আনন্দধারা বহিছে ভুবনে
সহেলী চট্টোপাধ্যায়
রাশি আজ বাড়ি থেকে রাগারাগি করে বেরিয়ে পড়েছে। এমনিতে ও যথেষ্ট ঠাণ্ডা স্বভাবের মেয়ে। তবু একজন মানুষ তো, তাই রাগ, দুঃখ হওয়া খুব স্বাভাবিক। রাশির মা বাবার মধ্যে একদম বনিবনা নেই। দুজনে এক বাড়িতে থাকে অবশ্য। তাতে রাশির সুবিধার থেকে অসুবিধাই হচ্ছে বেশি। মা অফিসে কাজ করে। বাবারও অফিস। সারাদিন রাশির বেশ ভালোই কাটে, কিন্তু যেদিন ওদের ছুটি থাকে সেদিন সকাল থেকেই বাড়িতে কাক-চিল বসার উপায় থাকে না। ওরা বোঝে না যে বাড়িতে একটা বাচ্চা মেয়ে আছে। তার মনে খুব কষ্ট হয় নিজের বাবা, মা কে এভাবে লড়াই করতে দেখে। পাড়া-প্রতিবেশিদের সামনে ও লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতে পারে না। সবাই তো জানে যে ওর বাবা মা এরকম বিচ্ছিরি ভাবে ঝগড়া করে। বাবার বাড়ির কাউকেই ভালো লাগে না মায়ের। সবার শুধু দোষই ধরে। এই করতে করতে মা জীবনের সব সুখ-শান্তি কখন যেন হারিয়ে ফেলেছে। বাবাও এক ধরনের। নিজের ইচ্ছে মতন চলে। মায়ের বাড়ির কাউকেই বাবা পছন্দ করে না। বাবার বাড়ির লোকগুলোও খুব অদ্ভুত। দেখা হলেই শুধু জিজ্ঞাসা করবে, তুমি অঙ্কে কত পেয়েছ? পড়াশোনা কেমন চলছে? ক্লাসে স্ট্যান্ড কর কি না? যত সব আজে বাজে প্রশ্ন। মামার বাড়িরও সেই এক। প্রত্যেকে নিজেদের ছেলে মেয়েদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। রাশির মত নিরেট মাথা তো ওদের ছেলেমেয়েদের নয়। কথাটা খুব সত্যি। তবে সব দোষ কি রাশির?
রাশি অনেক বুঝিয়েছে নিজের বাবা মাকে, কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। আর হবে বলেও মনে হয় না। এমন কোনও দুর্গা পুজো কাটেনি যেদিন ও মার খায়নি। এমন কোনও দীপাবলি নেই যেদিন ওর বাবা মায়ের মধ্যে ঝগড়া হয়নি। ছুটির দিন হলেই তো ধুন্ধুমার লেগে যায়। মা কাজের লোকদেরও ছাড়ে না। রাশি জানে ওর ভবিষ্যৎ অন্ধকার, কারণ দুজনের কারোরই ওর দিকে খেয়াল নেই। নিজেদের কেরিয়ারের চিন্তা করে সব সময়। অথচ স্কুলের বন্ধুদের বাবা মায়েরা কত ভালো। ওরা মোটেও এরকম করে না।
আজ আর ও পারল না সহ্য করতে। মা দুম দুম করে পিঠে কিল মেরে বসল। ও শুধু বলেছিল, ‘মাসিকে এত বকছ কেন? মাসির শরীর খারাপ ছিল বলেই তো দু’দিন আসেনি। তোমারও যখন শরীর খারাপ হয় তুমি অফিস কামাই কর।’
মা তাতেই ওর পিঠে কিল মেরে বসল। আর অনেক বকাবকি করল। বলল, ‘বড়দের ব্যাপারে নাক গলাতে এস না।’
এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল কিন্তু কিল মারাটা ও সহ্য করতে পারল না। তার ওপর কাজের মাসির সামনে। চোখে জল চলে এল। আজ রবিবার সবার ছুটি। তাই সারা দিনই এরকম আবহাওয়া চলবে। দুপুরে এক ফাঁকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল রাশি। সোজা স্টেশনে চলে যাবে ও। তারপর ট্রেন আসলে ও ঝাঁপ দেবে। ব্যাস সব চিন্তার শেষ হয়ে যাবে। দুপুরে আজ ভাতও খায়নি রাশি। মা রাগ করে রান্নাই করেনি। ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘুম দিচ্ছে। বাবা বেরিয়ে গেছে বন্ধুর বাড়ি। রাশিদের বাড়ি থেকে স্টেশন বেশ দূরে। ওকে হেঁটে হেঁটেই যেতে হবে। পয়সার ব্যাগ ও বাড়িতেই ফেলে এসেছে। যে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছে তার আর টাকা-পয়সা নিয়ে কি হবে?
শর্ট কাট করার জন্য রাশি সোজা রাস্তায় না গিয়ে অন্য একটা গলি ধরল। সামনে একটা লেভেল ক্রসিং পড়বে যার গেট নেই। ওখানেই যা করার করতে হবে। স্টেশনে অনেক লোক থাকবে। ওদের সামনে কিছু ঝুঁকি না নেওয়াই ভালো। ক্লাশ সেভেনে পড়া রাশিও অনেক কিছু বুঝে গেছে।
মাথার ওপর নীল আকাশের দিকে একবার তাকাল ও। ঘন নীল রঙের আকাশ। সাদা মত একটা লম্বা লাইন চলে গেছে আকাশের বুক চিরে। ওটা নিশ্চয় রকেট বা জেট প্লেন এর জন্য হয়েছে। কিছুদিন হল সরস্বতী পুজো গেছে তাই বেশ আরামদায়ক আবহাওয়া এখন। রাশি দেখল সামনে শিমুল গাছটা লাল লাল ফুলে ছেয়ে গেছে। মাটিতেও পড়েছে অনেক লাল ফুল। রাশি ফুলগুলো কুড়োতে শুরু করে দিল। এই রাস্তার দু’পাশে নানা রকম গাছ। সোনাঝুরি, অমলতাস, দেবদারু, কাঠবাদাম, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচুড়া, পলাশ আরও কত কী যে আছে! কৃষ্ণচুড়া রাধাচূড়ায় ফুল ফুটতে শুরু করে দিয়েছে। ওই হলুদ ফুলের গাছটার নাম জানে না রাশি, সারা বছর হলদে ফুলে ভর্তি হয়ে থাকে। গাছটার নাম জেনে নিতে হবে। রাশির আর একটা প্রিয় গাছ হল ছাতিম। ছাতিম ফুলের গন্ধ ভারি মিষ্টি লাগে ওর। বেগুনি আর কমলা রঙের কাগজ ফুলের গাছগুলোর নাম জানে না রাশি। ওর বন্ধু জিয়া বলেছে এগুলো কাগজফুল। ও যখন বড় হবে বাড়ির সামনে এই রকম কাগজফুল-এর গাছ লাগাবে। আরে সাদা সাদা ফুলে ভর্তি এই গাছগুলো কী গাছ? একটু ভালো করে দেখেই রাশি বুঝতে পারল এগুলো সজনে গাছ। সাদা সাদা সজনে ফুল হয়ে আছে গাছে। বাবা মাঝে মাঝে বাজার থেকে সজনে ফুল নিয়ে আসে। ইস কুল গাছে কত কুল হয়েছে। পাকা কুলের গন্ধে ম ম করছে। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া দিল আর শিরীষগাছ থেকে একরাশ পাতা উড়ে পড়ল মাটিতে। যেন বলতে চাইল, এত মন খারাপ কোর না রাশি। আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখো শুধু আনন্দ খুঁজে পাবে।
তুড়ুক তুড়ুক লাফ দিয়ে দুটো কাঠবিড়ালী সায় দিয়ে গেল শিরীষ গাছের কথায়। কু কু করে একটানা একটা কোকিল ডেকেই চলেছে। মনে হয় কোকিলটাও শিরীষ গাছকে সমর্থন করছে। দুটো সবুজ প্রজাপতি উড়ে গেল ফরফর করে, রাশির নাকে বসে পড়ল একটা। রাশি হেসেই ফেলল ওদের কীর্তি দেখে। ডানা ঝাপটে উড়ে গেল এক ঝাঁক গোলা পায়রা। ওই লম্বা ঘাস ফড়িং-গুলো নিশ্চয় পরিদের দেশ থেকে এসেছে। না হলে এত সুন্দর হয় না কি! ফড়িং ধরার চেষ্টা করল রাশি। কিন্তু পারল না। এদের দেখলেই ওর পরিদের কথা মনে পড়ে। তবে প্রজাপতি আর মথ দেখলেও পরিদের কথা মনে পড়ে ওর।
রাশি জানে মাটিরও নিজস্ব একটা গন্ধ আছে। খুব মিষ্টি একটা গন্ধ। স্কুলের বাগানে মাটি নিয়ে ঘাঁটা ঘাঁটি করতে গিয়ে রাশি এটা বুঝতে পেরেছে। স্কুলে জীবন বিজ্ঞানের ম্যাম মহুয়াদির উৎসাহে রাশিরা সবাই কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে সুন্দর একটা বাগান করার জন্য। প্রথম প্রথম মাটি ঘাঁটতে ঘেন্না পেত ও। কিন্তু মাটি ঘাঁটাটাই ওর খুব প্রিয় হয়ে গেল এক সময়। সুইসাইড করলে সে এত রকম আনন্দ আর সুখ থেকে বঞ্চিত হবে। আবার কি রাশি আসতে পারবে এই পৃথিবীতে? সে জানে পৃথিবীতে এত দুঃখ আছে। আবার এত আনন্দও আছে! আজ রাশি সেটা নতুন করে জানতে পারল।
পিক পিক করে একটা পাখি ডাকছে। রাশি ভালো করে লক্ষ্য করল খুব ছোটো একটা পাখি রাশির প্রায় গায়ের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। এইটুকু একটা পুঁচকে পাখি তার গলার কী জোর! ওর স্পষ্ট মনে হল পাখিটা ওকে ধমক দিচ্ছে। এই আজে বাজে চিন্তার জন্য। হাত বাড়িয়ে পাখিটাকে ধরতে গেল কিন্তু পারল না। ফুড়ুৎ করে উড়ে পালাল। সেই সবুজ প্রজাপতি দুটো আবার ফিরে এসেছে। সঙ্গে করে এনেছে দুটো সাদা প্রজাপতিকে। ওর নাকের কাছেই ওরা খালি ঘুর ঘুর করছে। শিমুল গাছের তলায় অনেকক্ষণ বসে আছে ও। মাথার ওপর টুপটাপ করে ফুল খসে খসে পড়ছে। শিমুল গাছটাই ওর মাথায় ফেলছে ফুলগুলো। ওকে খুব করে আদর করতে চাইছে হয়তো। লেভেল ক্রসিংটা দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। বেশ কয়েকটা ট্রেন বেরিয়ে গেল ঝাঁ ঝাঁ করে। রাশি উঠে দাঁড়াল। তাকে এবার বাড়ি ফিরতে হবে। এত আনন্দ ছেড়ে সে মরতে পারে না।
বাড়ি ফিরে সে দেখল মায়ের ঘুম ভেঙ্গে গেছে এর মধ্যে। বাবাও ফিরে এসেছে। দুজনে উদ্বিগ্ন মুখে ঘোরাফেরা করছে। রাশির মায়ের চোখে জল। বাবা ফোন করে চলেছে একের পর এক। এতক্ষণ সে বাড়ি ছিল না তাই দুজনে খুব চিন্তায় পড়ে গেছে খুব স্বাভাবিক ভাবেই। রাশিকে ঢুকতে দেখে দুজনেই দৌড়ে আসে। মা রাশিকে প্রথমে বুকে জড়িয়ে ধরে। বকতে গিয়েও পারে না কেঁদে ফেলে। বাবা এসে রাশির মাথায় হাত রাখে, বলে, ‘আমরা আর কখনও এমন করব না। আজ থেকে ঠিক বদলে যাব দেখিস।’ রাশি দেখল জানলায় সেই ছোট্ট হলুদ রঙের পাখিটা এসে বসেছে, ডাকছে পিক পিক।
____________
ছবি - দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী
No comments:
Post a Comment