গল্প:: অনেকটা পথ হাঁটতে হবে - অঙ্কুর ঘোষ


অনেকটা পথ হাঁটতে হবে
অঙ্কুর ঘোষ

আমি আলেকজান্ডারআমার জন্ম পোল্যান্ডে। পোল্যান্ডের সবচেয়ে ছোটো গ্রামগুলির মধ্যে একটি - যার একদম শেষ প্রান্তে একটা পাহাড় মাথা উঁচু করে সারাক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, আর আকাশের দিকে তাকিয়ে কত কী যেন ভাবে! তার পায়ের কাছে সবচেয়ে ছোট্ট যে লাল টালির বাড়িটা, সেইটেই ছিল আমাদের। পাশ দিয়ে বয়ে চলা একটা খরস্রোতা নদীর কুলকুল শব্দ চারিদিকের নিস্তব্ধতাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে আমি আর আমার দিদি মেরি খুব আনন্দে দিন কাটাতাম এই গ্রামে রোজ সকালে আমি স্কুল যেতাম, আর মেরি সারা দিন বাড়িতে থেকে ঘরের নানান কাজে হাত লাগাত, আর অবসর সময়ে উল বুনত কিংবা কাপড়ের উপর হরেকরকম নকশা সেলাই করত বিকেলে ফিরলেই সেগুলো আমায় সোৎসাহে দেখাত। আমি বিভোর হয়ে সেই সমস্ত নকশার দিকে চেয়ে থাকতাম আর ভাবতাম, যদি আমিও এমন নিখুঁত হাতের কাজ পারতাম; তাহলে মিস লিন্ডা আঁকার ক্লাসে আমায় অমন বকতেন না! অন্যদিকে মেরি আমায় বারবার জিজ্ঞাসা করত, স্কুলে নতুন কী-কী পড়ানো হয়েছে। আমি সদ্য মুখস্থ করা কোনো কবিতা গর্বের সঙ্গে আওড়াতাম - মেরি মুগ্ধ হয়ে তা চুপ করে শুনে যেত।
এমনভাবেই কাটছিল দিনগুলি - হঠাৎ একদিন ঘটে গেল সেই বিশেষ ঘটনাটা, যা আমাদের সকলের জীবন চিরকালের মতো নিমেষে বদলে দিল একদল ধূসর রঙের পোশাক-পরা হোমরাচোমরা জার্মান সৈনিক সবেগে ঢুকে পড়ে আমাদের গ্রামে। তাদের সকলের জামায় বুকপকেটের উপর একটা স্বস্তিক চিহ্ন জ্বলজ্বল করে, আর মাথার টুপিতে ঈগলের মতো দেখতে একটা হিংস্র পাখির ছবি আঁকা। ওদের বজ্রকঠিন, নির্মম মুখভঙ্গি দেখেই সমস্ত গ্রামবাসীর অন্তরাত্মা শুকিয়ে যেত। যেখানে যত দোকান-ঘর-বাড়ি ওদের চোখে পড়েছিল, সেই নৃশংস জার্মান সেনা তা নির্দ্বিধায় ধ্বংস করে দিয়েছিল তারপর, প্রায় দুশো-তিনশো গ্রামবাসীর তীব্র প্রতিবাদকে একেবারে উপেক্ষা করে, সম্পূর্ণ গায়ের জোরে তাদের একের পর এক ট্রাকে তুলে পোল্যান্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ে চলে গিয়েছিলআমি আর আমার দিদিও কিছু বোঝার আগেই সেই দলে সামিল হয়েছিলাম আমাদের কিছুই বোধগম্য হচ্ছিল না। কোথায় আমাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কেনই বা আমরা এইভাবে অজানা দেশের উদ্দেশ্যে চলেছি - কিছুই বুঝতে পারছিলাম নাকারোর জানা ছিল না, কী হতে চলেছে। শুধু মনে আছে, আমরা খুব ভয়ে ছিলাম।
মেরি আমার পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু মাঝপথে কীভাবে যেন ভিড়ের মধ্যে আমরা হাতছাড়া হয়ে যাই। গন্তব্যস্থলে নামতেই একটা বিশাল বড়ো ব্যানারে দেখেছিলাম লেখা - ওয়ারশ’, অর্থাৎ পোল্যান্ডের রাজধানী কিন্তু সে নিয়ে ভাববার পরিস্থিতি আমার ছিল না। আমি হন্তদন্ত হয়ে মেরিকে খোঁজার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম। শতসহস্র মানুষ অনবরত নেমে চলেছে সদ্য-ফেরত ট্রাকগুলি থেকে। বিপুল সেই জনস্রোতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমি যাকে সামনে দেখছিলাম জিজ্ঞাসা করছিলাম, “কেউ দেখেছ আমার দিদিকে?” কিন্তু কে আমার কথায় পাত্তা দেবে? সবাই যে নিজেদের আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধবদের খোঁজ করতেই ব্যস্ত, ঠিক আমারই মতো।
সেই কিম্ভূতকিমাকার জার্মান সৈনিকগুলোর প্রতি আমার যে তখন কী রাগ হচ্ছিল! কিন্তু কীই-বা আমার তখন করার ছিল? সেই বিপুল জনস্রোতে আমি নিজেই যেন ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছিলাম। এত মানুষের পায়ের ধুলোয় রাস্তা কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে আসছিল, পথ দেখাই দায় অতএব, অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমায় বাধ্য হয়ে অন্যান্য আগন্তুকদের মতোই প্রবেশ করতে হয়েছিল একটা উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ইহুদি ঘেটো-র মধ্যে। বন্দিশালা। যেখানে কয়েকশো ইহুদিকে জার্মান সেনা মাসের পর মাস বন্দি করে রেখেছিল।
কেউ আমার চেনা ছিল না সেখানে। প্রথম কয়েকদিন রাগে, অভিমানে গুম হয়ে এককোণে বসে থাকতামঅন্যান্য বন্দিরা নিজেদের মধ্যে গল্প করত নীচু স্বরে, ভয়ে ভয়ে। আমার সেদিকে বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। তবু মাঝে মাঝে কানে ভেসে আসত একটা শব্দ - ত্রেবলিনকাত্রেবলিনকা এমন এক জায়গা যেখানে গেলে কেউ নাকি কখনও ফেরে না। ওয়ারশ-র সমস্ত ইহুদি ঘেটোর বন্দিদের একে-একে ত্রেবলিনকায় নিয়ে যাওয়া হয় এইসব শুনে আমি ভাবতাম আর কাঁদতাম - আমার দিদিকেও কি তবে ইতিমধ্যে ত্রেবলিনকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে?
এই ঘেটোতে আমাদের মধ্যে একজন স্কুলমাস্টার ছিলেন। তিনি আমার সমবয়সি ছেলেমেয়েদের মনে উৎসাহ, উদ্দীপনা জাগাবার প্রবল চেষ্টা করতেন। তিনি একদিন প্রস্তাব দিলেন, ঘেটোর মধ্যেই একটা নাটক মঞ্চস্থ করবেনছেলেমেয়েরা নিজেরা সমস্ত পাঠ করবে, অভিনয় করবে। একটি বিদেশি নাটক, নাম- ‘ডাকঘরআমার নাটকটি বেশ অভিনব মনে হয়েছিল। আমি নিজে কখনও নাটক করিনি বটে কিন্তু আমাদের গ্রামে একবার ওয়ারশ থেকে একটা নামজাদা দল এসেছিল নাটক দেখাতে, রাস্তায় ভিড় করে দাঁড়িয়ে অনেকের সঙ্গে আমিও তা দেখেছিলাম।
আমাকেই দেওয়া হয়েছিল মুখ্য চরিত্র - অমল’-এর অভিনয়ের ভার। বেশ কয়েকদিন ধরে মহড়া চলেছিলদইওয়ালা, তোমার বাড়ি কোথায়?’ - সংলাপ মনে করে করে বলার মধ্যে দিয়ে কখন যেন বাস্তব জগৎ থেকে দূরে চলে যেতাম মনে থাকত না, ঘেটোর অন্ধকূপে আমি একজন সামান্য বন্দি; আমার দিদি মেরি আজ কোথায় সে বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র ধারণাও নেই। তখন যে আমি কেবলমাত্র অমল - জানালার ধারে উদাসীন হয়ে বসে থাকি রাজার চিঠির আশায় মাঝে মাঝে ভাবতাম, রাজামশাই অমলের মতো আমার জন্যও কি চিঠি পাঠাবেন কোনোদিন? কিন্তু এখানে তো কোনো ডাকঘর নেই থাকলেও, এখানের প্রহরীরা কি সে চিঠি আমার হাতে তুলে দেবে? প্রহরীদের আমাদের উপর এত রাগ কেন? কী ক্ষতি করেছি আমরা ওদের?
অবশেষে বহু আকাঙ্ক্ষিত সেই নাটকের দিন উপস্থিত হল। সন্ধ্যা হতে চলেছে ওয়ারশ-র বুকে ধীরে ধীরে অন্ধকার জমাট বাঁধতে শুরু করেছে আমাদের ঘেটোর মধ্যে অন্ধকারের আস্তরণ পড়া শুরু হয়েছে আর দেরি নয়, এটাই নাটকের আদর্শ সময়
তা সত্ত্বেও সে কী উদ্যম আমাদের! ইট-বের-হয়ে-আসা জীর্ণ দেয়ালগুলোকে ঘিরে বন্দিশালার মাঝখানটিতে সমস্ত ছেলেমেয়েরা জড়ো হয়েছিলামএই নাটকের প্রধান উদ্যোক্তা - আমাদের মাস্টারমশাই, সমস্ত অভিনেতা-অভিনেত্রীর চরিত্রের সঙ্গে দর্শকদের পরিচয় করালেন।
এরপর শুরু হল অভিনয়। সবই ঠিকঠাক এগোচ্ছিল তবু কেন জানি আমি উপলব্ধি করছিলাম, এর আগে, মহড়ার সময় যখন আমি সংলাপ বলতাম, তখন যেরকম অনুভূতি হত, আজ যেন কত আলাদা লাগছেকত শত বন্দি আমাদের ঘিরে, অপলক দৃষ্টিতে আমাদেরই দিকে চেয়ে আছে। তাদের ফ্যাকাশে মুখে সে কী আনন্দের হাসি! তারা যে কতদিন পর এত আনন্দ পেয়েছে, কে জানে? আর কতদিনই বা পাবে?
বলা চলে, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তারা প্রত্যেকে রুদ্ধশ্বাসে নাটকটা উপভোগ করেছিল শেষ দৃশ্যেসুধা তোমায় ভোলেনি!’ - দিয়ে যবনিকা পতন অবশেষে নাটক শেষ হল। সমগ্র বন্দিশালা অগণিত করতালিতে ফেটে পড়লকেউ তখন টেরও পায়নি, আমার মনের অতল গহ্বরে কতদিন ধরে চাপা পড়ে থাকা একটি ভাবনা সেই মুহূর্তে কোনোরকম বাধা না মেনে, আমার সব ক-টি স্নায়ুকে গ্রাস করে ফেলেছে; জয় করে নিয়েছে আমার বুদ্ধি, বিবেচনাবোধকে আগে কখনও এমন অনুভূতি হয়নি আমার আমি কি তবে পাগল হয়ে গিয়েছি? এ কোন লড়াইয়ের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছি আমি? আমার আর সন্দেহ নেই - এ হল সেই শেষ লড়াই - স্বস্তিক চিহ্নধারী কালো মৃত্যুদ্যূতের সঙ্গে আমার শেষ মোকাবিলাআর কোনোভাবে নিজের মনকে ঠেকিয়ে রাখতে পারলাম না
আমার তখন রোখ চেপে গিয়েছে; হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে সোজা দৌড়ে চলে গেলাম ঘেটোর প্রবেশদ্বারের দিকে। বাইরের সশস্ত্র প্রহরীদের উদ্দেশে রিনরিনে কণ্ঠে তারস্বরে গর্জে উঠলাম, “আমি তোমাদের কাউকে ভয় পাই না! কাউকে না! জানো না, আমি মৃত্যুর চেয়েও বড়ো! অন্যান্য বন্দিরা অনেক কষ্টে আমায় জোর করে টেনে এনেছিল ঘরের মধ্যে। বাধ্য হয়ে মাটিতে মাথা পেতে শোওয়ার সময়ও একনাগাড়ে বিড়বিড় করে বলে চলেছিলাম, “আমি ভয় পাই না...।
সেদিন রাতে আমার ভীষণ জ্বর এসেছিল এরপরের দিনগুলি আমি একটা ঘোরের মধ্যে কাটিয়েছিলাম। সমস্ত স্মৃতি ঝাপসা। তারপর একদিন, কত রাত কে জানে, শুনলাম প্রহরীর দল এসে ঘোষণা করছে, “আগামীকাল সকালে এই ঘেটো-র সমস্ত বন্দিদের ত্রেবলিনকায় নিয়ে যাওয়া হবেঅমলের সেই রাজার চিঠি অবশেষে আমার কাছে এসে পৌঁছেছে, তাহলে? আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে! আমার সারা মুখে একটা হাসির রেখা ফুটে উঠেছে
কিন্তু এ কী আশ্চর্য কাণ্ড - পরমুহূর্তেই দেখি, একটি ছায়ামূর্তি কখন আমার মাথার কাছে নিঃসাড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। জানালার ফাঁক দিয়ে ঢোকা ক্ষীণ চাঁদের আলোয় তাকে চিনতে আমার এতটুকুও ভুল হয়নি - এ যে মেরি! ওয়ারশ-তে আসার পথে হারিয়ে যাওয়া আমার সেই দিদি। তার মুখেও মৃদু হাসির ঝিলিকগ্রামে নদীর তীরে লুকোচুরি খেলার সময় বোধহয় শেষ ওইরকম আনন্দের হাসি দেখেছিলাম ওর মুখে। মুখটা নীচু করে আমার কানে কানে সে বলল, “উঠে পড়ো। এখন অনেকটা পথ হাঁটতে হবে যে! কোনোরকম দুর্বলতা, বেদনা অনুভব না করেই, অনায়াসে উঠে দাঁড়ালাম। তারপর মেরির হাত ধরে জিজ্ঞাসা করলাম, “কোথায় যেতে হবে? সেই পাঁচমুড়ো পাহাড়ের নীচে শ্যামলা নদীর দেশে?” উত্তরে একটা দমকা হিমেল বাতাসের ঝাপটা মুখে এসে লাগার সঙ্গে যেন শুনতে পেলাম - চিরন্তন সেই অভয়বাণী, ‘মেরি তোমায় ভোলেনি!

[উল্লেখ্য, ১৮ জুলাই, ১৯৪২ সালে ওয়ারশ-র এক ইহুদি ঘেটোর বন্দিদের মধ্যে ইয়ানুস কোরচাক নামে এক ব্যক্তি দুশো জন বালক-বালিকাকে নিয়েপোচতা’, অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথেরডাকঘর’-এর পোলিশ অনুবাদ নাটকটি অভিনয় করিয়েছিলেন ৬ আগস্ট, অর্থাৎ এই ঘটনার আড়াই সপ্তাহ পরেই কোরচাক ও সেই ঘেটোর ১৯৫ জন বালক-বালিকাকে চলে যেতে হয় ত্রেবলিনকার মৃত্যুকূপে]
----------
ছবি - শুভশ্রী দাস

No comments:

Post a Comment