মন্টুমাঝি
শুভজিৎ বরকন্দাজ
গাঁ-গঞ্জে সন্ধেটা বড় ঝুপ করে নামে। তায় শ্রাবণ মাসের শেষ। আকাশের যেদিকে চোখ যায় মেঘের পুঞ্জ-পুঞ্জ স্তূপ। এসে পড়েছি নদী-খালের দেশ সুন্দরবনে। যেতে হবে গাববেড়িয়ায়।
নদীর রাস্তা ধরে এক-পা দু-পা এগোই আর ঝুপ ঝুপ করে অন্ধকারও তার এক-পা দু-পা বাড়ায়। দেখে মনে হয় গভীর কালো আঁচল মেলে সন্ধেটা বুজিয়ে দিচ্ছে আলোর এক একটা দরজা।
চারপাশের ছায়া যত ঘন আর গভীর হচ্ছে, গা ছমছমে ভাবটাও ততই বাড়ছে। চারপাশের মানুষজন কমতে কমতে প্রায় শূন্য। আর কিছুটা গেলেই শুনেছি পড়বে তিন মুখের নদী একটা। নদী পেরোলেই হাঁটা পথে আবার ঘন্টাখানেক।
ব্যাপারটা যে ঠিক এরকম হবে তা আগে ভাগে আন্দাজ করতে পারিনি। এটা আমার স্বভাবদোষ। কোনও ব্যাপারেই আগে ভাগে আন্দাজ করা আমার ধাতে নেই। ভাবি এক আর শেষ মুহূর্তে ফল হয় দেখি তার উল্টো।
গাববেড়িয়ার বন্ধু সুজয়ের সাথে কলেজ লাইফ থেকেই পরিচয়। তারপর একই সাথে ডিগ্রী। বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডী পেরোতেই অবশ্য যোগাযোগটা ক্ষীণ হয়ে এসেছিল একেবারে। হঠাৎ সেদিন বিকেলে কফি হাউসের সামনে দেখা আর প্রথম দর্শনেই বিয়ের নেমন্তন্ন। এড়ানোর আর জো নেই।
তবে বন্ধুর আবদার ফেলতে পারব না বলেই যে গাববেড়িয়ায় আসা—তা কিন্তু নয়; শহরের ছেলে, সেরকমভাবে গ্রাম দেখার সৌভাগ্য ইতিপূর্বে হয়নি আমার—সেই তৃষ্ণা মেটাতেই বলতে গেলে ঝোঁকের বশে বিয়ের তিনদিন আগেই রওনা দিয়েছি নির্লজ্জের মতোই। তা এরকম বিপদে যে পড়তে হবে জানলে হয়ত আগে ভাগেই সাবধান হওয়া যেত। কিন্তু তার আর সুযোগ হয়নি বিন্দুমাত্র। প্রথম প্রথম বেশ সাহসী হয়েই নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম। কিন্তু অন্ধকার যত ঘন হচ্ছে, সাহসের বেলুনটাও চুপসে যাচ্ছে ক্রমশ।
ভাবতে ভাবতেই তিন মুখের নদীর ঘাটটা এসে পড়ল আবছা অন্ধকারে কিছুটা ঠাহর করলাম। মাথার উপরে এক ঢাল তারাভরা আকাশ। হালকা নরম আলোর আভা। মধ্যিখানে পার্থিব প্রকৃতির আঁধারঘন আঁচল। তার নীচে এলিয়ে পড়ে আছে রূপোলী ফিতের মতো তিন মুখের এই তিন ধারা নদী। একটু আধটু কবিত্ব করার অভ্যেস রয়েছে, তবু এমন অনন্য স্বর্গীয় মুহূর্তেও মনের মধ্যে একফোঁটা কবিত্ব এল না। কেমন এক অজানা ভয় এসে আমার সমস্ত কবিত্ব গিলে নিতে লাগল একটু একটু করে।
আবছা অন্ধকারে পা গুনে গুনে নদীর ঘাটে নেমে এলাম কিছুটা। নদীতে এখন ভরা জোয়ার। জল তাই রাস্তার প্রায় কানায় কানায়। ছলাৎ ছল শব্দ উঠছে বাতাসের মৃদু ধাক্কা লেগে। কিন্তু কোনও খেয়া নৌকো চোখে পড়ছে না এই মুহূর্তে। তবে কি সাঁতরে পেরোতে হবে নাকি এই নদী! ভাবতেই বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। শহরের ছেলে হলেও সাঁতার জানি দিব্যি। কিন্তু তাই বলে এই অন্ধকারের ভরা নদী! তবেই হয়েছে! মনে মনে দেরী হওয়ার জন্যে রাস্তায় খারাপ হয়ে যাওয়া লজঝড়ে বাসটাকে শাপ শাপান্ত করতে লাগলাম।
সবে সন্ধে বোধহয় সাতটা কি সাড়ে সাতটা হবে। তবে কি খেয়া নৌকো এর মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেল? সুজয়ের কাছে ব্যাপারটা শোনা হয়নি ঠিক মতো। আসলে বেলায় বেলায় চলে আসবার কথা ছিল। তাই সে প্রসঙ্গও আসেনি তখন। আশেপাশে কোনও লোকজনেরও দেখা নেই, যার সাথে এ বিষয়ে একটু আলাপ আলোচনা করতে পারি।
দীর্ঘক্ষণ নদীর পাশে বসে আমার বাহ্য চেতনাও তখন লুপ্ত হতে শুরু করেছে একটু একটু। পথের পাশের বুনো ঝোপ থেকে একটানা ঝিঁঝির ডাক ভেসে আসছে। নিজেকে এখন কেবল অন্ধকারেরই একটা অংশ বলে মনে হচ্ছে কেবল।
ঝিঁঝির একটানা ডাকে বুঁদ হয়েছিলাম বহুক্ষণ। হঠাৎ কানে এল ছপ-ছপ একটা দাঁড় টানার শব্দ। একটা নির্দিষ্ট লয় রেখে শব্দটা পূবদিক থেকে আমার দিকে এগিয়ে আসতে থাকল। এই প্রথম কেমন জানি গা-টা একটু ছমছম করে উঠল। সেই সঙ্গে একটু আশাও জাগল মনে। উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে রইলাম সামনের ভরা অন্ধকারের দিকে।
খুব সতর্কভাবে চেয়ে দেখলাম, এক টুকরো লম্বাটে ছায়া দীর্ঘ আকার ধরে হঠাৎই যেন এসে থামল নদীর ঘাটে। ঘোর কাটতে বুঝলাম ওটা আসলে একটা ডিঙি নৌকা।
এটাই তাহলে এখানকার খেয়া। এই জনপ্রাণীহীন ভরা জোয়ারপুষ্ট নদী পারের বাহন কিনা এই পুঁচকে চেহারার নৌকা! ভাবতেই বুকের ভেতরটা ছমছম করে উঠল। তবু মনের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া সাহসটা অনেকটা নিজের চেহারায় ফিরে আসতে শুরু করেছে টের পেলাম। নৌকার উদ্দেশ্যে বেশ মেজাজি গলায় হাঁক পাড়লাম, “ও মাঝি ভাই, এটা পারে যাবার খেয়া তো? দাঁড়াও দাঁড়াও...জোর বাঁচালে বুঝেছ!”
প্রত্যুত্তরে কোনও জবাব এল না। অন্ধকারের মধ্যে একতাল জমাট ছায়ার মধ্যে খেয়ামাঝি নিরুত্তাপ বসে রইল।
নৌকাটা ছোট হওয়ার দরুণ আমি ওঠাতে বেশ টলোমলো করছিল। হাঁটু মুড়ে ভয়ে ভয়ে কোনওরকমে বসে পড়লাম।
মাঝির দিকে এতক্ষণে নজর গেল। অন্ধকারে মুখ বোঝার জো নেই। শরীরটাই যেন একটা ছায়া-কাঠামো। বৈঠা ধরা ছায়াটার দুই হাত একটা নির্দিষ্ট ছন্দে উঠছে আর নেমে আসছে করাল অন্ধকারের বুকে। পরক্ষণেই আওয়াজ উঠছে ছপ ছপ...
খেয়াল করিনি ইতিমধ্যে নৌকা মাঝনদীতে এসে পড়েছে। আর খেয়াল করবটাই বা কীভাবে! অন্ধকারে বোঝাই দায়। এই ভরা নদীর মাঝে করালগ্রাসী অন্ধকারের মধ্যে এই মুহূর্তে এইটুকু এক ডিঙি নৌকার আমি একলা যাত্রী। মাথার উপরে ঘন তারায় ছাওয়া আকাশ। পশ্চিমে থমথমে একঢাল কালো মেঘের পুঞ্জ-পুঞ্জ স্তূপ।
হঠাৎ আমার কেমন জানি ভয় ভয় করতে লাগল। মাঝনদীতে যদি নৌকাটা এখন উলটে যায়! তাহলে! ভাবতেই শিরশির করে উঠল বুকের ভেতরটা। ভয়ে কাঁধের ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে বসে রইলাম নিস্পন্দ হয়ে। নৌকার এককোণে বসা খেয়ামাঝি তখন অন্ধকার ভেঙ্গে নির্বিকার চিত্তে বৈঠা টেনে পেরিয়ে চলেছে আঁধার ছাওয়া তিন মুখের সর্বনাশী নদী।
ভয় কাটাতে ভাবলাম মাঝির সাথে একটু আলাপ জমানো যাক। কিন্তু মাঝিটা কি বোবা? তখন থেকে একটা কথাও বলতে শুনলাম না। বোবারাও তো নিদেনপক্ষে হুঁ হাঁ আওয়াজটুকু তোলে! সন্দেহ দূর করার জন্যে হাঁক পড়লাম, “ও মাঝিভাই, গাববেড়িয়া কি এখান থেকে অনেকটা দূর?”
যথারীতি ওপার থেকে কোনও সাড়া পাওয়া গেল না্। বৈঠার ছপছপ শব্দখানাই আমার কথার প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরতে লাগল। আশ্চর্য! কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আবার জিজ্ঞেস করলাম, “নেমে গাড়ি-টাড়ি পাওয়া যায়, নিদেনপক্ষে ভ্যান-ট্যান?”
এবারেও কোনও সাড়া নেই। নিঃসন্দেহ হলাম, মাঝিব্যাটা নির্ঘাৎ বোবা। নইলে মাথার ব্যারাম আছে জব্বর। ভাবলাম, কী আর করা যাবে! সারাদিন দুর্ভোগের পর সন্ধেতেও এসে পড়লাম এক পাগলা মাঝির পাল্লায়। এরই নাম কপাল! নিরুপায় হয়ে নিকষ নিশুতি অন্ধকারের মধ্যে এক দোদুল্যমান নৌকার অসহিষ্ণু যাত্রী হয়ে নিজের মুণ্ডুপাত করে চললাম।
মিনিট পাচেঁক পরে কোথা থেকে হঠাৎ কুকুরের চিৎকার শুনতে পেলাম। একসঙ্গে অনেক ক’টা। বিকট শব্দে প্রবল চিৎকার করে রাতের অন্ধকার খান খান করছে কুকুরগুলো। বুঝলাম ঘাটে এসে পৌঁছেছি। সতিই তাই। মাঝিকে দেখলাম অন্ধকারের মধ্যে ঝুপ করে পাড়ে নেমে নৌকাটাকে বাঁধছে।
নামার সময় নৌকাটা বেশ টলমল করতে লাগল। খুব সাবধানে নীচের পৈঠায় পা দিলাম।
মাটিতে নেমে ভয়ানক নিশ্চিন্ত মনে হল নিজেকে। একটা লম্বা আরামের নিঃশ্বাস মহা আনন্দে আমার গা বেয়ে গড়িয়ে নামল ঘন আঁধারের বুকে।
এবারে ভাড়া চোকাবার পালা। কিন্তু বোবা মাঝিকে কীভাবে জিজ্ঞাসা করব যে তোমার ভাড়াটা কতো! পকেট হাতড়ে একটা পাঁচ টাকার নোট বেরোল। সেটাই ধরিয়ে দিলাম তার হাতে।
মাঝি নীরবে হাত বাড়িয়ে নোটটা নিল। এক মুহূর্তের জন্য মাঝির হাতটা স্পর্শ করার সুযোগ এল। ঠান্ডা নদীর জলের মতই ঠান্ডা বরফশীতল সে হাত। সারা গায়ে একটা শিহরণ ছড়ালো। কিন্তু পরমুহূর্তে মনে হল, জলে কাদায় সারাক্ষণ এদের কারবার। ঠান্ডাটা এক্ষেত্রে তেমন অস্বাভাবিক কিছু নয়। পাড়ের দিকে উঠে যেতে যেতে শেষবারের মতো চাইলাম খেয়ামাঝির দিকে। দেখি দুটি স্থির কালো চোখ অন্ধকারের মধ্যে বোবা দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। কেন জানি না গা-টা আরেকবার ছমছম করে উঠল।
###
পাড়ে উঠতে আরেক ফ্যাসাদ। দুর্ভোগ আর ফুরোয় না!
অচেনা লোক দেখে কোত্থেকে এসে ঘিরে ধরেছে খান দশেক বিকট চেহারার কুকুর। এক পাও এগোতে দিচ্ছে না আমাকে। দাঁত বার করে ভয়ানক হাড় কাঁপানো শব্দে ঘেউ ঘেউ করে ডাক পাড়ছে কুকুরগুলো।
ভয়ে বুকের রক্ত হিম হয়ে এল। দুয়েকবার সাহসী হয়ে ‘হ্যের..হিট...হিট...সর সর...আমাকে কি চোর ডাকাত ভেবেছিস... হিট হিট...’ করলাম। কিন্তু কোনও কাজ হল না তাতে। বরং কুকুরগুলোর আক্রোশ যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল তাতে। ভারি সমস্যায় পড়লাম। কী করে যে এ থেকে মুক্তি পাব তাই ভাবছি, এমন সময়... পিছন থেকে চাপা গোঙানির মতো হঠাৎ এক অদ্ভুত আওয়াজ ভেসে এল।
ভারি আশ্চর্য ব্যাপার! কুকুরগুলো দেখলাম হঠাৎই লেজ গুটিয়ে অন্ধকারের দিকে দ্রুত পালাচ্ছে কীসের এক আশঙ্কায়। কী এমন ব্যাপার! আশ্চর্য!
চমকে গিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখি, কখন যেন সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে বেঁটে খাটো চেহারার শীর্ণ এক ছায়ামূর্ত্তি।
কে ও ! ভয়ে শিউরে উঠলাম। ছায়ামূর্ত্তিটা পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আমি স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছি। নড়তে চড়তেও যেন ভুলে গেলাম ঘটনার আকস্মিকতায়। মূর্ত্তিটা কাছে আসতেই ব্যাপারটা জলের মতো পরিস্কার হল। সে আর কেউ নয়। একটু আগেই যে আমাকে পার করে দিয়েছে অন্ধকারের করালবদনী নদী—এ সেই খেয়া নৌকার মাঝি।
বুকের ওপর থেকে যেন একটা গুরুভার পাথর নেমে গেল। সাহসটাও ফিরে এসেছে অনেকটা। ভালো করে তাকিয়ে এবার মাঝিকে দেখতে লাগলাম। অন্ধকার অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছে। রোগা শীর্ণ বেঁটে খাটো চেহারাটার মধ্যে থেকে যেন একটা চাপা আগুন ছিটকে পড়ছে অন্ধকার ছাপিয়ে। চোখদুটো তার ভারি উজ্জ্বল। অন্ধকারে যেন সে দুটো জ্বল-জ্বল করতে থাকল আমার দিকে তাকিয়ে।
মাঝিকে একটা ধন্যবাদ দেওয়া দরকার। এত বড় দু-দুটো বিপদ থেকে আজ বাঁচাল আমাকে। হেসে বললাম, “ভারি উপকার করলে মাঝিভাই। চলি, কেমন? আমাকে এখন অনেক দূর যেতে হবে যে!”
প্রত্যুত্তরে মাঝি মৃদু হাসল। বেশ রহস্যময় লাগল এই মুহূর্তে মাঝির হাসিটাকে। অন্ধকার ছাপিয়ে সাদা দাঁতের সারিগুলো ঝিলিক খেলে গেল যেন। কথা না বাড়িয়ে পা-টা সবে বাড়াতে যাব এমন সময়... ভারি আশ্চর্য আরও একটা ঘটনা ঘটে গেল।
“কোন দিকি যাবেন বাবু?”
ফ্যাসফেসে ধরা গলায় আমার দিকে ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্নটায় প্রশ্নকর্তার দিকে চেয়ে আমি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে ফ্যাল-ফ্যাল করে চেয়ে রইলাম।
প্রশ্নটা ফিরে এল আবার, “কোন দিকি যাবেন?”
ভারি বিস্মিত হয়ে আমি তখন ভেবে চলেছি, খেয়ামাঝি তাহলে বোবা নয়! নিজেকে ভীষণ অপ্রস্তুত মনে হল। কোনওরকমে ঢোঁক গিলে বললাম, “ইয়ে...গাববেড়িয়া। সুজয় হালদারের বাড়িতে। চেনো সুজয়দের বাড়ি?”
মাঝি হঠাৎ গা কাঁপিয়ে হাসল। ঘড়ঘড়ে গলায় ফ্যাসফেসে হাসি। হঠাৎ সেই হাসির ধরন শুনে আমার গা-টা ছমছম করে উঠল।
“ই গায়েঁর বাবু ইমন কুনো জমিন লাই যে মন্টুমাঝি চিনে লা... হাঃ হাঃ হাঃ... ইঃ ইঃ ইঃ ...।”
মন্টুমাঝির সেই অদ্ভুত হাসির শব্দ যেন অন্ধকার ভেঙ্গে ভেঙ্গে নদীর বুকে গড়িয়ে পড়তে লাগল।
এমনিতেই খুব অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছি। কী বলব সেটাই আর বুঝে উঠতে পারছি না। ভারি হতভম্বের মত মাঝির দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলাম। এই অন্ধকারে গাববেড়িয়ায় পথ চিনে যাওয়া যে আমার পক্ষে সম্ভব নয় তাও বেশ বুঝতে পারলাম।
তবে কি মন্টুমাঝিকেই একবার বলে দেখব, আমাকে যদি এগিয়ে দিতে পারে কিছু পারিশ্রমিকের বিনিময়ে... দ্বিধান্বিত হয়ে ভাবছি। মাঝি কী করে যেন আমার মনের ভাবটা টের পেয়ে গেল।
“ডর লাইগছে বাবু? ডর লাইগছে...? ইঃ হিঃ হিঃ ...ইঃ হিঃ হিঃ... তুমরা শউরে বাবু.... ডর লাইগছে...? ইঃ হিঃ হিঃ ...ইঃ হিঃ হিঃ...,” মন্টুমাঝি আবার দশদিক কাঁপিয়ে হাসতে থাকল। সে হাসি শুনে বুকের ভেতরটা কেমন যেন করতে লাগল আমার।
মন্টুমাঝি লোকটা ভালোই...তবে হাসিটা আর গলার স্বরটা যেন কেমন একটু অদ্ভুত। এর চেয়ে না কথা বলা অবস্থাতেই মনে হয় বেশ ভালো ছিল। কিন্তু দায়টা এখন আমার। এই অন্ধকার রাতে অচেনা গাঁ-গঞ্জে এসে যে বিষম বিপদে পড়েছি, তা থেকে বাঁচতে তবু এই বিচিত্র মাঝিই এই মুহূর্তে আমার একমাত্র ভরসা।
ভারি আপ্লুত হয়ে খুবই অনুনয়ের সঙ্গে আমি মন্টুমাঝির কাছে হাত জড়ো করলাম।
“তোমার কি একটু সময় হবে মাঝিভাই, পারবে আমাকে বাকি পথটুকু পৌঁছে দিতে?”
মন্টুমাঝি আবার হেসে উঠল। সেই একই অদ্ভুত রহস্যময় হাসি। এবারে আরও উচ্চস্বরে। বোকার মতো আমিও যেন কখন মাঝির হাসিতে গলা মেলালাম। সেই অদ্ভুত দুই ধারার হাসিতে অন্ধকারও কখন যেন একটু একটু করে ফিকে হতে থাকল। আমি ভারি বিমোহিত হয়ে মাঝির পিছন পিছন নদীবাধেঁর উপর দিয়ে চলতে শুরু করলাম অন্ধকার চড়াই-উৎরাইময় মাটির রাস্তা ভেঙ্গে।
###
কতক্ষণ পথ হেঁটেছি জানি না। মনে হল ঘন্টা দেড়েক তো হবেই। উঁচু নীচু নদীবাঁধের উপর দিয়ে মেঠো পথ ধরে হাঁটার কষ্ট অনেক। বিশেষ করে আমার মতো আনাড়ির পক্ষে তো একটু বেশিই। তবে কষ্ট বিশেষ হল না। মন্টুমাঝির অদ্ভুত সাহচর্য আমাকে রাতের কষ্ট লাঘব করে দিল অনেকটাই। যেন এক আজ্ঞাপ্রাপ্ত ঈশ্বরের দূত হয়ে এই ভয়ানক অন্ধকার পেরিয়ে মন্টুমাঝি আজ এই বিশেষ মুহূর্তে আমাকে নিয়ে চলেছে কোনও স্বর্গীয় লোকের দিকে।
ভারি আশ্চর্যরকম হালকা বোধ হচ্ছে এই মুহূর্তে নিজেকে। এই মুহূর্তে কোনও ভয়-ভীতি, উত্তেজনা কিছুই যেন আমাকে ছুঁতে পারছে না আর। আমার সামনে এখন নির্বিকার হেঁটে চলেছে বৈঠা কাঁধে মন্টুমাঝির খর্বকায় শরীর। পিছন পিছন দ্বিধাহীন আমি।
চলতে চলতে কথাবার্তাও প্রচুর হচ্ছে। তবে তা নিতান্তই এক তরফা। আগলখোলা স্লুইজ গেটের মতো কলকলিয়ে কথা বলছি আমি। এই অচেনা অজানা গ্রামদেশের এক নিতান্ত সাধারণ মাঝির সাথে যে আমার এত কথা বলার থাকতে পারে সে বিষয়ে সত্যিই আমার ইতিপূর্বে কোনও ধারণাই ছিল না।
একসময় পথ ফুরোল। অন্ধকার পেরিয়ে কিছু দূরে কয়েকটা আলোর রেখা ফুটল বিন্দু বিন্দু। মন্টুমাঝি থমকে দাঁড়াল। আমিও দাঁড়িয়ে পড়লাম। তার অনেকটা গা ঘেঁষে। নদীর আঁশটে গন্ধ মন্টুমাঝির গা ফুঁড়ে আমার নাকে এসে আছড়ে পড়ছে।
দূরের আলোর রেখা দেখিয়ে মন্টুমাঝি আমাকে ইশারা করল, “হুই বাবু... ওই দিখা যায়... তুমার বন্ধুর বাড়ির নিশান...”
সে কি, এসে গেল! আমি চমকে আলোর রেখাগুলোর দিকে চাইলাম। এখান থেকে এখনও বেশ কিছুটা দূর। চতুর্দিকে বিছিয়ে থাকা ঘন অন্ধকারে আমি মন্টুমাঝির চোখে চাইলাম। সরল ঘন কৃষ্ণকান্ত দুটি চোখের আশ্চর্য চাহনি থেকে অন্ধকার ভেঙ্গে ঠিকরে বেরোচ্ছিল মায়াবী কোমল আনুগত্যের ছটা - যা দেখে ভালো লাগায় আমি যেন আরেকবার ভিজে গেলাম।
কৃতজ্ঞতার ভাষা আমার জানা নেই। ধরা গলায় বলতে চাইলাম, “মাঝিভাই তুমি যে আমার কী উপকার করলে... তোমার কথা আমি কখনও ভুলতে পারব না... চলি তাহলে... আবার দেখা হবে মাঝিভাই...”
আমার কথায় মন্টুমাঝি মৃদু হাসল। তারপর গাঢ় স্বরে আমাকে অভয় দিল, “কুনো ডর লাই বাবু... কুনো ডর লাই...আবার দিখা হবে.... আবার দিখা হবে...,” বলতে বলতে এক ঢাল কুয়াশা ঘেরা অন্ধকারের মধ্যে মন্টুমাঝি চলতে শুরু করল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো বোবা বিস্ময়ে আমি তার মিলিয়ে যাওয়া গমনপথের দিকে চেয়ে রইলাম।
###
আমাকে ওই অবস্থায় অত রাতে দেখে সুজয়দের বাড়ির সকলেই চমকে উঠল।
“এত রাতে?”
“কী করে এলি? নদীই বা পেরোলি কেমন করে? সন্ধের পর তো কোন খেয়াই থাকে না!” সুজয়ের প্রশ্নে আমার চমক ভাঙল।
আমাকে ঘিরে থাকা কৌতূহলী মুখগুলোর দিকে ফ্যাল-ফ্যাল করে চাইলাম। কিন্তু তেমন করে গুছিয়ে কোনও কথা বলতে পারলাম না...শুধু অস্ফুটে বিড় বিড় করে বললাম, “মাঝি... মন্টুমাঝি...!”
“অ্যাঁ, কে? মন্টুমাঝি!”
সকলের অবিশ্বাসী মুখগুলোর দিকে চেয়ে আমার মাথা গুলিয়ে গেল। সুজয় আমাকে ধরে ঝাঁকিয়ে দিল, “কী বলছিস তুই? মন্টুমাঝি এর মধ্যে কোথা থেকে এল... সে তো!”
সুজয়ের বাবা সবাইকে থামালেন। আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, “আমাকে সব খুলে বল তো বাবা।”
আমি একটু ধাতস্থ হতে সময় নিলাম। তারপর গুছিয়ে এক এক করে সব কথাই খুলে বললাম।
সুজয় তখন অবিশ্বাসীর মতো বিড় বিড় করছিল। মন্টু মাঝি? এটা কী করে সম্ভব!
আমি সুজয়ের দিকে অর্থহীন হয়ে বোবার মতো চাইলাম। কৌতূহলী মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে ঢোঁক গিলে বললাম, “মানে....?”
“মানে? মানে কিছু নয় রে বন্ধু! আজ থেকে বছর পাঁচেক আগে এমনি এক শ্রাবণের ভয়ঙ্কর ঝড় জলের রাতে নৌকাসুদ্ধ ডুবে মরেছিল মন্টুমাঝি! আর তুই কিনা বলছিস...!”
সুজয়ের কথাগুলো বুকের মধ্যে বড় ঝমঝম করে বাজছিল। অবিশ্বাসীর মতো মাথা নাড়লাম। তা কী করে সম্ভব! একটু আগেই যে মানুষটা আমাকে এতদূর পৌঁছে দিয়ে গেল...সে কী করে... আমার মাথা আর কাজ করছিল না... শরীরটা যেন খারাপ হতে শুরু করল হঠাৎ।
###
অনেক রাতে সুজয়দের শোবার ঘরের খোলা জানালায় দাঁড়িয়ে বাইরের অন্ধকারে দিকে তাকিয়েছিলাম। হালকা চাঁদের জ্যোৎস্না কুয়াশার চাদর পরে এলিয়ে রয়েছে বাইরের বিস্তীর্ণ মাঠের ওপর। সুজয়দের গেটের জারুল গাছটার দিকে হঠাৎই নজর পড়ল। দারুণ চমকে উঠলাম।
অস্পষ্ট খর্বাকায় সেই ছায়ামূর্ত্তি। সন্ধের ছায়ামূর্ত্তি। কাঁধে বৈঠা নিয়ে আমার জানালার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে নরম আলোর মতো হাসতে হাসতে কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে মন্টুমাঝি.......
_____
ছবি - সুতীর্থ দাশ
লেখক পরিচিতি — শৈশব থেকেই সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ। শৈশবেই কাব্য রচনার হাতেখড়ি। শিশু-কিশোর সাহিত্য রচনায় অত্যন্ত সাবলীল। শিক্ষকতার পেশায় নিযুক্ত। লেখেন এই সময়ের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা সাত। সম্পাদনা করেন জনপ্রিয় শিশু-কিশোর সাহিত্য পত্রিকা ‘ইষ্টিকুটুম’ এবং সীমান্তহীন সাহিত্য পত্রিকা ‘পানকৌড়ি। ভালবাসেন গান, কবিতা, ফটোগ্রাফি আর উন্মুক্ত প্রকৃতির মাঝে ঘুরে বেড়াতে।
No comments:
Post a Comment