উরগিন লান্ডুপ
রবীন্দ্রনাথ হালদার
১৯৮৯ সাল, মাঝখানে অনেকগুলো
বছর পেরিয়ে গেছে। আজও যে মানুষটাকে ভুলতে পারা যায়নি তার একটা ছোট্ট সিদ্ধান্তের
জন্য, তার নাম উরগিন লান্ডুপ। ভদ্রলোক লাদাখ অধিবাসী
একজন বুদ্ধিস্ট। এই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষরা কতটা
ন্যায়পরায়ণ হয়, তার সেইদিনের কাজই আমাদের কাছে সেটার দৃষ্টান্ত
স্থাপন করেছিল। ঘটনাটা আপাতদৃষ্টিতে খুবই ক্ষুদ্র হলেও সেইদিন তিনি আমাদের সকলের
শ্রদ্ধা আদায় করে নিয়েছিলেন। ইছাপুর
রাইফেল ফ্যাকটরির অভিযান ছিল লাদাখের গোলাপ কাংরি ও পরচা কাংরিতে। কলকাতা থেকে দশ
সদস্যের দল চলেছি লাদাখে। সকলের মধ্যেই তখন চলছে এক বিশেষ উত্তেজনা। কারণ লাদাখ
ছিল তখন মানুষের কাছে অনেকটাই কল্পনার জগত। আজকের মতন
সেই দিনগুলিতে ট্যুরিজমের এত রমরমা ছিল না। তাই মানুষের কাছে লাদাখ ছিল ধরাছোঁয়ার
বাইরে। ট্রেনের রাস্তা জম্মুতে শেষ। তারপরেই শুরু হয় লড়াই। সেই দিনের যা পরিস্থিতি, খুব বেশি যে গাড়িঘোড়া চলত তা নয়। কারণ রাস্তার নানা
প্রতিকূলতা, তার সঙ্গে পাকিস্তানের সীমান্ত সমস্যা। ট্রেন
থেকে নামার পর জম্মু থেকে সড়কপথে শ্রীনগর যেতে সময় লাগত বারো ঘণ্টা। আবার কখনও
কখনও সেটা চলে যেত একেবারে অনিশ্চয়তায়। রাস্তায় অনেক জায়গায় ধসে আটকে যেতে হত, যেটা আমাদের ক্ষেত্রেও হয়েছিল, যদিও
আমাদের অভিযানের পুরো দলটাই আর্মি কনভয়ের সঙ্গেই ছিলাম। এর একমাত্র কারণ রাইফেল
ফ্যাকটরির প্রশাসন ভারতীয় সেনা বিভাগের নিয়ন্ত্রণে। সেই
কারণেই অভিযানের পুরো দলটাকেই সেনা নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে লাদাখ যাতায়াত করতে হয়েছিল।
এই সাহায্যটা না পেলে অভিযানটা ব্যর্থই হত। সেটা পরবর্তী অভিজ্ঞতা দিয়েই বুঝেছিলাম।
কলকাতা থেকে ফোনেই জম্মু রেলওয়ে স্টেশন থেকে লাদাখ পর্যন্ত যাওয়া এবং আসা আর্মির
গাড়িতেই ব্যবস্থা হয়েছিল। জম্মু থেকে শ্রীনগর পর্যন্ত প্রাইভেট বাস সব সময় চলতে
থাকে, কিন্তু শ্রীনগর থেকে লে যাওয়ার বাস সম্পূর্ণ
নির্ভরশীল সেনা বিভাগের অনুমতির উপর, কারণ দ্রাস
থেকে কারগিল খুব স্পর্শকাতর জায়গা, পাকিস্তান
মাঝে মধ্যেই এই অঞ্চলে হামলা চালাতে থাকে। এর পরেও শ্রীনগরে প্রায়ই বাস ও অন্যান্য
গাড়িঘোড়া কারফুর জন্য অচল হতে থাকে।
আমাদের দল জম্মু আর্মি ইউনিটে
একরাত কাটানোর পরের দিন সকালে আর্মি কনভয়ের বাসে চলে যাই শ্রীনগরে, যদিও মাঝে মাঝে রাস্তায় ধসের জন্য আটকে যেতে হয়। সন্ধে ছ’টায় শ্রীনগরে পৌঁছানোর কথা ছিল, কিন্তু
সেখানে রাত দেড়টায় শ্রীনগর আর্মি ইউনিটে পৌঁছে এক অসহায় পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়।
সে এক নতুন অভিজ্ঞতা। এই প্রথম খুব কাছ থেকে সেনাদের রাত কাটানো দেখা হল। যখনই
কনভয় ঢুকবে শ্রীনগরে তখনই প্রত্যেক সেনাকে নিজ নিজ ইউনিটে যাওয়ার জন্য অফিস থেকে
লিখিয়ে স্ট্যাম্প করে নিতে হবে। রাত দেড়টা তখন, সব
অফিস বন্ধ। যে যার বেড রোল খুলে ঐ ঠান্ডায় কম্বল পেতে খোলা আকাশের নিচে শুয়ে পড়ল।
আমাদের দল ঐ অবস্থা দেখে বুঝে গেলাম আমাদেরও কী করতে হবে। ঐ রাতে একটা গাছের তলায়
সকলে আশ্রয় নিলাম। মনের মধ্যে তখন দলের প্রত্যেকেরই ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে একমাত্র লিডার
ও ডেপুটি লিডার ছাড়া। এতদিন বাইরে থেকে তাদের পোশাক-আশাক
দেখে এসেছি। আর দেখেছি তাদের যে কোনো কাজে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া এবং
ঝাঁপিয়ে পড়া। এর বাইরে সেনাবাহিনী সম্বন্ধে আর তেমন কোনো ভাবনার অবকাশ সম্ভব ছিল
না। রাতের ঐ শীতের দাপট হেলায় উড়িয়ে দিয়ে খোলা আকাশের নিচে দেশের জন্য জীবনকে সঁপে
দেওয়া চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা তো দূরের কথা,
অলীক বা মিথ্যা বলেই মনে হত। এইভাবে দিনে দিনে জীবনে কঠিন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে
নিজেদেরকে সেনারা গড়ে তোলে দেশের কাজের জন্য। এখান থেকেই ওরা সঞ্চয় করে আত্মবিশ্বাস
ও জীবন বলিদানের প্রেরণা। বিষয়টা
সাধারণ মানুষ কখনোই বাইরে থেকে অনুধাবন করতে পারবেন না। চলতে চলতে সেনাবাহিনীর আরও
কিছু দেখেছি যা কল্পনাতীত। সীমান্তের কাছাকাছি থাকা সেনাদের যে জীবন সেটা আরও
কঠিন। আর্মি কনভয়ে শ্রীনগর থেকে লে-র পথে শুরু
হয় আমাদের যাত্রা। রাস্তায় মাঝে দু-রাত কাটিয়ে তৃতীয় দিনে পৌঁছাতে হবে লাদাখ আর্মি
ট্রানজিট ক্যাম্পে।
শ্রীনগর থেকে প্রথম দিন সোনমার্গ
হয়ে ক্যাপটেন মোড় পেড়িয়ে দ্রাস। সোনমার্গ থেকে ক্যাপটেন মোড় পর্যন্ত রাস্তা পুরোটাই
চড়াই। ক্যাপটেন মোড়ের পর থেকে রাস্তা একটু একটু করে পাকদণ্ডি হয়ে নেমে গেছে
দ্রাসে। আমাদের অভিযানের দল ছিল লিড কনভয়ের সঙ্গে। গাড়ি
ক্যাপটেন মোড় পৌঁছাতেই গাড়ি থামিয়ে ক্যাপটেন চৌধুরীর স্মৃতিফলকে নারকেল ভেঙে তার
নির্মল জল ও ধূপকাঠি জ্বেলে পুজো দিয়ে দ্রাসের উদ্দেশে গাড়ি এগিয়ে চলে। এখানে
ক্যাপটেন মোড় এবং ক্যাপটেন চৌধুরীর উল্লেখ না করলে ও তার স্মৃতিচারণে দু-এককথা না বললে তাকে অসম্মানই করা হবে।
এই ক্যাপটেন চৌধুরী ছিলেন
ভারতীয় সেনার এক দক্ষ অফিসার। শুধু তাই নয়,
উনি ছিলেন এক জাতীয় সম্পদও বটে। শ্রীনগর
থেকে দ্রাসের এই পথ উনি ম্যাপ ঘেঁটে আবিষ্কার করেন এবং ওনার পরিকল্পনা অনুযায়ী এই
সড়ক তৈরি হয়। যখন সড়ক উদ্বোধন হয় তখন দেখা যায় সড়কের নামকরণ হয়েছে ঐ ব্যাটেলিয়নের
যিনি কর্নেল ছিলেন তার নামে। ক্যাপটেন
চৌধুরী এই চরম অপমান এবং যন্ত্রণার শিকার হওয়ায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং এক জোঙ্গা
জিপে চড়ে এই মোড় থেকে ঐ জিপ-সহ ঝাঁপ
দিয়ে আনুমানিক তিন হাজার ফিট নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া খরস্রোতা শতদ্রু নদীর জলে নিজেই
নিজের প্রাণ উৎসর্গ করেন দেশের জন্য। সেই থেকে আগের নাম বদলে ক্যাপটেন চৌধুরীর
স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই মোড়ের নামকরণ হয় ক্যাপটেন মোড়। না জানি এমন কত ঘটনাই নিভৃতে মানুষের
অজান্তে গুমরে মরে! এই পাহাড় সংক্রান্ত তেমনই এক
বঞ্চনার শিকার রাধানাথ সিকদারের ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়।
পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গের
আবিষ্কারক হলেন রাধানাথ সিকদার, কিন্তু ১৮৫২
সালে সারভেয়ার জেনারেল অ্যানড্রু ওয়াগ দাবি করেন, “আমি
পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গ আবিষ্কার করে ফেলেছি।” ঐ শৃঙ্গের আগে নাম ছিল পিক-১৫। সেই সময় পিক চিহ্নিত করার
জন্য নাম রাখা হত সংখ্যায়। ঐ অ্যানড্রু সাহেবই নামকরণ করেন আগের সারভেয়ার জেনারেল
জর্জ এভারেস্টের নামে। এই অ্যানড্রুও পরে সারভেয়ার জেনারেল হয়েছিলেন। ধারণা করা হয়
ঐ পদ পাওয়ার জন্যই হয়তো উনি আগের ঘটনাটা ঘটিয়েছিলেন। অ্যানড্রুর পরে যিনি সারভেয়ার
জেনারেল হন তার নাম কর্নেল সিডনি জেরাল্ড বারার্ড। ঐ ব্রিটিশ ভদ্রলোক চেয়ারে বসেই
সমস্ত পুরোনো তথ্য ঘেঁটে আবিষ্কার করেন পিক ১৫-এর
আবিষ্কারক হলেন অতি উচ্চস্তরের গণিতবিদ রাধানাথ সিকদার। সেই সময় ত্রিকোণমিতির
সাহায্যে হিমালয়ের ঐ অংশের জরিপ করা হয়েছিল, সঙ্গে
থিওডোলাইট যন্ত্রের সাহায্যে এই পর্যবেক্ষণ হয়েছিল। ঐ সার্ভের নাম ছিল ‘দ্য গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক সার্ভে’। অ্যানড্রু
ছিলেন অতি সাধারণ স্তরের একজন ইঞ্জিনিয়র। সিডনি জেরাল্ড বারার্ড এই মিথ্যে তথ্য
ফাঁস করে ব্রিটেনের নেচার পত্রিকায় ১৯০৪ সালে একটি প্রবন্ধ লেখেন ‘মাউন্ট এভারেস্ট’ নামে।
সেখান থেকেই সমস্ত তথ্য পাওয়া যায়। আসলে রাধানাথ যত বড়ো গণিতবিদই হোন না কেন তিনি
যে ছিলেন একজন কৃষ্ণাঙ্গ! যুগ যুগ ধরে
এই বঞ্চনার ইতিহাস চলে আসছে।
দ্রাসের সেই একটা রাত আমাদের
দলের কাছে খুব ত্রাসেই কাটে সেনাদের কষ্ট দেখে, যা
চিরকাল দেশের মানুষের কাছে অজানাই থেকে যাবে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ঠান্ডা পড়ে
রাশিয়ার সাইবেরিয়ার ভার্গনস্কে। ঠিক তার পরের দ্বিতীয় স্থানটা হল ভারতের দ্রাসে। ঐ
ঠান্ডার মধ্যে সেনাবাহিনীর কাজের প্রতিটা মুহূর্ত কত কষ্টের সেটা না দেখলে হৃদয়ঙ্গম
করা অসম্ভব। খোলা আকাশের নীচে মাইনাস ৩০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সারা রাত ক্রস মার্চিং
ডিউটি, একদিন নয় লাগাতার দিনের পর দিন চলতেই থাকে। দ্রাস
থেকে বুথখারবুর পথে কোনো এক জায়গায় কনভয় থেমে যায়। আমাদের পথের বাঁদিকের যে গিরিশিরা
তার অপর প্রান্তে পাকিস্তানের সীমানা। ভারতীয় সেনাদের এই অঞ্চলটায় মাটির উপরে কোনো
ক্যাম্প নেই। সবই মাটির তলায় বাঙ্কারে থাকার ব্যবস্থা। খারবু থেকে কারগিল হয়ে পরের
দিন বিকেলে লাদাখ ট্রানজিটে পৌঁছালাম। কার্গিল অতিক্রম করে লাদাখ ঢোকার দোরগোড়ায়
গুরুদুয়ারা। কারগিল থেকে এই গুরুদুয়ারার আগে পর্যন্ত এক লম্বা সমতলভূমি (PLATO), যার উপর দিয়ে চলে গেছে বেশ চওড়া ও
লম্বা পাকা রাস্তা। ১৯৬০ সালে ভারত-চিন যুদ্ধের সময় চিন সিয়াচিন হিমবাহ অতিক্রম
করে কার্গিল পর্যন্ত এই পাকা সড়ক তৈরি করেছিল, যদিও
পরবর্তীকালে এই অঞ্চলসহ সিয়াচিন ভারতের দখলে চলে আসে। এই প্লেটোটা এতটাই লম্বা যে
পৃথিবীর এই উচ্চতায় এত বড়ো লম্বা রাস্তা আর কোথাও নেই। লাদাখের ট্রানজিট ক্যাম্পে
পৌঁছানোর পরে মেজর জামলকির তত্ত্বাবধানে আমাদের থাকতে হয়। এই
ক্যাম্প থেকে লে শহর দশ কিলোমিটার পথ। এই মেজর জামলকির অনুমতি নিয়ে পরের দিকে আমরা
চলে যাই লে শহরে। কারণ অভিযানের সরকারি অনুমতির সব কিছুই হবে লে শহরে। সব সরকারি
অফিস লে শহরেই অবস্থিত। ফৌজি অনুশাসন থেকে বেরিয়ে ঐ শহরে ঢুকতেই অন্য সমস্যা শুরু
হয়ে গেল। শহরে প্রায়ই কার্ফু চলতে থাকে, কারণ লাদাখ
জম্মু কাশ্মীরের অন্তর্গত, ফলে সব
সরকারি অফিসে মুসলিমরাই কাজ করছে, লে-লাদাখের
স্থানীয় বৌদ্ধিস্টদের চাকুরি প্রায় নেই বললেই চলে। সেই সমস্যা নিয়ে বৌদ্ধিস্টদের ঐ
সময় লাগাতার আন্দোলন চলছিল। সেই আন্দোলন থামাতেই মাঝে মধ্যেই কার্ফু হচ্ছিল। ঐ
কার্ফুর জন্য আমাদের দলের কাজ যাতে ব্যাহত না হয় সেই জন্য ডিএম অফিস থেকে স্পেশাল
পারমিশন নেওয়া হয়েছিল। অভিযানে শীতের পোশাকের জন্য J & K ট্যুরিজমকে আগে থেকেই
চিঠি দিয়ে যোগাযোগ করা হয়েছিল। ঐ চিঠির কপি নিয়ে ডাইরেক্টরের সঙ্গে দেখা করলাম। দরজার
বাইরে সোনালি রঙের মেটাল দিয়ে ইংরেজি অক্ষরে লেখা রয়েছে উরগিন লান্ডুপ (URGIN LANDUP)। দরজার
বাইরে বসে আছেন মাঝবয়সি একজন চাপরাশি। তাঁকে হিন্দিতে জানালাম ডাইরেক্টরের সঙ্গে
দেখা করব। উনি আমাদের বাইরে দাঁড় করিয়ে ভিতরে
ঢুকলেন। বেরিয়ে এসে বললেন - যান। অনুমতি
নিয়ে দলের লিডার এবং ডেপুটি লিডার দুজনেই ঢুকলাম। আমাদের বিস্তারিত সব পরিচয় দিয়ে
IMF-এর পারমিশন দেখিয়ে ট্যুরিজমের চিঠির কপিটা ওনার
হাতে তুলে দিতেই উনি ভালো করে পড়লেন। তারিখানুযায়ী পুরোনো ফাইলগুলো ভালো করে ঘেঁটে
দেখলেন। শ্রীনগর হেডকোয়ার্টার থেকে তখনও ওনার কাছে কোনো ইনস্ট্রাকশন বা চিঠি
আসেনি। উরগিন লান্ডুপের ফাইল ঘাঁটার সময় নজরে এল ঘরের মধ্যে একটাই বড়ো ছবি দেয়ালে
ঝুলছে, সেটা নেতাজির সৈনিক বেশে ঘোড়ায় চড়ার। রুমটায়
সবুজ কার্পেট পাতা। বড়ো সেক্রেটারিয়েট টেবিলের তিন দিকটায় চেয়ার দিয়ে সাজানো। বেশ
একটা রুচিসম্পন্ন ঘর এবং মনোরম পরিবেশ। ঘরের সঙ্গে মানানসই তাঁর চেহারা এবং
পরিধানও। গায়ের রং খুবই ফরসা। পায়ে
কালো পালিশ করা লেশ বাঁধা শু। পরনে অফ
হোয়াইট কালারের প্যান্ট, সঙ্গে হালকা
নীল রঙের চেক হাফশার্টটা গুঁজে পরা। উচ্চতাও বেশ ভালো। এক কথায় সৌম্যদর্শন চেহারা।
ঘরে অনুমতি নিয়ে ঢুকতেই চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে উলটোদিক থেকে হাতটা বাড়িয়ে আমাদের
সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বসতে বললেন। প্রথম সাক্ষাতেই ভদ্রলোকের ব্যবহারে আমরা দুজনাই
অভিভূত। এক নিরহংকারী মানুষ। উনি হলেন বৌদ্ধিস্ট। বৌদ্ধ
ধর্মের মূলমন্ত্র অহংকারকে ত্যাগ করা। শুধু তাই-ই
নয়, যখন ফাইল ঘেঁটে দেখলেন শ্রীনগর হেড অফিসের কোনো
পারমিশন ওনার ফাইলে আসেনি তখন বললেন, “কিছু তো
একটা আপনাদের জন্য করতে হবে।” ঐ অচেনা
পরিবেশে এই কথা শুনে কিছুটা যেন পায়ের তলায় মাটি ফিরে পেলাম। নিশ্চয়ই
কিছু একটা পজিটিভ রাস্তা আমাদের জন্য উনি ভাববেন। কিছুক্ষণ আমাদের সঙ্গে কথা বলে উরগিন
লান্ডুপ যখন জানতে পারলেন আমাদের দল আর্মি ট্রানজিট ক্যাম্পের মাধ্যমেই লে শহরে
পৌঁছেছি, সঙ্গে সঙ্গেই উনি বললেন, “আর্মির
কোনো অফিসারকে দিয়ে একটা গ্যারান্টার লেটার এনে দিন। ওটা না পেলে তখন অন্য কোনো
চিন্তা করব।” শীতের
পোশাক না হলে আমাদের এই অভিযান যে খুব কষ্টকর হয়ে উঠবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
একজন লাদাখবাসী হয়েও উনি আমাদের জন্য এইটুকু অনুভব করেছেন, এই
কারণে অভিযানের দল ওনার কাছে যথেষ্ট কৃতজ্ঞ থাকবে। একথা কোনোদিন ভুলবার নয়।
সেদিনের মতন উরগিন লান্ডুপকে অভিবাদন জানিয়ে আমরা দুজন ওনার ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
পরের দিন লে শহর থেকে লিডার ও
ডেপুটি লিডার দুজনাই ছুটলাম আর্মি ট্রানজিট ক্যাম্পে মেজর জামলকির সঙ্গে দেখা
করতে। প্রায় দশ কিমি রাস্তা দুজনা হেঁটেই চলে গেলাম। এই লাদাখ উপত্যকাকে বলা হয়
হিমালয়ের ডেজার্ট বা মরু উপত্যকা। চারিদিকটা পর্বত গিরিশিরা দিয়ে ঘেরা। গাছপালার অস্তিত্ব
নেই বললেই চলে। শুধু নদীতটে (RIVER BED) ছোটো ছোটো কিছু সবুজ গাছ প্রকৃতির পানে
চেয়ে বেঁচে থাকার শেষ লড়াইটুকু চালিয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে শুধু রুক্ষ ও শুষ্ক পাথর
আর বালি মাটি। বছরে দুই থকে আড়াই ইঞ্চি বৃষ্টির পরিমাপ। অক্টোবরের শেষের থেকে শুরু
হয় বরফ বৃষ্টি ও তুষার পাত। চলে সেই মার্চ মাস পর্যন্ত। পাঁচ মাস এই দেশটা থাকে
বরফের চাদরে ঢাকা। বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ সমতল ভূমি থেকে অনেক কম থাকায় বড়ো
গাছপালা বিশেষ কিছু নেই, আর যা আছে
তার বাড়বাড়ন্ত ভীষণ কম। রুক্ষ ও শুষ্ক মরূদ্যান। দেখেই শ্বাসকষ্ট এমনিতেই শুরু হয়ে
যায়। কিন্ত এরই মধ্যে এক অপার সৌন্দর্য লুকিয়ে রয়েছে। মনটাকে নিমেষেই টেনে নিয়ে
যায় মরুভূমির দেশগুলির সেই আরব্য উপন্যাসের কহিনিতে। ভাবনার জগত হাত ধরে টানতে
টানতে কখন যেন পার করে দেয় এয়ারপোর্টের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের এই দীর্ঘ
পথ। আমাদের দুজনার কথার ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে ভেসে ওঠে উরগিন লান্ডুপের মুখটা, কারণ তাঁরই পরামর্শে ছুটে আসা এই ট্রানজিট ক্যাম্পে মেজরের
কাছে। এই রুক্ষ মাটি ও আবহাওয়ায় একটা মানুষ কতটা অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে সচেষ্ট হয়ে
উঠেছেন আমাদের পাশে দাঁড়াতে ও সাহায্য করতে, হয়তো
বৌদ্ধ ধর্মেরই এটা বিশেষ গুণ। সময় ও
দীর্ঘ পথকে উপেক্ষা করে পৌঁছে যাই আর্মি ট্রানজিট ক্যাম্পে।
মেজর জামলকির সাক্ষাতে সমস্ত
বিষয়টা খুলে জানাতেই বললেন, “বসুন, সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।” প্রথমে
জানতে চাইলেন, “এখানে এলেন কীভাবে? পায়ে হেঁটে?” বললাম, “হ্যাঁ।” উনি
একটু আশ্চর্য হয়ে উত্তর দিলেন, “আপনাদের
কাছে আমাদের ট্রানজিট ক্যাম্পের ল্যান্ড ফোন নাম্বার দেওয়া আছে। একটা ফোন করলেই
আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিতাম। আপনাদের এই অভিযানের জন্য একটা গাড়ি সবসময় আলাদা করে রাখা
আছে। আপনারা লে শহরের মধ্যে সেটা ব্যবহার করতে চাননি বলেই গাড়িটি ফিরে এসেছে। এখন
থেকে যে কোনো কাজে গাড়ি প্রয়োজন হলে একটা ফোন করবেন,
গাড়ি চলে যাবে।” কথার ফাঁকে অফিস বয় গরম কফি নিয়ে এল।
মেজর জামলকি স্টেনোগ্রাফারকে ডেকে গ্যারান্টারের বয়ানে একটা চিঠি বানিয়ে আনতে বললেন।
দশ মিনিটের মধ্যে চিঠি হাজির। ঐ অফিসে আমাদের অভিযানের জন্য নতুন একটা ফাইল খোলা
হল। চিঠির উপর সরকারি সিল ও মেজরের সিল লাগিয়ে সই করে সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ডেকে
আমাদের ছেড়ে দিলেন। ঐ গাড়ি নিয়ে সোজা ট্যুরিজম অফিসে পৌঁছে গেলাম। ওখানে লন্ডুপ
স্যারকে চিঠিটা দেখানো হল। চিঠিটা দেখে উনি একটু মুচকি হেসে বললেন, “বাঃ, এতেই কাজ
হয়ে যাবে। আগামীকাল সকাল দশটায় আসুন। আমি আপনাদের
শীতের পোশাকগুলি বুঝিয়ে দিয়ে দেব।” ঐ গাড়ি
আমাদের হোটেলে ছেড়ে দিয়ে ফিরে গেল ট্রানজিট ক্যাম্পে।
গাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে সবসময় একজন জুনিয়র কমান্ডিং অফিসার থাকেন (JCO)। যাবার
আগে তিনিও বলে গেলেন, “স্যার,
যখনই গাড়ির প্রয়োজন হবে একটা ফোন করে দেবেন।” অচেনা
আজানা পরিবেশে যে মানুষ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন বা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে ওঠেন
তারা আলাদা করে নিজেদের পরিচয় রেখে যান। এই বিষয়ে উরগিন লান্ডুপের সঙ্গে মেজর জামলকিও
অন্যতম।
মূল অভিযানে বেরোনোর ঠিক
পূর্বমুহূর্তেই মেজর জামলকিকে ফোনে গাড়ির প্রয়োজনের কথা জানাতেই বললেন, “ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই গাড়ি হোটেলে পৌঁছে যাবে।” দলের সবাই স্যাক গুছিয়ে অপেক্ষা করছি। গাড়ি এলেই সোজা ট্যুরিজম
অফিস থেকে শীতবস্ত্র তুলে নিয়ে ঐ গাড়িতেই পৌঁছে যাব আমাদের নির্দিষ্ট স্থানে। সেই
স্টোক ভিলেজে, যেখান থেকে শুরু হবে আমাদের অভিযানের পথ চলা। সকাল আটটায় গাড়ি এসে
থামল আমাদের হোটেলের দরজায়। উরগিন লান্ডুপের কথানুযায়ী ঠিক সাড়ে নয়টায় আমরা পৌঁছে
যাই ট্যুরিজম অফিসে। উনি না আসা পর্যন্ত আমরা গাড়িতেই অপেক্ষা করতে থাকি। আমাদের চরিত্র
অনুযায়ী দলের দু-একজন মন্তব্য করতে থাকে, “দেখুন, উরগিন লান্ডুপ দশটায় আসে না বারোটায় আসে!” দশটার ঠিক দশ মিনিট আগেই উনি অফিসের দরজার সামনে হাজির
হলেন। আমরাও একে একে ওনার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। নিজেই বলতে লাগলেন, “অভিতক অফিস খুলা নহি!” এর
মানে প্রত্যেক দিন যে এই সময় অফিসটা খুলে যায় সেটা বোঝা গেল। অফিসের অন্যান্য
কর্মচারীরাও তখন পৌঁছে গেছেন। অফিস খুলতে দেরি হচ্ছে দেখে ওনার বিরক্তি প্রকাশের
ভাবটা আরও বেড়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই একজনকে নির্দেশ দিলেন পাশের একটা জায়গা
থেকে একটা হাতুড়ি আর একটা হ্যাক-শ ব্লেড
নিয়ে আসার জন্য। তিনি দৌড়ে গিয়ে লোহা কাটা করাত ও একটা হাতুড়ি নিয়ে চলে এলেন।
লান্ডুপ নিজে হাতেই তালার কিছু অংশ কেটেই হাতুড়ি দিয়ে ঘা মারতেই তালাটা ভেঙে গেল।
ততক্ষণে চাবির কেয়ারটেকার ভদ্রলোক চলে এসেছেন। তখন ঘড়িতে দশটা বেজে পাঁচ মিনিট
হয়েছে। ডিরেক্টরের ঐ কাজ দেখে বাইরে দাঁড়ানো সকল কর্মচারী নিমেষেই ভয়ে যেন চুপসে
গেলেন। ভয়ে সকলেই তটস্থ, কারও মুখে কোনো কথা নেই। দরজা খুলে সবার আগে দ্রুতগতিতে
দোতলায় উঠে নিজের চেম্বারে ঢুকে চেয়ারে বসেই বেল বাজাতেই একজন দৌড়ে এলেন। তাকে
দিয়ে স্টোর ম্যানকে ডেকে পাঠালেন। লজ্জিত মুখে ততক্ষণে আমাদের চেয়ারে বসিয়ে
সামান্য পাঁচ মিনিট দেরি হওয়ার জন্য ক্ষমা চাইলেন। যার কাছে অফিসের চাবি ছিল তাকেও
ডেকে পাঠালেন। তিনি ডিরেক্টরের চেম্বারে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই বলে দিলেন হাজিরা
খাতায় সই না করতে এবং স্টেনোকে চাবি বুঝিয়ে দিয়ে বাড়ি চলে যেতে বললেন। মাথা নিচু করে
ভদ্রলোক কথা শুনে ভয়ে আস্তে করে বেরিয়ে গেলেন। পাঁচ মিনিট দেরির জন্য এমন ঘটনা হতে
পারে, এটা দেখে বিষয়টা আমাদের খুব ভাবিয়ে
তুলেছিল। স্টোরকিপার আসতেই আমাদের দশ পিস জ্যাকেট রেডি করে ওনাকে জানাতে বললেন। ততক্ষণে
আমাদের সকলের জন্য টেবিলে কফিও এসে গেছে। আমরা কফি পান করতে করতেই স্টোরকিপার খবর
দিয়ে গেলেন - স্যার জ্যাকেট সব রেডি। লান্ডুপ বললেন, “একটু অপেক্ষা করুন,
আসছি।” এই কফি পানের ফাঁকে উনি আমাদের অভিযানের বিষয়
নিয়ে খুব আগ্রহের সঙ্গে খুঁটিনাটি জানার চেষ্টা করছিলেন। ঠিক সেই সময়ে একটু সাহস
করে খুবই বিনয়ের সঙ্গে লান্ডুপজিকে অনুরোধ করলাম, “স্যার, আমাদের একটা আবেদন আছে সমস্ত দলের পক্ষ থেকে।” উনি মাথা নাড়িয়ে বললেন, “হ্যাঁ
হ্যাঁ, অবশ্যই বলুন।”
মনের মধ্যে ভয় থাকলেও নির্দ্বিধায় বললাম, “আজকে অফিসের
তালা ভেঙে দরজা খোলার ঘটনায় চাবির কেয়ারটেকারকে ক্ষমা করে দিন।” শুনে একটু মুচকি হাসলেন। উনি আমাদের কোনো অসম্মান না করেই
খুব বিনয়ের সঙ্গে বুঝিয়ে কিছু কথা বললেন, যে কথাগুলি
শুনে আমাদের দলের অমর্যাদা হওয়া তো দূরের কথা,
সকলেই খুব প্রভাবিত হয়েছিলাম সেই দিন।
উরগিন লান্ডুপ শুরু করলেন, “আমায় ক্ষমা করবেন আপনারা। এই চেয়ারে বসে আমি কোনো অধর্ম করতে
পারি না। আর ব্যক্তিজীবনেও আমি কোনো অধর্ম করি না।” সকলেই
ওনার মুখের দিকে চেয়ে ভাবলাম এই ঘটনার সঙ্গে ধর্মের কী সম্পর্ক আছে! আসলে ধর্ম বলতে আমরা যা বুঝি তা হল ঈশ্বরকে মানা না মানা, তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কিছু সংস্কার বা নিদান। উনি ধর্মের
যে সংজ্ঞা আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করে বোঝালেন তা হল সঠিক কর্ম করা। সময়ের কাজ সময়ের
মধ্যেই করা। সেই সময়কে লক্ষ্য স্থির করে সতর্ক থাকা। এমন কোনো কাজ করা উচিত নয়
যাতে অন্যের কোনো সময় নষ্ট হয়ে যায়। এর সঙ্গে সৎ চিন্তা সৎ আদর্শ অবশ্যই থাকা উচিত, যাতে অফিসের অন্যের কোনো কাজকর্ম ব্যাহত না হয়। আজ যদি
ওনাকে ক্ষমার চোখে দেখা হয় তাহলে আগামি দিনে কেউ দেরি করে অফিসে ঢুকলে তাকেও ক্ষমা
করতে হবে, না করলেই বিতর্কে জড়িয়ে যেতে হবে এবং
অফিসের কাজকর্মের প্রতি কর্মীরা অশ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠবে। সেই সঙ্গে আমিও অসৎ চিন্তার
সঙ্গী হয়ে উঠব। কোনো অন্যায় বা কোনো অনিয়মকে সমর্থন
করার অর্থ হল নিজেকেই অপরাধী তৈরি করা। অল্প পরিসরে এই ছোট্ট বিষয়টা এমনভাবে ব্যক্ত
করলেন যে সমস্ত পৃথিবীটাই ধর্মের নির্ঘণ্টের উপর চলছে। যেখানেই বিচ্যুতি সেখানেই
স্খলন। ধর্ম বলতে উনি যেটা বোঝালেন, সৎ চিন্তা
দ্বারা কর্মের নিষ্ঠা। এরপর এও বোঝালেন, “আপনারা
সুদূর কলকাতা থেকে এসেছেন। আজ যদি আমি এবং আমার অফিস আপনাদের সঠিক সাহায্য না করতে
পারি এবং আপনাদের পাশে না দাঁড়াই তাহলে আমার কাজের মধ্যে ত্রুটি থেকে যাবে। আর সেই
ত্রুটির জন্য অভিযানে ঠান্ডায় যদি কোনো প্রাণহানি ঘটে, আমি
কি সেই দায় এড়াতে পারি? আপনারা
লাদাখের ট্যুরিজম সম্বন্ধে কী ধারণা নিয়ে কলকাতায় ফিরে যাবেন?” খুবই বড়ো এক প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম সকলেই। কফিতে শেষ
চুমুকটা দিয়ে দাঁড়ালেন। বললেন, “চলুন, আপনাদের জ্যাকেটগুলি বুঝিয়ে দেই।” গটগট
করে আগে আগে বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে। আমরা সকলেই ওনার পিছনে। আমাদের অপেক্ষায়
স্টোরকিপার সব রেডি করে দাঁড়িয়ে আছেন। স্টোরে ঢুকেই উরগিন লান্ডুপ নিজে হাতে একটা
একটা করে দশটা জ্যাকেটই নিরীক্ষণ করলেন। এবার আমরা সব জ্যাকেটগুলি এক এক করে বুঝে নিলাম।
মালগুলি বুঝিয়ে দেওয়ার পর উনি আমাদের কাছে একটা অনুরোধ করলেন, “একদম নতুন মাল সিল ভেঙে আপনাদের দেওয়া হল, একটু সাবধানে ব্যবহার করবেন। নোংরা হলে অসুবিধা নেই, পরিষ্কার করে নেওয়া যাবে, কিন্তু
অন্যভাবে যেন ক্ষতি না হয়, কারণ এর
পরে এই জ্যাকেটগুলি ব্যবহারের জন্য অন্যদেরও দিতে হবে।”
সরকারি জিনিস হলেও একজন আধিকারিকের যে যথেষ্ট দায়িত্ব থেকে যায় এটাই তার প্রমাণ।
মাল বুঝিয়ে দেওয়ার পরেও গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে এসে আমাদের অভিযানের শুভেচ্ছা কামনা
করে বিদায় জানিয়ে গেলেন।
অভিযান সফল করে পুনরায় ট্যুরিজম
অফিসে উরগিন লান্ডুপের কাছে যেতে হয়েছিল জ্যাকেটগুলি ফেরত দেবার জন্য। সেদিনও
যথেষ্ট আপ্যায়ন করে কফি পান করিয়েছিলেন। তখনই জানতে পারি,
চাবির কেয়ারটেকারকে শো কজ করে চিঠি দিয়েছেন ঐ দিনের বিলম্বের কারণ জানতে চেয়ে। শেষ
সময়ে ভদ্রলোক যেচেই আমাদের আরও একটা সাহায্য করেছিলেন। ওনার অফিস থেকেই মেজর
জামলকিকে ফোন করতে চেয়েছিলাম দুটি কারণে। প্রথম
কারণ হল অভিযানের দল নিরাপদে লে শহরে ফিরে এসেছে এবং অভিযান সফল হয়েছে এই খবর দেওয়া, দ্বিতীয়ত ট্রানজিটে ফিরতে আমাদের গাড়ি লাগবে সে অনুরোধ করা। কিছুতেই
ফোনে যোগাযোগ হচ্ছিল না। উনি জানতে চাইলেন, “তাহলে
আপনারা ট্রানজিটে ফিরবেন কী করে?” জানালাম, “আগামীকাল পায়ে হেঁটে লিডার এবং ডেপুটি লিডার দুজনেই পৌঁছে
যাব ট্রানজিটে মেজর জামলকিকে অভিযানের সুখবরটা পৌঁছে দিতে। তখনই গাড়ির কথাটা সেরে
নেব।” সব কথা শুনে বললেন, “আগামীকাল সকাল সাড়ে দশটায় আমার গাড়িটা নিয়ে ট্রানজিট
ক্যাম্পে চলে যাবেন।” পরের দিন আমরা দুজনে ওনার গাড়িতেই
ট্রানজিট ক্যাম্পে যাই এবং লে শহরে ফিরে আসি।
পৃথিবীর যে কোনো দেশে ও
পরিবেশে মানুষ নিরন্তর ভালোকেই খুঁজতে থাকে। সেই কারণেই অন্তর্নিহিত সৃষ্টি এবং
সুখ দুই লুকিয়ে থাকে তারই মধ্যে। খারাপ কর্মকে কখনও কেউই মেনে নিতে চায় না, কারণ সুকাজের যে সম্মান ও ভালোবাসা সে শুধু মানুষকেই এগিয়ে
নিয়ে যায় না, সে এগিয়ে নিয়ে যায় একটা জাতি, একটা সমাজ ও সময়কেও। পৃথিবীতে যা শাশ্বত
তা অনাদিকাল ধরেই রয়ে যায়, সে কখনও
মলিনতার অক্টোপাসে বাঁধা পড়ে না। প্রকৃতির ধর্ম, জীবজগতের ধর্ম নিজ নিজ কর্মসূত্রেই
আবদ্ধ। ধর্ম কোনো আবেগতাড়িত কুসংস্কার ও সংস্কার নয়। যুগ যুগ ধরে মানুষ কিন্তু
সেখানেই পড়ে আছে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী একজন মানুষ কর্মের নিষ্ঠা দিয়েই তার ধর্ম ও
জাত চিনিয়েছে। সে কোনো বিশেষ পরিধান বা গুম্ফায় আবদ্ধ নয়। তার সেইদিনের ন্যায়পরায়ণ
কর্মনিষ্ঠা আজও দৃষ্টান্তস্থাপনের জন্য প্রায়ই হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় লে শহরের সেই
ছোট্ট ঘরটায় আর চোখের সামনে ভেসে ওঠে উরগিন লান্ডুপের সেই কাজ ও তার সঙ্গে ভেসে
আসে ওর সৌম্যদর্শন অম্লান অবয়ব। দীর্ঘ তিন দশক ধরে আমার হৃদয় কুর্নিশ করে চলেছে ঐ
মানুষটাকেই। আজও তাই চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ভেসে ওঠে উরগিন লান্ডুপ আর তার ঘরের
দেয়ালে মাথার উপর টাঙানো নেতাজীর ছবিটা, যিনি
কর্তব্যপরায়ণ একজন নিষ্ঠাবান মানুষের দৃষ্টান্তস্বরূপ, যুগের
প্রতীক হয়ে একটা সভ্যতা, সমাজ, সময় ও জাতিকে আজও বয়ে নিয়ে চলেছেন।
----------
শীর্ষচিত্র - লে শহর ২০২২, ফোটো - তাপস মৌলিক
No comments:
Post a Comment