![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEjKTkkkOKhHz41uy9DiHy6-6EtpZgKiC784DlaTtbJydb_rOY99K113Uc0dlO1YbEdT4evtFI74txnalksBXVrQhoFhjOFQe02f-QDXsPVXq1QZfeCcIqhgZjziCw5oNQP8lki8Z1m7bI5IvV3qQm5g1C3TA8N1zWRuxxDspe9Mj2Qyk_Iide4eJTXy6Q/w480-h640/Puchai%20Sukanta%20Mandal.jpeg)
পুচাই নিখোঁজ
মৃত্যুঞ্জয় দেবনাথ
পুচাই নিখোঁজ!
শুনেই চমকে উঠলাম সকলে! বসে
চা-শিঙাড়া খাচ্ছিলাম আমরা। সঙ্গে গল্পগাছা। প্রথমে আমরা ছেলেরা ক-জন। পরে এসে যোগ
দিল মহিলাবাহিনীও। জমে উঠেছিল আসর। হাসিমজার আধিক্য ক্রমে পঁয়ষট্টি ডেসিবেলের
মাত্রা ছাড়াচ্ছিল বই-কি। সংবাদটা আছড়ে পড়তে গোটা বাড়ি স্তব্ধ।
ছুটতে-ছুটতে এসে কথাটা বলল
বিট্টু।
ওর বড়দা। পুচাই আমার মেজো
শ্যালিকা ফুলুরানির কনিষ্ঠপুত্র। সংবাদটা জানিয়েই বিট্টু ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে রয়েছে
আমাদের দিকে। আমরা হতভম্ব।
আমি তড়াক করে উঠে দাঁড়ালাম।
ভুরু-কপাল কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী বলছিস? কোথায় গেল পুচাই? একসঙ্গেই তো খেলছিলি সবাই!”
“হ্যাঁ তো। এখন খুঁজে পাচ্ছি
না,” হাঁপাচ্ছে বিট্টু।
“কী আশ্চর্য! ছুটোছুটি করছিলি
যে একটু আগেও!”
“হ্যাঁ, খেলছিলাম
তো। লুকোচুরি।”
“তারপর?”
“হঠাৎ দেখি আর নেই।”
“নেই মানে! এ কেমন কথা? ভোজবাজি!
উবে গেল? কর্পূর
নাকি!”
বিট্টু বোবা।
“স্ট্রেঞ্জ! কোন্ জায়গা থেকে
নিখোঁজ হয়েছে ও, তাই
বল না রে?” আমি অস্থির
হয়ে উঠি।
“ওই যে, সামনের
গলিটা থেকে,” উত্তর দিকে আঙুল দেখায় বিট্টু, “চলো, দেখবে।”
আমরা দলবেঁধে ওর সঙ্গ নিলাম।
পুচাই যে-গলিটা থেকে আচমকা
নিরুদ্দেশ হয়ে গেল, সেখানে
এসে দাঁড়িয়েছি সকলে। আমাদের চোখেমুখে উৎকণ্ঠা। শ্যালিকা ফুলুরানি সানাইয়ের
পোঁ-ধরেছে ততক্ষণে।
সত্যিই অবিশ্বাস্য ব্যাপারটা!
কোথায় চলে গেল ছেলেটা! গলি
ধরে দূরের বড়ো রাস্তার দিকে নয় তো? কিংবা অন্য কোনো অলিগলির গোলকধাঁধায়
পড়ে আর বেরোতে পারছে না। ঘূর্ণির মতো একই আবর্তে পাক খাচ্ছে। স্ট্রেঞ্জ! তেমনটি
হলে কী করবে ও? ফিরতে
পারবে আর? কেমন
করে বা খুঁজে পাব আমরা ওকে?
বয়সে-অবয়বে এইটুকুনি পুচাই।
কিন্তু স্বভাবে যারপরনাই চঞ্চল। একমুহূর্ত শান্ত থাকতে জানে না সে। সর্বদা ছটফট, ঘুরঘুর, হইহল্লা আর
লম্ফঝম্পে মেতে আছে ও। একবার আমাদের কলকাতার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েও বড়ো বিপদ
ঘটিয়েছিল ব্যাটা। মনে পড়লে এখনও গা শিরশিরায় আমার। সেই থেকেই মনেপ্রাণে বিশ্বাস
করতে শুরু করেছি যে,
বাপ-মা মিথ্যে বলে না ওর সম্পর্কে। ওটি প্রকৃতই আস্ত ‘হনুমান’ একটি।
সেবারেও ছিল লুকোচুরির কেস।
আমাদের পাপাই আর ওরা দু-ভাই
মিলে লুকোচুরি খেলছিল অ্যাপার্টমেন্টের নীচের গ্যারেজে। পরে এসে যোগ দিয়েছিল পাশের
বাড়ির অনলদার ছেলে ঘন্টু,
কচি, লকাইরা।
নীচেই ছুটোছুটি, হইচই
করছিল চার-পাঁচজনে - উপরে বসেও শুনছিলাম আমরা। হঠাৎই নীচে একটা বাড়তি শোরগোল শোনা
গেল। তড়িঘড়ি জানালায় মুখ বাড়াতে জানলাম, পুচাই নিরুদ্দেশ।
উপর থেকে প্রায় লাফিয়ে নামলাম
আমরা সবাই।
তারপর চলতে থাকল পুচাই
অনুসন্ধানপর্ব। প্রথমে আমাদের বিল্ডিং-এর চতুর্পাশ ঘেঁটে ফেললাম। বাদ রাখলাম না
গা-ঘিনঘিন করা সেপটিক ট্যাঙ্কের দিকটাও। অ্যাপার্টমেন্টের পেছনের দিকগুলি নিয়মিত
পরিষ্কারের অভাবে আগাছার বাড়বাড়ন্ত হয়েছে খুব। হঠাৎই মনে হল, ওই দিকটাতে
লুকিয়ে নেই তো বিচ্ছুটা?
বিশ্বাস নেই ওকে,
সঙ্গীদের ভয় খাওয়ানোর খেলা খেলছে হয়তো বা।
না, সেখানে কোনো
চিহ্ন নেই ওর। একবার নয়,
কয়েকবার ঘুরেফিরে দেখছি আমরা সকলে। সত্যিই ম্যাজিকাল ব্যাপারটা। কোথায় উবে গেল
ছেলেটা!
“সেপটিক ট্যাঙ্কটা খুলে দেখলে
হয় না?” আচমকা বলে
উঠলেন ভাস্করদা। উদ্বেগ ওঁর চোখেমুখে।
“য়্যাঁ, সেপটিক
ট্যাঙ্ক!” শুনে চমকে উঠি আমি, “ওখানে কী হবে? ওখানে ঢুকবে কেমন করে ও? তা ছাড়া
সেপটিক ট্যাঙ্ক ঢাকনা দেওয়া। লোহার পিট। ভাঙাচোরাও নয় যে, পা হড়কে গলে
যাবে ভেতরে।”
“তবু?”
আমি ভাস্করদার অসহায় মুখটির
দিকে তাকিয়ে হার মানলাম। ঘর থেকে ছোটো শাবলটা নিয়ে এসে সেপটিক ট্যাঙ্কের ঢাকনা
খুললাম। কিন্তু পুচাই ওখানে থাকবে কেন?
এরপর পাশের পুকুরের দিকে
ছুটছিলাম। বিট্টুদের কথায় থামলাম। বিল্ডিং-এর মেইন গেট বন্ধ রয়েছে অনেকক্ষণ। ওরা
সবাই ভেতরেই খেলছিল। কেউ বাইরে যাওয়ার প্রশ্নই নেই।
তবে পুচাই? রয়েছে এই
অ্যাপার্টমেন্ট চত্বরেই?
কিন্তু কোথায়?
নীচের গ্যারেজের ধূলিকণাটি
পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ শেষ করে, একে-একে গোটা ‘রূপকথা অ্যাপার্টমেন্ট’-এর বারোটি
ঘর চেক করে; শেষে
গিয়ে উঠলাম ছাতে। কিন্তু ছাত অবধি এগোতে পারিনি তখনও। চিলেকোঠা ঘরের দিকে তাকিয়ে
চক্ষুস্থির আমার। চিলেকোঠার আবছা অন্ধকারেও স্পষ্ট দৃশ্যমান - দেয়ালের এক কোণে
দাঁড়িয়ে আছে পুচাই। মনে হল,
ঘেমেনেয়ে একশা ও। ওর ভয়ার্ত চাহনি। কিন্তু
স্ট্যাচু ও। প্রস্তরবৎ।
“কী রে, পুচাই, তুই এখানে!”
প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম আমি।
ও আমার দিকে ভয়ার্ত চাহনি
মেলে তাকিয়ে। ও নিরুত্তর। ও আঙুল তুলে কিছু একটা ইঙ্গিত করছে যেন আমায়।
“কী হয়েছে? বেরিয়ে আয়? সবাই
খুঁজে-খুঁজে হন্যে তোকে।”
পুচাই তখনও নিরুত্তর। বোবা।
এবারে ও যেন কাঁদছে। অথচ শব্দ বেরুচ্ছে না মুখ থেকে। সামনের দেয়ালের দিকে আঙুল
দেখাচ্ছে ও।
ততক্ষণে আমার নজরে এল ভয়ংকর
ব্যাপারটা।
চিলেকোঠা ঘরে ঢোকার মুখের
দেয়ালটায় একটি সাপ লেপটে আছে। ভাস্করদা আর্তনাদ চেপে ফিসফিসিয়ে উঠলেন, “চন্দ্রবোড়া!”
আমি আঁতকে উঠলাম। বিষধর সাপ
যে! হে ভগবান! এখানে এসে বাসা বেঁধেছে?
আর কথা বাড়ালাম না কেউ। আকারে-ইঙ্গিতে
তেমনই স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে বললাম পুচাইকে। এর-ওর ঘর থেকে চলে এসেছে ততক্ষণে
দু-একটি লাঠিসোটা। কিন্তু অমন দুঃসাহসিক কাজটি করবে কে? আঘাত ফসকালে
যে সাপটি পুচাইয়ের দিকেই ছুটবে!
লাঠি হাতে এগোতে থাকলেন
ভাস্করদা।
গাঁ-গঞ্জে থাকার সুবাদে
এ-কাজে তিনি সিদ্ধহস্ত;
অন্তত উপস্থিত আমরা আরও ক-জন গোবেচারা শহুরে ফ্ল্যাটবাসীর তুলনায়। কিন্তু
দু-পা সামনে এগোতেই বুঝি টের পেল সাপটি। একটু নড়ে উঠল। মাথাটাও ঘোরাল এদিক-ওদিক।
এরপরই হয়তো অন্যদিকে ঘোরার জন্যই প্রস্তুত হচ্ছিল। তার আগেই ভাস্করদার লাঠি পড়ল
সটান ওর মাথায়।
মেঝেয় পড়ে ভয়ংকর ছটফটাচ্ছিল
সাপটি। কিন্তু আঘাতটা এতই জোরালো ছিল যে, ও চলচ্ছক্তি হারিয়েছে। তার উপর
ভাস্করদা আরও ক-টি লাঠির বাড়ি কষালেন। সাপটি নিষ্প্রাণ নিথর হলে আমি হাতে ধরে
পুচাইকে ভেতর থেকে বার করে আনলাম।...
কিন্তু এবার কী হবে? এলাকাটা যে
একেবারেই অচেনা-অজানা আমাদের। আমরা এখানে বেড়াতে এসেছি। বড়ো শ্যালক তপনদার সঙ্গে। ওর
শ্বশুরবাড়ি। অনেক দিন থেকেই বলছিলেন গোপাবউদি। আজই সবাই দলবেঁধে চলে এলাম। দুপুরে
মস্ত খাওয়াদাওয়া হল। সঙ্গে আনন্দ হইহুল্লোড়। কিন্তু এখন সকলেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।
অনেকের চোখেই জল। আহা রে! পুচাই কোথায় হারিয়ে গেল?
এলাকাটার নাম সোমড়া। পাড়া, বীরপুর।
একটা ক্রমবর্ধিষ্ণু গ্রাম। অচিরেই শহরতলির তকমা পাবে জায়গাটি। অলিগলির শেষ নেই
পাড়াটায়। তেমনি সামান্য এগোলেই বড়ো রাস্তার মোড়। গাড়িঘোড়া, বাজারহাট, স্কুলকলেজ, থানা-পোস্টঅফিস
সব নিকটবর্তী। তপনদা নিরাশকণ্ঠে বললেন, “ভয়টা এখানেই। কোন্ ভুল গলিতে ঢুকে
কোথায় গিয়ে উঠবে, তার
ঠিকঠিকানা নেই। কী যে হবে!”
আমরা হনহনিয়ে হাঁটছি
পুবে-পশ্চিমে, উত্তরে-দক্ষিণে।
কেউ তপনদাকে অনুসরণ করছি; কেউ
গোপাবউদির পেছন-পেছন। আধা ঘণ্টা-পঁয়তাল্লিশ মিনিট চষে বেড়ালাম আমরা বীরপাড়া।
অবশেষে অন্য একটি পাড়াতে গিয়েও ঢুঁ মারলাম। তপনদা বললেন, “এটির নাম
বিষপাড়া। ক-বছর আগেও বনজঙ্গলে ভরা ছিল জায়গাটা। বিষধর সাপেদের আস্তানা ছিল। দু-এক
ঘর সাপুড়ে এসে বাসা বাঁধল এখানে প্রথম। ক্রমে আরও অনেকে। পাড়ার নাম হয়ে গেল ‘বিষপাড়া’।” গলির
ভেতরে ঢুকে পুচাইয়ের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করলেন তপনদা। না, হ্যাঁ-সূচক
উত্তর দিতে পারল না কেউই।
অমনি এল একটি ফোন।
আমার মোবাইলে। নম্বরটি আননোন।
সবুজ বোতাম টিপে ‘হ্যালো’ বলতে ফোনের
ও প্রান্ত থেকে অবিশ্বাস্য একটি প্রশ্ন করল অচেনা কণ্ঠস্বরটি।
“হ্যালো, আপনি কি
বলরামবাবু? পুচাই
নামের কেউ আছে আপনাদের?
মিন্স আত্মীয়?”
আমি লাফিয়ে উঠি। বলি, “হ্যাঁ তো, আছে! আপনি
কে? কোথায়
ও?”
এত কথার উত্তর দিলেন না
লোকটি। অন্য প্রশ্নে গেলেন। “আপনি ওর কে হন?”
“আমি ওর মেসো হই। ও কোথায়, দাদা?”
“আমার কাছে।”
“আপনার কাছে! মানে! আপনি কে? ও কোথায়?” বুলেট ট্রেনের
গতিতে প্রশ্ন করি আমি।
লোকটি ততটাই স্থির। এহেন চরম
মুহূর্তেও মজা করলেন কিঞ্চিৎ। বললেন, “আমি ভগবান। আপনার নিরুদ্দিষ্ট সম্পদ
বর্তমানে আমার হেফাজতে। এক্ষুনি দিনহাটার মোড়ে চলে আসুন।”
ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলাম দিনহাটার
মোড়ের দিকে।
সত্যিই সেখানে ভগবান
দাঁড়িয়েছিলেন আমাদের পুচাইকে বগলদাবা করে। প্রকৃতই লোকটির নাম, ভগবান।
পুচাইকে কাঁদতে দেখে সস্নেহে আগলেছেন ভদ্রলোক। শেষে একাধিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা সেরে
আমার ফোন নম্বরটি উদ্ধার করেছেন। তারপর –
পুচাইকে চোখের সামনে দেখে
অমাবস্যার আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ দেখলাম।
আনন্দে সকলের চোখে জল। কিন্তু
ও ব্যাটা কাঁদছে না। ভয়ার্ত চাহনি ছাপিয়ে যুদ্ধজয়ের হাসি ঠিকরে বেরোচ্ছে ওর
দু-ঠোঁট থেকে। আমি ওর পাশে দাঁড়িয়ে কৃতার্থ বোধ করছিলাম। মনে-মনে বলছিলাম, জগতে একটি
বিরল প্রাণী পাওয়া গেল তবু,
যে কিনা নিজের বাপ-মায়ের চাইতেও এই মেসোটিকে বেশি ভালোবাসে। রুমাল দিয়ে ওর
কপালের ঘাম মুছে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী রে পুচাই, মেসোকে এত্ত
ভালোবাসিস? আমার
ফোন নম্বরটাই মনে রাখলি শুধু! বাবারটা না! মায়েরটাও না!”
বিচ্ছুরাম আমার দিকে
ট্যারাচোখে চেয়ে ফিচেল হেসে বলল, “ধুট্! টা কেন? তোমাল নম্বরতা থবতাইতে থোদা কিনা।
নাইন জিলো ফাইব ওয়ান টু টু থিলি থিলি ফোল ফোল!”
----------
ছবি – সুকান্ত মণ্ডল
No comments:
Post a Comment