গল্প:: ফাঁড়া কাটল নন্দ পাটারির - মৃত্যুঞ্জয় দেবনাথ


ফাঁড়া কাটল নন্দ পাটারির
মৃত্যুঞ্জয় দেবনাথ

অবশেষে বদলির অর্ডার এল ভয়ংকর দারোগার
খবরটি ভুয়ো যদিও কিন্তু চাউর হল নিমেষে আসলে বদলি হচ্ছেন মেজোদারোগাবাবু পরশকান্তি বটব্যাল ওরফে ঢ্যাঁড়শকান্তি পাকা বেল ওটা আশপাশ অঞ্চলের ডেঁপো লোকেদের দেওয়া নাম টকটকে পাকা বেলটির মতোই গায়ের রং-টি কিনা তার অথচ একেবারেই কাজের নয় মানুষটি সাড়ে তিনমন ভুঁড়িটি নিয়ে ঝিমোতে-ঘুমোতেই ব্যস্ত থাকতেন সর্বদা তাই ওই নাম
ওদিকে ভুয়ো খবর শুনে অল্পজলের চিংড়ির মতো লাফাল নন্দ চোখ বুজে মা বিপত্তারিনীর নাম করে কপালে আঙুল ঠুকল এগারোবার মনে-মনে বলল, যাক, বিদায় অইল তবে আপদকান খুপ জ্বালাইল -দিন দয়ামায়ার চিহ্ন বলতি নাই শরীলে দৈত্যটির তাই একদিন রাগে ক্ষোভে আসল নামটি উপড়েভয়ংকর দারকানাম দিনু!
এলাকাবাসী যদিও তাকে ভালো নামেই চেনে শুভংকর দারোগা ন্যায় বিচার পায় কিনা কিন্তু বাদ সাধল নন্দর সাধের ব্যাবসাপত্তরের থানায় অমন ধর্মপুত্তুর যুধিষ্ঠিরের আবির্ভাব ঘটে যদি তবে ওর কারবারটি টিকিয়ে রাখে কেমন করে? বেজায় ঠোক্কর খেল তাই ভয়ংকর দারোগা পূর্বস্থলী থানায় এসে উঠতে প্রথম সাক্ষাতেই যমরাজটি খপাৎ করে ধরে শূন্যে আছাড় মারছিল ওকে তাতেই হাড়ে-হাড়ে বুঝেছিল নন্দ, -বস্তু ককনও শুবংকর হতি পারেনে, যে আগাপাশতলা ভয়ংকর!
অথচ দোষের মধ্যে, নন্দ সেদিন কমলাবতীর হাতে গড়া সুস্বাদু নারকোল-নাড়ুর লোভ দেখিয়েছিল মানুষটিকে মা! অমনি কিনা -
সে যাক গে শেষমেশ নন্দর সঙ্গে বড়োবাবুর সম্পর্কটা দাঁড়াল গিয়ে যাকে বলে, আদায় কাঁচকলায় অথবা সাপে নেউলে হলই বা নন্দ ছোটোখাটো চোর, তবু মানসম্মান বলেও কথা আছে একটি অথচ তার ধারকাছ দিয়েই গেলেন না সেদিন ভয়ংকর দারোগা নন্দরও তাই রাগ হল খুব মনে অথবা অভিমান, ক্রোধ একদিন ভয়ংকর দারোগাকে দেখে নেবে - এই পণ করে বসল
শুনে যদিও ফিক করে হাসে বউ কমলাবতী ফোড়ন কেটে বলে, হুঁহ! বামুনের আবার চাঁদের উপর আক্কোশ! পিতিশোদ! বুদ্দিসুদ্দি আর হবেনি দেকচি কনদিনও তমার
কেনে? বলে ঘাড় কাত করে তাকায় নন্দ এতে বুদ্দি-অবুদ্দির কী অইল শুনি? হলুম বা বামুন, ভয়ংকর দারকার চাইতে ছোটো ? ছোটো বলি রাগ-অবিমান থাকতি নাই বুজি?
তা বলে থানার দারকার উপর রাগ? পিতিজ্ঞে? নোকে শুনলি হাসপেনি? আমারও হাসি পেল তাই এক ডান্ডার বাড়ি খেলি -
চোখ বড়ো-বড়ো করে গোখরোর মতো ফুঁসল নন্দ তেড়েফুড়ে বলল, চুপ! একদম চুপ! ঘরের শত্তুর বিবিষন! মুকে খালি অলুক্কুনে কতা অমন ডান্ডার বাড়ি ঢের খেইচি জেবনে রে পোড়ারমুকি অত ভয় করিনে ওসপে ভয় করিনে কাউরে ভয়ংকর দারকারেও না আমিও নন্দ পাটারি তেনার ভয়ে গর্তে নুকিয়ে থাকপনে - কয়ে রাকলাম

সেদিন প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলেন শুভংকর দারোগা অমনি নন্দর সঙ্গে মাঝরাস্তায় মুখোমুখি সামনে পড়তে বড়োবাবুর থেকে নন্দর দৃষ্টি আর সরে না কেবলই কাঁচুমাচু করে তাকায় তাই দেখে দারোগাবাবুর সন্দেহ দানা বাঁধল ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় যেন দেখেছি হে?
অমনি সরু গোঁফের ফাঁক গলে এককণা হাসি ঝরল নন্দর বলল, যাচ্চলে! এরই মদ্যি ভুলি গেলেন? আমি নন্দ সেই যে, নারকেল-নাড়ু - তাপ্পর আমারে ধরি শূন্যে তুলি - অরে বাবা রে!
শুনে গুরুগম্ভীর চাহনি মেলে তাকালেন ভয়ংকর দারোগা ঘাড় নেড়ে বললেন, হ্যাঁ-হ্যাঁ, বেশ মনে পড়েছে কিন্তু খবরদার বাপ, চুরি-চামারির নামটি কোরো না যেন আর অন্তত এই তল্লাটে যদ্দিন আছি আর তোমার ওই সনাতন দারোগার কথা ভুলে যাও
অভিমান হল নন্দর অমনি বিড়বিড় করল, ধুৎ! আপনে বড়ো নেষ্টুর
কী বললে?
না, কিচু না নন্দ মা কালীর মতো জিভ কাটে
গাম্ভীর্য ত্যাগ করে এবারে পরিষ্কার করে হাসলেন দারোগাবাবু বত্রিশপাটি বার করে বললেন, শোনো বাছা, ওইসব থাকলে আমাদের চলবে কেন? তবে যে দেশের বদনাম পুলিসজাতির বদনাম অত মায়াদয়া শরীরে নিয়ে ঘুরলে, তোমাদের মতো চোরছ্যাঁচ্চড়দের শায়েস্তা করব কেমন করে?
কথা ক'টি শেলের মতো বিঁধল নন্দর তবু উচ্চবাচ্য করার নাম করল না উলটে হাত কচলাতে-কচলাতে বড়োবাবুকে উদ্দেশ্য করে বলল, একটা কতা ছেল ছার, যতি অভয় দেন
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন ভয়ংকর দারোগা কী কথা?
এঁজ্ঞে, আপনের ভয়ে সপ ব্যাবসাপত্তর লাটে মানে অইল, বাপঠাকুদ্দার কাচ থিকে জম্মসূত্তে যা পেয়েচিনু কিনা একটি সিঁদকাটি আর অন্যের ঘর সাফ করার চালাকি বুদ্দি এদ্দিন ঘরে বসি দু-পায় খিল ধইরল সাধের সিঁদকাটিতেও জং তবে কী হাওয়া খাই বাঁচি? রোজগারপাতি বলতি নাই উপোস করি বা কদ্দিন চলে? মন চায় করবির দানা খাই অক্কা যাই
নন্দর দিকে তাকিয়ে থমকালেন বড়োদারোগাবাবু আহা, মরবে কেন?
তবে এককান কামের ব্যবস্তা যে আপনেরেই করি দিতি অয় আপনের লাগি এদ্দিনকার বাপঠাকুদ্দার ব্যাবসায় তালা যতি বলে কাঁচুমাচু মুখ করে তাকায় নন্দ
শুনে মন কেমন করে ওঠে বড়োবাবুর বলেন, যা কাজ দেব, পারবে?
নন্দ মুচকি হাসে বড়ো করে মাথা নাড়ে পারব বই-কি
বেশ, কাল একবার দেখা করো
ধড়ে প্রাণ এল নন্দর আপনমনে কইমাছের মতো লাফাল -বার কপালে আঙুল ঠুকে ঈশ্বরের উদ্দেশে বলল, পোভু, সপ তমার নীলা

ঘুম থেকে উঠে উঠোনের বাগান পরিদর্শনে বেরোন ভয়ংকর দারোগা আর দু’ঠোঁটে জ্যোৎস্নার হাসি ঝুলিয়ে বলেন, আহা, চমৎকার করেছিস বাগানখানা নন্দ ভাবিনি, এমন পরিপাটি কাজ তোর দ্বারা সম্ভব
নন্দ মুচকি হাসে বলে, সে আপনের কিপা
ভাবছি রজনীগন্ধার পৃথক বাগান করব একটি কেমন হয় রে নন্দ?
বেশ হয় ছার -টি চারা যে চাই তবে?
সব ব্যবস্থা করছি বলে পিঠ চাপড়ে দেন নন্দর
নন্দর কান্না পেয়ে যাচ্ছিল অমনি পাওয়ারই কথা ডান্ডার বাড়ির বদলে জীবনে এই প্রথম পুলিসের আদর খেল কিনা সে যাক গে সেইদিনই প্রথম নন্দর দেওয়া নারকোল-নাড়ু খেলেন ভয়ংকর দারোগা কথাটা দারোগাবাবু নিজেই তুললেন নন্দর ফুলগাছে জল দেওয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী রে নন্দ, গাঁ-ঘরে এত্ত লক্ষ্মীপুজো গেল তোর ঘরেও হল কই, সেই নারকোল-নাড়ু খাওয়ালি না তো?
শুনে আহ্লাদে আটখানা হয়ে তাকাল নন্দ সত্যি ছার? খেতি চান আমার কমলাবতীর আতের নাড়ু? তবে যে কালই আনতি অয়
এনেওছিল নন্দ এক থলে নারকোল-নাড়ু আয়েশ করে খেতেও দিল দারোগাবাবুকে একটি-দুটি-তিনটি-চারটি - আটটিতে গিয়ে থামলেন বড়োবাবু তারপরই ঘটল বিপত্তি নাড়ু চিবিয়ে উদরস্ত করতে-না-করতে অদ্ভুত ঝিমুনি এল প্রথমে তারপর দু’চোখ বুজে বিছানায় কেতরে পড়লেন
ঘণ্টাখানেক বাদে চোখ মেলে অগ্নিমূর্তি ধারণ করলেন ভয়ংকর দারোগা
বেচারা নন্দর তথৈবচ অবস্থা ততক্ষণে যাকে বলে, চোখের জলে-নাকের জলে দশা দুই হাঁটুতে কম্পন বড়োবাবুর চরণতলে নিজেকে সঁপে দিয়ে বলল, খেমা করি দেন ছার আর হবেনি জেবনে মা-কালীর দিব্যি
বড়োবাবু গম্ভীর হয়ে তাকালেন নাড়ুতে কী মেশানো ছিল? সত্যি করে বল? ঘুমের বড়ি?
এঁজ্ঞে মুখচুন করে ছেঁড়া কলাপাতার মতো মাথা দোলায় নন্দ
কেন?
ভুল করি, ছার অনেকদিনের অব্যেস কিনা
এর কী শাস্তি, জানিস?
নন্দ আরও কম্পমান এঁজ্ঞে না
ভয়ংকর দারোগা ঝিমোতে-ঝিমোতে বিড়বিড় করলেন, কান ধরে উঠবোস মাঝ উঠোনে ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমার ঘুমের ঘোর কাটছে!
শাস্তির বয়ান শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল নন্দ
ফাঁসি হতে-হতে রক্ষা পেল যেন মা-বিপত্তারিনির নাম স্মরণ করে তিনবার কপাল ঠুকে বড়োবাবুর দিকে তাকাল নন্দ ভয়ংকর দারোগা তখনও ঝিমোচ্ছেন ঢুলুঢুলু নয়নে তাকাচ্ছেন তারই মধ্যে জড়ানো স্বরে বললেন, ইয়েস স্টার্ট -
প্যাঁচামুখ করে উঠবোস করায় মনোযোগী হল নন্দ এক, দুই, চার, আট, বারো -
মনে-মনে যদিও প্রবল অট্টহাসে বলে, হুঁ! কেমন নাগতিচে তবে ভয়ংকর দারকা! আমি অইল গিয়া নন্দ পাটারি পিতিজ্ঞে করিচিনু তমারে ঘোল খাওয়াম; ঠিক খাওয়ানু কিনা!
----------
ছবি – নচিকেতা মাহাত
ম্যাজিক ল্যাম্প 

No comments:

Post a Comment