সময়ের নিঃশ্বাস
প্রতীক কুমার মুখার্জী
ট্যাক্সি ধরলাম উল্টোডাঙার মোড়ের কাছে, ঠিক আমার অফিসের সামনে থেকে। ক্লান্ত, তাই উঠেই সীটে শরীরটা এলিয়ে দিলাম। অনেক রাত হয়ে গেল আজ। হঠাৎ ড্রাইভারের সীটের পিছনে লেখা ট্যাক্সির নম্বরটা চোখে পড়তেই চমকে উঠলাম...
WCX 212 - ঠিকঠাক দেখছি তো? মন্দার বোসের সেই সংলাপ মনে পড়ে হাসি পেল ‘চোখে ছানি-টানি পড়ল না কি?’ এতো পুরনো নম্বর? ভাবার আগেই চিন্তাধারা গুলিয়ে দিল সামনের ভারী কণ্ঠস্বর, “কাঁহা জাঈয়েগা বাবুসাহিব?” - প্রবীণ শিখ ড্রাইভার! তড়াক করে সোজা হয়ে উঠে বসলাম - ট্যাক্সিতে ওঠার সময় এনাকে তো দেখিনি! সে ড্রাইভার তো ভীষণভাবে বাঙালী ছিলেন! যাই হোক, শুকনো গলায় কোনওক্রমে বললাম, “সল্টলেক চলিয়ে।”
সর্দারজি সটান আমার দিকে ঘুরলেন, “বাতাইয়ে না বাবুসাহিব? রাত বহুত হুয়া - হামে ভি ঘর যানা হ্যায়। মজাক মত কিজিয়ে।”
হতবাক হয়ে ভাবলাম, এতে মজা করার কী দেখলেন সর্দারজি?
আচমকা খেয়াল করলাম চারদিক আলো-আঁধারিতে ভরে গেছে। গাড়িটাও বদলে গেছে কোন মন্ত্রবলে। শিউরে উঠলাম! হাতলে চাপ দিতে দরজা খুলল উলটোমুখে! নেমে বিস্ফারিত চোখে দেখলাম, এ যে সেই বইয়ে পড়া অস্টিন 12/4LL ট্যাক্সি - আঠারো শতকের শেষের দিকে যা কলকাতায় চলত! তৎক্ষণাৎ ঘোড়ার খুরের শব্দ, একটা কিছু হুড়মুড় করে আসা, কিছু ‘গেল! গেল!’ শব্দ, দুটো বলিষ্ঠ হাতের টান - সিংজি আমায় ফিটন চাপা পড়া থেকে বাঁচালেন। সামলে নিয়ে চারদিকে তাকাতেই হতবাক - ওটা কী? ঘোড়ায় টানা ট্রাম? রাস্তাঘাট প্রায় অন্ধকার, টিমটিমে গ্যাসবাতির আলো, গাছপালা ভরা সরু রাস্তা, কোথায় গেল দোকানপাট, বাড়িঘর? লোকজন বিশেষ নেই। যা আছে যেন সেই টিভিতে দেখা প্রমথেশ বড়ুয়ার সাদাকালো সিনেমা!
অনন্যোপায় হয়ে বিকারগ্রস্ত অবস্থায় অস্টিনেই চেপে বসলাম। বুঝলাম, যেভাবেই হোক আঠারো শতকের কলিকাতায় হাজির হয়েছি! কোনওমতে বললাম, “ডালহৌসি চলিয়ে।” অন্তত ওই জায়গাটা তো আছে! চেতন ও অবচেতনের মাঝে আলো আঁধারে পুরনো কলিকাতার চেহারা দেখতে দেখতে চললাম ঢাউস জানলা দিয়ে - যা ইন্টারনেটেও দেখিনি কখনও। দিলাম হাতের উপর চিমটি - রক্ত বেরোবার দাখিল, কিন্তু দৃশ্য অপরিবর্তিত। একটা জায়গা পেরিয়ে গেলাম - অন্ধকার, ঝোপঝাড়, পানাপুকুরে ভর্তি, ঝিঁঝিঁ ডাকছে। সিংজি বললেন, “ইয়ে কাঁকুড়গাছি।”
গলার ভিতর থেকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও একটা বাক্য বেরিয়ে এল, “গুরবক্স, ডাহিনে লো গাড়ি... দুশমন পিছে সে ভি তো আ সাকতা হ্যায়!” বলতেই, গাড়ি সেই গতিতেই ঘুরে ডানদিকে বাঁক নেওয়ার সাথে সাথেই গাড়ির আয়নায় চোখ পড়ল আমার। গাড়ির পিছনের আসনে এটা কে বসে আছে? শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল!
উদ্বিগ্ন মুখে এক সম্ভ্রান্ত ও দৃপ্ত চেহারার বৃদ্ধ বসে আমার জায়গায়। উত্তেজনায় দরজার হাতল শক্ত করে ধরে আছেন। দু’চোখে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর অপেক্ষা। যতটুকু দেখতে পাচ্ছি, এনার পরনে দামি আদ্দির গিলে করা পাঞ্জাবি, গলায় সোনার চেন, হাতের প্রায় প্রতিটা আঙ্গুলেই সোনার আংটি। ঘাড় অব্দি লম্বা ধপধপে সাদা চুল উল্টে আঁচড়ানো, প্রশস্ত কপালে লম্বা সিঁদুরের টীকা আর বিশাল রাজকীয় গোঁফের সাথে মানানসই পুরুষ্টু গালপাট্টা। নিজের গালে হাত বোলাতেই সেই বৃদ্ধ একইভাবে তাঁর গালেও হাত বোলালেন! এতো ভূতুড়ে ব্যাপার!
প্রতিবিম্ব ছেড়ে নিজের দিকে তাকাতেই ভয়ে ঘেমে উঠলাম! আমার পরনেই তো ঘামে ভিজে যাওয়া বেনিয়ানের উপর জবজবে হয়ে ভিজে ওঠা দামি আদ্দির পাঞ্জাবি, সাথে ধুতি আর ‘অ্যালিগেটর স্কিন’-এর দুস্প্রাপ্য জুতোজোড়া। আতরের গন্ধে ভুরভুর করছে গাড়ির ভিতরটা। আসনের পাশে হাতির দাঁতের ছড়ি আর নানা দামি জিনিসের সাথে একটা পেটমোটা কালো চামড়ার ঝকঝকে ব্যাগ! মাথাটা আরও গুলিয়ে গেল দুটো জিনিস দেখে। একটা ঝকঝকে গুপ্তি আর চকচকে দোনলা বন্দুক!
তাহলে আমায় ধরে নিতে হয় যে ভোজবাজির এক অসামান্য মন্ত্রবলে আমি আঠারো শতকের কলিকাতায় এসে রূপান্তরিত হয়ে গেছি এক ষাটোর্ধ, মৃত্যুভয়ে ভীত এক বৃদ্ধে, যিনি প্রতি মুহূর্তে অদৃশ্য, কিন্তু অমোঘ কোনও শত্রুর হাত থেকে বাঁচতে পালাচ্ছেন তাঁর গাড়ি করে, তাঁর বিশ্বস্ত ড্রাইভারের সাহায্যে! কিন্তু তাই যদি হবে, তাহলে ড্রাইভারই বা আমায় প্রথমে কেন চিনতে পারল না আর জিগ্যেসই বা করল কেন আমি কোথায় যাব? কিচ্ছু বুঝলাম না।
হঠাৎ সামনের বাঁক থেকে গুলির মতো বেরিয়ে এল আর একটা কালো গাড়ি। আর তার সাথে নিদেনপক্ষে দশটার উপর ঘোড়া - বন্দুকবাজ! গুরবক্স সিং কোনওরকমে ব্রেক কষে আমাদের গাড়িটা ওলটানোর থেকে বাঁচিয়েই এবার অন্যদিকে চালিয়ে দিতে পারল। তবে এবার সাক্ষাৎ মৃত্যু আমাদের পিছনে। আর বাঁচার উপায় নেই। সব মনে পড়ে গেল এক লহমায়।
আমি রিষড়ার সোনারপুর গ্রামের একছত্র অধিপতি জমিদার দিগেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার। অত্যাচারী, সবরকম দোষে দুষ্ট একজন অর্থপিশাচ, নিজের কাজের জন্য মানুষ মারতে যার কোনওদিন হাত কাঁপে না। শুধু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছে অনেক দাম দিয়ে, প্রচুর কাঠখড় পুড়িয়ে, নিজের জমিদারি টিকিয়ে রেখেছি। শরীকী বিবাদের জেরে আমাদের জমিদারি প্রায় শেষের মুখে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বোলবোলাও আর আগের মতো নেই। আমাদের দেশের সমস্ত মানুষ কোমর বেঁধে লড়াই শুরু করে দিয়েছে দেশকে স্বাধীন করতে। দিকে দিকে তাই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সংগঠন ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে ওঠায় ক্ষমতার লড়াই এবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। এতদিন আমার রাজত্ব চলতো আমাদের জমিদারিতে। কিন্তু কোম্পানির শক্ত খুঁটির রাশ আলগা হতে আমার তোষামোদে তুষ্ট লাট বড়লাটরাও একে একে সাত সমুদ্র পেরিয়ে দেশে ফিরে যাচ্ছেন। আমার ছোটভাইরা এতদিন মুখ বুজে পড়েছিল আমার পায়ের তলায়। কিন্তু এবার পটবদলের পালা। আমি অত্যাচারী জমিদার হিসেবে বিশেষ কুখ্যাত, তাই আমার প্রজারাও একটা বদল চাইছিল।
আমার দিন ঘনিয়ে আসছে এ আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম। কারণ, এ যাবত আমার উপর দুবার হামলা হয়ে গেছে। আমার ভাইরা আমায় মারতে চায়, এ খবর আমি নানাদিক থেকে শুনতে পাই। তবে আজ চূড়ান্ত বিপর্যয়! ষড়যন্ত্রের খবর গোপনে পেয়েই কোনওরকমে কাগজপত্র আর সোনা নিয়ে আমি শেষ মুহূর্তে পালিয়ে কলিকাতায় আসতে পেরেছি। তবে মনে হচ্ছে শেষ রক্ষা হল না। আমার পুত্র ত্রিদিবনারায়ণকে আরেক বিশ্বস্ত লোকের হাত দিয়ে বিহারে পাঠাতে পেরেছি। জানি না আমার কী হবে!
শত্রুরা তাড়া করে আসছে। পিছনের গাড়িটা অনেক শক্তিশালী। আর ঘোড়সওয়াররাও আমাদের গাড়িকে প্রায় ধরে ফেলেছে। বুড়ো গুরবক্সও আর পেরে উঠছে না। গাড়ির আয়নার ভিতর দিয়ে ড্রাইভারের মুখটাও দেখা যায়। হঠাৎ চোখ পড়তে দেখি গুরবক্স সিংয়ের মুখে কোনওরকম আতঙ্কের ছায়া নেই। বরং তার মুখেও এক বক্র কুটিল অভিব্যক্তি ফুটে উঠছে। পরমুহূর্তেই ওর ভারী কণ্ঠ ভেসে এল, “সাহিব, হামারা পুত্তর কা কোই পতা নেহি চলা... আপনে উসকো যো পড়নে কে লিয়ে ভেজা থা?”
আমি প্রমাদ গুনলাম। হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন? ওর ছেলে আমার কোনও একটা কুকীর্তি দেখে ফেলেছিল। ঠগিদের কাছ থেকে ডাকাতির বখরা নেওয়ার সময় আর লাশ পাচার করার কথোপকথন ওই ছেলে জেনে যায়। আমি তো ওকে আমার লেঠেলদের দিয়ে গুমঘরে... তবে কি ও ব্যাপারটা জেনে গেছে? সম্বিৎ ফিরল গুরবক্সের রক্ত জল করা হাসিতে। “সাহিব, হামকো সব পতা চল গয়া। সোনারপুর মে তো আপকা কই কুছ বিগাড় নেহি সকতা... ইসিলিয়ে ইতনা দূর আনা পড়া।”
গাড়ির গতি ধীরে ধীরে কমতে লাগল। আর পিছনের গাড়ি আর বন্দুকবাজরা আমাদের গাড়িকে ঘিরে ফেলতে লাগল।
পালাবার পথ নেই। আমি বন্দুক তুলতে যেতেই গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল। সিংয়ের হাতে ততক্ষণে উঠে এসেছে চকচকে ভোজালি। তার একটা হাত আমার আস্তিন ধরতেই কাঁচ ভাঙ্গার একটা ঝনঝন শব্দ। এক ঘোড়সওয়ার তার হাতের বর্শাটা দিয়ে আমার গাড়ির পিছনের কাঁচটা ভেঙে চৌচির করে দিল এক নিমেষে!
হঠাৎ একটা মোক্ষম ঝাঁকুনি আর হর্নের আওয়াজে যেন চটকা ভেঙে উঠলাম। ডালহৌসি এসেছে। আমিও ফিরেছি ২০১৬ তে! কোথায় সিংজি আর তার ভিনটেজ গাড়ি। আর কোথায় পুরনো কলকাতা? বাঙালী ড্রাইভার আমার আস্তিন ধরে ঝাঁকাচ্ছেন, “ও দাদা, কী ব্যাপার বলুন তো আপনার? কখন থেকে ডাকাডাকি করছি! নিন নিন...এসে গেছি, ভাড়াটা দিয়ে কাটুন দেখি... রাতের বেলায় যতসব ভুলভাল লোক!”
শেষটা না বললে কেউ কিছুই বুঝবেন না। আমার নাম রাতুল মজুমদার। আমার স্বর্গত পিতার নাম ব্রতীন মজুমদার আর পিতামহ শ্রী ত্রিদিবনারায়ণ মজুমদার। আর ১৮৮২-তে নিজের ভাইদের ষড়যন্ত্রে নিজের ড্রাইভারের হাতে খুন হন আমার প্রপিতামহ, ডাকসাইটে অত্যাচারী জমিদার, কুখ্যাত শ্রী দিগেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার - কলকাতায় তাঁর গাড়ির ভিতর। সেই জমিদারিও আর নেই, সেই মানুষগুলোও হারিয়ে গেছে ইতিহাসের ধুলোয়। শুধু একঝলক নিঃশ্বাস এসে আমায় ডাইমেনশনে নিয়ে গিয়ে ফেলেছিল। সময়ের নিঃশ্বাস?
পরে খোঁজ নিয়ে আমার পরিবারের ইতিহাস ঘেঁটে জানতে পারি, ১৮৮২ সালের জুলাই মাসের ১৭ তারিখে সেই ঘটনা ঘটেছিল আমার প্রপিতামহের অভিশপ্ত জীবনে। আর আমার সাথে এই অদ্ভুতুড়ে ঘটনার তারিখও একেবারেই এক!
কী অবস্থায় বাড়ি ফিরেছিলাম সেদিন বলে কাজ নেই। তবে আগের রাত জেগে ক্ল্যদিয়া হ্যাম্মড-এর ‘Time Warped’ বই পড়াটা বিফলে যায়নি। 6th Dimension-এ বেমালুম পৌঁছে গেছিলাম এক্কেবারে উলটোডাঙ্গার মোড় থেকেই!
_____
ছবি- পুস্পেন মণ্ডল
লেখক পরিচিতিঃ জন্ম ও বেড়ে ওঠা শিল্পনগরী দুর্গাপুরে। আদি বাড়ি বিখ্যাত মোহিনীবাবুর বাগান, নলহাটি, বীরভূম। বর্তমানে কলকাতা ও ডুয়ার্সে কর্মসূত্রে যাতায়াত। রিসর্ট ও আনুষঙ্গিক ব্যবসার অবসরে আঁকা, বই, গান, ফটোগ্রাফি আর সিনেমায় ডুবে থাকেন। লেখালিখির জগতে নতুন। এই প্রথম প্রয়াস কোনও পত্রিকায়।
Ashamanno Lekha..........
ReplyDeleteBhalo Likhechho
ReplyDelete