প্রকল্প
ভট্টাচার্য
একলা
জানুয়ারি, কুড়িকুড়ি
আজ থেকে
আমি ডাইরি লেখা শুরু করলাম। আজ বছরের প্রথম দিন। মা বলে, প্রথম দিনে যা করা হয়,
সারা বছর সেটা করা যায়। তাই আজ। আগের বছরও আমি বাবার অফিসের নতুন ডাইরি নিয়ে লিখতে
শুরু করেছিলাম, কিন্তু সেটা প্রথম দিন ছিল না। তাই সারা বছর লিখতে পারিনি। বাকি
পাতাগুলোয় ছবি এঁকেছি, আর মা বাজারের ফর্দ লিখেছে।
আসলে
আমার মন খুব খারাপ। এতই খারাপ, যে খুব খারাপ। এখানে আমার কোনও বন্ধু নেই। আগের
পাড়ায় কত্তো বন্ধু ছিল, আর কত্তো গাছ! আমার গাছ খুব ভালো লাগে। তাদের নাম দিই। তাদের চড়ি। আমি গাছে চড়তে পারি।
আমি তালগাছেও চড়তে পারি। বন্ধুরা পারে না, তাই আমার খুব ভক্ত। কিন্তু বাবা চলে এল,
বলল ঐ পাড়াটা নাকি ভালো না, গ্রাম গ্রাম। গ্রাম কেন ভালো না সেটা বলল না। মা আর
আমাকে নিয়ে চলে এল। এখানে সব
ঘিজিঘিজি বাড়ি, কিন্তু নাম অ্যাপার্টমেন্ট। অ্যাপার্ট মানে তো দূরে দূরে! বাবা এখন
অফিসে। রাতে বাবাকে দুটো প্রশ্ন করতে হবে। গ্রাম কেন ভালো না, আর গায়ে গায়ে বাড়িকে
কেন অ্যাপার্টমেন্ট বলে।
দুইলা
জানুয়ারি, কুড়িকুড়ি
ঠিক
করেছি, রোজ বিকেলে ডাইরি লিখব। সকালে স্কুলের তাড়াহুড়ো। নতুন স্কুল, খুব চুপচাপ
থাকতে হয়। কেউ কথা বলে না। আমার সঙ্গে। খেলার জন্য একটা পিরিয়ড আছে, তাকে বলে
পিটি। স্যার একজন খেলা শেখায়। নিজের মতো খেলা যায় না। বাজে স্কুল। বিকেলে বাড়ি
ফিরে ডাইরি লিখব। কিন্তু কী লিখব এখনও ঠিক করিনি। মা বলে, যা যা হয়েছে তাই লিখবি।
কিন্তু এখানে কিছুই তো হয় না! শুধু আমার মনখারাপ হয়। তাহলে সেটাই লিখি। গাছ নেই।
বন্ধু নেই। বাবা এখনো বলেনি গ্রাম কেন ভালো না।
তিনলা
জানুয়ারি, কুড়িকুড়ি
আজ খুব
মজার দিন। বাড়ির পিছনে একটা মেজ গাছ খুঁজে পেয়েছি। মেজ নয় মাঝারি। তবে চড়া যায়।
চড়েছি, তারপর আরও মজা! আমায় গাছে চড়তে দেখে একজন বলল, ‘বাঃ, তুমি তো ভালো গাছ
বাইতে পারো!’ আমি ভাবলাম বলি যে গাছ তো বায় না, নৌকো বায়। কিন্তু দেখলাম রোগামতো
লোকটা। তাই কিছু বলিনি। শুধু হেসেছি। নেমে এসে বলেছি, ‘তোমার নাম কী?’ লোকটা এদিক
ওদিক দেখে চুপিচুপি বলল, ‘কারোকে বোলো না, আমার নাম স্পাইডারম্যান!’ আমি হেসে ফেলে
বললাম, ‘ধ্যাত, সে তো বিদেশে থাকে, আর তার আসল নাম তো পিটার পার্কার!’ লোকটা বলল,
‘ঐ, ঐ আমার আসল নাম। আমি পালিয়ে এসেছি। এখন এখানেই লুকিয়ে থাকি!’ আমি তাও বিশ্বাস
করিনি। বললাম, ‘কই, তোমার পোষাক? তোমার হাতের স্পাইডার ওয়েব?’ বলল, ‘সব লুকিয়ে
রেখেছি যাতে কেউ চিনে না ফেলে আমায়! তবে আমি প্রমাণ দিতে পারি।’ এই না বলে সামনের
দেয়ালটার খাঁজে পা দিয়ে দিয়ে তরতর করে চড়তে লাগল! ব্যস, আমার আর কোনও সন্দেহ রইল না
যে ও সত্যিই স্পাইডারম্যান! তবু বললাম, “তুমি এখানে লুকিয়েছ কেন?” বলল, “ঐ ডক্টর
অক্টোপাস আমার পিছু নিয়েছে। অন্য বন্ধুরা ধারেকাছে নেই। তাই লুকিয়ে আছি। এখানে
থাকার সুবিধা হল, এখানে কেউ কোনও কথা বিশ্বাস করে না। তাই আমি স্পাইডারম্যান বললেও
কেউ বিশ্বাস করবে না। তাতে আমারই ভালো। ধরা পড়ব না। আর কিছুদিন প্র্যাকটিস করে
নিয়ে লড়াই করতে যাব। আচ্ছা,
তুমি এখন বাড়ি যাও, আমিও লুকোই। কেউ চলে আসতে পারে।” তাই বাড়ি চলে এলাম। মা কে
বললাম, মা জানো, আমাদের বাড়ির পিছনে স্পাইডারম্যান থাকে। মা বিশ্বাস করল না। বলল
ওদিকে যাস না, যদি মাকড়শা কামড়ে দেয়। স্পাইডারম্যান ঠিকই বলেছে। এখানে কেউ কিছু বিশ্বাস করে না।
তাই আমিও আর কারোকে বলব না। লোকটা সত্যি স্পাইডারম্যান না হলেও, গাছে চড়তে ভালোবাসে,
আমার সঙ্গে অনেক কথা বলেছে। তাই বন্ধু। তাই কম কীসের!
চারলা
জানুয়ারি, কুড়িকুড়ি
আজ আমার
খুব আনন্দের দিন। স্পাইডারম্যানদা বলেছে আমাকে তার অ্যাসিস্ট্যান্ট করবে! বলেছে,
ব্যাটম্যানের যেমন রবিন, তেমন আজ থেকে স্পাইডারম্যানের সঙ্গে বাবিন! আমার নাম যদিও
বাবুন, তবে একটু বদলে বাবিন হয়ে গেলে ভালোই হয়। বলেছে আমাকে আমেরিকা নিয়ে যাবে।
তবে তার আগে এখানে কিছু মিশন আছে। কী মিশন তা বলেনি। আমাকে ট্রেনিং দেবে। দেয়াল
চড়াকে দেয়াল বাওয়া বলে। দেয়াল বাইতে শেখাবে। আমি আজ একটু পেরেছি, কাল পুরো পারব। হাতে আর কাঁধে ব্যথা হয়েছে, তাই
বেশি লিখছি না আজ।
পাঁচলা
জানুয়ারি
ইয়েয়েয়েয়ে
আমি দেয়াল বাইতে শিখে গেছি। আজ দোতলা ছাড়িয়ে তিনতলার কার্নিশ অবধি পৌঁছে গেছি।
স্পাইডারম্যানদা রোজ বিকেলে আসে, আমাকে শেখাতে। পুরো শিখে গেলেই আমি
অ্যাসিস্ট্যান্ট। আরও একদিন লাগবে নাকি। চারতলা অবধি বাইতে হবে। জলের পাইপে পা
দিয়ে উঠতে হয়। খুব সহজ। কিন্তু লুকিয়ে বাইতে হয়। কেউ দেখলে পড়ে যেতে পারি। তাই আজ
রবিবার হলেও সকালে প্র্যাকটিস করতে পারিনি। কাল আমার টেস্ট নেবে বলেছে। চারতলা
অবধি বাইতে হবে। বাবা বলে, টেস্টের আগে খুব প্র্যাকটিস করতে হয়, কিন্তু এই টেস্টের
আগে প্র্যাকটিস করা যাচ্ছে না। বিকেল না হলে স্পাইডারম্যানদাও আসে না। আজ তাড়াতাড়ি
ঘুমিয়ে পড়ি। কাল যেন টেস্টে পাশ করে অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে যেতে পারি!
ছয়লা জানুয়ারি
আজ খুব
খারাপ দিন। স্পাইডারম্যানদা ধরা পড়ে গেছে। আমি স্কুল থেকে ফিরে জামাকাপড় বদলে যেই
নিচে যাচ্ছি, দেখি আশেপাশের অনেকগুলো কাকু বাড়ির পিছনে! তাদের সামনে
স্পাইডারম্যানদা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখে এক কাকু বলল, “তুমি ওদিকে যেও না।
ও লোকটা চোর। দেয়াল বেয়ে চারতলায় উঠে জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকতে গেছিল, ধরা পড়ে গেছে।”
আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। আমাদের আগের পাড়ায় একটা চোর ধরা পড়েছিল, তাকে সবাই খুব
মারছিল। ভয়ে ভয়ে বললাম, “কাকু, তোমরা কি ওকে মারবে?” কাকু একটু চুপ করে থেকে বলল,
“না, মারব না, তবে পুলিশে দেব। চুরি করা অন্যায়, জানো তো? এখন বাড়ি যাও।” বাড়ি ফিরে মাকে বললাম, পুলিশ কি চোরদের খুব
মারে? মা বলল, না, তবে জেলখানায় আটকে রাখে। তাও ভালো। মারবে না। জেলখানা থেকে
স্পাইডারম্যানদা ঠিক পালিয়ে যাবে, জানি। কেউ ওর আসল নাম না জানলেই ভালো। আমার
টেস্টটা হল না। ও পালিয়ে এসে আমাকে অ্যাসিস্ট্যান্ট বাবিন করে নেবে। তারপর দু’জনে
মিলে মিশনে বেরোব।
আর
ডাইরি লিখতে ভালো লাগছে না। আগে স্পাইডারম্যানদা ফিরে আসুক। আবার মনটা খারাপ
হচ্ছে।
শিশুমনের সরল বিশ্বাস আর পাকা মাথার সন্দেহ। দোলাচলে রেখে গেল গল্পটা। পাঠককে ভাবাবে।
ReplyDelete