গল্প:: রাসুর পরীক্ষা - সৌরভ চাকী


রাসুর পরীক্ষা
সৌরভ চাকী

।। ।।

রাসুর খুব টেনশন হচ্ছে টেনশনে রাত্তিরের ঘুমটাও উড়ে গেছে কদিন হল কাল প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা দু-বছর ধরে ডিগ্রিটা পাওয়ার চেষ্টা করে গেছে ও থিয়োরি, মৌখিকে একশোয় একশো কিন্তু প্র্যাকটিকালে কিছুতেই উতরোতে পারছে না কাল থার্ড টাইম, এইবারে পাশ না করতে পারলে ডিগ্রিটাও হাতছাড়া হয়ে যাবে সেন্টারের নিয়ম বড়ো কড়া তিনবারের মধ্যে পাশ করতে হবে, তবেই চূড়ান্ত ডিগ্রি মিলবে, নইলে আবার দশ বছরের বিরতি চুল পাকবে, অভিজ্ঞতা বাড়বে তবে আবার পরীক্ষায় বসতে পারবে
এ পর্যন্ত পড়ে ভাবছ চুলপাকা, অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সঙ্গে পরীক্ষায় বসার কী সম্পর্ক? ডিগ্রিটাই বা কী? কোথাকার ইনস্টিটিউটই বা দেয়?
তবে একটু খুলেই বলি রাসুকে চেনে না এহেন লোক এ তল্লাটে খুব কমই আছে এ তল্লাট মানে নারায়ণগঞ্জ, গোপালপুর, রতনচক-সহ আশেপাশের দশ-বিশটা গাঁ-গঞ্জকে বোঝাচ্ছি রাসু এ অঞ্চলের নামকরা চোর হাসতে হাসতে তোমার পাশ থেকে চুরি করে নিয়ে যাবে, তুমি টেরই পাবে না বহুরূপী সাজতেও তার মতো ওস্তাদ কেউ নেই তুমি আমি তাকে হয়তো বহুবার দেখেছি কিন্তু চিনতে পারিনি হয়তো যে ভিখিরিকে দু-টাকা ভিক্ষা দিলে সেই রাসু অথবা যাকে রাস্তায় চলতে চলতে গোপালখুড়োর বাড়িটা দেখিয়ে দিলে সেই হয়তো রাসু সারা তল্লাট তাই রাসুর চৌর্যবৃত্তির ভয়ে তটস্থ থাকে, এই বুঝি মালকড়ি হাতিয়ে নিল
সেদিন তো এমন হয়েছে সাধনবাবু নদীতে নাইতে গেছে, তো গামছা মালকোঁচা মেরে পরে জামাকাপড় ঘাটে খুলে রেখে নদীতে ডুব দিতে নেমেছেন উঠে দেখেন জামাকাপড়, চটি সব লোপাট
আবার সেদিন দেখো অবনীজেঠু ভোরবেলা নদীর ধারে প্রাতঃকৃত্য সারতে গেছেন সুদৃশ্য পিতলের গাড়ু নিয়ে, এটা ওনার দীর্ঘদিনের অভ্যাস ওনার ঝাঁ চকচকে বাড়িতে ইস্টার্ন, ওয়েস্টার্ন টয়লেট বেশ কয়েকটা আছে তা সত্ত্বেও ছেলে, বউমাদের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে ভোরবেলা নদীর ধারে প্রাতঃকৃত্য না করলে সারাদিন নাকি আইঢাই করে কিছু বললে বলেন, “তোমরা কি আমাকে মারতে চাও, ক্লিয়ার না হলে তো পেট ফুলে মরে যাব, তাই চাও?”
এসব শুনে আর কেউ কিছু বলতে ভরসা পায় না, যতই হোক বুড়োমানুষ, সেন্টিমেন্টের ব্যাপার তা সেদিনও অভ্যাসমতো প্রাতঃকৃত্য সেরে পিছন পানে হাত বাড়িয়েছেন গাড়ুটা নেবেন বলে, দেখেন হাওয়া বোঝো তাঁর অবস্থা
তা সেই রাসু চোর পঞ্চানন্দ চৌর্যবৃত্তি ট্রেনিং স্কুলের সিনিয়র ছাত্র এটাই এ অঞ্চলের বিখ্যাত একমাত্র স্কুল যেখানে চৌর্যবৃত্তিতে হাতে-কলমে ট্রেনিং দেওয়া হয় এবং শিক্ষান্তে সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হলে ডিগ্রি দেওয়া হয় রাসু তার বাবা বিখ্যাত চোর দাসুর হাত ধরে সেই ছেলেবেলায় এই স্কুলে ভরতি হয়েছিল তখন থেকেই এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা কাম মহাগুরু পঞ্চানন্দ ওরফে পাঁচু তার আদর্শ লোকে বলে পাঁচুর বয়সের গাছপাথর নেই কত যে বাঘা বাঘা চোর তার হাত থেকে বেরিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই খবরের কাগজে এই সব বিখ্যাত চোরদের কথা হামেশাই শোনা যায়
রাসুর হাত ধরে বাবা পাঁচুকে বলে গেছিল, “গুরুদেব রাসুকে আপনার কাছে দিয়ে গেলাম জানি আপনার মতো দিকপাল হবে না, তবে একটু মানুষ করে দেবেন, যাতে চুরিবিদ্যায় নাম করে অন্তত করে-কম্মে খেতে পারে
তা সেই মানুষ হওয়া বোধহয় রাসুর আর হল না চিরকাল বোধহয় অমানুষ হয়েই থাকতে হবে ঐ গাড়ুটা, বাটি-ঘটিটা, জামাকাপড় চুরি করে ছ্যা, ছ্যা জীবনের ওপর ঘেন্না ধরে গেল সেই কবে পাঁচুগুরুর কাছে প্রাইমারির পাঠ চুকেছে, তারপর আরও দু-তিন বছর ছোটোখাটো চুরি-চামারি করে প্র্যাকটিকাল পরীক্ষায় পাশ করে চুরিরত্ন সার্টিফিকেট পেয়েছে, এতে ছোটোখাটো চুরি-চামারি করার ছাড়পত্র আছে কিন্তু শেষ ডিগ্রি চুরিমহারত্ন উপাধিটা না পেলে কেরিয়ারে আর এগোনোই সম্ভব নয় এটা ভেবেই রাসু মুষড়ে পড়ে প্র্যাকটিকালে সে দু-বছর ফেল এবছর প্র্যাকটিকালে তাকে দেওয়া হয়েছে নারায়ণগঞ্জের আড়তদার মহাকিপটে আর সদাসতর্ক রজনি ঘোষের শোবার ঘর থেকে ক্যাশবাক্স খুলে টাকা চুরি করে আনার কাজ কাজটা কঠিন শুধু নয়, অসম্ভবই বটে তার ওপর পাঁচুগুরুর দুই নন্দি-ভৃঙ্গি চ্যালা হরেন আর নরেন হচ্ছে ওই কী বলে যেন অবজারভার তাদের অদৃশ্য চোখ সর্বদা পরীক্ষার্থীদের লক্ষ করে যায় চুরি করতে গিয়ে একটু অসদুপায় নিয়েছে কি সঙ্গে সঙ্গে খবর চলে যাবে, ব্যস তখনই স্কুল থেকে বিতাড়ন রাসু জানে যবে থেকে তাকে প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার বিষয় দেওয়া হয়েছে তবে থেকে হরেন আর নরেনের অদৃশ্য চোখ তার উপরে সিসি টিভির মতো নজর রাখছে
এই তো গতবার চুরিমহারত্নের প্র্যাকটিকাল পরীক্ষায় গোপালপুরের বিখ্যাত চোর কানুকে দেওয়া হয়েছিল ইন্দিরা ঠাকরুনের সাধের অষ্টধাতুর নাড়ুগোপাল চুরির কাজ নাড়ুগোপাল ইন্দিরা ঠাকরুনের প্রাণ ওটা সঙ্গে নিয়েই উনি ঘুমোন, খেতে বসেন আবার পাড়া ঘুরতেও বেরোন তা কানু দু-দুবার ওটা হাতানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে শেষে ইন্দিরা ঠাকরুনের ছিটে-বেড়ার ঘরে গিয়ে তার সঙ্গে ভাব জমায় তারপর বুড়িকে ভুজুং ভাজুং দিয়ে অনেক পটিয়ে বলে, “তা ঠাকুমা তোমার গোপাল কেন আর পুরোনো বেশে থাকবে বলো? দাও আমি তাকে সোনার করে দিচ্ছি সেই যেবার হিমালয়ে গেছিলাম সেখানের এক সাধুবাবা আমাকে এক পরশপাথর দিয়েছে, তা দিয়ে কোনো মূর্তিতে ছোঁয়ালেই তা সোনার হয়ে যাবে দাও তোমার নাড়ুগোপালকে সোনার করে দিচ্ছি
বুড়ি খানিকটা নিমরজি হয়ে নাড়ুগোপালকে কানুর হাতে তুলে দিল কানুও মন্ত্র-তন্ত্র পড়ে হাতসাফাই করে ঝোলা থেকে আনা সোনালি একটা নাড়ুগোপাল বের করে ইন্দিরা ঠাকরুনকে দিল ওটা আসলে নিখাদ একটা পিতলের মূর্তি ইন্দিরা ঠাকরুও চোখে কম দেখে, তাই সোনার মূর্তি ভেবে খুব আনন্দিত হয়ে কানুকে দুটো নাড়ুই খাইয়ে দিল কিন্তু হরেনদের মারফত খবর চলে গেল মহাগুরুর কাছে যে কানু এইরকমভাবে অসদুপায়ে লোক ঠকিয়ে পরীক্ষায় পাশ করতে চাইছে সঙ্গে সঙ্গে গুরুর নির্দেশে তিন বছরের জন্য স্কুল থেকে সাসপেন্ড সে বেচারা এখন সাইকেলে করে ঘুরে ঘুরে চুনোমাছ বিক্রি করে
রাসু কয়েকদিন রজনি ঘোষের আড়ত, বাড়ির চারপাশ ঘুরে মায় ছদ্মবেশে ওনার সঙ্গে আলাপ জমিয়ে রেইকি করে এসেছে গুরু বলে, “যে যত বেশি সূক্ষ্মভাবে এই রেইকির কাজটা করতে পারবে সে তত সফল হবে
গুরুর কথা রাসুর কাছে বেদবাক্য, তাই সে গুরুর সমস্ত উপদেশ চুরির সময় যথাসাধ্য মেনে চলার চেষ্টা করে রজনিবাবুর বাড়ির চৌহদ্দিতে গিয়ে রাসু দেখেছে দুটো তাগড়াই কুকুর ঘুরে বেড়ায় লোক দেখলেই ভৌ ভৌ করে তেড়ে আসে তবে তেজ থাকলে কী হবে, জাতে তো নেড়ি কুত্তার কোনো পেডিগ্রি নেই তাই একটু তু তু করলেই লেজ নাড়েএ কদিনে আড়ালে বাতাসা, বিস্কুট খাইয়ে রাসু ওদের হাত করে ফেলেছে যাতে পরীক্ষার দিন রাতে ওকে দেখে কুকুর দুটো না চেঁচায় তারপর খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিলেই নিশ্চিন্ত
যে ঘরে রজনিবাবু থাকেন সেটা দেখেও রাসু উৎফুল্ল কারণ ঘরটা একটু পিছনের দিকে আর তার পিছনে জলা-জঙ্গল, ফলে লোকজন সেদিকটায় নেই নিশ্চিন্তে সিঁধ কেটে ঢোকা যাবে কিন্তু লোকটা ক্যাশবাক্সটাকে নাকি পাশবালিশ বানিয়ে শোয়, সেটাই একটা সমস্যা আরেকটা সমস্যা রজনিবাবুর মাথার পাশে নাকি একটা গাদা বন্দুক রাখা থাকে রজনিবাবু সেটা তার দাদুর কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন তার দাদু ছিলেন এ অঞ্চলের জমিদার দেদার পাখি শিকার করেছেন ওই বন্দুক দিয়ে অবশ্য এসব গল্প রাসুর ছেলেবেলা থেকে শোনা বাবার কাছে কিন্তু রাসুর বন্দুকে বড়ো ভয় গুলি কোনোরকমে বেরোলেই দুম-ফটাস, ব্যস সব শেষ কিন্তু কী আর করা, পরীক্ষার দায়, কেরিয়ারের দায়, বড়ো দায় তবে রজনিবাবু যতই কিপটে হোন, ওনার একটা গুণ বাবা বিশ্বনাথের পুজোয় কোনো কার্পণ্য করেন না, ধুমধাম সহযোগে করেন বাবার বড়ো ভক্ত কিনা! অন্য সময় ভিখারিরা বাড়ির ত্রিসীমানায় ঢুকতে পারে না বাড়িতে লোক এলে আপ্যায়নে জোটে দুধ-চিনি ছাড়া এক কাপ লিকার চা আর লেড়ো বিস্কুটবলেন, “এটাই শরীরের পক্ষে উপকারী ওষুধ ঐ বিদঘুটে চা খাওয়ার ভয়ে প্রতিবেশীরা ওনার বাড়িতে আসা একপ্রকার ছেড়েই দিয়েছে এ কদিনে ওই সমস্ত খবরই টুকটুক করে রাসু জোগাড় করে নিয়েছে এবার পরীক্ষায় বসার পালা রাসু যেখানে যত মহান চোরেরা তাদের চৌর্যবৃত্তিতে বিখ্যাত হয়েছেন তাঁদের স্মরণ করে আশীর্বাদ চেয়ে কোনোরকমে রাতে ঘুমোতে গেল, তাও মনে টেনশন, কালকের পরীক্ষায় কী হয়!

।। ।।

রাত তখন দেড়টা কি দুটো হবে, রাসু চুপিসারে বাগদি পাড়ার পাশ দিয়ে রাধাকান্ত খুড়োর আমবাগানের ভিতর দিয়ে শর্টকাট করে এগিয়ে গেল রজনি ঘোষের বাড়ির দিকে অমাবস্যা হওয়াতে চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার বসন্তকাল যদিও পড়ে গেছে তবুও হালকা ঠান্ডার রেশটা রয়েই গেছে অন্ধকার গ্রামের পথে জনমানুষ তো দূরের কথা কুকুরেরা কোথায় যে সেঁধিয়েছে ভগবান জানে রাসুর তাতে সুবিধাই হয়েছে এই রাস্তার কুকুরগুলোই উটকো ঝামেলা বাঁধায় রাসুর পরনে খালি মালকোঁচা মারা খাটো ধুতি, সারা গা তেল জবজবে এই তেল বাড়িতেই বানিয়ে দেয় রাসুর বউ বংশপরম্পরায় এর তৈরির পদ্ধতি রাসুরা জেনে এসেছে তেলটার বিশেষত্ব হচ্ছে এর কোনো গন্ধ নেই ফলে কেউ টেরই পাবে না কিন্তু হাত দিয়ে ধরতে গেলেই পাঁকাল মাছের মতো পিছলে যাবে আত্মরক্ষার এক মোক্ষম দাওয়াই রাসু সিঁধকাঠিটা হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে চলে এল রজনি ঘোষের বাড়ির কাছে আজকে ত্রিশূলাকৃতি সিঁধকাঠিটা নিয়েছে কারণ রজনীবাবুর পাকাপোক্ত বাড়ির সিঁধ কাটতে ওটাই দরকার
রাসুকে দেখে বাড়ির কুকুর দুটো লেজ নাড়তে নাড়তে ছুটে এল সহজেই ঘুমপাড়ানি ওষুধ মেশানো লাড্ডু খাইয়ে ওদের ঘুম পাড়িয়ে দিল রাসু তারপর চুপি চুপি পিছন দিকে গিয়ে রজনিবাবুর ঘরের দেয়ালে সিঁ কাটতে শুরু কর যতটা সহজ হবে ভেবেছিল রাসু ততটা নয় বেশ শক্তপোক্ত গাঁথনি প্রায় ঘন্টাখানেক লেগে গেল সিঁধ কাটতে ঘর্মাক্ত কলেবরে রাসু প্রবেশ করল রজনিবাবুর ঘরে
ঘরের হালকা মৃদু আলোয় চোখ সয়ে গিয়ে রাসু দেখতে পেল খাটের উপর ঘুমন্ত রজনিবাবুকে তবে ঘুম যে ওনার গাঢ় নয় রাসু বুঝতে পারল ফোরৎ ফোঁ, ফোরৎ ফোঁ...” করে গম্ভীর নাক ডাকার তালে ভুঁড়িটা উঠছে আর নামছে মাঝে মাঝে নাক ডাকা থেমে যাচ্ছে আর তখন রজনিবাবু এপাশ-ওপাশ ফিরছেন ক্যাশবাক্সটা কোলবালিশের মতো পাশেই রাখা রাসু উৎফুল্ল হয়ে উঠল, ক্যাশবাক্স থেকে টাকা হাতানোর এখানে দরকার নেই, পুরো ক্যাশবাক্সটাই গর্ত দিয়ে গলিয়ে দেবে, তারপরে আর দেখে কে - বাক্স নিয়ে পগার পার পাঁচুগুরুর কাছে গিয়ে শুধু বাক্স ভেঙে টাকা তুলে দেওয়ার অপেক্ষা, ব্যস হাতে হাতে ডিগ্রি উফ্, ভেবেই রাসু উৎফুল্ল হয়ে গেল হে মা কালী, কাজ হয়ে গেলে তোমাকে জোড়া পাঁঠা, না না বেশি হয়ে গেল, জোড়া মুরগি, না না মুরগি কেউ দেয় না কি, তোমাকে আমি জোড়া চালকুমড়ো উপহার দেব হেই মা দেখো ডিগ্রিটা যেন পাই
উত্তেজনায় কোঁচড় থেকে ঘুমপাড়ানি মলমের শিশিটা বের করতে গিয়ে হাত ফসকে গেল পড়ে ঠক করে আওয়াজটা মৃদুই হয়েছিল, কিন্তু তাতেই ঘুম ভেঙে উঠে বসলেন রজনিবাবু রজনিবাবু রাসুকে ঘরে দেখেই সবিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেলেন, গাদা বন্দুকটা হাতে নিয়ে অস্ফুটে বলে উঠলেন, “কে? কে ওখানে?”
রাসুর তখন তীরে এসে তরি ডোবার অবস্থা বাঁচার শেষ চেষ্টা করতে হবে গুরুর নাম জপতে জপতে মাথায় বুদ্ধিটা ঝিলিক দিয়ে গেল বলে উঠল, “আমাকে চিনতে পারলি না? রোজ সকাল সন্ধ্যায় আমাকে ডাকিস আর আজ বলছিস কে?”
কে আপনি প্রভু?” রজনিবাবু গদগদ কণ্ঠে বলে উঠলেন
ওরে তোর ডাকে এই করোনার মাঝেও সেই কৈলাস থেকে ছুটে লাম শুধুমাত্র ত্রিশূলখানা সম্বল করে সবাই চিনলে তো কাড়াকাড়ি করবে তাই মানুষের বেশেই এলাম মর্ত্যের যা হাল করেছিস
হে দেবাদিদেব আপনি স্বয়ং এই গরিবের কুটিরে,” এই বলে আনন্দের আতিশয্যে রজনিবাবু রাসুর পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে গেলেন
রাসু তিন পা পিছিয়ে এল, “করিস কী! এখন ছোঁয়া-ছুঁয়ি সব বারণ না? যা করবি দূর থেকে,” এই বলে রাসু দূর থেকে আশীর্বাদ করল
বলুন প্রভু আপনার কী সেবা করতে পারি? আমার পরম সৌভাগ্য যে আজ আপনি আমার ঘরে পদধূলি দিয়েছেন আমার সর্বস্ব আপনার চরণে দান করতে প্রস্তুত আপনি আদেশ করুন প্রভু
দ্যাখ, আমার আর কী দরকার? চালচুলো তো কিছুই নেই, এখানে ওখানে পড়ে থাকি তবে এবার একবস্ত্রেই চলে এসেছি তোদের মাসঙ্গে ঝগড়া করে তোর ঐ কাঠের বাক্সটা দে আমার জিনিসপত্র যাতে রাখতে পারি মর্ত্যে ঘুরতে সুবিধা হবে, দিন থাকব তো
তা প্রভু অন্য ভালো বাক্স আছে, এনে দিচ্ছি ভিআইপি, সাফারির ভালো ট্রলি আছে নাকি পিঠের স্যাক দেব?”
না না, ওগুলো কি আমার ড্রেসের সঙ্গে যায়? আমাকে ওটাই দে তবে তোর যদি আপত্তি থাকে তো দিস না, অন্য কোথাও পেয়ে যাব,” এই বলে রাসু চলে যেতে উদ্যত হল
রজনিবাবু তৎক্ষণাৎ বাক্সটা তুলে দিলেন রাসুর হাতে, “না প্রভু আমার সবকিছু তো আপনারই, এই নিন
তোর মঙ্গল হোক, তবে ভাবিস না কৈলাসে ফেরার সময় তোকে এটা ফেরত দিয়ে যাব নে এবার তুই চোখ বন্ধ কর দেবতাদের প্রস্থান দেখতে নেই, তাতে অমঙ্গল হয়
হ্যাঁ প্রভু, এই আমি চোখ বন্ধ করলাম
রজনিবাবু চোখ বন্ধ করতেই ফুড়ুৎ করে বাক্স নিয়ে সিঁধ কাটা গর্ত দিয়ে রাসু গলে গেল মনটা ভীষণ উৎফুল্ল আনন্দে হালকা সুর ভাঁজতে ভাঁজতে ভুবনডাঙার মাঠটাও পেরিয়ে গেল
দূর থেকে হরেন আর নরেনের ছায়া দেখতে পেল রাসু চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হল, “দ্যাখ নন্দি-ভৃঙ্গি, আমার চুরিমহারত্ন ডিগ্রিটা এবারে কে আটকায় পুবের আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে লম্বা লম্বা পায়ে রাসু পৌঁছে গেল পাঁচুগুরুর ট্রেনিং স্কুলের ডেরায় পাঁচু আরও দুই চ্যালাকে নিয়ে রাসুর অপেক্ষাতেই বসে ছিল রাসু গিয়ে ঠক করে বাক্সটা পাঁচুর পায়ের কাছে নামিয়ে রাখল পঞ্চানন্দ ওরফে পাঁচু রাসুর কেরামতিতে বলে উঠল, “সাবাশ ব্যাটা, ডিগ্রিটা মনে হচ্ছে পেয়েই গেলি, আমার নাম রাখলি এতদিনেনে বাক্সটা খুলে এবার মালকড়ি বের কর দেখি
রাসু কোঁচড় থেকে ছোট্ট একটা তারের মতো যন্ত্র বের করল তারপর পাকা হাতে দু-তিনবারের চেষ্টায় চাপ দিতেই খুলে গেল ক্যাশবাক্স রাসু হাত বাড়াল ভেতরে কিন্তু এ কী! ভেতর ফাঁকা কেন? বাক্সটা পুরো খুলতেই সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল, তাই তো! পুরো ফাঁকারাসু মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল না বাক্সের মধ্যে একটা চিরকুট রয়েছে খুলতেই দেখা গেল লেখা আছে,

প্রিয় চোর মহাশয়,
খুবই খারাপ লাগছে আপনার হাতে কিছু তুলে দিতে না পেরে কত পরিশ্রম, কত বিনিদ্র রাত কাটিয়ে আজ আপনি আমার ক্ষুদ্র কুটিরে দক্ষতার সঙ্গে পদার্পণ করেছেন, কিন্তু আপনার এই কৃতিত্বকে পুরস্কৃত করার মতো একটা কানাকড়িও আমার কাছে নেই। চুপি চুপি বলছি সব আমার ওই গিন্নির হেফাজতে। কোথায় যে লুকিয়ে রাখে তার হদিস আমার কাছেও নেই। তাই আপনার প্রতীক্ষাতেই এতদিন ছিলাম। ঐ লুকানো সম্পত্তি উদ্ধার করে তার কিছু অংশ যদি এ গরিবকে কমিশন হিসেবে দান করেন তবে বাধিত হব আপনার সাফল্য কামনা করি।
পুনশ্চ: গিন্নির শাড়ির আঁচলে একগোছা চাবি থাকে যা উনি কখনোই কাছছাড়া করেন না, তার মধ্যেই হয়তো রয়েছে গুপ্তধনের হদিস।
- অভাগা রজনি ঘোষ
----------
ছবি - লাবণি চ্যাটার্জি

No comments:

Post a Comment