ভূত না অন্য কিছু
সহেলী চট্টোপাধ্যায়
অনেকদিন পর ছোটোকাকু
এসেছে। দীর্ঘদিন লক ডাউন, করোনা সমস্যার জন্য আমরা কেউ বাইরে
বেরুতেই পারছি না। অনলাইনে ক্লাস করছি। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে না। এত সমস্যা,
এত মন খারাপ জীবনে কখনও দেখিনি। ছোটোকাকু হোটেল ম্যানেজমেন্ট পাস করে বরাবর দেশের বাইরেই
চাকরি করেছে। বছরে দু-একবার আসে। পুজোর সময় আসার চেষ্টা
করে। মিস হলে বইমেলার সময়। ছোটোকাকু এলে বাড়িতে যেন উৎসব লেগে যায়। মা
ভালো ভালো রান্না করে। ঠাম্মিরও মন ভালো থাকে। বাবা ঘুরতে
যাওয়ার প্ল্যান করে। পিসি পিয়ুকে নিয়ে চলে আসে। কাকু এক এক দিন
রান্নাঘরে ঢুকে নতুন রেসিপি বানিয়ে খাওয়ায়। রাতে খাওয়ার পর আমরা গোল হয়ে বসি
কাকুকে ঘিরে। দেশ বিদেশের গল্প শুনি। এইবার কাকু ফিরল যখন মুখে হাসি নেই। সামান্য
এক ভাইরাস আমাদের সব আনন্দ কেড়ে নিয়েছে। কাকু পনেরো দিন নিজের ঘরেই ছিল। আমাদের সঙ্গে
দেখা করেনি। মা রান্না করা খাবার দরজার বাইরে রেখে আসত। কাকু নিজের থালা বাসন মেজে
রাখত। জামাকাপড় কেচে রাখত। কাকু এই সময় বই পড়েই কাটাত বা টিভি দেখত। এই
কোয়ারেন্টাইন পিরিয়ড কেটে যাওয়ার পর ধড়ে প্রাণ এল। বাড়িটা যেন আবার আগের মতো হয়ে গেছে। কাকু
মায়ের অনেক কাজ সামলে দিচ্ছে। তা না
হলে মায়ের বড়ো কষ্ট হত। লোক তো আসছে না। একদিন রাতে
খাওয়াদাওয়ার পর বসেছি সবাই মিলে। পিসি পিয়ুকে নিয়ে আসতে পারেনি। ভিডিও কল চলছে।
বাইরে বৃষ্টি পড়ছে
ঝমঝম। মা বলল, “কুশের মুখে অনেক দিন ভূতের গল্প শুনিনি।” বাবা বলল, “হ্যাঁ, একটা ভূতের গল্প হোক।” ওয়ার্ক ফ্রম হোমের ফাঁকে ফাঁকে বাবাও এসে আসরে যোগ দিচ্ছে। ঠাম্মি বলল, “দুর, তোদের যে কী পছন্দ। সব
সময় ঠাকুরের স্মরণ নিতে হয়।”
কাকু বলল, “মেজরিটি যা বলবে তাই
হবে।” আমার দিকে ফিরে বলল, “বান্টি তুই কী শুনতে
চাস?”
আমি হাত তুলে বললাম, “ভূতের। তবে ঠাম্মির
বলা ঠাকুরের গল্পগুলোও খুব সুন্দর। কিন্তু এই সময় ভূতের গল্প শুনতেই
ইচ্ছে করছে।”
“তবে শোন। একটা ভূতুড়ে গল্প। আমি তখন মুম্বাই-এর একটা হোটেলে আছি।
তখন বয়সও অনেক কম। সবে জয়েন করেছি ধর। সেই সময় পটবর্ধন স্যারের সঙ্গে পরিচয় হয়।
স্যার এই হোটেলে আসতেন মাঝে মাঝে। ওনার একটা ট্রাভেল এজেন্সি ছিল। অনেক কর্মচারী
ছিল। বয়স চল্লিশ বিয়াল্লিশ হবে। ফিটফাট থাকতেন। বেশ পয়সাওলা ছিল। আমার সঙ্গে ভালোই বন্ধুত্ব হয়ে গেল।
উনি ঠিক করলেন একটা নতুন ব্যাবসায় হাত দেবেন। উনি ঘোস্ট ট্রাভেলিং শুরু করলেন।
আমার একটা নতুন কাজ হল যে সব ট্রাভেলার ঘোস্ট ট্রাভেলিং করতে চায় তাদের সঙ্গে
থাকা। ঘোস্ট ট্রাভেলিং মানে তোমরা জানো নিশ্চয়।”
“হ্যাঁ, অনেক ট্রাভেলার-এর শখ থাকে ভূত দেখার।
তাই পুরানো বাড়ি বা হাভেলিকে হন্টেড হাউস বা ভূতুড়ে বাড়ি সাজানো হয়।
নানা রকম আষাড়ে গল্প তৈরি করা হয়। ভয় দেখানোর
অনেক রকম ব্যবস্থাও থাকে।”
“বাহ, বউদি, একদম ঠিক বলেছ!” কাকুর গলায়
বিস্ময়!
“তারিণীখুড়োর গল্পেই তো
আছে। আমরা রামোজি ফিল্ম সিটিতেও দেখেছি,” মা বলল। ঠাম্মি
পান বানিয়ে সবাইকে দিল।
কাকু পান মুখে নিয়ে
আবার শুরু করে, “হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ। বেশিরভাগটাই
ধাপ্পা থাকে। বিলেতে অনেক বেশি থাকলেও আমাদের দেশে বেশি নেই। আমাদের দেশের লোকজন
ভূত-টুত অত পছন্দ করে না। পটবর্ধন তো কাজ শুরু করে দিলেন। প্রথম
যেদিন কাজটা শুরু হল কয়েকজন পর্যটক-এর সঙ্গে আমিও ছিলাম গাইড হিসেবে।
তার আগে আমি সেই ভূতুড়ে বাড়িটা দেখে এসেছি ভালো করে। ছোটোখাটো একটা দুর্গের স্টাইলে
বাড়িটা তৈরি করা হয়েছে। পটবর্ধন স্যার বলেছিলেন এই বাড়িটা সস্তায় কিনে উনি রিপেয়ার
করিয়েছেন। কিছু ভূতুড়ে ঘটনা ঘটেছে কিনা জানেন না। ছাদের ওপর একটা কাউন্ট
ড্রাকুলা দাঁড়িয়ে আছে। দেখে বেশ ভয়ই লাগবে। ভালো করে দেখলে বোঝা যায়
এটা মূর্তি। আর একটা ঘর ভর্তি আছে নকল বাদুড়। একটা ঘরে কঙ্কাল ঝুলে রয়েছে। একটা ঘরে
একটা ভূত থাকে, তাকে কেউ দেখতে পায় না, সে কথা বলে সবাইকে
স্বাগত জানাবে। সবই যন্ত্রের কেরামতি। একটা ঘরে নকল মমি। প্রাচীন মিশর-এর জিনিসপত্র। যদিও সেগুলো মোটেই প্রাচীন নয়। দেয়ালে হায়রোগ্লিফিকে কিছু লেখা। আরেকটা ঘরে ছিল কিছু ভয়ানক দেখতে পুতুল। বাচ্চাদের ফেলে দেওয়া কিছু পুতুল জোগাড় করে এগুলো বানানো হয়েছিল। ছাদের ওপর ফুড
সেন্টার। সব রকম খাবার আছে। পটবর্ধন সব কিছুই খুব ভালো করেছেন। প্রথম দিন
গণেশপুজো করে ফিতে কাটা হল। সবাই প্রসাদ খেলাম।
“দু’দিন পর থেকে শুরু হবে
ব্যাপারটা। প্রথমদিকে পটবর্ধন স্যারের বন্ধু এবং পরিচিতরা ছিলেন। দু’জন ওনার কলেজ জীবনের
বন্ধু। মিস্টার রাও এবং মিস্টার আপ্টে। আপ্টে কলেজে পড়ান। রাও সাংবাদিক একটি
নামকরা দৈনিকের। পটবর্ধনের শ্যালক মিস্টার সিং ছিলেন। সিং-এর সঙ্গে ওর বন্ধু এবং
বিজনেস পার্টনার মিস্টার কুলকার্নি। কুলকার্নির মিসেসও ছিলেন। আর শ্রীবাস্তব
সারনেমের একটি ছেলে। আসল নাম আজ আর মনে নেই। সেও নাকি একটি বিদেশি কাগজের ফটোগ্রাফার।
আর পটবর্ধন স্যার তো ছিলেনই।
“দু’দিন পর আমরা এক
বৃষ্টিভেজা সকালে চললাম সেই হন্টেড হাউসের উদ্দেশে। সবাই হোটেলেই ছিল। পটবর্ধন-এর ছোটো একটা ট্যুরিস্ট বাসে চড়ে
সবাই মিলে যাত্রা করলাম। গান গাইতে গাইতে চলে
এলাম। আমি কথা বলতে বলতে সবাইকে ভেতরে নিয়ে এলাম। পটবর্ধন যা আমাকে বলতে শিখিয়ে দিয়েছিলেন তাই বললাম। বাইরে দাঁড়াতেই সদর
দরজা খুলে গেল। ভূত নয়, সবটাই বিজ্ঞানের কেরামতি। কিন্তু আমাকে ভূতের হয়েই বলতে
হবে। ভেতরে মৃদু আলো জ্বলছে। আমি আবার বানানো গল্প বলতে যাব, কিন্তু তার আগেই কোনো মেয়ের গলা শুনলাম। সে
আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। কিন্তু এরকম তো কথা ছিল না। পটবর্ধনের মুখ ভাবলেশহীন।
দেখে কিছু বোঝা যায় না মনের ভেতর কী চলছে। সবাই খুব এনজয় করছে। কয়েকটা বাদুড় উড়ে চলে গেল মাথার
ওপর দিয়ে। মিসেস কুলকার্নি চেঁচিয়ে উঠলেন। ম্যাডাম ভয় পাবেন না। ওগুলো নিরীহ জীব।
আমার কথা শুনে মিসেস কুলকার্নি বললেন তিনি মোটেও চিৎকার করেননি। তাহলে কে?
“পাশের ঘরে দেখি নকল
বাদুড়গুলো দিব্যি আসল হয়ে ওড়াওড়ি করছে! পটবর্ধন আমাকে কিছুই
জানাননি। তারপর একটা ব্যাপার হল, যে ঘরে কঙ্কাল ঝোলার কথা সে ঘরে
গিয়ে দেখি কঙ্কালের বদলে একটা মেয়ে ঝুলছে। চোখগুলো জ্বলছে। অন্যরা ভয় পেলেও আমি ভয়
পাচ্ছি না। কারণ এগুলো সাজানো আমি তা জানি। পটবর্ধন এত পট পরিবর্তন করেছেন অথচ
কিছুই জানালেন না। দেখলাম উনি কপালের ঘাম মুছছেন, যদিও এসি চলছে। আমি
কিছু বলতে গেলেই কেউ আমার কণ্ঠ যেন রোধ করে দিচ্ছে। একটি মেয়ে মারাঠি ভাষায় নানান গল্প বলে
চলেছে। ওই যেন গাইড। আরেকটা ঘরে সবাই মিলে খুব ঝগড়া করছে। অনেকগুলো গলার আওয়াজ।
মিসেস কুলকার্নিই প্রথম বললেন, ভালো লাগছে না। আমি বললাম, ফুড প্লাজায় যাবেন না?
“কেউই যেতে চাইছেন না।
পটবর্ধনও নয়। বাইরে বেরুবো ভাবছি, এমন সময় নজরে পড়ল শ্রীবাস্তব
নেই। কখন যেন পিছিয়ে গেছে। রাও আপ্টে আমি সবাই পেছনের ঘরগুলো দেখতে লাগলাম ভালো করে। বেশি খুঁজতে
হয়নি। শ্রীবাস্তব একটা ফাঁকা ঘরেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। বোতল থেকে জল নিয়ে ওর চোখে
মুখে ছিটোতেই উঠে বসল।
“এই ঘরেই সবাই চলে
এসেছে। শ্রীবাস্তব বলল, অদৃশ্য কেউ তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে। ক্যাঁচ করে একটা
শব্দ। পিছন ফিরে দেখি সদর দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। আমরা ছুটতে শুরু
করলাম। তারপর...”
ছোটোকাকু থামল। একটা
লম্বা শ্বাস নিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “তারপর কী হল?”
“তারপর আরেক ব্যাপার।
কোনোরকমে দরজা ঠেলে বাইরে এলাম। হাসির শব্দ হচ্ছে। কেউ আমাদের
অবস্থা দেখে খুব হাসছে। ছুটতে ছুটতে বাসে উঠে পড়লাম। জানলা দিয়ে
দেখলাম বাড়ির ছাদে ড্রাকুলার মূর্তির পাশে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। বাতাসে দুলছে তার শাড়ির আঁচল। একেই ঝুলতে
দেখেছিলাম। বাসে উঠে আরেক বিস্ময়! সবার জন্য খাবারের প্যাকেট।”
বাবা বলল, “ভূতেরাও জানে, অতিথি দেব ভবঃ।”
“তারপর কী হল!” মা জিজ্ঞাসা করল।
“তারপরের ঘটনা খুব সামান্য।
পটবর্ধন মোটেও কিছু চেঞ্জ করেননি। সব নিজে থেকে হয়েছে। তবে শ্রীবাস্তব আসার দু’দিন আগে প্লেন
ক্র্যাশে মারা গেছিল!”
বাবা বলল, “দু’দিন আগে না, দু’দিন পর বল।”
কাকু জোর দিয়ে বলল, “দু’দিন আগে। সব হিসেব
মেলে না রে।”
“তার মানে! ঢপ দেওয়ার আর জায়গা পাসনি।”
মা বলল, “ও মোটেও ঢপ দিচ্ছে না। এরকম হয় আমি জানি। আমি একটা গল্প বলি শোনো।”
ঠাম্মি বলল, “উফ! আর একটাও গল্প নয়। সব আমার ঘর থেকে বেরো। রাত্তিরে
যত বাজে গল্প। শুধু বুবুন (মানে আমি) থাকবে।”
বাবা, মা, কাকু আরও কিছু বলতে চায়। বাইরে জোর হাওয়া দিতে শুরু করেছে। দপ করে আলো নিভে গেল।
----------
ছবি - পুষ্পেন মণ্ডল
ম্যাজিক ল্যাম্প
No comments:
Post a Comment