জয়তী অধিকারী
রোজকার
মতোই আজও একদম ভোরবেলাতেই লামার চোখ খুলে গেল। তাড়াতাড়ি পাশে তাকিয়ে দেখে নিল সে
বড়োভাই বিরজু উঠে পড়েছে নাকি এখনও ঘুমোচ্ছে। তখনও ওঠেনি দেখে লামা একটু নিশ্চিন্ত
হল। যাক বাবা, আজ তাহলে বিরজু আর ওকে ছেড়ে চলে যেতে পারবে না। না হলে রোজ পাহাড়
থেকে সন্ধেবেলা ফিরে এসে বলে, “লামা, তুই এখনও ছোটো আছিস। আর একটু বড়ো হয়ে যা। আমি
তোকে আমার সঙ্গে পাহাড়ে নিয়ে যাব।”
লামারা
দুই ভাই তাদের বাবা, মা আর কাকার সঙ্গে উত্তরাখন্ডের এই পাহাড়ীতেই থাকে। জন্ম
থেকেই সে দেখে এসেছে পাহাড়ের কোলে একটা ছোট্ট পাথরের ঘরে তাদের বাস। তার সামনে একফালি
জমিতে ভুট্টার চাষ আর গোটা দশেক ছাগল-ভেড়া নিয়ে তাদের সংসার। বাবা মাঝে মাঝেই ট্যুরিস্টদের
নিয়ে আরও অনেক উঁচু পাহাড়ে চলে যায়। এক-দু’মাস পরে আবার ফিরে আসে। তখন তাদের
বাড়িতে যেন উৎসব লেগে যায়। বাবা কত জিনিস আনে তাদের জন্যে। রাতে লামা তখন ওর বাবার
কাছে গিয়ে গা ঘেঁষে শোয়। বাবাও তখন সেই বরফ পাহাড়ের গল্প শোনায় তাদের। লামার খুব
ভালো লাগে শুনতে। সে শোনে আর ভাবে কবে সে বাবার মতো বড়ো হবে আর ওই উঁচু পাহাড়ে
যাবে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে লামা স্বপ্ন দেখে সে আর বিরজু অনেক উঁচু পাহাড়ে গেছে। সেখানে
সূর্য আরও অনেক উজ্জ্বল, আর বরফে মোড়া রাস্তায় কনকনে ঠান্ডা হাওয়া। লামা আর বিরজু
তখন আর এই ভেড়ার চামড়ার গরম জামা পরবে না, বাবার মতো ওই মোটকা জ্যাকেট পরে যাবে।
“কী
হল লামা? আজ স্কুলে যাবি না?” বিরজুর কথায় লামা যেন তার স্বপ্নের রাজ্য থেকে
বাস্তবে ফিরে এল।
“না
দাদা, আজ আমি তোমার সঙ্গেই যাব।”
“আমার
সঙ্গে কোথায় যাবি? আমি তো ছাগল আর ভেড়া চরাতে যাব।”
“আমিও
যাব দাদা। তোমাকে ভেড়া গুনে আনতে সাহায্য করব। আমি এখন পঞ্চাশ পর্যন্ত
গুনতেও পারি। মাস্টারজি বলেছে আমি নাকি ক্লাসে সবথেকে ভালো গুনতে শিখেছি।”
ঘর
থেকে বেরিয়ে এসে বিরজু ওর মাকে জিজ্ঞাসা করল যে সে লামাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে কিনা।
মাকেও লামা এতবার বলেছে যে আজ তিনিও ‘না’ বলতে পারলেন না।
“আচ্ছা,
যাক তাহলে। কিন্তু লামা, খবরদার খাদের দিকে যাবে না কিন্তু। আর দাদাকে বিরক্ত করবে
না।”
লামা
তার মাকে ঘিরে দু’পাক নেচে নিল। কাল স্কুলে গিয়েই ভীমাকে গল্প করতে হবে আজ সারাদিন
সে ‘ভেড়-বকরী’ চরিয়েছে পাহাড়ে, একদম বড়োদের মতো। ভীমাকে সব কথা না বললে তার খাবার
হজমই হয় না। ভীমা যে তার একমাত্র কাছের বন্ধু।
পাহাড়ে
ভোরের আলো ফুটলেই দিনের কাজ শুরু হয়ে যায়। যদিও কোনো ব্যস্ততা চোখে পড়ে না, কিন্তু
সূর্যের সঙ্গেই তাদের সমস্ত কাজের নিয়ম বাঁধা। সন্ধে হওয়ার আগেই বাড়ি না ফিরতে
পারলে সমূহ বিপদ।
দুই
ভাইকেই খাইয়ে দুপুরের খাবার টিফিনবাক্সে ভরে দিয়ে দিল ওদের মা। আর সঙ্গে জলও। তাদের
এগিয়ে যেতে দেখে কপালে একবার হাত ঠেকিয়ে মনে মনে বলল, ‘রক্ষা কোরো ঠাকুর।’
“চল
লামা, এই গাছের ডালটা নে। কোনো ভেড়া বা ছাগল পাহাড়ের পথে এদিক ওদিক চলে গেলে
তাড়িয়ে নিয়ে আসবি। কেমন?”
“আচ্ছা
দাদা,” আজ তো লামা দাদার কথায় উঠছে আর বসছে। না হলে অন্যদিন এতক্ষণে দু’বার
মারপিটও হয়ে যেত হয়তো। কিন্তু আজ লামা ঠিক করেই নিয়েছে কোনো অবস্থাতেই দাদার
অবাধ্য হবে না আর দাদার সঙ্গে ঝগড়া-মারপিটও করবে না।
এতদিন
লামা ভাবত তাকেই কষ্ট করে স্কুলে যেতে হয়, পড়াশোনা করতে হয়। আর দাদা খুব মজা করে
‘ভেড়-বকরী’ চরাতে যায়। সারাদিন ওরা ওদের মতো চরে বেড়ায়, দাদা পাহাড়ের গায়ে শুয়ে
ঘুমোয় আর বিকেল হলেই আবার ওদের নিয়ে বাড়ি চলে আসে। কিন্তু আসলে যে কাজটা এতটা কঠিন
ওর তো কল্পনাতেও ছিল না। একটা এদিকে যায় তো অন্যটা উলটোদিকে খাদে নেমে যেতে চায়,
আর লামা যখন ওগুলোকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে রাস্তায় নিয়ে আসে ততক্ষণে হয়তো আর একটা বকরী
মানে ছাগল ওকে বেকুব বানিয়ে পাকদণ্ডি বেয়ে উঠতে শুরু করেছে।
“কী
কান্ড! আরে পড়ে যাবি তো! নেমে আয়, নেমে আয় বলছি!” লামার আস্ফালন শুনে বিরজু ওর
দিকে তাকিয়ে মুচকে মুচকে হাসতে থাকে।
“আরে আরে বুদ্ধু, ওদের ছেড়ে
দে। ওরা এরকম ভাবেই ঘাস খেয়ে ঠিক সময়মতো নেমে আসবে। তুই ভাবিস না। শুধু চোখে চোখে
রাখিস, কোনো শেয়াল যেন না এসে পড়ে।”
“শেয়াল??!!” লামার চোখদুটো
যেন ঠেলে বেরিয়ে আসার উপক্রম। “আমাকে ভয় দেখালে বাড়ি গিয়ে মাকে বলে দেব কিন্তু,” এবার
একটু রেগে গিয়ে লামা বলল দাদাকে।
“আরে সত্যিই, আমি একদিন
দেখেছি। ওইইইই দূরের পাহাড়টায়। সেই থেকে আমি আর ওদিকে যাই না তো, এই পাহাড়েই থাকি।”
এবারে লামার যেন মনে হল, কী
জানি! হতেও পারে। তাও একবার আড়চোখে বিরজুর দিকে তাকিয়ে নিল। কিন্তু বিরজুর
চোখেমুখে তো কোনোরকম দুষ্টুমির ছাপ নেই। তার মানে ঠিকই বলছে। এবার লামা একটু ভয়
পেল। শেয়াল মানেই ধূর্ত একটা প্রাণী, আর তারা ছাগল-ভেড়ার যম... এটা তো পাহাড়ের বাচ্চাও
জানে।
কিছুক্ষণ এদিক ওদিক থেকে ঘুরে
এসে লামা দেখল বিরজু একটা গাছের ছায়ায় গামছা পেতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ছাগল চরানোর
কাজটা যতটা আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল, এখন আর ততটা লাগছে না। একা একা বসে কী করবে ভাবতে ভাবতে লামার চোখ পড়ল ওই
দূরের পাহাড়ে। ওখানেই তো শেয়াল এসেছিল বলল বিরজুদাদা। একবার গিয়ে দেখবে? যদি শেয়াল
দেখা যায়?
পায়ে পায়ে লামা এগিয়ে চলল ওই
দূর পাহাড়ের দিকে। ভেড়া-পালকদের পায়ে চলা পথের রেখা ধরে এগিয়ে চলল সে। কিন্তু বেশিদূর
যেতেও ভয় লাগছে, দাদা যদি রেগে যায়? যদি চিন্তা করে? কছাকাছি একটা বড়ো পাথর দেখে
তার উপরে উঠে বসল লামা। এখান থেকে দূরের পাহাড়টা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। কিছু যেন
নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে মনে হচ্ছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখল কয়েকটা ছাগল, কিন্তু মাথায় বড়ো
ভেড়ার মতো শিং আছে, চরে বেড়াচ্ছে। লামা আর একটু ভালো করে দেখার জন্য আরও একটু
এগিয়ে বসল। এবার পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে চারটে বড়ো ছাগল আর একটা ছোটো বাচ্চা ঘুরে
ঘুরে ঘাস খাচ্ছে। কী অদ্ভুত! খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে চরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু পড়ে
যাচ্ছে না!
হঠাৎ লামার চোখে পড়ল দূরে
একটা মোটা ল্যাজওয়ালা কুকুর গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে ছাগলগুলোর দিকে। লামার কী রকম
অস্বস্তি হতে লাগল। হঠাৎ ও উঠে দাঁড়িয়ে ছুটতে শুরু করল।
“দাদা, দাদা, বিরজু দাদা,”
ছুটতে ছুটতেই চেঁচাতে লাগল লামা।
লামার গলা শুনে বিরজুও
ধড়মড়িয়ে উঠে বসল।
“কী হয়েছে? ছাগল-ভেড়া সব ঠিক আছে তো?”
“দাদা, সব ঠিক আছে। কিন্তু ওই
পাহাড়ে মনে হয় শেয়াল,” হাঁফাতে হাঁফাতে লামা কোনোরকমে বলেই আঙুল দিয়ে ইশারায় দেখাল
বিরজুকে। দুই ভাই মিলে ছুটতে ছুটতে সেই জায়গাটায় গেল, যেখান থেকে লামা দেখতে
পেয়েছিল শেয়ালটাকে।
“এগুলো বোরাল,” বিরজু বলল
লামাকে, “এখানে চুপ করে দাঁড়া, শব্দ করবি না একদম।”
লামা শব্দ করবে কী, ভয়ে আর উত্তেজনায় ওর তো গলাই
শুকিয়ে গেছে। ওই পাহাড়ের খাড়া গা বেয়ে তখন বোরালগুলো নিচে নামার চেষ্টা করছে।
এখানে হাওয়ার খুব দাপট। তাই পাহাড়ের গা ক্ষয়ে ক্ষয়ে এবড়ো-খেবড়ো, মাথার দিকে ক্রমশ
সরু হয়ে ছুঁচলো হয়ে গেছে। কয়েকটা জায়গায় শুধু পাথরের মাথাগুলো দু-তিন আঙুল মতো
চওড়া। তার উপরে পা রেখে রেখে সার দিয়ে নেমে আসছে বোরালগুলো। ওরা এখনও জানে না,
ওদের পেছনে যমদূত দাঁড়িয়ে। হঠাৎ একটা পাথর গড়িয়ে আসার শব্দে কয়েকটা বোরাল ঊপরে
তাকিয়ে শেয়ালটাকে দেখতে পেল। প্রাণভয়ে তারা লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে লাগল পাহাড়ের গা
বেয়ে। লামার গলা দিয়ে একটা আর্ত চিৎকার বেরিয়ে এল, “দাদা, ওই বাচ্চাটা...”
বিরজুও ডানদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে
দেখল একটা বোরালের বাচ্চা বেশ পিছিয়ে পড়েছে। বড়োদের মতো সে অত তাড়াতাড়ি নামতেও
পারছে না, আর ব্যালেন্স রাখতে গিয়ে সরসর করে নেমে আসছে ঢাল বেয়ে। কিন্তু এভাবে
নামতে থাকলে ও তো খাদের মধ্যে পড়ে যাবে!
“কী হবে দাদা?” লামার উদ্বেগ বিরজুর
মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু তার অভিজ্ঞতা বেশি, তাই ভয়ের প্রকাশ কম।
“আরে বেওকুফ, কুছ নাহি হোগা।”
দু’জনেরই চোখ বোরালের
বাচ্চাটার উপর। শেয়ালটাও ওকেই টার্গেট করে নিয়েছে। অনেকটা নেমে এসেছে ঢাল বেয়ে।
এদিকে বাচ্চাটাও পাহাড়ের গায়ে একটা খাঁজে দাঁড়িয়ে পড়েছে। জীবন-মৃত্যুর মাঝে
দাঁড়িয়ে আছে সে। কোনদিকে যাবে বুঝতে পারছে না বেচারা। তার মা এবং বাকি সঙ্গীসাথীরা
অনেকটাই নিচে নেমে গেছে। ওরা সকলেই নিরাপদ জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শেয়ালটাও এদিক
দিয়ে নামতে গিয়ে বিপদ বুঝে আবার খানিকটা উঠে গেল। অন্য দিক দিয়ে ঘুরে আবার আসছে
বাচ্চাটার দিকে। বাচ্চাটা আর শেয়ালটার মধ্যে দূরত্ব ক্রমশ কমে আসছে। লামা আর বিরজু
দু’জনেই স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে সেদিকে। বাচ্চাটা ছটফট করছে। কিন্তু খাদের দিকে
নামতে ভয় পাচ্ছে।
আচমকাই বিরজু মুখের সামনে দুটো
হাতের পাতা রেখে গলায় অদ্ভুত একটা শব্দ করে উঠল। অনেকটা যেন কুকুরের ডাকের মতো।
সেই আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ল এই পাহাড় থেকে ওই পাহাড়ে। কিন্তু মাঝে হাওয়ার দাপটে তার রেশ
হয়তো গিয়ে পৌঁছাল না ওইদিকের পাহাড়ে। তাতে শেয়াল বা বোরালছানা, কারুরই কোনো হেলদোল
দেখা গেল না। বিরজু আবার একইভাবে শব্দ করল, এবার আরও জোরে। এবারে আওয়াজটা পাহাড়ে
পাহাড়ে ঘুরে ফিরতে লাগল। শেয়ালটা একটু কান খাড়া করে এদিক ওদিক তাকাল। কিন্তু ফিরে
গেল না। তার নজর সেই বোরালছানার দিকেই। কিন্তু বোরালছানাটা সেই অপরিচিত শব্দে ভয়
পেয়ে তড়বড় করে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে লাগল। কখনও পাথরের মাথায়,
কখনও বা খাঁজে পা রেখে রেখে সে নেমে গেল অনেকটা নিচে... শেয়ালটার ধরা-ছোঁয়ার
বাইরে। আর একটু নেমে গেলেই সে তার দলের কাছে, তার মায়ের কাছে পৌঁছে যাবে। এভাবেই
জীবন প্রত্যেককে আত্মরক্ষার পদ্ধতি শিখিয়ে দেয়। সেদিকেই তাকিয়ে রইল বিরজু। লামা
ডানদিকে তাকিয়ে দেখল শেয়ালটা আস্তে আস্তে পেছন ফিরে চলে যাচ্ছে। শিকার ফসকে যাওয়ার
দুঃখ তার হাঁটাচলায় ফুটে বেরোচ্ছে।
“ওই দেখ লামা,” বিরজুর গলায়
যেন জয়ের আনন্দ, একটা প্রাণ বাঁচানোর খুশি ঝরে ঝরে পড়ছে।
লামা তাকিয়ে দেখল,
বোরালছানাটা তার মাকে দেখতে পেয়েই হয়তো তিড়িং তিড়িং করে লাফিয়ে ছুটেছে তার দলের
দিকে। দলটা ওর জন্যেই অপেক্ষা করছিল নিরাপদ জায়গায়। ছানাটা দলের সবথেকে সামনে
দাঁড়িয়ে থাকা বোরালটার পেটের কাছে গিয়ে ঢুকে পড়ল।
“ওটা নিশ্চয় ওর মা, তাই না
বিরজুদাদা?”
“হ্যাঁ, ওর মা ওর জন্যই
অপেক্ষা করছিল, দেখলি না?” বিরজুর গলাতেও খুশির ছোঁয়া।
“চল দাদা, মা আমাদের জন্য বাড়িতে
অপেক্ষা করছে হয়তো,” বলেই লামা লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে লাগল পাথরের গা বেয়ে। তার হাতে
ধরা গাছের ডাল দিয়ে তাড়িয়ে নিয়ে আসতে লাগল ছাগল-ভেড়াগুলোকে। ওদিকে বিরজু তখন পেছন
থেকে শব্দ করছে, “হোইইই, হুর্র্র্র্, চল্ চল্।”
_____
ছবিঃ সুজাতা ব্যানার্জী
No comments:
Post a Comment