হাওয়া কার্ড ও কল-সই
তৃষ্ণা বসাক
“মনে করে হাওয়া কার্ডটা নিস।”
“ভালো মনে করালে। ওটা আবার রিচার্জ করিয়ে নিতে হবে।”
উহহ এত কার্ড! মনে
রাখাই শক্ত। আগে ছিল মেট্রো কার্ড, ক্রেডিট
কার্ড, আধার কার্ড, কিন্তু একটু ভালো থাকার জন্য, ভালো জায়গায় এসে কী যে মুশকিলে পড়া গেছে।
প্রতিবার বেরোবার সময় জল কার্ড, বৃষ্টি
কার্ড, এডিবল চিপ কার্ড আর
সম্প্রতি আবার অক্সিজেন কার্ড। পৃথিবীতে জল,
বৃষ্টি, খাবার, অক্সিজেন যখন একদম নেই হয়ে গেল, তখন সবাই যে যার মতো ভালো জায়গায় কেটে
পড়ল। অবশ্যই যাদের ট্যাঁকের জোর ছিল, তারা যেতে পারল। আর যাদের সে জোর ছিল না,
তারা পড়ে রইল পচা পৃথিবীতে। কেউ কেউ নতুন করে গাছ লাগানো, জলের নতুন উৎস খুঁজে বার করা, চাষবাস করার নতুন নতুন পন্থা আবিষ্কার করে বেশ একরকম করে বেঁচে
রইল। কিন্তু অসুবিধে হল, যারা
নতুন জায়গায় চলে এল, তাদের।
এ একেবারেই বড়োলোকি জায়গা। এখানে সব কিছুই আছে। শুধু পয়সা ফেলার অপেক্ষা। ফেলো কড়ি
মাখো তেল ব্যবস্থা। নাড়ুর ঠাকুমা দেখেশুনে চোখ কপালে তুলে বললেন, “মাগো মা,
কোতায় যাব আমি, হাওয়া
খাওয়ার জন্যেও কড়ি গুনতে হবে?” বাড়িতে
চারজন লোক। নাড়ু, ওর
বাবা, মা আর ঠাকুমা। ঠাকুমা
এখানে কতটা মানিয়ে নিতে পারবেন, সে
নিয়ে ওদের চিন্তা ছিল। ঠাকুমা এসেওছেন বেশ কিছুদিন পরে। আসার ইচ্ছে একদমই ছিল না।
কিন্তু আসার পর দেখা গেল এই নব পর্যায়ের পৃথিবীতে ঠাকুমাই সবার আগে সুন্দর করে
মানিয়ে নিলেন। কিন্তু শুধু ওই সব জিনিসের আলাদা আলাদা কার্ড - এটাই ঠাকুমাকে অবাক
করল। বিশেষ করে যে বাতাস আমরা সহজেই টানি,
তার জন্য আবার কার্ড? যেদিন তাঁরও ঝকঝকে কার্ড দিয়ে গেল পোস্টম্যান এসে,
সেদিন তিনি অবাক হয়ে বললেন, “আমারও কার্ড লাগবে? হায়
হায়! সিনিয়র সিটিজেন বলে একটুও ছাড় নেই গা!”
সবাই বুঝিয়ে পারে
না, আরে অক্সিজেন তো আর সিনিয়র
জুনিয়র বুঝে লাগবে না, সবার
লাগবে। বাড়িতে তো সবার জন্য অক্সিজেন সাপ্লাই আসে। আলাদা কার্ড লাগে না। কিন্তু
বাইরে গেলে এই কার্ড রাখা জরুরি। সবজায়গায় তো সাপ্লাই ঠিক নেই। সাপ্লাই দেবার
নেটওয়ার্ক কাজ করে না আবার।
ঠাকুমা এখন বুঝেছেন
একটু, আর গাঁই-গুঁই করেন না, বরং যে কেউ বাইরে বেরোবার আগে মনে
করিয়ে দেন হাওয়া কার্ডটা সঙ্গে নেবার কথা। তবে মাঝেমাঝেই আক্ষেপ করেন এককাঁড়ি
টাকা খরচ করে তাঁর হাওয়া কার্ড ভরার কোনো মানেই হয় না। কারণ ঠাকুমা তো কোথাও বেরোন
না। এটা সত্যি, ঠাকুমাকে কোথাও বেরোতে হয়
না, মানে স্কুল কলেজ আপিসের
বাধ্যতামূলক বেরোনো তাঁর নেই, যেমনটা
আছে মা বাবা কিংবা নাড়ুর। এর বাইরে থাকে শখের বেড়ানো,
পার্কে, সিনেমা
বা বন্ধুর বাড়ি। পৃথিবীতে থাকতেই ঠাকুমা কোনোদিন পার্কে-টার্কে যেতেন না, আর সিনেমা তো বাড়ি বসেই দিব্যি আরামে
দেখা যায়। বাকি রইল বন্ধুর বাড়ি। তা ঠাকুমার বয়সি খুব কম মানুষই এ তল্লাটে আছেন।
যাঁরা আছেন, তাঁদের কাউকেই ঠাকুমা
চেনেন না, যেসব জায়গায় গেলে নতুন করে
বন্ধুত্ব হতে পারে, সেসব
কোথাও তিনি যাবেন না। সে কমিউনিটি মেডিটেশন সেন্টার বা সিনিয়র সিটিজেন জোন - কোথাও
না। বলতে গেলে বলবেন, “দূর
দূর ওই বুড়োদের মধ্যে গিয়ে কী করব? খালি
তো বাড়ির লোকের নিন্দে, আর
পেনশন এত কম কেন? এইসব
কথা।”
তাঁকে নাড়ু বোঝায়, “ওই সব বুড়োবুড়ি পুরোনো পৃথিবীতেই দেখা
যায়, এখানে সব লেটেস্ট মডেলের
বুড়োরা আসে। তারা পার্টি করে, এক্সপেডিশনে
যায়, তরুণদের থেকেও তরুণ তারা।
বরং তুমিই তাদের কাছে একটু বুড়ো।”
এসব কথায় বলাই
বাহুল্য ঠাকুমা খেপে গেছেন, আর
তার পর থেকে তাঁকে বাড়ি থেকে বার করে কার সাধ্য?
শুধু একমাত্র বকুলফুলের কথাতেই তাঁর মনটা ছলছল করে ওঠে। বকুলফুল
মানে ঠাকুমার সই, শ্রীমতী
চকিতা চমৎকার। নাড়ুরা চলে আসার পর নাকি তিনিই ছিলেন ঠাকুমার সর্বক্ষণের সঙ্গী। তিনি
নাকি যে-কোনোদিন এসে পড়বেন এখানে, তাঁর
কাগজপত্রে কীসব অসুবিধে আছে, সেসব
মিটে গেলেই তিনি চলে আসবেন। তাঁর বাড়ি রেডি আছে। একা লোক,
তিনকুলে কেউ নেই, দিব্যি
থাকবেন হাত-পা ছড়িয়ে, আর
ঠাকুমা মাঝে মাঝেই চলে যাবেন সেখানে বেড়াতে।
নাড়ুর বাবা শুনে
বললেন, “একা মানুষ যখন, আমাদের সঙ্গেই থাকতে পারেন দিব্যি। কত বড়ো
আমাদের বাড়ি, তিন তিনটে ঘর তো খালি পড়ে
আছে, বিজুকাকারা তো এল না শেষ
পর্যন্ত। এখানে কোনো অসুবিধে হবে না। বিজুকাকাদের দিকটা তো আলাদা করাই আছে।
মাঝখানের দরজাটা বন্ধ করলেই তো ওদিকটা আলাদা হয়ে যাচ্ছে।”
“না না আমার বকুলফুল কারোর সঙ্গে থাকবে না। সে অনেক পুথি লেখে, চিন্তা করে। সবার সঙ্গে থাকলে তার সব
ঘেঁটে যাবে। আমি কি বলিনি ভেবেছিস? কত
বললাম, বকুল আয় আমার ছেলে বউ নাতি
ভারী লক্ষ্মী, তুই আমার সঙ্গে থাকবি আয়।
দুই সই মিলে কত আমোদ হবে। তা সে ভারী ঘাড়বেঁকা। বলে পৃথিবীতে গিজগিজে ভিড়। এত বছর ছোটো
জায়গায় লোকের সঙ্গে গাদাগাদি ভিড়ে থাকলাম। এবার শেষ ক-দিন একটু ফাঁকা ফাঁকায় থাকতে
দে।”
“শেষ ক-দিন আবার কী গো ঠাকুমা? আমরা তো তোমার টপ আপ ভরে দিয়েছি। আরও একশো বছর হেসেখেলে। এটা শেষ হবার আগেই
আবার ভরে দেব। তুমি মরবেই না। তোমার বকুলফুল ভরেনি বুঝি?
আচ্ছা এখানে এলে সবার আগে আমি ওঁর এক্সপায়ারি টপ আপ আর হাওয়া
কার্ড ভরে দেব।”
ঠাকুমা এ কথা শুনে
মুচকি হাসেন। তারপর ওকে দু-খানা চন্দ্রপুলি খাওয়ন। এমনিতে তো নিত্য খাবার কোনো ঝামেলা নেই। আগে বড়ি খেতে হত। এখন শুধু রিচার্জ
করে নিতে হয়। বাড়ি বসেই করা যায়। তবু দেখা গেল খিদে পাওয়া জিনিসটা ঠিক পেট ভরা
থাকার ওপর নির্ভর করে না। কোনো কারণ ছাড়াই খিদে পায়,
বা ভালোমন্দ খাবার ইচ্ছে জাগে। খুব সুখে যেমন লোকে বলে কী
খাওয়াবি? খুব দুঃখ-হতাশাতেও ভালো
কিছু খেতে ইচ্ছে হয়। ওই রিচার্জ করে নয়, মুখে পুরে, চিবিয়ে,
চুষে, চেটে। নাড়ুর এখন যদিও সেই
খিদে পায়নি, কিন্তু ঠাকুমার যেহেতু মন
খুশি, তাই খুশি জানাবার সবচেয়ে বড়ো
উপায় হচ্ছে কিছু খাইয়ে দেওয়া। খেতে খেতে অদ্ভুত একটা আনন্দ হচ্ছিল নাড়ুর। এরকম তো
রিচার্জের সময় কক্ষনো হয় না।
২
ঠাকুমার বকুলফুল কবে
যে আসবে? তবেই নাকি ঘর থেকে বেরোবেন
ঠাকুমা। শুনলেই রাগ হয় নাড়ুর। কেন, তারা
কি সব চাঁদের জলে ভেসে এসেছে? অন্তত, তাকে ঠাকুমা একটু গ্রাহ্যির মধ্যে আনতে
পারতেন তো। বকুল ফুলের জন্যে তার আগ্রহ দেখা গেল ঠাকুমার থেকেও বেশি। তার কারণ আছে, গভীর কারণ। খাবার-দাবার ঠাকুমা যা নিয়ে
এসেছিলেন, তার স্টক তো অনন্ত নয়, এর মধ্যেই নিশ্চয় শেষ হয়ে যাবে। আর এ
এমন জিনিস যে টপ আপ ভরানো যাবে না, রিচার্জ
রিফিল কিছুই করানো যাবে না। তার ওপর আন্তঃগ্রহ ডেলিভারি সিস্টেম খুব খারাপ। আগে
যারা টোমাটো বা জুইগিতে কাজ করত, সেইসব
ছেলেমেয়েরা লিলুয়া আর চুঁচড়োর বাইরে দূরে কোথাও যেতে চায় না। যতই তাদের স্পেস বাইক
দেওয়া হোক, তারা বলে এতটা নির্জন
রাস্তায় বাইক চালাতে তাদের একদম ভালো লাগে না,
ঘন ঘন খিদেও পায়, তখন
তারা সঙ্গের যা ডেলিভারি করতে এসেছে, তার থেকেই খেতে থাকে। ফলে যখন তাদের ডেলিভারি ডেস্টিনেশনের দরজায় হাজির হয়, তখন দেখা যায় থলে বেবাক ফাঁকা। এই নিয়ে
অনেক নালিশ, চিঠি-চাপাটি করেও কোনো লাভ
হয়নি। নিঃসঙ্গ চরাচর পথে এভাবে খাওয়ার ইচ্ছে নাকি জাগতেই পারে - সমাজবিজ্ঞানীরা গবেষণায়
দেখিয়ে দিয়েছেন। তাছাড়া এতদূর কেউ আসতেও চায় না,
শুধু যে দূরত্বই প্রধান কারণ তা নয়, এখানে আসার পর নাকি তাদের বুকের মধ্যে
ফাঁত ফাঁত করে। চারদিকে বেবাক শূন্যের মধ্যে ভেসে আছে ক’টা বাড়ি, তা সে যত মজবুতই হোক না
কেন, দেখলে তাদের হাড়হিম হয়ে যায়। বাড়িগুলো
এই বুঝি পড়ে গেল, এই
বুঝি পড়ে গেল - এমন টেনশন হয় । তাই তারা হাজার লোভ দেখালেও এদিকে আসতে চায় না। তার
ওপর বাসিন্দাগুলোও ভারী অভদ্র। জল চাইলে, সঙ্গে সন্দেশ, নিদেনেপক্ষে
বাতাসা দিয়ে একগ্লাস ঠান্ডা জল দেওয়া তো দূরের কথা,
বলে কিনা তোমার ইনটেক সিস্টেমের পাসওয়ার্ডটা দাও, আমরা জল,
নাস্তা সব ভরে দিচ্ছি। মানে খেলাম না,
অথচ খাওয়া হল। না, না এসব তাদের পোষাবে না মোটেই। সুতরাং পৃথিবী থেকে হোম ডেলিভারি খুব বিরল
ঘটনা। আলেকালে কেউ এসে পড়ে, অদ্ভুত
সন্দেহজনক চেহারার লোক, নাড়ুর
ধারণা, তারা ঠিক মানুষ নয়, কিন্তু তারা যে কী তাও সে বুঝতে পারে
না। তবে তাদের আনা খাবারের স্বাদ একদম আলাদাই। এবং এইসব আসে কোনো অর্ডার ছাড়াই। কে
পাঠিয়েছে কিছুই লেখা থাকে না। দিয়ে একমুহূর্ত দাঁড়ায় না লোকটা। বলে, “আমার মেলা কাজ আছে, এখনও অনেক বাড়ি থলে বিলি বাকি।” সে
চলে যাবার পরেও দরজার কাছে সুগন্ধে ম ম করে।
নাড়ু ভেবেছিল
ঠাকুমার বকুলফুল এরকম প্রচুর খাবার নিয়ে আসবে। সে একদিন থাকতে না পেরে ঠাকুমাকে
বলল, “ও ঠাকুমা, তোমার বকুলফুল কবে আসবে গো? এদিকে য…”
সে বলতে যাচ্ছিল
খাবারের স্টক শেষের দিকে, সেটাকে
সামলে নিয়ে সে বলল, “এদিকে যে তার জন্যেও হাওয়া কার্ড রেডি রাখা আছে।”
ঠাকুমা কুলকুল করে
হেসে বলেন, “হাওয়া কার্ড? বকুলফুলের জন্যে? কালে কালে কত দেখব?”
নাড়ু তো অবাক। সে
একটু রেগেও যায়। হাওয়া কার্ড ছাড়া বাইরে বেরোনো যাবে বুঝি?
বাড়িতে না হয় সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপ্লাই আছে, কিন্তু বাইরে?
তখুনি দরজার ঘণ্টি
বাজে, আর নাড়ু ছোটে সেদিকে। দেখে
দরজায় সেই অদ্ভুত লোকটা দাঁড়িয়ে, তার
পিঠে একটা মস্ত ব্যাগ। বলে, “মণীষাদেবীকে ডাকুন, পার্সেল
আছে। সই করে নিতে হবে।”
ঠাকুমা এসে বলেন, “এসে গেছে?
দেখি কোথায় সই করতে হবে?”
“এই যে সব পার্টস ডিসম্যান্টল করা আছে। নাতিকে বলুন জুড়ে দেবে। তারপর চার্জে
বসাতে হবে। কাল থেকে রেডি হয়ে যাবে।”
ঠাকুমা ঝলমল করে
হেসে বলেন, “কাল থেকে রেডি হবে আমার
বকুলফুল? সব কাজ করবে আগের মতো? গল্প করবে?
পুথি লিখবে? চিন্তাও
করবে? আহা বড়ো ভালো মেয়ে। ছেলেরা
চলে আসার পর ওর ভরসাতেই তো এদ্দিন একা ছিলাম পৃথিবীতে। ও ‘আউট অব অর্ডার’ হতে
এখানে এলুম। কোম্পানির লোক বলল, ‘চিন্তা
নেই, লেটেস্ট আর একটা কল-সই
আপনার ঠিকানায় পৌঁছে যাবে। এসো বাবা একটু মিষ্টিমুখ করে যাও।’”
লোকটা মহা খুশি হয়
এ-কথায়। এই প্রথম এ তল্লাটে
কেউ কিছু খেতে ডাকল তাকে। কিন্তু নাড়ু খুব মুষড়ে পড়ে। যে নিজেই এসেছে ব্যাগের
মধ্যে টুকরো টুকরো হয়ে, সে
যে তার জন্যে চন্দ্রপুলি আর এলোঝেলো আনেনি ঠাকুমার মতো,
তা তো বেড়ালেও বোঝে। ঠাকুমার বকুলফুল যে একটা রোবট, কে জানত! যাব্বাবা! তাহলে সে যে হাওয়া
কার্ড রাখল বকুলফুলের জন্যে, তার
কী হবে?
----------
ছবি - অতনু দেব
আগামী পৃথিবীর কল্পিত ছবি এই গল্পে খুব সুন্দর ভাবেই এসেছে।
ReplyDelete