অপারেশন সাক্সেসফুল!
জেমস হেরিয়ট
অনুবাদ – প্রতীক কুমার মুখার্জি
সেইবার যখন ট্রিকির সঙ্গে আমার দেখা হল, সত্যিই আমি ভয়ানক দুশ্চিন্তায় পড়ে
গিয়েছিলাম। গাড়ি চালাতে চালাতে যখন আমি তাকে
দেখি, সে রাস্তায় তার মনিবের পাশে পাশে হাঁটছিল।
তার অস্বাভাবিক চেহারা চোখে পড়তেই, আমি রাস্তার পাশে গাড়িটা থামাতে বাধ্য হলাম। একেবারে বেঢপ মোটা হয়ে গিয়েছিল ট্রিকি - মনে হচ্ছিল যেন সসেজের একটা বিশাল
টুকরোকে হাওয়া দিয়ে ফুলিয়ে, সেটার
চারকোণে চারটে ঠ্যাং গুঁজে দেওয়া হয়েছে। তার দু-চোখ রক্তবর্ণ ও সেই চোখে শীতল
চাউনি, তার দুই চোয়ালের ফাঁক দিয়ে জিভটা কেমন যেন নিষ্প্রাণ অবস্থায় ঝুলে ছিল।
শ্রীমতী প্যামফ্রি তড়িঘড়ি
বোঝাতে শুরু করলেন, “মিস্টার হেরিয়ট, ও যেন
কেমন একটা নিষ্প্রভ হয়ে গেছে! দেখলে মনে হবে ওর শরীরে একফোঁটা শক্তিও আর অবশিষ্ট
নেই। আমার মনে হয়েছিল ও নির্ঘাত
অপুষ্টিতে ভুগছে, তাই ওর নিয়মিত খাবারের মাঝে মাঝে আমি কিছু বাড়তি জিনিস যোগ
করেছি, যাতে ও একটু জোর পায়। বেশি
কিছু না - ওই একটু মল্ট, একটু কড লিভার অয়েল আর রাতে ঠিকঠাক ঘুমের জন্য এক বাটি
করে হরলিক্স।”
“আমি যে মিষ্টি জাতীয় খাবারগুলো ওকে দিতে একদম বারণ
করেছিলাম, সেগুলো আর দেওয়া হয়নি তো?”
“আসলে, আমি কিছুদিনের জন্য চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু তাতে
ও এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ে, বাধ্য হয়ে আমাকে আপনার কথার অবাধ্য হতে হয়। ও তো আসলে ক্রিম কেক আর আইসক্রিম অন্ত
প্রাণ, তাই বাধ্য হয়েই ওকে আর বাধা দিতে পারিনি আমি!”
আমি মাথা নীচু করে ছোট্ট কুকুরটার দিকে তাকালাম। ওর সমস্যাটা অন্য জায়গায়। ট্রিকির
জীবনে একমাত্র সমস্যা হচ্ছে ওর প্রচণ্ড লোভ! জীবনে কখনও সে একবারের জন্যেও খাবারের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি; দিনে বা রাতে যে সময়ে, যতবারই তাকে খেতে দেওয়া হোক না কেন - সে ঠিক খাবারটা
নিয়ে লড়ে যাবে! সেই মুহূর্তে আমি ভাবছিলাম অন্য
কথা, যে কথাগুলো শ্রীমতী প্যামফ্রি আমাকে বলেছেন সেগুলো নয় - যে কথাগুলো তিনি আমার কাছ থেকে
চেপে গেছেন, সেগুলোর কথা!
“আপনি কি ওকে রোজ যথেষ্ট ছোটাছুটি, ব্যায়াম এসব করাচ্ছেন?”
“মোটামুটি রোজই যে ও আমার সঙ্গে একবার করে হাঁটতে যায়, সে
তো আপনি দেখতেই পাচ্ছেন। মুশকিল হল, আমাদের বাগানের
মালি, বুড়ো হজকিন কয়েক দিন ধরে কোমরের ব্যথায় রীতিমতো কাবু হয়ে বিছানা নিয়েছে -
তাই রিং লোফালুফিটা আপাতত বন্ধ!”
আমি যারপরনাই গম্ভীরমুখে বলার চেষ্টা করলাম, “দেখুন আমি আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি। যদি আজ থেকেই আপনি ওর খাবারের পরিমাণ অর্ধেকেরও অর্ধেকে নামিয়ে আনতে না
পারেন, আর পর্যাপ্ত পরিমাণে ছোটাছুটি ও ব্যায়াম করাতে না পারেন, আমি বলতে বাধ্য
হচ্ছি - ও কিন্তু মর্মান্তিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বে! নিজের মনকে শক্ত করে, দাঁতে
দাঁত চেপে হলেও ওকে অত্যন্ত কড়া একটা ডায়েটে রাখা প্রয়োজন।”
শ্রীমতী
প্যামফ্রি অস্থিরভাবে হাত কচলাতে থাকেন, “নিশ্চয় করব আমি, মিস্টার হেরিয়ট! আমি নিশ্চিত যে আপনি
সঠিক কথাই বলছেন, কিন্তু এই কাজটা যে বড়োই শক্ত! বড়োই কঠিন আমার পক্ষে!” এই বলে মাথা হেঁট করে রাস্তা দিয়ে সটান হাঁটতে শুরু
করলেন শ্রীমতী প্যামফ্রি - মনে
হল, যেন বাড়ি ফিরেই এই নতুন নিয়মকানুন লাগু করার জন্য প্রবলভাবে বদ্ধপরিকর উনি!
তাদের হেঁটে যাওয়ার দৃশ্যটা আমার দুশ্চিন্তা আরও বাড়িয়ে তুলল। ট্রিকি তার টুইডের কোট পরা অবস্থায়, টলমলিয়ে পা ফেলে এগিয়ে চলেছে; তার বাড়িতে একটা সম্পূর্ণ ওয়্যারড্রোব এই সমস্ত কোটে উপচে পড়ছে - শীতকালের জন্য আলাদা কোট, আর বর্ষাকালের জন্য আলাদা
আলাদা বর্ষাতি! সে কোনোমতে এগিয়ে চলেছে - তার লিশ-এর ওজনেই যেন আস্তে আস্তে সে নেতিয়ে পড়ছে! আমি আন্দাজ করলাম, শ্রীমতী প্যামফ্রির কাছ থেকে ট্রিকির স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ফোন আসাটা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।
কিছুদিনের মধ্যেই প্রত্যাশিত ফোনটা এসে পড়ল আমার কাছে। শ্রীমতী প্যামফ্রির কণ্ঠস্বরে রীতিমতো বিলাপের সুর। ট্রিকি খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে! এমনকি তার প্রিয় খাবারগুলোও ছুঁয়ে
দেখছে না সে; বরং ক্রমাগত বমি করে চলেছে। সারাদিন সে নাকি তার গালচের উপর শুয়ে শুয়ে হাঁফাচ্ছে! তাকে হাঁটাতে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না, এমনকি অন্য কিছু
করাবারও কোনো উপায় নেই, সে কিছুই
করতে চাইছে না!
আমি এই ব্যাপারে আগে থেকেই একটা ছক কষে রেখেছিলাম। ট্রিকিকে বাঁচানোর একমাত্র উপায়, ওই বাড়িটা থেকে অন্তত কিছুদিনের জন্যে হলেও তাকে বার করে আনা! আমি নিদান
হাঁকলাম - ট্রিকিকে অবিলম্বে ক্লিনিকে ভরতি করতে হবে, অন্তত দিন পনেরোর জন্য। তাকে
ডাক্তারের কড়া নজরদারির আওতায় রাখাটা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে!
আমার কথা শুনে ভদ্রমহিলা প্রায় সংজ্ঞা হারান আর কী! উনি নিশ্চিত ছিলেন যে
ট্রিকিকে যদি তিনি প্রতিদিন দেখতে না পান, তাহলে উনি শোকে জর্জরিত হয়েই মারা যাবেন।
আমি নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকলাম। ট্রিকির
অবস্থা সত্যি করেই খারাপ, এবং তাকে বাঁচিয়ে তোলার এই একমাত্র উপায়৷ যেমন ভাবা তেমন
কাজ - আমি আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করার পক্ষপাতী ছিলাম না।
তাই, শ্রীমতী প্যামফ্রির হৃদয়বিদারক, বুকফাটা হাহাকারকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, গটগটিয়ে আমার গাড়ির
দিকে হাঁটা দিলাম। আমার কোলে তখন একটা ছোটো তোয়ালেতে
মোড়া অবস্থায়, ট্রিকি নিস্তেজ অবস্থায় শুয়ে!
শ্রীমতী
প্যামফ্রির বাড়ির
যত কাজের লোক ছিল, তারা এক তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে তুলল - ট্রিকির সকালের বিছানা,
রাতের বিছানা, তার প্রিয় কুশনগুলি, অজস্র খেলনাপাতি, রাবারের রিং, ব্রেকফাস্টের বাটি,
লাঞ্চের বাটি, ডিনারের বাটি নিয়ে ছোটাছুটি শুরু করে দিল! আমার গাড়িতে কখনোই অত
জিনিস আঁটবে না বুঝে ফেলে, আমি
অবিলম্বে গাড়িতে স্টার্ট দিলাম। গাড়ির
চাকা গড়াতে শুরু করতেই, কোথা থেকে শ্রীমতী প্যামফ্রি বুকফাটা এক আর্তনাদ সহকারে ছুটে এসে গাড়ির জানলা গলিয়ে একগোছা ছোটো ছোটো
কোট ছুড়ে মারলেন। বাড়ির ড্রাইভওয়ে পেরিয়ে ডানদিকে
মোড় নেওয়ার আগে আমি লুকিং গ্লাস দিয়ে এক ঝলক তাকালাম - প্রত্যেকে সেই মুহূর্তে
চোখের জল মুছতে ব্যস্ত!
বড়ো রাস্তায় পড়ে, আমার পাশের সিটে শুয়ে হাঁফাতে থাকা ছোট্ট বেচারি
প্রাণীটার দিকে তাকাবার সুযোগ পেলাম। তার
মাথায় দুটো আদুরে চাপড় মারার সঙ্গে সঙ্গে সে নিজের ছোট্ট লেজটা নাড়াবার খুব চেষ্টা
করল! “বেচারি বুড়ো খোকা!” আমি বললাম, “সত্যিই
তোমার নড়ার ক্ষমতা নেই, কিন্তু আমি জানি কী করলে তুমি আগের মতো সুস্থ হয়ে উঠবে!”
আমার ক্লিনিকে পৌঁছোতে, সেখানে
আশ্রিত কুকুরেরা আমাদের ঘিরে ধরল। ক্লান্ত, অলস দৃষ্টিতে ট্রিকি সেই হইচই করা দলটার দিকে একবার
তাকাল, এবং তাকে নীচে নামিয়ে দিতে, কার্পেটের উপর নিশ্চল অবস্থায় পড়ে রইল। অন্যান্য কুকুরেরা তাকে কিছু সময় ধরে ঘুরেফিরে শুঁকছিল, কিন্তু তার দিক
থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে, তাকে
সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করে নিজের নিজের জায়গায় ফিরে গেল।
অন্যান্য কুকুরদের শোবার জায়গার পাশে, আমি তার জন্য একটা আরামদায়ক, গরম, বড়োসড়ো বাক্সের ব্যবস্থা করে দিলাম।
পরের দুটো দিন সে আমার কড়া নজরদারিতে থাকল, আমি তাকে
কোনো খাবার দিলাম না। তাকে শুধু পর্যাপ্ত
পরিমাণে জল খেতে দেওয়া হল। দ্বিতীয়
দিনের শেষে ট্রিকি যেন তার পারিপার্শ্বিক জিনিসপত্রের উপর কিছুটা আগ্রহ দেখাতে
শুরু করল। তৃতীয় দিনের শুরুতে, উঠোনে খেলতে থাকা অন্যান্য কুকুরদের সমবেত চিৎকার শুনে, সে অত্যন্ত করুণ স্বরে কুঁইকুঁই করতে শুরু করে দিল।
আমি উঠোনের দরজাটা খুলে দেওয়ামাত্রই, ট্রিকি তার খুদে খুদে পায়ে বেরিয়ে
পড়ল, এবং তৎক্ষণাৎ বিশাল গ্রে হাউন্ড জো ও তার দলবল তাকে ঘিরে ফেলল। তাকে উলটে ফেলে, চারিদিক থেকে তার উপর যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবার
পরে, অন্য কুকুরেরা সন্তুষ্ট হয়ে বাগানের দিকে রওনা দিল। ট্রিকি তাদের পিছনে পিছনে চলল, পা ফেলার তালে তালে তার মেদবহুল শরীরটায় ঢেউ
খেলে যেতে থাকল।
পরে, সেই দিনেই খাওয়ার সময় কুকুরদের সামনে আমি হাজির হলাম। আমার অনুচর ট্রাইস্টান একের পর এক বাটিগুলোতে কুকুরদের খাবার ঢেলে দিচ্ছিল। খাবার দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অতগুলো কুকুরের প্রাণপণে ছুটে আসার শব্দ, দুরন্ত
গতিতে বাটিগুলো থেকে খাবার চেটেপুটে খাওয়ার শব্দে চারিদিক ভরে উঠল; প্রতিটা কুকুরই
জানত যে সে যদি সময়ে নিজের খাবার শেষ করতে না পারে, তাহলে তার বাটিতে পড়ে থাকা
অবশিষ্ট খাবারের অংশটুকুর জন্য তাকে অন্যদের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সম্মুখীন
হতে হবে।
খাওয়া-দাওয়ার পর্ব মিটলে পরে, ট্রিকি চকচকে বাটিগুলোর চারপাশ দিয়ে একবার
পায়চারি করে এল, দেখা গেল দু-একটা বাটিতে সে একবার করে জিভ বুলিয়ে নিচ্ছে৷ পরের
দিন, তার জন্যে একটা বাটিতে আলাদা করে খাবার দেওয়া হয়েছিল, এবং আমি এটা দেখে খুশি
হলাম যে, বাটিতে খাবার দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে
সেও অন্যান্যদের সঙ্গে গায়ে গা মিলিয়ে খাবারের দিকে প্রাণপণে দৌড় লাগাল!
তারপর থেকেই, তার স্বাস্থ্যে অভাবনীয়
উন্নতি দেখা গেল। তাকে কখনোই কোনো ওষুধপত্রের
মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়নি, সারাদিন
ধরে সে শুধুমাত্র অন্যান্য কুকুরদের সঙ্গে ছোটাছুটি করে বেড়াতে লাগল - তাদের সঙ্গে
অবিরামভাবে খেলাধুলো চালিয়ে যেতে লাগল। অন্যরা যখন তাকে ঠেলে মাটিতে ফেলে দিত, তার গায়ের উপর উঠে খেলার ছলে
কামড়াকামড়ি করত বা সবাই মিলে কিছু একটা নিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ কাড়াকাড়ি করত, তখন তাকে
দেখে মনে হত সেগুলো সে অত্যন্ত উপভোগ করছে। অল্প
সময়ের মধ্যেই সে সেই দলের এক অপরিহার্য সদস্য হয়ে উঠল, এবং অন্যান্য বড়োসড়ো, লোমশ ও আলুথালু চেহারার কুকুরদের মধ্যে তার রেশমের মতো
চকচকে ছোট্ট শরীরটা অত্যন্ত ব্যস্তভাবে নিজের খাবারের অংশটুকু দখল করার জন্য বাঘের
মতো প্রবল বিক্রমে লড়ে যেত। রাতে
সকলের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ওরা পুরোনো মুরগির ঘরের চারপাশে মেঠো ইঁদুর শিকার
করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। ট্রিকির জীবনে এরকম সুখের
দিন আগে কখনও আসেনি সম্ভবত!
এই পুরো সময়টায়, আমাদের কর্মকাণ্ডের নেপথ্যে অত্যন্ত চিন্তান্বিতভাবে
দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন শ্রীমতী প্যামফ্রি - সারাদিনে
অসংখ্যবার ফোন করে চলেছিলেন তিনি ট্রিকির খবরাখবর নেওয়ার অছিলায়। ট্রিকির কুশনগুলো নিয়মিত উলটে-পালটে দেওয়া হচ্ছে কি না, বা আবহাওয়া অনুযায়ী তাকে সঠিক কোটগুলি পরিয়ে রাখা হচ্ছে
কি না, এই সমস্ত অবান্তর প্রশ্নগুলো আমি সযত্নে এড়িয়ে যাচ্ছিলাম; কিন্তু তাঁকে আমি
এটুকু খবর পৌঁছে দিতে পেরেছিলাম যে ট্রিকি বিপদ
কাটিয়ে উঠেছে, এবং অত্যন্ত দ্রুতগতিতে সে আরোগ্যলাভ করছে।
'আরোগ্যলাভ'-এর কথাটা শুনে যেন
শ্রীমতী প্যামফ্রি আমূল বদলে গেলেন আবার! ট্রিকি
যাতে তাড়াতাড়ি পুরোনো শক্তি ফিরে পায়, তার জন্য তিনি টাটকা ডিম পাঠিয়ে দিতে থাকলেন
- প্রতিদিন গুনে গুনে দু-ডজন করে! পরপর বেশ ক’দিন ধরে আমার অনুচরগণ ও আমি ব্রেকফাস্টে দুটো করে ডিমের পুষ্টি উদরস্থ করতে
থাকলাম। কিন্তু যখন থেকে ওয়াইনের
বোতলগুলো তাঁর তরফ থেকে এসে পড়তে লাগল, তখন থেকে আমার ক্লিনিকের পরিবেশটা কেমন হতে
পারে, তা সহজেই বোধগম্য হতে থাকল।
ট্রিকির রক্ত যাতে পরিশ্রুত হয়, তাই এই ওয়াইনের আগমন! কাজেই প্রতিদিন লাঞ্চের আগে নিয়ম করে পেয়ালা দুয়েক
ওয়াইন আর লাঞ্চের সময় আরও কয়েক পেগের যোগসাজশে আমাদের লাঞ্চগুলো বিশেষভাবে উপাদেয়
হয়ে উঠল!
শেষ পর্যন্ত যখন ব্র্যান্ডির বোতল এসে পড়তে লাগল, আমরা নিজেদের চোখের উপর
বিশ্বাস হারাতে শুরু করলাম - ওগুলো নাকি ট্রিকির শরীরের সর্বাত্মক শক্তিকে আরও বর্ধিত করবে! ফলত, বেশ কয়েক রাত ধরে ওই উৎকৃষ্ট
পানীয় আমাদের আনন্দ উৎপাদনে বড়োই সাহায্য করল।
আগামী দিনগুলি হয়ে উঠল অত্যন্ত শান্তিময় - দিনের শুরুতে ব্রেকফাস্ট শুরু হত
একটা করে বাড়তি ডিম দিয়ে, লাঞ্চে প্রতিদিনের খাবারের সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণে
উপাদেয় ওয়াইন, আর আগুনের ওম নিতে নিতে ডিনার শেষ হত খাবারের সঙ্গে ব্র্যান্ডির
রাজকীয় উপস্থিতিতে।
মাঝে মধ্যে মনে হত, ট্রিকিকে যদি পাকাপাকিভাবে আমার কাছে রেখে দেওয়া যায়,
তাহলে আমাদের পক্ষে সেটা অত্যন্ত লাভদায়ক হবে।
কিন্তু আমি জানতাম শ্রীমতী প্যামফ্রি কী পরিমাণ কষ্ট ও উৎকণ্ঠায় দিন
কাটাচ্ছেন - তাই, ঠিক পনেরো দিনের মাথায় আমি তাঁকে ফোন করে বলতে বাধ্য হলাম যে
তাঁর পরমপ্রিয় পুষ্যি, তাঁর ছোট্ট কুকুরটি
সম্পূর্ণভাবে সেরে উঠেছে, এবং চাইলে তিনি তাকে অবিলম্বে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে
পারেন।
ফোন করার মাত্র মিনিট কয়েকের মধ্যেই, আমার ক্লিনিকের বাইরে এসে দাঁড়াল
প্রায় তিরিশ ফুট লম্বা, চোখ
ধাঁধানো কালো রঙের অত্যন্ত দামি এক ধাতব
বাহন! শোফার নেমে এসে দরজা খুলে দাঁড়াতেই, আরামদায়ক অন্ধকারের মধ্যে প্রায় লুকিয়ে
থাকা শ্রীমতী প্যামফ্রির অবয়বটি
আমি আবিষ্কার করে ফেললাম। তিনি নিজের শরীরটা কাঠের মতো
শক্ত করে, হাত জোড় করে বসেছিলেন একমুখ উৎকণ্ঠা নিয়ে। তাঁর ঠোঁটদুটো মৃদু মৃদু কাঁপছিল, “ঈশ্বরের দোহাই, প্লিজ মিস্টার হেরিয়ট, দয়া করে আমাকে সত্যি কথাটা বলুন! ও কি সত্যি করে সেরে উঠেছে?”
“অবশ্যই, সে একদম ঠিক হয়ে গেছে! আপনাকে আর কষ্ট করে গাড়ি
থেকে নামতে হবে না - আমি এক্ষুনি ট্রিকিকে নিয়ে আসছি আপনার কাছে!”
আমি ক্লিনিকের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সোজা বাগানে এসে পড়লাম। একদল কুকুর সবুজ লনের মধ্যে জটলা পাকিয়ে ঘুরে ঘুরে খেলছে, এবং তাদের
মধ্যমণি হয়ে তার লম্বা লম্বা কানগুলো নাচাতে নাচাতে, লেজ নাড়তে নাড়তে লাফিয়ে চলেছে
ছোট্ট ট্রিকির মসৃণ, সোনালি শরীরটা! মাত্র এই দুই সপ্তাহের ভিতর, সে যেন কোনো ভোজবাজিতে বদলে গেছে এক সুঠাম, পেলব, পেশিবহুল চেহারার নজরকাড়া সুন্দর প্রাণীতে; সে কুকুরের দলটার সঙ্গে
রীতিমতো পাল্লা দিয়ে ছুটছে, লাফিয়ে
উঠছে আর তার বুকটা মাঝে মাঝে সবুজ ঘাসের ডগাগুলো হালকাভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে!
আমি তাকে কোলে তুলে নিয়ে, বাড়ির
মধ্যে দিয়ে ক্লিনিকের সামনের অংশে পৌঁছে গেলাম৷ গাড়ির শোফারটি তখনও হাত বাড়িয়ে
গাড়ির দরজাটা খুলে ধরে রয়েছিল৷ যখন ট্রিকির নজর গিয়ে পড়ল গাড়ির ভিতরে বসে থাকা তার
মনিবের দিকে, সে আমার কোল থেকে একটা
অবিশ্বাস্য লাফ দিয়ে, হাওয়ার মধ্যে দিয়ে ভাসতে
ভাসতে, সোজা গিয়ে পড়ল তার মনিবের কোলে! তিনি প্রচণ্ডভাবে চমকে উঠে “উফফফ!” বলে
একটা শব্দ করার পরক্ষণেই, দু-হাত দিয়ে নিজেকে ট্রিকির আদরের মারাত্মক ঘনঘটার হাত থেকে
রক্ষা করার চেষ্টায় ব্যস্ত হলেন। ট্রিকি
ততক্ষণে ভদ্রমহিলার কোল ধামসে, সারা গা ও মুখ চেটেচুটে, আদরের গর্জনে নিজের মনিবকে
রীতিমতো ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে!
এইসব ঘটনার মাঝে, আমি শোফারকে ক্লিনিকের ভিতর থেকে যাবতীয় বিছানাপত্র, খেলনাপাতি, কুশন, কোটের সম্ভার ও বাটিঘটিগুলি বার করে এনে সেই পেল্লায় গাড়িতে বোঝাই
করতে সাহায্য করলাম - যে সমস্ত জিনিসের একটাও,
একটা দিনের জন্যেও ব্যবহার করা হয়নি। মস্ত
গাড়িটা চলতে শুরু করলে, সেটার জানলা থেকে মাথা গলিয়ে দিলেন শ্রীমতী প্যামফ্রি। তাঁর চোখে জল, তাঁর ঠোঁটদুটো
তিরতির করে কাঁপছে!
“ও মিস্টার হেরিয়ট!” তিনি চিৎকার করে বললেন, “কীভাবে
যে আমি আপনার ঋণ শোধ করব, আমার
জানা নেই! এভাবে যে জটিল অপারেশনটা সাক্সেসফুল হবে, আমি তা ভাবতেও পারিনি কখনও!”
----------
কথাশিল্পী ও পশু
চিকিৎসক জেমস হেরিয়টের সৃষ্টিগুলির অন্যতম এই ছোটোগল্প ‘দ্য ট্রায়াম্ফ অফ সার্জারি’
----------
ছবি - আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment