গল্প:: গুমখুন ২ - বুমা ব্যানার্জী দাস


গুমখুন ২
বুমা ব্যানার্জী দাস

নিঝুম অন্ধকার কোথাও জনপ্রাণী নেই প্রাইভেট গোয়েন্দা তিরুপতি শাসমল বন্দুক বাগিয়ে ধরে পা টিপে টিপে এগিয়ে চলেছেন অন্ধকারে কে বা কারা চুপিসারে তাঁর গতিবিধি লক্ষ করে চলেছে এমন সময়ে, ঠিক যখন অন্তুর চোখ দুটো গুল্লি গুল্লি হয়ে উঠেছে, ডান কানের ভিতর দিয়ে একটা ফড়িং ঢুকে বাঁ কান দিয়ে বেরিয়ে আসছে, গলা শুকিয়ে স্যান্ডপেপার, ঠিক তখন পিঠের উপর ধড়াম করে একটা মোক্ষম চাপড় পড়ল বইটা হাত থেকে ছিটকে নীচে পড়ে গেল, খাটের নীচে শুয়ে থাকা মামদো চমকে উঠে মাথায় গুঁতো খেয়ে ঘৌ আর ওঁকস মিশিয়ে ঘোঁকস জাতীয় শব্দ করে বেরিয়ে এল
“উফ্ মেজকা, এরকম চমকে দেওয়ার মানে হয়?” ব্যাজার মুখে বলে অন্তু, ওর বুকের ভিতর এখনও ধড়াস ধড়াস করছে, অন্ধকার থেকে বদমাশ লোকের দল যেন তিরুপতি শাসমল নয়, অন্তুর ঘাড়েই ঝাঁপিয়ে পড়েছে
“ছ্যা! এই তোর সাহস!” মুখ ব্যাঁকায় মেজকা, “রাতদিন ওই বস্তাপচা রাবিশ গোয়েন্দা গল্পগুলো পড়লে এই হয় কী যে পাস বইগুলোতে সেই তো দুই হস্তে দুটি বন্দুক ও অপর হস্তে টর্চ লইয়া গোয়েন্দাপ্রবর ছাদ হইতে লাফাইয়া পড়িলেন টাইপের ব্যাপার ছোঃ
অন্তুর কান গরম হয়ে যায় সে গোয়েন্দা গল্প পড়তে খুবই ভালোবাসে, পড়ার বইয়ের ফাঁকে লুকিয়ে সেসব বই হামেশাই পড়ে মেঝেতে ছিটকে পড়া বইটা তুলবে কিনা ভেবেও হাত গুটিয়ে নিল হাফ ইয়ার্লিতে অঙ্কে খুব একটা সুবিধে হয়নি, মেজকা এমনিতে বেজায় ভুলোমন হলেও এসব ঠিক মনে রাখে এই ভর সন্ধেবেলা পড়তে না বসে সে যে গল্পের বই পড়ছে সেটা নির্ঘাত বাবাকে গিয়ে লাগিয়ে দেবে তাড়াতাড়ি কথা ঘোরানোর জন্য অন্তু বলে, “কী বলবে বলো, আমার হোমওয়র্ক আছে
অন্তুর মেজকা তপোধন মিত্র বেজায় ভুলোমনের মানুষ ফলে সারাদিন সে যে কত কিছু হারিয়ে ফেলে তার কোনো হিসেব নেই বাড়িসুদ্ধ সবাই তার এই জিনিস হারিয়ে ফেলার ঠ্যালায় অস্থির কী করে যে সে কলেজে পড়ায় সেটাই আশ্চর্যের ব্যাপার তপোধন আবার গোপনে লেখালেখি করে, যদিও এখনও ছাপা-টাপা হয়নি একটাও
তবে নিজের উপর অন্তুর মেজকার অগাধ বিশ্বাস
“একদিন ঠিকঠাক একটা গোয়েন্দা গল্প লিখে সাড়া ফেলে দেব দেখিস, তখন ওসব ফালতু বই আর পড়বি না বুঝলি,” অন্তুকে গল্পের বই পড়তে দেখলেই একবার করে শুনিয়ে রাখে তপোধন তার লেখার ব্যাপারটা অবশ্য জানে কেবল অন্তু, অন্তুর মা অর্থাৎ তপোধনের বড়ো বৌদি আর অন্তুর পিসি শর্মিষ্ঠা পিসি অবশ্য বিয়ের পর আসানসোলের বাসিন্দা এই বছর দেড়েক

কিন্তু এখন মেজকার এই ঘরে হানা দেওয়ার মানে কী? বইটা লাইব্রেরির, শিগগির ফেরত দিতে হবে বেশ খানিকটা বাকি আছে পড়া তার উপর হাফ ইয়ার্লির রেজাল্ট দেখে বাবার কড়া হুকুম ‘ক্লাস এইট হয়ে গেছে অন্তু, এখন পরিশ্রমের সময় রোজ অন্তত তিরিশটা করে অঙ্ক করা চাই’ আড়চোখে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকায় অন্তু আর মিনিট পনেরোর মধ্যে অঙ্কের টিচার সুব্রতদা এসে যাবে তার আবার একদিনও কামাই না করার রেকর্ড আছে অন্তু করুণ চোখে মেজকার দিকে তাকায়
ঠিক সেই সময়ে তপোধনের হাতে ধরা মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে ব্যস্তভাবে ফোনটা কানে ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে, অন্তু লম্বা শ্বাস ফেলে একটা জোর বাঁচা গেছে, ফোনে কথা শেষ হতে হতে মেজকা ঠিক ভুলে যাবে কেন এসেছিল নীচু হয়ে বইটা যত্ন করে তুলতে যায় অন্তু মামদো এর মধ্যে বইটা কয়েকবার শুঁকে-টুকে ল্যাজ গুটিয়ে ওটার পাশেই শুয়ে পড়েছে লাইব্রেরির বই, ভাগ্যিস ছিঁড়েটিড়ে যায়নি গোয়েন্দা তিরুপতি শাসমল তার সবচেয়ে প্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র, গোটা সিরিজটা অন্তু প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছে এই বইটা অন্ধকারের বেড়াজাল সিরিজের সবচেয়ে নতুন বই পাড়ার লাইব্রেরিতে অনেক আগে থাকতে বলে রেখেছিল অন্তু, তাও বেরোনোর চার মাস পর হাতে পেল নিয়ম অনুযায়ী একদম সবে বেরোনো নতুন বই মাত্র সাত দিনের জন্য নেওয়া যায় সুব্রতদার হোমটাস্কের ঠেলায় জুত করে বইটা পড়েই উঠতে পারছে না অন্তু

আরেঃ! এটা কী? বইটা তুলতে গিয়ে অন্তু দেখে ছিটকে পড়ার সময়ে ঝাঁকুনি খেয়ে বইয়ের ভিতর থেকে এক টুকরো কাগজ বেরিয়ে এসে মাটিতে পড়েছে ছোটো সাধারণ এক টুকরো কাগজ কিছু একটা লেখা আছে মনে হচ্ছে, লেখাটা কাগজের যে পিঠটা মাটির দিকে পড়েছে, সেই দিকে উপরের দিকের পিঠে পেনের আঁচড়ের ছাপটা পড়েছে শুধু কাগজের টুকরোটা তুলে নেয় অন্তু সাদা কোনো খাতার পাতা থেকে ছেঁড়া একটা অংশ বলেই মনে হচ্ছে উলটো পিঠে লেখা
গুমখুন ২
হারুদারোগা
গলাকাটির মাঠ, ল্যাম্পপোস্টের পাশের গলি, ২৫শে জু
বাকিটা ছেঁড়া অন্তু ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকে কাগজের টুকরোটার দিকে এসব কী! গলাকাটির মাঠ অন্তু চেনে, তাদের পাড়া ছাড়িয়ে আর একটু গেলেই বাঁ দিকে একটা মস্ত দিঘি পড়ে তার গায়েই একটা মাঠ আছে কয়েকবার বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে গেছে সেখানে অন্তু সেই কবে অন্তুর বাবা যখন ছোটো ছিলেন কাকে যেন কারা গলা কেটে খুন করেছিল সেই মাঠে তখন বিশেষ বাড়ি-টাড়ি ছিল না ওদিকে তবে সেই থেকে ওই মাঠের নাম হয়ে যায় গলাকাটির মাঠ সেই মাঠে কী হবে? ‘গুমখুন ২’-টাই বা কী? দু-দুটো গুমখুন হবে, না দ্বিতীয় গুমখুনটা হবে গলাকাটির মাঠে? প্রথমটাই বা কোথায় হল? হারুদারোগা আবার কে, সেই কি খুন হবে? ভাবতে ভাবতে অন্তুর চুল খাড়া হয়ে উঠল পিঠ বেয়ে পিঁপড়ে নামতে লাগল হঠাৎ সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেয়ে সম্বিত ফেরে অন্তুর কাঁটায় কাঁটায় সাতটা, মানে সুব্রতদা উঠে আসছে সিঁড়ি দিয়ে ঝপাত করে কাগজের টুকরোটা বইয়ের মধ্যে ঢুকিয়ে, বইটা টেবিলের টানায় চালান করে অঙ্ক বইটা টেনে নিল অন্তু
বলাই বাহুল্য, আজ সব ক’টা অঙ্ক ভুল হল অন্তুর একটা অঙ্কে তো স্টেটমেন্টে হারুদারোগা লিখে ফেলল মাথায় ঘুরতে থাকল একটাই চিন্তা এই কাগজের টুকরো এল কী করে বইয়ের ভিতর এ তো একেবারে আনকোরা নতুন বই ছাপাখানার কেউ কি তবে কাউকে খুন করার মতলব আঁটছে, নাকি লাইব্রেরির কেউ নাকি এই চার মাসের মধ্যে যারা বই নিয়েছে তাদের কেউ ধ্যাত, খুনিরা লাইব্রেরি যায় বলে মনে হয় না কিন্তু হতেও তো পারে, হয়তো কোন বিষের কী প্রভাব এসব পড়তে লাইব্রেরিতে এসেছিল সর্বনাশ, খুনি কি তবে পাড়ার চেনা কেউ? অন্তু ভাবার চেষ্টা করে তিরুপতি শাসমল হলে এরকম অবস্থায় কী করতেন হঠাৎ খেয়াল হয় সুব্রতদা কী একটা বলছেন বেশ খানিকক্ষণ ধরে পরীক্ষা শব্দটা কানে এল যেন এই রে, আবার টেস্ট নেবেন বোধহয়
তিরিশটার জায়গায় পঞ্চাশটা অঙ্ক হোমওয়র্ক দিয়ে সুব্রতদা চলে যাওয়ার পর অন্তু আবার কাগজের টুকরোটা খুলে ধরে নাহ্, প্রখ্যাত গোয়েন্দা তিরুপতি শাসমলের একনিষ্ঠ ভক্তের কী করা উচিত এমন অবস্থায় তাতে অন্তুর কোনোই সন্দেহ নেই তাকে একবার যেতেই হবে গলাকাটির মাঠে ২৫শে জু মানে ২৫শে জুন, না জুলাই? যদি জুন হয়, আজ হল ২৩শে, তার মানে হয়তো পরশু খুনটা হতে চলেছে ওই হারু দারোগাই খুন হবে কিনা কে জানে মুহূর্তে প্ল্যান অফ অ্যাকশন ঠিক করে নেয় অন্তু পরশু বৃহস্পতিবার স্কুলের পর সিনহা স্যারের কাছে ইংরাজি পড়তে যাওয়া আছে স্যারকে বলে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে সন্ধের পর সে নিজেই একবার যাবে গলাকাটির মাঠে একা একা যাওয়া ঠিক হবে না হয়তো, কিন্তু বড়োদের কাউকে বললে দুটো মুশকিল হওয়ার সম্ভাবনা এক, তাকে এই ব্যাপারে কোনোভাবেই জড়াতে তাঁরা দেবেন না; দুই, বইটা নির্ঘাত বাজেয়াপ্ত করা হবে
জিগরি দোস্ত সোমনাথটাও এখন এখানে নেই, মালদা না কোথায় বিয়েবাড়ির নেমন্তন্ন খেতে গেছে মন স্থির করে নেয় অন্তু যা করার তাকেই করতে হবে একা

সন্ধে পার হয়ে গেছে খানিকক্ষণ এদিকটা এমনিতেই একটু ফাঁকা ফাঁকা, আজ যেন রাস্তায় একটাও লোক নেই মামদোটাকে সঙ্গে নিয়ে এলে বোধহয় ভালো হত সবচেয়ে বড়ো মুশকিল হল, তিরুপতি শাসমলের কাছে বন্দুক থাকে, আর তার পকেটে আছে একটা পেনসিল কাটার ছুরি, সেটাও খুব যে ধারালো তা বলা যায় না অন্তু একবার ভাবল ফিরেই যাই পরমুহূর্তেই মনে হল, ছি ছি এত ভীতু সে! এই মনোবল নিয়ে সে গোয়েন্দা হবে! অন্তু তিরুপতি শাসমলের মতো করে ভাবার চেষ্টা করে কাগজের টুকরোটা প্যান্টের পকেট থেকে বের করে আরও একবার দেখে নেয় লেখা আছে ল্যাম্পপোস্টের পাশের গলি, কিন্তু কোন ল্যাম্পপোস্ট? মাঠ পার হয়ে ওপাশেরটা, না এদিকেরটা খানিক ভাবে অন্তু, মাথাটা একবার চুলকে নেয় নিশ্চয়ই মাঠ পার হয়ে ওপাশেরটাই এদিকেরটার পাশ দিয়ে তো কোনো গলি-টলি নেই মাঠ পার হয়ে ল্যাম্প পোস্টের নীচে গিয়ে দাঁড়ায় সে ল্যাম্পের হলুদ আলো এসে পড়েছে মাঠে গলির ভিতর একদিকে বন্ধ হয়ে যাওয়া সাবানের কারখানার লম্বা পাঁচিল সেদিকটা একেবারে অন্ধকার এদিকে কোনোদিন আসেনি অন্তু গলিতে ঢুকে তারপরই বা কী? গলির মুখে একটা ভ্যাট, বিশ্রী গন্ধ ছাড়ছে ভ্যাট পেরিয়ে সাবানের কারখানার উলটোদিক ধরে দেখতে দেখতে চলল অন্তু একটা টেলরিং শপ, পাশে একটা মুদির দোকান দুটোই আশ্চর্যরকম ফাঁকা দোকানি পর্যন্ত বসে নেই সেগুলো পেরিয়ে প্রায় পা টিপে টিপে এগিয়ে যায় অন্তু গলিটা সত্যিই খুব সন্দেহজনক এখানে কোন বাড়িতে হারুদারোগা থাকে সে খুঁজবে কী করে অন্তু পকেটের ভিতর পেনসিল কাটার ছুরিটা চেপে ধরে একটা ঘুপচি মতন বাড়ি সামনে, ভালো দেখা যাচ্ছে না তাও তার মনে হল বাড়িটা অনেক পুরোনো, ছাদের উপর টিন বা অ্যাসবেসটস বাড়ির সামনে নোংরা উঠোনে দড়ি টাঙিয়ে নানা রঙের কাপড়ের লম্বা ফালি মেলে দেওয়া, যেন কেউ আনাড়ি হাতে যা হোক করে প্যান্ডেল টাঙিয়েছে অন্তু সাবধানে পা ফেলে উঠোনটায় টকটকে লাল একটা কাপড়ের ফালি সরিয়ে উঁকি মারতে যাচ্ছে, ঠিক তখন -
“তবে রে, এই ভরসন্ধেবেলা আমার ইঁচড় চুরি করতে এয়েচ? একটা ইঁচড় গাছে রাখার জো নেই বাপু...,” খ্যানখ্যানে তীব্র একটা গলা কানের কাছে বেজে ওঠে অন্তুর অন্তু বেজায় চমকে উঠে মোক্ষম একটা বিষম খায় ততক্ষণে ভীষণ রাগি চেহারার এক বুড়ি কাপড়ের আড়াল থেকে হাত বাড়িয়ে খপাত করে কান টেনে ধরে অন্তুর অন্তু কাশি না কান কোনটা সামলাবে ভেবে পায় না আবার খনখনে গলায় বলে ওঠে বুড়ি, “দেখে তো ভদ্দরলোকের ছেলে বলে মনে হচ্ছে, চুরি করতে লজ্জা করে না এই নিয়ে সাতখানা ইঁচড়...”
অন্তু কাশি সামলে আর্তনাদ করে ওঠে, “ইঁচড় নয়, হারুদরোগা গুমখুন হবে
কয়েক সেকেন্ড পিন পতন নিস্তব্ধতা তারপর বুড়ি পাড়া ফাটিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, “কীইইই! আমার হারু সাত চড়ে রা কাড়ে না, মাছির গায়ে হাত তোলে না, সে কিনা দারোগা খুন করবে! তুইই ব্যাটা ডাকাতের স্যাঙাত কে কোথায় আছ বাঁচাওও, বাড়িতে ডাকাত পড়েছে গো, কিছু আর রাখলে না
অন্তুর সব গুলিয়ে ঘন্ট পাকিয়ে যায় এক পা এক পা করে পিছিয়ে আসতে থাকে সে ভয়ে ঘাড়ের লোম খাড়া হয়ে গেছে ঘুরে দাঁড়িয়ে এক লাফে গলিতে পড়ে টেনে দৌড় লাগায় অন্তু বুড়ির ছাদ ফাটানো আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে অবশ্য বুড়ির চেঁচানি শুনে কেউ তার পিছু ধাওয়া করছে বলে মনে হয় না এই পাড়াটা সত্যি বড় নির্জন

সাবানের কারখানার পাঁচিলটা এবার শেষ পাঁচিলের গায়ে ঠেস দিয়ে হাঁফাতে থাকে অন্তু এখান থেকে গলিটা ডানদিকে ঘুরে গেছে কী বিপদে পড়ছিল আর একটু হলে এমন হিংস্র বুড়ি জীবনে দেখেনি অন্তু ও অবশ্য জানে বুড়ি বলাটা অসভ্যতা, বয়স্ক মানুষ বলতে হয় কিন্তু এখন কোনদিকে যাওয়া উচিত যা হল, এরপরআরে, কিরকির করে কেমন একটা আওয়াজ আসছে না? পাঁচিলের ওপার থেকে কি? কেউ যেন ধাতব কিছু ঘষে চলেছে সমানে পাঁচিলের ওপার থেকেই আসছে শব্দটা কিন্তু এই সাবান কারখানা তো বহুদিন বন্ধ, বাবাকে অনেকবার এটার কথা বলতে শুনেছে অন্তু পাঁচিলটা বাঁদিকে ঘুরে গেছে একটা পোড়ো জমির পাশ দিয়ে অন্তু পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় সেইদিকে কিরকির আওয়াজটা আরও বেড়ে গেল যেন খানিকটা এগিয়ে পাঁচিলের গায়ে একটা গেট, তালা ঝুলছে সেখানে এটাই বোধহয় কারখানায় ঢোকার গেট ছিল কোনোসময়ে আওয়াজটা থেমে গেল হঠাৎ অন্তু সন্তর্পণে দাঁড়িয়ে থাকে গেটটার সামনে ভুল শুনল নাকি? ধুর, ফিরে যাওয়াই ভালো এবার সত্যি বলতে কি, একটু গা ছমছম করছে অন্তুর হয়তো কোনো কুকুর বেড়াল ভিতরে ঢুকে ওরকম আওয়াজ করছে
ফিরেই যাচ্ছিল অন্তু হঠাৎ আবার শুরু হল আওয়াজটা সঙ্গে আরও একটা আওয়াজ, কেউ কি ফোঁপাচ্ছে? না, এ তো কুকুর বেড়াল নয়, স্পষ্ট কেউ কাঁদছে, চাপা গলায় গেটের গ্রিলের ফাঁকে পা রাখে অন্তু একটু উঁচু হলেও এই গেট বেয়ে ওঠা তার কাছে কোনো ব্যাপার নয় কিন্তু ওপারে যদি বিশ্রী কোনো বিপদ থাকে সঙ্গে সঙ্গে মেজকার মুখটা মনে পড়ে যায় মনে হয় মেজকা যেন হেসে হেসে বলছে‘ছি ছি! এই তোর সাহস অন্তু এই সাহস নিয়ে তুই গোয়েন্দা গল্প পড়িস ওই তিরুপতি শাসমলের মতো গোয়েন্দার চেলা হলে এই হয়
ইশ! গুরুর অপমান নাহ্, আর দ্বিতীয় কিছু ভাবার জায়গা নেই, গ্রিলের উপর স্নিকার পরা পা রাখে অন্তু তারপর কাঠবেড়ালির দক্ষতায় ফাঁকে ফাঁকে পা রেখে উঠতে থাকে ওপারে গিয়ে সামান্য লাফিয়ে মাটিতে যখন নামে অন্তু তখন উত্তেজনায় বুক দুরদুর করছে তার বড্ড অন্ধকার ভিতরে, সঙ্গে একটা টর্চ রাখা উচিত ছিল কিরকির শব্দটা আবার থেমে গেছে অন্তু কোনদিকে যাবে বুঝতে পারে না, বেশ কিছু বছর ধরে এই কারখানা পরিত্যক্ত, ঝোপ জঙ্গল গজিয়ে গেছে চারিদিকে পাঁচিলের ওপার থেকে গলির অন্যদিকের বাড়ির ক্ষীণ আলো এলেও সে আর কতটুকু গলিতে ল্যাম্প পোস্ট নেই একটাও, থাকলে এত অন্ধকার হত না ভিতরটা হঠাৎ আবার সেই ফোঁপানো শব্দটা শুরু হল মনে হচ্ছে আরও ভিতর দিক থেকে আসছে সেটা পায়ে পায়ে এগোতে থাকে অন্তু, তার গায়ের রোম খাড়া হয়ে উঠেছে ভয়ে আর দুশ্চিন্তায় দম প্রায় বন্ধ করে আরও খানিকটা এগিয়ে যায় সে অন্ধকারটা হঠাৎ আরও গাঢ় হয়ে যাওয়াতে অন্তু বুঝতে পারে এখানে একটা শেড বা ওরকম কিছু রয়েছে কান্নাটা এখন একদম স্পষ্ট কেউ এখানে কাঁদছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই
শেডটার কাছে পৌঁছে অন্তু হাতড়ে হাতড়ে বোঝার চেষ্টা করে একটা দরজা মনে হচ্ছে, সামনেটা বোধহয় জঞ্জালে ভরা অন্তু মোক্ষম একটা হোঁচট খায় মরিয়া হয়ে কিছু একটা ধরে সামলানোর জন্য হাত বাড়িয়েও সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে হুড়মুড় করে একগাদা কীসব জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে, কনুইয়ের কাছটা হুহু করে জ্বলতে থাকে অন্তুর ব্যথায় মুখ কুঁচকে যায় উঠতে গিয়ে আবার পা হড়কে এবার দরজাটার উপরেই আছড়ে পড়ে অন্তু খুব জোরে ফুঁপিয়ে ওঠে কেউ এবার অন্তু ব্যথা ভুলে উঠে বসে ঠিক, ওই বন্ধ দরজার ওপারেই কেউ কাঁদছে দরজায় হালকা চাপড় মেরে অন্তু বলে, “কে কাঁদছ ওখানে?
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ, ফোঁপানোর আওয়াজটাও আর আসে না তারপর কান্না জড়ানো একটা বাচ্ছার ক্ষীণ গলা ভেসে আসে, “কে?
“আমি অন্তু, মানে অনন্তধন মিত্র তুমি কে? কী করছ এখানে?
“আমি পিথ্থিশ, এখানে খুব অন্দকার মা কোথায়
সর্বনাশ! এ তো একেবারে একটা বাচ্ছা, নাম বোধহয় পৃথ্বীশ অন্তুর গা ছমছম করতে থাকে
“তুমি এখানে এলে কী করে?
“জানি না, ওরা এনে আটকে রেকেচে
“কারা?
“এই যে আমরা”পিছন থেকে চিবিয়ে চিবিয়ে কেউ বলে ওঠে হঠাৎ দরজা খুলে একটা কঙ্কাল বেরিয়ে এসে নাচতে শুরু করে দিলেও অন্তু এতটা চমকাত না বোধহয় সোজা হয়ে দাঁড়ানোর আগেই কর্কশ একটা হাত এসে অন্তুর কাঁধটা চেপে ধরে
“কে হে তুমি চাঁদ, এখানে কোথা থেকে উদয় হলে?” বিশ্রীভাবে সুর টেনে লোকটা বলে ওঠে অন্তু লোকটার মুখ ভালো করে দেখতে পাচ্ছে না, তবে সে যে বেশ ষণ্ডা গোছের সেটা বুঝতে পারছে এক ঝাঁকুনি দিয়ে অন্তুকে মাটিতে শুইয়ে ফেলে লোকটা প্রচণ্ড লাগে অন্তুর পিঠে
“খুব কৌতূহল না তোর? শোন তবে, বাচ্চাটা পৃথ্বীশ রায়চৌধুরী, ওর বাপ বড়ো ব্যাবসাদার কুড়ি লাখ দিলে তবে ছেলে পাবে
অন্তুর ঝপ করে মনে পড়ে যায়, ক’দিন আগে খবরে বলেছিল বিখ্যাত ব্যবসাদারের একমাত্র ছেলে নিখোঁজ খুবই ছোটো বাচ্ছা, বোধহয় চার-পাঁচ বছর বয়স হবে তাকে এখানে ধরে রেখেছে? এই লোকটা একা নিশ্চয়ই নয়, নির্ঘাত আরও লোক আছে এদের দলে ততক্ষণে নীচু হয়ে অন্তুর মুখটা বেঁধে দিতে যায় শয়তানটা
“দলের বাকিরা খাবার নিয়ে ফিরুক, তারপর তোকে নিয়ে কী করা যায় ভাবা যাবে তোর বাপও যদি পয়সাওয়ালা হয়, তবে তো ডবল ফুর্তি
অন্তুর হঠাৎ বাড়ির কথা মনে পড়ে যায় কতক্ষণ হয়ে গেছে কে জানে মা নিশ্চয়ই ভাবছেন বুকটা কেমন করে ওঠে অন্তুর কী ভুলটাই না করে ফেলেছে সে

লোকটার মুখ বাঁধা শেষ এবার অন্তুর হাতদুটো ধরতে যায় আলো আঁধারিতে অন্তু লোকটার পায়ের আউটলাইন দেখতে পাচ্ছে হঠাৎ বিদ্যুৎ খেলে যায় অন্তুর মাথায় এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে সর্বশক্তি দিয়ে লোকটার একটা পা ধরে হ্যাঁচকা টান দেয় সে
বিকট একটা আওয়াজ করে আছড়ে পড়ে লোকটা অন্তু উঠে দাঁড়িয়ে তিরবেগে ছুটতে থাকে পাঁচিলের দিকে লোকটার খুব বেশি কিছু হয়নি, সেও উঠে দাঁড়ায়, পরমুহূর্তেই তাড়া করে অন্তুকে মুখের বাঁধনটা খুলতে পারলে চিৎকার করা যেত, কিন্তু ছুটতে ছুটতে খোলা অসম্ভব, খুব শক্ত করে বাঁধা মরিয়া হয়ে গেটটা খুঁজতে থাকে অন্তু লোকটা তাকে ধরে ফেলেছে প্রায়
নাহ্ শেষ রক্ষা হল না আর অন্তুর হাতটা পিছন থেকে মুচড়ে ধরেছে লোকটা শরীরটা বাঁকিয়ে হাত ছাড়াবার চেষ্টা করতে থাকে অন্তু কী জোর লোকটার গায়ে, সাঁড়াশির মতো ধরে আছে হাতটা ব্যথায় নিঃশ্বাস আটকে আসে অন্তুর আর এক হাত দিয়ে লোকটা কিছু বের করে আনে, বোধহয় পকেট থেকে আবছা আলোতেও অন্তুর বুঝতে অসুবিধা হয় না সেটা কী
হিংস্র গলায় লোকটা বলে, “বড্ড সাহস তোর, না? এবার মজা দেখ
ছুরিটা মাথার উপর তোলে লোকটা, নামিয়ে আনতে থাকে অন্তুর গলা লক্ষ্য করে
তিরুপতি শাসমল, মেজকা, মাআআবাঁধা মুখ দিয়ে কেবল বুবু করে একটা শব্দ বেরোয় অন্তুর
তিরবেগে কী যেন একটা অন্তুর পাশ কাটিয়ে লাফিয়ে পড়ে লোকটার উপর আঁক করে একটা আওয়াজ, তারপরেই লোকটা ছুটতে থাকে উলটোদিকে জোরদার একটা ঘৌ ঘৌ আওয়াজে পাড়া কাঁপিয়ে লোকটার পেছনে ছুটছে ও কে? এ তো খুব চেনা আওয়াজ
মুখের বাঁধনটা দুই হাতে ধরে টানতে থাকে অন্তু খুলতে পারে না, কিন্তু টানের চোটে মুখ থেকে সামান্য নেমে আসে সেটা প্রাণপণে চেঁচিয়ে ওঠে অন্তু“মামদোওও!!
বিস্ময়ে, আনন্দে দিশেহারা হয়ে পড়ে অন্তু মামদো এখানে কী করে এল? পিঠে আলতো ছোঁয়া পেয়ে আবার আঁতকে ওঠে সে চেনা একটা গলা বলে ওঠে, “কী ব্যাপার রে?
চারিদিক টলে ওঠে অন্তুর জ্ঞান হারিয়ে মেজকা তপোধন মিত্রের বাড়ানো হাতের মধ্যে পড়ে যায় সে

পুলিশি ঝামেলা মিটতে মিটতে মাঝরাত হারানো ছেলে পৃথ্বীশ ফিরে গেছে তার বাবা-মায়ের কাছে এমনি কোনো আঘাত লাগেনি, তবে ভয় পেয়েছিল বিস্তর অতটুকু ছেলে, বড়ো কষ্ট গেছে কদিন ধরে ওকে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছিল তাও সাহস করে সেই শিকল ঘরে রাখা একটা লোহার টেবিলে ঘষে ঘষে আওয়াজ বের করছিল সাহায্য পাওয়ার আশায়
দলের বাকিদের জন্য ওঁত পেতে ছিল পুলিশ, ওরা ফিরতেই সোজা থানায় চালান দিয়েছে
বাবা আর মেজকা মিলে পুলিশ, রিপোর্টার সবাইকে সামলেছে
যাওয়ার আগে সাব ইনস্পেকটর বলে গেছেন, “কাল এসে সমস্ত ভালো করে শুনব মশাই, কী ভাবে কী হল কিছুই তো পুরো বুঝিনি এখনও

বোঝেনি অন্তুও তপোধনের মনেও প্রশ্নের বন্যা বাড়ির সবারও তাই
নিজের বিছানায় মামদোর গলা জড়িয়ে বসে ছিল অন্তু রাত সাড়ে বারোটা, কারুর চোখে ঘুম নেই একফোঁটা মা মাঝে মাঝে এসে অন্তুর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন, একবার এসে কনুইতে চুন হলুদ লাগিয়ে গেলেন বেশ ফুলেছে ডান কনুইটা মায়ের চোখে জল, কিন্তু মুখে গর্বের হাসি
“সবার আগে বলো, তোমরা ওখানে পৌঁছালে কী করে?” অন্তু এতক্ষণে সুযোগ পায়
“আরে আমি তো ওই গলিতে একটা কাজে গেছিলাম, ভাবলাম মামদোটাকেও একটু হাঁটিয়ে আনি শুয়ে শুয়ে মোটা হচ্ছে ব্যাটা কাজ সেরে ফিরছি যখন, ও হঠাৎ কেমন করতে শুরু করল কুঁইকুঁই করছে, টানছে, নাক উঁচু করে শুঁকছে তারপর এক টানে হাত থেকে লীশ ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড় আমিও ছুটলাম, কী আর করব যে পাঁচিলের পাশ দিয়ে ছুটছি তার ওপারে তোর এমন বিপদ তা তো আর জানি না তখন ছুটতে ছুটতে একটা আধ ভাঙা গেটের ফাঁক দিয়ে, মানে সাবান কারখানার গেট দিয়ে মামদো তিরবেগে ঢুকে গেল আমি আর কী করব, বাধ্য হয়ে গেট টপকালাম হাত পায়ের নুনছাল উঠে একাকার হল ঢুকে দেখি শ্রীমান মুখ বাঁধা অবস্থায় বু-বু করছেন
মা শিউরে উঠে কপালে হাত ঠেকিয়ে কাকে যেন প্রণাম জানান
বাবা গম্ভীর গলায় বলেন, “কিন্তু তুই ওখানে গেলি কেন সেটা বল
অন্তু সবই এক এক করে বলে, পকেট থেকে কাগজের টুকরোটা বের করে দেখায় কিন্তু কপালটা এখনও কুঁচকে আছে তার
“এই হল ব্যাপার, কিন্তু ‘গুমখুন ২’ মানে কী? হারু দারোগাই বা কে? আর এই কাগজের রহস্যটা তো কিছুই বোঝা গেল না, আরে মেজকা তোমার আবার কী হল?
তপোধন হঠাৎ উঠে গুটিগুটি ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, তার মুখ লাল হয়ে উঠেছে
অন্তুর কেমন সন্দেহ হয়, এক লাফে বিছানা থেকে উঠে মেজকার হাত টেনে ধরে কনুইটা ঝনঝন করে ওঠে ব্যথায়
“মেজকা তুমি নিশ্চয়ই কিছু জানো, শিগগির বলো কী ব্যাপার,” অন্তু তপোধনের হাত ধরে প্রায় ঝুলে পড়ে
ভারী লাজুকভাবে হাসে তপোধন তারপর আমতা আমতা করে বলে, “তোমরা তো জানো আমার কীরকম ভুলোমন তুই বস না অন্তু
“তারপর, বলে যাও,” অন্তু মেজকার হাত ছেড়ে বসার কোনো লক্ষণ দেখায় না
“ইয়ে মানে, কলেজের অ্যানুয়াল প্রোগ্রামে নাটক হবে আমি বলেছি একটা জমজমাট গোয়েন্দা গল্প লিখে দেব তাই...,” থেমে যায় তপোধন
ঘরের ভিতর সবাই কোলাহল করে ওঠে
মা বললেন, “ওমা সে তো খুব ভালো কথা তপু
বাবা অবাক গলায়, “তুই গোয়েন্দা গল্প লিখবি? বলিস কী?
অন্তু খুব গম্ভীর গলায়, “তাই কী মেজকা?
“আরে ওই তো, জানিসই তো সব ভুলে যাই, তাই গল্পটা কেমন হবে সেই ব্যাপারে কিছু পয়েন্ট আর অন্য কিছু ইনফরমেশন একটা ছোটো ছেঁড়া কাগজের টুকরোয় লিখে কোথায় যে ঢুকিয়ে রেখেছিলাম...”
“কোথায় আবার, আমার লাইব্রেরির বইতে ঢুকিয়ে রেখেছিলে, উফফ মেজকা,” আর্তনাদ করে ওঠে অন্তু, “কিন্তু মেজকা এটা তো তোমার হাতের লেখা নয়, তাহলে তো আমি চিনতেই পারতাম
“আমার গল্পে থাকবে ভিলেন নিজের পরিচয় লুকানোর জন্য বাঁ হাতে লিখছে সেটাই প্র্যাকটিস করে দেখছিলাম আর-কি, তাই বুঝতে পারিসনি আসলে বেশ কিছুদিন ধরেই বাঁ হাতে লেখা অভ্যেস করছি, প্রথম প্রথম কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং হত, আসলে ব্যাপারটা আদৌ করা যায় কিনা সেটা দেখতে হবে তো,” তপোধন মুখ নীচু করে বলে
বাবা কাগজটা ইতিমধ্যে অন্তুর হাত থেকে নিয়ে নিয়েছিলেন, এবার দেখতে দেখতে বলেন, “দাঁড়া দাঁড়া, এক এক করে বল, ‘গুমখুন ২’ মানে কী?
“আরে ও কিছু নয় বড়দা, গোয়েন্দা গল্প, তাই গোটা দুয়েক অন্তত গুমখুন রাখব ভেবেছিলাম গল্পটাতে
মা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসি আটকাতে চেষ্টা করেন
“কিন্তু গলাকাটির মাঠ, ল্যাম্পপোস্টের পাশের গলি? এ তো সত্যিকার জায়গা, সেটা লিখেছ কেন, আর হারুদারোগাই বা কে? যাকে খুঁজতে গিয়ে আমি বাজখাঁই এক বুড়ি মানে বয়স্ক মহিলার পাল্লায় পড়লাম?” অন্তু প্রায় সেই বুড়ির মতোই বাড়ি মাথায় করে চেঁচিয়ে ওঠে
“আরে ওই গলিতে ডেকরেটরের বাড়ি, নাটকের দিন স্টেজ বাঁধা, সাজানো-টাজানোর ব্যাপার থাকবে তো ভাবলাম প্রায় পাড়ারই তো লোক, যদি কাজটা পেলে ডিসকাউন্ট দেয় কিছু ওরাও কাজ পেল, আমাদেরও সুবিধা ডেকরেটরের নাম হারু কী ভাগ্যি, আমি আজ ওর বাড়িই গেছিলাম নাহলে তুই...,” গলাটা এবার ধরে আসে তপোধনের
“ওটাই তো সেই ভয়ানক বুড়ির বাড়ি তাহলে,” অন্তু টানটান গলায় বলে
“সে তো বুঝতেই পারছি, তুই যাওয়ার একটু পরেই আমি পৌঁছেছিলাম বুড়ি তখনও জোর গলায় চেঁচামেচি করছিল, আমাকে দেখে থামল বলে কিনা ডাকাত এসেছিল আমি কি আর তখন বুঝেছি ডাকাত আমার নিজের ভাইপো?” এতক্ষণে হতাশভাবে আবার বসে পড়ে তপোধন ছি ছি, তার দোষেই এত কাণ্ড হল
“কিন্তু হারু ডেকরেটর দারোগা হল কী করে?” বাবা কিন্তু বেশ মজা পাচ্ছেন পুরো ব্যাপারটায় বড়ো উদ্বেগ গেছে ছেলেটাকে নিয়ে, কিন্তু তাঁর ছেলে যে এমন সাহসী সেটাও তো তিনি বোঝেননি কখনও আর তাঁর ভাই গোয়েন্দা গল্প লিখতে পারে! এটাও তাঁর কাছে সমান অবিশ্বাস্য
“বলতেই হবে?” মিনমিন করে বলে তপোধন, “নামটা শুনে পছন্দ হয়েছিল, তাই গল্পের একটা চরিত্র ওই নামে রাখব ভেবেছিলাম কাগজটা আর খুঁজে পাচ্ছিলাম না
“তুমি রোজ ব্রাহ্মী শাক খাও মেজকা,” এতক্ষণে মিত্র বাড়ির সবাই প্রাণখুলে হেসে ওঠে
“তোমার নাটক কবে তপু? আমরা সবাই দেখতে যাব কিন্তু,” মা অন্তু আর মামদোকে কোলের কাছে টেনে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করেন
“আমি জানি,” অন্তু চেঁচিয়ে ওঠে, “২৫শে জু, কিন্তু জুন নয়, জুলাই রাইট মেজকা?
“রাইট,” তপোধন মাথা নাড়েন, তারপর দ্বিধাভরে বলেন, “শোন, তোর ওই তিরুপতি শাসমলের বই একটা পড়তে দিবি রে? লিখতে একটু সুবিধা হবে আর-কি
অন্তু ভারী লজ্জা পেয়ে মায়ের কোলে মুখ লুকায় খুব বোকার মতো কাজ সে করে ফেলেছিল ঠিকই, কিন্তু বাচ্চাটাকে তো উদ্ধার করা গেল তবে একা ওরকমভাবে সে আর যাবে না, অন্তত যতদিন না বড়ো হয়ে ঠিকঠাক গোয়েন্দা হচ্ছে
মামদো যেন তার মনের কথা বুঝতে পেরে বলে ওঠে ভৌউউউ...
----------
ছবি - শুভশ্রী দাস

No comments:

Post a Comment