গণ্ডোলায় গণ্ডগোল
দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী
কী কুক্ষণে যে ইউরোপ ঘুরতে এসেছিলাম। গণেশ আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত করে ছেড়েছে। নেহাত আমার মাসতুতো ভাই, নইলে একাই ঘুরতে আসা ভালো ছিল। জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ সেরে সুইজারল্যান্ডের পাহাড়ে পাহাড়ে গোটা একটা দিন কাটাব, গন্ডাখানেক ছবি তুলব, তা সে গুড়ে বালি।
একমুহূর্তও তিষ্ঠোতে দেবে না।
আজ একটা ট্রেন মিস হয়ে ইস্তক সে আমার ওপর খেপে আছে।
হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলি, “কোন গ্রাম এটা?”
“দেখতে পাচ্ছ না? কোনো ইনস্ট্রাকশন ফলো করতে পারো না। তোমার জন্য এই গণ্ডগ্রামে আজ গোটা বিকেলটা কাটাতে হবে। রাতে কোথায় থাকব কে জানে?”
“সে আমি কী করে জানব এর পরে আর ট্রেন নেই। লাইনে ঝামেলা হয়েছে। এদিকে তো এসব হয় না জানতাম। তবে গ্রামটা ভীষণ সুন্দর রে গণেশ।”
“প্লিজ আমাকে বাইরের লোকের সামনে খালি গণেশ বলবে না। এই একটু আগেই এক স্টেশন লোকের সামনে আমার নাম ধরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে যা খেলাটাই দেখালে।”
বুঝলাম গণেশের মাথা গরম। কিন্তু আমার কী দোষ? ও না হয় ইউরোপে এতদিন আছে, প্রচণ্ড জোরে দৌড়োতে আর হাঁটতে পারে। আমি একটু আলুভাতে, তারপর ইয়া বড়ো একখানা ব্যাগ নিয়েছি পিঠে। তার মধ্যে একখানা রেনকোট, একটা ছাতা, একটা জলের বোতল, হোটেল থেকে প্যাক করা আলুর পরোটা, একটু চালতার আচার, একটা সেলফি স্টিক, একটা নতুন ক্যামেরা, একটা সাজের বাক্স, এটুকু তো লাগবেই বাইরে বেরোলে।
একটা ট্রেন থেমেছে কি তার পরের ট্রেনটা বড়োজোর পাঁচ মিনিটও দাঁড়ায়নি। গণেশ অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে দৌড়ে লাফিয়ে ধাঁ করে পরের ট্রেনে উঠে পড়েছিল। আর আমি পেছনে পড়ে থাকার ভয়ে – “আমাকে ছেড়ে যাস না গণেশ। ও গণেশ,” বলতে বলতে, দুলতে দুলতে এসেছি। আর একটু হলেই আমার দম আটকে, পা পিছলে আলুর দম হয়ে যেত।
আমার জন্য গণেশকে ট্রেন থেকে নেমে পড়তে হয়েছে তাই তার খুব রাগ।
“কেন এক্সারসাইজ করো না? দুটো মানুষের খাবার খাও এদিকে একটা মানুষের মতো দম নেই। আর দম নেই তো পৃথিবী ঘুরতে আসা কেন বাপু।”
পাহাড়ি হাওয়া, সুন্দর প্রকৃতি, গোরুর গলার ঘণ্টার টুংটাং আওয়াজ - গণেশের চোখে কানে কি কিছুই যায় না। আচ্ছা বেরসিক লোক বাবা।
কী সুন্দর ছোট্ট একটা গ্রাম। নাম ওয়েঙ্গেন। রাস্তাঘাটগুলো যেন ছবির মতো।
খুব একটা শীত নেই। রাস্তার দু-ধারে লাল, নীল ফুল ফুটেছে।
পরপর অনেকগুলো রেস্তোরাঁ দেখে, বিশেষ করে পিৎজার দোকান দেখে গণেশের মাথা একটু ঠান্ডা হয়েছে বলে মনে হল।
আর একটু অপেক্ষা করলে দুটো ছবিও তুলে দিতে পারে। কী ঝামেলা যে ওকে দিয়ে ছবি তোলানো। একটা গোটা আমি কখনোই ছবিতে আসি না। কখনও মাথা, কখনও ঠ্যাং, কখনও বা আকাশ। এমনকি পাশে পায়চারি করা গোরুটার ছবিও পরোপুরি আসে, অথচ দেখা যায় আমার অর্ধেক কপাল ছবিতে কেটে গেছে।
গণেশ আমাকে ডেকে বলল, “সরু, এই সরুদি, পিৎজা খাবে? এখানে তো আর কিছু নেই দেখছি!”
আমি মাথা নেড়ে দিলাম ঢক করে। এখন গণেশের সব হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মেলাতে হবে। চোরে চোরে মাসতুতো ভাই হয়, আমরা দুজনও মাসতুতো ভাই-বোন। ও গণেশ আমি সরস্বতী। সরস্বতী থেকে ‘সরু’।
বাইরে চেয়ার টেবিল পেতে বসার চমৎকার ব্যবস্থা।
পিৎজা খেতে বসে আমি গণেশকে বললাম, “দাঁড়া একটা ভিডিয়ো করি, এখনই খেয়ে নিস না। প্লেটের একটা ছবি তুলি।”
“প্লেটের আবার ছবি তোলার কী আছে? পিৎজা ঠান্ডা হয়ে গেলে তো খাওয়াই যাবে না। উফফ!”
আমার সাধের গো প্রো ভিডিয়ো ক্যামেরা তুলে আমি ইন্টারভিউ নেওয়ার কায়দায় বলে উঠি, “উই আর এনজয়িং দিস ইনক্রেডিবলি ডিলিশিয়াস পিৎজা টুগেদার, মি এন্ড গ গ মাই ব্রাদার।”
গণেশ বিরক্ত হলেও ক্যামেরার সামনে এলে একেবারে বদলে যায়। এগারো সেকেণ্ড চওড়া একটা হাসি দিয়ে লজ্জা লজ্জা মুখ করে গণেশ বলল, “ইয়েস উই আর, রিয়েলি চার্মিং প্লেস।”
এইসব চলছে, এমন সময় দেখি আমাদের দিকে লক্ষ্য করে দূর থেকে একটা কালো পাহাড়ের মতো লোক এগিয়ে আসছে। চোখদুটো রীতিমতো লাল, মুখটা থমথমে। সাক্ষাৎ যমদূতের মতো দেখতে।
লোকটা এগিয়ে এসে চাপা গলায় ইংরেজিতে বলল, “আপনারা আমার ছবি তুলছিলেন কেন?”
“আপনার ছবি? কী বলছেন? আমরা তো নিজেদের ভিডিয়ো করছি,” আমি বললাম।
লোকটা তাতেও নিরস্ত না হয়ে বলল, “কই দেখান।”
এবারে গণেশ গেছে খেপে।
উঠে দাঁড়িয়ে চোখ সরু করে বলল, “দেখাব মানে? আপনি কোথাকার কে যে আপনাকে ক্যামেরা দেখাতে হবে? প্লিজ গেট লস্ট।”
এইবারে একটা ঝামেলা শুরু হতে চলেছে বুঝতে পারলাম আমি। গণেশের মারামারিতে খুব উৎসাহ। রোমে ঘুরতে গিয়ে একজনের ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে দিয়েছিল। পোর্তুগালে এক চোরকে হাতে-নাতে ধরে ফেলে কান ধরে ওঠবোস করিয়েছিল। এসব গল্প সে ফলাও করে বলে বেড়ায়।
এদিকে লোকটা আগুনের চোখে গণেশের দিকে তাকিয়ে আছে, গণেশও দেখলাম হাত মুঠো করছে। আর আমি বিল মিটিয়ে পালাতে পারলে বাঁচি।
ঠিক সেই সময় ওয়েটার এসে পড়ায় লোকটা চট করে সরে গেল।
আমিও বিল মিটিয়ে গণেশের হাত ধরে টানতে লাগলাম। লোকটাকে আর দেখতে পেলাম না। এই গ্রামে আর নয়।
ওপরে পাহাড়ে আরও এক গ্রাম আছে। সেখানে গণ্ডোলা যাচ্ছে। বেশ ভিড় আর লাইন সেখানে। আমরা যেতেই যেটা গেল অনেক ভিড় হল সেখানে। ভাবলাম সেটা ছেড়ে দেওয়াই ভালো। তারপর শুনলাম পরেরটাই লাস্ট গণ্ডোলা। উপরের স্টেশন থেকে সন্ধেয় একটা ট্রেন পাওয়া যেতেও পারে। গণ্ডোলায় চড়ে দেখি এ যে সেই লোকটা।
এতক্ষণ আমাদের দুজনকে চুপি চুপি ফলো করেছে মনে হয়। গণেশের মুখ থমথমে। আমাকে ফিসফিস করে বলল, “লেট্ মি হ্যাণ্ডেল দিস। এরকম অনেক গুন্ডা সিধে করেছি।”
লোকটা আমাদের দিকে এগিয়ে এসে ইশারায় বলল ভিডিয়ো ক্যামেরাটা ওকে দিতে।
গণেশ আবার আর্গুমেন্ট দিতে যাচ্ছিল।
লোকটা গণেশের দিকে সরে এসে বলল, “লেট্ মি গিভ ইউ এ ভেরি গুড এডভাইস, নতুন দেশে তোমাদের দেশের নিয়ম-কানুন চলে না। কারোর ছবি তার অনুমতি ছাড়া তোলা যায় না।”
গণেশেও তার চোখ স্থির রেখে বলল, “আপনার উপদেশ চাই না। গেট লস্ট।”
এদিকে আমি গণেশের পেছন থেকে নীরবে করজোড়ে লোকটাকে কাকুতি-মিনতি জানাচ্ছি। লোকটা আড়চোখে সেদিকে তাকিয়ে বলল, “সঙ্গে মহিলা আছে তাই।”
“নইলে কী?”
গণেশ এবার লোকটার দিকে ঘুষি বাগিয়ে এগিয়ে গেল। লোকটা তক্ষুনি গণেশের হাত ধরে পেঁচিয়ে ওকে ছিটকে ফেলে আমার ভিডিয়ো ক্যামেরার দিকে এগোল।
আমার সাধের ক্যামেরা, তাতে কত না ভিডিয়ো আর ছবি আছে, চোখ বন্ধ করে মা দুর্গার কথা স্মরণ করে দিলাম একটা থাপ্পড়। কী আশ্চর্য! প্রকাণ্ড লোকটা ধড়াম করে পড়ে গেল। সেলফি নিয়ে নিয়ে আঙুলের পেশি যে এত মজবুত করে ফেলেছি বুঝতে পারিনি।
ওদিকে গণ্ডোলা থেমে গেছে। ওদিক থেকে দুজন পুলিশ ছুটে এল। গণেশ একদিকে এলিয়ে পড়েছে। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে সেও উঠে দাঁড়াল।
লোকটাকে দেখে পুলিশ বলল, “এ তো কুখ্যাত গ্যাংস্টার ডন ডেভিল। বারোটা দেশের পুলিশ একে খুঁজছে। আপনি তো পুরস্কার পাবেন। দশ হাজার ইউরো।”
সে যে কী আনন্দ আমার। আরও পাঁচটা দেশে সোলো ট্রিপের প্ল্যান করলাম। কনফিডেন্স বেড়ে গেছে এবারে। আর গণেশকেও দরকার হবে না।
কিন্তু কী আশ্চর্য, দেশে ফিরে আমার বোনঝিদের এ গল্প শোনাতে তারা বলল, “ও সব জানা আছে, গণেশ মামাও অনেক এরকম গল্প দেয়।”
----------
ছবি - স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়
খুব সুন্দর গল্পটা । চমৎকার লাগলো।
ReplyDelete