ভ্রমণ:: বোরাসুর বাঁকপথে - ইন্দ্রনীল মুখোপাধ্যায়


বোরাসুর বাঁকপথে
ইন্দ্রনীল মুখোপাধ্যায়

।। প্রথম পর্ব ।।

বারোই জুন যাত্রা শুরু
রাতে দুন এক্সপ্রেসে উঠে খবর পেলুম আজ আর কাল বিহার বন্ধ৷ অনেক হিসেব করে দেখা গেল ট্রেন বিহারের সীমানা পেরোচ্ছে সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ৷ জানি না, কী হবে! আমরা - মানে, আমি আর বুড়োদা একটা কামরায়, দুটো লোয়ার বার্থ৷ তাপস আর জয়া পাশের কামরায়৷ সন্দীপ আমাদের সঙ্গে ভিড়বে দেরাদুনে৷
আজ সারাদিন খুব দৌড়োদৌড়ি গেল৷ ট্রেকিং-এর জিনিসপত্র কেনা, সেগুলো গুছোনো, পুলিশের চিঠি আনা, শেষমুহূর্তে গ্লু-কন-ডি আর স্টোভের পিন কেনা সব মিলিয়ে দিনটা যা গেল! আমার আর এক বন্ধু, এও সন্দীপ, যার উৎসাহে আমার প্রথম ট্রেকিং-এ হাতেখড়ি, এসেছিল স্টেশনে৷ আমাদের ট্রেন আবার থামে চন্দননগরে৷ তাই মা আবার রুটি-তরকারি করে পার্থর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিল৷ ট্রেনের দুলুনি, অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে মাঝে মাঝে আলোর ফুটকি দেখা যাচ্ছে... খাওয়াদাওয়া শেষ, ঘুম ঘুম পাচ্ছে; শুয়ে পড়লেই হয়৷

তেরোই জুন ট্রেনের ঝুটঝামেলা
গতরাতে বার কয়েক ঘুম ভেঙেছে৷ স্টেশন এলেই কেন জানি ঘুম ভেঙে যায়৷ ভোর চারটে নাগাদ বার্থে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছি, বাইরে তখনও আধো অন্ধকার৷ ভোর হবার আগের আবছা আলোয় ট্রেন একটা ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে৷ ঘুম ভেঙেছে, কিন্তু বার্থ ছেড়ে তখনও উঠিনি৷ কিছু পরে মনে হল যে একটু যেন বেশি সময় দাঁড়িয়ে আছে ট্রেন৷ ধড়মড়িয়ে উঠে বুঝলুম ট্রেনের এই স্থিতাবস্থা সিগনালের জন্য নয়৷ সামনেই শ’খানেক মিটার দূরে একটা স্টেশন, বেশ কিছু লোকজন লাল ঝাণ্ডা লাইনের মাঝে পুঁতে বসে পড়েছে – বিহার বন্ধের একটা ছোট্টো নমুনা৷ আমাদের ভাগ্য এত ভালো যে দুন এক্সপ্রেস-ই প্রথম ট্রেন যে এই বন্ধের কবলে পড়ল! তবু ভালো, কাছেই গোটা দুয়েক গভীর কুয়ো; অন্তত জলের সমস্যা তো মিটল৷ কিন্তু খাদ্যসমস্যা যে প্রকট৷ এদিকে আমাদের সামনের বার্থে বসে একজন প্রচণ্ড মোটা ভদ্রমহিলা অনবরত খেয়ে চলেছেন আর খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে ঘুমিয়ে নিচ্ছেন৷ বিহারের প্রত্যন্ত গ্রামে ধূ ধূ মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেন থেকে একটা দারুণ সূর্যোদয় আমাদের মনে কোনো ছাপ ফেলতে পারল না ট্রেন ছাড়ার অনিশ্চয়তার জন্য৷
ট্রেন থেকে নেমে তাপসের কামরায় যাওয়া, জল আনা, সূর্যের উদয় থেকে মধ্যগগনে যাওয়া, পুরোনো ট্রেকিং-এর গল্প কোনোরকমে সময় কাটানো আর কি৷ প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ, ঠিক ছ’ঘন্টা পরে, অবরোধকারীদের দয়ায় অবশেষে ট্রেন ছাড়ল৷ স্টেশন ছাড়িয়ে যাবার সময় নামটা দেখলুম চিচাকী৷ বেশ কয়েকজন লোক লাঠি-সোঁটা-বল্লম নিয়ে আর গাদাখানেক পুলিশ সং সেজে দাঁড়িয়ে আছে৷
বিকেলে মোঘলসরাই আর সন্ধের মুখে বেনারস৷ ট্রেনের জানলা দিয়ে বেনারসের গঙ্গার ঘাট; পুরোনো স্মৃতি ভেসে এল সেই নৌকাবিহার, সন্ধেবেলায় আরতি, আর রাত পর্যন্ত ঘাটে বসে আড্ডা, সেই আড্ডায় সেদিন সন্দীপও ছিল... ওর সঙ্গে আবার কতদিন পরে দেখা হবে...

চোদ্দই জুন - অবশেষে দেরাদুন
ভোর রাতে লক্ষ্ণৌ, বিকেলে হরিদ্বার পেরিয়ে ট্রেন যখন দেরাদুনের পথে যেতে শুরু করল, তখনই প্রথম মনে হল আমরা আবার ট্রেকিং-এ যাচ্ছি, এতক্ষণের একঘেয়েমি যেন একটু কাটল৷ একটাই লাইন, ট্রেন থেকে মুখ বার করে দেখলে বোঝা যায় সোজা চলেছে রেললাইন, মাঝে মাঝে একটু ওপরদিকে উঠে গেছে৷ স্টেশনগুলোর নাম বড়ো মিষ্টি৷ রাইওয়ালা হয়ে কাঁসো স্টেশনে থামল৷ ছবির মতো ছোট্টো সুন্দর৷ নিচু প্লাটফর্ম৷ দু’পাশে অল্প জঙ্গল৷ বিকেলের পড়ন্ত আলোয় ট্রেন থেকে নেমে পড়ার লোভ সামলাতে পারলুম না৷ পরের স্টেশন দইওয়ালা৷ হর্‌‌রাওয়ালা স্টেশন ছাড়িয়ে দেরাদুনে ট্রেন থামল তখন সন্ধে সাতটা৷ গতবারের মতো এবারও থাকা হল ভিকটোরিয়া হোটেলে৷
দেরাদুন শহর কোনোদিনই ঘোরা হয়নি৷ তবু মনে হল, অনেক কিছুই এক রয়ে গেছে৷ সাঁকরির বাস ছাড়বে মীডো হোটেলের সামনে রাজীব ট্রান্সপোর্ট থেকে৷ সন্দীপের সঙ্গে দেখা হোটেলে ঢোকার মুখেই৷ রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ, শুয়ে পড়লেই হয়৷ কাল খুব ভোরে উঠতে হবে৷ গতবারের অভিজ্ঞতা বলে ভোর পাঁচটা থেকে সাঁকরির বাসে উঠে জায়গা রাখতে হবে৷

পনেরোই জুন আজ যাব সাঁকরি
ঠিক ছ’টায় বাস ছাড়ল৷ ঘন্টাখানেক বাস চলেছে কি চলেনি, দাঁড়িয়ে রইল প্রায় আধঘন্টা৷ একটু বাস চলে তো আবার কিছুক্ষণ থামে৷ এইরকম করতে করতে পুরলায় এসে থামল, দুপুর গড়িয়ে গেছে৷ টায়ারে আবার গণ্ডগোল এর মধ্যে৷ ফলে দাঁড়িয়ে রইল যতক্ষণ না টায়ার ঠিক হয়৷ আরও কিছুক্ষণ পরে বাস ছাড়ল৷ বাসের ড্রাইভার, কণ্ডাকটার, সবাই বেশ নির্বিকারচিত্ত৷ কারুর জীবনে কোনো তাড়া নেই৷ মৌরি, নেটোয়ার হয়ে সাঁকরি পৌঁছল ছ’টা বেজে গেছে৷ কাছাকাছি দোকান থেকে চাল, ডাল ইত্যাদি রেশন কিনে তাড়াতাড়ি উঠে পড়লুম তালুকার জীপে৷ এখন সাঁকরি থেকে তালুকা পর্যন্ত জীপ যাচ্ছে, সাঁকরি জায়গাটা বেশ বড়ো হয়েছে, অনেক নতুন নতুন বাড়ি হয়েছে, ট্রেকিং করতে গেলে টাকা দিতে হয়, পোর্টারদের ইউনিয়ন হয়েছে, সভ্যতা হই হই করে এগিয়ে চলেছে৷
বাস থেকে নামতেই সুলুকরামের সঙ্গে দেখা৷ নিশ্চিন্ত হওয়া গেল৷ আবহাওয়া বাদ না সাধলে আর আমাদের সব্বার শরীর ঠিক থাকলে বোরাসু যাওয়া বোধহয় অসম্ভব হবে না৷ তালুকা পৌঁছলুম সাড়ে সাতটা বেজে গেছে৷ অনেকখানি রাস্তা৷ এখানে এখন গাড়োয়াল মণ্ডল বিকাশ নিগমের বিরাট রেস্ট হাউস তৈরি হয়েছে৷ ডর্মিটরিতে একটা বেড পঞ্চাশ টাকা৷ সাঁকরির মতোই এখানেও অনেক নতুন নতুন বাড়ি হয়েছে৷ প্রায় সবই কাঠের বাড়ি৷ রাতে পনেরো টাকায় রুটি-ডাল-সবজি, যত খুশি খাও৷ এখানে এখনও বিশেষ ঠাণ্ডা লাগছে না৷ রাতে একটা লেপেই হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে৷ ডর্মে মোট পাঁচটা বিছানা - অর্থাৎ গোটা ডর্মটাই আমাদের৷

ষোলোই জুন তমসা নদীর তীরে
আজ থেকে আমাদের ট্রেকিং শুরু৷ সুলুকরামের ঠিক করা পোর্টার দু’জন আজ সকালে আসবে ওসলা থেকে৷ যাতে দেরি হয়ে না যায়, তাই সন্দীপ, বুড়োদা আর জয়া এগিয়ে গেল৷ আমি আর তাপস পোর্টারদের সঙ্গে যাব বলে থেকে গেলুম তালুকায়৷ আটটা পর্যন্ত একজন মাত্র পোর্টার এল বাহাদুর সিং৷ তালুকা থেকে আরও দু’জন নেওয়া হল, কারণ না হলে দেরি হয়ে যাবে৷ অবশেষে বেরোনো হল ন’টায়৷ সেই পরিচিত পথ৷ তবু মনে ফুর্তি কম নেই৷ আসলে অনেকদিন পরে আবার আমরা একসঙ্গে আসতে পেরেছি৷ সেই কবে প্রায় পাঁচ বছর আগে গিয়েছিলুম ফাচুকান্দি পাস৷ তারপর মাঝে তো সন্দীপের সঙ্গে কারুর দেখাই হয়নি৷ কিছুটা যাবার পর দূরে স্বর্গারোহিনী দেখতে পেলুম৷ সত্যি, কতদিন পরে আবার বরফঢাকা পাহাড়ের চূড়া দেখতে পেলুম৷ আরও কিছু পরে নদীর ধারে নেমে আসতে হল তমসা নদী আমাদের বাঁ দিকে৷ গতবারে এই জায়গায় তাপসের একটা ছবি তোলা হয়েছিল মাথায় স্কার্ফ পরে৷ চড়াই-উৎরাই করতে করতে এসে পৌঁছোলুম গঙ্গাড গ্রামে৷ ডানদিকে চলে গেছে ফাচুকান্দি পাসের রাস্তা৷ সেই দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ বিভোর হয়ে তাকিয়ে রইলুম আমরা৷ আসলে ফাচুকান্দি পাসে যাওয়া ছিল আমাদের কাছে এক স্বপ্নের মতো৷ সুলুকরামের ডাকে সংবিত ফিরে রওনা দিলুম সীমার উদ্দেশে৷
বেশ কিছুটা হেঁটেছি, আকাশ হঠাৎ মেঘে ছেয়ে গেল৷ বৃষ্টি নামবে বলে মনে হচ্ছে৷ তাড়াতাড়ি হাঁটতে হল; বেশ কষ্টকর ব্যাপার৷ চোদ্দো কিলোমিটার পথের শেষটুকু তাড়াহুড়ো করা বেশ ঝামেলার৷ দমে মনে হচ্ছে ঘাটতি পড়েছে৷ যাই হোক, অবশেষে সীমায় এসে পৌঁছোলুম৷ রাকস্যাক কাঁধ থেকে নামাতে না নামাতেই ঝেঁপে বৃষ্টি এল৷ আর একটু দেরি হলেই ভিজতে হত৷ একটা ঘর৷ বেশ বড়৷ কাঠের মেঝে৷ বিছানার সংখ্যা দুই হলেও অসুবিধে নেই, আমাদের সঙ্গে ম্যাট্রেস আছে৷ বৃষ্টির মধ্যেই দৌড়ে সামনের দোকান থেকে রুটি-ডাল-সবজি খেয়ে এলুম৷ ছোট্টো দোকানটা আগের মতোই আছে৷
বৃষ্টি ধরল কিছুক্ষণ পর৷ আকাশও পরিষ্কার হল আস্তে আস্তে৷ এর মধ্যে আবিষ্কার করলুম আমার ডান পায়ের হাঁটুতে কোনোভাবে লেগেছে৷ ভোভেরান লাগিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই৷ যে সরু পায়ে চলা রাস্তা দিয়ে আমরা এলাম, সেটার ডানদিকে আমাদের থাকার জায়গা৷ তার উলটোদিকে অর্থাৎ রাস্তার বাঁদিকে একটু নিচে তমসা নদীর কলকল শব্দ কানে আসছে৷ সোজা চলে গেলে পৌঁছনো যায় রুইসারা তাল৷ আর যদি তুমি সামনে একটু এগিয়ে বাঁদিকের সরু কাঠের পুল পেরিয়ে আবার ডানদিকে ঘুরে যাও, তাহলে অনেক অনেকটা এগিয়ে গেলে পৌঁছে যাবে হর্-কি-দুন৷ আমরা সেদিকে যাব কালকে৷
চারিদিকের সব কিছুই কেমন যেন সুন্দর লাগছে, কেমন এক শান্তির পরিমণ্ডলের মধ্যে এসে পড়েছি আমরা৷ হঠাৎ সন্দীপ ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকে বলল, “আরে, আকাশ পরিষ্কার, আমি চললুম ওসলায়।”
“আমিও যাব,” বুড়োদা তাই শুনে লাফিয়ে উঠল৷
আমি বসে রইলুম পা ছড়িয়ে। এর মধ্যে ভোভেরানের দৌলতে হাঁটু বেশ জ্বালা করছে। ওরা দু’জনে বেরিয়ে পড়ল ওসলার উদ্দেশে৷
ওসলা গ্রামে থাকে সুলুকরাম, ওসলা হল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর গ্রাম৷ পাহাড়ের গায়ে কোনো এক শিল্পী তুলি দিয়ে একটু একটু করে ফুটিয়ে তুলেছে৷ সামনে বয়ে চলা তমসা নদী পেরিয়ে পাহাড়ের ওপরে ওসলা৷ গ্রামবাসীদের আরাধ্য দেবতা দুর্যোধন৷ গ্রামের মাঝখানে অপূর্ব সুন্দর দুর্যোধনের মন্দির৷ অসাধারণ তার কারুকার্য৷ মন্দিরে দুর্যোধনের মুখের ছাঁচ, বুকের বর্মের মতো কিছু জিনিস আছে৷ কিন্তু এখন মূর্তিটা ওসলায় নেই৷ এই মূর্তি পালা করে কাছাকাছি একুশটা গ্রামে ঘোরে৷ এখন এটা আছে জাখোল গ্রামে৷
আমরা তিনজন, আমি, তাপস আর জয়া এখন রোদে বসে আরাম করার চেষ্টায়৷ বন-বাংলোর চৌকিদার ভজন সিং৷ এখন এখানে নেই, সম্ভবত সাঁকরি গেছে৷ তাই আমাদের সঙ্গে এবার দেখা হল না৷ আগের বার বেশ বন্ধুত্ব হয়েছিল৷ সন্দীপ আর বুড়োদা এল ছ’টা বেজে গেছে৷ তারপর আর কী, ঘরে বসে আড্ডা৷ রাত পৌনে আটটার সময়ও আকাশে বেশ আলো রয়েছে৷ হাঁটুর ব্যথা বেশ বেড়েছে, ভাঁজ করতে গেলে লাগছে৷
আমাদের ঘরের ঠিক উলটোদিকে রাতের খাবার জায়গা৷ ছোট্ট দোকান৷ কাঠের তৈরি৷ মাথার ওপর একটা কাঠের ফ্রেমের ওপরে পাহাড়ি শুকনো ঘাসের ছাউনি৷ দোকানে ঢুকেই বাঁ দিকে কয়েকটা টুল, কয়েকটা কাঠের, কয়েকটা আবার বেতের মতন কিছু দিয়ে তৈরি৷ তার ওপর ছোটো ছোটো রংবেরঙের আসন পাতা আছে৷ তার পাশে কম্বলের মতো, কিন্তু ঠিক কম্বল নয়, বিছানো রয়েছে৷ দোকানের একদম সামনে মাটির উনুনে কাঠের আগুন জ্বলছে৷ মেনু সেই একই - রুটি-ডাল-সবজি৷ দোকানটা যে কার সেটা বোঝা মুশকিল৷ একজন রুটি করছে; হঠাৎ দেখি বাইরে থেকে আর একজন এসে সেও রুটি করতে শুরু করে দিল৷ আমাদের সঙ্গে শুরু হল তাদের গল্প৷ কত দিনের যেন চেনা৷ সেই আগের বারের কথা বলতেই একজন বলে উঠল, “আরে আমি তো তোমাদের চিনতে পেরেছি৷ আগেরবার তো তোমরা চার জন এসেছিলে৷ এখান থেকে হর্-কি-দুন গিয়ে আবার ফিরে এসে ফাচুকান্দি পাস গিয়েছিলে, তাই না?” আমাদের যে কী ভালো লাগল, বলবার নয়৷ সেই কতদিন আগে এসেছিলাম, সেটা এখনও মনে রেখেছে৷
দোকানে আস্তে আস্তে ভিড় বাড়ছে৷ সবাই এখানকারই লোক৷ আড্ডা বেশ জমে উঠেছে৷ একজন লোক এরই মধ্যে আমাদের খাবার জোগাড় করতে শুরু করে দিল৷ উনুন থেকে গরম রুটি সোজা আমাদের থালায়, এর স্বাদই আলাদা৷ দোকানের ভেতরটা বেশ গরম৷ অন্ধকারের মধ্যে আগুনের আলোয় এক অদ্ভুত পরিবেশ৷ খেয়েদেয়ে সামনের সরু রাস্তা পেরিয়ে আমাদের ঘরে যেতে গিয়েই ঠাণ্ডায় জমে গেলাম৷ আর কোনো কথা নয়, সোজা কম্বলের তলায়৷ আমাদের ঘরে কম্বল ছিল৷ তাই আর স্লিপিং ব্যাগ বার করতে হল না আজ৷ কাল থেকে আসল ট্রেকিং শুরু৷

সতেরোই জুন - হর্-কি-দুনের সবুজ উপত্যকায়
পাহাড়ে ঘুম ভেঙে যায় তাড়াতাড়ি৷ পায়ের অবস্থা একটু ভালো৷ খেয়েদেয়ে বেরোতে বেরোতে সাতটা বেজে গেল৷ পোর্টার দু’জন এসে গেছে বাহাদুর সিং আর রায় সিং৷ বাহাদুরের গ্রাম ওসলা আর রায় সিং থাকে পোয়ানিতে৷ আগে একবার এসেছি৷ তাই চেনা রাস্তায় হাঁটা শুরু হল হর্-কি-দুন-এর উদ্দেশে৷
তমসা নদী পেরিয়ে কিছুটা চড়াই, তারপর মোটামুটি সোজা রাস্তা৷ একটু এগিয়ে নদীর অন্য পারে দেখা যায় এক সুন্দর ঝরনা৷ আকাশ সকাল থেকেই আজ মেঘে ঢাকা৷ ভয় হয় এই বুঝি বৃষ্টি নামল৷ পথের ধারে প্রচুর ফুল ফুটে রয়েছে৷ হলুদ রঙের ছোট্ট ফুল অজস্র৷ চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে সাদা ফুলের ছোটো ছোটো ঝোপ৷ যত সময় যাচ্ছে আকাশ তত পরিষ্কার হচ্ছে৷ সন্দীপ, বুড়োদা অনেক দূর চলে গেছে৷ সামনে পাহাড়ের মাথায় বরফ পড়েছে৷ এ বছর মনে হচ্ছে বরফ বুঝি একটু বেশিই পড়েছে৷ আস্তে আস্তে চোখের আড়ালে চলে গেল তালুকা৷ এই তো আকাশ আবার নীল হচ্ছে৷ সাদা মেঘ রয়েছে অল্প অল্প৷ ডানদিকে নিচে বয়ে চলেছে তমসা নদী৷ নেটওয়ারের কাছে সুপিন নদীর সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে নেমে গেছে কোথাও হয়তো কোনো বড়ো নদীর সঙ্গে মিশবে বলে৷ বাঁদিকে পাহাড়ের গা ঘন সবুজ ভেলভেটের মতো৷ তমসার ঝর ঝর শব্দ, ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা, চারিদিকের রংবেরঙের ফুল দেখতে দেখতে এসে পৌঁছোলুম এক দারুণ ঝরনার ধারে৷ ছবি তুলতে গিয়ে দেখি প্রথম রিল শেষ৷ দ্বিতীয় রিল লাগিয়ে যেই না ঝরনার ছবি তুলতে যাব, ব্যস ঘোর বিপত্তি৷ ক্যামেরার শাটার লক৷ ঝরনার ছবি আর তোলা হল না৷ শুধু তাই নয়, হর্-কি-দুন-এর আগে আর কোনো ছবি-ই তুলতে পারব না৷ যাই হোক, কী আর করা যাবে৷ হর-কি-দুন পৌঁছলুম পৌনে একটা নাগাদ৷
জায়গাটায় যেন ফুলের উৎসব৷ কত রকমের আর কত রঙের ফুল দেখে দেখে চোখের আশ মেটে না৷ রডোডেনড্রনও ফুটেছে বেশ কিছু৷ জি.এম.ভি.এন-এর বাংলোয় উঠলাম৷ খেয়েদেয়ে আবার বেরিয়ে পড়লুম৷ কোনো উদ্দেশ্য নেই, এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানো আর কী! সামনে অপূর্ব সুন্দর উপত্যকা সোজা চলে গেছে তমসা নদী ধরে যমদ্বার হিমবাহের দিকে৷ ডানদিকে স্বর্গারোহিনীর চূড়াগুলোর ওপর বরফ পড়েছে, তারা এখন মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে৷ যতদূর চোখ যায় ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে জায়গাটা৷ বেশ দেখেশুনে হাঁটতে হচ্ছে যাতে ফুল না মাড়িয়ে ফেলি৷ পাঁচ বছর আগে এখানে এসেছিলুম, তখন এত ফুল দেখিনি৷ ওটা অক্টোবর মাস ছিল, তাই হয়তো৷ পেছন ফিরে দেখলুম মারিন্দা তালের রাস্তা দেখা যাচ্ছে, কাল আমাদের ওই পথেই যাওয়া৷ এখানে বেশ ঠাণ্ডা লাগছে৷ আসলে বাইরে বেরোলেই ঠাণ্ডা হাওয়া গায়ে লাগছে৷ কাল একটু এগোলেই বোধহয় বরফ পাওয়া যাবে৷ বেশি বরফ থাকলে হয়তো সমস্যা হতে পারে৷ যাই হোক, এখন ভেবে লাভ নেই, যা হবার কাল দেখা যাবে৷ বাংলোর বারান্দায় বসে আমরা৷ সামনে স্বর্গারোহিনী উঁকি দিচ্ছে মেঘের আড়াল থেকে, সূর্যাস্তের লাল আভা তাদের চূড়ায়৷
সন্ধে হল প্রায় আটটা নাগাদ৷ ইতিমধ্যে রায় সিং বেশ কিছু কাঠ জোগাড় করে এনেছে৷ আগুনের ধারে বসে আড্ডা, কালকের প্ল্যান, ডান পায়ের হাঁটুতে ভোভেরান লাগানো এরই মাঝে এল রাতের খাবার৷ তারপর আর কী লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লুম৷ এখনও পর্যন্ত লেপ পাওয়া যাচ্ছে, কাল থেকে স্লিপিং ব্যাগে ঢুকতে হবে৷

আঠারোই জুন রাথাডোরে বিপর্যয়
ভোরবেলা উঠে এদিক ওদিক একটু ঘোরাঘুরি করতে করতেই বাজল সাড়ে ছ’টা৷ সঙ্গে আনা ম্যাগি নুডলস্ আর চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লুম৷ আজ যেতে হবে রাথাডোর৷ আকাশ ঝকঝকে নীল৷ ঘড়িতে সাতটা কুড়ি৷ বাংলো থেকে কিছুটা নেমে এসে নদী পেরিয়ে শুরু হল চড়াই৷ বেশ খানিকটা চড়াই ভাঙতে হল৷ এ পথে পড়ল অজস্র রডোডেনড্রন৷ প্রথমে চোখে পড়ল হালকা বেগুনি রঙের, তারপর সাদা আর হালকা হলুদ রঙের রডোডেনড্রনও দেখতে পেলুম৷ চারিদিকে পাহাড়ের গায়ে ছোপ ছোপ রং লেগে রয়েছে৷ পেছনে ঘন নীল আকাশের বুকে স্বর্গারোহিনীর ওপর সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ছে৷ আস্তে আস্তে ট্রি-লাইন পেরিয়ে এলুম৷ দু’ধারে পাহাড়, যদিও এদের মাথায় সেরকম বরফ নেই৷ আমরা চলেছি মাঝের উপত্যকা দিয়ে৷ ডানদিকে এক নদী বয়ে চলেছে নিচে গিয়ে তমসা নদীর সঙ্গে মিশবে বলে৷ জিজ্ঞেস করে জানলুম এই নদীর নাম মারিন্দা গাড৷ আমাদের সঙ্গে চলেছে স্রোতের শব্দ আর এক ছোট্ট পাখি৷ সেই ছোট্ট পাখি যেন আপন মনে খেলতে খেলতে উড়তে উড়তে ডানার ঝাপটায় সাদা রং ছিটিয়ে দিয়েছে সারা পাহাড়ময়, ছোপ ছোপ বরফ তাদের গায়ে৷ প্রায় ঘন্টা দুয়েক হাঁটার পর দেখি নদীটা একটু চওড়া হয়েছে৷ দু-তিনটে বিরাট পাথর নদীর মধ্যে থাকায় বেশ কিছু জায়গা জুড়ে জল জমে রয়েছে৷ এটাই মারিন্দা তাল৷
তাল হিসেবে এটা বেশ ছোটোই৷ ভাবলুম একটু বিশ্রাম নেব৷ তার কী জো আছে, সুলুকরামের তাড়া, “আরে সাব, ইত্‌‌না ধীরে চলেগা তো সাম হো যায়গা৷ ইধার ভালু হ্যায়।”
আসলে আমরা আজ খুব ধীরে ধীরে হাঁটছি৷ জানি যে আজকের রাস্তা খুব কঠিন নয়, কাল থেকে নাকি যা রাস্তা হবে, বোঝা যাবে কার কত দম! তার ওপর সারা জায়গাটাই নরম রোদ্দুরে মাখামাখি, মাথার ওপর নীল আকাশ৷ কতদিন পরে আবার এইরকম ঘন নীল দেখতে পাচ্ছি৷ আমাদের শহরে এইরকম আকাশ তো দেখাই যায় না৷ তাই যেদিকে তাকাই চোখ ফেরাতে পারি না, তারই ফল সুলুকরামের বকুনি৷
আবার হাঁটা শুরু৷ এতক্ষণ তবু একটা রাস্তা ছিল, এখন তার কোনো চিহ্ন নেই৷ নদীর ধার দিয়ে সোজা হেঁটে যাওয়া৷ এখানে ফুটে আছে নানান রঙের ফুল - হলুদ, বেগুনি, সাদা, লাল, নীল হরেকরকমের৷ বেশ কিছু ফুল আমরা হর্-কি-দুন-এ দেখতে পাইনি৷ একটা গাছ বা ঝোপজাতীয়ও কিছু নেই৷ শুধু ঘাস আর মাটির সঙ্গে লেগে থাকা লতাগুল্ম৷ আকাশ এখনও ঘন নীল৷
প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ পৌঁছোলুম রাথাডোর৷ এখানেই আজ তাঁবু ফেলা হবে৷ খুব সুন্দর জায়গা এই রাথাডোর৷ সামনের আবছা পায়ে চলা রাস্তা বোরাসু পাসের দিকে চলে গেছে৷ পাশেই এক ছোট্ট নদী পাথর থেকে পাথরে লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে নিজের মনে৷ তার ওপারে উঁচু পাহাড় উঠে গেছে৷ তার ওপর থেকে নেমে এসেছে পাশাপাশি দুটো বরফের চাদর৷ মাঝে মাঝে সেখান থেকে বরফ খসে পড়ছে, গড়াতে গড়াতে এসে পড়ছে মারিন্দা গাডের জলে৷ কিছু জায়গা ছাড়া সবুজের চিহ্নমাত্র নেই৷
আজ প্রকৃতি আমাদের সঙ্গে৷ চারিদিকে শুধু ভালো লাগা৷ হাঁটছি আমরা মনের আনন্দে৷ একটা জায়গা দেখি একটু ফাঁকা, নরম সবুজ ঘাসে মোড়া৷ মাঝে মাঝে মাথা উঁচিয়ে কয়েকটা বড়ো বড়ো পাথর৷ এটাই রাথাডোর৷ রাকস্যাক নামিয়ে রেখেছি সবে৷ ভারী স্যাক নামাতে পেরে মুখ দিয়ে আপনা থেকেই বেরিয়ে এল একটা শব্দ ‘আঃ’৷ একটু ক্লান্ত হলেও শরীর-মন বেশ তাজা৷
সুলুকরাম হাতছানি দিয়ে ডাকল৷ সামনে একটু বাঁ দিকে কোনাকুনি আঙুলের নির্দেশ৷ ‘উয়ো হ্যায় বোরাসু পাস!
লাফিয়ে এসে ঘিরে ধরি আমরা সবাই সুলুকরামকে৷ দূরে, অনেক দূরে একটুখানি দেখা যাচ্ছে বোরাসুর চূড়া৷ তারই একপাশে কোথাও বোরাসু পাস, ঘাপটি মেরে বসে আছে৷ আমাদেরই প্রতীক্ষায়! এক বিহ্বল আবেশে রাথাডোর থেকে দেখলুম প্রথম বোরাসু৷ সূর্যের আলোয় আবছা হওয়া রহস্যময় বোরাসু!
তাঁবু খাটিয়ে ফেলা হল৷ এবার ঠাণ্ডার মধ্যে একটু জমিয়ে কফি না খেলেই নয়৷ স্টোভ আর তার সরঞ্জাম বেরিয়ে এল এদিক ওদিক থেকে৷ তারপরই সর্বনাশ! যাকে বলে একেবারে ঘোর বিপর্যয়! স্টোভের ওয়াশার লাগাতে গিয়ে সেটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল৷ খুঁজে দেখা গেল আর কোনো ওয়াশার নেই৷ আমাদেরই ভুল৷ এই সামান্য জিনিসটার যে এত দাম, সেটা যে কেন আমরা খেয়াল করিনি... এবার কী হবে ভাবতে পারলুম না৷ সেই কথায় আছে যে মানুষ ঠেকে শেখে৷ আর আমরা এমন ঠেকে শিখলুম সারাজীবন মনে থাকবে৷ হয় ফিরে যেতে হবে, আর না হয় খুব ঝুঁকি নিয়ে এগোতে হবে৷ এখানে বা সামনে অন্তত দু’দিন কাঠ পাওয়া যাবে না৷
জয়া কোথা থেকে একটা ছেঁড়া কাপড় জোগাড় করে ওয়াশার তৈরির কাজে লেগে পড়ল৷ আমি পায়চারি করতে শুরু করলুম৷ এতদিন পরে পাহাড়ে এসে বোরাসু পাস কি তাহলে যেতে পারব না? সন্দীপ দূরে একটা পাথরের ওপর বসে পড়ল৷ বুড়োদা একদৃষ্টিতে পাহাড়ের গায়ে বরফের দিকে চেয়ে রয়েছে৷ বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল৷ অনেকক্ষণের চেষ্টায় জয়া কোনোরকমে একটা ওয়াশার তৈরি করে ফেলল৷ আমরা সব লাফিয়ে উঠলুম যখন স্টোভ জ্বলল৷ একটু নিশ্চিন্ত৷ কফি আর ম্যাগি খেয়ে ভাবতে বসলাম এরপর কী হবে? কারণ এই ভাবে তো সামনের তিনদিন স্টোভ জ্বালানো মুশকিল৷ যদি না জ্বলে তাহলে ঘোর বিপত্তি৷ শুধু শুকনো খাবার, মানে বিস্কুট আর চানাচুর খেয়ে মাইলের পর মাইল হাঁটব কী করে?
সুলুকরাম আর রায় সিং নিচে নেমে গেল যদি কিছু কাঠ পাওয়া যায়৷ আমরা এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছি; কী করব কিছু বুঝে পাচ্ছি না৷ মাথায় মাঝে মাঝে কিছু উদ্ভট ভাবনা আসছে, যেগুলো দিয়ে আর যাই হোক ট্রেকিং করা সম্ভব নয়৷ এর মধ্যে বুড়োদার সেই বৈপ্লবিক প্রস্তাব৷
“আরে কোনো ব্যাপার নয়,” বুড়োদার ঘোষণা, “আমার মাথায় একটা ব্যাপক প্ল্যান এসেছে।”
“আবার কী প্ল্যান? তাপসের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি, তারপর আমার দিকে ফিরে, “এত তাড়াতাড়ি অলটি হলে তো মুশকিল!' অলটি মানে অলটিচিউড সিকনেস্৷
“আরে, প্রত্যেকে স্যাকের মাথায় চারটে বড়ো কাঠ বেঁধে নেব৷ পাঁচ জন আছি, পাঁচ দিন চলে যাবে৷ কী বল?
“হ্যাঃ৷ কোনো আইডিয়া আছে? একেকটা কাঠের ওজন প্রায় এক কিলোর ওপর৷ আমাদের স্যাকের ওজন অলরেডি চোদ্দো-পনেরো কিলো হবে৷ তার ওপর আরও পাঁচ কিলো, বইতে পারবে!! আড়চোখে তাকিয়ে তাপসের গম্ভীর মন্তব্য৷
“ওরে বাবা, না না, এমনিতেই বড্ড ভারী লাগছে... তার মধ্যে কী ঠাণ্ডা! বুড়োদার তৎক্ষণাৎ উত্তর৷
পাহাড়ে এলে সন্দীপের মধ্যে মাঝে মাঝে আবার একটু সন্ন্যাসী সন্ন্যাসী ভাব জাগে৷ উদাসভাবে তাকিয়ে রইল৷ ভাবটা যেন ‘কী আর করা যাবে...
ঠাণ্ডা বাড়ছে, সূর্যের তেজও কমছে৷ এই জায়গাটায় যেন একটু বেশি হাওয়া৷ বেশ কিছুক্ষণ পরে রায় সিং ফিরে এল বিরাট লম্বা এক কাঠ নিয়ে৷ ঐকিক নিয়ম দিয়ে আমি আর তাপস বার করে ফেললুম যে অন্তত তিনবার রান্না করা যাবে এই কাঠ দিয়ে৷ তাহলে তিন দিন রান্না করে খাওয়া, আর এক-দু’দিন শুকনো খাবার মনে হয় কষ্ট করে হয়ে যাবে এ যাত্রায়৷ রায় সিং-এর কাছে শুনলাম সুলুকরাম হর্-কি-দুন চলে গেছে ওয়াশারের খোঁজে৷
বিকেল পাঁচটা নাগাদ আবার রান্না চাপাতে হল, কাঠের আগুনে৷ রায় সিং তাঁবুর মধ্যে, বাহাদুর আর আমরা কাঠের আগুন নিয়ে কসরত করছি যাতে আগুন নিভে না যায়৷ সুলুকরাম ফিরে এল কিছু পরে, আরও কিছু কাঠ নিয়ে৷ খিচুড়ি তৈরি৷ এই অবস্থায় খিচুড়ির স্বাদ যেন পোলাও-এর মতো লাগল৷
রাথাডোরে আমরা যেখানে তাঁবু ফেলেছি, তার কাছেই একটা পাথরের ঘর আছে; ঘর মানে স্লেটের মতো পাথরের ওপর পাথর চাপিয়ে একটা পাথরের ইগলু তৈরি করা হয়েছে৷ ইগলুর মতনই হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয়৷ বেশ কিছু কাঠ জোগাড় হয়েছে, রাতের খাওয়াও শেষ৷ ঠাণ্ডার প্রকোপও বাড়ছে৷ রান্নার আগুন প্রায় নিভু নিভু হাওয়ার ধাক্কায় কমলা-হলুদ আগুনের ফুলকি উড়ে বেরিয়ে কালো অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে৷ মাথার ওপরে ঘন কালো আকাশে হাজার হিরে ঝকমক করছে৷ সামনের পাহাড়ে সাদা বরফের সেই আচ্ছাদন দু'টো জড়ামুড়ি করে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ গল্প আর ঠিক জমছে না৷ সাঁই সাঁই হাওয়ার শব্দ, দূরে ঝোপঝাড়ের মাঝে মাঝে হয়তো কোনো নিশাচর প্রাণীর গা ঘষার হালকা আওয়াজ৷ পাশে মারিন্দা গাডের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ আর নেই৷ সে এখন ফিসফিসে স্বরে বলে, ‘এবার শুয়ে পড়ো, সামনের রাস্তা অনেক লম্বা আর কঠিনও কিন্তু৷ ঘুমিয়ে চাঙ্গা হয়ে যেতে হবে সেই বোরাসু গিরিবর্ত্মে, বরফের রাজ্যে...।’
সন্দীপ এতক্ষণে সন্ন্যাসী ভাব ছেড়ে বলে উঠল, “অনেক হয়েছে৷ আমি চললুম পাথরের ঘরে, ভোরবেলার আগে আমাকে কেউ ডাকবে না।” মুহূর্তের মধ্যে সন্দীপ হাওয়া!
সুলুকরাম, রায় সিং আর বাহাদুর রয়েছে একটা ফোর মেন টেন্টে৷ কালকে আমাদের যেতে হবে শ্যাওড়া বীডা৷ জয়া একটু যেন চুপচাপ হয়ে গেছে হঠাৎ! ন্যাকড়া দিয়ে ওয়াশার তৈরি করে ও এখন আমাদের হিরো! তাপসের ভ্রূ কোঁচকানো মনে হচ্ছে! হয়তো কালকের ব্যাপারে চিন্তায় আছে...
সবার শেষে আমি আর বুড়োদা যখন পাথরের ইগ্‌‌লু-কাম-স্যুইটে ঢুকলুম, সন্দীপ ঘুমে কাদা৷
(এরপর আগামী সংখ্যায়)
_____
ফোটোঃ তাপস মণ্ডল

No comments:

Post a Comment