চুইং টিং ছট
সৈকত মুখোপাধ্যায়
মিস চুইং, মিস
স্টিকি আর মিস্টার চিটপিটে সিং।
নাম শুনে কী ভাবছ? ওরা
তিনটে আলাদা-আলাদা
দেশের মানুষ? চীনেম্যান, মেমসাহেব, সর্দারজি
এইসব?
উঁহু।
ভুল।
একদম ভুল।
ওরা আসলে তিনটে চুইংগাম।
একই কোম্পানিতে তৈরি, একইরকমের
রঙচঙে আর ফিরফিরে প্লাস্টিকের প্যাকেটে মোড়া।
তুমি হাতে নিলে আলাদা করে বুঝতেই পারবে না, কোনটা
কে।
ওরা নিজেরা কিন্তু এ-ওকে
দিব্যি আলাদা করে চিনতে পারে।
এ ওর নাম ধরে ডাকে, গল্প
করে।
সে গল্প অবশ্য তুমি শুনতে পাবে না।
তুমি মানুষের ছানা কিনা, তাই। চুইংগামদের
মধ্যে যে-সব
কথাবার্তা হয়, সে
কেবল চুইংগামেরাই শুনতে পায়।
আর এই মাত্র-ক’দিন
আগে বুঝলাম, আমিও
পাই।
সেইজন্যেই বোধহয় সকলে বলে, আমার
মাথায় ছিট আছে।
হয়েছিল কি, ছুটির
দিন দুপুরে আমাকে দোকান সামলাতে বলে দুই দাদা চলে গেল কার যেন শ্রাদ্ধের নেমন্তন্ন খেতে।
দোকানটা আমাদেরই, তবু
আমি ভালো করে জানি না, কোথায়
কী রয়েছে।
ওসব বড়দা মেজদারাই জানে।
আমি দোকানে বিশেষ বসি-টসি
না।
ওরাও খুব একটা জোরজার করে না।
দোকান চালাতে গেলে খুব ভালো অঙ্ক জানতে হয়।
মুখে-মুখে হিসেব করে ফেলতে হয় এক কিলো মুগ ডালের দাম যদি একশো-পঁয়ত্রিশ
টাকা হয়, তাহলে
পঞ্চাশ গ্রামের দাম কত।
বাপ রে! তার চেয়ে দাম না নিয়ে ছেড়ে দেওয়াই ভালো।
দিয়েওছি তাই অনেকবার; আর
সেটা জানতে পেরে গেছে বলেই দাদারা আমাকে আর দোকানে বসার জন্যে জোর করে না।
তবু সেদিন নিতান্ত বাধ্য হয়েই ওরা আমার হাতে দোকান ছেড়ে দিয়ে শ্রাদ্ধবাড়ি চলে গেল।
বৈশাখ মাসের দুপুর।
ঝাঁই ঝাঁই করে রোদ উঠেছিল।
খদ্দের-টদ্দের কেউ আসবে বলে মনে হচ্ছিল না।
আমি একটা টুলের ওপরে বসে-বসে
দেখছিলাম, বস্তাভর্তি চাল-ডাল, বোতলভর্তি নানারকমের তেল।
সাবান, শ্যাম্পু, সস, জ্যাম, আচার। দেখছিলাম
আর ঘুমে ঢুলছিলাম।
ঢুলছিলাম আর ভাবছিলাম, কত
জিনিস লাগে রে বাবা মানুষের বেঁচে থাকার জন্যে।
এদের মধ্যে কেউ যদি জাহাজডুবি হয়ে একটা জনহীন দ্বীপে গিয়ে ওঠে, তাহলে
কী হবে? কোথায়
পাবে মিনিকিট চাল আর সোনামুগের ডাল? কোথায়
পাবে শ্যাম্পু-সাবান? তখন তো কাঁকড়া-পোড়া
আর ডাবের শাঁস খেয়েই কাটাতে হবে।
কলাগাছের বাকল পুড়িয়ে, সেই
ছাই দিয়ে কাপড় কাচতে হবে।
তাহলে সেটা এখন থেকেই প্র্যাকটিস করে না কেন?
হঠাৎ শুনি ফিনফিনে গলায় কারা যেন একেবারে আমার ঘাড়ের কাছেই কথাবার্তা বলছে।
ঘুমের চটকা ভেঙে গেল।
ধড়মড় করে সোজা হয়ে বসে বুঝতে চেষ্টা করলাম, কারা
কথা বলে।
বলব কী ভাই, কাউন্টারের
নিচে, মাচার ওপরে, চালের
বস্তার আড়ালে এমনকি ক্যাশবাক্সের ভেতরে অবধি খুঁজলাম; কাউকে
দেখতে পেলাম না।
অথচ তখনও বেশ জোরে-জোরে
তর্ক-বিতর্ক চলছিল।
ভূতের ভয়ে ঘেমে-টেমে
যখন আমার গেঞ্জি একেবারে পিঠের সঙ্গে লেপটে গেছে, তখনই
হঠাৎ চোখ পড়ল কাউন্টারের একেবারে বাঁদিকে একটা কাচের বড়ো বয়ামের দিকে।
বয়ামটার মধ্যে মাত্র তিনটে চুইংগাম পড়েছিল – ওই
তিনজন -- যাদের কথা গল্পের শুরুতে বলছিলাম।
চুইং, স্টিকি আর চিটপিটে সিং।
অবাক হয়ে দেখলাম ওরাই ঝগড়া করছে।
প্রত্যেকটা চুইংগামের যে আবার আলাদা-আলাদা
নাম হয়, তাই
তো আগে জানতাম না।
এতদিন ভাবতাম, নাম
থাকে শুধু মানুষের আর পোষা কুকুরের।
কিন্তু চুইংগামগুলো দিব্যি এ ওকে
নাম ধরে ডাকছিল।
তাই শুনেই এই নতুন ব্যাপারটা শিখলাম।
বন্ধু হলেও, ঠিক
তখনই ওদের মধ্যে বেশ একটা ঝগড়া মতন হচ্ছিল।
চিটপিটে সিং বলছিল, সমস্ত
চুইংগামের জীবন একভাবে কাটে।
কোনো বৈচিত্র্য নেই।
স্টিকি তাতে ভয়ঙ্কর আপত্তি করছিল।
ও বলছিল, একদম
না।
একবার মানুষ যদি আমাদের চিবিয়ে ফেলে, তারপর
কে যে কোন কাজে লাগব কেউ জানে না।
নামটা চীনেম্যানের মতন হলেও, মিস
চুইং-ই দেখলাম
ওদের মধ্যে সবচেয়ে সভ্য-ভদ্র। সে
মিনমিন করে বাকি দু’জনের ঝগড়া থামাবার চেষ্টা করছিল আর কেবলই বলছিল, আহা! তর্ক করে লাভ কী? দাঁড়া
না।
একটু বাদেই তো আমরা বেরিয়ে পড়ব।
তখনই বোঝা যাবে কার কথা ঠিক।
চিটপিটে সিং বলল, তাহলে
প্রমিস কর, ঘুরে-টুরে আসার পর, আমরা
এখানেই আবার মিট করব। তবেই
তো জানতে পারব, কার
কী অভিজ্ঞতা হল।
বাকি দু’জন একসঙ্গে বলল, বেশ, তাই হবে।
আমি সবে ভাবছি, চুইং
কেমন করে বলল, ‘একটু
বাদেই বেরিয়ে পড়ব’? বয়ামের
মুখ তো মোটা কাচের ঢাকনা দিয়ে ঢাকা।
ও মা! ভাবতে
না ভাবতেই পর পর তিনজন খরিদ্দার এসে হাজির।
প্রত্যেকেই একটা করে চুইংগাম কিনে নিয়ে চিবোতে চিবোতে চলে গেল।
ফাঁকা বয়ামটার দিকে তাকিয়ে আমি হাঁ করে বসে রইলাম।
তারপর আবার কতদিন বাদে কে জানে, একে-একে ওরা তিনজনেই দোকানের সামনে ফিরে এল – তিনটে
চিবোনো চুইংগাম।
এ ওকে বলতে শুরু করল নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা।
আমিও কান পেতে শুনলাম।
যা শুনলাম বলি, কেমন? তারপর তোমরাই ঠিক কোরো, সব
চুইংগা্মের জীবন একভাবে কাটে কি না।
* * *
চিটপিটে সিং বলল, তোরা
তো দেখলিই, আমাকে
একটা বছর পনেরোর ছেলে কিনে নিয়ে গেল।
ছেলে তো নয়, পিলে। বোম্বাই-রকমের বিচ্ছু।
নাম আবার প্রশান্ত।
ও যদি প্রশান্ত হয় আমি তাহলে বরফ-জমা
আর্কটিক সী।
আমাকে মুখে পুরে প্রশান্ত সাইকেল চালিয়ে খেলার মাঠের দিকে চলল।
পুরো রাস্তাটায় সাইকেলের হ্যান্ডেলে হাত ছোঁয়াল না।
দু-হাত
ছেড়ে উল্কার বেগে ল্যাগব্যাগ করে ঢুকে পড়ল সোজা মিত্তিরদের বাড়ির পেছনের মাঠে।
ও মাঠে ঢোকামাত্রই ওরই মতন আরও অনেকগুলো ব্যাঁদড়া বালক ‘ক্যাপ্টেন এসে গেছে, ক্যাপ্টেন
এসে গেছে’ বলে
হই হই করে প্রশান্তকে ঘিরে ধরল।
ভাবলাম কিসের ক্যাপ্টেন রে বাবা! একটু
পরেই অবশ্য বুঝলাম ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন।
সেই বিকেলে প্রশান্তদের চড়কডাঙ্গা সেভেন-স্টারের
সঙ্গে হাকিমপাড়া ইউথ ক্লাবের সেভেন-সাইড
ম্যাচ ছিল।
প্রশান্তটা দেখলাম মারকাটারি ফরোয়ার্ড।
পায়ে বল পেলেই ডানদিক-বাঁদিক
কাটিয়ে, চড়চড় করে একদম অপোনেন্টের গোলের মুখে উঠে যাচ্ছে।
শটও নিচ্ছে।
কিন্তু গোল পাচ্ছে না।
হাফটাইমের আগেই ওর তিনখানা গোলার মতন শট হাকিমপাড়ার জালে জড়িয়ে গেল, কিন্তু
একটাতেও গোল হল না।
কেন বলো তো?
আরে, প্রত্যেকটাতেই
যে প্রশান্ত অফসাইডের ফাঁদে পড়ে যাচ্ছিল।
যখন নিজের টিমের প্লেয়ারদের কাছ থেকে প্রশান্তর দিকে বল আসছিল, তখন
ইচ্ছে করেই হাকিমপাড়ার ডিফেন্স-এর
প্লেয়াররা ওকে এগোতে দিয়ে নিজেরা একটু পিছিয়ে যাচ্ছিল আর প্রশান্ত পাসগুলো নিচ্ছিল ওদের থেকে একটু এগিয়ে।
ব্যস, অমনি রেফারির বাঁশি বেজে উঠছিল ফুররর।
অফসাইড, গোল নাকচ।
চুইং জিজ্ঞেস করল, আর
লাইনসম্যানের ফ্ল্যাগ উঠছিল না?
উঁহু।
ছোটো মাঠে আবার লাইনসম্যান থাকে নাকি? রেফারিই
সব।
হাফটাইম অবধি এই চলল।
হাফটাইমে মাঠের একপাশে পা ছড়িয়ে মুখ গোঁজ করে বসে রইল প্রশান্ত।
কী যেন চিন্তা করছে আর একমনে আমাকে চিবিয়ে চলেছে।
একবার ফুঃ করে আমাকে মুখ থেকে ফেলে দিতে গিয়েও ফেলল না।
আমি ভাবলাম, কী
হল রে বাবা! আমার
মধ্যে তো স্বাদ-গন্ধ
আর কিছু অবশিষ্ট নেই।
তাহলে এখনও চিবোয় কেন?
হাফ-টাইমের
পরে আবার খেলা শুরু হল।
শুরুতেই গোল।
কার আবার? প্রশান্তর।
গোলের মধ্যে বল ঢুকল।
রেফারির বাঁশি বেজে উঠল ফুররর।
আর সঙ্গে-সঙ্গে
হাকিমপাড়া ইউথ ক্লাবের ছেলেরা দৌড়ে এসে রেফারিকে ঘেরাও করল – ‘অফসাইড
দিলেন না কেন’?
অফসাইডই তো দিলাম।
কাঁচুমাঁচু মুখে জবাব দিলেন মাঝবয়সি সিড়িঙ্গে মতন রেফারি।
এবার তেড়ে এল প্রশান্তর দলবল – মানে, চড়কডাঙ্গা সেভেন-স্টারের
ছেলেরা।
তারা বলল, অফসাইড
দিলেন মানে? গোলে
বল ঢুকে যাওয়ার তিন মিনিট বাদে বাঁশি বাজালেন, আর
বলছেন অফসাইডের বাঁশি! নেহি
চলেগা।
হাম নেহি মানেগা।
গোল দিতেই হবে।
যাই হোক, ওই
এক গোলেই শেষ অবধি চড়কডাঙ্গা সেভেন-স্টারের
জয় হল।
সবাই প্রশান্তকে কাঁধে তুলে নাচতে-নাচতে
বাড়ি ফিরল।
এই অবধি শুনেই চুইং আর স্টিকি মহা ক্যাঁওম্যাঁও জুড়ল – এর মানে কী? এর মধ্যে তোমার ভূমিকা কী? তোমাকে তো যে-কোনো চুইংগামের মতোই ফেলে দিয়েছিল ওই প্রশান্ত,
ঠিক কি না?
কে বলেছে? রুখে উঠল
চিটপিটে সিং। তাহলে রেফারির অফসাইডের বাঁশি
বাজল না কেন?
তার মানে? – ওরা ভ্যাবলার
মতন মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।
হ্যাঁ, সেটাই তো
গল্প। প্রশান্ত করেছিল কী জানো? হাফ-টাইমের সময় ও মুখ
থেকে চেবানো চুইংগাম বার করে রেফারির বাঁশির ফুটোতে আটকে দিয়েছিল। বেচারা রেফারি প্রশান্তর অফসাইড দেখে বাঁশিতে ফুঁ দিলেন। বাঁশি বাজল না। আবার ফুঁ দিলেন। বাজল না। মুখ-টুখ লাল করে ফুঁয়ের পরে ফুঁ দিয়ে যাচ্ছেন। বাঁশি আর বাজছে না, শেষমেষ মুখ থেকে বাঁশিটা নামিয়ে, ভালো করে ইন্সপেকশন
করে বুঝলেন গন্ডগোলটা কোথায়।
বাঁশির ফুটো থেকে আমার চিটপিটে শরীরটা ছাড়িয়ে আবার যখন ফুঁ দিলেন, তার তিন মিনিট আগেই বল জড়িয়ে গেছে গোলপোস্টের
জালে। বুঝলে কিছু?
এবার তুই বল স্টিকি, তোর জীবনটা কেমন কাটল।
* * *
স্টিকি বলল, আমাকে
তখন এই দোকান থেকে কে কিনে নিয়ে গেল জানো? বিখ্যাত
জালিয়াত পার্লস রোজবাড।
চুইং অবাক হয়ে বলল, বলো কী! ওই স্যুটেড-বুটেড লোকটা
বিখ্যাত জালিয়াত পার্লস রোজবাড? আমিও তো ওই কাচের বয়ামের মধ্যে
বসে ওকে দেখলাম। চিনতে পারিনি তো।
তবে আর বলছি কী? গম্ভীরমুখে বলল স্টিকি। আমিই কি চিনেছিলাম? রাস্তায় বেরোনোর পরে ওর মোবাইলে পরপর কয়েকটা
কল এল আর তখনই বুঝলাম মহাপুরুষটি কে।
পার্লস রোজবাড আমাকে মুখের মধ্যে পুরে চিবোতে-চিবোতে চলল সোজা সেন্ট্রাল জেলের দিকে। জেলখানায় তখন ভিজিটিং আওয়ার শুরু হয়েছে। পার্লসের ডানহাত, জাপানি-ক্রিমিনাল কাশীবাসী আঁখিহারা ওই জেলখানায় বন্দি
হয়ে রয়েছে। পার্লস চলেছে তাকে জেল থেকে
বের করে আনার ব্যবস্থা করতে।
তারপর? চোখ গোলগোল
করে জিজ্ঞেস করল বাকি দুই চুইংগাম।
ব্যবস্থা দেখলাম ভারি সহজ। মানে সবার কাছে কি আর সহজ? তবে রোজবাডের মতন শিল্পীর কাছে কিছুই না। ও করল কী, জেলখানার
গার্ডকে প্রথমেই এক-প্যাকেট দামি সিগারেট দিল। তারপর তার পিঠে হাত দিয়ে গল্প করতে-করতে এদিক-সেদিক কিছুক্ষণ
ঘুরল। ওই ঘোরাঘুরির মধ্যেই গার্ডের
কোমরের বেল্টের সঙ্গে চেন দিয়ে বাঁধা চাবিটা আলতো করে বের করে এনে…
কী করল?
সেটাই তো বলছি। চুপ করে শোনো না। ততক্ষণে তো রোজবাডের মুখের মধ্যে আমি চ্যাপটা হয়ে গেছি। আমার চ্যাপটা শরীরের ওপরে সেই চাবিটার একটা ছাপ নিয়ে, গরাদের এপাশ থেকে ওর বন্ধু কাশীবাসীর সঙ্গে
দু-চারটে মামুলি কথা বলে, পার্লস সোজা চলে
এল নদীর ধারে একটা চাবিওলার ঘরে।
সেই চাবিওলা মনে হল ওদের লাইনেরই লোক। দিব্যি আমার বুকের ওপরে ধরে রাখা চাবির ছাপটার সঙ্গে মিলিয়ে
একটা চাবি তৈরি করে ফেলল। তারপর আমাকে জানলা দিয়ে বাইরে
ছুঁড়ে ফেলে দিল। আমিও এখানে চলে এলাম। এর পরের খবর নিশ্চয় পরের দিনই খবরের কাগজের প্রথম পাতায় বেরিয়েছিল।
* * *
এবার ওরা দু’জন চুইং-এর দিকে ঘুরে তাকাল। তুই বল।
আমি… আমি…? থতোমতো খেল চুইং।
হ্যাঁ, তুই-ই তো। কোথায় গিয়েছিলিস, বল। প্রায় এক-সপ্তাহ লাগিয়ে
দিলি ফিরতে।
বেশি দূরে কোথাও যাইনি। বলল চুইং। তবু এমন একটা ব্যাপারে জড়িয়ে
পড়েছিলাম যে, ফেরা অসম্ভব ছিল।
তোরা
দু’জন আগেই চলে গিয়েছি্লিস তো, তাই আমাকে যে কিনে নিয়ে গেল তাকে
দেখিসনি। সে একটা ছোট্ট মেয়ে। নাম তার বুলবুলি। সবাই বুলু বলে ডাকে। ওই খালপাড়ে যে ভাঙা একটা একতলা বাড়ি আছে, ওটাই বুলুদের বাড়ি।
বুলু মাত্র আটআনা পয়সা নিয়েই এসেছিল। ওটাও সে জোগাড় করেছিল অতিকষ্টে।
স্টিকি জিজ্ঞেস করল, খুব চুইংগামের নেশা বুঝি মেয়েটার?
উঁহু।
তবে?
শোনো না পুরোটা। ও চুইংগামটা চিবোতে-চিবোতে বাড়ি ঢুকল। ওর মা তখন একটা ঘরে ঘুমোচ্ছিল, কিন্তু বুলবুলি সে ঘরে ঢুকল না। ও চুপিচুপি অন্য একটা ছোটো ঘরের ভেজানো দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল।
সেই ঘরে বিছানার ওপর এক অসুস্থ বৃদ্ধ শুয়েছিলেন। বুলবুলি চুপি-চুপি ঘরে ঢুকে হালুম করে সেই বৃদ্ধের গলা জড়িয়ে ধরল। বৃদ্ধ মানুষটি বোধহয় ঘুমিয়েই পড়েছিলেন। চমকে উঠে বললেন, কে রে?
বুলবুলি খিলখিল করে হেসে বলল, আমি গো দাদু, আমি। বুলু - তোমার নাতনি। আমাকে তুমি চিনতে পারছ না, না কি গো?
কেমন করে চিনব দিদিভাই? দাদু বুলবুলির কোঁকড়া চুলে আঙুল বুলিয়ে বললেন। দেখছ না, আমার চশমার
একটা কাচ খুলে গেছে। চশমা পরতে পারছি না, তাই তোমাকেও দেখতে পাচ্ছি না।
আর বইও পড়তে পারছ না?
ঠিক। বইও পড়তে পারছি না।
সেইজন্যে তোমার কষ্ট হচ্ছে?
খুব কষ্ট হচ্ছে দিদিভাই। তুমি তো জানো, বই না পড়ে আমি থাকতে পারি না।
বুলু খাটের ওপর জাঁকিয়ে বসে বলল, আমি তোমার চশমা সারিয়ে দেব?
তুমি? তুমি কোথা
থেকে সারাবে দিদি? চশমার দোকান তো অনেক দূরে। তুমি ছোটো মেয়ে, একা-একা কি যেতে পারো? তোমার বাবা
পরের সপ্তাহে জামসেদপুর থেকে বাড়ি আসবে। তখন সে সারিয়ে আনবে।
বুলবুলি
ছোট্ট নাকটা কুঁচকে বলল, কী যে বলো না দাদু! অতদিন তুমি বই না পড়ে থাকবে? তুমি বই না পড়লে আমাকে গল্প
বলবে কেমন করে? দাও, আমাকে চশমাটা আর কাচটা
দাও।
দাদু বললেন, দ্যাখো, বালিশের পাশে রেখেছি। পেয়েছ?
পেয়েছি।
তারপর বুলবুলি মুখ থেকে চিবোনো চুইংগাম, মানে আমাকে বার করে, তাই
দিয়ে কী সুন্দর করে যে খুলে-যাওয়া কাচটাকে আবার দাদুর চশমার ফ্রেমের
সঙ্গে আটকে দিল, না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। তারপর চশমাটা নিজের হাতে দাদুর চোখে পরিয়ে দিয়ে বলল, এবার আমায় দেখতে পাচ্ছ?
পাচ্ছি বইকি সোনা। তোমার মতন ভালো আমাকে কেউ
বাসে না। দাও, ওই ‘বুড়ো আংলা’ বইটা দাও। তারপর রিদয়ের কী হল বলি তোমাকে।
বুলুর কাহিনি শেষ করে চুইং বলল, তাহলে তোমরাই বলো, দাদুর
চশমাটা দোকানে নিয়ে যাওয়ার আগে আমি ফিরি কেমন করে?
* * *
এরপর তিন চুইংগাম-ই কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। আমার ধারণা আমিও দোকানের
মধ্যে বসে ওদের কথাই শুনছিলাম। কিন্তু হঠাৎ শুনি দোকানের
দরজায় দাঁড়িয়ে বড়দা মহা চিৎকার জুড়েছে – দেখেছ হতভাগাটার কান্ড। একে তো ক্যাশবাক্সের ওপরে
মাথা রেখে গাধার মতন ঘুমোচ্ছে, তার ওপরে
চুইংগাম খেয়ে খেয়ে দোকানের সামনে ছড়িয়ে রেখেছে। আমার জুতোয় এমন আটকে গেছে যে, আর ছাড়াতে পারছি না।
মনটা বড্ড খারাপ লাগছিল, তাই বড়দাকে আর বললাম না যে, ওরা কেউ সাধারণ চুইংগাম নয়
আর আমি ওদের খাইনি। যা বলার তোমাদেরই বললাম। তোমরাই বিচার করো।
_____
ছবিঃ জয়ন্ত বিশ্বাস
Salute Saikat da
ReplyDeleteমন ভরে গেলো, সৈকতদার ম্যাজিক কামাল করে দিল। দারুন গল্প। কিন্তু মেয়ে এখন চুইংগাম কিনতে চাইছে। ওকে ওটা এখনো খেতে দি নি। বলছে খাবে না। মাথার কাছে রেখে গল্প শুনবে ওরা কথা বলে কিনা!!
ReplyDeleteসৈকত,আপনার গল্পটা পড়ে খুব মজা উপভোগ করলাম। শিশু-কিশোররা যে কীরকম আনন্দ পাবে পড়ে, সেটা বুঝতে পারছি। আপনার সাবলীল ঝরঝরে গদ্য-সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। তিনটে চুইং গাম নিয়ে যে তিন গল্প ফেঁদেছেন,সেগুলোর প্রত্যেকটাকেই বিশ্বাসযোগ্য করেছেন। একটাই প্রশ্ন আমা।। জালিয়াতটিকে বিদেশী করলেন কেন? এটা আমার জানার কৌতূহল আরকী। এমন শারদ উপহারের জন্যে আমার তরফে আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা এক আকাশ।
ReplyDeleteঅসাধারণ শিশু কিশোর সাহিত্য। মন ভরে গেল।
ReplyDeleteসৈকত ম্যাজিক।
ReplyDeleteঅসাধারণ, কি ভালো লাগলো।
ReplyDeletebesh manane chuinggum diye aatke thaklo aapnar lekhata
ReplyDelete