ম্যাজিক মিস্ট্রি
দেবলীনা চক্রবর্তী
“দাদু চলো, আমাদের ছুটি
হয়ে গেছে…”
কেশববাবু জানলার পাশে রাখা
আরাম কেদারাটায় আধশোয়া হয়েছিলেন। শেষ বিকেলের এই সময়টাতে একটুখানি তন্দ্রা জড়িয়ে
ধরে তার চোখের পাতাদুটিকে। না চাইতেও আপনি বুজে আসে।
নাতি সৌরভের ডাক পেয়েই উঠে বসলেন
তিনি। কখন সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে টেরই পাননি। সৌরভকে সবাইকে নিয়ে গিয়ে বারান্দায়
বসানোর নির্দেশ দিয়ে চোখে মুখে জল দিতে এগিয়ে গেলেন।
সাতষট্টি বছরের কেশব মুখার্জী
বছর সাতেক আগে রিটায়ার করেছেন। ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে স্কুলে অত্যন্ত জনপ্রিয়
ছিলেন তিনি। তবে অবসর গ্রহণের পর থেকে আর পড়াশোনা নিয়ে থাকতে ভালো লাগে না। এখন তার
প্রিয় কাজ দুটি। গল্প লেখা এবং গল্প বলা।
না, কোনো
পত্রপত্রিকা বা বইয়ের পাতায় প্রকাশ করার জন্য গল্প লেখেন না কেশববাবু। তার গল্পের কোনো
পাঠক নেই,
আছে কেবল শ্রোতা। আর সেই একনিষ্ঠ শ্রোতারা হল পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র নাতি সৌরভ
আর তার জনা দশ-বারো বন্ধু। কেশববাবুর ছোটো ছেলে রিষভ বছর তিনেক আগে
বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার পাঠ শেষ করেছে। এখন সে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার প্রস্তুতি
নিচ্ছে। সেই ছোটকুর কাছেই সৌরভ আর তার স্কুলের ওই সহপাঠীরা সপ্তাহে তিন দিন অঙ্ক
আর বিজ্ঞানের টিউশনি পড়ে। মঙ্গল আর শুক্রবার সন্ধেবেলা পড়া থাকলেও রবিবার দিন
দুপুর বেলায় পড়া থাকে। আর ওই দিনটাতেই ছোটকু ছুটি দেওয়ার পর সবাই মিলে ভিড় জমায়
ওদের সব্বার প্রিয় গল্পদাদুর কাছে। ফি রবিবার কেশববাবুর কাছে গল্প না শুনলে ওদের
রবিবারটা ছুটির দিন বলে মনেই হয় না। কেশববাবুও
ভারী আনন্দ পান ওদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে। প্রচণ্ড রকম শরীর খারাপ না হলে বা একান্ত
প্রয়োজনে কোথাও যেতে না হলে একদিনও বাদ যায় না এই গল্পের আসর।
প্রথম দিকে ঠাকুমার ঝুলি, রূপকথার
গল্প, পারস্য
উপকথা, বিভিন্ন
দেশের কিশোর সাহিত্যের অনুবাদ এসব নানাধরনের গল্পের ডালিই সাজিয়ে নিয়ে বসতেন। তবে
সে ভাঁড়ার ক্রমশ তলানিতে ঠেকে যাওয়ার পর থেকে নিজেই গল্প লিখতে শুরু করেছেন। এতে
অবশ্য তার সুবিধেই হয়েছে। সারা সপ্তাহ নতুন নতুন ভাবনা চিন্তার মধ্যে দিয়ে কীভাবে
যে সময় কেটে যায়, টেরই পান না। এমনকি রোজ সন্ধেয় গিন্নি আর বড়ো বউমার
পাল্লায় পড়ে ওই হিজিবিজি টিভি সিরিয়ালগুলোও জোর করে গিলতে হয় না। নিজের ঘরে, আপন
খেয়ালে নতুন নতুন সৃষ্টির নেশাতেই মশগুল হয়ে থাকেন তিনি।
শ্বেতপাথরের মেঝের উপর
পাটকাঠির মাদুর বিছানো। সেখানেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে রয়েছে দশ বারো বছরের খুদে
শ্রোতার দল। সবার সামনে একখানা বেতের চেয়ারে আয়েশ করে বসে রয়েছেন কেশব মুখুজ্যে।
হাতে বড়োবউমার হাতে তৈরি এক কাপ লাল চা। আদা দিয়ে বেশ কড়া করে বানানো।
“তা খবর কী সবার? ক্লাস
টেস্ট ছিল না কাল? কেমন হল?” চায়ের কাপে একখানা লম্বা চুমুক দিয়ে
বলে উঠলেন কেশববাবু।
সবাই সমস্বরে উত্তর দিল, “ভালো
হয়েছে দাদু।”
কেশববাবু মাথা নাড়লেন। সবার
উৎফুল্লতাই প্রমাণ দিচ্ছে ওদের সার্থকতার। শুধু ওই কোনায় বসে থাকা সায়ন যেন কেমন
উদাস হয়ে রয়েছে। মুখটাও যেন ভার। পরীক্ষা কি ভালো হয়নি ওর?
“কী রে সায়ন? তোর মুখখানা
অমন বাংলার পাঁচের মতন হয়ে আছে কেন? পরীক্ষা ভালো হয়নি বুঝি? কত
নম্বর ছেড়ে এসেছিস?” প্রশ্নটা করেই ফেললেন কেশববাবু।
“না গো দাদু পরীক্ষা নয়, সায়নের
ম্যাজিক পেনটা নষ্ট হয়ে গেছে বলে ওর মন খারাপ,” সায়নের পাশে
বসে থাকা রক্তিমের কাছ থেকেই উত্তরটা এল।
ভুরু কোঁচকালেন কেশববাবু। “ম্যাজিক
পেন? মানে?”
এতক্ষণে মাথা তুলল সায়ন। মুখটা
একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠল, “আর বোলো না দাদু। আমার মেজমামা
স্পেনে থাকে। ওখান থেকেই আমাকে একটা পেন পাঠিয়েছিল। দেখতে একদম সাধারণ পেনের মতোই, তবে
পেছনদিকের বোতামটা টিপলে কালির রং বদলে যেত। একবার নীল, একবার কালো
একবার সবুজ। দারুন… পুরো ম্যাজিকের মতো।”
“বেশ তো। তা কী হল ওই ম্যাজিক পেনের? খারাপ
হয়ে গেছে নাকি?”
“হ্যাঁ গো। কাল ওটা স্কুলে নিয়ে
গিয়েছিলাম। আসার পর থেকে দেখছি আর ওটার কালি বদলানো যাচ্ছে না। যতবারই বোতামটা
টিপি ওই এক বিচ্ছিরি নীল কালি বেরোচ্ছে। আগে নীল কালিটাও কত সুন্দর ছিল। এখন ওটাও
কেমন ফ্যাকাশে মতো হয়ে গেছে। কী করে যে এমন হল!” কাঁদো কাঁদো
মুখে বলে উঠল সায়ন।
“হাত থেকে পড়ে-টড়ে গেছিল নাকি?”
“না গো। আমি ওটা ব্যবহারই করিনি। শুধু
সবাইকে একবার দেখিয়ে পেনসিল বক্সে রেখে দিয়েছিলাম। বাড়ি ফিরে নতুন খাতায় নাম লিখতে
গিয়েই দেখলাম আর কাজ করছে না।”
কাপে আরও একটা চুমুক দিলেন
কেশববাবু। ব্যাপারটা তার বেশ রহস্যময় ঠেকছে। একটা জলজ্যান্ত কলম, হাত
থেকে পড়েওনি। তাহলে তার গুণ নষ্ট হল কেমন করে!
“তোর কাছে আছে এখন কলমটা?”
“হ্যাঁ দাদু। দাঁড়াও দেখাচ্ছি,” ব্যাগের
ভেতরে রাখা পেনসিল বক্স থেকে একটা কালচে রঙের কলম বের করে কেশববাবুর হাতে দিল সায়ন।
কেশববাবু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে
কলমটাকে দেখলেন। নেহাতই সাধারণ একটা পেন। সামনের অংশ খুলে রিফিলটাও পরীক্ষা করলেন, পাতি
ডটপেনের রিফিল। এটা দিয়েই ভিন্ন ভিন্ন রঙের লেখা পড়ত?!
কলমটা সায়নকে ফিরিয়ে দিলেন
উনি। আরেকখানা প্রশ্ন করলেন, “পেনটা কি
সারাদিন তোর সঙ্গেই ছিল?”
মাথা চুলকালো সায়ন, “হ্যাঁ
মানে পেনসিল বক্সেই তো ছিল। আর বক্সটা তো আমার কাছেই ছিল। কম্পিউটার ল্যাবে যাওয়ার
সময় ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়ে গিয়েছিলাম।”
“কম্পিউটার ল্যাবে গিয়েছিলি? কখন? সবাই
গিয়েছিল?”
সন্দিগ্ধ গলায় প্রশ্ন করলেন গল্পদাদু।
“ওই লাস্ট পিরিয়ডে। হ্যাঁ সবারই ক্লাশ
ছিল।”
“সবাই একই সঙ্গে গিয়েছিলি? ফিরেও
ছিলি?”
“হ্যাঁ মানে, যাওয়ার সময় সবাই একসঙ্গেই
বেরিয়েছিলাম ক্লাস থেকে, লাইন করে। আসার সময় আমার একটু দেরি
হয়েছিল। আগের সপ্তাহে আ্যবসেন্ট ছিলাম তো, তাই
প্র্যাকটিকাল খাতায় কয়েকটা বেশি সই করানোর ছিল। কিন্তু দাদু আমার পেন তো চুরি
যায়নি। যেমনকে তেমন বক্সে ছিল। শুধু কী করে যে ওর ম্যাজিকটা নষ্ট হয়ে গেল!” চোখ
দুটো ছলছল করে উঠল রোগপাতলা ছোট্ট ছেলেটার।
কেশববাবু খানিকক্ষণ মাথা নিচু
করে বসে রইলেন। গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন যেন। তারপর সোজা হয়ে বসলেন। একটু যেন হাসি
ফুটে উঠল তার ঠোঁটের কোণে।
“মন খারাপ করিস না। যা হবার তা তো
হয়েই গেছে। তার চেয়ে বরং আজকের গল্পটা শোন। মনটা ভালো হয়ে যাবে।”
সবাই হই হই করে উঠল। সায়নও
মাথা নাড়ল।
বাকি চা-টুকু এক চুমুকে শেষ
করে শুরু করলেন কেশববাবু -
“অনেক অনেক দিন আগের কথা।
কেষ্টপুর নামের এক গ্রামে এক গরিব ব্রাহ্মণ ছিল। তার নাম হিতলাল ভটচাজ। গ্রামের এক
প্রান্তে সে আর তার গিন্নি এক মাটির বাড়িতে থাকত। নিঃসন্তান
এই দম্পতির সংসারে বড্ড অভাব। দু-চার বাড়ি নিত্য পূজা করে যে চাল কলাটুকু রোজগার
হয়, তাতে
মোটেই তাদের গ্রাসাচ্ছাদন হয় না। কোনোদিন আধপেটা খেয়ে থাকতে হয়, তো কোনোদিন
শুধু জল খেয়েই কাটাতে হয়। যতই চেষ্টা করুক অবস্থার আর উন্নতি কিছুতেই হয় না।
গ্রামে ব্রাহ্মণ পুরোহিতের অভাব নেই। তাছাড়া বড়ো বড়ো পুজো-আচ্চা
করার জন্য জমিদার মশায়ের বাঁধা পুরোহিত রয়েছে। বয়স্ক এই মানুষটিকে তেমন কেউ ডাকে
না। বড়ো কষ্টে তার দিন গুজরান হয়।
“বছরের পর বছর এমনভাবে কাটাতে
কাটাতে ব্রাহ্মণ গিন্নির সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেছে। সে দিনরাত তার স্বামীকে গালমন্দ
করে। খেতে পড়তে যদি নাই দিতে পারো, তবে বিয়ে করেছিলে কেন? কত
দিন ভালো কিছু মুখে দিই না! এই এক ছেঁড়া শাড়ি পড়ে আর কতদিন চলবে!
“তা এরকম রোজই হয়। হিতলালের
গিন্নির মুখ ঝামটা সয়ে গেছে। তা একদিন কী হল, দু-বাড়ি পুজো করেও একমুঠো চাল পেল না
সে। মুখচোরা নিরীহ মানুষটা মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারল না।
“এদিকে বাড়িতে ফেরার পর
অশান্তি একদম সীমা ছাড়িয়ে গেল। গিন্নি মুখের উপর বলেই ফেলল, যদি
আজ চালের ব্যবস্থা না করতে পারো, এ মুখ আর দেখিও না আমাকে।
“রাগে দুঃখে জর্জরিত হয়ে
হিতলাল গৃহত্যাগ করল। কোনো কিছু না ভেবে উত্তরদিকের পথ ধরে হাঁটতে শুরু করল।
“মাইলের পর মাইল হাঁটতে থাকল
সে। কত গ্রাম,
গঞ্জের পথ পেরিয়ে শেষে এক জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। গভীর সে জঙ্গলে দিনের বেলাতেও যেন
আঁধার ছেয়ে থাকে। তা, তোরা কেউ জঙ্গল দেখেছিস?”
“আমি দেখেছি দাদু। আগের বছর পুজোর
ছুটিতে গোরুমারা ফরেস্টে গিয়েছিলাম,” রাহুল উত্তর দিল।
“আচ্ছা। তা কী কী জীবজন্তু
দেখতে পেলি?”
“অনেক কিছু। একটা হাতি, দুটো
বাইসন। ময়ূরও দেখেছি অনেকগুলো,” চোখ গোলগোল করে বলে উঠল রাহুল।
মাথা নাড়লেন কেশববাবু। একটু
থেমে ফের শুরু করলেন।
“এটাও ধরে নে ওইরকমই একটা জঙ্গল। শাল, সেগুন, শিরিষে
ভরা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল। তা হিতলালের তো কোনো জ্ঞান নেই। সে মনের দুঃখে
হেঁটে চলেছে। হঠাৎ সে দেখতে পেল এক নদী। জঙ্গলের ভেতর দিয়েই বয়ে চলেছে। পায়ে পায়ে
সেই নদীর তীরে গিয়ে দাঁড়াল সে। যত রকম দুঃখ, কষ্ট, অপমান
সব যেন মনের মধ্যে ভিড় করে এল। তার দু-চোখ
বেয়ে জল বইছে। মনে মনে সে ভাবল, কী লাভ এই জীবন রেখে! দুঃখ, কষ্ট, অভাব
ছাড়া তো আর কিছুই পাইনি। গিন্নিও আমাকে চায় না। তার চেয়ে এই নদীর বুকে ঝাঁপ দিয়ে
মৃত্যুবরণ করে নিলেই বুঝি শান্তি পাওয়া যাবে।
“এই সব ভেবে যেই না সে নদীতে
ঝাঁপ দিতে যাবে,
ওমনি কেউ যেন তার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিল। হিতলাল তো বিষম অবাক। এই গহীন
অরণ্যে কে আসবে তার প্রাণ বাঁচাতে! ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল এক সাধুবাবা
দাঁড়িয়ে। জটাজূটধারী, ছাই ভস্ম মাখা, পরনে বাঘছাল। চোখ দুটো লালচে। কাঁধে
বেশ বড়োসড়ো এক ঝুলি। সেই সাধুবাবা গম্ভীর স্বরে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি
করতে যাচ্ছিলি তুই? আত্মহত্যা? জানিস আত্মহত্যা কত বড়ো পাপ?’
“ব্রাহ্মণ ডুকরে কেঁদে উঠল। কাঁদতে
কাঁদতেই বলে উঠল, বাবা আমার বড্ড অভাব। দু-বেলা দু-মুঠো ভাতও জোটে না। বউকে কোনো সুখ
দিতে পারিনি। কেউ চায় না আমাকে। এত দুঃখ কষ্ট নিয়ে আর বেঁচে থাকতে পারছি না যে…।
“সাধুবাবা তার কাঁধে হাত
রাখলেন। তারপর বললেন, ‘শান্ত হ। এ জীবনে এমন কোনো সমস্যা নেই, যার
সমাধান নেই। তোর কষ্ট আমি দূর করে দিতে পারি।’
“হিতলাল চোখের জল মুছে হাত
জোড় করে দাঁড়াল। সাধুবাবা কি পারবেন তার অন্নকষ্ট দূর
করতে?
“সাধুবাবা চোখ বন্ধ করে
মন্ত্র পড়া শুরু করলেন। কী ভীষণ কঠিন সে মন্ত্র। হিতলাল ব্রাহ্মণ পুরোহিত হয়েও এমন
মন্ত্র কখনও শোনেনি। বেশ খানিকক্ষণ মন্ত্র জপ করার পর সাধু ঝুলি থেকে একটা মাঝারি
মাপের পাথর বের করে হিতলালের হাতে ধরিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, ‘শোন, এ
হল বাসনাপূরণ শিলা। মা অন্নপূর্ণার মন্ত্রপূত এই পাথরকে একটা ধোয়া কলাপাতার উপর
বসাবি। তারপর যে খাবারের কথা উচ্চারণ করবি, দেখবি সেই
খাবারই তোর পাতে উপস্থিত হয়েছে। অনন্তকাল ধরে ব্যবহার করতে পারবি এই শিলা।’
“হিতলাল তো নির্বাক হয়ে গেল
সবকিছু শুনে। এমন আবার হয় নাকি! নদীর ধারে এমন কত পাথরই তো পড়ে থাকে, তার
কি কোন বিশেষ ক্ষমতা থাকতে পারে!
“সাধুবাবাজি বুঝতে পারলেন
হিতলালের তার কথায় বিশ্বাস হচ্ছে না। তিনি তাকে আদেশ দিলেন ওপাশের গাছ থেকে একটা
কলাপাতা তুলে নদীর জলে ধুয়ে নিয়ে আসতে। হিতলাল সাধুর কথা অনুযায়ী তাই করল। দুজনে
মাটির উপর মুখোমুখি বসল, পাতাটাকে মাঝখানে রেখে তার উপর পাথরটাকে
রাখল। তারপর সাধুবাবা হিতলালকে বললেন, ‘নে, এবার তোর যা
যা খেতে ইচ্ছে করছে সব বল।’
“হিতলালের সত্যিই খুব খিদে
পেয়েছিল। সকাল থেকে কিচ্ছুটি খায়নি সে। কোনোরকমে সে উচ্চারণ করল, ভাত।
“সঙ্গে সঙ্গে কলাপাতার উপর
গরম ধোঁয়া ওঠা অনেকটা ভাত চলে এল। কোথা থেকে
এল কিছুই বোঝা গেল না।
“হিতলালের চোখের পলক পড়ল না।
এ যে একেবারে ভেলকি! সত্যিই অবিশ্বাস্য! সে গদগদ হয়ে
সাধুবাবার চরণে পড়ে গেল। বাবা মিটিমিটি হেসে তাকে আরও খাবারের নাম বলতে বললেন।
“হিতলাল এক এক করে সেইসব
খাবারের নাম বলতে থাকল, যেগুলো সে হয় বহুদিন খায়নি, না
তো কোনোদিনই খাবার সুযোগ পায়নি। সোনা মুগের ডাল, পটলের দোলমা, বেগুন
ভাজা, ছানার
ডালনা, আমের
চাটনি, রসগোল্লা, মিষ্টি
দই… আরও
কত কিছু। আর দেখ না দেখ একের পর এক সবকিছু একটা একটা করে পাতের উপর উদয় হতে শুরু
করল, একেবারে
কথা শেষ হতে না হতেই। তার সুগন্ধে ব্রাহ্মণ আর নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারল না। পেট
পুরে ওসব অমৃতের স্বাদ নিতে থাকল।”
এই পর্যন্ত বলে থেমে গেলেন
কেশববাবু। খুদে শ্রোতাদের মুখের দিকে তাকালেন। সবার মুখ হাঁ হয়ে গেছে। জিভে জল আসব আসব অবস্থা।
রগুড়ে গলায় প্রশ্ন করলেন তিনি, “তা, হ্যাঁ
রে, তোদের
কাছে যদি এমন এক জাদু পাথর থাকত তোরা কী কী খাবার চাইতিস?”
চকলেট আইসক্রিম, পিজ্জা, চিকেন
পকোড়া, মোমো, ফুচকা, বিরিয়ানি, চুরমুর,
টুটি ফ্রুটি…
আরও কত নাম ভেসে এল। তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে। নাক সিঁটকোলেন কেশববাবু। আজকাল
ছেলেমেয়েদের এই এক সমস্যা। শুধুই ওসব হাবিজাবি ফাস্ট ফুডের দিকে ঝোঁক। কোথায় বলবে
বর্ধমানের সীতাভোগ মিহিদানা, কে সি দাসের রসগোল্লা, জাফরানি
পোলাও, মুড়িঘন্ট, কবিরাজি
তা নয়, যত্তসব
উলটোপালটা।
সবার জল্পনা কল্পনাকে মাঝপথে
থামিয়ে গল্পে ফিরে গেলেন গল্পদাদু -
“অনেক হয়েছে, তারপর কী হল
শোন। পেটপুরে খেয়েদেয়ে সাধুবাবাকে প্রণাম জানিয়ে মনের আনন্দে ফেরার পথ ধরল হিতলাল।
কিন্তু ততক্ষণে সন্ধে নামব নামব করছে। বাড়ি কম করে হলেও ক্রোশ
চারেক হবে। ক্রোশ মানে বুঝিস তো, এক ক্রোশ মানে প্রায় তিন কিলোমিটার।
“সে যাই হোক। অতখানি পথ তো আর
এত রাতে পাড়ি দেওয়া যাবে না। তাহলে কী উপায়! অনেক
ভেবেচিন্তে হিতলালের এক পুরোনো বন্ধুর কথা মনে পড়ল। সেই বন্ধুর বাড়ি এই জঙ্গলের
ঠিক আগের গ্রামেই। তার বাড়িতে নাহয় রাতটা কাটিয়ে ভোর ভোর রওনা দিলেই হল।
“যেই ভাবা সেই কাজ। হিতলাল পা
চালিয়ে জঙ্গল পেরিয়ে সেই বন্ধুর বাড়ি পৌঁছোল। ততক্ষণে
বেশ রাত হয়ে গেছে। এতকাল পরে পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে দুজনেই বেশ খুশি।
বন্ধুপত্নী তাকে খাবার খাওয়ার জন্য অনুরোধ করল। কিন্তু পাহাড় প্রমাণ সুস্বাদু
খাবার খেয়ে হিতলালের পেট ভীষণ ভর্তি, তাই আর কিছু মুখে না দিয়ে সে শুয়ে পড়ল।
ঘুমোনোর সময় পাথরটাকে মাথার উপরে রেখেই শুল সে।
“পরদিন সুয্যি উঠলেই ওদের
বিদায় জানিয়ে রওনা দিল সে। পা চালিয়ে দুপুরের আগেই বাড়ি পৌঁছে গেল। আজ তার মনে বড়ো
আনন্দ। কত বছর পর গিন্নিকে মন ভরে আর পেট পুরে সুখাদ্য খাওয়াতে পারবে।
“ব্রাহ্মণ গিন্নি কিছুই বুঝে
উঠতে পারছিল না। তবু স্বামীর কথামতো জল গড়িয়ে, কলাপাতা
সাজিয়ে বসে পড়ল।
“হিতলাল পাথরটাকে পাতের উপর
সাজিয়ে কাল যা যা খেয়েছিল একে একে সেইসব পদের নাম বলে গেল। কিন্তু ওমা, কোথায়
কী! একটাও
খাবার এল না।
“অনেকবার চেষ্টা করল হিতলাল।
সাধুবাবাকে স্মরণ করে, মা অন্নপূর্ণাকে স্মরণ করেও কোনো লাভ হল না। কিছুই বুঝে
উঠতে পারল না সে। কী করে যে দৈবী পাথরের গুণ নষ্ট হয়ে গেল!
“এদিকে গিন্নির তো রেগে আগুন
তেলে বেগুন দশা। একেই কাল থেকে না খেয়ে আছে। আর এখন এসব প্রহসন। টাকা রোজগার করে
আনার বদলে পাথর নিয়ে এসে নাটক করা হচ্ছে! ওই পাথরকে আছড়ে ফেলে ভেঙে দিয়ে শোয়ার
ঘরে ঢুকে খিল আটকে বসে রইল সে।
“হিতলালের কাঁদো কাঁদো
অবস্থা। না জানি কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছে ভগবান তাকে। পাথরের টুকরোগুলোর দিকে
তাকিয়ে সে বেচারা কাঁদতে থাকল। মনে মনে ঠিক
করল কাল আবার সে ওই জঙ্গলে যাবে। ওই সাধুবাবার কাছে। যা হোক একটা বিহিত তো করতেই
হবে!
“সেইমতো পরের দিন সক্কাল
সক্কাল বেরিয়ে সে বনের পথ ধরল। দুপুরের মধ্যেই জঙ্গলের ওই নদীতীরে পৌঁছে গেল।
কিন্তু সাধুবাবার দেখা পেল না। আকুল হয়ে সে বাবা তুমি কোথায়, একবারটি
দেখা দাও বলতে বলতে জঙ্গলের ভেতর ঘুরতে থাকল।
“অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও বাবার
সন্ধান না পেয়ে হিতলাল একটা বড়ো গাছের নীচে বসে পড়ল। চারিদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে।
শরীর অবসন্ন হয়ে পড়ছে। এমন সময়ই তার সামনে উদয় হলেন সেই সাধুবাবাজি। গম্ভীর
গলায় বলে উঠলেন,
‘কী রে, তোর সমস্যা মেটেনি? আজ কেন এসেছিস এখানে? আমাকে
খুঁজছিলি কেন?’
“হিতলাল হাপুস নয়নে কাঁদতে
কাঁদতে সাধুর পায়ে পড়ে গেল। পাথরের গুণ নষ্ট হওয়ার সব গল্প তাকে বলল।
“সাধুবাবাও সবটা শুনে ভীষণ
অবাক হয়ে গেলেন। এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। মন্ত্রপূত ওই শিলার ক্ষমতা কোনোভাবেই নষ্ট
হওয়া সম্ভব নয়। তবে হিতলাল মিথ্যে বলছে, তেমনও নয়।
“অগত্যা সাধুবাবা আবার মন্ত্র
পড়তে শুরু করলেন। আজকের মন্ত্রটা গতদিনের থেকে আলাদা। বেশ খানিকক্ষণ মন্ত্র পড়ার
পর ঝুলি থেকে একটা ছোটোখাটো জাঁতা বের করে হিতলালের হাতে দিলেন। জাঁতা কি জিনিস
জানিস তো?”
“হ্যাঁ দাদু জানি। ওতে আটা পেষা যায়, মশলা
পেষা যায়। এইভাবে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পিষতে হয়, আমি টিভিতে
দেখেছি।”
সৌরভের উত্তরে সন্তুষ্ট হলেন
কেশববাবু। যাক,
টিভির কিছু ভালো গুণও আছে তবে।
“হুমম। তা
সেই জাঁতাটাকে হিতলালকে ধরিয়ে সাধুবাবা বললেন ওটা নাকি কুবেরের মন্ত্রপূত জাঁতা।
ওটাকে ঘোরালেই পয়সা বেরোয়।
“হিতলাল তো ভীষণ অবাক। ভয়ে
ভয়ে সে জাঁতাটাকে আস্তে করে একবার ঘোরাল। সত্যিই তো! কলকল
করে ওর ভেতর থেকে পয়সা বেরোতে থাকল। যত ঘোরাচ্ছে
তত পয়সা বেরোচ্ছে।
“আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল
হিতলাল। সাধুবাবাকে প্ৰণাম করে বেরিয়ে এল জঙ্গল থেকে। ততক্ষণে রাত বেশ গভীর হয়ে
গেছে। আজও রাতটা বন্ধুর বাড়িতেই কাটাতে হবে। সেইমতো ওই
বন্ধুর বাড়িতেই উঠল সে। আজ কোনো
খাবার সে পায়নি। যদিও তার কোমরের পুঁটলিতে বেশ কিছু পয়সা রয়েছে। বন্ধুর বউ তাকে
যত্ন করে গুড় রুটি খেতে দিল। সেই খেয়েই লম্বা ঘুম দিয়ে পরদিন সকালে সে বাড়ির পথ
ধরল।
“গিন্নির এতক্ষণে রাগ ভেঙেছে।
মানুষটা সেই কাল বেরিয়েছে। আদৌ মুখে কিছু দিয়েছে কিনা সেই ভেবেই তার বড্ড মন
খারাপ। হিতলালকে ঘরের দাওয়ায় পা রাখতে দেখেই খুশি হয়ে উঠল সে। হিতলাল কোনো কথা না
বলে মুচকি হেসে তার হাতে জাঁতাখানি ধরিয়ে দিল। গিন্নির মুখ ব্যাজার হয়ে গেল। ঘরে
তো জাঁতা রয়েছে,
আরও একটা কেনার কী মানে হয়! তার চেয়ে দু-মুঠো চাল ডাল আনলে ভালো
হত না!
“হিতলাল গিন্নিকে জাঁতাটা
ঘোরাতে বলল। সে জানে ওটা ঘোরালে যা ভেলকি শুরু হবে, গিন্নির তাক
লেগে যাবে। ব্রাহ্মণ গিন্নি তার কথামতো জাঁতা ঘোরাতে শুরু করল, কিন্তু কোথায় পয়সা! বহুবার
ঘোরানোর পরও ঘরঘর শব্দ ছাড়া আর কিছুই বেরোল না। একটা টাকাও না। গিন্নির ধৈর্য্যের
বাঁধ এবার ভেঙে গেল। জাঁতাটাকে ছুঁড়ে ভেঙে দিয়ে যারপরনাই গালমন্দ করা শুরু করল
ব্রাহ্মণকে।
“হিতলালও ভীষণ রকম অবাক হয়ে
গেছে। কী করে সব জিনিসের গুণ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না। গিন্নি
তার কোনো কথাই শুনতে নারাজ। হঠাৎ তার মনে পড়ল পুঁটলিতে রাখা পয়সাগুলোর কথা। ওগুলো
বের করে গিন্নিকে দেখিয়ে সব গল্প শোনাল। এতক্ষণে হিতলালের কথায় বিশ্বাস হল তার
পত্নীর। সে তখন ঐ পয়সাগুলো দিয়ে চাল, আলু, চিঁড়ে মুড়ি
যা হোক কিছু কিনে আনার কথা বলল। সঙ্গে সঙ্গে এও বলল যে কাল সকালে আবার ওই
সাধুবাবার কাছে যেতে। বাবা যদি কোনো বিধান দিতে পারেন।
“গিন্নির কথা অনুযায়ী পরদিন
সকালে হিতলাল দুটো চিঁড়ে মুড়ি বেঁধে নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করল। জঙ্গলের নদীতীরে
পৌঁছোতেই এবার সে বাবার দর্শন পেল। সাধুবাবা তখন নদীতে স্নান করছিলেন। তিনি উঠে
আসতেই তার পা ধরে ক্ষমা চেয়ে সবটা বলল হিতলাল। সব
শুনে বাবা বললেন, ‘তুই কি পাথর বা জাঁতাটা সঙ্গে এনেছিস?’
“কাঁচুমাচু মুখে স্বীকার করল
হিতলাল। তার গিন্নি রাগ করে ভেঙে দিয়েছে ও দুটোকে। বাবা বললেন, ‘তুই
এখান থেকে সোজা বাড়ি যাস, না পথে কোথাও বিশ্রাম নেওয়ার জন্য
আশ্রয় নিস?’
“হিতলাল তার বন্ধুর কথা বলল
সাধুবাবাকে। তাদের কথা শোনার পর উনি বললেন, ‘হ্যাঁ রে,
সত্যি করে বল তো, তুই ওই দিব্য জিনিসগুলোর শক্তির কথা বন্ধু বা তার স্ত্রীকে
বলিসনি তো?’
“হিতলাল হাঁ হাঁ করে উঠল। ‘না
না বাবা, এসব কী বলছেন, আমি তো ঘুণাক্ষরেও কাউকে কিছু জানাইনি।
এমনকি রাতে শোওয়ার আগে ওদের বার বার বলে দিয়েছিলাম পাথরটাকে কিছু না বলতে, বা
জাঁতাটা না ঘোরাতে।’
“এটা শুনেই একটা গভীর
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন সাধুবাবা। দু-হাত দিয়ে কপালের রগ চেপে ধরলেন, তারপর বলে উঠলেন, ‘ওরে
গাধা, মানুষ কি এমনি এমনি জাঁতা ঘোরায়? নাকি পাথরের সঙ্গে কথা বলে? তুই
অমন করে বলেছিস বলেই তোর বন্ধু আর তার বউ বুঝে গেছে ওগুলোর কোনো দিব্য শক্তি আছে।
ওরাই নিশ্চিত ওগুলোকে চুরি করে তার বদলে একই রকম দেখতে সাধারণ পাথর আর জাঁতা রেখে
দিয়েছিল। তুই কিছু না বুঝে ওগুলোকেই ঘরে নিয়ে গিয়েছিস।’
“সহজ সরল হিতলাল আকাশ থেকে
পড়ল। তারই কতকালের পুরোনো বন্ধু, শেষে কিনা তাকে এভাবে ঠকাল?
বড়ো দুঃখ হল তার। বিষণ্ন গলায় সাধুকে জিজ্ঞেস করল সে, ‘এবার কী
করব বাবা?’
“সাধুবাবা হাসলেন। তারপর
গাছের তলায় রাখা ঝুলি থেকে একটা লাঠি আর বেশ মোটা একগাছা দড়ি বের করলেন। ওগুলোকে
হাতে নিয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়লেন। তারপর বললেন, ‘এগুলো ধর।
বাবা ধর্মরাজের মন্ত্র পড়া আছে এতে। তুই রোজকার মতোই তোর বন্ধুর বাড়ি চলে যা। রাতে
শোওয়ার আগে এটাকে মাথার উপর রেখে শুবি, আর বন্ধুকে বলবি ওটা যেন স্পর্শ না
করে। তুই কিন্তু ঘুমোবি না। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকবি। তারপর দেখবি এর খেল।
কাজ হয়ে গেলে কাল এ দুটোকে নদীর জলে ভাসিয়ে তারপর ঘর ফিরবি।’
হিতলাল মাথা নাড়ল। মনে মনে
একটু দুঃখই পেল। বাবা তার অভাব দূর করার কিছু দিলেন না এবার। চুরি যাওয়া ওই জিনিস
দুটো কি আর ফেরত পাওয়া যাবে! এই লাঠি আর দড়ি যে কী কাজে লাগবে!
“সে যাই হোক, সাধুকে
মুখ ফুটে সে কিছুই বলে উঠতে পারল না। তাকে প্রণাম জানিয়ে সে গুটিগুটি পায়ে বন্ধুর
বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
“তাকে দেখে তো বন্ধুর আনন্দের
সীমা নেই। বন্ধুপত্নী আজ আপ্যায়ন করে পঞ্চ ব্যঞ্জন সাজিয়ে খেতে দিল। স্বাদ যেন
অমৃত। হিতলাল সহজেই বুঝে গেল, এ খাবার ওই পাথরের কল্যাণে পাওয়া।
খুব রাগ হলেও সে কিছুই বলল না। চুপচাপ মেঝেয় পাতা শীতলপাটির উপর শুয়ে পড়ল। তবে তার
আগে সাধুবাবার কথামতো লাঠি আর দড়ি শিয়রে সাজিয়ে রেখে বন্ধুকে বলে দিল, ‘ওগুলোতে
কিন্তু হাত দিও না ভায়া।’
“রাত তখন বেশ গভীর। কিন্তু
হিতলাল ঘুমোয়নি। চোখ বুজে মটকা মেরে শুয়ে আছে। স্পষ্ট বুঝতে পারল তার বন্ধু আর
বন্ধুপত্নী পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকে তার মাথার কাছে এসে দাঁড়াল। আর
তার একটু পরেই ধুপধাপ করে শব্দ, আর ওদের দুজনের প্রচণ্ড জোর চিৎকার। -
ওরে বাবা রে, মরে গেলাম রে, বাঁচাও বাঁচাও।
“হিতলাল ধড়মড় করে উঠল, সামনের
দৃশ্য দেখে সে তো অবাক। এ তো দারুণ ব্যাপার। দড়িটা ওদের দুজনকে পেঁচিয়ে ধরেছে। আর
লাঠিটা নিজের থেকেই ওদের বেদম পেটান পেটাচ্ছে। যেন অদৃশ্য কেউ ওই লাঠিটা দিয়ে ওদের
মারছে।
“বেশ কিছুক্ষণ ওদের মার খেতে
দেখল হিতলাল। থামাতে গেল না। তারপর ওরা যখন কাহিল হয়ে পড়ল, তখন সে ওই লাঠিটাকে
স্পর্শ করল। সঙ্গে সঙ্গে ওটা শান্ত হয়ে গেল আর দড়িটা ওদের ছেড়ে মাটিতে পড়ে গেল।
“বন্ধু আর বন্ধুপত্নী
হিতলালের পায়ে পড়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতে সব সত্যি স্বীকার করল। তারাই ওই পাথর আর
জাঁতা নিয়েছে। ওগুলোর গুণ দেখে ওরা আর লোভ সামলাতে পারেনি। বন্ধুপত্নী তড়িঘড়ি গিয়ে
পেছনের ঘর থেকে ও দুটোকে নিয়ে এল।
“হিতলাল ওদের ছেড়ে দিল। যতই
হোক পুরোনো বন্ধু, তাই ক্ষমাই করে দিল। কাল থেকে যত পয়সা ওরা জাঁতা ঘুরিয়ে বের
করেছে, সেগুলোকেও
ওদের কাছেই রাখতে বলে জিনিস দুটোকে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। পাশের
গ্রামে এক নদীর জলে লাঠি আর দড়িটাকে বিসর্জন দিয়ে মনে মনে সাধুবাবাকে প্রণাম জানাল। তারপর
ঘরের দিকে রওনা দিল।
“সেই থেকে ব্রাহ্মণের আর কোনো
অভাব রইল না। নিজেদের অভাব মিটিয়ে সব শখ সাধ পূরণ করার পরেও তার অর্থ কম পড়ে না। গরিবদের
প্রচুর দানধ্যান করে, মন্দির বানিয়ে সৎপথে তারা ওই অর্থ খরচ করে। আর মণ্ডামিঠাই
মন ভরে খেয়ে মহা সুখে জীবন যাপন করতে থাকে।”
গল্প শেষ হতেই সবাই হাততালি
দিয়ে উঠল। ওদের হাসিহাসি মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা
যাচ্ছে, গল্পটা
ওদের ভারী পছন্দ হয়েছে।
কেশববাবু জলের বোতল থেকে
খানিকটা জল খেলেন। গলাটা বড্ড শুকিয়ে গিয়েছিল যে। তারপর সবাইকে আসতে বললেন। সাতটা
বেজে গেছে। আজ আবার একবার পাড়ার ক্লাবে যেতে হবে। দূর্গাপুজোর আর বেশি বাকি নেই।
তারই মিটিং ডেকেছে।
সবাই গল্পদাদুকে টাটা করে
গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেল। সদ্য শোনা গল্পটাকে নিয়ে জল্পনায় মশগুল সবাই। শুধু সায়ন
যেতে যেতেও গেল না। দরজার পাল্লা ধরে দাঁড়িয়ে পড়ল।
কেশববাবুর চোখ এড়াল না
ব্যাপারটা। ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী রে, কিছু
বলবি?”
সায়ন মাথা চুলকাল, “না
মানে, দাদু বলছিলাম যে… না থাক, কিছু না… আসছি।”
খানিকক্ষণ ইতস্তত করার পর
কিছু না বলেই বেরিয়ে গেল সায়ন। কেশববাবু মুচকি হাসলেন। বারান্দার আলো নিভিয়ে
ভেতরের ঘরে চলে গেলেন।
* * *
খবরের কাগজটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে
পড়ছিলেন কেশববাবু। প্রতিদিনই কাগজটা সকালে শুধু চোখ বুলিয়ে রেখে দেন। পরে দুপুরে
খাবার পর বা বিকেলের দিকে ফের ওটাকে নিয়ে বসেন। তখন একেবারে বিজ্ঞাপন সমেত খুঁটিয়ে
খুঁটিয়ে সবটা পড়ে ফেলাই তার অভ্যাস।
মন দিয়ে উচ্চ রক্তচাপের একটা
নতুন ওষুধ বের হওয়ার খবরটা পড়ছিলেন। তখনই দরজায়
কেউ যেন টোকা মারল।
কেশববাবু কাগজ থেকে মুখ তুলে
দেখলেন সায়ন দাঁড়িয়ে আছে।
একটু অবাকই হলেন তিনি। আজ তো
মঙ্গলবার। রবিবার ছাড়া তো ওরা তার ঘরে বড়ো একটা আসে না। তাছাড়া সোয়া ছ’টা
বাজে। আর একটু পরেই ওদের পড়াতে শুরু করবে
রিষভ।
“কী রে, এখানে কী
মনে করে?”
“একটা কথা বলার ছিল দাদু,” হাসি
হাসি মুখে ভেতরে ঢুকল সায়ন।
“কী কথা?”
“থ্যাংক ইউ।”
আকাশ থেকে পড়লেন কেশববাবু। এ
ধন্যবাদের কারণ কী?!
“আমি ম্যাজিক পেনটা ফিরে পেয়েছি দাদু।
শুধু তোমার জন্যই।”
এতক্ষণে সবটা পরিষ্কার হল
কেশববাবুর কাছে। রগুড়ে গলায় বলে উঠলেন, “তাই নাকি? ম্যাজিক
পেনটা ফিরে পেলি নাকি পেনটা ম্যাজিক ফিরে পেল?”
“না গো দাদু। ওটা ওই পেনটাই ছিল না।
কুশল, আমার
ক্লাসমেট,
আমার পেছনের বেঞ্চেই বসে… ওই নিয়েছিল পেনটা। ওটার বদলে একটা
পাতি পেন ভরে দিয়েছিল আমার বক্সে,” এক নিঃশ্বাসে বলে গেল সায়ন।
“কী করে বুঝলি তুই?”
“তোমার ওই গল্পটা থেকে। ওটা শোনার পর
থেকেই মনে হচ্ছিল কেউ যদি ঐ ব্রাহ্মণের ম্যাজিক পাথর আর জাঁতার মতো আমার পেনটাকেও
বদলে দিয়ে থাকে?
সেই ভেবেই আমি একটা প্ল্যান করলাম। দিদিভাই-এর কাছে একটা ইঙ্ক ইরেজার আছে। যে
কোনো পেনের কালি দারুণ মোছা যায় ওটা দিয়ে। ওটা আমি দিদিভাই-এর কাছ থেকে চেয়ে কাল
স্কুলে নিয়ে গেছিলাম। আগের দিনের মতোই সবাইকে ওটা দেখিয়ে বক্সে ঢুকিয়ে রেখে দিলাম।
তারপর ছোটো টিফিনের সময় ক্লাসরুমের বাইরে গিয়ে জানলার পেছন থেকে খেয়াল রাখছিলাম কেউ
বক্সে হাত দেয় নাকি। আর জানো কী দেখলাম, কুশল চুপি চুপি আমার পেন্সিলবক্স
খুলে ইরেজারটা বের করে নিজের একটা পাতি ইরেজারে ওর খাপটা পরিয়ে বক্সে রেখে দিতে
যাচ্ছিল। ব্যস, হাতেনাতে ধরলাম। আর যাবে কোথায়! হেড স্যারের
কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতেই ভ্যাঁ করে কেঁদে দিল। সঙ্গে সঙ্গে আমার ম্যাজিক পেনটাও
ব্যাগ থেকে বের করে দিল।”
জাদু কলমের উদ্ধার বৃত্তান্ত
শুনে হাসি ফুটে উঠল কেশব মুখুজ্যের মুখে। যাক! তার গল্পটা
বলার উদ্দেশ্য সফল হল। ম্যাজিক মিস্ট্রির সমাধান হল।
সায়ন দাদুকে আরও অনেকবার
ধন্যবাদ জানিয়ে পড়তে চলে গেল। কেশববাবু খবরের কাগজটাকে ভাঁজ করে টেবিলের উপর রেখে
গল্প খাতাটা টেনে নিলেন।
রবিবার আসতে মোটেই দেরি নেই, তার
আগে নতুন একটা গল্প লিখে ফেলতে হবে তো!
----------
ছবি – সপ্তর্ষি চ্যাটার্জি
No comments:
Post a Comment