গল্প:: রহস্যদ্বীপ - শরণ্যা মুখোপাধ্যায়


রহস্যদ্বীপ
শরণ্যা মুখোপাধ্যায়

।। ।।

স্থান: মাডাগাসকার
বছর: ১৯২০
শব্দটা আসছে অনেক দূর থেকে লেখা থামিয়ে হরিমোহনবাবু উৎকর্ণ হলেন তবে কিএতদিনের লড়াই কি সত্যিই তাহলে সফল হল? পায়ের নীচের মাটি অল্প কাঁপছে না
কাকা, কাকা…” বিম্ব ছুটে আসছে কি তবে দেখেছে! তাঁবুর বাইরে রাখা চেয়ার ছেড়ে টলমলে মাটির ওপর দুলতে থাকা হরিমোহন উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ালেন কোনোক্রমে এগিয়ে গেলেন ভাইপোর গলার স্বর অনুসরণ করে কোল থেকে পড়ে গেল ডায়ারি, ছিটকে গেল পাশের ফোল্ডিং টেবিলের ওপরে রাখা ইয়ুল সাহেবের লেখা বইটা মাটি অসম্ভব কাঁপতে শুরু করেছে গোটা দ্বীপটা মনে হচ্ছে ভেঙে ঢুকে যাবে সাগরের অতলে পিটার সাহেবদের খবর দেওয়া দরকার এখনই, ওরা গেছে দ্বীপটার উত্তরপ্রান্তে
হ্যাঁ, ওই তো ফরাসি রাজত্বের বিভুঁইয়ে এই দশবছরের পরিশ্রম সার্থক হয়েছে তাঁর কিন্তু এ কী! দৈত্যপ্রমাণ জিনিসটা অমানুষিক গতিতে এগিয়ে আসছে চোখের সামনেই তার অমিত পেষণে মাটিতে মিশে গেল বিম্বহাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন হরিমোহন হা ঈশ্বর! পরিবারের শেষ বংশধর!
মুহূর্ত! একটি পলবদলে দিতে পারে সবকিছু, উলটেপালটে দিতে পারে ভালোমন্দ, ন্যায়-অন্যায়, অস্তিত্বের যাবতীয় হিসেব মহাজাগতিক মহাবিস্ফোরণের মতো একটিমাত্র ঘনীভূত চূড়ান্ত শক্তিবিন্দুর হঠাৎ উন্মাদনায় যেরকম বিশ্বসৃষ্টি, সেরকমই ধ্বংস, অণুপ্রমাণ এবং অপরিমেয়
সাহেবদের খবর দেবার সময় নেই নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে তাকিয়ে শান্ত হয়ে চোখ বুজলেন হরিমোহন
হা মধুসূদন!”

।। ।।

স্থান: কলকাতা
বছর: ২০১৯
বিশ্ব উষ্ণায়ন আমাদের জীবনকে যতটা প্রভাবিত করেছে এবং যতদিন ধরে করছে তার সিকিভাগও যদি মানুষ উপলব্ধি করতে পারত!... জানো কি? আজ থেকে পনেরোশো বছর আগে আইসল্যান্ড আর মধ্য আমেরিকার ইলোপ্যাঙ্গো অঞ্চলে দুটো ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির হঠাৎ অগ্ন্যুৎপাতের ফলে যে আকাশ কালো করা ধোঁয়া তৈরি হয়েছিল তাতে সে সময়ে তাপমাত্রার গুরুতর পরিবর্তন ঘটেছিল সূর্য নিভিয়ে দেওয়া ছাই আর সালফারের জন্য চাষাবাদ নষ্ট হওয়া থেকে শুরু, আর শেষ হল কীসে জানো? কুখ্যাত ব্ল্যাকডেথেসেবারে মানুষ সামলে উঠতে পেরেছিল, কারণ সে তখনও আধুনিক হয়ে ওঠেনি আজকের মতো… ” খবরের কাগজটা বন্ধ করলেন প্রমথেশবাবু পারস্য উপসাগরে একসঙ্গে প্রায় শ-খানেক সামুদ্রিক প্রাণীর মৃতদেহ ভেসে উঠেছে তীরে খবরটা আমিও দেখেছি কিন্তু প্রমথেশবাবুর এই কথাগুলো বলার কারণ শুধুমাত্র একটি নৈর্ব্যক্তিক সংবাদ নয়, সেটা জানি গত পরশুই জেনেছি আর সেজন্য মনটা বেশ উত্তেজিতই হয়ে আছে
প্রমথেশবাবুর রহস্য অভিযানের আমি এক ভাষক মাত্র পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি প্রমথেশবাবু থাকা মানেই কোনো জটিল, রহস্যময় ঘটনাবলির সাক্ষী হতে যাচ্ছি, যেটা লেখার পাতায় যতটা সম্ভব পুঙ্খানুপুঙ্খ ফুটিয়ে তোলাই আমার মূল উদ্দেশ্য আমি অরুণেশ রায়, পেশায় সাহিত্যের অধ্যাপক এবং সেইসঙ্গে শখের লেখক, প্যারানর্মাল সোসাইটির ভূতপূর্ব মেম্বার অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট প্রমথেশ চ্যাটার্জী শুধু আমার বন্ধুমানুষই নন, সেই রুরুনামের নারকীয় জীবের হাত থেকে আমাকে আমার বন্ধুকে উদ্ধার করার পর, আমি ধীরে ধীরে হয়ে উঠি ওনার এক সহকারী নামধাম পালটে, দিদার দেওয়া সর্বজয় ছদ্মনামে রুরুগল্পটা প্রকাশ করি তারপরই ওনার সম্পর্কে মানুষ জানতে পারেন প্রমথেশবাবু প্রথমে একেবারেই খুশি হননি এই প্রচার থেকে দূরে থাকতেই উনি হিমালয়ে একা বাস করা শুরু করেছিলেন ফালুটের যে প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমি আর আমার বন্ধু প্রদীপ্ত গিয়েছিলাম এক চূড়ান্ত অতিপ্রাকৃত শক্তির থেকে বাঁচবার আশায়, এবং অদ্ভুতভাবে বেঁচেও গিয়েছিলাম, যেটা যাঁরা রুরুগল্পটা পড়েছেন তাঁরা জানেন, সেইখানেই ওনার অন্যতম এবং এখন একমাত্র বাংলো তারপর দীর্ঘদিন গেছে ওনাকে এটা বোঝাতে যে ওনার মতো একজন মানুষের সাহায্য আমাদের মতো কিছু বিপদগ্রস্ত লোকের একান্ত দরকার ঠিক সেই কারণেই আমার এই গল্পপ্রকাশ তারপর অঘোরীর কবলে’, ‘মানুষখেকো’, ‘রিপু’... একের পর এক আমাদের বিভিন্ন অভিযান, আর সাফল্য সেই অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ নিতেই বারবার বেরিয়ে পড়ি প্রমথেশবাবুর সঙ্গেকিন্তু না, এবারে অন্যান্যবারের মতো কোনো কেস আসেনি সেই অর্থে প্রমথেশবাবুই কলকাতায় এসেছিলেন কিছু কাজে যথারীতি উঠেছেন আমার কাছেই তখনই জানান, একটা ডাক এসেছে, বেড়াতে যাবার তবে হাজার হোক, প্রমথেশবাবুর তরফ থেকে তো! এই ডাকটার পিছনেও একটা রহস্য রয়েই গেছে
জানুয়ারি মাস সবেমাত্র বড়োদিনের ছুটি গেছে পরীক্ষার মরশুমেরও দেরি আছে ক্লাসের সংখ্যা তুলনায় কম লেখাপড়ার জগতের একপ্রকার শীতঘুমের সময় এটা সেমেস্টার নামের তাপ না পেলে ঘুম চট করে ভাঙবে না সে কারণেই প্রমথেশবাবুর জিওলজিস্ট বন্ধু জ্যোতি সেন যখন ওনাকে আমন্ত্রণ জানালেন সুনামি-পরবর্তী মারিয়ানা দ্বীপমালার কাছে, একটা নতুন গজিয়ে ওঠা দ্বীপ ভ্রমণের জন্য, তখন, ব্যাপারটা ওনার মুখে শুনেই আমি একপায়ে খাড়া হয়ে গিয়েছিলাম সব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি পাওয়াটাও খুব কঠিন হয়নি গেল অ্যাডভেঞ্চারগুলোর জন্য কিছু রেপুটেশন তো আমারও হয়েছে!
প্রমথেশবাবুর মুখেই শুনলাম সামুদ্রিক এই দ্বীপের ব্যাপারটা নিয়ে একটা ঝামেলা হয়েছে দ্বীপটা নাকি মাঝে-মধ্যেই নড়ে ওঠে এদিক ওদিক সরে যায় শুধু তাই নয়, ওই অঞ্চলে দুটো দুর্ঘটনাও ঘটে গেছে এর মধ্যে একটা জাহাজ আর একটা ট্রলার ওই দ্বীপের ধাক্কায় ডুবে গেছে সরকারিভাবে দুজন মৃত ঘটনাগুলো ঘটেছে শেষ একমাসে দ্বিতীয় খবরটা জানার পর থেকেই আমেরিকার উচ্চমহল নড়েচড়ে বসে নাশকতার সন্দেহে দ্বীপে সৈন্যবাহিনী গিয়ে রীতিমতো চিরুনিতল্লশি করে‌, কিন্তু কিছুরই হদিস পায়নি তারা শেষমেশ আমেরিকার মারিয়ানা ট্রেঞ্চ মেরিন ন্যাশন্যাল মনুমেন্ট একদল বিজ্ঞানীকে পাঠায় গবেষণার জন্য; যাদের মধ্যে একজন প্রমথেশবাবুর বন্ধু জ্যোতি সেন তিনিই ডাক পাঠিয়েছেন জানি না এরকম একটা ব্যাপারে প্রমথেশবাবুর সাহায্য সত্যিই কোনো কাজে আসবে কিনা বিজ্ঞানীদের, কারণ আপাতদৃষ্টিতে এখানে অতিপ্রাকৃতের কোনো ব্যাপারই নেইবাকি রইল পড়াশোনার দিক প্রমথেশবাবু নিজে মূলত অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের লোক, তাই সেদিক দিয়েও এক্ষেত্রে কী লাভ হবে ওনাদের তা বুঝতে পারছিলাম না তবে কি এবার শুধুই নতুন জায়গা দেখা? কিন্তু সেজন্য কি কেউ প্লেনের টিকিট পর্যন্ত অগ্রিম পাঠিয়ে দেয়?
তখন আন্দাজও করতে পারিনি, কী অভূতপূর্ব ঘটনার সাক্ষী হতে চলেছি আমরা! তথাকথিত অতিপ্রাকৃত ঘটনা ছাড়াও যে আরও কত রহস্য বিশ্বসংসারে লুকিয়ে আছে! মাঝে মাঝে আমাদের মতো সৌভাগ্যবান কিছু পাগলদের চোখের সামনে হিমশৈলের কেবল চূড়ার মতো সে রহস্যের কণামাত্র ঝলসে উঠে, আমাদের বেঁচে থাকার অর্থবহতাকে নতুন মাত্রা দিয়ে যায়

।। ।।

হু হু করে হাওয়া আসছে দক্ষিণ দিক থেকেপ্রশান্ত মহাসাগরীয় উত্তর-পশ্চিমের এই না গরম, না ঠান্ডা অঞ্চলটির দ্বীপমালা জুড়ে কেন ট্যুরিস্টদের এত ভিড় হয় সেটা বুঝতে পারছি মনোরম আবহাওয়া, অপূর্ব দৃশ্য আর চমৎকার শান্ত পরিবেশ তবে জ্যোতি সেন বলছিলেন অন্যান্য বছরের তুলনায় বছর গড় তাপমাত্রা নাকি স্বাভাবিকের থেকে বেশ কিছুটা বেশি এখানে আরও ঠান্ডা থাকার কথা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সেইসঙ্গে থাকার কথা ছিল শুষ্কতাও কিন্তু বাতাসে আর্দ্রতার মাত্রা বেশ বেশি
কথা হচ্ছিল চমৎকার পাথুরে রহস্যদ্বীপে বসেই
প্রফেসার সেন বেশ ইন্টারেস্টিং মানুষ জার্মানিতে প্রমথেশবাবুর সঙ্গে কিছুদিন প্যারাসাইকোলজিক্যাল সোসাইটিতে একসঙ্গে কাজ করেছিলেন সেইসূত্রেই আলাপ মাঝারি উচ্চতা, রং ফরসা, মাথার প্রায় সব চুলই সাদা, চোখে হাই-পাওয়ারের চশমা, সব মিলিয়ে ভদ্রলোককে দেখলে একজন গড়পড়তা শিক্ষিত বাঙালি বলে মনে হলেও, আসলে ওনার জীবন বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতায় পূর্ণ, তবে সেগুলোর সবকটাই বিজ্ঞান সংক্রান্ত ওনাকেই জিজ্ঞেস করছিলাম, দ্বীপের এই ঘোরাফেরার ব্যাপারটার কোনো পূর্ব উদাহরণ আছে কিনা?
আছেকিন্তু এভাবে নয় দেখো অরুণ,… সাধারণত দ্বীপ হল সমুদ্রে ডুবে থাকা কোনো পাহাড় বা আগ্নেয়গিরির উপরিভাগ মাত্র, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যার নীচের অংশ জোড়া থাকে সমুদ্রের তলদেশের সঙ্গে হ্যাঁ, কিছু ভাসমান দ্বীপ থাকে যারা হয়তো হঠাৎ করে কোনো আগ্নেয়গিরি বা বড়ো কোনো দ্বীপের ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে কিন্তু জাহাজডুবি ঘটানোর মতো ক্ষমতা তাদের কখনোই থাকে না…”
প্রত্যক্ষদর্শীরা কী বলছেন?”
ওই জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন খালাসি স্পষ্ট দেখেছে প্রবলগতিতে আসতে থাকা জাহাজটাকে সটান ধাক্কা মারে এই দ্বীপ মুহূর্তেই জাহাজের একপাশে ত্রিকোণাকৃতি আকারের একটা গর্ত তৈরি হয় তারপর আস্তে আস্তে দ্বীপটা সরে যেতে থাকে কিন্তু দ্বীপের এতটুকুও ক্ষতি হয়নি দ্বিতীয়বারেও একই ঘটনা বুঝতে পারছি না, দ্বীপটা কি কোনোভাবে বেছে বেছে টার্গেট করছে? আরও দু-তিনটে জাহাজ তারপরেও এখান দিয়ে গেছে যতক্ষণ না এই জলপথ সিল করে দেয় মার্কিন সরকার কিন্তু তাদের কিছু হয়নি…”
হুমচলো ওদিকটা দেখে আসি
এগিয়ে চলেছি দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে খুব বেশি চড়াই-উতরাই না থাকলেও দ্বীপের জমি অসমান এবড়ো-খেবড়ো পাথুরে রাস্তা গাছ বলতে সেরকম কিছুই নেই জমির দক্ষিণ-পশ্চিম দিক কিছুটা ঢেউ খেলানো মাঝে মাঝে ঘাসজাতীয় সবুজের ছোঁয়া আছে আর গাছ নেই বলেই সম্ভবত কোনো প্রাণীও সেরকমভাবে দেখা যাচ্ছে নাগতকাল এসে পৌঁছেছি এখানে প্রফেসার সেনের আতিথেয়তার তুলনা নেই আসার পর থেকেই আলাপ হয়েছে পুরো দলটার সঙ্গেই খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে আজ সাইট-সিয়িং অবধি বলিহারি যাই এদের দেশের ব্যবস্থা কে নেই সে দলে - বটানিস্ট, জুলজিস্ট, অ্যানথ্রোপলজিস্ট, ভাইরোলজিস্ট থেকে শুরু করে একজন ক্রিপ্টোজুওলজিস্ট পর্যন্ত এসেছে বিভিন্ন ধরনের কাজের লোকজন মাটি খোঁড়া, জরিপ, নমুনা সংগ্রহকিচ্ছু বাদ নেই সবাই এখানে এসেছে পনেরোদিন হলআজ আমরা তিনজন বেরিয়েছি দ্বীপভ্রমণে উজ্জ্বল একটা সকাল খানিকটা দূর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে পাখির দলজলের শান্ত শব্দ ভেসে আসছে এরকম পরিবেশের মধ্যে কী ভয়ানক রহস্য থাকতে পারে সেটাই ভেবে উঠতে পারছিলাম না কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা বলে সত্যিকারের বিপদ আপাত শান্ত বিষয়ের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে একেবারে সামনে না আসা অবধি টেরও পাওয়া যায় না, আর তাই সাবধান হবার সু্যোগও থাকে না তাই এমন সুন্দর পরিবেশের মধ্যেও ঠিক নিশ্চিন্ত হয়ে ঘু্রতে পারছিলাম না মাইলের পর মাইল জুড়ে হালকা খয়েরি রঙের পাথুরে বিস্তার জমিটা বেশ কিছু জায়গায় স্বচ্ছ, পিছল উপরিভাগ থেকে ভিতরের খরখরে অংশ টের পাওয়া যাচ্ছে নীচু হয়ে জমিতে হাত রাখলাম আমি
এটাও কিন্তু এক রহস্য…” মুখ তুলে দেখলাম আমার দিকেই তাকিয়ে কথাটা বলছেন প্রফেসার সেন, এই মাটিটা, এরকম পাথুরে মাটির সংস্পর্শে আগে কখনও আসিনিদ্বীপের ক্ষেত্রে সাধারণত পাহাড়ি পাথুরে অংশ, পিউমিস দেখা যায়; আরও অনেক কিছুই হয় ইরানের হরমাস দ্বীপের মাটি তো মশলা হিসেবে খাওয়াও যায় বিজ্ঞানে অনেক আশ্চর্য ব্যাপারই ঘটে, তার ব্যাখ্যাও দেওয়া যায়, কিন্তু এই পাথুরে মাটিটা ঠিক কী, তা আমরা এখনও বুঝতে পারিনি ওই যে, সাদা শার্ট পরা টাকমাথা ভদ্রলোক, কাল আলাপ করালাম, প্রফেসর র‍্যামন উনি একজন মাটি বিশেষজ্ঞ পাথরের ব্যাপারটা আমিই দেখি উনি আর আমি মিলে নিশ্চিত হয়েছি যে জিনিস আমরা আগে কখনও কোথাও দেখিনি যেন পৃথিবীর মাটিই নয়…”
কোনো উল্কা? বাইরে থেকে আসা কিছু…?”
জানি না অরুণ…” মাথা নাড়লেন সাদাচুলো প্রাজ্ঞ মানুষটি তার জন্যও এখানে লোক আছেপরীক্ষা চলছে আমাদের মধ্যে একজন অ্যাস্ট্রোনট পর্যন্ত আছেন…”
অধিক সন্ন্যাসী…” - চাপা গলায় কথাটা বলে বিরক্তির শ্বাস ছেড়ে আমাদের ফেলে এগিয়ে গেলেন প্রমথেশবাবুপ্রফেসার সেন পা চালিয়ে পৌঁছে গেলেন ওনার পাশেএই রে, আমি ভেবেছিলাম উনি শুনতে পাননি কথাটা… “সেইজন্যেই তো তোকে ডাকলাম রে আমি তো জানি ওইসব ভূতপ্রেত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলেও তোর মধ্যে যুক্তিবুদ্ধির ধারটা আজও একইরকম আছে জীবনের জটিল অস্বাভাবিকতার দিকগুলো, তার আশ্চর্য বৈচিত্র্যগুলো বিজ্ঞানচেতনা দিয়ে দেখার ক্ষমতা আছে তোরআর সেটা থেকে যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্তে আসতেও পারবি তুই, সেই ভরসাতেই…”
প্রমথেশবাবু ঘুরে তাকালেন বন্ধুর দিকে, “তাই যদি ভাবিস, তাহলে আমাকে একা ছেড়ে দে আমি জায়গাগুলো নিজের মতো করে দেখতে চাই, কোনো কমেন্টারি ছাড়া!...”
ওকে ওকে,… like a lone wolf!... Understood…” আমার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে পিছু ফিরলেন প্রফসার সেন বন্ধুকে চেনেন, বুঝলাম প্রমথেশবাবু এগিয়ে গেলেন দূরের উঁচু টিলাগুলোর দিকে গোটা জায়গাটা প্রায় চার হেক্টর মতো, শুনেছি প্রফেসার সেনের কাছেই এত বড়ো জায়গা পায়ে হেঁটে সবটা ঘোরা! অবশ্য প্রমথেশবাবুর পক্ষে সবই সম্ভব দূরত্ব রেখে চারপাশ দেখতে দেখতে এগোতে থাকলাম ওনার পিছু পিছু একটা অদ্ভুত ব্যাপার আমিও লক্ষ করেছি এখানে এসে, কিন্তু এতধরনের পরস্পরবিরোধী তথ্য আসা ইস্তক মাথায় ঢুকে চলেছে যে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবার অবকাশ পাইনি সেটা এখন যেন এই নিস্তব্ধতায় এসে, মনের গভীর থেকে ডুবসাঁতার দিয়ে যেন আচমকাই বেরিয়ে এল প্রমথেশবাবুকে ডাকতেই যাচ্ছিলাম, ঠিক তার আগের মুহূর্তেই উনি ফিরলেন আমার দিকে!
বলে ফেলো…” এই মানুষটার ইনটুইশন বোধহয় আজীবন আমাকে আশ্চর্য করে যাবে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলাম ওনার পাশে গলাখাঁকারি দিয়ে নিজের অবাক আবিষ্কারের কথাটা বলেই ফেললাম প্রমথেশবাবুকে
দ্বীপটার ওপর দিয়ে কোনো পাখি ওড়ে না, দেখেছেন? সবাই পাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে একটু আগেই দেখলাম একটা ঝাঁক, কিন্তু দ্বীপের কাছাকাছি এসেই যেন একেবারে ব্লেড দিয়ে চিরে দেবার মতো দু-ভাগে ভাগ হয়ে দ্বীপের দু-পাশ দিয়ে উড়ে বেরিয়ে গেল…” অবাক হয়ে দেখলাম, স্বভাবসুলভ ঠাট্টায় আমার পর্যবেক্ষণ হেসে ওড়ানোর বদলে সিরিয়াস হয়ে গেলেন উনি
লক্ষ করেছি অরুণ, কালই সেটাই তো চিন্তার জ্যোতি বলল এই জায়গা থেকে কোনো রেডিয়েশন হচ্ছে না, ওরা পরীক্ষা করে দেখেছে সাবমেরিন দিয়ে দেখেছে এই দ্বীপের তলাটাওযতটা সম্ভব দ্বীপটার মাত্র একভাগ উপরে…”
কতটা নেমেছিল ওরা?”
জ্যোতি বলল ৩৫০ মিটার, শেষ দেখা সম্ভব হয়নি ওদের পক্ষে crush depth অঞ্চল চলে আসায় ওরা উঠে আসে…”
তারও নীচে তো যাওয়া যায়, নাকি?”
সব সাবমেরিনের পক্ষে সেটা সম্ভব নয় সাধারণভাবে সাবমেরিনের crush depth বা যে জলস্তরে গেলে জলের চাপে সাবমেরিন গুঁড়িয়ে যাবে, সেটা ৪০০-৪৫০ সেটাও রিসার্চ সাবমেরিনগুলোর ক্ষেত্রে মনে রেখো এখান থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে পৃথিবীর গভীরতম মারিয়ানা খাত জলের চাপ অন্য সব অংশের থেকে এখানে অনেক বেশি এখানে কিছু করতে গেলে অন্য জায়গার তুলনায় অনেক বেশি সতর্কভাবে করতে হবে নাহলেই শীতল নির্বিকার মৃত্যুর অনন্ত অপেক্ষার বাহুবন্ধনে বাঁধা পড়তে হবে…”
ঘড়িতে চোখ পড়ল হাঁটতে হাঁটতে অনেকটাই চলে এসেছি, এবারে না ফিরলে লাঞ্চ-টাইমের আগে পৌঁছোতে পারব না সেটাই বলতে যাব প্রমথেশবাবুকে, হঠাৎ দেখলাম উনি মাটিতে ঝুঁকে কী যেন দেখছেন চোখ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে, শরীর বাঁকানো ধনুকের মতো টানটান ভঙ্গি আমার জানা দৌড়ে গেলাম ওনার পাশে!
এ যাবৎ প্রমথেশবাবুর সঙ্গে ঘুরে বহু অত্যদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছে নার্ভ অনেক স্টেডি হয়েছে বলেই ধারণা করতাম এতদিন, যত অদ্ভুত জিনিসই দেখি না কেন, ঠিক স্থির থাকতে পারব, বিশ্বাস ছিল আমার নিজের সম্পর্কে কিন্তু যতবারই ওনার সঙ্গে বার হই, নিজের বিষয়ে ধারণাগুলো ততবারই জোর ধাক্কা খায় যা দেখলাম তাতে হৃৎপিণ্ডটা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দ্বিগুণ বেগে চলতে শুরু করল
দেখলাম হালকা খয়েরি পাথুরে জমিটার একটা একেবারে স্বচ্ছ অংশের মধ্যে জিনিসটা দেখা যাচ্ছে যেন স্ফটিকের মধ্যে ফুটে আছে, আমরা বাইরে থেকে দেখছি ডায়ারি, দু-হাট করে খোলা একটা ডায়ারি, ফসিলের মতো রয়েছে পাথুরে জমির মধ্যে এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা হল তার ভিতরের লেখাগুলো দিব্যি পড়া যাচ্ছে এবং সেটাও বাংলায় ঝুঁকলাম আমিও

‘…রহিয়াছি গত দশবৎসর উক্ত সময়ে আমাদিগের দেশীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতির সংবাদও যে কর্ণে কিঞ্চিৎ প্রবেশ করে নাই, তাহা নহে তথাপি, আমি মৎস্যচক্ষু-লক্ষ্য হইয়া আছি কেবলমাত্র স্বীয় গুরু হইতে প্রাপ্ত বিজ্ঞানশিক্ষার সম্মানরক্ষার্থে তাহার কারণ ম্লেচ্ছদের নিকট শুধুমাত্র আমাদের দেশীয় মেধার প্রতিষ্ঠাস্থাপনই নয় এই তুচ্ছ দিনলিপিটুকুই আমার স্বীকারোক্তি, ইহাতে ভাবগৃহে চৌর্যবৃত্তি করিয়া নরকে পতিত হইতে চাহি না সত্য হইল, ইহার অন্যতম কারণ বিম্ব আমাদিগের বংশের একটিমাত্র জীবিত প্রদীপ ইংরাজ প্রভুর বিরুদ্ধাচরণের জন্য উহার পিতা, অর্থাৎ আমার ভ্রাতা এবং উহার পিতামহ, আমাদিগের পিতা মৃত্যুবরণ করিয়াছেন দারোগার কুদৃষ্টি আমাদিগের পরিবার হইতে সরাইবার অপর কোনো পন্থা আমার নিকট ছিল না শয়তান ইংরাজ! নিতান্ত শিশু, বিম্বকে অবধি ছাড় দেয় নাই শতকোটি প্রণাম আমার গুরুদেব বিজ্ঞানসাধক শ্রীযুক্ত বিষ্ণুচরণ শাস্ত্রী মহাশয়ের চরণে তাঁহার হস্তক্ষেপেই পিটার সাহেবের মতন বিশ্বখ্যাত বৈজ্ঞানিকের এইরূপ অসামান্য অভিযানের অংশীদার হইয়া দেশত্যাগ করিতে সক্ষম হইয়াছি বিম্বকেও আমার নিজস্ব শিক্ষায় শিক্ষিত করিয়া তুলিতে পারিতেছি তদুপরি পিটার সাহেবের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় রহিয়াছে সর্বোপরি এই মাদাগাসিকারা নামক বিচিত্র প্রদেশ যে কত আশ্চর্য জীবের বাসস্থল, তা ভাবিলেও শিহরিত হইতে হয় বিম্ব সম্মুখ হইতে প্রকৃতির অপূর্ব লীলা চাক্ষুষ করিবার অবকাশ পাইতেছেউহার প্রকৃত মানুষ হইয়া উঠাই আমার একমেবাদ্বিতীয়ম লক্ষ্য ইহাই আমার নিস্পন্দ জীবনসায়াহ্নের একমাত্র আনন্দ
আজি, চতুর্দশ দিবসান্তে আমি, সামান্য এক বিজ্ঞানসাধক হরিমোহন চক্রবর্তী পুনরায় দিনলিপি খুলিয়া বসিয়াছি, বিশেষ উদ্দেশ্যেই ইয়ুল সাহেবের বইটি হইতে রোখের সম্পর্কে যাহা জানিয়াছিলাম তাহা যথেষ্ট নহে, আশঙ্কা আমার বরাবরই হইয়াছে এস্থানে কারিগরি ব্যুৎপত্তির প্রয়োজনীয়তার কথা আমি পিটার সাহেবের কর্ণগোচর করিয়াছিলাম উনিও পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়াছিলেন স্বীয় পদ্ধতিতে কার্যনির্বাহ করিবার
এদেশীয় এক জ্যোতিষী গতকল্য আমার হস্তরেখা পরীক্ষাপূর্বক সাফল্যের কথা নিজমুখে জানাইয়াছে যদিচ, তাহার বক্তব্য রহস্যপূর্ণ সে বলিয়াছে এই বৎসর উলটাইলে আমরা সাফল্য পাইব! সাফল্য শুনিয়াই অধীর হইয়াছিলাম, বৎসর কিভাবে উলটাইবে তাহা আমার অজানিত! যাহাই হউক, আমার কর্ম আমি করিয়া চলিব বাকি জগদীশ্বর বুঝিবেন আমাদের গবেষণার বিষয়টি লইয়া গত দশবৎসরের প্রাণান্ত পরিশ্রম অন্তে সাফল্যের দিশা গত সপ্তাহে পাইয়াছি আমারই নির্দেশানুসারে উপযুক্ত আবহাওয়া নির্মাণার্থে রোখের বিশেষ অংশে চাপ তাপ প্রয়োগের ফল ফলিতেছে তাহার আকৃ্তির পরিবর্তন দেখিয়া পিটার সাহেব স্বয়ং আমার হস্তমর্দন করিয়া গিয়াছেন প্রাপ্তি বিরাট কল্য রাত্র হইতেই আমার বিনিদ্র অপেক্ষা চলিতেছে, অদ্য প্রভাতে কিছু ঘটিবেই আমার একান্ত বিশ্বাস আর সে বিশ্বাসই বোধকরি সত্য হইতে চলিয়াছে এইমাত্র নিজ পদতলীয় ভূমিতে অল্প কম্পন টের পাইয়াছিওই,… বিম্ব ডাকিতেছে…’

মোবাইলটা বার করো অরুণ!...” প্রমথেশবাবুর ইস্পাতশীতল স্বর শুনতে পেলাম চটপট ছবি তুলে নিলাম কয়েকটা তারপর প্রমথেশবাবুর দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম
তারিখটা লক্ষ করলে?”
ঘাড় নাড়লাম আমি… “১২ জানুয়রি, ১৯২০”…
মনের মধ্যে জমা প্রশ্নটা করতেই যাচ্ছি, পায়ের মাটি দুলে উঠল ভূমিকম্প!
“Stop that…!” তীব্র চিৎকার করে প্রমথেশবাবু দ্বীপের উত্তরাংশের দিকে ছুটলেন র‍্যামনের তত্ত্বাবধানে মাটি খোঁড়ার কাজ থেমে গেছে
এরকম কাঁপুনি রোজই হয় প্রফেসার চ্যাটার্জী, ভয় নেই…”
যা বলছি শুনুন, জিনিস আপনি খুঁড়তে পারবেন না…” প্রমথেশবাবুর স্বরে র‍্যামন পিছু হটলেন
দ্বীপের মধ্যভাগ কোথায়?” গোটা দ্বীপটা পাগলা হাতির মত খেপে উঠেছে
বলুন!” প্রমথেশবাবুর চিৎকারে হুঁশ ফিরল হতচকিত র‍্যামনেরকাঁপা হাতে আরো উত্তরের দিকে আঙুল তুললেন তিনি
চলুন দক্ষিণদিকে, মাঝখান থেকে যতদূরে যাওয়া যায়!...”
তুমুল আন্দোলনের মধ্যে যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি এগোতে লাগলাম আমি, প্রমথেশবাবু, র‍্যামন আর তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা কিছুটা যেতেই দেখলাম প্রফেসার সেনও ছুটে আসছেন
প্রমথেশ, স্যাটেলাইট ফোনে খবর দিচ্ছি, সেনাবাহিনী কাছেই আছে, তোরা…”
টলমল হাতে সেনের হাত চেপে ধরলেন প্রমথেশবাবু
তোদের যে দুটো চপার আছে, তাতে সবাইকে তোল…” অবাকচোখে মুহূর্তমাত্র প্রমথেশবাবুর দিকে তাকিয়েই ফোনটা কানে তুললেন প্রফেসার সেন তখনই তুমুল আতঙ্কের চিৎকারের মধ্যে শব্দটা শুনতে পেলাম চিড় খেয়ে পাথর ফাটলে যে শব্দ হয়, সেই শব্দ চপারটা দেখতে পাচ্ছি, প্রায় একশো মিটার… “…” সমবেত আর্তনাদে ভরে উঠল দ্বীপের থমথমে বাতাস! দ্বীপটা মাঝ বরাবর ফেটে গেছে, আমাদের অংশটা উল্লম্বভাবে উঠে যাচ্ছে ওপরের দিকে গড়িয়ে নেমে আসছি, ক্রমশ টের পাচ্ছি শীতল জলস্পর্শ
ওপরে তাকাও অরুণ…”
প্রমথেশবাবুর শিরছেঁড়া স্বরে চমকে কোনোক্রমে উপরে তাকালাম, আর তাকিয়েই ভুলে গেলাম কোথায়, কী অবস্থায় আছি! মাথার আকাশ ঢেকে গেছে বিরাটাকার দুই হালকা সাদাটে-খয়েরি ডানায়, পাথরের মতো বাঁকানো সুকঠিন ঠোঁট আর ঈগলসুলভ শ্যেণদৃষ্টির পাখিটা ধীরে ধীরে দ্বীপের গর্ভ থেকে বেরিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে
রক, দেখো অরুণ, ইবন বতুতা আর আরব্যরজনিতে যার বর্ণনা য়েছে, সেই রকপাখি!...”
আমাদের সঙ্গের সিকিউরিটি ওই অবস্থাতেই মেশিনগান তুলতে গেল মুহূর্তের ধাক্কায় তাকে জলে ফেললেন প্রমথেশবাবু উড়ে গেল প্রাচীন পুরাণপাখি

*                   *                   *

সেনাবাহিনীর চপারে যখন উঠলাম, তখন কয়েক মিনিট আগের তাণ্ডবের চিহ্নমাত্রও নেই বক্তা প্রমথেশবাবুর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন চপারের বিজ্ঞানীদের সবাই, যাঁদের অনেকের চোখেই সম্ভ্রমপূর্ণ বিস্ময় নিয়েছে প্রাথমিক রাগের জায়গা
এবার বুঝলেন? অরুণের ফোনের ওই লেখাটা পড়েই বুঝেছিলাম বিজ্ঞানী হরিমোহন একশো বছর আগে মাদাগাসকারে গিয়েছিলেন হেনরি ইয়ুলের মার্কোপোলোর অনুবাদ বইটি পড়ে যেখানে উনি বিরাটাকার এপিওরনিস পাখির ডিমের সন্ধান পান বলে উল্লেখ আছে, যা ইয়ুল মধ্যপ্রাচ্যের পুরাণকথায় বহুবার উল্লিখিত, অপরাজেয়, দানবাকৃতি রকপাখির ডিম বলে শনাক্ত করেছিলেন কিন্তু তার আকার ছোটো ছিল মায়ের অবর্তমানে সে ডিমের প্রয়োজন ছিল ইনকিউবেটরের, যেটা তৈরির কাজ করছিলেন ওনারা আংশিক সাফল্য আসে যখন ডিমের আকার বাড়তে থাকে, কিন্তু এতটা বাড়বে সেটা ওনাদেরও স্বপ্নাতীত ছিল সে ডিম ধরে রাখার ক্ষমতা ছিল না ওনাদের আমার ধারণা ওই দানব ডিমের চাপেই শেষ হয় গবেষণাকারী দলটা তারপর কালের পরিহাসে সেই অতুল সম্পদ পেরিয়ে আসে একটি মহাসাগর, সম্ভবত তাসমানিয়ার কাছে সাউথ-ইস্ট কেপ দিয়ে সুনামির সময় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ঢোকে আমার ধারণা, এই ডিম থেকে এমন কোনো অদৃশ্য বিচ্ছুরণ ঘটছে যাতে অন্য কোনো প্রাণী এর কাছে আসতে পারে না পাখিরাও এর ওপর দিয়ে উড়তে সাহস পায়নি
ঘটনাচক্রে হরিমোহনবাবুর ডায়ারিটা ওই ডিমের তলায় চাপা পড়ে এবং ওনার দেওয়া তাপ চাপের কারণে খোলার উপরিভাগ সামান্য ভেঙে ঢুকে যায় ওর মধ্যে, আর কোনো আশ্চর্য উপায়ে ফসিলীকৃত অবস্থায় থেকে যায় নাহলে এত সহজে রহস্যের মর্মোদ্ধার হত না…”
কিন্তু জ্যোতিষীর কথাটা?”
ফলল তো!”
ভুরু কুঁচকে তাকালেন প্রফেসার সেন, আমিও!
বুঝলে না? ডায়ারিতে কী বছর ছিল? ১৯২০ এটা? ২০১৯, উলটে গেল !”
কিন্তু তখন অত চেষ্টাতেও ডিম ফুটল না, আর এখন…”
প্রাকৃতিক ইনকিউবেটর জ্যোতি! তুই নিজেই বলেছিস উষ্ণায়নের জন্য এখানে তাপমাত্রা অনেক বেশি, আর্দ্রতাও সেইসঙ্গে যোগ হয়েছে মারিয়ানা খাতের জলের চাপ! ভিতরের প্রাণ জেগে উঠেছে তাতেই, আর তার নড়াচড়ার মুহূর্তে সামনে কোনো জাহাজ এসে পড়লে...”
তুই যদি আমাকে তখন সেনা ডাকতে দিতিস, তাহলে অন্তত পাখিটাকে ধরা যেত প্রমথেশ!...” উষ্মাটা ঢাকলেন না প্রফেসার
রকপাখি কীসের প্রতীক জানিস? রক্ষকের! বৈপ্লবিক কল্পনা আর উপকথার দুনিয়ার শাক্ত রাজা সে রহস্য তার ভূষণ, অতিবাস্তবের চড়া আলোয় নিলাম হওয়া তার সাজে?”
প্রমথেশবাবুর কথাটার উত্তর দিতে পারলেন না প্রফেসার সেন রহস্যদ্বীপ দু-খোলায় ভাগ হয়ে তখন ভাসছে মহাসাগরীয় গাঢ় জলে
----------
ছবি - শুভ্রা ভট্টাচার্য

1 comment:

  1. অসাধারণ একটি রহস্য গল্প। ভীষণ ভালো লাগলো।

    ReplyDelete