়ে টুবলুর তো ভীষণ আনন্দ হয়েছে, সবুজ রঙের বেশ মোটা মোজা। গায়ে আবার বাদামি রঙের ভাল্লুক আঁকা আছে। ডান পায়ের গার্ডারের কাছে সুতো সরে গেছে একটু, এই যা। নয়তো অমন মোজাকে টুবলু আর ওর মতন ছোটো বাচ্ছারা নতুনই বলে। ও, তোমরা তো আবার টুবলুকে ঠিকঠাক চেনোই না।
টুবলু এই অনাথ আশ্রমের সব থেকে শান্ত ছেলেটি। এক্কেবারে ছোটোবেলায় কেমন করে যেন এখানে এসে পড়েছিল। তারপর থেকে এখানেই থাকে, পড়াশোনা, হাতের কাজ শেখে, বাগানে খেলা করে অন্যদের সঙ্গেসব ঠিকঠাকই আছে, শুধু মেট্রনমাসি খুব কড়া। মাঝেমধ্যেই সব্বাইকে খুব বকে, না খেতে দিয়ে একা আটক-ঘরে বন্দি করে রাখে আর ছোটো ছোটো বাচ্ছাগুলোর গাল, কান টেনে কাঁদিয়ে দেয় মিছিমিছি। টুবলুর খুব রাগ হয় তখন।
টুবলুদের আশ্রমে মাঝেমধ্যে দামি দামি গাড়ি করে অনেক অনেক মানুষ আসে ভালো ভালো জামাকাপড় পরে। ওঁরা এলে সেদিন আশ্রমের সমস্ত বাচ্ছাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জামা পরতে হয়, শান্ত হয়ে থাকতে হয়, চেঁচামেচি, হট্টগোল করা চলে না। তবে সেইসব দিনে ভালো খাবার পাওয়া যায়, প্রায় নতুন জামাকাপড় আনেন অনেকে, যেমন এই মোজাটা, আবার কোনো কোনো দিন আশ্রমের বাচ্ছাদের বেড়াতেও নিয়ে যান ওঁরা। তাই মেম্বারদের আসার কথা থাকলে আশ্রমের সবাই খুব খুশি হয়।
এবার মেম্বাররা এসেছিলেন শীতের শুরুতে। সব্বাইকে এমনি নতুন সোয়েটার মোজা দিয়ে গেছেন। টুবলু সোয়েটারটা ভাঁজ করে রেখে মোজাটা পায়ে পরতে গেল আর কোথা থেকে রুমের সবথেকে দুষ্টু ছেলে মন্টাই এসে ছোঁ মেরে ওর হাত থেকে মোজাখানা কেড়ে নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। টুবলুও ছুটল ওর পিছনে পিছনে - “মন্টে আমার মোজা আমাকে ফিরিয়ে দে শিগগিরবলে চিৎকার করতে করতে। মন্টাই এমনিতে খুব শক্তসমর্থ ছেলে, তায় টুবলুর থেকে লম্বায় অনেকখানি বড়োটুবলু ছোট্টখাট্ট রোগাসোগা শান্তশিষ্ট মানুষ, সে পারবে কেন মন্টাইয়ের সঙ্গে দৌড়ে। মন্টাই বাগানে ওর হাতের নাগালের বাইরে দৌড়ে বেড়াতে লাগল, টুবলু খানিকক্ষণ ওকে ধরার চেষ্টা করে একসময় হাঁপিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। মন্টাই তখনও নাগালের বাইরে দাঁড়িয়ে ওকে ভ‍্যাঙাচ্ছিল আর টুবলু রাগে চিৎকার করে ওকে বকছিল। দু’জনের কেউই খেয়াল করেনি কখন মেট্রন অফিস থেকে বেরিয়ে ওদের কাণ্ডকারখানা দেখছিলেন। বাজখাঁই গলায় টুবলু, মন্টাইডাক শুনে দু’জনেরই আক্কেল গুড়ুম, মাথা নিচু করে গুটিগুটি পায়ে এসে দাঁড়াল মেট্রনের সামনে। মেট্রন জিজ্ঞেস করলেন, “মন্টে, তোর হাতে ওটা কী? আর টুবলু তুই এত চিৎকার করছিলি কেন?”
দু’জনে একসঙ্গে হাঁউমাউ করে কীসব বলতে শুরু করেছিল, মেট্রন এক ধমকে থামিয়ে দিলেন দু’জনকেই, তারপর বললেন, “ওই মোজাটা কার?”
টুবলু “আমারবলতেই মেট্রন বললেন, “বুঝেছি। মন্টে আজ তোর খাবার বন্ধ, ঘর আটক আর টুবলু তোরও ঘর আটক তবে খাবার বন্ধ না” এই বলে হনহন করে অফিসে চলে গেলেন তিনি আটক ঘরের চাবি আনতে।

মন্টাই আর টুবলু দুটো ছোট্ট ঘরে বন্দি আছে সেই দুপুর থেকেসন্ধেবেলায় ঘরে ঘরে লাইট জ্বলল, ওদের আটক ঘরেও পনেরো ওয়াটের বাল্ব জ্বলে উঠল একটা করে। আলোর থেকে ছায়ারা তখন বেশি ঘন হয়ে আসে। ঘর দুটো আসল দালানবাড়ি থেকে খানিক দূরে বাগানের মধ্যে। তাই ঝিঁঝিঁর শব্দ ছাড়া চারিপাশে আর কোনো শব্দ নেই। এতক্ষণ মন্টাই চিৎকার করছিল, “টুবলু, তোর জন্যে আমাকে এখানে আটকে রেখেছে। কাল বেরোতে দে, দেখাব তোকে মজাও মাসি আর কখনও করব না গো, ছেড়ে দাও গো” এইসব। টুবলু এমনিভাবে চিৎকার চেঁচামেচি করেনি, শুধু হাঁটু মুড়িয়ে চুপ করে বসে ছিল দরজার পাশে।
দূর থেকে রাতের খাবারের ঘন্টা ভেসে এল, খানিক পরে ওর জন্যও একটা থালায় দুটো রুটি খানিকটা আলু বেগুনের তরকারি কে যেন দরজার নিচে দিয়ে ঠেলে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে গেল। কিন্তু টুবলুর ইচ্ছে করছে না খেতে। মন্টাইটা খাবে না, তাহলে ওই বা একা একা কী করে খায়? “ধুস!বলে মেঝেতেই শুয়ে পড়ল থালাটা একপাশে সরিয়ে। মোজাটা তখনও ওর হাতে ধরা। তারপর খিদেয় কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ল আস্তে আস্তে।

গভীর ঘুমের মধ্যে মনে হল, কে যেন টুবলুর পেটের কাছে ঠেস দিয়ে বসল। বেশ গরম গরম গা। আরাম হচ্ছে টুবলুর। আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে একটা ছোট্ট বাদামি রঙের ভাল্লুকের বাচ্ছা! সেও ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে পুটপুট করে। টুবলু তো আমার খুব সাহসী ছেলে। পেটের কাছে অমনি উলুরঝুলুর লোমওয়ালা বাদামি রঙের ভাল্লুকছানা দেখেও ভয় পেল না সে। আস্তে আস্তে উঠে বসে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে? এখানে এলে কেমন করে? তুমি কি আমাকে কামড়ে দেবে?”
ভাল্লুক বাচ্ছা বলল, “না না। আমি তোমাকে কামড়াব না। আমি তো তোমার বন্ধু টিপাই। ঐ সবুজ মোজার মধ্যে থাকি। কিন্তু টুবলু, আমার যে ভীষণ খিদে পেয়েছে। আমাকে কিছু খেতে না দিলে আমার কান্না পেয়ে যাবে আর আমি চিৎকার করে কেঁদে ফেলব তখন।”
“এই কেঁদো না গো। এখান থেকে কোনো শব্দ বাইরে গেলে মেট্রনমাসি আবার একদিন আটক ঘর করে দেবে। তুমি বরং ঐ যে রুটি তরকারি আছে থালায়, ওটা খেয়ে নাও
“রুটি, তরকারি! আরিব্বাস। বেশ বেশ তাহলে খাই আমি? কিন্তু খাবারের এই থালাটা এখানে এল কী করে?”
“ওটা আমার রাতের খাবার, কিন্তু পাশের ঘরের মন্টাই কিচ্ছু খেতে পাবে না আর আমি খাব! এটা ভাবতেই কান্না পেল তাই আমিও না খেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম
“ও! এই কথা! দাঁড়াও আমি ম্যাজিক করে মন্টাইয়ের জন্যও খাবার আনিয়ে দিচ্ছি। ও খেলে তুমিও খাবে তো?”
“হ্যাঁ, খাব তো। আমারও যে ভীষণ খিদে পেয়েছে
এইসব বলার মাঝেই টুবলু শুনতে পেল মন্টাই আনন্দে হেসে উঠল। ও ঘর থেকে থালা আর জলের গ্লাসের শব্দ শোনা গেল। ‘তার মানে মন্টাইও খাবার পেয়েছে’ - বুঝতে পেরে টুবলু নিজের থালা থেকে একটা রুটি নিজে নিল, অন্যটা ভাল্লুকছানা টিপাইকে দিয়ে ধীরে ধীরে চিবিয়ে চিবিয়ে খেতে খেতে আবার ঘুমিয়ে পড়ল সেখানেই।

পরের দিন ভোরে আটক ঘরের দরজা খুলে টুবলু আর মন্টাইকে বার করে ঘরে নিয়ে গেল মেট্রনমাসি। কী হাসিখুশি মুখ মাসির। টুবলু মুঠো করে ধরে রেখেছে ওর সবুজ মোজা আর মন্টাই ওর গলা জড়িয়ে খুব শান্তভাবে ওর পাশে পাশে যাচ্ছিল, ওরা এখন পরস্পরের বেস্ট ফ্রেন্ড
----------
ছবি - শ্রীময়ী
ম্যাজিক ল্যাম্প 

No comments:

Post a Comment