গল্পের ম্যাজিক:: এই ভালো! - চুমকি চট্টোপাধ্যায়


এই ভালো!

চুমকি চট্টোপাধ্যায়

স্কুল থেকে ফিরে খেয়ে একটু বসতে না বসতেই চারটে বেজে গেল। উফ্, ভাল্লাগে না! কান্না পেয়ে যায় মেঘলার। এখুনি অঙ্ক স্যার চলে আসবে। রবিবার ছাড়া আর একটা দিনও ফাঁকা নেই যে নিজের মতো চলব। হয় পড়া, নয় আঁকা শেখা, নয় গান শিখতে যাওয়া... ধুর!
ভাবতে ভাবতেই চোখ গেল পাশের যুবিনদাদের ছাদে। ওদের পোষা হুলোটা আরাম করে ঘুমোচ্ছে। দেখেই ঘুমোতে ইচ্ছে করল মেঘলার। কিন্তু সে উপায় তো নেই!
মা বলে, এখন যে তুই এত পরিশ্রম করছিস, দেখবি একদিন ঠিক তার ফল পাবি। অনেক বড়ো চাকরি করবি, অনেক টাকা রোজগার করবি। তখন নিজের ইচ্ছেমতো বাঁচতে পারবি। তার জন্য একটু কষ্ট তো করতেই হবে, তাই না?
এই লোভ দেখিয়ে মা বেশ পড়া থেকে শুরু করে গান, আঁকা সবকিছু করিয়ে নেয়। আবার সেদিন বাবাকে মা বলছিল, মেঘলাকে কম্পিউটার সেন্টারে ভর্তি করে দিলে হয়। এখন তো এসব না জানলে বড়ো কোনো চাকরিবাকরি পাওয়া যায় না। খুব কাজের জিনিস। এখন ওর বয়েস কম আছে, তাড়াতাড়ি ধরতে পারবে।”
এই রে! আবার একটা নতুন ক্লাস! তার মানে রবিবারটাও গেল! কান্না পেয়ে যায় মেঘলার। কিন্তু এখন তো ও ছোটো, বাবা-মা যা চাইবে সেটাই ওকে করতে হবে। এই সব চিন্তা করতে করতেই দেখল, হুলোটা আড়মোড়া ভাঙছে। ইস্, বেড়াল হলে বেশ হত। কেমন সারাদিন আলসেমি করে কাটে ওদের। কোনো চিন্তাভাবনা নেই। খায় আর ঘুমোয়। মাঝেমধ্যে পাড়া বেড়িয়ে আসে।’ এমন সময় বেল বাজল... ওই অঙ্ক স্যার এল।
ঠিক দুদিন বাদেই মেঘলা স্কুলে যাবে বলে রেডি হচ্ছে, এমন সময় বাবুসোনাদের বাড়ি থেকে বেশ একটা শোরগোল শোনা গেল। বাবুসোনাদের বাড়ি যুবিনদাদের বাড়ির ঠিক পাশেই।
কী ব্যাপার? না, হুলো বাবুসোনাদের রান্নাঘরে ঢুকে গোপালের পায়েস বানানোর জন্য রাখা দুধে মুখ দিয়েছে শুধু নয়, বাটিটাও উলটে দিয়েছে। ওদের ঠাকুর পরমানন্দ হাতের খুন্তি ছুঁড়ে মেরেছে। হুলোর পেছনের ডান পায়ে ভালোই লেগেছে। রক্ত বেরোচ্ছে।
হুলোটাকে দেখতে পেয়েছে মেঘলা। মনটা খারাপ লাগছে। কেন রে তুই অন্যের বাড়ি চুরি করে খেতে গেছিস? খেলি তো মার? নাহ্, বেড়াল হওয়া যাবে না। পোষা বেড়ালেই যদি চুরি করে খায়, তাহলে রাস্তার বেড়ালগুলো কী করবে?
আজ স্কুলে গল্প বলার ক্লাস ছিল। প্রত্যেক সপ্তাহে পাঁচ জনকে ছোটো ছোটো গল্প বলতে হয়। আজ মেঘলার বলার দিন। ওর মনে পড়ে গেল হুলোর কথা। সকালের ঘটনাটা গল্পের মতো করে বলল সে। টিচার খুব ভালো বললেন শুনে। অন্য বন্ধুরাও হাততালি দিল।
স্কুল থেকে ফেরার পথে বাসটা জ্যামে দাঁড়িয়েছিল। মেঘলার মনে আবার মেঘ জমল। আজ গানের ক্লাস আছে পাঁচটা থেকে। গান শিখতে ওর ভালোই লাগে, কিন্তু এইভাবে নয়। ছুটির দিনে বেশ আরাম করে গান করতে পারলে ভালো হত। আঁকাও তাই।
হঠাৎই লাইট পোস্টের তারে চোখ যায় মেঘলার। কি সুন্দর নীল সবুজ আর কালোয় মেশানো ছোট্ট একটা পাখি বসে আছে তারে। দোল খাচ্ছে একটু একটু। আচ্ছা, পাখিরা কী করে?
পাখিদের তো তেমন কোনো কাজ নেই। ওরা উড়ে উড়ে বেড়ায়, খিদে পেলে কেউ ফুলের মধু খায়, কেউ ফল খায়, কেউ কেউ রাস্তায় পড়ে থাকা খাবার খায়। পোষা পাখিরা অনেক ভালো ভালো খাবার খায়। কিন্তু পোষা পাখিরা খাঁচায় বন্ধ থাকে। না-পোষা পাখিরাই ভালো। কত দেশ উড়ে বেড়াতে পারে। যেখানে ইচ্ছে যেতে পারে।
পাখি হবার সাধ ভীষণ ভাবে জেগে ওঠে মেঘলার মনে। রাত্রে শোবার আগে, সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রার্থনার সময় রোজ বলা শুরু করে, ঠাকুর, আমাকে পাখি করে দাও।’
রবিবার বিকেলে ছাদে গেছিল মেঘলা। ওর বাবাও সঙ্গে গেছিল। বাবার সঙ্গে গল্প করতে করতে পাক খাচ্ছিল মেঘলা, এমন সময় একটা চড়াই পাখি উড়ে এসে বসল ছাদের পাঁচিলে। উত্তেজনায় মেঘলা বাবা দেখো চড়াই বলতে না বলতে কোত্থেকে একটা চিল এসে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল চড়াইটাকে। ককিয়ে উঠল মেঘলা।
ওর বাবা বলল, খাদ্য খাদকের সম্পর্ক যে! দুনিয়ার এমনই নিম। এখানে কাউকে দোষ দেওয়া যাবে না। মন খারাপ করিস না।’ মেঘলা বুঝল, পাখি হওয়া সুবিধের হবে না। ওই চিল-টিল হয়েও লাভ নেই। বিচ্ছিরি দেখতে! আর কাঁচা জিনিস খায়... ইহ্, ঘেন্না ঘেন্না!
এই মাসের শেষের দিকে তিনদিন টানা ছুটি আছে। কোথাও একটা ঘুরে এলে হয়...’ বাবা বলল মা-কে, মেঘলা শুনল। মনটা নেচে উঠল ওর। কী মজা! তিনদিন পড়া নেই, গান নেই, আঁকা নেই!
মেঘলার বাবা ফ্রেজারগঞ্জ গেল ওদের নিয়ে। কী সুন্দর হোটেলটা, সমুদ্রের ধারে। ঘরে বসেই সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। আর সুন্দর হোটেলের সামনের বাগানটা। মেঘলা তো ভোর হতে না হতেই বাগানে চলে আসছে। কত ফুল আর কত প্রজাপতি! প্রজাপতি কী সুন্দর দেখতে!
ওই সাদা আর হলুদ মেশানো প্রজাপতিটা বেশি সুন্দর। এরকম প্রজাপতি ও কোনোদিন দেখেনি। কলকাতার প্রজাপতিগুলো কেমন কালচে মতো।
প্রজাপতিদের কত মজা, শুধু ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ানো আর মধু খাওয়া। এইবার পেয়েছি! আমি প্রজাপতি হব। প্লিজ, ঠাকুর প্লিজ, আমাকে প্রজাপতি করে দাও! ফিরে গিয়েই তো আবার সেই বোরিং রুটিন!
সারাদিনই মনে মনে দেবতার উদ্দেশে কাকুতি মিনতি চলল মেঘলার। বড়োই পছন্দ হয়েছে প্রজাপতি পতঙ্গটা।
আজ সকালটাই শুধু এখানে থাকা, বিকেলেই ফিরে যাওয়া বাড়িতে। মেঘলা তাই যত বেশি সময় সম্ভব বাগানে কাটাচ্ছে। সমুদ্রেও গেছে দুবার, বাবা-মার সঙ্গে। মেঘলার আবার সমুদ্রের থেকে এই বাগানটা বেশি ভালো লাগছে। সমুদ্রে স্নান করলেই একগাদা বালি লেগে যায়, ঝামেলা!
ফুল গাছের পাশে পাশে ঘুরতে ঘুরতে মেঘলার নজরে পড়ে একটা গাছে নিচে পড়ে আছে সেই সাদা-হলুদ প্রজাপতিটা। কী হয়েছে ওর! ঝুঁকে বসে পড়ে মেঘলা। আলতো করে হাতে তুলে নিয়ে ঘরে এসে মাকে দেখায়।
- মা, প্রজাপতিটার কী হয়েছে?
- ও আর বেঁচে নেই সোনা, ওকে যেখান থেকে তুলে এনেছ সেখানেই রেখে এসো।
- কিন্তু মা, কালকেও আমি ওকে ওড়াউড়ি করতে দেখেছি। এক দিনের মধ্যেই মরে গেল?
- এই ধরনের ছোটো ছোটো প্রজাপতিরা মোটামুটি একমাস মতো বাঁচে। ওর আয়ু ফুরিয়ে গেছে, চলে গেছে। এই নিয়ে মন খারাপ কোরো না আবার!
মনটা তো একটু খারাপ হলই মেঘলার। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে আর একটা কথা মনে হল, প্রজাপতি হয়ে কাজ নেই। এত কমদিন বাঁচলে তো কিছুই করা হবে না, দেখা হবে না।’
এবার বাড়ি ফেরার পালা! বাসে উঠে জানলার ধারের সিটে বসল মেঘলা। বাস চলতে শুরু করল। বেশ জোরে ছুটছে বাস। হাওয়ায় চুল এসে ঝাপটা মারছে মেঘলার মুখে। সূর্য কমলালেবু রঙের হয়ে গেছে। এখন বেশ তাকানো যাচ্ছে সূর্যর দিকে।
দেখতে দেখতে টুপ করে ডুবে গেল সূর্য। যে গাছগুলো, বাড়িগুলো সোঁ সোঁ করে পিছিয়ে যাচ্ছিল, তাদের আর দেখা যাচ্ছে না, ওর মনে হচ্ছে যেন পক্ষীরাজে করে উড়ে যাচ্ছে কোথাও।
মা বলল, কাঁচটা নামিয়ে দিই মেঘলা, এত হাওয়া লাগছে মুখে গলায়, ঠান্ডা লেগে যাবে।” বাসের ভেতরের আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। চোখ লেগে গেল মেঘলার। স্বপ্ন দেখল চোখ ধাঁধানো আলোর সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে বলছে, আমি মানুষই থাকতে চাই ঠাকুর। তুমি আমাকে খুব ভালো একজন মানুষ তৈরি কোরো।’
_____
ছবিঃ কৃষ্ণেন্দু মণ্ডল

5 comments:

  1. ছোটর মধ‍্যে সুন্দর মেসেজ। মিষ্টি গল্প।

    ReplyDelete
  2. চুমকি-ম্যাডাম,গল্পটা পড়লাম। কী সাবলীল ঝরঝরে লেখা, যেন বহতা ন! কুলকুল করে বয়ে গেল!এত সহজ কথা এত সহজে বললেন যে মন ভরে গেল একেবারে! সেই সঙ্গে নবীন প্রজন্মের শৈশব-হারানোর জন্যে দায়ী তাদের ওপর আরোপিত চাপের ব্যাপারটা মনে করিয়েও দিলেন...সরাসরি না বললেও বোঝাতে চাইলেন---এই চাপ কিছুটা শিথিল হতে তো কোনো বাধা নেই! এমন মনছুঁয়ে যাওয়া গল্প উপহার দেওয়ার জন্যে অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে চুমকি-ম্যাম এবং শুভেচ্ছা অন্তহীন।

    ReplyDelete