বিজ্ঞান:: টাইম ট্র্যাভেলের আশ্চর্য গল্প - অমিতাভ সাহা

টাইম ট্র্যাভেলের আশ্চর্য গল্প
অমিতাভ সাহা

টাইম ট্র্যাভেল কথাটার সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত এবং এটা খুব ইন্টারেস্টিং ব্যাপারহলিউডে এই কনসেপ্ট নিয়ে অনেক মুভি তৈরি হয়েছে। কার না মন চায় অতীতে ফিরে গিয়ে ছোটোবেলার সুন্দর দিনগুলি আবার উপভোগ করতে অথবা ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা আগে থেকেই জেনে নিতে। কিন্তু এটা কি বাস্তবে সম্ভব?
বিজ্ঞানীরা বলেন, টাইম ট্র্যাভেল সম্ভব। একটা সময় পর্যন্ত মানুষের ধারণা ছিল, সময়ের উপর আমাদের কারও নিয়ন্ত্রণ নেই এবং গোটা ইউনিভার্সে সময় সবার জন্য সমান, পৃথিবীতে ১ সেকেন্ড আর মঙ্গল গ্রহে ১ সেকেন্ড সমান। সময় একটি ধ্রুবক (Constant) গতিতে নিরন্তর ৬০ সেকেন্ডে ১ মিনিট, ৬০ মিনিটে ১ ঘন্টা আবার ২৪ ঘণ্টায় ১ দিন এভাবে অতিক্রান্ত হয়ে চলেছে।
কিন্তু ১৯০৫ সালে আইনস্টাইনের “থিওরি অফ রিলেটিভিটি” প্রকাশিত হবার পর এই ধারণা পালটে যায়। এই থিওরি অনুযায়ী মহাকাশ এবং সময় একে অপরের সঙ্গে যুক্ত, যাকে স্পেস-টাইম (Space-Time) বলা হয়। সময় হচ্ছে ফোর্থ ডাইমেনশন (দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতার পরে) এবং এর গতি বাড়ানো বা কমানো যেতে পারে। সময় এই ইউনিভার্সে একটি নদীর মতো বয়ে চলেছে। নদীতে যেমন কোনও স্থানে জলের গতি কম, আবার কোথাও বেশি, তেমনিভাবে এই ইউনিভার্সের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে সময় ভিন্ন গতিতে চলে
আইনস্টাইনের থিওরি অনুযায়ী যদি কোনও বস্তু বেশি গতিতে চলে, তাহলে তার সাপেক্ষে সময় ধীর গতিতে চলবে। যখন আমরা উচ্চ গতিসম্পন্ন বিমানে ট্র্যাভেল করি, তখন পারিপার্শ্বিক জগতের সাপেক্ষে সময় আমাদের কাছে ধীর গতিতে চলে। কিন্তু সময়ের এই পার্থক্য এত নগণ্য, যে তা অনুধাবন করা মুশকিল। সময়ের এই পার্থক্য বুঝতে হলে আমাদের গতিবেগ আলোর গতিবেগের সমান বা তার ৯৫% হতে হবে।
স্টিফেন হকিং এই থিওরি’কে এগিয়ে নিয়ে যান। তিনি কল্পনা করেন, গোটা পৃথিবীকে বেষ্টন করে একটি রেলওয়ে ট্র্যাক বানানো হল এবং আলোর গতিতে সেই ট্র্যাক বরাবর ট্রেন চালানো হল। যদি ট্রেনটিকে আলোর গতিতে চালানো হয়, তাহলে ট্রেনের যাত্রীদের কাছে সময় ভীষণ মন্থর গতিতে চলবে। কিন্তু ট্রেনের ভেতরের সাপেক্ষে বাইরের পৃথিবীতে সময় অনেক দ্রুত গতিতে অতিক্রান্ত হবে। এক সপ্তাহকাল ট্রেন যাত্রা করার পর ট্রেনটি যখন থামবে এবং যাত্রীরা পৃথিবীতে নামবেন, তখন দেখতে পাবেন পৃথিবীর ৬৫ বছর সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। তারা নিজেদেরকে ভবিষ্যতের দুনিয়ায় পাবেন। কিন্তু একটি ট্রেনকে আলোর গতিতে চালানোর জন্য  E = mC2 সূত্র অনুযায়ী অসীম শক্তির প্রয়োজন হবে, যা আমাদের পুরো ইউনিভার্সেও নেই। কেননা কোনও বস্তুকে আলোর গতিতে চালাতে হলে তাকে ভরহীন হতে হবে। সুতরাং, এই থিওরি’র বাস্তব প্রয়োগ সম্ভব নয়। তবে এটা ঠিক যে, টাইম ট্র্যাভেল সম্ভব। পরীক্ষামূলকভাবে টাইম ট্রাভেল করে দেখানো হয়েছে, তাতে সামান্য ন্যানো সেকেন্ড পেছনে ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়েছে, যা একেবারেই নগণ্য তাই টাইম ট্রাভেল করার যন্ত্র বা টাইম মেশিন আজও সায়েন্স ফিকশন হয়েই রয়ে গেছে, যা বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি বা হবে বলে মনে হয় না।
কিন্তু এই রহস্যময় পৃথিবীতে প্রাকৃতিকভাবেই অনেক টাইম ট্র্যাভেলের ঘটনা ঘটেছে, যার কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেইকিছু মানুষ বিভিন্ন সময়ে অপ্রত্যাশিতভাবেই টাইম ট্রাভেল অনুভব করেছেন। দু’একটা ঘটনা এখন বলব।

ঘটনা ১
১৯৫৪ সালে একটি প্লেন জাপানের এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করেছিল। প্লেন থেকে এক যাত্রী নেমে এয়ারপোর্ট থেকে বাইরে বেরোচ্ছিলেন। বেরোনোর সময় এক জায়গায় পাসপোর্ট চেকিং হচ্ছিল। ওনাকে দেখে মনে হচ্ছিল, উনি কোনও বিজনেস ট্রিপে এসেছিলেন। যখন উনি অফিসিয়ালদের পাসপোর্ট দেখালেন, তখন তাঁরা দেখলেন, ঐ ব্যক্তির পাসপোর্ট “টরেড” নামক একটি ইউরোপিয়ান দেশের। বাস্তবে “টরেড” নামের কোনও দেশের অস্তিত্বই নেই। লোকটির পাসপোর্টে সমস্ত এন্ট্রি এবং স্ট্যাম্প চেক করে দেখা গেল সেগুলি একেবারে সঠিক এবং ঐ ব্যক্তি বলেছিলেন, তিনি গত পাঁচ বছর ধরে জাপানে ব্যাবসার কাজে যাওয়াআসা করছেন। তখন অফিসিয়ালরা ওনাকে একটি ম্যাপ দিয়ে বললেন, “তোমার দেশটি কোথায় আছে দেখাও উনি ম্যাপে ফ্রান্স এবং স্পেনের মাঝামাঝি একটা জায়গা দেখিয়ে বললেন, “এখানেই আমার দেশ ‘টরেড’ ওনার কাছে একটি লাইসেন্সও ছিল, যাতে দেশের নাম লেখা ছিল টরেড।

চিত্র ১ ।। যাত্রী দ্বারা ম্যাপে চিহ্নিত টরেড দেশের অবস্থান

এরপর অফিসিয়ালরা ওনাকে একটি হাই সিকিউরিটি হোটেল রুমে পাঠিয়ে দিলেন এবং পরদিন সকালে আরেকবার ইন্সপেকশনের পর ওনাকে ছেড়ে দেওয়া হবে বললেনপরদিন সকালে যখন অফিসিয়ালরা হোটেলে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এলেন, তখন ঐ ব্যক্তিকে হোটেল রুমে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। সারারাত সিকিউরিটি গার্ডরা ঐ ব্যক্তির উপর নজরদারি করছিলতা সত্ত্বেও ঐ ব্যক্তি উধাও হয়ে গেলেন এবং আশ্চর্যের ব্যাপার হল, ওনার যে ডকুমেন্টগুলো পুলিস অফিসারদের কাছে রাখা ছিল, সেগুলিও উধাও হয়ে যায়। এই ঘটনাটি একটি রহস্য হয়েই রয়ে গেছে। ধারণা করা হয়, ঐ ব্যক্তি হয়তো ভবিষ্যৎ থেকে এসেছিলেন। ভবিষ্যতে কয়েকশো বছর পরে হয়তো “টরেড” নামক কোনও দেশ হবে, যেখান থেকে ঐ ব্যক্তি টাইম ট্র্যাভেল করে এসেছিলেন শুধু দেখার জন্য যে অতীত কেমন ছিল।

ঘটনা ২
২০০৬ সালে সীন নামের একটি চোর ইংল্যান্ডের লিভারপুলের একটি দোকান থেকে কিছু জিনিস চুরি করে পালাচ্ছিল এবং সিকিউরিটি গার্ড ওকে তাড়া করছিল। দৌড়োতে দৌড়োতে হঠাৎ সীনের বুকে ব্যথা শুরু হয়। ওর মনে হচ্ছিল বেহুঁশ হয়ে যাবে এবং ও মাটিতে বসে পড়েছিলকিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে ও যখন আবার দৌড়োতে যাচ্ছিল, তখন দেখল, ওখানকার ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট সব বদলে গেছে। সিকিউরিটি গার্ডও নেই। আর রাস্তায় লোকজন পুরোনো আমলের পোশাক পরে ঘুরছিলেন। ও দৌড়ে গিয়ে একটি নিউজপেপারের দোকানে গিয়ে দেখল, ১৯৬৭ সালের পেপারযে সিকিউরিটি গার্ড ওকে তাড়া করেছিল, তাঁকে পরে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে বলেছিল দৌড়োতে দৌড়োতে হঠাৎ রাস্তার মাঝখানে চোরটি গায়েব হয়ে যায়। এই ঘটনার পেছনে ব্যাখ্যাটি হল, ভুল করে টাইম ট্র্যাভেল করে চোরটি ৩৯ বছর পেছনে চলে গেছিল। কিন্তু সৌভাগ্যবশত ও ১৯৬৭ সালে বেহুঁশ হয়ে গেছিল। সৌভাগ্যবশত এই কারণে বললাম যে, ওর যখন হুঁশ এল, তখন ও নিজেকে আবার ২০০৬ সালেই দেখতে পেল। চোর এবং সিকিউরিটি গার্ড দু’জনেই কনফিউজড ছিল, আসলে ওদের সঙ্গে কী ঘটেছিল।

চিত্র ২ ।। সিকিউরিটি গার্ড চোরটিকে তাড়া করার সময় চোরটি হঠাৎ উধাও হয়ে যায়

ঘটনা ৩
১৯৭৯ সালে ইংল্যান্ডের দুই দম্পতি ফ্রান্সে ছুটি কাটাতে গেছিলেন। ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে যখন ওরা ক্লান্ত হয়ে পড়লেন, তখন থাকার জন্য হোটেল খুঁজতে শুরু করে দিলেনখুঁজতে খুঁজতে তারা একটি পুরোনো আমলের হোটেলের সামনে উপস্থিত হলেন। যখন ওরা হোটেলের ভেতর ঢুকলেন, তখন দেখলেন হোটেলের স্টাফ বহু বছর আগে মানুষ যেরকম পোশাক পরতেন, সেরকম পোশাক পরে ছিলেনওরা জিজ্ঞেস করলেন, হোটেলে কোনও রুম খালি আছে কিনা। হোটেল স্টাফ বললেন, কোনও রুম খালি নেই এবং ওদের অন্য হোটেল দেখতে। ঐ হোটেল থেকে বেরিয়ে ওরা যখন পাশে আরেকটি হোটেলে গেলেন, তখন ঐ হোটেলটিও অনেক পুরোনো দিনের হোটেল বলে মনে হচ্ছিল। ভেতরে ঢুকে দেখলেন প্রায় সব কিছুই ভারি কাঠের তৈরি। আধুনিকতার কোনও চিহ্নই সেখানে ছিল না। লাকিলি ওনারা ওখানে রুম পেয়ে গেলেন এবং সারা রাত ঐ হোটেলেই কাটালেন। ওদের ফটোগ্রাফির শখ ছিল। ওরা হোটেলটির অনেকগুলি ছবি তুলেছিলেন এবং অন্যান্য রুমের লোকজন যারা পুরোনো দিনের পোশাকে চলাফেরা করছিলেন, তাঁদের ছবিও তুলেছিলেন।

চিত্র ৩ ।। ফ্রেঞ্চ দম্পতি দ্বারা বর্ণিত হোটেলের ভেতরকার চিত্র

পরদিন ওরা আবার ঘুরতে বেরিয়ে গেলেন, কিন্তু ফেরার সময় দেখলেন, ঐ স্থানে দুটি হোটেলের একটিও নেই। স্থানীয় লোকদের জিজ্ঞেস করে ওরা জানতে পারলেন, ঐ স্থানটি বহু বছর থেকেই খালি পড়ে আছে। অনেক বছর আগে ওখানে একটি হোটেল ছিল, যা অনেকদিন আগেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আশ্চর্য হয়ে ওরা ভাবলেন, হোটেলের ভেতরে যে ছবি তুলেছেন, সেগুলো দেখলে কেমন হয়। কিন্তু ফটো ওয়াশ করার পর ওরা ব্ল্যাঙ্ক ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলেন না। এই ঘটনাটি আজও রহস্যময় হয়ে আছে এবং মনে করা হয় টাইম ট্র্যাভেল করেই ওরা ভুল করে অতীতে পৌঁছে গেছিলেন।

এরকম আরও অনেক ঘটনা আছে। সেগুলি পরে আরেকদিন বলব।

তথ্যসূত্রঃ
1.    ইউটিউব ভিডিও (https://www.youtube.com/watch?v=JHyK0GnAlIk)
2.    ইউটিউব ভিডিও (https://www.youtube.com/watch?v=5PTOn72VTNU&t=629s)
3.    ইউটিউব ভিডিও (https://www.youtube.com/watch?v=DKHxmaBwH1o&t=812s)

_____

No comments:

Post a Comment