গল্পের ম্যাজিক:: টান - সহেলী চট্টোপাধ্যায়


টান
সহেলী চট্টোপাধ্যায়

আমাদের বিল্টুদা বিদেশ চলে যেতে চাইছে। তার বহুদিনের স্বপ্ন বিদেশ চলে যাবে। ওখানে সবকিছুই ভালো, এখানে সব খারাপ লাগে। সত্যি, ওয়েদার খুব খারাপ। সবকিছুই খারাপ এখানে। খবরের কাগজ আর চ্যানেল খুললেই বোঝা যায় সব খারাপ এখানে। কখনও ডাক্তাররা মার খাচ্ছে, কখনও শিক্ষকরা মার খাচ্ছে। মারপিট, বোমাবাজি তো লেগেই আছে। তাই বিল্টুদা এখানে আর থাকবে না। বিদেশ চলে যাবে। কিন্তু চলে যাব বললেই তো আর যাওয়া হয় না। এর জন্য অনেক প্রস্তুতি লাগে। বিল্টুদা তেমন চাকরি করে না যে অফিস থেকে যাওয়ার সুযোগ পাবে। পড়াশোনা করতে যাওয়ার সুযোগও নেই। বাড়িতে কোচিং ক্লাস করে প্রাইভেট টিউশন করায় আর চাকরির পরীক্ষা দেয়। আমরাও ওর কাছেই পড়তাম। বয়স তিরিশ হতে চলল। বাড়িতে মা আর বাবা। কাকাবাবু, মানে বিল্টুদার বাবা রাগ করে ছেলেকে বিল্টে বলে ডাকেন। ভালো চাকরিবাকরি না থাকলে ছেলেদের আর বাবারা খাতির করে না। বিল্টুদারও হয়েছে সেই সমস্যা। তবে কাকিমা বিল্টু বলতে অজ্ঞান। বিল্টুদার ভাই বেশ মেধাবী। ব্যাঙ্গালোরে সে ভালো চাকরি করে। কাকাবাবুর নিল্টুদা মানে বিল্টুদার ভাইকে নিয়ে গর্বের শেষ নেই। সে মাঝে মাঝে আসে। চাকরিতে ছুটি বিশেষ পায় না।
আমাদের গল্প বিল্টুদাকে নিয়ে। নিল্টুদার গল্প আরেকদিন হবে। বিল্টুদা বিদেশ যাবার জন্য পাগল। যেন বিদেশে যেতে পারলেই জীবন ধন্য হয়ে যাবে।
বিল্টুদা কিছু সমাজ সেবা করে। গরিব ছেলেমেয়েদের বিনা মাইনেতেই পড়ায়। প্রত্যেককে বলা আছে কোন সমস্যায় পড়লে তারা যেন বিল্টুদাকে বলে। বিল্টুদা সাধ্যমতো চেষ্টা করে। গতবছর সে একটি বাচ্চা মেয়ের বিয়ে রুখে দিয়েছিল নিজের বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে। এদিকে বস্তি আছে, কিছু দিন আন দিন খাওয়া শ্রেণীর মানুষ বাস করে। বিল্টুদা এদের ছেলেমেয়েদের পড়ায়। কাকাবাবুর ভাষায় ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। আমরা মাঝে মাঝে প্রশ্ন করি। আমরা মানে আমি রঞ্জন, কৌশিক, ঋষি আর নির্বাণ।
হ্যাঁ গো বিল্টুদা, তুমি বিদেশে গিয়ে থাকবে কী করে? তোমার এখান ছেড়ে যেতে ভালো লাগবে? এত ছেলেমেয়েদের গাইড করো, বিদেশে এসব পাবে কি?
বিল্টুদা হাসে, উত্তর দেয় না।
এর মধ্যে নিল্টুদার বিয়ে হল। বৌদিকে নিয়ে নিল্টুদা বিদেশ চলে গেল।
বিল্টুদা আর বিয়ে করল না। আমরাও আস্তে আস্তে বড়ো হয়ে গেলাম। সবাই স্কুল থেকে কলেজ, তারপর কলেজ থেকে চাকরির চেষ্টায়। আমাদের আর রোজ দেখা হয় না। অবশ্য রবিবার বিকেলে আমরা রোজ দেখা করি। হয় সেটা চায়ের দোকান বা কোন পার্ক বা লেকের ধারে। সন্ধেটা আমরা একসঙ্গে কাটাই। নটার আগে বাড়িই ফিরি না সেদিন
নির্বাণ বলল, জানিস, আজ বিল্টুদাকে দেখলাম।
আমরা আজ পাড়ার চায়ের দোকানে বসেছি।
কৌশিক বলল, সে তো আমরা রোজই দেখি। এক পাড়ায় আছি, দেখা হওয়া তো স্বাভাবিক।
নির্বাণ বলল, আজ সকালে বাবাকে নিয়ে মেডিকেয়ারে চেক-আপে গেছিলাম। বিল্টুদাও কাকাবাবুকে নিয়ে এসেছে দেখলাম। কাকাবাবু সারাক্ষণ নিল্টুদার প্রশংসা করে গেলেন। বললেন, খুব ভাগ্য করে নিল্টুর মতো ছেলে পেয়েছি। সে আরও উন্নতি করেছে। কেমন বাড়ি কিনেছে টেক্সাসে! ছবি পাঠাব তোমাদের। আমাদের যেতে বলে বারবার। আমার খুব যাওয়ার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু শরীরের জন্য সাহস হয় না। আর বিল্টুকে দেখুন, জীবনে কিছুই করতে পারল না। বিয়ে-থাও করল না। ওকে দেখলে খুব কষ্ট হয়। ডাক্তার দেখানোর পর দেখলাম বিল্টুদা কাকাবাবুকে হাত ধরে টোটোতে ওঠাচ্ছে। আমার বাবা বলল - সত্যিই চ্যাটার্জিদা অনেক ভাগ্যবান কিন্তু খুব বোকা। নিল্টুর জন্য যেমন গর্ব করেন, বিল্টুর জন্য আরও বেশি করা উচিত। আমাদের পাড়ার সবাইকে ও আগলে রেখেছে।
এই ঘটনা শুনে আমাদের খুব খারাপ লাগল। বিল্টুদার মার মুখে শুনেছি, নিল্টুদার বউ তেমন ভালো ব্যবহার করে না। নিল্টুদা মাঝেসাঝে কিছু টাকা পাঠায় এবং ফোনও মাঝেসাঝেই করে, রোজ করে না। বৌদি ওদের যেতেও বলে না। তবু সব বাবা-মাই ছেলেমেয়েদের সফলতা আর আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যই কামনা করেবিল্টুদার সফলতা কেউ বুঝবে না।
তারপর কেটে গেল আরও কিছুদিন। বিল্টুদার সঙ্গে এখন দেখা হয় এবং ও বিদেশ চলে যাবার কথা বলে। বলে, ওখানে একটা কাজ পেলে আর এই পোড়ার দেশে ফিরব না।
বেশ তো, যাও না। তোমার তো ভাই আছে,” ফুট কাটে ঋষি
আমাদের মধ্যে সবার আগে ওরই জব হয়েছে। আমি আর কৌশিক এখন পাইনি। নির্বাণ একটা পেয়েছে, কিন্তু ওর ভালো লাগছে না কাজের পরিবেশটাতাই ও ছেড়ে দেবে কিনা ভাবছে। সত্যি, কত সমস্যা আমাদের।
বিদেশে যাওয়ার সু্যোগ এসে গেল বিল্টুদার। টেক্সাসে নিল্টুদার কাছেই যেতে হল। বিল্টুদা কাকিমাকে পৌঁছে দিতে গেল। কাকু আগেই মারা গেছেন। বৌদির শরীর ভালো নেই তাই কাকিমাকে যেতে হল।
আমাদের সঙ্গে হোয়াটস অ্যাপে কথা হয় বিল্টুদার। ও ছবি পাঠায়। সবকিছুই খুব সুন্দর সে দেশে। বিল্টুদা লিখেছে, পূর্বজন্মের সুকৃতি না থাকলে ওদেশে যাওয়া বা বাস করা যায় না।
থাকতে থাকতে বিল্টুদা ওখানে একটা চাকরি নিয়ে নিল। ভাষা শিখে নিয়েছিল আগেই। নিল্টুদা আর বৌদির একটা মেয়ে হয়েছে। বৌদির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কাকিমাও খুব ভালো আছেন। আস্তে আস্তে মায়ায় জড়িয়ে পড়ছে বিল্টুদা। বেশ কিছু বছর হয়ে গেছে তারা বাইরে। এখানে আর ফিরবে বলে মনে হয় না। বাড়িটা এবার বিক্রি করে দেবে নিশ্চয়আমরা নিজেদের মধ্যে জল্পনা করি। বিল্টুদাদের বন্ধ বাড়িটা দেখলে বুকটা হু হু করে ওঠে। বাগানটা একদম নষ্ট হয়ে গেছে। কাকাবাবুর শখের বাগান ছিল। একসময় কত দৌরাত্ম্য করেছি। এই বাড়িতে বিল্টুদার কাছে পড়তে আসতাম। লক্ষ্মীপুজো, সরস্বতী পুজোয় কত হইচই। সেসব দিন এখন কোথায়? আমরাই মাঝে মাঝে তালা খুলে বাড়ি পরিষ্কার রাখি। আর সেটা করতে গেলেও খুব কষ্ট হয়। পুরনো স্মৃতি সব ভিড় করে আসে। কৌশিক জ্যামিতি পারছে না বিল্টুদা না বকে ভালোরে বুঝিয়ে যাচ্ছে। বিজয়ার প্রণাম করতে গেছি কাকিমা অনেক কিছু খেতে দিয়েছেন। কখনও ছাদে সবাই ঘুড়ি ওড়াচ্ছি। আমাদের হাতেই কাকিমা চাবি দিয়ে গেছেন।
দেখতে দেখতে বছর ঘুরে গেল। বিল্টুদা আমাদের সঙ্গে আর বেশি যোগাযোগ রাখে না। অনেক সময়ই মেসেজের উত্তর দেয় না। আমরা ওকে ভালোবাসি আর ওর দেখানো পথে চলার চেষ্টা করি। আমাদের রবিবারের আড্ডা রোজ হয় না সময়ের অভাবে। আমরা চেষ্টা করি একজোট হওয়ার। মাসে একদিন বা দুদিন দেখা হয়। ঋষি বিদেশে চলে গেছে নিজের কাজের সূত্রে।
এক রবিবার সন্ধেবেলা কৌশিক, নির্বাণ আর আমি বসে আছি চায়ের দোকানে। একটা গাড়ি এসে থামল। গাড়ি থেকে যে নামল তাকে দেখে আমরা এগিয়ে এলাম হুড়মুড় করে। বিল্টুদাকে দেখে আমরা তো হাঁ। কী ভালো দেখতে হয়েছে! হবে না? টেক্সাসের জল গায়ে পড়েছে যে!
বিল্টুদা, তুমি ফিরে এলে? আমাদের খবর দিলে না কেন? আজকাল তো কথাই বলো না আমাদের সঙ্গে। ছুটি পেলে কতদিনের? কাকিমা কই?কত প্রশ্ন আমাদের।
হ্যাঁ। বিদেশে আর কতদিন থাকা যায়! তাই সব ছেড়েছুড়ে চলে এসেছি। মা নিল্টুর মেয়েকে সামলাচ্ছে।
সে ী! চাকরি ছেড়ে চলে এলে?
হ্যাঁ। এখানে বস্তির ছেলেমেয়েদের কী অবস্থা? তোরা ভালোভাবে টেক-কেয়ার করছিস তো?
আমরা ঘাড় নাড়লাম। বলতে ভুলেই গেছি, আমরা বিল্টুদার নির্দেশমতো ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করেছি যতটা সম্ভব।
নির্বাণ জিজ্ঞাসা করল, তাহলে তুমি কি ফিরে এলে? আর যাবে না ওখানে?
না রে! আমি ওখানে শান্তি পেলাম না। মন পড়ে থাকত তোদের জন্য, অসহায় ছেলেমেয়েদের জন্য। আমি ওখানে জব করে অনেক টাকা উপার্জন করেছি শুধু ওদের জন্য। এখন আরও মন দিয়ে সিরিয়াসলি কাজ করতে হবে। এখন চলি রে কাল রেস্ট নেব, পরশু তোদের সঙ্গে দেখা করব আর তখনই সব গুছিয়ে বলব।
চলি রে বললে হবে না তোমার বাড়ির চাবি তো আমার কাছে। বলেই নির্বাণ পকেট থেকে চাবির গোছা বার করে দোলাতে লাগল ওর নাকের সামনে। বিল্টুদা সেটা ছিনিয়ে নিয়ে বড়ো বড়ো পা ফেলে এগিয়ে চলল। হাত নেড়ে বলল, তাহলে পরশু দেখা হচ্ছে।
বিল্টুদা এগিয়ে চলল তার ট্রলিব্যাগ ঠেলতে ঠেলতে।
_____

1 comment:

  1. "ভালো চাকরি না পেলে বাবারা আর ছেলেদের খাতির করে না", এই কথাটা বেশ মনে রাখার মতো সত্যি। গল্পটা ভাল লাগল। তবে শেষটা আর একটু অন্যরকম হলে আরও ভালো হতো।

    ReplyDelete