ভয়
শিশির বিশ্বাস
গাঢ় নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। সেই অতল অন্ধকারে তলিয়ে
যাচ্ছি ক্রমশ। আতঙ্কে হাত–পা ছুঁড়ে বৃথাই চিৎকার। গলা দিয়ে বিন্দুমাত্র আওয়াজ বের হচ্ছে না। তারই
মধ্যে হঠাৎ খট–খট শব্দ। খুব ধীর গতিতে হেঁটে আসছে কেউ।
আওয়াজটা বাড়ছে ক্রমশ। তারপরেই দেখতে পেলাম নিকষ অন্ধকার ফুঁড়ে ভয়ানক চেহারার এক
দানব এগিয়ে আসছে। এরপরেই তীক্ষ্ণ একরাশ
নখ অন্ধকারে ঝলসে উঠল। যন্ত্রণায় চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। ভয়ানক স্বপ্নটা ভেঙে গেল
ওই সময়। চোখ মেলে যা দেখলাম‚ তা আরও ভয়ানক! পাশে বসে বিশাল চেহারার মানুষ হাকিমসাহেব। হাতের ডানায় সুচ
ফুঁড়ে ইনজেকশন দিচ্ছেন। যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে শরীর। পাশেই উদ্বিগ্ন মুখে দাদু আর
ঠাকুরমা।
ভয়ানক স্বপ্নটা ছেলেবেলায় প্রায় তাড়া করে বেড়াত। ঘুম ভেঙে চমকে উঠে বসতাম। ব্যাপারটা যে নিছক
স্বপ্ন‚ সত্যি নয়‚ বুঝতেও সময় লাগত। কিন্তু তারপরেও আতঙ্ক কিছুমাত্র কমত না। হিম হয়ে আসত শরীর।
ভয়ে বলতেও পারতাম না কাউকে। এমনকি কাছের মানুষ ঠাকুরমাকেও নয়। এরপর সেই প্রথম
স্বপ্নের ঘোর কাটতেই সামনে দেখলাম হাকিমসাহেবকে। স্বপ্নে দেখা সেই ভয়ানক দৈত্য আর
হাকিমসাহেব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। আতঙ্ক বাড়ল আরও। শুধু রাতে নয়‚ এরপর দিনের বেলাতেও
স্বপ্নটা কখনও ভেসে উঠত চোখের সামনে। তাড়া করে আসত সেই দৈত্যটা। দিনের অনেকটা সময়
দাদু নানা কাজে বাইরে থাকতেন। তাই লেগে থাকতাম ঠাকুরমার সঙ্গে। আর যমের মতো ভয়
পেতাম হাকিমসাহেবকে।
মানুষটির পুরো নাম ছিল আবদুল হাকিম। সবাই হাকিমসাহেব
বলেই ডাকত। কাছাকাছি সবচেয়ে পসারওয়ালা ডাক্তার ছিলেন উনি। কালো বিশাল শরীর। দেখতে
মোটেই সুশ্রী ছিলেন না। মুখ ভরতি বসন্তের দাগের জন্য আরও ভয়ানক দেখাত। ঘোড়ায় চেপে
রোগী দেখতে বেরোতেন। বাড়ির বাইরের উঠোনে খটখট শব্দ হলেই বুঝতাম‚ উনি এসেছেন। লাফিয়ে ঘোড়া
থেকে নেমেই হাঁক পাড়তেন‚ ‘কই গো মাতুব্বরদা। নাতি কেমন?’
আমার মুখে ততক্ষণে ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে।
ঠাকুরমা আমার সেই মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা আঁচ করতেন হয়তো। বাড়িতে দাদু না
থাকলে মাথায় কাপড় টেনে দরজার আড়াল থেকে বলতেন‚ ‘দাদুভাই আজ ভালোই আছে হাকিমসাহেব। একবার দেখে
যাবেন নাকি?’
‘তাহলে থাক,’ ভারী গলায় উত্তর আসত‚ ‘একটা কথা কই দিদিজান। মণিরে এবার কলিকাতা
পাঠায়ে দেন। ছোটো মানুষ তো।’
ভিতরে কাঠ হয়ে বসে আমি এরপর হাকিমসাহেবের
লাফিয়ে ঘোড়ায় ওঠার শব্দ পেতাম। খট–খট আওয়াজ মিলিয়ে যেত
ক্রমশ। হাঁপ ছাড়তাম আমিও।
ছেলেবেলায় বাবা চাকরি নিয়ে কলকাতায় চলে এলেও
দাদু আর ঠাকুরমার ইচ্ছেয় কিছুদিন দেশের বাড়িতেই থেকে গিয়েছিলাম। ম্যালেরিয়া রোগটা
শরীরে জাঁকিয়ে বসেছিল ওই সময়। যখন তখন কাঁপিয়ে জ্বর আসত। তারপর বেহুঁশ। চিন্তিত
দাদু আর ঠাকুরমা চিকিৎসার কোনো ত্রুটি রাখেননি। জ্বর উঠলেই তল্লাটের সেরা ডাক্তার
হাকিমসাহেবকে খবর দেওয়া হত। দাদুর বন্ধু মানুষ ছিলেন উনি। জ্বর থাক বা না থাক‚ কাছে কোনো কলে এলে খোঁজ
নিয়ে যেতেন। দশাসই চেহারা ছিল মানুষটার। তেমনই বুকের পাটা। নানা গল্প চালু ছিল
ওনাকে নিয়ে। একবার ভাটির দিকে এক গ্রামে নাকি বাঘ এসেছিল। খবর পেয়ে নিজের দো-নলা
বন্দুক নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। দিন চারেক বাদে মেরেও এনেছিলেন সেই বাঘ। আশপাশের গোটা
কয়েক গ্রামের মানুষ ভেঙে পড়েছিল দেখতে। একবার কী এক ব্যাপার নিয়ে হঠাৎ দুই দলে
দাঙ্গা বাধার উপক্রম। ভয়ে কাঁপছে সবাই। হাকিম সাহেব ভিন গাঁয়ে গিয়েছিলেন রোগী
দেখতে। খবর পেয়ে ছুটে এসেছিলেন। একা হাতে ঠেকিয়েছিলেন সেই দাঙ্গা। এসব কারণে তাঁর
শত্রু ছিল অনেক। কিন্তু পরোয়া করতেন না। ডাক পেলে রাতবিরেতে ছুটে যেতেন ভিন গাঁয়ে।
কারোর পরামর্শে কর্ণপাত করেননি।
এসব শুনেছি অনেক পরে। কিন্তু সেইদিনের সেই
ব্যাপারের পর হাকিমসাহেব আমার কাছে হয়ে উঠেছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক। দেখলেই স্বপ্নের
সেই ভয়ানক দৈত্যটার কথা মনে পড়ে যেত। নিকষ অন্ধকারের ভিতর তলিয়ে যাচ্ছি ক্রমশ।
সামান্য প্রাণের স্পন্দন নেই। তারই মধ্যে তীক্ষ্ণ বর্শা হাতে খট–খট শব্দে এগিয়ে আসছে বিকট চেহারার সেই দৈত্যটা। কালো হাঁড়ির মতো বিশাল মাথা।
ছড়ানো মোটা নাক। পুরু ঠোঁট। মুখ ভরতি বসন্তের দাগ। ঠিক হাকিমসাহেব। তবে এরপর
বেশিদিন আর গ্রামে দাদু–ঠাকুরমার কাছে থাকা
হয়নি। খবর পেয়ে বাবা এসে কলকাতায় নিয়ে গিয়েছিলেন।
কলকাতায় আসার পর ম্যালেরিয়া ছাড়ল অল্প দিনের
মধ্যেই। তবে ভয়ানক সেই স্বপ্নটা সহজে ছাড়েনি আমাকে। যদিও বয়স বাড়ার সঙ্গে কিছু কমে
এসেছিল‚ এই মাত্র। বলা যায়‚ সেই কারণেই দেশের বাড়িতে এরপর আর যাইনি। দাদু আর ঠাকুরমা অবশ্য মাঝে-মধ্যে
আসতেন। সেই স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত যে একদিন সত্যি হয়ে দেখা দেবে‚ ভাবতেও পারিনি। সেটাই
ঘটে গেল এক রাতে।
স্কুল ছেড়ে সবে কলেজে ভরতি হয়েছি। হঠাৎ দেশ
থেকে দাদুর আর্জেন্ট টেলিগ্রাম। ঠাকুরমা ভীষণ অসুস্থ। কয়েকটা জরুরি ওষুধ দরকার।
তার মধ্যে কোরামিনও রয়েছে। বাবা অফিসে। উৎকণ্ঠিত মা অফিসে ফোন করতে বললেন। বাবার
অফিসে অডিট চলছে জানতাম। তাই বললাম‚ “দরকার নেই মা। আমি ওষুধগুলো নিয়ে এখুনি বেরিয়ে পড়ছি। দেরি করা ঠিক হবে না।”
মা চিন্তিত গলায় বললেন‚ “কিন্তু তুই কি পারবি? কতদিন যাসনি!”
মার চিন্তার কারণ ছিল। একে তো সেই যে দেশের
বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় এসেছি‚ আর যাইনি। তারপর স্টেশন থেকে বাড়ি মাইল পাঁচেক পথ। এখুনি বেরিয়ে পড়লেও মাঝে ট্রেন পালটে গ্রামের
স্টেশনে পৌঁছোতে সন্ধে হয়ে যাবে।
অন্ধকার গ্রামের পথে অতটা পথ চিনে যাওয়া সহজ নয়। কিন্তু মায়ের আশঙ্কা উড়িয়ে দিলাম
আমি। পরিস্থিতি বুঝে মাও আর আপত্তি করলেন না। বলা যায়‚ সেই দণ্ডেই ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে পড়লাম।
ওষুধগুলো কিনতে সময় লাগল। বিশেষ করে কোরামিন।
প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি হয় না। টেলিগ্রাম দেখিয়ে গোটা কয়েক দোকান ঘুরে ওষুধটা
যখন হাতে পেলাম‚ অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। তারপর পথে ট্রেন পালটাতে হল। গ্রামের স্টেশনে যখন
নামলাম‚ রাত প্রায় দশটা।
পৌঁছোতে রাত হয়ে যাবে ভেবেছিলাম।
কিন্তু এতটা ভাবিনি। ছোটো হল্ট গোছের স্টেশন। নীচু প্ল্যাটফর্মের মাঝে টিমটিম করে
এক কেরোসিন ল্যাম্প জ্বলছে। শুক্লপক্ষের চাঁদ ইতিমধ্যে পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়েছে।
অস্ত যাবে অল্প সময়ের মধ্যে। স্টেশনে জনাকয়েক মানুষ নামলেও অন্ধকারে কে কোথায়
ছিটকে গেছে! কিন্তু আমার সে উপায় নেই। অগত্যা স্টেশনমাস্টারকে ধরলাম। সব শুনে তিনি
পথের হদিস বুঝিয়ে দিলেও সাফ জানালেন‚ এই অন্ধকার রাতে অচেনা পথে না যাওয়াই ভালো। পরের ট্রেন ভোর পাঁচটায়। ওই ট্রেনে ওদিকের
মানুষ পাওয়া যেতেও পারে। তাদের সঙ্গ ধরলে সহজেই পৌঁছে যাওয়া যাবে। না হলেও ততক্ষণে
আলো ফুটে যাবে। সমস্যা হবে না।
কিন্তু আমার উপায় ছিল না। তাড়াতাড়িতে সঙ্গে
টর্চ আনতে ভুলে গেছি। তবু অসুস্থ ঠাকুরমার কথা ভেবে নেমেই পড়লাম পথে।
দু-দিকে বিস্তীর্ণ মাঠের মাঝে উঁচু কাঁচা
রাস্তা। পথের দু-দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দু-চারটে বাবলা আর খেজুর গাছ। ডালের ফাঁকে থোকা
থোকা জোনাকি। দূরে দু-একটা শেয়ালের কোরাস। সেই সঙ্গে দূরের কোনো গ্রাম থেকে ভেসে আসা কুকুরের
চিৎকার। নির্জন পথে এছাড়া কোথাও প্রাণের স্পন্দন নেই। আকাশে চাঁদ তখনও রয়েছে। সেই
আলোয় পথ চিনতে অসুবিধা হচ্ছিল না। বড়ো বড়ো পায়ে দ্রুত এগিয়ে চলেছি। বড়ো এক
কবরস্থান চোখে পড়ল। পথের ধারেই নতুন এক কবর। পাশেই ডাঁই করা ইট–বালি। দু-এক দিনের মধ্যেই বাঁধানো হবে। পয়সাওয়ালা কোনো ব্যক্তির কবর। মনে পড়ল‚ এ পথে মধুখালির কাছে
পথের ধারে এক কবরখানা আছে। সন্দেহ নেই সেটাই। মনটা খুশি হয়ে উঠল। অল্প সময়ের মধ্যে
অনেকটাই চলে এসেছি তাহলে! জামতলা হাট আর মাইল খানেক পথ মাত্র। ছোটোবেলায় দাদুর হাত
ধরে কতবার ওই হাটে এসেছি। চেনা পথ। তারপর গ্রাম মাত্রই মাইল দেড়েক।
কিন্তু ভাবনার সঙ্গে বাস্তবের মিল সবসময় হয়
কোথায়? মধুখালি পেরিয়ে আসার কিছুক্ষণের মধ্যে পশ্চিম
আকাশে চাঁদ অস্ত যেতেই টের পেলাম সেটা। দেখতে দেখতে অন্ধকার আরও ঘন হয়ে উঠল। সেই সঙ্গে হঠাৎই মেঘ করে এল আকাশে।
অন্ধকার আরও বাড়ল। কলকাতার মানুষ। অনেক রাতেও পথ চলা অভ্যাস। কিন্তু অন্ধকার এমন
ভয়ানক হতে পারে‚ ধারণাই ছিল না। ভাবতে গিয়ে‚ হঠাৎ সারা শরীর প্রায় কাঁটা দিয়ে উঠল! মনে হল‚ ছেলেবেলার সেই ভয়ানক স্বপ্নটা হঠাৎ যেন সত্যি
হয়ে উঠেছে! চারপাশে সেই গাঢ় নিশ্ছিদ্র অন্ধকার! সামান্য দূরেও কিছু নজরে পড়ছে না।
সেই অন্ধকারের ভিতর ক্রমশ অতলের দিকে এগিয়ে চলেছি। তলিয়ে যাচ্ছি ক্রমশ! পার্থক্য
দু-পাশে থোকা থোকা জোনাকির ঝাঁক। অন্ধকারের ভিতর একদল দানব যেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে
তাকিয়ে আছে আমার দিকে। প্রায় ভুলে যাওয়া ছেলেবেলার সেই আতঙ্ক দেখতে দেখতে প্রায়
গিলে ফেলল আমাকে। একবার তো মনে হল‚ নিছক সেই স্বপ্নটাই দেখছি আবার। ঘরে শুয়ে আছি বিছানায়। এখুনি ভেঙে যাবে ঘুমটা।
সেই ছোটোবেলায় যেমন হত। কিন্তু তা যে সম্ভব নয়‚ এই মুহূর্তে ঘুমিয়ে নয়‚ জেগেই আছি‚ একই সঙ্গে বুঝতে পারলাম সেটাও।
শুধু তাই নয়‚ হঠাৎ আবিষ্কার করলাম‚ দশ বছর আগের সেই স্বপ্নের মতোই চারপাশ হঠাৎ
কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। খানিক আগে দূর থেকে ভেসে আসা শেয়ালের কোরাস‚ কুকুরের ডাক আর শোনা
যাচ্ছে না। সামান্য প্রাণের স্পন্দন নেই কোথাও। বোধহয় বৃষ্টিও নামবে। একবার ভাবলাম‚ স্টেশনে ফিরে যাই বরং।
কিন্তু অনেকটাই চলে এসেছি। ফেরার পথ ধরলেও এই ঘন অন্ধকারে শেষ পর্যন্ত যে সেখানে পৌঁছোতে পারব‚ এমন নিশ্চয়তা নেই। তাই
বাতিল করতে হল সেই মতলব।
অনুমানে পা ফেলে প্রায় হাতড়ে হাতড়েই চলতে
লাগলাম এরপর। প্রতি মুহূর্তে ভয় হচ্ছিল‚ এখুনি হয়তো পথের ধারের খাদে হুমড়ি খেয়ে গড়িয়ে পড়ব। এভাবে কতক্ষণ চলেছি‚ মনে নেই। হঠাৎ খেয়াল হল‚ আমি একা নই‚ পিছনে কেউ আসছে।
চারপাশের নিস্তব্ধতা ছিঁড়ে খুব হালকা ধুপ–ধুপ আওয়াজ। কারও পায়ের শব্দ। এই ঘন অন্ধকারে কিছুই দেখা সম্ভব নয় জেনেও পিছনে
তাকালাম। যথারীতি নজরে পড়ল না কিছু। তারপর কান পেতে বোঝার চেষ্টা করতেই মাথার ভিতর
টনক নড়ল। পায়ের শব্দ ঠিকই। কিন্তু এ শব্দ কোনো মানুষের পায়ের নয়। বিলম্বিত লয়ে খট–খট আওয়াজ। যেন পেরেকের উপর হাতুড়ি পড়ছে। আওয়াজটা ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। কাছে
এগিয়ে আসছে। স্বপ্নে দেখা সেই দৈত্যটা নয়তো! আতঙ্কে শরীর হিম হয়ে গিয়েছিল আগেই। কোনোমতে
চেঁচিয়ে বলতে গেলাম‚ “কে? কে ওখানে?”
সামান্য ফ্যাসফ্যাস আওয়াজ ছাড়া গলা দিয়ে কোনো
স্বরই বের হল না। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। শব্দটা ইতিমধ্যে আরও কাছে এগিয়ে এসেছে।
অন্ধকারে দেখা না গেলেও উৎস কয়েক হাত মাত্র। হঠাৎ মনে হল‚ বাঁচতে হলে পালানো ছাড়া অন্য উপায় নেই।
মুহূর্তে দিগ্বিদিক হারিয়ে ছুটতে শুরু করলাম। আর তখনই হুঁশ হল অদূরে আমার সামনে
সর্বাঙ্গ সাদা কাপড় গায়ে একটা মানুষ। বলিষ্ঠ চেহারা হলেও মাথা অদ্ভুতভাবে ঝুঁকে
পড়েছে বুকের উপর। দেখে কিছুটা হলেও সাহস ফিরে এল। গলা ঝেড়ে নিয়ে চিৎকার করে বললাম‚ “শুনছেন।”
কিন্তু ওদিক থেকে কোনো সাড়া এল না। সেই একই
ভাবে মাথা ঝুঁকিয়ে চলতে লাগল। অগত্যা গতি বাড়ালাম আমিও। পিছনে সেই আওয়াজ তখনও
সমানে তাড়া করে আসছে।
এভাবে কতক্ষণ সেই মানুষটির পিছনে ছুটেছি‚ হুঁশ নেই। কিন্তু
আশ্চর্য‚ দূরত্ব সামান্য কমাতে পারলেও ধরতে পারিনি তাকে। তারপর একসময় হঠাৎই দাঁড়িয়ে
পড়লেন তিনি। ছুটে সামনে গিয়ে হাত বাড়িয়েছিলাম। ভয়ানক চমকে উঠে মুহূর্তে টেনে
নিলাম। মানুষটির মাথা সেই একইভাবে ঝুঁকে রয়েছে বুকের উপর। তবু অন্ধকারেও যেন চিনতে
পারলাম তাঁকে। মুহূর্তে দারুণ আতঙ্কে হিম হয়ে গেল শরীর। হাকিমসাহেব! কেমন মরা
মাছের মতো চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। গলায় গভীর এক ক্ষতচিহ্ন। মাথাটা কোনোরকমে
ঝুলে রয়েছে।
আতঙ্কে আমার সারা শরীর তখন প্রায় পাথর হয়ে
গেছে। বুকের উপর ঝুলে থাকা মাথাটা নড়ে উঠল সামান্য, “মণি‚ আর ভয় নাই। সামনেই বাড়ি। একাই যাতি পারবা।”
আতঙ্কে হিম হয়ে যাওয়া শরীরে সেই কথায় হঠাৎ যেন
প্রাণ সঞ্চার হল। ততক্ষণে সামনে সেই মানুষটা কথা শেষ করে এগিয়ে গেছে। অন্ধকারে আর
দেখতে পেলাম না। পিছনে তাড়া করে আসা সেই আওয়াজটাও আর শোনা যাচ্ছে না। তারপরেই
খেয়াল হল‚ দাঁড়িয়ে আছি কোনো এক লোকালয়ের ভিতর। অদূরে ঘর–বাড়ির আভাস। পথের পাশেই এক বাড়ির
ভিতর আলো জ্বলছে। জানলা দিয়ে সেই আলোর রেখা। আরে, ঘরের পিছনে ওই তো আমাদের সেই উঁচু জোড়া খেজুর গাছ! পাশেই পথের উপর দাঁড়িয়ে
আছি! চিৎকার করে ডাকলাম, “দাদু–উ–উ–উ‚ আমি শিবু‚ শিবনাথ। দরজা খোলো।”
মুহূর্তে সশব্দে গোটাকয়েক দরজা খুলে গেল। ওদিকে
কাছারি ঘরের দিক থেকে কাজের মানুষ হারানের গলার আওয়াজ, “কে? মণিভাই! এত রাতে!”
ততক্ষণে ওদিকের বড়ো ঘর থেকে দাদু হাতে আলো নিয়ে
বের হয়ে এসেছেন। কাছে এসে অবাক হয়ে বললেন, “দাদুভাই!”
“হ্যাঁ দাদু। দুপুরে টেলিগ্রাম পেয়েই বেরিয়ে
পড়েছি। তবু ওষুধ কিনতে দেরি হয়ে গেল। কেমন আছে ঠাকুরমা? কোরামিন এনেছি।”
আমার ওই কথায় দাদুর চোখ দিয়ে হঠাৎ জল গড়িয়ে
পড়ল। উত্তর না দিয়ে ঘরে নিয়ে এলেন। আমার সাড়া পেয়ে আশপাশের আরও কয়েকজন হাজির
হয়েছেন। ঘরে এসে দেখি অসুস্থ ঠাকুরমাও জেগে উঠেছেন। বুক থেকে একটা স্বস্তির নিশ্বাস
পড়ল। তাড়াতাড়ি বললাম, “কোরামিন আর লাগেনি?”
“লেগেছিল দাদুভাই,” ধরা গলায় দাদু বললেন।
“কোথায় পেলে?”
উত্তর দিতে গিয়েও দাদু থেমে গেলেন হঠাৎ। একজন
ঠাকুরমার কাছ থেকে আমাকে পাশের ঘরে টেনে এনে বললেন, “ওসব এখন থাক মণিভাই। সে অনেক কথা।”
কিন্তু থাক বললে আমার যে চলবে না। তাড়াতাড়ি
বললাম, “কী? হাকিম সাহেব?”
“হ্যাঁ‚ হাকিম সাহেব। কোরামিন পাওয়া যায়নি শুনে উনি নিজেই
দূরের এক রোগীর বাড়ি থেকে খুঁজে এনেছিলেন ওষুধটা। গতকাল অনেক রাতে।”
“কেমন আছেন উনি?” উৎকণ্ঠিত গলায় কোনোমতে
বলতে পারলাম।
“উনি খুন হয়েছেন গত রাতে।
এখান থেকে ফেরার পথে। শত্রু তো কম ছিল না। এই রাতে একা ফিরতে তাই মানা করেছিল
সবাই। লেঠেলের জন্য সর্দারপাড়ায় লোকও পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু কানে তোলেননি।
জানিয়েছিলেন‚ ঘোড়া যখন রয়েছে‚ চিন্তার কিছু নেই। বরং একা গেলে অনেক তাড়াতাড়ি
বাড়ি পৌঁছোতে পারবেন।”
----------
ছবি - স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়
ছোটোদের জন্য চমৎকার গল্প।
ReplyDelete