বিজ্ঞান:: বিপুল তরঙ্গ রে - বিমান নাথ


বিপুল তরঙ্গ রে
বিমান নাথ

সবার মুখে এক কথা — কী এক নতুন ধরনের তরঙ্গ নাকি ধরা পড়েছে। এই তরঙ্গের কথা নাকি খোদ আইনস্টাইন বলে গিয়েছিলেন। ঠিক ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে’… এমন করে লিখে না রেখে গেলেও, মহাকর্ষ নিয়ে তাঁর বিখ্যাত সমীকরণ আবিষ্কারের ঠিক একশো বছর পর মহাকর্ষীয় তরঙ্গ পৃথিবীতে এসে হাজির হয়েছে। যন্ত্রপাতি নাড়িয়ে দিয়ে তার আস্তিত্বের জানান দিয়েছে। এর চেয়ে নাটকীয় আর কী হতে পারে? সেই একশো বছর আগে যেমন হয়েছিল, এই ‘বিপুল তরঙ্গে'র ধাক্কায় আবার সব জায়গায় দেখা গেল আইনস্টাইনের উসকোখুসকো চুল সহ ভাবুক ভঙ্গির ছবি। মুখে - ‘বলেছিলাম না?’ — এমন ভাব।

মহাকর্ষীয় তরঙ্গটা আসলে কী? সহজ ভাষায় এই তরঙ্গ মহাকর্ষের পরিবর্তনের খবর নিয়ে আসে। ধরা যাক সূর্যের ভেতরে কোনও এক ধরনের ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটল, যার জন্য তার ভেতরকার জিনিস এদিক ওদিক হল। তাহলে সূর্যের মহাকর্ষে কিছুটা অদলবদল হবে। সেটা আমরা জানব কী করে? নিউটনের মতে মহাকর্ষের প্রভাব নিমেষে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে পড়ে। এই খবরটা বয়ে নিয়ে যেতে এক মুহূর্তও দেরি হবে না। ম্যাজিকের মত বিশ্বব্রহ্মান্ডের অন্য সব বস্তু এই বদলে যাওয়া মহাকর্ষের জন্য তাদের গতিবিধি পালটে দেবে। কেন বা কী ভাবে সেটা সম্ভব তা নিয়ে তিনি চিন্তিত ছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেই মুশকিল আসান করতে পারেন নি। বলেছিলেন, হয়ত মহাকর্ষের ধর্মই এই।

আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিকতা তত্ত্বে প্রথমেই সব ধরনের গতির একটা সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন। আলোর চেয়ে বেশি গতিতে কোনও কিছু যেতে পারে না। সেই সূত্র ধরে তিনি স্পেস আর টাইম, স্থান আর কালের মধ্যে মেলবন্ধন করেছিলেন। আর সেই সূত্র ধরে নিউটনের নিয়মও পাল্টে যায়। মহাকর্ষের পরিবর্তনের খবর এক লহমায় সব জায়গায় চলে যেতে পারে না — এই আলোর গতিবেগেই সেই খবর অন্যান্য জায়গায় পৌঁছাবে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে আলোর মত মহাকর্ষেরও একটা তরঙ্গ থাকা চাই — যে তরঙ্গের পিঠে চড়ে পরিবর্তনের খবর নানান দিকে ছড়াবে।

সে না হয় হল। কিন্তু তরঙ্গটা কীসের তরঙ্গ? জলে যখন ঢেউ ওঠে, তখন জলের স্তর ওঠানামা করে। শব্দ তরঙ্গে বাতাস আলোড়িত হয়। আলো — যা নাকি বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ — তার জন্য কোনও মাধ্যমের দরকার হয় না। কারণ এই তরঙ্গে  বিদ্যুৎ (এবং চুম্বকীয়) ক্ষেত্রের (ফিল্ড) কমবেশি হয় — এই ক্ষেত্র শূন্যেও থাকতে পারে, পদার্থ ছাড়াই। তাই আলো শূন্যেও এগোতে পারে, বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় ক্ষেত্রের মধ্যে আলোড়ন তুলে। মহাকর্ষীয় তরঙ্গে তাহলে কীসের কমবেশি হচ্ছে? সেটা বুঝতে গেলে মহাকর্ষ সম্বন্ধে আইনস্টাইনের ধারণাটা আমাদের  জানতে হবে।

আইনস্টাইনের মতে মহাকর্ষ আসলে কোনও বল (ফোর্স) নয়। কোন ভরশালী বস্তুর জন্য তার চারদিকে স্পেস-টা বেঁকে যায়, আর অন্যান্য বস্তুরা সেই বেঁকে যাওয়া উঠোনে ঘুরে ঘুরে নাচে। আসলে সে সরল রেখায় যাচ্ছে, কিন্তু উঠোন বাঁকা বলেই তার পথ বেঁকে যাচ্ছে। আমরা যারা বাঁকা উঠোনটা দেখতে পারছি না, তারা ভাবছি ভরশালী বস্তুটার ভেতরে একটা বিশেষ গু আছে যার জন্য অন্যান্য বস্তুগুলো তার চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে। আমরা এই গুণটার নাম দিয়েছি মহাকর্ষ।

আইনস্টাইন বললেন এমন আজগুবি কথায় কান না দিতে। তাঁর মতে ঘুরপাক খাওয়ার আসল কারণ হল স্পেস-এর বেঁকে যাওয়া, আমরা যাকে মহাকর্ষ বলি সেটা তার ফলমাত্র। এই দুমড়ে-চুমড়ে যাওয়া স্পেস আসলে একটা রাবারের পরদার মত। আর তাই যদি হবে তাহলে তার মধ্যে কোনও পরিবর্তনের খবর নিশ্চয় এক নিমেষে বিশ্বব্রহ্মান্ডের সব জায়গায় পৌঁছে যেতে পারে না। এই খবর একটু একটু করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। এটাই হল মহাকর্ষীয় তরঙ্গ।

মনে হতে পারে আমাদের চারিদিকে যে স্পেস বা স্থান আছে, সেটা আবার কী করে বেঁকে যেতে পারে? একে বাঁকাতে গেলে, বা দুমড়ে মুচড়ে দিতে গেলে অন্য আরেকটা ‘দিক’ চাই না? ধরা যাক একটা কাগজের টুকরো নিলাম। তার মধ্যে দৈর্ঘ্য আর প্রস্থ আছে। কিন্তু উচ্চতা বলতে (প্রায়) কিছু নেই। ধরা যাক আমরা সেই কাগজ-জগতের বাসিন্দা — এক ধরনের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-বিশিষ্ট-কিন্তু-উচ্চতা-বিহীন পিঁপড়ে। এবার যদি এই কাগজের টুকরোকে একটা গোল বলের ওপর মুড়ে দেওয়া হয়, তাহলে আমরা কি কখনো বুঝতে পারব যে আমাদের সমতল কাগজের টুকরো বেঁকে গেছে? আমাদের তো উচ্চতা সম্বন্ধে কোনও ধারণা নেই, আর আমরা এই ‘সমতল’ কাগজ ছেড়ে কোথাও যেতে পারবো না। তবু কি কোনও উপায়ে কাগজের বক্রতা টের পাব?

এর উত্তর রয়েছে জ্যামিতিতে। ধরা যাক দুটো সমান্তরাল রেখা নিলাম। যদি সমতলের ওপর এই দুটো রেখাকে আমরা দুদিকে বাড়িয়ে দিই, তাহলে রেখাদুটোর মধ্যে দূরত্ব একই থাকবে— রেল-এর দুটো লাইনের মত। কিন্তু যদি কোনও বাঁকা তলের ওপর রেখাদুটোকে বাড়ানো হয়, তাহলে তাদের মধ্যে দূরত্ব সমান থাকবে না। পৃথিবীর ওপর যেমন দ্রাঘিমারেখা-গুলো মেরুতে গিয়ে এক জায়গায় মিলে যায়।

এই ধরনের পরীক্ষা করে আমরা পিঁপড়েরা তাদের কাগজ-পৃথিবীর মধ্যে বসেই জানতে পার আমাদের চারদিকের উঠোন বাঁকা কি না। সমান্তরাল রেখা ছাড়াও জ্যামিতির আরও অন্য নিয়ম নিয়ে পরীক্ষা করা যেতে পারে। যেমন পিথাগোরাস উপপাদ্য খাটছে কি না। স্থান বা স্পেস-এর বক্রতার সংজ্ঞা এই পিথাগোরাস উপপাদ্য ব্যবহার করেই দেওয়া হয়। এই উপপাদ্যের সাহায্যে আমরা সাধারণত সমকোণ ত্রিভুজের বাহুর দৈর্ঘ্য মাপি। এই উপপাদ্যের নিয়ম থেকে ব্যবধান যত বেশি হবে, বক্রতার মাত্রা তত বেশি হবে। অর্থাৎ দুই বিন্দুর মধ্যে দূরত্ব তত বেশি বদলে যাবে। তাহলে স্পেস -এর বক্রতার অর্থ দাঁড়াচ্ছে এই যে কোনও দুই বিন্দুর মধ্যে দূরত্ব কমবেশি হবে।

এই বক্রতার মাত্রা কতটুকু হতে পারে? আইনষ্টাইনের জটিল অঙ্ক কষে যে উত্তর পাওয়া যায় তাতে একটা চমক আছে। ধরা যাক দুটো বিশাল অন্ধকূপ (ব্ল্যাক হোল) — যাদের একেকটার ভর সূর্যের চেয়ে ত্রিশগুণ বেশি — নিজেদের চারিদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে প্রচণ্ড গতিবেগে - ধরা যাক আলোর গতিবেগের অর্ধেক গতিবেগে। তার জন্য মহাকর্ষের মাত্রার পরিবর্তন হবে প্রতি মুহূর্তে। এই পরিবর্তনের জের সামলাতে স্পেস-এর বক্রতায় উঠবে ঢেউ। এক বিশাল পরিমাণ শক্তি সেই তরঙ্গে করে ‘বিকিরিত’ হবে। বিশাল বললে কম বলা হয়। এই তরঙ্গের ‘ঔজ্জ্বল্য’ সমস্ত মহাবিশ্বের নক্ষত্রসমূহ থেকে বেরিয়ে আসা আলোর দীপ্তির চেয়ে প্রায় পঞ্চাশগুণ বেশি হবে। মনে হতে পারে এমন শক্তিশালী তরঙ্গ পৃথিবীতে এসে পৌঁছালে তার তোড়ে হয়ত প্রলয় শুরু হয়ে যাবে।

কিন্তু না। আইনস্টাইনের অঙ্ক থেকে জানা যায় যে আমরা স্পেস-কে রাবার-এর মতন তুলনা করতে পারি, তার ওপর দিয়ে ঢেউ খেলে যায় বলে, কিন্তু এই ‘রাবার’ খুব শক্ত ধরনের। এতে প্রচণ্ড শক্তিশালী একটা ঢেউ এসে ধাক্কা মারলেতার মধ্যে উঁচুনিচু হওয়ার মাত্রা খুব কম হয়। প্রায় ধরাছোঁয়ার বাইরেই বলা যায়। যদি এমন একটা জোড় অন্ধকূপ আমাদের থেকে প্রায় একশো কোটি আলোকবর্ষ দূরে থাকে, তাহলে সেখান থেকে ধেয়ে আসা মহাকর্ষীয় তরঙ্গে পৃথিবীর স্পেস-এ যে ঢেউ খেলাবে, তার মাত্রা হবে প্রায় 10-19 শতাংশ। অর্থাৎ, আমরা যদি এক কিলোমিটারের একটা রুলার পরীক্ষা করি, তার দৈর্ঘ্য খানিকটা কমবে-বাড়বে — আর এই কমবেশির মাত্রা হবে একটা প্রোটন-এর সাইজের চেয়েও কম!

তাহলে দৈর্ঘ্যের এমন কমবেশি কেমন করে মাপলেন বিজ্ঞানীরা? তার চেয়েও বড়ো প্রশ্ন হল এই : যদি মাপার জন্য ব্যবহার করার রুলারের দৈর্ঘ্যই কমে-বাড়ে, তাহলে সেই রুলার দিয়ে দৈর্ঘ্যের কমবেশি হওয়াটা কেমন করে মাপা যাবে?

একটা উপায় আছে। দৈর্ঘ্য কমবেশি হলেও আইনস্টাইনের নিয়ম অনুযায়ী একটা জিনিস থেকে যায় যার কোনও অদলবদল হয় না। সেটা হল আলোর গতিবেগ। এটা একটা ধ্রুবক। আর আলো এক ধরনের তরঙ্গ। এই ধ্রুবকের সুযোগ নিয়ে বিজ্ঞানীরা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ধরার চেষ্টা করেছেন।

মনে করা যাক একদল সৈন্যকে উত্তর-দক্ষিণের এক রাস্তা ধরে কুচকাওয়াজ করে এগিয়ে যেতে বলা হল। সেই রাস্তায় একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে খুঁটি পোঁতা হল। বলা হল যে সেখানে পৌঁছে তারা যেন আবার ফিরে আসে। একই সময় আরেক দল সৈন্যকে বলা হল পূর্ব-পশ্চিমের এক রাস্তায় একই দূরত্বে রাখা খুঁটি পর্যন্ত গিয়ে যেন তারাও ফিরে আসে। দুদল সৈন্য যাতে একই গতিবেগে যায় তাও বলে দেওয়া হল। এবার তারা যেখান থেকে কুচকাওয়াজ শুরু করেছিল সেখানে যখন ফিরে আসবে তখন তাদের পায়ের ওঠানামা লক্ষ করলে দেখা যাবে যে একই ছন্দে পায়ে পা মিলিয়ে ফিরে এসেছে।

কিন্তু যদি তাদের যাওয়ার সময় কেউ দুষ্টুমি করে খুঁটিগুলো খানিকটা সরিয়ে দেয়, তাহলে তারা যখন ফিরে আসবে তখন দেখা যাবে তাদের পায়ে পা মিলছে না। লক্ষ করলে ধরা পড়বে যে ছন্দপতন হয়েছে। তাল কেটে যাচ্ছে।

ঠিক এই ভাবে দুই দিকে আলো পাঠিয়ে এবং ফিরিয়ে এনে আলোর তরঙ্গের ওঠানামার ছন্দপতন থেকে দৈর্ঘ্যের কমবেশি মাপা যেতে পারে। অবশ্য এটা একটা খুব সূক্ষ্ম পরীক্ষা। বিজ্ঞানীদের সতর্ক থাকতে হবে যাতে অন্য কোনও ধরনের ঝাঁকুনি তাঁদের যন্ত্রপাতিতে না পড়ে। অল্পমাত্রার ভূমিকম্প থেকে শুরু করে কত কিছুর ওপর যে তাদের নজর রাখতে হয়েছে! ধারেকাছে যদি কেউ মোটরবাইক স্টার্ট করে তাহলে যে ঝাঁকুনি ধরা পড়বে, তার মাত্রা মহাকর্ষীয় তরঙ্গের তুলনায় অনেক বেশি। বিজ্ঞানীরা এই সব অবান্তর দুলুনিগুলোকে হাতেনাতে শনাক্ত করে সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রপাতির ওপর তাদের প্রভাব বাতিল করার ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁরা যে লেসার আলো ব্যবহার করেছিলেন সেগুলো যাতে একটানা কয়েক মাস একই দীপ্তিতে জ্বলতে পারে, এবং যে আয়না দিয়ে আলোকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেগুলোর মধ্যে যাতে এতটুকু খুঁত না থাকে, এই ব্যবস্থাপনা করতেই কয়েক দশক ধরে গবেষণা করেছেন।

অ্যামেরিকার দুই জায়গায় এই পরীক্ষার যন্ত্রপাতি বসানো হয়েছে — ওয়াশিংটন এবং লুইসিয়ানা প্রদেশে। একেক দিকের আলোর যাওয়া-আসার পথের দূরত্ব ৪ কিলোমিটার। এর নাম দেওয়া হয়েছে Laser Interferometer Gravitational-wave Observatory (LIGO)। গত সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে বিজ্ঞানীরা তাঁদের যন্ত্রপাতির সংবেদনশীলতা আগের তুলনায় অনেক গুণ বাড়িয়ে নিয়ে ভেবেছিলেন এবার একবার চেষ্টা করে দেখা যায়। প্রায় সেই রাত্রেই একটা দুলুনির চিহ্ন ধরা পড়ে, এক সেকেন্ডের দশ ভাগের এক ভাগ সময় ধরে। তারপর থেকে কয়েক মাস ধরে তাঁরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন এই দুলুনি অন্য কোনও কারণে হতে পারে কি না। দেখা গেল যে দুটো যন্ত্রতেই এই দুলুনি ধরা পড়েছে —আর দুলুনির রকমসকমও একেবারে এক ধরনের। কিন্তু দুটো যন্ত্রে তাঁর চিহ্ন ধরা পড়েছে কয়েক মিলিসেকেন্ড-এর তফাতে। দুই যমজ যন্ত্রের মধ্যে দূরত্ব হল প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার। অঙ্ক কষে দেখা যাচ্ছে যে তরঙ্গটা এই দুই যন্ত্র ছুঁয়ে গেছে, তার গতিবেগ আলোর গতিবেগের সমান! ঠিক যেমন বলে গিয়েছিলেন আইনস্টাইন!

বিজ্ঞানীরা এই ঝাঁকুনির চিহ্ন থেকে এই তরঙ্গের সৃষ্টি সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পেরেছেন। তাঁদের মতে দুটো অন্ধকূপ নিজেদের চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় একে অন্যের ওপর এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ার ফলে দুয়ে মিলে এক হয়ে গেছে। সেই সন্ধিক্ষণে সবচেয়ে বেশি মাত্রায় মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বেরিয়ে ছিল। তার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত অন্ধকূপ দুটো ধীরে ধীরে কাছে এসেছে, সঙ্গে তাদের আবর্তনের গতি বেড়েছে। তার ফলে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের মাত্রা এবং ফ্রিকোয়েন্সি দুটোই বাড়ার কথা — সেটা পরিষ্কার দেখা গেছে। আর শেষে দুয়ে মিলে যখন একটা বিশাল অন্ধকূপ তৈরি হল, তখন ঢেঁকুর তোলার মত তার মধ্যে কিছু সময় ধরে প্রচণ্ড কাঁপুনি হওয়ার কথা — সেটার চিহ্নও পাওয়া গেছে। যাকে বলে অঙ্কের বইয়ের পেছনে দেওয়া উত্তরের সঙ্গে মিলে যাবার মত ব্যাপার।

তবে এটাও বলা দরকার যে স্বয়ং আইনস্টাইনও অনেক বছর ধরে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ নিয়ে সংশয়ে ভুগছিলেন। (এখানে  আইনস্টাইনের লেখা একটা প্রবন্ধের ইতিহাস পাওয়া যাবে : http://www.geology.cwu.edu/facstaff/lee/courses/g503/Einstein_review.pdf   ) অনেক পরে, প্রায় পঞ্চাশের দশকে বিজ্ঞানীরা এর অস্তিত্বের কথা সম্যক ভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। আসলে এই অঙ্কটা এমনিতেই কঠিন তার ওপর যে ব্যাপারটা খুব একটা পরিষ্কার ছিল না সেটা হল অনেক সময় অঙ্কের ফল বাস্তবগ্রাহ্য নাও হতে পারে। বিজ্ঞানীদের সন্দেহ ছিল যে হয়ত অঙ্কের ফলটা শুধু কয়েকটা বিশেষ দৃষ্টিকোণ (বা রেফারেন্স ফ্রেম ) থেকে দেখলে সত্যি হবে, সবার ক্ষেত্রে ঠিক নাও হতে পারে। এই বেড়াজাল পেরোতেই কয়েক দশক লেগে গিয়েছিল।

কিন্তু এই সাম্প্রতিক আবিষ্কার শুধু আইনস্টাইনের তত্ত্বের সত্যতাই যে শুধু প্রমাণ করে দিয়েছে তা নয়, এই মহাবিশ্বকে এক নতুন ভাবে দেখার জানালা খুলে দিয়েছে। এই প্রথমবার অন্ধকূপের অস্তিত্বের সন্দেহাতীত প্রমাণ পাওয়া গেল — এর আগে পর্যন্ত অন্ধকূপের চারপাশের গ্যাসের বিকিরণ থেকে অন্ধকূপের অস্তিত্বের কথা জানতাম। এও জানা গেল যে অন্ধকূপের জুটি ও হয়। কেন কীভাবে এমনটা হতে পারে, তা নিয়ে এখন গবেষণা চলবে। আগামীতে এমন আরও তরঙ্গের হাত ধরে মহাবিশ্বের এই ধরনের ভয়ঙ্কর সুন্দর ঘটনার কথা আরও বিশদ ভাবে জানা যাবে।

এই আবিষ্কার যেমন একদিকে বিজ্ঞানীদের এতদিনের নিরলস সাধনার ফলস্বরূপ তাদের হাতে জয়ের মুকুট তুলে দিয়েছে, তেমনি এক নতুন যুগের, নতুন ধরনের জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণা করার সম্ভাবনার ডালা সাজিয়ে নিয়ে এসেছে।
_______
ছবি - আন্তর্জাল

5 comments:

  1. বাহ - খুব সহজ ভাষায় অনেক গভীরতার সন্ধান দেওয়া রয়েছে! খুব ভালো প্রবন্ধ

    ReplyDelete
  2. Baah mon vorey galo..... Ato valo bigyan bishoyok lekha ami kom poreychi... Amar shrodhdha grohon korben Biman babu

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম-- জানানোর জন্য ধন্যবাদ।

      Delete
  3. ভালো লাগলো। বেশ সহজ করে লেখা। আগের লেখাটাও খুব ভালো ছিলো।

    ReplyDelete