হেল্পলাইন
দেবব্রত দাশ
এক
অনেকদিন
ধরেই সুকান্তর কাছে একই কাঁদুনি গাইছেন ইলা প্রায় প্রতিদিন... কখনও সকালে, কোনোদিন চেম্বার
থেকে ফিরলে... আর রোববারগুলোতে তো দিনভর। আজ সুকান্ত
সবে দাড়ি-টাড়ি কামিয়ে শেভিং-এর সরঞ্জাম গুছিয়ে তুলে রাখছেন, তখন ইলা যেই আবার সেই অভিযোগের তির তাঁর দিকে ছুড়বার জন্যে প্রস্তুতি
নিয়েছেন, তখন তিনি হঠাৎই বিদ্রোহ করলেন, “আবার শুরু করলে তো! এবার
আমি হয় পাগল হয়ে যাব, নয়তো সন্নিসী হয়ে হিমালয়ে গিয়ে আশ্রয়
নেব।”
“আচ্ছা সুকান্ত, মানুষ তো স্ত্রীর
কথায় গুরুত্ব দেয়, কথা দিয়ে কথা রাখে... তুমি কী গো!” ঝাঁঝিয়ে ওঠেন
ইলা, “সেই কবে অতিমারি-আবহের আগের বছর বস্টনে গিয়েছিলাম মেয়ে-জামাইয়ের বাড়ি, তারপর তো দেখতে দেখতে তিন বছর হতে চলল... কেন তুমি খামোখা কথা দিয়েছিলে বলো তো - ২০২১ শেষ হওয়ার আগেই সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে
যাব রমুর কাছে?
“তা - তোমার ভাবগতিক
দেখে মনে হচ্ছে, ২০২২-টাও ‘তা না
না না’ করে পার করে দেবে... যেমন গয়ংগচ্ছ ভাব তোমার, কী আর
বলব! আমার কথা এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে
বের করে দিচ্ছ... তার চেয়ে বরং...”
“না না - তুমি একদম নিশ্চিন্ত
থাকো ইলা,” আপসের পথে হাঁটেন সুকান্ত, “আমি এবার অগস্টের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহের কোনো একটা দিনের
ফ্লাইটের টিকিট কেটে ফেলবই ফেলব। পাক্কা
তিন মাস, বুঝলে? পুরো সেপ্টেম্বর-অক্টোবর বস্টনে থেকে নভেম্বর-শেষে ওদেশে জাঁকিয়ে শীত পড়বার আগেই ফিরে আসব কলকাতায় আগের বারের
মতন। এখন আর ঘ্যানঘ্যান কোরো না একদম, চেম্বার থেকে ফিরে আসি... তারপর
তোমার সঙ্গে আলোচনা করে দিনক্ষণ একেবারে পাকা করে ফেলব।”
“বলছ বটে, কিন্তু বিশ্বেস
হচ্ছে না ঠিক,” বলে ওঠেন ইলা, “এমন কথা তুমি এর আগেও দিয়েছ অনেকবার ...যাক গে, আমি এবার কথার
খেলাপ হলে আর তোমার মুখ চেয়ে বসে থাকব না কিন্তু, একাই
চলে যাব। রমুকে বলব - টিকিট
কেটে ‘হোয়াটস অ্যাপ’-এ পাঠিয়ে
দিতে, ওখানে এয়ারপোর্ট থেকে রমু বা জামাই এসে
আমাকে নিয়ে যাবে অ্যাক্টন-এ ওদের বাড়ি।”
“'অ্যাক্টন' নামটা বললে বলে
মনে পড়ে গেল তিন বছর আগের কথা... খুদে একরত্তি
দাদুভাইয়ের কথা...”
“হ্যাঁ, এখন কী দস্যি
হয়ে উঠেছে কুবলাই সোনা দেখেছ!” মাঝপথে সুকান্তকে
থামিয়ে দিয়ে বলে ওঠেন ইলা, “ভিডিয়ো কল-এ
দেখায় কী আর মন ভরে বলো! নাতিকে কোলে
নিয়ে আদর করতে ইচ্ছে করে না তোমার?”
“করে বই-কি... কিন্তু আমার প্রফেশনে কতখানি দায়িত্ব নিয়ে পেশেন্টদের ভালোমন্দের
দিকে নজর রাখতে হয় - ঝক্কি কতখানি, তা বোধহয় মাথায় থাকে না তোমার!”
“থাকে বলেই বলছি, আমার দুই বান্ধবীর
হাজব্যান্ডই ডাক্তার, তাদের একজন তো গতমাসেই গেল বিদেশে ছেলের
কাছে। তোমার মতো এত দায়িত্ব-সচেতন আর কাউকে
আমি অন্তত দেখিনি।”
“হ্যাঁ ঠিকই বলেছ, এই যে আমি আমার
নিজের গাঁয়ের চেম্বারে গিয়ে সপ্তাহে দু-দিন গরিবগুর্বো অসুস্থ মানুষদের নামমাত্র ফি
নিয়ে চিকিৎসা করি, এটা খুব বেশি সংখ্যক ডাক্তার করে না।”
ইলা
এবার চুপ করে যান, মানে থামতে বাধ্য হন। এরকম
মানবিক হওয়ার দরুন ডক্টর সুকান্ত রায়কে পাড়াপড়শিরা কতখানি সম্মানের চোখে দ্যাখে, তা তো তিনি বিলক্ষণ জানেন। আর সেজন্যে
সহধর্মিণী হিসেবে মনে মনে গর্ব অনুভবও করেন।
দুই
শেষপর্যন্ত
অগস্টের একেবারে গোড়ার দিকে দমদমের নেতাজি বিমানবন্দর থেকে বস্টনগামী বিমানে ইলাকে
নিয়ে সুকান্ত চেপে বসতে পারলেন এক মেঘমেদুর অপরাহ্ণে। দিল্লি
হয়ে প্রথমে যেতে হল লন্ডনের হিথরো এয়ারপোর্টে। সেখান
থেকে পাড়ি দিতে হল দীর্ঘ আকাশপথ। অতলান্তিক মহাসমুদ্র
পার হয়ে তবে উত্তর আমেরিকা মহাদেশ। আর তারও পরে
অনেকটা দূরে বস্টন শহর। রম্যাণিরা বস্টন শহরের শহরতলি অ্যাক্টনে
থাকে। ম্যাসাচুসেটস প্রদেশের রাজধানী বস্টন
থেকে পশ্চিম উত্তর-পশ্চিমে ‘মিডলসেক্স কাউন্টি’-র অন্তর্গত কমবেশি ৩৪ কিলোমিটার দূরে অ্যাক্টনের অবস্থান। সবুজে
ছাওয়া সাজানো-গোছানো কোলাহলমুক্ত নিরিবিলি এই শহরতলি শান্তিতে বাসের
পক্ষে উপযোগী। প্রথমবার এসেই খুব ভালো লেগেছিল সুকান্ত-ইলার। এখানকার
বাসিন্দাদের মধ্যে প্রায় প্রত্যেকেরই উদ্যানসহ ভিলা আছে।
সুকান্তর
একসময়ের অন্তরঙ্গ সহপাঠী তমাল বক্সির একমাত্র পুত্র সুস্নাত বস্টনে কর্মরত ইঞ্জিনিয়ার। অত্যন্ত
মেধাবী। বছর দশেক আগেই এসেছিল সে এদেশে। সুস্নাতর
সঙ্গে রম্যাণির সম্বন্ধ করে বিয়ে দিয়েছেন সুকান্ত সাত বছর আগে। কম্পিউটার
সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করে রম্যাণিও তখন এমসিএ ডিগ্রি পেয়েছে, কিন্তু বিয়েতে তার পূর্ণ সম্মতি ছিল। স্বেচ্ছায়
দূর বিদেশে হাউসওয়াইফ হিসেবে চুটিয়ে সংসার করতেই আগ্রহী রম্যাণি, সচরাচর যা নবীন প্রজন্মের মেয়েদের ক্ষেত্রে দেখা যায় না।
তমাল
আর তার স্ত্রী কাবেরী তাঁদের মতোই বছরে অন্তত একবার ছেলে-বউয়ের কাছে অ্যাক্টনে গিয়ে
অন্তত মাসদুয়েক কাটিয়ে আসেন। নাতি কুবলাই-এর
জন্মের পরে পরেই অবশ্য তাঁরা টানা ছ-মাস থেকেছিলেন।
এবার
অ্যাক্টনে পৌঁছে দু-তিন দিনে ‘জেট
ল্যাগ’ কাটিয়ে খুব অল্প সময়েই চারবছর বয়সি নাতি
কুবলাইয়ের সঙ্গে দাদু-দিদিমা ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলেন, বিশেষ
করে দিদিমা ইলা, ইলা তো নাতিকে চোখে হারাতে থাকেন প্রতি
মুহূর্তে।
দিন
পনেরো পার হয়ে গেল নতুন দেশের এই শহরতলির মনোরম পরিবেশে। অগস্টে
অ্যাক্টনের আবহাওয়ায় গরমের দেশ থেকে যাওয়া প্রবীণ দুজন মানুষের পক্ষে মানিয়ে নিতে অসুবিধে
হল না একটুও। এসময় কলকাতায় বরং গুমোট ভ্যাপসা আবহাওয়া
প্রতি বছরই তাঁদেরকে জ্বরজ্বালা-সর্দিকাশিতে
কাবু করে ফেলে।
ইলা
সুকান্তর উদ্দেশে বললেন, “এ সময় তোমাকে
কলকাতায় কিন্তু ইনহেলার নিতে হয়, অথচ এখানে...”
“হ্যাঁ, কিন্তু এখানকার
ডিসেম্বর-জানুয়ারির শীত আমি সহ্য করতে পারব না,” ইলাকে
থামিয়ে দিয়ে বলে ওঠেন সুকান্ত, “ছবিতে দ্যাখোনি
তুষারপাতের ফলে চারপাশ কেমন সাদা হয়ে থাকে!”
“কিন্তু সে তো বাইরে, ঘরের
ভেতরে ‘সেন্ট্রাল এয়ার কন্ডিশনিং’-এর দৌলতে কোনো কষ্টই হয় না, বলেছে
রমু।”
“বলেছে জানি,” সুকান্ত বলেন, “ঘরবন্দি হয়ে বসে থাকাটা আমার ধাতে পোষাবে না বলে রমুর বিয়ের
পর প্রথম বছরে ডিসেম্বরে যে আমি আসতে রাজি হইনি, তা তো
তুমি জানো ইলা।”
এর পর একমাসের
মাথায় একটা কাণ্ড ঘটল আচমকাই। একদিন শেষরাতে
টয়লেট থেকে ফেরার সময় ড্রয়িংরুমে ঢুকে সুকান্ত চার্জ-এ দিয়ে
রাখা তাঁর মোবাইল ফোন দেখতে গিয়ে দেখলেন শতকরা ১০০ ভাগ চার্জ হয়ে গেছে। দেখে
প্লাগ-পয়েন্টে লাগানো কর্ড থেকে মোবাইল-সেটটা বিচ্ছিন্ন
করে নিজেদের শোওয়ার ঘরের টেবিলে এনে রাখলেন। যদিও এ সময় ঘুম
আর আসবে না, তবু উঠে কিছু করার নেই বলে শুয়েই রইলেন
তিনি। বাইরে ভোরের পাখিদের কলকাকলি শুনতে শুনতে
হয়তো চোখের পাতা লেগে গিয়ে থাকবে, ফোন বেজে ওঠার
শব্দে ধড়মড় করে উঠে বসলেন সুকান্ত। ইলারও ঘুম ভেঙে
গেল সে শব্দে। হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে ফোন তুলে নিয়ে
কল রিসিভ করতেই কানে এল আমেরিকান উচ্চারণে যে কথাগুলো, তার
বাংলা করলে দাঁড়ায় - আমরা অ্যাক্টনের পুলিশ, আপনার সাহায্যের জন্যে চলে এসেছি। আপনি
ড্রয়িংরুমে চলে আসুন।
কী কাণ্ড! পুলিশ কেন! ভাবতে ভাবতে
খাট থেকে নেমে ড্রয়িংরুমে ঢুকে বন্ধ দরজার কাছে যেতেই স্বচ্ছ অভঙ্গুর কাচের ভিতর দিয়ে
বাইরে নজর গেল সুকান্তর, তিনি দেখলেন - জনাকয়েক পুলিশ
দাঁড়িয়ে আর রাস্তায় নীলবাতি-লাগানো পুলিশের
গাড়ি। একজন মেয়ে-পুলিশও
রয়েছে দলে। ততক্ষণে উঠে এসে সুকান্তর পেছনে দাঁড়িয়েছে
রম্যাণি আর ইলাও খাট থেকে নেমে পায়ে পায়ে এসে গিয়েছেন।
পুলিশের
কর্তাব্যক্তিটি ফোনে বললেন, “আপনি ‘ইমার্জেন্সি কল’ করেছেন বলেই
এসেছি আমরা, কী বিপদ ঘটেছে বলুন আমাদেরকে।”
রম্যাণির
জিজ্ঞাসার উত্তরে সুকান্ত বললেন, “আমি কিছুক্ষণ
আগে চার্জার থেকে ফোন খুলেছিলাম বটে, তখন কি... বুঝতে পারছি না রে রমু, আমি
তো কিছু করেছি বলে মনে পড়ছে না...”
সুকান্তর
হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে রম্যাণি পুলিশকে বলল, “না - কোনো বিপদই ঘটেনি।”
কিন্তু
নাছোড় পুলিশকর্তা চাপ দেন, “সব ঘর... এমনকি কিচেন, টয়লেট - সব দেখুন।”
শেষমেশ
যখন দেখে-টেখে এসে জানানো হল - এভরিথিং অলরাইট, তখন পুলিশ বিদায় নিল বটে, যাওয়ার
আগে বলে গেল - এরপর যদি কোনো বিপদ ঘটে, সঙ্গে সঙ্গে ফোন করবেন কিন্তু।
“আসলে, নির্ঘাত ‘ইমার্জেন্সি কল’-লেখাটা মোবাইল-স্ক্রিনে
ফুটে উঠেছিল এবং বাপি - নির্ঘাত তোমার
আঙুলের ছোঁয়া লেগেছিল সে-লেখার ওপর।”
যাই
হোক, দিন পনেরো পরে আবার বিপত্তি। এবারকার
ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান কুবলাইয়ের। এক শনিবারের
সকালে ছুটির দিন বলে সুস্নাত রয়েছে বাড়িতে, কুবলাই
বায়না ধরল খেলবে। ব্রেকফাস্টে পছন্দের খাবার না পেয়ে মনমেজাজ
তার এমনিতেই বিগড়েছে। আসলে, অনলাইনে
সব পাওয়া গেলেও মন ভরে না রম্যাণির, তাই সে দেখেশুনে
কিনতে বেরোয় মাঝে-মধ্যে, এবার দেরি হয়ে
গেছে বলে অনেক কিছুই নেই ভাঁড়ারে।
সুস্নাত
ঘর-লাগোয়া ‘ডেক’ টেনে বাইরে বের করে কুবলাইকে নিয়ে সেখানে গেল। ব্যালকনির
সঙ্গে ‘ডেক’-এর তফাত হল
- ঘরের দরজা খুলে ‘ডেক’ টেনে বের করা
যায়, আবার গুটিয়ে রাখাও যায় আর এর চারপাশ স্বচ্ছ
অভঙ্গুর কাচ দিয়ে আটকানো, প্রায় ১২ ফুট
বাই ১০ ফুট মতন জায়গা।
‘ডেক’-এ দাঁড়িয়ে দুমদাম
শব্দে ফুটবল পেটাতে শুরু করল কুবলাই আর বল তুলে নিয়ে তার দিকে বারবার ছুড়ে দিতে থাকে
সুস্নাত।
এদিকে, রম্যাণি বেরিয়েছে বাইরে কেনাকাটা করতে। কুবলাইয়ের
মেজাজ ফুটবল পিটিয়েও শান্ত তো হলই না, বরং উত্তরোত্তর
আরও তিরিক্ষে হয়ে উঠল। সে ভয়ানক চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে লম্ফঝম্প করতে থাকে একনাগাড়ে। তারপর
হঠাৎ বলে ওঠে, “বাপি আমাকে টেডি এনে দাও।”
“টেডি তো পাশের ঘরেই আছে, নিয়ে
আয় গিয়ে।”
“না - আমার ওই টেডি
ছিঁড়ে গেছে, নতুন কিনে এনে দাও তুমি এখনই।”
অনেক
ভুলিয়ে-ভালিয়ে পরে এনে দেব বলেও ব্যর্থ হয়ে অগত্যা সুস্নাত
বেরোল।
সে বেরোনোর
পর রম্যাণি সবে ঘরে ফিরেছে, তখন হঠাৎ 911 নম্বর থেকে পুলিশের ফোন। কী ব্যাপার?
অভিযোগ - শিশু-নির্যাতন।
রম্যাণি
আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে জবাব দিল, “wrong information”।
তারপর, ফোন হোল্ডে রেখে সুকান্তকে জিজ্ঞেস করল, “বাপি, তোমার জামাই
কি ডেক-এ দাঁড়িয়ে কুবুকে বকাবকি করেছিল?”
“না রে রমু, একদম নয়। তবে
হ্যাঁ, কুবলাই খুবই লম্ফঝম্প করছিল আর ভয়ানক
চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলেছিল!”
“ওহ্! বুঝেছি,” রম্যাণি বিরক্তি প্রকাশ করে, “ডিসগাস্টিং! তাহলে, কোনো প্রতিবেশী
হয়তো 911-এ...।”
কুবলাই
ততক্ষণে বিপদ বুঝে তার দিদিমার নিরাপদ আশ্রয়ে মুখ লুকিয়েছে।
তিন
মাসখানেক
পর... অক্টোবর শেষ হতে
আর মাত্র দিনকয়েক বাকি... নভেম্বরের দ্বিতীয়
সপ্তাহের শুরুতেই কলকাতায় ফেরার ফ্লাইট... এই সময় এদেশের
মেপল-পাতায় রং লাগে, আশ্চর্য রংবাহার! প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে সুকান্তর মনেও লাগে রঙের ঝিলিমিলি। দিন
যত যাচ্ছে, বাড়ছে ঠান্ডাও। উলেন
সোয়েটার চাপাতে হচ্ছে গায়ে। হিমেল হাওয়ার
কনকনানি উপভোগ করেন সুকান্ত, ফেরার সময় অবশ্য
রোদ উঠে গেলে তাপমাত্রা ঊর্ধ্বমুখী হয়।
একদিন
মনের আনন্দে হাঁটতে হাঁটতে এতটা দূরে চলে গেলেন, যা আগে
কখনও যাননি। আসলে, আড়াআড়ি
এসে মেশা রাস্তায় অজস্র ‘মেপল ট্রি’ দেখে এমনই উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েছিলেন তিনি যে, ফেরার রাস্তা মনে রাখতে পারবেন কিনা - তা মাথা থেকে বেরিয়ে গেল।
এভাবেই
এল অপ্রত্যাশিত বিপদ। ফেরার সময় খানিক দূরত্ব অতিক্রম করতেই
বুঝলেন যে, পথ ভুল করেছেন। এদিকে
মুশকিল এটাই যে, নিজের মোবাইল ফোন ঘরের চৌহদ্দিতে ‘ওয়াই ফাই’-ব্যবহারে চালু
থাকলেও বাইরে ‘মোবাইল ডাটা’-সংযোগের
ব্যবস্থা তিনি করেননি আর ওই কারণেই কাউকে জিজ্ঞেস করা ছাড়া
অন্য কোনো উপায়ই নেই।
একজন
মধ্যবয়সি পথচারীকে সামনে দেখতে পেয়েই নিজের ঠিকানা জানিয়ে সাহায্য চাইলেন। তিনি
তাঁর আমেরিকান উচ্চারণে যা যা বললেন, তা সুকান্তর
কানে ঢুকলেও পুরোটারই মাথামুন্ডু মালুম হল না। এরপর
আর এক পথচারী কিঞ্চিৎ বেশি সময় ব্যয় করলেন, অঙ্গুলি নির্দেশ করে কোন পথে গিয়ে কত বার কোন দিকে টার্ন নিতে
হবে, তা ‘জলবৎ
তরলং’ করে দেওয়ার ভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন। কিন্তু
তাও বেকার গেল।
আর একটু
এগিয়ে যেতেই দেখলেন ‘ফেডেক্স ক্যুরিয়ার সার্ভিস’-এর গাড়ি আসছে। হাত দেখিয়ে দাঁড়
করাতেই ড্রাইভারের আসন থেকে নেমে এল এক সুদর্শন তরুণ। এর উচ্চারণ
বোধগম্য হল। ছেলেটি মেক্সিকান। সমস্যা
বুঝে নিয়ে সে বলল, “নো টেনশন স্যার, আপনি এই গাড়িতে উঠে বসুন, আমি
দু-জায়গায় ডেলিভারি দিয়ে আপনার বাড়ির দিকেই যাব।”
দোনামনা
কাটিয়ে সুকান্ত উঠলেন গাড়িতে এবং প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে সে যখন মেয়ে-জামাইয়ের বাড়ির
গেটে তাঁকে নামাল, ততক্ষণে রম্যাণি আর ইলা কুবলাইকে সঙ্গে
নিয়ে সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে। দাদুকে দেখে
কুবলাই ছুটে এসে তাঁকে জাপটে ধরল আর ইলার কণ্ঠ থেকে সমানে অগ্নিবর্ষী বাণ নিক্ষিপ্ত
হতে থাকে, “আক্কেলটা কী তোমার বলো দেখি! আর একটু দেরি হলে রমু তো 911–এ ফোন
করতে যাচ্ছিল... মেয়েটা তোমার চিন্তায় ঘর-বার করতে করতে এত বেলা অবধি না খেয়ে রয়েছে, তুমি কী বলো তো! সন্তানের প্রতি
তোমার একটুও মায়া-মমতা...”
“মা - থামো এবার, কী শুরু করেছ বলো তো!” ক্ষুব্ধ
রম্যাণি ইলাকে থামিয়ে দিয়ে বলে ওঠে, “বাপি তো শেষমেশ
নিরাপদে ফিরে এসেছে আমাদের কাছে!”
----------
ছবি - সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
No comments:
Post a Comment