গল্পের ম্যাজিক:: ক্ষতিপূরণ - অনন্যা দাশ


ক্ষতিপূরণ
অনন্যা দাশ

পুজোর ছুটিতে সমুদ্রের ধারে বেড়াতে এসেছে টপ্পা, টিঙ্কা আর রাজা। টপ্পা আর টিঙ্কা ভাই-বোন আর রাজা ওদের মাসির ছেলে। প্রতিবারই পুজোর পর ওদের দুটো পরিবার একসঙ্গে মিলে বেড়াতে বের হয়। খুব মজা হয়। এবার অবশ্য জায়গাটা একটু অভিনব। বসন্তপুর অন সিতে ওদের থাকার সব ব্যবস্থা টপ্পা টিঙ্কার মেসোমশাই মানে রাজার বাবাই করেছেন। জায়গাটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা, একেবারেই লোকজন নেই। একটাই গেস্ট হাউস, সেটাও সবে তৈরি হয়েছে। ভিড় তো একেবারেই নেই। সমুদ্র সৈকত একেবারে খালি। এমন কী নুলিয়াদেরও দেখা যায় না। সোনালি বালি, নীল জল, একেবারে অপরূপ।
টপ্পা টিঙ্কার বাবা বললেন, “আর চার-পাঁচ বছরেই হয়তো এখানে পুরী-দীঘার মতন ভিড় হয়ে যাবে!”
সেটা শুনে মেসোমশাই অবশ্য মাথা নাড়লেন, “না সুখেন, সেই সম্ভাবনা খুবই কম। এই সমুদ্র সৈকতটা বলা যেতে পারে প্রাইভেট। এটা রকওয়েল-অগরওয়াল অ্যাসোসিয়েটসের জায়গা। হেমন্ত অগরওয়ালের বাবা বসন্ত অগরওয়ালের নামে জায়গাটার নাম। এখানে বেড়াতে আসতে গেলে ওদের অনুমতি নিয়ে আসতে হয়। আমার বন্ধু যতিন বছর খানেক হল ওই কোম্পানিতে ঢুকেছে তাই আমরা আসতে পারলাম। এখানে কোনও হোটেল নেই। ওই একটাই গেস্ট হাউস, সেটাও কোম্পানির লোকেদের পরিবারের জন্যে, আর ওদের থ্রু দিয়েই কেবল বুক করা যায়। যতিন আর ওর পরিবারের আসার কথা ছিল কিন্তু ওদের ছেলেটার জন্ডিস হয়েছে বলে যতিনকে কলকাতা ছুটতে হয়েছে আর ওরা আসতে পারেনি।”
“ও আচ্ছা, এই ব্যাপার। তাহলে তো আমরা একেবারে যাকে বলে এক্সক্লুসিভ জায়গায় এসে পড়েছি দেখছি!”
পরের দিন সকালে জলখাবার খেয়েই জলে নেমে পড়ল ওরা তিন ভাই বোন। খুব হুটোপাটি করে খেলা হল। টিঙ্কা জল থেকে উঠে ঝিনুক কুড়োচ্ছিল, ততক্ষণে বাবা-মা, মাসি-মেসোরাও এসে পড়লেন। মসুদ্র সৈকত ধরে হেঁটে হেঁটে কিছুটা দূর যাওয়ার পর বিশাল বাড়িটাকে দেখতে পেল ওরা।
মেসোমশাই বললেন, “ওই যে, ওটা ওদের এখানকার হেডকোয়ার্টার। এটাকে অফিস বললে অবশ্য ভুল হবে, যতিন বলেছে এটা ওদের রিসার্চ ওয়ার্কশপ বা গবেষণাগার। এখানে নানান পরীক্ষা ইত্যাদি চলে ওদের। যাই হোক, কালকের জন্যে একটা গাড়ি ভাড়া করেছি। এখান থেকে কিছুটা দূরে একটা মন্দির আছে সেটা দেখতে যাওয়ার প্ল্যান। মানে খুব বিশাল কিছু নয়, কিন্তু একটা পাহাড়ের ওপর বলে ওখান থেকে সব দৃশ্য ভারি সুন্দর দেখা যায়। সেটাই দেখে আসব। ওইখানেই এখানে যারা কাজ করে তারা থাকে। এই দিকটায় কারও থাকার অনুমতি নেই। হ্যাঁ যা বলছিলাম, কাল মন্দিরটা দেখে আসব, তারপর দুটো দিন স্রেফ বিশ্রাম!”
সেদিন সারা দিনটা খুব ভালোই কাটল ওদের গেস্ট হাউসে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা আছে, তাই মা-মাসিরও ছুটি, আর খাবারও বেশ ভালোদিব্যি হইচই করে কেটে গেল সারাদিন। সমুদ্রের ফুরফুরে হাওয়ায় ঘুমও হল জব্বর
পরদিন সকাল সকাল গাড়ি এসে হাজির। পাহাড়ের মাথায় ওঠা, মন্দির দর্শন সব কিছু ভালোভাবেই হল। আশপাশের আরও দুয়েকটা দ্রষ্টব্য জায়গা দেখে ফেরার পথ ধরল ওরা
টপ্পা বলল, “আমি কিন্তু ফিরে গিয়ে একবার জলে নামব!”
বাবা তাই শুনে বললেন, “বাপ রে! তোমাদের এনার্জির শেষ নেই দেখছি! তোমরা যা খুশি করো, আমি বাপু একটু ঘুমোবো। একটু না ঘুমোলে যেন ঠিক ছুটি ছুটি মনে হচ্ছে না!”
মা তো সেটা শুনে হাঁ হাঁ করে উঠলেন, “সে কী! এখন ঘুমোবে মানে? পাঁচটা তো প্রায় বাজতে চলল।”
গেস্ট হাউসে পৌঁছে অবশ্য ওরা দেখল কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে। ওখানকার কেয়ারটেকার কাম ম্যানেজার মিস্টার মেহতা বললেন, “ভাগ্যিস আপনারা ছিলেন না! এদিকে তো ভয়ানক কান্ড হয়ে বসে আছে!”
ওরা সবাই ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
“আর বলবেন না। কোম্পানি থেকে জলের তলায় কী সব যন্ত্রপাতি নামানো হয়েছিল নানা রকমের পরীক্ষার জন্যে। ঠিক কী করছিল ওরা আমি বলতে পারব না, কিন্তু আজ সকাল এগারোটা নাগাদ ওই রকম কোনও একটা যন্ত্রে একটা ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ হয়। প্রচন্ড জোরে শব্দ হয়েছিল আর মাটি কেঁপে উঠেছিল আমরা সবাই তো খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মোট কথা এখন ওরা বলছে এই এলাকার জল দূষিত হয়ে গেছে, তাই সমুদ্রে নামা চলবে না, জলে নামা বারণ।”
তাই শুনে টপ্পা, টিঙ্কা আর রাজার তো মুখ ভার হয়ে গেল।
টপ্পা জিজ্ঞেস করল, “কত দিন জলে নামতে পারব না? কাল নামা যাবে তো?”
“সে তো জানি না। আজকে নামা নিষেধ বলে নির্দেশ আছে। ওরা বলেছেন পরে আরও বিস্তারিতভাবে সব কিছু জানাবেন।”
ওরা জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল। হ্যাঁ, সমুদ্রের ধার ধরে ধরে লাল লাল বোর্ড লাগানো হয়েছে। তাতে ‘সাবধান’ ‘ডেঞ্জার’ ইত্যাদি লেখা রয়েছে।
“আর মন খারাপ করে কী হবে?” বলে মাসি ব্যাগ থেকে লুডো বার করলেন। সেই নিয়েই বিকেলটা কেটে গেল।
পরদিন সকালে উঠে ওরা দেখল সাইন বোর্ডগুলো যেমন ছিল তেমনই রয়েছে। মিস্টার মেহতা শুকনো মুখ করে মাথা নেড়ে বললেন, “না, আজকেও আপাতত জলে নামা চলবে না। ওরা বলেছেন সব কিছু স্বাভাবিক হলে আমাকে জানাবেন।”
হঠাৎ টিঙ্কা বলল, “জলে নামা না হয় বারণ কিন্তু বালিতে খেলতে তো পারি?”
মিস্টার মেহতা মাথা চুলকে বললেন, “দাঁড়ান, আমি জিজ্ঞেস করে বলছি।”
একটু পরে এসে বললেন, “হ্যাঁ, বালিতে খেলা যাবে তবে সাইন বোর্ডগুলোর এপারেই থাকতে হবে। জলের এতটুকু কাছেও যাওয়া চলবে না মোটেই!”
“সে ঠিক আছে, নাই মামার চেয়ে তো কানা মামা ভালো!” বলে ওরা তিনজন খোন্তা বালতি নিয়ে ছুটল। বালিতে নাকি রাজপ্রাসাদ বানাতে হবে।
প্রাসাদই বানাচ্ছিল ওরা, হঠাৎ রাজা সমুদ্রের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, “ওই দ্যাখ! আমাদের জলে নামতে দিল না অথচ অন্য লোক জলে দিব্যি সাঁতার কাটছে!”
“কই, কই?” করে টপ্পা অ্যান্ড টিঙ্কাও তাকিয়ে দেখল। হ্যাঁ, রাজা ঠিকই দেখেছে, জলে সাঁতার কাটছে কেউ। ওরা তাকিয়ে থাকতে থাকতেই জল থেকে উঠে এল দু’জন ছেলে। ছেলে না বলে যুবক বলাই ভালো, ওদের চেয়ে কিছুটা বড়ো তারা। কলেজে পড়ে মনে হয়। একজন একটা সাদা কালো আঁটোসাঁটো বডি স্যুট পরেছে। ঠিক যেমন সাঁতারুরা পরে। সেই ছেলেটার চেহারা বেশ ভালো - লম্বা, চওড়া, স্বাস্থ্যবান। অন্যজন লালচে কমলা রঙের একটা ঢিলে ঢালা জামা পরে রয়েছে। সে বেঁটেখাটো, কেমন একটা লিকপিকে চেহারা তার।
রাজা ওদের দিকে ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমরা জলে নেমেছিল কেন? জলে নামা বারণ জানো না?”
ওরা দু’জন মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বলল, “ও, বারণ বুঝি? আমরা জানতাম না। আমাদের তো কেউ বলেনি!”
টিঙ্কা বলল, “বলার কী আছে? এত বড়ো বড়ো করে সাইনবোর্ড লাগিয়েছে দেখছ না? তোমরা তো বড়ো, পড়তে পারছ না?”
ছেলে দুটো মাথা নেড়ে বলল, “আমরা যেখান থেকে এসেছি সেখানে কিছু লেখা নেই। তা জলে কী ফেলেছে তোমরা জানো?”
ওরা তিনজনই মাথা নাড়ল, “না, তা জানি না। তবে ওরা ইচ্ছে করে কিছু ফেলেনি। জলের ভিতর কী সব পরীক্ষা করছিল তখন বিস্ফোরণ হয়েছে। সেই জন্যেই কিছু বাজে জিনিস মনে হয় বেরিয়ে জলের সঙ্গে মিশেছে, তাই ওরা কাউকে জলে নামতে দিচ্ছে না। আমরা কলকাতা থেকে এখানে এসেছি ছুটি কাটাতে, কিন্তু জলে নামতে পারছি না।”
“কলকাতায় কী সমুদ্র আছে?” বেঁটে রোগা ছেলেটা জিজ্ঞেস করল।
“না, ওখানে নদী আছে। তবে সেটা তোমাদের জানা উচিতভূগোল পড়নি তোমরা?”
“না... মানে ইয়ে তোমাদের নাম কী?”
ওদের নাম শুনে ছেলে দুটো বলল, “ও তোমাদের বুঝি দুটো করে নাম! আমাদের একটা করেই নাম। আমি তিমির আর ও হল অষ্ট,” লম্বা ছেলেটা বলল।
রাজা বলল, “ও, তাহলে তোমরা আমাদের তিমিরদা আর অষ্টদা। তা তোমরা কোথায় উঠেছ? গেস্ট হাউসে তো তোমাদের দেখিনি।”
“না, না, বললাম তো আমরা এখানে থাকি না। আমরা অনেক দূর থেকে সাঁতার কেটে এসেছি। এখান থেকে অনেক দূরে থাকি।”
“ও!”
এমন সময় মা আর মাসি ওদের খেতে ডাকলেন।
রাজা বলল, “তিমিরদা, অষ্টদা, তোমরাও আমাদের সঙ্গে খাবে চলএখন তো আর সাঁতার কেটে ফিরতে পারবে না। রাস্তা দিয়ে ফিরতে হবে, তাই অনেক সময় লেগে যাবে। আচ্ছা তোমরা তো ভিজে একশেষ, তোমাদের কাছে টাকা আছে? গাড়ি ভাড়া করে বাড়ি ফিরে যেতে পারবে?”
“অ্যাঁ, টাকা?” বলে দু’জনে আবার একে অপরের দিকে তাকাল
ওরা দু’জনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ছে দেখে টিঙ্কা বলল, “তোর যেমন বুদ্ধি! সাঁতার কাটতে বেরিয়ে টাকা কী করে নেবে শুনি? সব তো ভিজে ঢোল হয়ে যাবে!”
তিমিরদা আর অষ্টদা তাড়াতাড়ি বলল, “হ্যাঁ, সব ভিজে ঢোল হয়ে যাবে, তাই টাকা নিইনি।”
তারপর তিমিরদা বলল, “আচ্ছা যেখানে ওরা যন্ত্র নামিয়েছে তোমরা সেই জায়গাটা দেখেছ?”
“আজ তো দেখিনি, গতকাল ওই দিকটায় হাঁটতে গিয়ে দেখেছিলাম।”
“ওখানে যারা কাজ করে তাদের চেনো তোমরা? ওদের সঙ্গে একটু কথা বললে ভালো হত। আসলে ঠিক কী ঘটেছে, কতটা বিপদজনক সেটা জানতে চাই আমরা। আমাদের ওদিকে তো ওরা সাইন লাগায়নি।”
টপ্পা বলল, “হ্যাঁ, আমরাও জানতে চাই ঠিক কী হয়েছিল, কিন্তু কাউকে তো চিনি না। মেসোর বন্ধু যতিনকাকু ওখানে কাজ করেন বটে, কিন্তু এখন উনি ছুটিতে।”
রাজা সব কথা শুনছিল, এবার সে বলল, “এক কাজ করা যাক, আগে খেয়ে নিই তারপর সবাই মিলে ওই দিকে যাব
তিমিরদা আর অষ্টদা সঙ্গে সঙ্গে রাজি, “হ্যাঁ হ্যাঁ, সেটাই ভালো হবে।”
গেস্ট হাউসে যেতে মা আর মাসি সব শুনে বললেন, “এ বাবা ভিজে জামাকাপড় পরে তো আর খেতে বসা যায় না।”
তিমিরদা আর অষ্টদা কিন্তু কিন্তু করছিল, ‘আমরা ঠিক আছি’ বলছিল, কিন্তু বড়োরা শুনলেন না। ওদের দু’জনকে বাবা আর মেসোমশাইয়ের জামাকাপড় পরতে দেওয়া হল তিমিরদার গায়ে সব আঁটো আর অষ্টদার গায়ে সব ঢোলা!
খেতে বসে ওরা শুধু চিংড়ি আর মাছ খেল একটু করে, বলল নাকি তেমন খিদে নেই।
বড়োরা সবাই তিমিরদা আর অষ্টদাকে ওদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছিলেন। ওরা কার সঙ্গে থাকে, বাড়িতে আর কে আছে, বেড়াতে এসেছে নাকি এই সব। ওদের উত্তরগুলো কেমন যেন ভাসা ভাসা। এটুকু বোঝা গেল যে ওরা যেখান থেকে সাঁতার কেটে এসেছে সেখানেই থাকে। ওদের দু’জনেরই একান্নবর্তী পরিবার, অনেকে একসঙ্গে মিলেমিশে থাকে। ওদের ওখানে সবাই আন্দাজ করছিল যে কিছু একটা হয়েছে, তাই ওদের দু’জনকে পাঠানো হয়েছে ঠিকমতন খোঁজখবর নিতে। কী হয়েছে জেনে ওদের ফিরে যাওয়ার কথা। ওদের ওখানে ওরা নাকি কোনও খবর-টবর পায় না, তাই এদিকে আসতে হল।
“কিন্তু সমুদ্রে সাঁতার কেটে আসা তো সহজ কাজ নয়! বড়োদের নৌকা-টৌকা নিয়ে আসা উচিত ছিল,” মা যুক্তি দিলেন।
“না, না, আমরাই তো ওই এলাকার সব থেকে ভালো সাঁতারু, তাই আমাদের পাঠানো হয়েছে।”
খাওয়াদাওয়া শেষ করে বড়োরা তাস খেলতে গেলেন। সেই সুযোগে ওরা পাঁচজন বেরিয়ে পড়ল। বালির ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে টিঙ্কা একটা ছোটো প্লাস্টিকের বালতিতে করে ঝিনুক কুড়োচ্ছিল কলকাতায় ফিরে বন্ধুদের দেবে বলে। অষ্টদা ওর কাছ থেকে বালতিটা নিয়ে বইছিল আর মাঝে মাঝে বলছিল, “উফফ দুটো হাতে আমার আর চলছে না!”
হঠাৎ বালিতে একটা কাঁকড়া দেখতে পেয়ে ছুটে গিয়ে সেটাকে তুলে নিল। তারপর টিঙ্কার মনে হল কপ করে সেটাকে মুখে পুরে দিল। তবে সে কথাটা ফিসফিস করে টপ্পাকে বলতে সে বলল, “ধুস্‌, কী আজেবাজে কথা বলছিস!”
এদিকে অষ্টদা হুটোপাটি করে কাঁকড়া ধরছে দেখে তিমিরদা এক ধমক দিয়ে দিল, “এই তুই থামবি অষ্ট!”
কিছুটা হাঁটার পরই বিশাল বড়ো বাড়িটাকে দেখতে পাওয়া গেল।
রাজা আঙুল দিয়ে দেখাল, “ওই যে, ওই বাড়িটাই ওদের কোম্পানির গবেষণাগার!”
সেদিন অবশ্য আগের দিনের মতন সমুদ্র সৈকত খালি ছিল না। বেশ কিছু লোকজন সেখানে কাজ করছিল। বড়োসড়ো মেশিনের ভাঙা টুকরো বালিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছিল।
ওদের দেখতে পেয়ে একটা ষন্ডামার্কা লোক ছুটে এল ওদের দিকে।
বাজখাঁই গলায় সে বলল, “এই কী হচ্ছে! তোমরা এদিকে এসেছ কেন? যাও চলে যাও এখুনি, নোটিস পড়নি?”
রাজা দু’পা এগিয়ে গিয়ে ‘আমরা’ বলে কী একটা বলতে যাচ্ছিল এমন সময় লোকটা হনহন করে এগিয়ে এসে ঠাস করে ওর গালে একটা চড় কষিয়ে দিল!
“যা বলছি শুনতে পাওনি নাকি? যাও চলে যাও এখান থেকে!” চিৎকার করে উঠল লোকটা।
এরপর মুহূর্তের মধ্যে সব কিছু ঘটে গেল। তিমিরদা লোকটার কাছে গিয়ে ডান হাত দিয়ে লোকটাকে একটা ধাক্কা দিল। লোকটা শূন্যে উঠে গিয়ে অনেকটা দূরে গিয়ে পড়ল হাঁউমাঁউ করে চিৎকার করতে করতে।
তাই দেখে ওরা তো থ! তিমিরদার গায়ে এত জোর? যারা কাজ করছিল তারাও কাজ থামিয়ে তিমিরদার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে দেখতে লাগল। আরেকজন পালোয়ান গোছের লোক তেড়ে এল ওদের দিকে। এবার অষ্টদা ওকে জাপটে ধরল। লোকটা পরিত্রাহি চিৎকার করতে লাগল, “বাবা গো, মা গো, মরে গেলাম গো! ছেড়ে দাও গো!” করে।
অষ্টদা ওকে যখন ছাড়ল তখন সে বালিতে লুটিয়ে পড়ল। লোকগুলোর মধ্যে ম্যানেজার গোছের একজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “কে তোমরা? কী চাও?”
তিমিরদা বলল, “আমরা কে সেটা জেনে আপনাদের কোনও লাভ হবে না, কিন্তু আপনারা যা করছেন তাতে আমাদের ভয়ঙ্কর ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। আমাদের অনেক বন্ধু বান্ধব এবং পরিবারের লোকজন মারা গেছে। আমার মনে হয় আপনারা বোধহয় তেল খোঁজার চেষ্টা করছেন, কিন্তু এখানে তেল নেই। বৃথা পন্ডশ্রম!”
ম্যানেজার লোকটার মুখ হাঁ হয়ে গেল তিমিরদার কথা শুনে। আমতা আমতা করে সে বলল, “ও, লোক মারা গেছে বলে তো আমাদের জানা ছিল না। চন্দ্রকান্ত, যাও স্যারদের ডেকে নিয়ে এসো! দুর্ঘটনার খবর পেয়ে রকওয়েল সাহেব নিজে এসেছেন। আপনি ওঁর সঙ্গে কথা বললে ভালো হবে। ক্ষতিপূরণ ইত্যাদির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত তো উনিই নেবেন।”
“ক্ষতিপূরণ? আমাদের ক্ষতিপূরণ দেবে তোমরা?” বলে তিমিরদা মাথা নাড়ল।
একটু পরেই যে লোকটা ভিতরে গিয়েছিল সে একজন সাহেব আর আরেকজন স্যুট পরা ভদ্রলোককে নিয়ে বেরিয়ে এল
“কী হয়েছে কৃপারাম?”
“স্যার, ইনি বলছেন কালকের বিস্ফোরণে নাকি এনাদের প্রচুর আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুরা মারা গেছেন!”
“অ্যাঁ! বলো কী! কোথায় থাকো তোমরা?”
“সেটা জানার কী খুব দরকার আছে? আমি বলছি আমার পরিবারের লোক আর বন্ধুরা মারা গেছে, সেটা কী বিশ্বাস হচ্ছে না আপনাদের? তাদের মৃতদেহ দেখতে চান?”
“না, না, মানে আমরা তো জানতামই না। ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে তাহলে তো!”
“আপনাদের ওই এক চিলতে ক্ষতিপূরণ আমাদের চাই না! ক্ষতিপূরণ দিয়ে নৈতিক দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চান, তাই তো? সেটা হবে না!”
“তাহলে কী চাও?” হেমন্ত অগরওয়াল অসহায়ভাবে জিজ্ঞেস করলেন।
“আপনারা জলে ওই সব পরীক্ষা করা বন্ধ করুন। এখানে পাড়ে অফিস রাখতে চান রাখতে পারেন, কিন্তু ওই সব নিম্ন স্তরের মেশিন জলে ডুবিয়ে তেল খোঁজার চেষ্টা বন্ধ করুন! এখানে তেল নেই। আপনাদের ওই যন্ত্রগুলো জলে নামাবার উপযুক্ত নয় মোটেই, ফেটে যাচ্ছে, ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। ওই জল আমরা খাই তা জানেন? ওই জলই আমাদের জীবন। আপনারা এতটাই স্বার্থপর যে অন্য কারও কথা কোনোদিন ভেবে দেখেন না!”
“এই ছেলে! সেঠজীর সঙ্গে ওই ভাবে কথা বলবে না!” বলে আরেকজন ষন্ডামার্কা লোক তেড়ে এল
তিমিরদা একটা টোকা মারল তাকে এবং সে প্রায় উড়ে গিয়ে সমুদ্রের জলের কাছে পড়ল।
রকওয়েল সাহেবের মুখ হাঁ হয়ে গেছে, “কে তুমি?”
“আমরা কে না হয় নাই বা জানলেন। এটা জেনে রাখুন আমরা যদি চাই তাহলে সুনামির মতন ঢেউ তুলে আপনার এইসব ঘরবাড়ি ভেঙে লন্ডভন্ড করে দিতে পারি। লোকজন সবাইকে শেষ করে দিতে পারি, কিন্তু আমরা তা করব না। আমরা হিংস্র নই। আমরা কারও ক্ষতি করতে চাই না, শুধু নিজেদের মতন করে বাঁচতে চাই। এই মুহূর্তে আমরা চাইলে এখানকার সব কিছু ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারি, কিন্তু আমরা কিছুই করব না। আমরা শুধু অনুরোধ করতে এসেছি।”
রকওয়েল সাহেব ওর কথা শুনে মাথা নাড়লেন, “হেমন্ত, তোমার এই প্রোজেক্টটার ইতি টানো তুমি। এমনিতেও এই বিস্ফোরণে যা ক্ষতি হয়েছে সেটাকে সামাল দিতেই অনেকদিন লেগে যাবে আর আখেরে কিছু লাভ হবে না। আমার মন বলছে এদের কথাই ঠিক, এখানে তেল নেই।”
তারপর তিমিরদার দিকে ফিরে বললেন, “আমি কথা দিচ্ছি আমরা এই জলে আর কিছু ডোবাব না। আমি নেলসন রকওয়েল এই কথা দিচ্ছি তোমাদের, কিন্তু তোমরা কে সেটা বলো?”
“সেটা জেনে যাবেন। কথা না রাখলে কিন্তু নিজেরাই বিপদে পড়বেন মনে রাখবেন। আর এবার যা ঘটবে সেটা কাউকে না বললেই ভালো, অবশ্য বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না আপনাদেরই মাথা খারাপ হয়েছে মনে করবে! টিঙ্কা, টপ্পা, রাজা তোমাদের সাহায্যের জন্যে অনেক ধন্যবাদ!” বলে ওদের বাবাদের জামাকাপড়গুলো ছেড়ে ফেলল তিমিরদা আর অষ্টদা। ওদের গায়ে আবার সেই সাদা কালো বডি স্যুট আর লালা কমলা জামা। হাত নেড়ে জলে ঝাঁপ দিল ওরা দু’জনে। পাড়ে দাঁড়িয়ে সবাই আশ্চর্য হয়ে দেখল ওদের দু’জনকে জলে মিলিয়ে যেতে।
হঠাৎ রাজা চিৎকার করে উঠল, “ওই যে, ওই যে!”
ওর হাতের আঙুল অনুসরণ করে সবাই দেখল বেশ কিছুটা দূরে সমুদ্রের মধ্যে জল থেকে লাফিয়ে উঠেছে একটা বিশাল সাদা কালো তিমি মাছ আর তার পাশেই জলে ভাসছে একটা বিশাল লালচে কমলা রঙের অক্টোপাস!
_____
ছবিঃ সুমিত রায়

2 comments:

  1. খুব সুন্দর গল্প। শিক্ষা মূলক। পড়ে আনন্দ পেলাম

    ReplyDelete
  2. প্রকৃতিকে বাঁচানোর বার্্তা পেলাম। খুব ভালো লাগল।

    ReplyDelete