গল্পের ম্যাজিক:: স্বপ্ন পূরণের গল্প - রম্যাণী গোস্বামী


স্বপ্ন পূরণের গল্প
রম্যাণী গোস্বামী

আড়মোড়া ভেঙে একটা ছোট্ট হাই তুলে চোখ পিটপিট করে সটান ঘড়িটার দিকে তাকিয়েই আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল টিনা’র। ঘড়িটা আদৌ চলছে তো? নাকি বন্ধ হয়ে পড়ে আছে কাল রাত এগারোটা পনেরো থেকে? বাড়িতে এত লোক। মা, বাপি, কুট্টিকাকা, ঠামি, জেজে, জেম্মা, কেউ ওকে ডাকল না একবারও? এত বেলা হয়ে গেল তাও? ওর ফেভারিট কার্টুন ‘প-পেট্রল’ মিস হয়ে গেল তাও? এমনকি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড কুটাই? সেও ওকে ভুলে গেছে? অভিমানে ঠোঁট ফুলে গেল বেচারির।
পায়ে পায়ে হল রুমে এসে রাগের পাল্লা ভারি হল আরও। সবাই গদগদ মুখে বসে আছে ডাইনিং টেবিল ঘিরেকুট্টিকাকার হাতের প্লেটে ফুলকো লুচি আর লাল লাল আলুর দম। মা কুট্টিকাকার চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে বড় এক বোল হাতে। গাজরের হালুয়া খাওয়ানোর জন্য সাধাসাধি চলছে! জেজে একবার চশমার ফাঁক দিয়ে তাকালেন টিনা’র দিকে। মুখে কিছু না বললেও টিনা জানে ওই তাকানোর মানে একটাই। সেটা হল, এই দ্যাখো, আমাদের ধাড়ি মেয়ে এতক্ষণে ঘুম থেকে উঠলেন!
মা বললেন, ব্রাশ করেছিস? আয়, দুটো লুচি খেয়ে নিবি আয়।
টিনা মোটেই সেদিকে গেল না। ওর চোখ জ্বালা করছে। বরং ধাঁ করে ঘুরে ও সেঁধিয়ে গেল ব্যালকনিতে। নীল রঙের আকাশে রোদ ঝলকাচ্ছে খুশির। রোববারের সকাল। সবাই আনন্দে মাতোয়ারা। কিন্তু টিনার মুডটাই ভালো নেই একদম। কারণটা আর কিচ্ছু নয়। ছোট থেকে যাকে নিয়ে ধস্তাধস্তি, ও ব্যাটাই, ক্লাস এইটের ফাইনাল পরীক্ষায় সেই ভয়ঙ্কর অঙ্কের পেপারটাই ওকে ডুবিয়েছে আবারও। বাকিগুলো মনে হয় উতরে গেছে ভালো মতো। কিন্তু অঙ্কে মেরেকেটেও ষাটের বেশি উঠবে না। এতবার প্র্যাকটিস করা জিনিস কিন্তু পরীক্ষার হলে বসে ঘামতে ঘামতে কেমন করে যেন সমস্ত গুলিয়ে একশা!
আর সেই খবরটা শোনার পর থেকেই বাড়ির সকলে এমনভাবে তাকাচ্ছে ওর দিকে যেন কী একটা সাঙ্ঘাতিক অপরাধ করে ফেলেছে টিনা। বাপি দুদিন প্রায় কথাই বলেন নি। বাকিরা বলছে বটে টুকটাক, কিন্তু কেমন যেন করুণা করবার মতো ভাব ভঙ্গি তাঁদেরকুট্টিকাকা গত বছরই ফিজিক্সে এমএসসি তে গোল্ড মেডেল পেয়ে এখন পিএইচডি করতে ব্যস্ত। আর এস হস্টেলে থাকেন আর সপ্তাহে একদিন করে বাড়ি আসেন। সব শুনে টুনে ওর দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছেন যেন টিনা অন্য গ্রহের এলিয়েন। মিত্তিদিদি, মানে জেজে-জেম্মার একমাত্র ডলপুতুলের মতো দেখতে মেয়ে মৃত্তিকা এখন দিল্লিতে সেটলড। সে ইকনমিকস এর প্রফেসর। জেম্মা শুনে কাঁদোকাঁদো গলায় বলেছিলেন, ওরে, আজকাল যে সবেতেই অঙ্ক জানতে হয়। তোর দিদির ফ্ল্যাটে যে কত অঙ্কের বই! দেখলে তোর মাথা ঘুরে যাবে। এই অবধি শুনেই শুকনো মুখে টিনা উঠে চলে এসেছে জেম্মাদের ঘর থেকে। রোজকার মতো ফ্রিজ খুলে জেজের এনে রাখা ক্যাডবেরি বের করে মুখে ঢোকানোর কথাটাও ভুলে গেছে বিলকুল।
আচ্ছা? জেজে কি এবার থেকে বাজার ফেরত ওর জন্য চকোলেট কিনে এনে ফ্রিজে রাখবেন আর? উহু! মনে হয় না।
টিনার ইচ্ছে করছে কোথাও চলে যেতে। দূরে কোথাও। যেখানে কেউ ওকে চিনবে না। কেউ জানবে না যে এই মেয়েটা এবার ফাইনালে ম্যাথস এ সিক্সটি পাবে। আত্রেয়ী, বিতান, অনুস্কা সব্বাই একশো তে একশো! কিন্তু পালিয়ে যাবেটা কোথায়? মামাবাড়ি চলে গেলে হয় না? ধুর! ওখানেও তো একই কথা, একই আলোচনা। তাহলে? ইস! এখন যদি সিন্ডেরেলার মতো কোনও ফেয়ারি গড মাদার আসত ওর কাছে? ভাবতে ভাবতে আকুল হয়ে টিনা শুনতে পেল কলিং বেলের আওয়াজ। তারপরই মায়ের গলা। ওর নাম ধরেই ডাকছেন মা।
পায়ে পায়ে হলরুমের দরজার কাছটিতে এল টিনা, শুকনো মুখে জোর করে একটু হাসি ফুটিয়ে। পুরো হল একেবারে গমগম করছে একজন মানুষের গলার আওয়াজে। হবে না? মানুষটা যে আর কেউ নয়, পরাশর আঙ্কল। এমন মজাদার লোক জীবনে দেখেনি টিনা। সবসময় হা-হা হাসিতে ভরিয়ে রাখেন সকলকে! খুব ভালো ছাত্র ছিলেন কিন্তু কেরিয়ার তৈরিতে কোনও আগ্রহই নেই। একাই থাকেন। লেখালেখি, লিটল ম্যাগাজিন, কবিতা ক্লাব এইসব নিয়ে আছেন। ঘ্যামা ঘ্যামা চাকরি পেয়েছিলেন কিন্তু একমাত্র এই শহর, বন্ধুদের ছেড়ে গিয়ে মন টিকল না। সুতরাং ব্যাক টু প্যাভিলিয়ান। এখন একটা খবরের কাগজের অফিসে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করেন। টিনাকে বরাবরই স্নেহ করে এসেছেন পরাশর আঙ্কল। আজও এসেছেন ইয়াব্বড় চকোলেটের বক্স হাতে নিয়ে। ইস! কী লজ্জা!
কোথায়? আমাদের টিনা ম্যাডাম? আমার যে ভীষণ দরকার আছে ওর সঙ্গে। দারুণ ব্যস্তভাবে বলছেন পরাশর আঙ্কল আর এদিক ওদিক খুঁজছেন তাকে। এত লোকজনের হট্টগোলে দরজার কোণে লুকিয়ে থাকা টিনাকে দেখতেই পাননি আঙ্কল। বাপির দিকে তাকিয়ে বললেন এবার, শোন জরুরি কথা। ‘প্রতিশ্রুতি প্রকাশনা’ থেকে ছোটদের একটা গল্প সংকলন বেরোচ্ছে এবার শিলিগুড়ি বইমেলায়। সম্পাদনায় রয়েছেন সুবিখ্যাত লেখিকা মঞ্জুশ্রী ঘোষাল, মানে আমাদের মঞ্জুদি। বারোজন লেখকের বারোটি ছোটগল্প। ওর একটা কাজেই তোদের এখানে ছুটতে ছুটতে এলাম।
বাপি নড়েচড়ে বসেছেন, ‘প্রতিশ্রুতি প্রকাশনা’? বাব্বা! এ তো বড় হাউজ। তা ওই কাজে এখানে এসেছিস মানে? বুঝতে পারলাম না।
আর বলিস না! মঞ্জুদির একটাই ডিমান্ড। ছোটদের গল্পের বইতে ছোট্ট দুটো হাতের ছোঁয়া চান উনি। প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে ভিতরের পাতার ইলাসট্রেশন, সব হবে কোনও অ্যামেচার শিশুশিল্পীকে দিয়ে আঁকানো। নামজাদা আঁকিয়েরা তো অনেক রয়েছে। সবাই চেনে তাঁদের আঁকা। তার চাইতে বরং হোক না একটু নতুনত্ব। কী বলিস? কেমন আইডিয়া?
বেশ বেশ! এবার বাপি নয়, উৎসাহের গলায় বলে উঠলেন জেজে।
হুম! মায়ের এগিয়ে দেওয়া চায়ের কাপে একটা দীর্ঘ চুমুক দিয়ে বললেন পরাশর আঙ্কল, মঞ্জুদি আমার ওপর ভার দিয়েছেন আঁকিয়ে খোঁজার। আমি খুঁজেও পেয়েছি।
খুঁজে পেয়েছেন? কাকে? কুট্টিকাকা খাবার প্লেট হাতে নিয়ে বসে পড়লেন আঙ্কলের পাশে।
কাকে আবার? আমাদের টিনা’কেওর হাতের কিছু কিছু পেনসিল স্কেচ রাখা ছিল আমার ফাইলে। মঞ্জুদিকে দেখালাম। উনি তো দারুণ ইম্প্রেসড! তবে কাজটা মোটেই সহজ নয়। গল্পের ডিমান্ড অনুযায়ী ছবি আঁকতে হবে। একটা দুটো নয়, বারোখানা। আমিও হেল্প করব যতটা পারি। প্রচ্ছদের জন্যেও খাটতে হবে খুব। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে টিনা পারবে। তা ডাকো ওকে। কোথায় সে? পরীক্ষা তো সবে শেষ হল। মামাবাড়ি চলে যায়নি তো? এইরে! তাহলে তো খুব মুশকিল!
চিন্তা চিন্তা মুখটা নিমেষেই খুশির হাসিতে ভরে উঠল পরাশর আঙ্কলের। টিনাকে এতক্ষণে দেখতে পেয়েছেন উনি। হাত বাড়িয়ে ডাকলেন, আয় আয়, জলদি আয় তোর স্কেচবুক আর পেনসিল নিয়েতোকে গল্পগুলো শোনাই। অ্যাট লিস্ট একটা ছবি কিন্তু এঁকে দিতেই হবে আজ।  মঞ্জুদি দেখতে চেয়েছেন।
টিনা থমকে দাঁড়িয়ে আছে দরজার কোণা আঁকড়ে। শীত চলে যায়নি পুরোপুরি। কিন্তু বগলের তলা ঘামছে ওর। কপালের রগ বেয়ে টপটপ করে ঘাম পড়ছে। এখন ঘরের বাকি পাঁচজোড়া গোল্লা গোল্লা চোখ চেয়ে রয়েছে ওর দিকে। মা বললেন নার্ভাস গলায়, ও... ও কি পারবে পরাশরদা? মনের আনন্দে কীসব হিজিবিজি আঁকে রাতদিন উপুড় হয়ে। আর এসব তো প্রফেশনাল আর্টিস্টদের কাজ।
আরে ভাই মনের আনন্দ ছাড়া কি ভালো কিছুর সৃজন হয়? পাওয়া যায় কি সৃষ্টির সুখ অন্তরের তাগিদ ছাড়া? কি রে? পারবি তো? আমাকে ডোবাবি না তো রে? টিনার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন পরাশর কাকু।
আসছি, একটু দাঁড়াও। প্রায় ফিসফিস করে কথাগুলো বলেই টিনা ছুটল নিজের ঘরের দিকে। ওয়ারড্রবের তৃতীয় তাকটা ওর নিজস্ব জগত। সেখান থেকে টেনে বের করে আনল আর্ট পেপার, টেন-বি পেনসিল, ইরেজার এইসব টুকরো টাকরা। জিনিসপত্র বগলদাবা করে ফিরে আসতে গিয়ে হঠাৎ চোখ পড়ল জানালার দিকে। উফ্‌, আকাশে আজ কত যে নীলের শেড! এই নীল রঙেরই প্রচ্ছদ হলে কেমন হয়?
বইমেলা জমজমাট। স্টলের সামনে বন্ধুদের ভিড়। নীল-নীল-গাঢ় নীল মলাটের বই হাতে-হাতে ঘুরছে সবার। কুট্টিকাকা কাকে যেন ডেকে দেখাচ্ছেন বইয়ের ভিতরের একটা পাতার ছবি। এই দেখো, আমাদের টিনার আঁকা সব। ছোট্ট থেকে মেয়েটা আঁকতে বড়ই ভালোবাসে যে! মা-বাপি হাসি-হাসি মুখে দাঁড়ানো। জেজে হাত ধরে আছে টিনার। জেম্মা মোবাইলে কথা বলছেন মিত্তিদিদির সঙ্গে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমাদের টিনা রে! তোকে পোস্ট করে দিয়েছি বইটা। মলাটটা যে কী সুন্দর হয়েছে! দেখিস! পরাশর আঙ্কল মুচকি হাসছেন। বলছেন, আমি জানতাম তুই পারবি। ঠিক পারবি।
চোখটা আবারও জ্বালা করে উঠল। কিন্তু এর স্বাদ আলাদা। দু’হাতের চেটো দিয়ে চোখ মুছে ফেলল টিনা। সঙ্গে সঙ্গে পায়ের কাছে একটা নরম ছোঁয়া পেয়ে চমকে উঠল। কুটাইটা কোথা থেকে দৌড়ে এসে জামা ধরে টানছে ওর। আর লেজ নাড়ছে জোরে জোরে। যেন ও বলতে চাইছে, চলো চলো, আর দেরি কীসের?
পেনসিলটা আঙুলে আঁকড়ে ধরে ছুটল টিনা, এবার ও ঠিক পারবে নিজের স্বপ্নপূরণ করতে।
____________
ছবি –দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী


লেখক পরিচিতিঃ রম্যাণী গোস্বামী - শিলিগুড়ির বাসিন্দা। পেশায় পদার্থবিদ্যার অধ্যাপিকা। লেখালেখি শুরু বছর দুয়েক আগে থেকে। ভালোবাসেন বই পড়তে, বেড়াতে যেতে এবং ফটোগ্রাফি করতে।

4 comments:

  1. বেশ ভাল লাগলো গল্পটি ।

    ReplyDelete
  2. আমারও বেশ ভাল লেগেছে । আরও চাই

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ । চেষ্টা করব অবশ্যই ...

      Delete