গল্প:: পাখিদাদু - বুমা ব্যানার্জী দাস


পাখিদাদু
বুমা ব্যানার্জী দাস

স্কুলে যাওয়ার পথে লোকটাকে প্রথমবার দেখেছিলাম দিনটা ছিল মঙ্গলবার, নাকি বুধবার মোটমাট অঙ্ক পরীক্ষা ছিল ফার্স্ট পিরিয়ডে ক্যাপটেন আর আমি একটু ধীরে সুস্থে হাঁটছিলাম, মিস আগের দিন কড়া চোখে তাকিয়ে বলেছিলেন, যে লেট করবে তার পরীক্ষা ক্যানসেলড গার্জিয়ান কলও হতে পারে আমার আবার এমন অবস্থা যে পরীক্ষাটা দিলেও গার্জিয়ান কল হওয়া বিচিত্র নয়, তাই একটু ধীরেই হাঁটছিলাম কোনোভাবে মিনিট দশেক লেট করতে পারলেই কেল্লা ফতে ক্যাপটেনের অবস্থাও কতকটা তাই আরে না না, ও ক্লাস ক্যাপটেন-ট্যাপটেন নয়, সে তো ওই গোমড়ামুখো অরিন্দ্র এই ক্যাপটেন মানে আমার জিগরি দোস্ত সমু, মানে সৌমিক দিদিও তার প্রাণের বন্ধুর সঙ্গে যাচ্ছিল আমার খানিকটা আগে, পিছন ফিরে কপাল কুঁচকে তাকাচ্ছিলও অর্থাৎ তাড়াতাড়ি হাঁট দিদিটা আবার ওর ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল, আমার পক্ষে সেটা যে কী মুশকিলের ব্যাপার কী আর বলব

হঠাৎ দেখি কীসের যেন একটা জটলা দিদি দেখলাম পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল, ক্যাপটেন আর আমি কি এমন সুযোগ ছাড়ি! প্রথমে ভেবেছিলাম কেউ কিছু বিক্রি-টিক্রি করছে বা কিছুর খেলা দেখাচ্ছে, কিন্তু কাছে গিয়ে চোখ কপালে উঠল দেখি, একটা পাগলাটে চেহারার বুড়ো মতলোক উবু হয়ে বসে আছে রাস্তায় হাতে একটা মস্ত পাখি তার একটা ডানা মনে হয় ভাঙা, কারণ একদিকের ডানা কেমন একটা ভাবে মেলে ধরে এক দিকে কাত হয়ে আছে পাখিটা লোকটা সেই ডানায় কী যেন করছে
ক্যাপটেন আমার কনুইয়ের কাছে মোক্ষম একটা চিমটি কেটে বলল, “চিল, মনে হয় ঘুড়ির সুতো জড়িয়ে ডানাটা ভেঙেছে, পড়ে গেছিল বোধহয়
ঠিক এই সময়ে পিছন থেকে কার একটা মোক্ষম ধাক্কা খেয়ে একেবারে লোকটার সামনে গিয়ে পড়লাম লোকটা চোখ তুলে তাকাল একবার দেখলাম, ভারী অন্যমনস্ক দুটো চোখ যেন কিছুই দেখছে না আসলে চিলটা দেখলাম কেমন অদ্ভুত চকচকে চোখে তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে আমার গা-টা কেমন শিরশির করে উঠল হঠাৎ টাল সামলে ভিড় থেকে বেরিয়ে এসে ক্যাপটেনকে বললাম, “

পরীক্ষা তো যা হবার তাই হল, সে নিয়ে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই তবে সারাদিন চিলের সেই চকচকে চোখ আর বুড়োটে লোকটার সেই অন্যমনস্ক চোখ দুটো কেন জানি না বারবার মনে পড়ছিল স্কুল থেকে বেরোনোর সময়ে ক্যাপটেনকে ফস করে বলে বসলাম, “পাখিদাদুকে খুঁজে দেখি চ
সে আবার কে?” ক্যাপটেন তো হাঁ আমিও সামান্য চমকে গেছিলাম নিজের কথাতে একেবারে পাখিদাদু!
আরে সকালের লোকটা, চিলটার কী হল একবার দেখলে হয়,” তাড়াতাড়ি কথাটা চাপা দিই
অনেকক্ষণ খুঁজেও কোথাও লোকটাকে দেখতে পেলাম না চিলের লেজের ডগার পালকটুকু পর্যন্ত নয় সাইকেল সারানোর দোকানের পাশ দিয়ে ঘুরে সেই নেতাজি সঙ্ঘের মাঠ পর্যন্ত ঘুরে এলাম অবশ্য ওই নামেই মাঠ, চারিদিকে উঁচু উঁচু বাড়ি উঠে এখন একফালি চিলতে জমি পড়ে আছে শুধু বুড়োর খোঁচা দাড়ির ডগাটুকু পর্যন্ত দেখলাম না সাইকেলের দোকানটা খোলা থাকলেও না হয় হত রাজুদা পাড়ার সবার খবর রাখে, ও সাইকেলের দোকান না দিলে নির্ঘাত গোয়েন্দা হত বিরস মুখে বাড়ি ফিরলাম বড়োদের এইসব কথা জানানোর মানে হয় না তার উপর যদি অঙ্ক পরীক্ষার কথা মনে পড়ে যায় ওনাদের, তাহলেই হয়েছে আর কী

লোকটাকে আবার দেখলাম সপ্তাহখানেক বাদে ততদিনে গরমের ছুটি পড়ে গেছে ক্যাপটেনের বাড়িই যাচ্ছিলাম আগের রাতে খুব ঝড় হওয়াতে রাস্তা জুড়ে ভাঙা ডাল, পাতা, কাগজ, প্লাস্টিক আরও হাবিজাবি কত কী ছড়িয়ে আছে তার ঠিক-ঠিকানা নেই দূর থেকে গানের স্কুলের পাশে বড়ো গাছটার নীচে উবু হয়ে বসে থাকা মূর্তিটার দিকে চোখ যেতেই পেটের ভিতরটা কেমন গুড়গুড় করে উঠল ওই তো সে মাটির দিকে একমনে তাকিয়ে আছে এগিয়ে গিয়ে দেখি লোম ওঠা কুৎসিত একটা পাখির ছানা চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে, বেঁচে আছে কিনা তাও বোঝা যাচ্ছে না বোধহয় ঝড়ের সময়ে বাসা থেকে পড়ে গেছে পা দুটো কেমন মুড়ে রেখেছে বুড়োটা দেখি একটা বড়ো পাতার উপর পাখিটাকে যত্ন করে শোয়াচ্ছে
ও বাঁচবে?” নিজেই বুঝতে পারি আমার গলাটা কাঁপছে
লোকটা তাকায়, সেই অন্যমনস্ক চোখ যেন আমাকে দেখেও দেখতে পাচ্ছে না
বাঁচবে খোকাবাবু, একটু চেষ্টা করতে হবে এই যা,” লোকটার গলাটা কিন্তু বেশ গম্ভীর, উচ্চারণ পরিষ্কার, “ওর বাসাটা দেখতে পেলে সেখানেই তুলে দিতাম, কিন্তু সেটা বোধহয় ভেঙে পড়েছে ওর বাপ-মাকেও দেখছি না আশেপাশে কোথাও
এমনিতে আমাকে খোকাবাবু বললে খুব রাগ হয়, কিন্তু কেন জানি না রাগ হল না জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় নিয়ে যাবে ওকে?”
লোকটা ঝিকমিক করে হাসল চাপা গলায় বলল, “দেখবে?”

বাড়ি ফিরতে বেশ দেরি হয়ে গেছিল, বলা বাহুল্য সেই নিয়ে কী যে হইচই বকাঝকা বুঝলাম এরা কিছু জানে না

মনের মধ্যে লেগে থাকা ঘোরটা কাটছে না একদম নেতাজি সঙ্ঘের মাঠের চিলতে জমিটার পাশে ওরকম একটা জায়গা থাকতে পারে ভাবিনি কখনও পাখিদাদু, মানে ওই লোকটার পিছন পিছন যেতে যেতে কেমন গুলিয়ে যাচ্ছিল সব চেনা রাস্তাগুলো কেমন অন্যরকম মনে হচ্ছিল মাঠের ডানদিকে একটা বড়ো পাথরের চাঁই আছে বড়োদের কোমর-সমান উঁচু, আমার তো প্রায় কান পর্যন্ত পৌঁছয় সেটার পিছন দিকে একটা সুড়ঙ্গের মতো খোঁদল, লোকটা সটান তার মধ্যে ঢুকে গেল বাইরে দাঁড়িয়ে ভাবছি ঢোকাটা উচিত হবে কিনা, দেখি লোকটা মুখ বের করেছে আবার
আসবে না? ভয় পাচ্ছ বুঝি? তবে থাক,” লোকটা আবার মাথাটা ঢুকিয়ে নেয় সুড়ঙ্গের ভিতর
এর পর আর দাঁড়িয়ে থাকা চলে না আমিও ঢুকে পড়ি অন্ধকার খোঁদলটায়
যতটা অন্ধকার ভেবেছিলাম ততটা কিন্তু নয় হালকা একটা চাপা আলো আসছে কোথাও থেকে টিপ টিপ করে জল পড়ার শব্দও হচ্ছে যেন লোকটাকে স্পষ্ট দেখতে না পেলেও, বুকের কাছে পাখির ছানাটাকে ধরে কোমর থেকে সামান্য ঝুঁকে সে আমার আগে আগে চলেছে সেটা বুঝতে পারছি সুড়ঙ্গট নীচু, আমার অসুবিধা না হলেও লোকটা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না একটা অদ্ভুত চেঁচামেচি কানে এল হঠাৎ যেন অনেক কিছুতে একসঙ্গে চেঁচাচ্ছে
সুড়ঙ্গটা হঠাৎ শেষ হয়ে ডানদিকে মোড় ঘুরল তারপরে যা দেখলাম তেমন দৃশ্য জীবনে কোনোদিন দেখিনি গুহা হবে হয়তো কোনো, যদিও আমাদের এই রমাপদ বাই লেনে গুহা কোথা থেকে আসবে সেটা বোধগম্য হল না মোটেই সেই অদ্ভুত গুহা জুড়ে নানা আকারের নানা রঙের পাখি কেউ গুহার মেঝেতে বসে দানা খাচ্ছে, কেউ গুহার ছাদ থেকে ঝোলানো দোলনায় বসে দোল খাচ্ছে ঠিক মাঝখানে একটা মস্ত গাছ গুহার ছাদ ফুঁড়ে সটান উঠে গেছে তার কিছু ডালপালা গুহার ভিতরেও ছড়িয়ে আছে কোনো কোনো পাখি আবার সেই ডালে বসে পোকা ধরে খাচ্ছে আর সবাই মিলে যে কী সাংঘাতিক চেঁচামেচি জুড়েছে তা কহতব্য নয় আরও অদ্ভুত ব্যাপার হল কোনো পাখিই পুরো সুস্থ নয় কারোর একটা পা নেই, কারোর ঠোঁট ভাঙা কেউ ডানা খুলতে পারছে না পুরো
আমাকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে লোকটা বলল, “সুস্থ হয়ে গেলে নিজে থেকেই উড়ে যায়, ধরে রাখি না
আমার গলাটা কেমন শুকিয়ে এসেছিল, কেশে নিয়ে বললাম, “এতজনকে খাওয়াবার পয়সা কোথায় পাও?” – পাখিদাদু বলে ডাকতে খুব ইচ্ছা করছিল, কিন্তু কেমন লজ্জা করতে লাগল
কেমন একটা হেসে লোকটা বলল, “জুটে যায় খোকাবাবু

হঠাৎ পিছন থেকে কড়া একটা গলা ভেসে এল, “এইখানে তাহলে লুকিয়ে আছ বাছাধন?”
দুজনেই বেজায় চমকে গেছিলাম পিছনে তাকিয়ে দেখি, ও বাবা! পাড়ার সব বড়োরা একজোট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সঙ্গে আবার অরিন্দ্র সে আঙুল তুলে লোকটাকে দেখিয়ে বলছে, “ওই যে ও সপ্তর্ষিকে নিয়ে চুপি চুপি এদিকে আসতেই তোমাদের খবর দিয়েছি দিন ধরে টিভিতে যে কিডন্যাপারের ছবি দেখাচ্ছে তার সঙ্গে দেখো লোকটার হুবহু মিল আমি ক্লাস ক্যাপটেন, আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া সহজ নয়
বলা বাহুল্য, সপ্তর্ষি আমারই নাম
আমি স্ট্যাচু হয়ে গেছি পুরো এসব কী হচ্ছে অরিন্দ্রর বাবা সমরেশকাকু দেখি ধীরে ধীরে লোকটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, হাতে আবার একটা মোটা লাঠি লোকটার মুখে কেমন একটা হাসি, তাকে বোধহয় কান্নাও বলা যায় আমার পা দুটো কাঁপছে

সমরেশকাকু লাঠিটা তুলতে যেতেই হঠাৎ কোথা থেকে তিরবেগে ক্যাপটেন এসে ওর কোমর ধরে ঝুলে পড়ল সমরেশকাকু আর এগোতে পারছে না লোকটা অদ্ভুত একটা শিস দিয়ে উঠল এবার, কেমন মনকেমন করা সুর চারিদিক থেকে ঝটপট ঝটপট করে শব্দ উঠল সেই সঙ্গে সব পাখি একসঙ্গে উড়ে এসে ঢেকে ফেলল লোকটাকে, যেন পাখির চাদর তারপর লোকটাকে সুদ্ধু সবাই মিলে ছাদের ফোকটা দিয়ে উড়ে বেরিয়ে গেল এক ঝলকের জন্য লোকটার চোখদুটো দেখতে পেয়েছিলাম সে দৃষ্টি ভোলার নয় আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম গুহার মেঝেতে

সেই সুড়ঙ্গের মুখটা আর খুঁজে পাইনি কখনও পাখিদাদুকেও আর দেখিনি ক্যাপটেন আর আমি কোনোদিন ও নিয়ে আলোচনা করি না তবে দুজনেই জানি, আবার দেখা হলে পাখিদাদু বলেই ডাকব
----------
ছবি - শুভশ্রী দাস

No comments:

Post a Comment