দেবদত্তা বন্দ্যোপাধ্যায়
রবিবার সকালে ঘুম ভাঙতেই নাকে
ভেসে এল গোবিন্দভোগ চাল আর খেজুর গুড়ের মিলিত গন্ধ। মা পায়েস
বানাচ্ছে, গতকাল বেশ রাত করেই কুট্টি মামা এসেছে
আমাদের বাড়ি। প্রায় এক বছর পর কুট্টি মামা দেশে ফিরল। লাফ
দিয়ে উঠে পড়লাম। মুখ ধুয়েই ছাদের ঘরে গিয়ে দেখি আমার বোন
রিন্টি আর বড়দার মেয়ে ফড়িং আজ আগেই উঠে পড়েছে। আর কুট্টি
মামাকে নিয়ে জমিয়ে বসেছে।
মামা আমায় দেখে বলল, “আয়, আমাদের দ্বিতীয় পর্বের চা চলছে। তুই
ছিলি না বলে গল্পের ঝুলি খুলিনি এখনও।”
“এবার কিন্তু চিন বা জাপানের গল্প
বলতে হবে কুট্টি দাদু,” ফড়িং মামার কোলেই উঠে পড়ে প্রায়। ডোরেমন
আর সিনচেন দেখে দেখে ও চীন আর জাপানের বাইরে যে আরও দেশ রয়েছে মানতেই চায় না।
ওর চুলটা ঘেঁটে দিয়ে মামা বলল,
“এবার তো ওর কথাই রাখতে হবে। এ দাবি
ওর বহু পুরোনো। আজ তোদের চীনের একটা ঘটনা বলব ভেবেছি। তোরা
মগুইচেং-এর নাম শুনেছিস?”
রিন্টি আর ফড়িং মাথা নেড়ে না বলল। আমি
ঠোঁট কামড়ে ভাবছিলাম জায়গাটা কোথায় হতে পারে।
কুট্টি মামা আমার দিকে ফিরে বলল,
“অত বড়ো পত্রিকা তোকে কী দেখে চাকরি দিল? জেনারেল নলেজে
তো তুই ডাহা ফেল।”
মাথা চুলকে বললাম, “মানে আমি তো
ঐ ভ্রমণের গল্প...”
আসলে আমি একটা বড়ো পত্রিকার অফিসের
ভ্রমণ বিভাগ দেখি। সত্যি লজ্জা করছিল।
“মগুইচেং চীনের জিনঝিয়াং মরুভূমিতে
এক পরিত্যক্ত শহর। আমাদের সাউথের ধনুষ্কোটির মতো, বুঝলি। মগুইচেং
শব্দটার আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায় শয়তানের শহর। এখানের
আশেপাশের গ্ৰামের লোকজন অদ্ভুত সব ঘটনা দেখেছেন বলে দাবি করেন। পর্যটকরা
এখানে বাতাসে দূর থেকে বিভিন্ন আজব আজব সুর ভেসে আসতে শুনেছেন। কখনও
বাচ্চার কান্না আবার কখনও বাঘের গর্জন শুনেছেন কেউ কেউ। কেউ
শুনেছে বাঁশির শব্দ বা মন্দিরের ঘণ্টার ধ্বনি। তবে
এই শব্দের উৎস কেউই এখনও খুঁজে পাননি। এবার
আমি এই শহরে পৌঁছে গেছিলাম।”
বৌদি লুচি, ছোলার ডাল আর পায়েস নিয়ে হাজির। বলল,
“কুট্টি মামা, আমায় ফেলে সব গল্প বলে ফেললে নাকি?”
“আরে সবে শুরু হচ্ছে বৌদি, বসে পড়ো,” বলে আমি একটা খাবারের প্লেট টেনে নিলাম।
সবাইকে খেতে দিয়ে বৌদি ফড়িংকে
নিয়ে গুছিয়ে বসল। ওকে খাওয়ানো একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ। তবে
লুচি পায়েস ওরও প্রিয়। আর সঙ্গে কুট্টি
মামার গল্প থাকলে ওর হাঁ বন্ধই হয় না।
ছোলার ডালে লুচি চুবিয়ে মুখে দিয়ে
কুট্টি মামা বলল, “আঃ, কতদিন পর এই বাড়ির খাবারের স্বাদ পেলাম
রে। ঐ চাউমিন আর মোমো খেয়ে খেয়ে পেটে না চড়া
পড়ে গেছিল আমার।”
আমি এই ফাঁকে গুগল করে মগুইচেং-টা
একটু চিনে নিয়েছি। অন্তত মামা আবার কোনও প্রশ্ন করলে যাতে
কিছু বলতে পারি। যদিও তেমন কিছুই পেলাম না গুগলে।
তৃতীয় লুচি শেষ করে কুট্টি মামা
বলল, “এই পৃথিবীতে এমন অনেক কিছুই আছে বিজ্ঞানে যার ব্যাখ্যা মেলে না, মগুইচেং হল তেমনি এক জায়গা। মরুভূমির
ধারে বাতাসের ক্ষয়ে, আবহবিকারে পাহাড় এমন ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে
যে মনে হয় এ এক পরিত্যক্ত নগর। খুব
কম পর্যটক যায় ঐ অঞ্চলে। আমি গত মাসে
এক বন্ধুর সঙ্গে চলে যাই এই মগুইচেং দেখতে। কিন্তু
ঐ অঞ্চলের আসল রহস্য দৃশ্যপট নয়। হাওয়া
ঐ আবহবিকারে ক্ষয়প্রাপ্ত পাথুরে অঞ্চলের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হলে নানা রকমের আওয়াজ শোনা
যায়। কখনও মনে হয় বাচ্চা কাঁদছে, কখনও বা ঘণ্টার আওয়াজ। অদ্ভুত
ঘটনা হল আমরা যখন গিয়ে পৌঁছেছিলাম, হাওয়া চলছিল না। কিন্তু
একটা মৃদু বাঁশির শব্দ ভেসে আসছিল। আমার
বন্ধু নোহারা বেশিক্ষণ থাকতে চাইছিল না। ওর জায়গাটা
দেখেই কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। ওর পাশের
গ্ৰামে কিছু কাজ ছিল। ও তাড়া দিচ্ছিল
ফেরার জন্য। কিন্তু আমায় ঐ রুক্ষ প্রান্তর থেকে কে
যেন ভীষণভাবে ডাকছিল। আমি নোহারাকে
বললাম, আমি পুরো বিকেলটা ওখানে কাটাতে চাই। শব্দগুলো
আমায় ভীষণ টানছে। ও অদ্ভুতভাবে আমায় দেখছিল। তবে
আমার জেদ সম্পর্কে ওর ধারণা ছিল। ও জানত
আমায় জোর করে সরাতে পারবে না। তাই
বার বার আমায় বলল সূর্য ডুবে যাওয়ার আগে গ্ৰামে ফিরতে। রাতে
ঐ উপত্যকা নাকি জেগে ওঠে। গ্ৰামবাসীরা ভুলেও রাতের বেলায় এদিকে আসে না। বলে
শয়তানের শহরে রাতে থাকলে কেউ বাঁচে না।”
রিন্টি খাওয়া ভুলে হাঁ করে শুনছিল
মামার গল্প। ফড়িঙের খাওয়া প্রায় শেষ। মা আরেক
গামলা গরম লুচি পাঠিয়েছে।
মামা আরও দুটো ফুলকো লুচি নিয়ে
বলল, “হাওয়ার ক্ষয় পাথুরে পাহাড়গুলোকে কী অপূর্ব সব রূপ দিয়েছে না দেখলে বুঝতেই পারবি
না তোরা। আমি ঘুরতে ঘুরতে এমন একটা জায়গায় চলে
এলাম যেখানে চারদিকে মনে হয় কোনও বিশাল প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ। সিঁড়ির
মতো ধাপে ধাপে উঠে গেছে পাথুরে পথ। কোথাও
মনে হয় মন্দির। তখনই শুনতে পেলাম ঘণ্টার ধ্বনি। নাকে
আসল ধূপ অগরু চন্দনের মিশ্র গন্ধ। চীন
দেশেও এসব দিয়ে পূজা হয় ধারণা ছিল না। তবে
প্রাচীন চীনা মন্দিরে ধূপ দীপ জ্বলতে দেখেছি আগেও। ঘণ্টার
ধ্বনি পাহাড়ের খাঁজে বাতাসের বেগের ফলে শব্দের প্রতিফলনে হতে পারে, কিন্তু গন্ধ!! আমি চারদিকে খুঁজেই চলেছি। খেয়াল
নেই কখন সূর্য ডুবে চাঁদ উঠেছে। গোল
রূপার থালার মতো চাঁদ আলোর বন্যায় ধুইয়ে দিচ্ছে চরাচর। হঠাৎ
আমার মনে হল খিলখিল করে হাসির শব্দ শুনলাম। পরক্ষণেই
মনে হল একটি মেয়ে সরে গেল ওপাশে। চুড়ি
আর নূপুরের স্পষ্ট আওয়াজে আমিও ওদিকে ছুটলাম। পা-টা
বোধহয় হড়কে গেছিল একটা ফাটলে। আমি
গড়িয়ে পড়লাম আর মাথাটা কিছুতে ঠুকে গেল। অন্ধকার
একটা পর্দা নেমে এল চোখের সামনে।
“মৃদু মন্ত্রপাঠ আর মিষ্টি সৌরভ
ভেসে আসছে, আবার ঘণ্টার আওয়াজ পেলাম। ধীরে
ধীরে চোখ মেলে দেখি একটা ঘরের ভেতর কাঠের পালঙ্কে শুয়ে রয়েছি। মাথায়
বেশ ব্যথা। সামনের জানালা পথে এক ঝলক আলো আসছে। তবে
কি নোহারা আমায় গ্ৰামে নিয়ে এসেছে? আস্তে আস্তে
নেমে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। পাহাড়ের
গায়ে এ এক মাটি আর পাথরের প্রাচীন গ্ৰাম। মৌমাছির
চাকের মতো ঘরগুলো ঝুলছে থাক থাক হয়ে।
“তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম, শুনশান রাস্তাঘাট, একটা মন্দির
চোখে পড়ল। কাপড়ের খস খস, চুড়ির রিনরিনে আওয়াজ -
কিছু কোলাহল ভেসে আসছে যেন। আমি
পাগলের মতো ছুটতে থাকি এধার ওধার। কিন্তু
এক অদৃশ্য পর্দা সব কিছুকে কেমন আড়াল করে রেখেছে। এ নগরে
সব রয়েছে শুধু প্রাণের চিহ্ন নেই কোথাও। বাড়ি
ঘরগুলো দেখে মনে হচ্ছে একটু আগেও লোক ছিল বোধহয়। কোথাও
টেবিলে ঢাকা খাবার, কোথাও জামাকাপড় মেলা, কোথাও ফুলদানিতে টাটকা ফুল, দোলনা
দুলছে এমন ভাবে যেন কেউ এখনি নেমে গেল। আমি
চিৎকার করি - কেউ কি আছ? আমায় শুনতে পাচ্ছ? প্রতিধ্বনিত হতে হতে আমার স্বর মিলিয়ে যায় মরুভূমির বুকে। শুধু
কিছু ফিসফিস, খস খস ধ্বনি... যেন
কেউ রয়েছে লুকিয়ে।
“আমি ফাঁকা পথ ঘাট বাজারে ঘুরি। কিন্তু
সর্বক্ষণ মনে হয় কেউ আমায় দেখছে, কেউ আমায় লক্ষ
করছে। এ যেন ছোটোবেলায় রূপকথায় পড়া সেই নগর
যেখানে সবাইকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল এক ডাইনি বুড়ি। কিন্তু
এখানে তো সেই ঘুমন্ত লোকগুলোকেও দেখতে পাচ্ছি না। কেমন
এক গভীর অবসাদ পেয়ে বসে আমায়। একটা
বাড়ির সামনের চাতালে বসে আমি মনে মনে বলি - কেউ কি নেই এ নগরে? বাতাস বয়ে যায় হু হু করে আর আমার কানের কাছে কে যেন ফিসফিস করে
বলে আমি আছি ... আমি আছি।
“পূর্ণিমার চাঁদ তখন মধ্য গগনে, কানে আসে এক নারীর কান্না। শিশুদের
ভয়ার্ত চিৎকার। আমি সেই কান্না লক্ষ করে উপরে উঠতে থাকি। পাহাড়ের
মাথার কাছে একটা পাথরের ঘর। মনে
হয় ওখানেই রয়েছে সেই কান্নার উৎস। আমি
দ্রুত উঠে যাই সেখানে। ঘরটার দরজা জানালা
বন্ধ। আমি আবার চিৎকার করে ডাকি - কে তুমি?
আমায় দেখা দিচ্ছ না কেন? হাওয়ার বেগ তীব্র
হতে হতে ঝড় হঠে। ধুলোর ঝড়। মনে
হয় সে ঝড়ে সব ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি
প্রাণ বাঁচাতে ঐ পাথরের ঘরের দরজা ধাক্কাই। কাঠের
শক্ত দরজা কেঁপে কেঁপে ওঠে, হঠাৎ দরজাটা
খুলে যায়। অন্ধকারে একটা হাত আমায় টেনে ঢুকিয়ে নেয়
ঘরে।
“একটা চর্বির প্রদীপ জ্বলছে মেঝের
এক কোণে। একটি মেয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কেঁদে
কেঁদে ওর চোখ ফুলে গেছে। জংলি লতাপাতা
আঁকা একটা সিল্কের পোশাক পরা সুন্দরী মেয়েটা একটু অবাক হয়েই আমার দিকে চেয়ে রয়েছে।
“হঠাৎ মেয়েটা বলল, ‘নি চিয়াও সেম্মা
মিংঝ?’ এর অর্থ তোমার নাম কী? ভাগ্যিস
চিনের এই ভাষাটা অল্প স্বল্প জানতাম।
“আমার নাম বলতেই মেয়েটি বলল, ‘নি
শে না গোয় রেন?’ অর্থাৎ আমার দেশ কোথায়। ভারতকে
চীনা ভাষায় বলে ‘ইন তু’, বলতেই মেয়েটার
মুখটা একটু উজ্জ্বল হল।
“ও বলল, ‘ভারত তো জাদুকরদের দেশ। তুমি
পারো না ঐ শয়তান জাদুকরের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করতে?’
“আমি তো অবাক! ও কে! কী বলছে! কিছুই তো বুঝতে
পারছি না।
“মেয়েটা বলল, ওর নাম মিয়াশিং। এই নগরের
নগরপালের মেয়ে ও। ওদের রাজ্যে বহুবছর বৃষ্টিপাত হয় না। ওদিকে
মরুঝড়ে ও বাতাসের তীব্রতায় প্রতিদিন ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। এক ভিনদেশী
জাদুকর সান্তুরা ওদের নগরে এসে এসব দেখে বলেছিল সে পারবে এই দুর্যোগের কবল থেকে রাজ্যকে
রক্ষা করতে।
“‘ও নাকি বাঁশি বাজিয়ে বৃষ্টি
নামাতে পারে। নগরের সবাই রাজি হয়ে যায়। লোকটার
কাছে একটা অদ্ভুত দেখতে বাঁশের সাতটা নল লাগানো বাঁশি ছিল। ও সেটা
বাজাতে শুরু করে। আস্তে আস্তে নগরের সব লোক সেই অপূর্ব
বাঁশির টানে ওখানে চলে আসে। আকাশ
কালো করে মেঘ ছেয়ে যায়, বৃষ্টি নামে। আমাদের
খেতগুলো জল পেয়ে বুভুক্ষুর মতো শুষে নেয়, সবুজ হয়ে ওঠে। গাছপালা
সতেজ হয়ে ওঠে। তিন দিন বৃষ্টিপাতের পর জাদুকর সান্তুরা
এসে পিতার কাছে পারিশ্রমিক দাবি করে। পিতাও
আনন্দিত হয়ে ওকে বলে বসে যা চাই মন খুলে বলতে। সন্তুরা
আসলে ভীষণ ধূর্ত ও শয়তান একটা জাদুকর। ও সাত
ঘড়া মোহরের সঙ্গে আমায় চেয়ে বসে। সাত
ঘড়া মোহর পিতা দেবে বললেও আমায় ওর হাতে তুলে দিতে পিতা রাজি হন না কিছুতেই। এতে
জাদুকর খেপে যায়। ও আবার ভিন্ন সুরে বাঁশি বাজাতে শুরু
করে। এ সুর ভীষণ ভয়ের। আবার
ঝড় ওঠে। মারাত্মক ধুলোর ঝড়। আমাদের
নগর ধুলোয় ঢেকে যায়। বাড়ি ঘর ভেঙে
পড়ে। পাহাড়ে ধ্বস নামে। নদী
শুকিয়ে যায়। ওর বাঁশি থামে না। আস্তে
আস্তে ধুলোর ঝড়ে সবাই অদৃশ্য হয়ে যায়, কাউকে আমি খুঁজে পাই না আর। আমায়
ও বন্দি করে রাখে এই ঘরে। রোজ ও বাঁশি
বাজিয়ে আমার মন পেতে চায়। আমি ওকে ঘৃণা
করি। ওর বাঁশির আওয়াজ ছাপিয়ে আমার কানে আসে
বাচ্চাদের ভয়ার্ত চিৎকার, মেয়েদের কান্না। ও জোর
করে আমায় অধিকার করতে পারবে না কখনও। কিন্তু
কেউ যদি ওর বাঁশিটা ভেঙে দেয় ওর জাদু শেষ হয়ে যাবে। পারবে
তুমি এই জাদুর হাত থেকে আমাদের মুক্ত করতে?’ সজল
নয়নে মিয়াশিং আমার দিকে তাকায়।
“আমি কি উত্তর দেব বুঝতে পারি
না। আমি এ কোন জগতে রয়েছি তাই বুঝতে পারছি
না তখনও।
“মিয়াশিং আবার বলে, ‘যদি তুমি আমায় মুক্ত করতে না পারো তবে পালিয়ে যাও। সান্তুরার
আসার সময় হয়েছে। ও এসে তোমায় দেখলে অদৃশ্য করে দেবে। ও কাউকে
বাঁচতে দেবে না। সে মৃত্যুর থেকেও ভয়ঙ্কর জীবন। যারা
অদৃশ্য হয়ে রয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে তাদের হাহাকার আর আমি শুনতে পারছি না। ওদের
কষ্টে আমার বুক ফেটে যায়। গভীর এক কৃষ্ণগহ্বরে
হারিয়ে গেছে আমার রাজ্যের সব লোকজন। কে জানে
কবে এরা মুক্তি পাবে।’
“বাইরের ঝড় একটু কমেছে। চাঁদ
যৌবনের জৌলুস হারিয়ে ঝুঁকে পড়েছে বার্ধক্যের দিকে।
“মিয়াশিং বলে, ‘এবার আসবে সেই জাদুকর। তুমি
কি পারবে ওর বাঁশিটা ধ্বংস করতে?’
“‘কি করে করব? আমি ওকে কোথায় পাব? তুমিই
বা করছ না কেন?’ আমি বলি।
“‘আমি ওর জাদুতে বন্দি। আমার
সে ক্ষমতা নেই। তুমি ভিনদেশী, তাই তুমি পারবে। ও আসবে
এখনই, ওর ঝুলিটা ঐ থামের গায়ে ঝুলিয়ে ও আমার
কাছে আসবে। ঝুলি থেকে বাঁশিটা বার করে তুমি আছড়ে
ভাঙবে। সব ঠিক হয়ে যাবে আবার।’
“আমি মাথা ঝাঁকাই।
“মিয়াশিং একজোড়া ছোট্ট চীনা পুতুল
আমায় দিয়ে বলে, ‘এটা আমার ভারতীয় বন্ধুকে উপহার। তুমি
ঐ থামের পিছনে লুকিয়ে পরো। জাদুকর
আসবে এবার।’
“ম্লান চাঁদের আলোয় নিচের উপত্যকাকে
মনে হচ্ছে এক বিষাদ নগরী। চিনা পুতুলের
জোড়াটা আমার পিঠের ব্যাগে ভরে আমি থামের আড়ালে চলে গেলাম।
“একটু পরেই দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল
এক ভীষণ দর্শন আধবুড়ো লোক। গলায়
হারের মালা। ভুরুতে রঙিন পাথরের দুল। কানে
দশটা করে দুল পরেছে। রঙচঙে তালি মারা
জোব্বা পরনে।
“কালো ঝোলাটা থামে ঝুলিয়ে লোভী
চোখে কুতকুতে চাউনি আর মুখে বিচ্ছিরি কান এঁটো করা হাসি নিয়ে ও মিয়াশিং কে বলল, ‘আর কতদিন আমায় অপেক্ষা করাবে এভাবে?’
“জাদুকরকে টপকে মিয়াশিং-এর করুণ চোখ তখন আমায় ছুঁয়ে গেল। আমিও
কালো ঝোলাটা টেনে নিয়ে বাঁশের বাঁশিটা বের করে ফেলেছি। আর কী
করে যেন জাদুকর টের পেয়ে আমার দিকে ঘুরে হুঙ্কার দিয়ে উঠেছে।
“‘ভেঙে দাও ঐ অভিশপ্ত বাঁশি। ধ্বংস
করো এই শয়তানের জাদু।’
“মিয়াশিং-এর চিৎকারে আমি সম্বিত
ফিরে পেলাম। বাঁশিটা ভীষণ জোরে থামের মধ্যে বাড়ি মারলাম। একবার, দু’বার, তিনবার... হুড়মুড় করে যেন সব ভেঙে পড়তে শুরু করল। সন্তুরার
দেহ গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ভেঙে মাটিতে মিশে গেল। মিয়াশিং
আমায় নিয়ে ছুটে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু
কোথায় সেই মায়াবী রাজ্য। চারদিকে সব ভেঙে
পড়ছে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে। মিয়াশিং যেন
ছায়া হয়ে মিলিয়ে গেল। এত কোলাহল চিৎকার
কান্না সব ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে। উপত্যকাটা
কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছে। সব যেন কে ইরেজার
ঘষে মুছে দিচ্ছে চোখের সামনে থেকে। একটা
বড়ো পাথরের দেয়াল ভেঙে পড়ল আমার ঠিক সামনেই। আমি
ছুটে খোলা চাতালে চলে এসেছি।
“আস্তে আস্তে পূর্বদিক ফরসা হচ্ছে। ঐ তো
মগুইচেং-এর ক্ষয়প্রাপ্ত সেই অভিশপ্ত পাহাড়। আস্তে
আস্তে সব শান্ত হচ্ছে। সেই প্রাসাদ
মন্দির বাড়িঘর আর নেই কোথাও। মগুইচেং
যেমন ছিল সেভাবেই রয়েছে। তবে সমস্ত কোলাহল
মিলিয়ে গেলেও বাতাসে ভেসে আসছে একটাই শব্দ – ‘শিয়ে
শিয়ে’, বাংলায় যার অর্থ –‘ধন্যবাদ’।
“হঠাৎ পিছন থেকে আরেক কোলাহল আর
গাড়ির হর্নের আওয়াজে তাকিয়ে দেখি নোহারা সাতসকালে লোকজন নিয়ে আমায় খুঁজতে চলে এসেছে। নেহাত
রাতে গ্ৰামের লোকেরা এদিকে আসতে চায়নি। নাহলে
ও রাতেই আসত। আমায় দেখে নোহারা ছুটে এল।
“আমি ঠিক আছি কিনা দেখে বলল, ‘কাল রাতে মারাত্মক ধুলোর ঝড় হয়েছিল এখানে, তুমি থাকলে কী করে?’
“গ্ৰামবাসীদেরও এমনি সব প্রশ্ন
উড়ে আসতে লাগল।
“আমি শুধু বললাম, ‘আমি ঠিক আছি।’
“কুট্টি মামা, আমি কিন্তু বড়ো হয়ে গেছি। এসব
রূপকথার গল্প দিয়ে আর ভুলিও না,” আমার বোন রিন্টি বলে ওঠে।
কুট্টি মামা বেসিনে হাত ধুয়ে নিজের
ব্যাগ থেকে এক জোড়া খুব সুন্দর চিনামাটির পুতুল বার করে ফড়িংকে দিয়ে বলে, “সারা চীনে এমন পুতুল আরেক জোড়া খুঁজে পাইনি। এ নাকি
বহু পুরোনো এন্টিক পুতুল। এটাই সেই রাতের
প্রমাণ হিসাবে থেকে গেছিল। ফড়িং
রানি, এটা তোমায় দিলাম, এটার যত্ন কোরো। এটা
মিয়াশিং আর আমার বন্ধুত্বের উপহার।”
আমি আর রিন্টি অবাক হয়ে পুতুলটা
দেখছিলাম। আমরাও এত সুন্দর পুতুল আগে দেখিনি কোথাও। ডলস
মিউজিয়ামেও নেই।
মামা ব্যাগ থেকে একটা ফাটা সরু
বাঁশের টুকরো বার করে আমায় দিয়ে বলল, “সেদিন নোহারা
আমায় নিতে এল যখন আমার হাতে ধরা ছিল এই বাঁশের টুকরোটা, পরীক্ষা
করিয়েছি। এর বয়স দশ হাজার বছরের বেশি বলছে। তুই
পরীক্ষা করাতে পারিস। তার আগে একবার
কানে দিয়ে দেখ।”
আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম সেই অভিশপ্ত
বাঁশির টুকরোটাকে। রিন্টি আমার হাত থেকে নিয়ে কানে লাগিয়ে
কী যেন শুনল। পরক্ষণেই আমার হাতে ফিরিয়ে দিল ঐ বাঁশের
টুকরো।
No comments:
Post a Comment