বারান্দা
শ্যামলী আচার্য
ছোটোমামা এলে তাঁকে ওই দোতলার
বারান্দার লাগোয়া ঘরটাতেই থাকতে দেওয়া হবে। তিনি নাকি নিজে তেমন চেয়েছেন। কথাটা
আমার কানে এল। আর শোনা ইস্তক খুব মেজাজ খারাপ হয়ে আছে আমার। কিন্তু বলব কাকে? আমার
কথা কেউ শুনলে তো!
আসলে বারান্দার সঙ্গে জুড়ে
থাকা ওই পুঁচকে ঘরটা আমার খুব প্রিয়। দোতলার বারান্দাতে মাধবীলতার ঝাড় বেয়ে উঠেছে।
গরমের সন্ধ্যায় ভারি সুন্দর গন্ধ আসে। শ্বেতকরবীর একটা ডাল বারান্দাতেই ঢুকে পড়তে
চায়। বিকেলে দক্ষিণ দিক থেকে হাওয়া দিলে আশেপাশের বাড়ি পেরিয়ে ওই বারান্দাতেই
বাতাস খেলে বেড়ায়। ঘরের জানলাতেও গ্রিলের গায়ে বাড়ির পিছনের নিমগাছের ঝিরিঝিরি
পাতা দোল দিয়ে যায়। কাচের আড়াল থেকে দারুণ লাগে পাতার কাঁপন। আমি একলা দুপুরে ওই
বারান্দার রেলিঙে বসে পাখিদের গল্প শুনি।
ওই ঘরে আমার অনেক খেলনা। সেই
ছেলেবেলা থেকে আমার যত খেলনা ছিল, মাটির পুতুল, ঘাড়-নড়া বুড়োবুড়ি, কাঠের ঘোড়া,
তুলো ভরা কাপড়ের পুতুল, প্লাস্টিকের ডল, হাওয়া ফুরোনো ফুটবল... সব ওই ঘরের বড়ো
দেয়াল আলমারিতে গুছিয়ে রাখা আছে। আলমারির কাচের দরজার ফাঁক দিয়ে তারা তাকিয়ে থাকে।
শ্রীনাথদা ওদের যত্ন করে ঝেড়েমুছে রেখেছে। ঘরের এককোনায় তানপুরা দাঁড় করানো। ওটার
একটা তার অবশ্য ছিঁড়ে গেছে। অনেকদিন গানের রেওয়াজ বন্ধ। তানপুরাতেও বেশ ধুলো।
ওইটাতে শ্রীনাথদা হাত দেয় না। শ্রীনাথদা এই বাড়ির বহু পুরোনো চাকর। বুড়ো হয়েছে তো।
বোধহয় ভয় পায়। ভাবে, ভেঙে যায় যদি!
জানলার ধারে একটা ছোট্ট খাট।
আর তার পাশে একটা পড়ার টেবিল। খুব ছেলেবেলায় যে গল্পের বইগুলো নিয়ে আমি গোগ্রাসে
গিলতাম, ছবি দেখতাম, সেই বইগুলো ওই টেবিলের ওপরেই যত্ন করে রাখা আছে। আমার আঁকার
খাতা রয়েছে টেবিলে। রংপেন্সিলের বাক্স, তুলি, জলরং সব
সাজানো। একদম ঝকঝকে। ওগুলোও ঝাড়পোঁছ করে শ্রীনাথদা। আমি এখন আর ছবি আঁকার সময় পাই
না। তাই এখন আর ওগুলো কাজে লাগে না। সাজানোই রয়েছে।
আমাদের বাড়িটা বেশ বড়ো। আমার
ঠাকুর্দার সময়ে ছিল যৌথ পরিবার। জ্যাঠা, বাবা, কাকা মিলে অনেকে মিলে হই হই করে
থাকা। ধীরে ধীরে সকলেই বিভিন্ন দিকে ছড়িয়েছিটিয়ে গেছে। চাকরির জন্য, পড়াশোনার
জন্য, কেউ দেশের অন্য প্রান্তে, কেউ বিদেশে। বাড়িতে থাকার লোক কমেছে একটু একটু
করে। এখন হাতে-গোনা ক’জন মাত্র লোক এই বাড়িতে।
তার মধ্যেই ছোটোমামা আসছে
শুনে খুব রাগ হল।
আমার ছোটোমামা মানুষটি কিন্তু
দারুণ ভালো। এককালে মিলিটারিতে ছিলেন বলে একটু রাশভারী। ন’মাসে ছ’মাসে আসতেন
ছুটিছাটায়। এসেই সব আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে গিয়ে দেখা করতেন, খোঁজখবর নিতেন। অনেক
উপহার আনতেন সকলের জন্য। নিজে বিয়ে-থা করেননি, সংসারের পিছুটান নেই, কাজেই একেবারে
ঝাড়া হাত-পা। এর-তার বাড়িতে ছুটি কাটিয়ে আবার ফিরে যেতেন নিজের কর্মস্থলে।
কেন জানি না, আমাকে সামনে
পেলেই ছোটোমামা কেবল পড়া ধরতেন। আসলে জ্যাঠতুতো খুড়তুতো ভাইবোনেদের মধ্যে আমিই
পড়াশোনায় বেশ কমজোরি ছিলাম। ক্লাসে বরাবর টেনেটুনে পাশ। ছোটোমামা এসেই আমাকে মুখে
মুখে অঙ্ক করতে দিতেন। কী জটিল সব হিসেব। এক কেজি আলুর দাম তেত্রিশ টাকা পঁচিশ
পয়সা হলে সাত কেজি চারশো পঁচাত্তর গ্রাম আলুর দাম কত হবে? আচ্ছা কোনো মানুষ মুখে
মুখে এত ভয়ানক অঙ্ক কষতে পারে? চিরকাল ভূগোলে আমি কাঁচাগোল্লা পাই। সেই আমাকে যদি নাকের
সামনে বোঁ করে একটা গ্লোব ঘুরিয়ে জিব্রাল্টার কিংবা বিশকেক খুঁজে বের করতে বলে,
কান্না পায় না? ইতিহাস আমার প্রিয় সাবজেক্ট ঠিকই। কিন্তু
মধ্যযুগে কারা কবে ভারতবর্ষ আক্রমণ করতে এসেছিলেন, সেইসব সালতারিখ আমি তো পড়িইনি। আমি
ছোটোমামার ভয়ে ওই বারান্দার কোনার ঘরে গিয়ে লুকিয়ে থাকতাম। আর ছোটোমামা আমাকে ঠিক
খুঁজে বের করবেই।
“আশ্চর্য মুনিয়া, তুই কি
কিছুই জানিস না? যা জিজ্ঞেস করি, তাতেই হয় ভুল উত্তর, নয় স্পিকটি নট। তুই একটা
গণ্ডমূর্খ তৈরি হচ্ছিস। মিনিমাম পড়াশোনা করিস না!”
এইসব শুনলে কার না মনখারাপ
হয়? অত পড়া পড়া আর পরীক্ষা ভালো লাগে কারও? মনে হত ছোটোমামাকে বলি, আরও তো
দাদা-দিদি ভাইবোনেরা রয়েছে, তাদের ধরো না বাপু! আমার ওপর কেন এত অত্যাচার?
ছোটোমামা জানেই না, স্কুলের
বইয়ের পাতার মধ্যে বন্দি ওই শব্দগুলো আমার কাছে বড়ো নীরস। তার চেয়ে অনেক বেশি
প্রিয় সন্ধের আকাশে উড়ে যাওয়া বকের সারি। নির্জন দুপুরে আমি পাশের বাগানে ছাতারে
পাখির ঝগড়া শুনি, বুঝতে চেষ্টা করি কী বলছে ওরা। মন দিয়ে লক্ষ করি কাঠপিঁপড়েদের ব্যস্ত
হয়ে আসা-যাওয়া। চড়াইদের পোকা খুঁজে বেড়ানো দেখি। নারকেল গাছের পাতার ফাঁকে একফালি
চাঁদ দেখলে মনকেমন করে আমার। কাঠঠোকরা মন দিয়ে ঠুকে ঠুকে তেজপাতা গাছে গোল গর্ত
বানায় পাতার আড়ালে বসে; আমি ওকে লক্ষ করি সারাদিন ধরে। স্কুলের পড়াশোনার চেয়ে আমার
ঢের ভালো লাগে বসে বসে ছবি আঁকতে, গলা ছেড়ে গান গাইতে, ঝিলের জলে হুটোপাটি করে
সাঁতার কাটতে। ওই দোতলার বারান্দায় বসে পাখির ডাক শুনে, আকাশ দেখে আমার কত চমৎকার
দিন কেটেছে। সে সব ছোটোমামা বুঝতে চাইলে তো!
ছোটোমামা এলেই আমার সব
গণ্ডগোল হয়ে যায়।
শুধু পড়া না পারা এক জিনিস,
পড়া না পারলে কানমলা খাওয়া খুব অপমানের। শেষ যেবার এসেছিল, প্রথম পানিপথের যুদ্ধ
কোন সালে হয়েছিল বলতে পারিনি বলে কান মলে দিল। এ কী অন্যায়! আর কেউ কিচ্ছু বলল না।
আমি দোতলার বারান্দার লাল মেঝেতে একা গিয়ে শুয়ে রইলাম চুপটি করে।
এবার মনে মনে ঠিক করলাম, ছোটোমামাকে
জব্দ করতে হবে। প্রথমদিনের জন্য সব প্ল্যান রেডি করে ফেললাম। বারান্দার ঘরে একবার
থাকতে আসুক, তারপর দেখাচ্ছি মজা। রাতে বিছানায় কাঠপিঁপড়ে ছেড়ে দেব।
ছোটোমামা আমাদের বাড়িতে এল দুপুর
গড়িয়ে বিকেলে। আমি কাছাকাছি ছিলাম না। কী দরকার বাবা! দোতলা থেকেই উঁকি দিয়ে
দেখলাম ছোটোমামার চুলে পাক ধরেছে, চোখেমুখে বয়সের ছাপ। সকলের জন্য অনেক উপহার
এনেছে এবারও। আগের মতো আর হাঁকডাক নেই। বেশ চুপচাপ। শ্রীনাথদাকে ডেকে বলল, “ওই
ওপরের ঘরটাতেই আমি থাকব। আজকের রাতটুকুই। কাল সকালে রওনা হব।”
আমি শুনে নিশ্চিন্ত। যাক
বাবা, খুব বেশিদিন জ্বালাবে না। কিন্তু ওই ওপরের বারান্দার ঘরে থাকার প্ল্যানটায়
আমার খুব আপত্তি। আচ্ছা, দেখাই যাক। একটা রাত্তিরের তো ব্যাপার। মনের মধ্যে ছোটোমামাকে
জব্দ করার ইচ্ছেটা কেমন যেন থেকেই গেল।
পূর্ণিমার পরের দিনেও আকাশে
গোল থালার মতো চাঁদ এসে দাঁড়ায়। রাত বাড়লে বারান্দায় ভেসে আসে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক।
মফস্বলের এই পাড়ায় এখনও পুরোনো দিনের সব গন্ধ লেগে আছে। দূর থেকে শাঁখের ডাক শোনা
যায়। তবলার বোল প্র্যাকটিস করছে কেউ। আমার
এইসময় জোনাকি পোকার ওড়াউড়ি দেখতে ভারি ভালো লাগে। চুপ করে বসে আছি বারান্দার ঘরে।
কাচের জানালার বাইরে আলোর পোকা উড়ে বেড়ায়। হঠাৎ মনে হল, সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে কেউ।
সর্বনাশ! ছোটোমামা নয় তো? কেলেঙ্কারি কাণ্ড। এই ঘরে আমাকে একা পেলে আবার কী কী সব
প্রশ্ন করবে কে জানে! ভয়ে সিঁটিয়ে যাই আমি। মাথার মধ্যে ভগ্নাংশের অঙ্ক, সিপাহী
বিদ্রোহের ইতিহাস আর ভূমধ্যসাগরের জলবায়ু ঘুরপাক খায়। দেখলেই আবার আমায় পড়া ধরে
যদি! আমার যে কিচ্ছু মনে পড়ছে না!
পায়ের আওয়াজটা এগিয়ে আসে
ক্রমশ। ভেজানো দরজার সামনে চেনা চেহারার আভাস। হাতে টর্চ জ্বলে ওঠে।
“চারদিক অন্ধকার করে রেখেছ
কেন তোমরা? এদিকের বারান্দাতে একটা আলো জ্বেলে রাখতে পারোনি?”
ছোটোমামার গলার জোর সেই
একইরকম। বাপ রে!
বলতে বলতেই হুড়মুড় করে ভেজানো
দরজাটা জোরে ঠেলে খুলে দেন ছোটোমামা।
আর সেই সঙ্গে টর্চের আলো পড়ে
আমার মুখে। অমনি এক পরিত্রাহি চিৎকার। কিন্তু ছোটোমামা ঘরের দরজা থেকে সমানে পিছনের
বারান্দার রেলিঙের দিকে সরে যাচ্ছে যে! কী সর্বনাশ। দুর্ঘটনা ঘটবে একটা। আমি এগিয়ে
যাই ছোটোমামার দিকে। বারান্দার ওই কোণের কার্নিশটা যে খুব বিপজ্জনক! মাধবীতলার
ঝোপে আড়াল হয়ে থাকে বলে ঠিক বোঝা যায় না।
“ওদিকে যেও না, ওদিকে নয়,”
আমি বলতে বলতে এগিয়ে যেতেই ওই বারান্দার কার্নিশ ভেঙে ছোটোমামা হুড়মুড় করে পড়ে গেল
নিচে।
ঠিক আমি যেভাবে বেকায়দায় পড়ে
গিয়েছিলাম বারান্দার ওই রেলিং থেকে। ঘাড় ভেঙে গিয়েছিল আমার। দোতলার বারান্দা থেকে
চেয়ে দেখি, ছোটোমামাও একইভাবে পড়ে রয়েছে নিচে। উঁচু থেকে পড়ে গেলে মাথার পেছনে,
ঘাড়ে বড়ো জোরে ব্যথা লাগে। আমার নিজের ঘাড়ের পেছনে হাত চলে যায় অজান্তেই। ছোটোমামার
চোখদুটো আমার দিকেই তাকিয়ে, এখন একদম স্থির।
----------
ছবি – নীলাদ্রি রায়
ম্যাজিক ল্যাম্প
ভীষণ ভীষণ ভালো লাগলো। আর ও এরকম গল্প চাই।❤
ReplyDeleteখুব সুন্দর গল্প। অনেকদিন পর একটা প্রকৃতিপ্রেমিক মিষ্টি ভূতের গল্প পড়লাম।
ReplyDelete