গল্প:: জাত ব্যাবসা - অরিন্দম ঘোষ


জাত ব্যাবসা
অরিন্দম ঘোষ

হরেন সামন্তর বাড়িতে আজ সকাল থেকেই সাজ সাজ ব্যাপার খুব ধুমধাম করে চুপিচুপি একটা অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে হরেন ধুমধাম করে করা অনুষ্ঠান কী করে চুপিচুপি করা সম্ভব সেটা সবার কাছেই বোধগম্য ওয়া কঠিন বুঝতে পারছি সত্যি কথা বলতে কি, এই গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানটাকে গোপন রাখা নিয়ে হরেন সামন্ত আর তার পরিবারের চিন্তাও নেহাত কম ছিল না
তিন মেয়ের পর একটা ছেলে যেদিন জন্মেছিল, তখন হরেন যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল জাত ব্যাবসা লাটে ওঠার উপক্রম হত তা না হলে মেয়েদের হাতে তো আর ব্যাবসা তুলে দেওয়া যায় না তাছাড়া হল বংশগত ব্যাবসা হরেনের দাদুর বাবা ছিলেন ঠগির দলের নেতা তাঁর কথা হরেন বিশেষ কিছু জানে না, দাদুর কাছে ছোটোবেলায় শোনা গল্পের আবছা আবছা কিছু স্মৃতিই খালি সম্বল তবে দাদুর কথা তার মোটামুটি ভালোই মনে আছে দাদু ছিলেন এই অঞ্চলের নামকরা ডাকাত জেলার এই দিকটা তখনও ঘন জঙ্গলে ভরা ছিল সেই আমলে বীরেন ডাকাতের নামে ইংরেজরাও ভয়ে কাঁপত তাদের দু-নলা বন্দুকের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য বীরেন আর তার দলবলের তীর, ধনুক আর বর্শাই যথেষ্ট ছিল শেষ পর্যন্ত অবশ্য বন্দুকের গুলিতেই আহত হয়ে বীরেন ডাকাত ধরা পড়েন তারপর জেলে থাকা অবস্থাতেই তাঁর অকালে পরলোকগমন দাদুর দলে থেকেই হরেনের বাবার ডাকাতিতে হাতেখড়ি ভোর রাতে ঘুম ভেঙে বাথরুম করতে উঠে সে বাবাকে রণপা চড়ে দৌড়ানো প্র্যাকটিস করতে দেখেছে, সেটা তার এখনও ভালোমতো স্মরণে আছে কিন্তু দাদু ধরা পড়ার পর বাবা একটু কেমন যেন মিইয়ে যায় ডাকাতির দল, বর্শা-বল্লম ছেড়ে সিঁধ কাঠি হাতে তুলে নেয় তাছাড়া ততদিনে জঙ্গল ক্রমশ ফাঁকা হতে শুরু করে দিয়েছে তবে প্রতিভা একটা আলাদা জিনিস, তাকে চেপে রাখা বড়ো কঠিন ফলে সিঁধেল চোর হিসেবে নরেন সামন্ত ক্রমে ক্রমে নাম কামানো শুরু করে দিল সবাই বলত নরেনের মতো হাত খুব কম জনের আছে মাটি তো মাটি, পাথরের দেয়াল নাকি তার বাবা এমন নিঃশব্দে কেটে ফেলতে পারত যেন জন্মদিনের কেক কাটা হচ্ছে
হেন বংশের রক্ত হরেনের ধমনিতে ইছে সেটা নিয়ে এক দিকে যেমন তার গর্বের শেষ নেই, তেমন সারা জীবন একটা চাপ নিয়ে তাকে দিন কাটাতে হয়েছে কোথাও সিঁধ কাটতে গেলে চাপ থাকত, ধরা না পড়ে যায় বাপ ঠাকুরদার নাম শেষ পর্যন্ত না মাটিতে মিশিয়ে দেয় চাপ কি নেহাত কম চাপ? এই চাপ নিয়েই হরেন ব্যাবসা করে খাচ্ছিল বহুকাল কিন্তু বছর তিনেক আগে পাশের গ্ৰামে নিশিকান্ত স্যাঁকরার বাড়িতে ঘটে গেল এক অঘটন সিঁধ কেটে ঢুকে, সবাইকে ঘুম পাড়িয়ে, সিন্দুক ভেঙে কিছু গয়না আর বাসন-কোসন হাতিয়ে নিয়েছিল সে, সেগুলো নিয়ে পালিয়ে এলেই বিপদটা ঘটত না কিন্তু যে বলে নিয়তির টান কানাঘুষায় শোনা ছিল যে নিশিকান্তর চিলেকোঠার ঘরে সিন্দুকে নাকি সোনা-রুপোর মোহর ভরা আছে সেটার লোভে চিলেকোঠার তালা ভাঙা অবধি কাজটা এগিয়েছিল তারপর ঘরের ভেতরে পা রাখতেই হঠাৎ ফোঁস্ আওয়াজ সাপের ভয় হরেনের চিরকালের, তাই এক দৌড়ে পালাতে গিয়ে হল বিপত্তি পুরোনো বাড়ির ছাদের রেলিং ভেঙে দোতলা থেকে হরেন পড়ল কুয়োতলায় বস্তা শুদ্ধু চুরির মাল ঝুপ করে কুয়োর মধ্যে পড়ল, আর বেচারা হরেন পা ভেঙে বসল সেদিন ওখান থেকে ওই অবস্থায় সে যে কীভাবে পালিয়ে এসেছিল, তা সে খালি নিজেই জানে সেই তার শেষ কাজ গ্ৰামের হাতুড়ে হাড়ভাঙা বদ্যি পা টেনেটুনে কী যে চিকিৎসা করল কে জানে, শেষটায় হরেনের নামটাই বদলে ল্যাংড়া হরেন হয়ে গেল
সেই থেকে নিরুপায় হয়ে বাড়িতে বসে আছে হরেন তবে ওই যে, কথায় বলে, চোর চুরি না করলেও তার বদনাম আশে পাশে কোনো তল্লাটে কোথাও চুরি ছিনতাই হলে এখনও তার ডাক পড়ে থানায়, ল্যাংড়া পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গিয়ে নিজের নির্দোষিতার প্রমাণ দিতে হয় গত মাসেই গ্ৰামীণ ব্যাঙ্কের দেয়াল কেটে বড়োসড়ো চুরি হয় রাতের বেলায় গ্ৰামশুদ্ধু লোক সেদিন ভাদুমেলার শেষ দিনের জলসায় মেতেছিল কলকাতা থেকেও নামকরা গাইয়ে বাজিয়ে এসেছিল সেই সুযোগে চোরেরা নাকি টাকা ভর্তি ট্রাঙ্ক নিয়ে উধাও হয়ে গেছে তার তদন্ত করতেও পুলিশ এসেছিল, হরেনের বাড়ির তল্লাশি পর্যন্ত নিয়ে গেছে হরেন পুলিশকে বোঝাতেই পারে না যে ইচ্ছে থাকলেও এখন আর তার কাজে যাওয়ার উপায় নেই ভূতো দারোগার তাতেও সন্দেহ যায় না, বলে, “তোর ছেলেও তো এখন বড়ো হয়ে গেছে রে! সেও তো এই বংশের ছেলে” “ছেলে তো এখনও ইস্কুলে পড়ছে দারোগাবাবু,ল্যাংড়া হরেনের যুক্তিকে যেন ল্যাংড়া অজুহাত হিসেবে নিয়ে ভূতো দারোগা বাঁকা হাসি হেসে চলে গেছে ঠিক, কিন্তু বিশ্বাস করেছে বলে তো মনে হয় না

কিন্তু ইস্কুলের গন্ডি না পেরোলে কী হল, ফরেনের বয়স ষোলো পেরিয়ে গেছে গত বৈশাখে ছেলের নাম ফরেন রাখা নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেছিল জ্যোতিষীর কথা শুনেদিয়ে রাখতে গেলেও অজস্র নাম ছিল হাতের কাছে, কিন্তু হরেন নিজের যুক্তিতে অনড় ছিল, “যদি বিদেশ নাম হতে পারে, তাহলে ফরেন নয় কেন?” যাই হোক, ফরেনকে এবার হাতে সিঁধ কাঠি দেবার সময় হয়ে গেছে আজ কোজাগরি পূর্ণিমাতে সেই অনুষ্ঠানের আয়োজন হচ্ছে চুপচাপ
আজকের দিনটা তস্করকুলের কাছে একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন দোকানদারের যেমন হালখাতা হয় পয়লা বৈশাখে, ইস্কুলে যেমন সরস্বতী পুজো বসন্ত পঞ্চমী তিথিতে, হরেনদের গোষ্ঠীতে তেমন কোজাগরি হরেনের ঠাকুমা বলতেন, “কোজাগরি মানে আসলে হচ্ছে ‘কে জাগো রে?এক কালে ঘটা করে লক্ষ্মী পুজো করে আলো জ্বালিয়ে জেগে থাকত সারা গ্ৰাম রাতে নিঃশব্দে কার ঘরে সেঁধিয়ে সামান্য কিছু একটা টোকেন হিসেবে তুলে আনতে পারলেই খাতা খুলত, তারপর সারা বছর ভালো যাবে, এটাই ছিল বিশ্বাস
ফরেনকে সারাদিন উপোস করে থেকে সন্ধেয় নতুন কাপড় পরে পুজোয় বসতে হল যাবতীয় সামগ্ৰীর সঙ্গে সাজিয়ে রাখা হল তাদের পারিবারিক সিঁধ কাঠি ফরেন আজকালকার ছেলে, জানা নেই কতদিন এটা ব্যবহার করবে, কিন্তু আজ পুজোর দিনে তো এটা নিয়ে বেরোতেই হবে নিয়ম বলে কথা এই পুজোয় বাইরের পুরোহিত লাগে না, জানাজানি হয়ে যাবার ভয়েই মনে হয় এমনটা নিয়ম পুজো শেষ করে উপবাস ভেঙে বাবার কাছে এক প্রস্থ উপদেশ, সতর্কবাণী আর মোটিভেশনাল কথাবার্তা শুনতে হল ফরেনকে সিঁধেল চুরির ক্ষেত্রে দিকজ্ঞানটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ফরেন আশ্বাস দিল, তার হাতে আছে আধুনিক অস্ত্র মোবাইল ফোনে দিকনির্ণয় অ্যাপ ঠিক চিনিয়ে দেবে, ভুল হবার কোনো উপায় নেই
রাত দুটো নাগাদ কুলদেবতা এবং বাপ-মাকে প্রণাম করে ফরেন বেরোল তার প্রথম অভিযানে আশীর্বাদ করে মা বলল, “বেশি রিস্ক নিস না বাবা, প্রথম কাজ, সাবধানে করিসদিদিরা বুড়ো আঙুল তুলে বলল, “অল দা বেস্ট”, এবং কাঁচকলা দেখাবার জন্য মা কাছে বকুনিও খেল দায়িত্বশীল পিতা হরেন শেষ মুহূর্তে মোবাইলটা সাইলেন্ট করার পরামর্শ দিতে ভুলল না তারপর বিনিদ্র রাতকর্তা গিন্নি কুলদেবতার সামনে হাত জোড় করে প্রার্থনা শুরু করল একটা একটা করে ঘন্টা পার হয়, আর সবার বুক ঢিপঢিপানি বাড়তে থাকে, পাল্লা দিয়ে জোরদার হতে থাকে প্রার্থনার স্বর

ফরেন ফিরল তখন প্রায় সাড়ে চারটে, ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই সারা গায়ে তার মাটি মাখা, নিয়ে এসেছে একটা পিতলের ধুপদানি আর সামান্য কিছু টাকা সে যাক গে, কিছু একটা প্রতীকী আনলেই চলে আবার এক প্রস্থ প্রণাম আর আশীর্বাদের পালা ধুপদানিটায় ধুপ লাগিয়ে কুলদেবতার সামনে নিবেদন করা হল, প্রথম শিকার হল যে বাড়ি, সেখানের মাটি মাখা সিঁধ কাঠিও দেবতার চরণে ঠাঁই পেল
দিদিরা বলতে শুরু করল, “ফরু, এবার কী হল সেই গল্প বল
মা বলল, “এখন ওকে একটু ঘুমোতে দে বাপু তোরা, কাল শুনিস সারাদিন খুব ধকল গেছে ছেলেটার
হরেন জিজ্ঞেস করল, “কোন দিকে গিয়েছিলি?”
ফরেন বলতে শুরু করল, “পশ্চিমপাড়ার খেলার মাঠের ধার থেকে কাটতে শুরু করেছিলাম কিন্তু প্রবলেম হল মোবাইলটা নিয়ে, মাটির নিচে কাজ করল না ঠিকঠাক সবকেমন গুলিয়ে গেল
তারপর?” সমস্বরে প্রশ্ন
কাটতে কাটতে যে বাড়িতে গিয়ে উঠলাম সেটা কার বলো তো?”
কার? কার?” কৌতূহলী প্রশ্নের ঝাঁক একসঙ্গে ধেয়ে এল
এই দ্যাখো,” বলে ফরেন তার মোবাইল মেলে ধরল নাইট ল্যাম্পের হালকা আলোকে ছাপিয়ে কোজাগরি চাঁদের আলো জানলা দিয়ে খাটের ওপর এসে পড়ছিল হরেনের চিনতে অসুবিধা হল নাঝাঁকড়া গোঁফওয়ালা টাকমাথা ঘুমন্ত মানুষটি আর কেউ নন, স্বয়ং ভূতনাথ রক্ষিত, ওরফে ভূতো দারোগা নাসিকা গর্জন এবং তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভুঁড়ির ওঠানামার যুগলবন্দির ভিডিও ফরেনের মোবাইলে বন্দি হয়ে রয়েছে সকলের বিস্ফারিত চোখ তখন কপাল থেকে নামেনি, দ্বিতীয় বোমাটা ফাটাল ফরেন পরের ভিডিওটায় ফোকাস করা হয়েছে খাটের নিচেটর্চের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে একটা বিরাট লোহার ট্রাঙ্ক, গায়ে লেখা রয়েছে গ্ৰামীণ ব্যাঙ্কের নামনস্করপুর শাখা
তো ব্যাঙ্কের চুরি যাওয়া টাকা ভর্তি ট্রাঙ্ক! এত কিছু ফেলে শুধু পেতলের ধুপদানিটা শেষ পর্যন্ত নিয়ে এলি বাপ আমার?”
আমাদের ইস্কুলের কম্পিউটারের মাস্টার বলে আজকের দিনে টাকার চেয়ে মূল্যবান হল তথ্য ভূতো দারোগাই যে ব্যাঙ্ক চুরির মূলে, এই তথ্য তোমার কাছে ছিল বাবা?”
হরেনের হাঁ বন্ধ হয় না, সেআনমনে দু’পাশে মাথা নাড়ে ফরেন বলে, “বাবা, আমি তোমাদের মতো চোর ডাকাত হব না, এতে রিস্ক বড্ড বেশি আমি আজ থেকে ভালো করে পড়াশোনা করব, তুমি দেখো ভূতো দারোগার মতো পুলিশ আমায় হতেই হবে
হতভম্ব হরেনের হাত দুটো হঠাৎ আপনিই উঠে গেল আশীর্বাদের ভঙ্গিতে
----------
ছবি – অতনু দেব
ম্যাজিক ল্যাম্প 

No comments:

Post a Comment