মানুষখেকো
।। ১।।
ফোনটা
এল সকাল সাতটা নাগাদ। শনিবারের সকাল, তখনও বিছানা ছাড়িনি। রামপুর থানার ওসি বীরেন
শাসমলের ফোন।
“কী
রে, ঘুমোচ্ছিস?”
“আরে
বল, কী ব্যাপার! এত সকালে?”
“একটা
জরুরি ব্যাপার রে, তোর প্রমথেশবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ আছে তো?”
“হ্যাঁ...”
“ওনার
সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার।”
“কী
ব্যাপার আমাকে খুলে বল, কোন কেস? কেস পছন্দ না হলে উনি আসবেন না।”
“শোন
তাহলে...”
বীরেন
আমার ছেলেবেলার বন্ধু। মাঝে মাঝে কথা হয় এখনও। কিন্তু এরকম ফোন আশা করিনি ওর থেকে। চিরকালের
নাস্তিক এই বন্ধু এমনভাবে প্রমথেশবাবুকে খুঁজবে সেটাও ভাবিনি কখনও। তবে যা বলল ও,
সেটা শুনলে হয়তো প্রমথেশবাবু ইন্টারেস্টেড হতে পারেন। দেখি ফোন করে।
।। ২।।
বৃষ্টিভেজা
শীত শীত সকালেও প্রমথেশবাবু উঠে পড়েছেন সেই ভোর পাঁচটায়। না, আমি উঠিনি, আমি
জানলাম আমাদের বাড়ির বিনুকাকার থেকে। সাড়ে সাতটা নাগাদ ফিরে প্রমথেশবাবু যখন
বিনুকাকার হাতে কফি খাচ্ছেন তখন, যখন আমার ঘরে টোকা দিয়ে আমাকে জাগাল বিনুকাকা।
চক্ষুলজ্জায় পড়ে গেলুম বেশ।
কাল
প্রমথেশবাবু এসেছেন কলকাতায়। উঠেছেন আমারই বাড়িতে। হ্যাঁ, তিনদিন আগে আমার ফোন
পেয়েই আর দেরি করেননি একদিনও। আজ সকাল ন’টায় বীরেনের আসার কথা।
“কী
ঘুম ভাঙল?”
“আর
বলবেন না, ইয়ে মানে আজ থেকে পুজোর ছুটি শুরু হল তো, তাই... মানে...”
“আরে
নো প্রবলেম, তোমার বাড়ির সামনের পার্কটায় গেছিলাম, বেশ কয়েকটা পুরোনো গাছ দেখলাম।
বট, অশ্বত্থ তো আজকাল দেখাই যায় না। এই পাড়ায় এখনও সেই ব্যাপারটা রয়েছে। পুরোটা
আধুনিক হয়ে যায়নি। যাক, তোমার বন্ধু কখন আসবে?”
“এসে
তো পড়ার কথা এখনই...” বলতে বলতেই কলিংবেল বাজল। বিনুকাকার দরজা খোলার দশ সেকেণ্ডের
মধ্যেই প্রবেশ ঘটল আমার কলেজ-জীবনের বন্ধু বীরেনের। চেহারাটা পুলিশ হয়ে আরও দশাসই
হয়েছে। ফরসা মুখে কালো গোঁফটায় সাদা রেখা ঝিলিক মারছে দেখলাম। কপালে চিন্তার ভাঁজ। প্রাথমিক পরিচয় সেরে নিয়েই স্বভাবসিদ্ধ
ভঙ্গিতে বিষয়ে চলে এলেন প্রমথেশবাবু।
“শুরু
থেকে বলুন।”
বিনুকাকার
আনা কফিতে চুমুক দিয়ে শুরু করল বীরেন -
“আপনি
যখন সেই ফালুট থেকে এতদূর ছুটে এসেছেন অরুণের একটা ফোন পেয়ে তখন এটুকু বুঝতে পেরেছি
যে ঘটনাটা আপনার মনে রেখাপাত করেছে। প্রথমেই বলি আমি অলৌকিকত্বে বিশ্বাস করি না,
বা বলা ভালো করতাম না, কিন্তু মল্লিকা ভবনের ঘটনাটা হবার পর থেকে আমার বিশ্বাস আর
স্থির নেই। শুরু থেকেই আবার বলছি আপনাকে। দক্ষিণে বাসন্তী হাইওয়ের দিকে যেতে একটা
ছোট্ট জনপদ পড়ে। নাম কুসুমপুর। আমার থানার জুরিসডিকশনে পড়ে জায়গাটা। দিন কুড়ি আগে
একটা খুনের ঘটনা ঘটে সেখানে। প্রোমোটার লাল্টু পালের ভাইপো জগা খুন হয় ওখানের এক
বর্ধিষ্ণু বাড়ির বাগানে। বর্ধিষ্ণু বলছি বটে, কিন্তু এখন আর তেমন কিছু নেই। প্রফেসর
বিজন সেনগুপ্তের বাড়ি ওটা। বটানিস্ট। মারা গেছেন মাসখানেক হল। বাড়িতে আছেন ওনার বিধবা বোন কমলা দেবী
আর পুরোনো কাজের লোক গোপাল। ছেলে বিদেশে থাকে, স্ত্রী আগেই গত হয়েছেন। উনি মারা যাবার
পর পরই লাল্টু পাল ওই বসতবাড়ির দখল নেবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। কমলা দেবীর উপর চাপ
দিচ্ছে বাড়িটা বিক্রি করে দেবার জন্য। যা হয় আরকি। জায়গাটা অনেকখানি। ওরা একটা
ফ্ল্যাট করতে চায় ওখানে। কমলা দেবী কিন্তু চাপের মুখে নতিস্বীকার করতে চাননি, চান
না। এমন সময় একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। লাল্টুর ভাইপো জগা প্রায়ই
বিজনবাবুর বাগানে আসত। ফুল ছিঁড়ত, গাছের ফল নিয়ে চলে যেত, কমলা দেবী হাজার চেষ্টা
করেও রুখতে পারেননি সেটা।
“এখন
এই বাগানটা সম্পর্কে একটু বলা দরকার। বটানিস্ট হবার সুবাদে বিজনবাবু দেশবিদেশের
নানা জায়গায় ঘুরেছেন। রিসার্চের জন্য, লেকচারের জন্য বিদেশ থেকে ডাক আসত ওনার। শেষদিকে
বছরখানেক মধ্য আমেরিকা এবং আফ্রিকার বেশ কয়েকটি অরণ্যে ঘুরে কাজ করেন বিজনবাবু। সেখান
থেকে বেশ কিছু অজানা গাছ নিয়ে এসেছিলেন দেশে। ওই বাগানে বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য গাছ
রয়েছে, সেগুলোই ছিল বিজনবাবুর প্রাণ। ছেলের প্রতিও সেই টান ছিল না, যেটা ছিল নিজের
বাগানের প্রতি। ওই জগা অনেক ক’টা গাছের গোড়ায় অ্যাসিড ঢেলে পুড়িয়ে দেয়। খুব দুঃখ
পেয়েছিলেন। মানসিক চাপ থেকেই সম্ভবত হার্ট এটাক হয় ওনার। এখনও এই বাগানে বেশ কিছু
দুর্মূল্য ওষধি রয়েছে, অন্যান্য গাছ রয়েছে, বিদেশের এবং স্বদেশেরও। সবাই
ভেবেছিল সে সব আর বোধহয় বাঁচানো যাবে না। জগা খুন হবার পর রোখ চেপে গিয়েছিল
লাল্টুর। কিন্তু, বিধি উলটো।
“ঘটনার
পাঁচ দিনের মাথায় লাল্টু আরও দু’জন লোক পাঠায় বাড়ির দখল নেবার জন্য। পুলিস বা
প্রশাসন কাউকেই তারা কেউই খুব একটা পাত্তা দেয় না। কিন্তু এবারে ব্যাপারটা অন্যরকম
হল। গুণ্ডা দুটো এসেছিল আন্দাজ রাত বারোটা, কিন্তু বাড়ির দরজা অবধি পৌঁছানোর আগেই
কেউ বা কারা তাদের মাথার পিছন দিকে তীব্র আঘাত করে। শুধু তাই নয়, ওরা জ্ঞান
হারাবার পর দু’জনকেই পাওয়া যায় বাগানের ইতিভা নামের একটা মৃত বিদেশী গাছের তলায়। গাছেরই
শিকড় দিয়ে হাত-পা পিছমোড়া করে বাঁধা, দু’জনেরই শরীরের একাধিক হাড় ভেঙেছে। এভাবে আরও
দু-রাতে মোট চারজনের ক্ষেত্রে এই একই ঘটনা ঘটে। প্রথম ঘটনার পরই আমি সাদা পোশাকে ও
বাড়িতে পুলিস মোতায়েন করেছিলাম, কিন্তু তারা কেউ কিচ্ছু জানে না। শুধু একটা কথাই
তারা দু’জনেই বলেছে, বাগানে রাতের দিকে একটা হিস হিস শব্দ পাওয়া যায়, যেটা অনেকটা
সাপের মতো। কিন্তু তারা কোনও সাপ বা অন্য কোনো প্রাণীকেই বাগানে দেখতে পায়নি।
“আমার
নিজের ধারণা, ডিপার্টমেন্টের ধারণা, কমলা দেবীর এই ঘটনার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যোগ আছে। কিন্তু একজন সত্তর
বছরের মহিলা, যতই মানসিক জোর থাক না কেন, আর তারও বেশি বয়সের অশক্ত একজন কাজের লোক
কীভাবে এই গুণ্ডাগুলোকে এরকম সাংঘাতিকভাবে কাত করছে? কমলা দেবী চেনা কাউকে দিয়ে যে
এসব করাবেন তাও সম্ভব নয়। বাগানে ঢোকার একটাই রাস্তা, সেখানে একজন আর বাগানের
পিছনের দিকে আরেকজনকে চব্বিশ ঘন্টা পাহারায় রেখেছি আমি। একটা মাছিও
গলেনি সেখানে। তাহলে? লোকগুলোর অজ্ঞান দেহ আবিষ্কার হয়েছে ভোর রাতে, আমার ছেলেরাই করেছে।
সব ক’টাকেই ট্রেসপাসিং-এর চার্জ দিয়েছি, কিন্তু তারা সবাই এখন হাসপাতালে। বেরোলেই
লক আপে পুরব, কিন্তু তারাও কেউ কিচ্ছু বলতে পারেনি। সকলেই মাথার পিছনে বাড়ি
খেয়েছে, কে মারল সেটা জানার সুযোগ পায়নি। কমলা দেবী প্রত্যেকবারই এসেছেন সব ঘটনার
শেষে। তিনি নিজে কিছুই বলতে পারেননি, কিছু দেখেনওনি। অন্তত কমলা দেবীর ভার্সান
সেটাই। কিন্তু এই ঘটনা আর বেশিদিন চলবে না। আমার কাছে খবর আছে,
লাল্টু এবার ফাইনাল অ্যাকশনে নামবে। যেভাবেই হোক বাড়ি দখল নেবেই অথবা মরবে। আমার
পুলিসি সেন্স বলছে একটা রক্তপাত ঘটবেই, কিন্তু সেটা আটকাতে গেলে আমার জানা দরকার ঐ
বাগানে কী ঘটছে। আপনি প্লিজ হেল্প করুন প্রমথেশবাবু।”
হাতের
তালুর ওপর চিবুক রেখে চোখ বন্ধ করে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে প্রমথেশবাবু শুনছিলেন কথাগুলো। শেষ হতে চোখ খুলে টেবিলের ওপর থেকে মোটা কালো ফ্রেমের পুরোনো
দিনের চশমাটা নিয়ে পরলেন চোখে। নিস্তরঙ্গ গম্ভীর গলায় প্রশ্ন
করলেন, “আচ্ছা জগা কীভাবে খুন হয়?”
“হ্যাঁ, এটা বলা হয়নি, ওই ইতিভা
গাছের তলাতেই জগার দেহ পাওয়া যায়, সেদিন ও হুমকি দিয়েছিল কমলা
দেবীকে বাড়ি ছাড়ার ব্যাপারে। বাড়ি থেকে বেরোবার পরই ঘটনাটা
ঘটে। আন্দাজ রাত এগারোটা নাগাদ। হাত-পা পিছমোড়া করে বাঁধা,
আর গলাতেও গাছের শিকড় পেঁচানো, গলার হাড় ক্যারোটিড
ভেঙে মৃত্যু।”
“হুম, বাগানটা দেখা যাবে?”
“একদম, কবে যাবেন?”
“আজই।”
।। ৩।।
বাসন্তীর
দিকে গাড়ি যত এগোয় ততই প্রকৃ্তির বিস্তীর্ণ বিশালতা সামনে আসে। এই বিরাটের সামনে নিজেকে কেমন যেন অসহায় বলে মনে হয়। কুসুমপুর পৌঁছাতে বেলা একটা বাজল। আমার গাড়িতেই বীরেন এসেছে। সত্যিই জায়গাটা খুব নিস্তব্ধ, শুনশান। মল্লিকা ভবনের আশেপাশে অন্তত
এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বাড়ি নেই। গাড়ি থেকে নামতেই ছুটে এসে
গেট খুলে দিল বছর পনেরোর একটি ছেলে। আমাদের দেখে অল্প একটু হাসল, ম্লান হাসি।
“আসুন প্রমথেশবাবু, অশোক যাও গিয়ে দিদিমাকে খবর দাও,
আমরা এসে গেছি।”
“এটি কে বীরেন?”
“এর কথা বলা হয়নি আপনাদের। এ হল অশোক, গোপালের নাতি। ও জন্ম থেকেই এখানে আছে। এখানকার একটা স্কুলে পড়ে। মা মারা গেছেন, বাবা পাঁশকুড়ায় মিলে কাজ করেন। ও বিজনবাবুর কাছেই মানুষ। বিজনবাবু চলে যাবার পর এই
বাগানটার দেখাশোনা ওই করে।”
কথা বলতে
বলতে আমরা চলে এসেছি বাগানের ভিতরে। গেট থেকে বেশ কিছুটা হাঁটলে
তবে মূল বাগানে আসা যায়, যেখানে বিদেশী নাম-না-জানা গাছগুলি রয়েছে। আরো একটু এগোলে দেখা যাচ্ছে ভবনের মূল দরজা। হঠাৎ ঘুরে দেখি পাশে প্রমথেশবাবু নেই, অবাক হয়ে চারপাশে
তাকাতেই চোখ পড়ল, ভবনের মূল দরজার থেকে কিছুটা বাঁ দিকে একটা অদ্ভুত গাছ। কোঁকড়ানো
শাখা-প্রশাখাগুলি, অনেকটা উঁচুতে উঠে গেছে। গাছটা প্রায় ফুট দশেক লম্বা, কালো মোটা
গুঁড়ি। সম্পূর্ণ পাতাহীন। ইতিভা। এক ঝলক দেখলে যে উপমাটি মাথায় আসে সেটা হল মেডুসার
মাথা, আর তার তলায় দাঁড়িয়ে গাছটার দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে আছেন প্রমথেশবাবু। চোখ
দুটো জ্বলছে, এ দৃষ্টি আমি জানি। আগে বেশ কয়েকবার দেখেছি। উনি কিছু একটা ধারণা
করতে পেরেছেন। বীরেন ডাকতে যেতেই আমি থামালাম, “ওনাকে একা ছেড়ে দে...” দরজার সামনে
পক্ককেশ, অভিজাত চেহারার এক বৃদ্ধার আবির্ভাব হয়েছে। কমলা দেবী। আমরা এগিয়ে গেলাম।
বীরেন আলাপ করিয়ে দিতে উনি আমাদের ভিতরে নিয়ে গিয়ে বসালেন।
“আপনারা
এমনসময় এলেন যে, আপনাদের একটু আপ্যায়ন করব সে অবস্থা নেই।”
“আপনি
ব্যস্ত হবেন না। আমরা এসেছি কাজে, আপনার সমস্যা সমাধানের জন্য।”
“আপনারা
মনে করেন এসব আমার দাদার অতৃপ্ত আত্মা করছে, তাই তো?” কঠিনস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন
কমলা দেবী।
হঠাৎ
এই প্রশ্নে হকচকিয়ে গেলাম।
“আমি
প্রমথেশবাবুর কথা পড়েছি। দাদাও জানতেন ওনার কথা। ওনার লেখা রিসার্চ-পেপার দাদা পড়তেন।
উনি যে সুপারন্যাচারাল কোনো ব্যাপার ছাড়া এখানে আসবেন না সেটা নিয়ে আমি নিশ্চিত।”
“আপনি
ঠিক ধরেছেন, ব্যাপারটা সুপারন্যাচারাল। কিন্তু কে বলল যে আপনার
দাদার আত্মা এ সব করছেন?” চমকে উঠলাম, আমার চেয়ারের পিছনে ঘরে ঢোকার দরজার কাছে
প্রমথেশবাবুর গলা শুনে। কমলা দেবীও দেখলাম, চুপ করে রইলেন। তারপর চাপা কঠিন স্বরে
বললেন, “সবাই বলছে, গ্রামের লোক, বাড়িতে আসা ধোপা-কাগজওয়ালা আর এখন পুলিসও।”
“আপনাদের
বাগানের ওই গাছটা কবে এনেছিলেন বিজনবাবু, যার নিচে ঘটনাগুলো ঘটছে?”
“দশ
বছর গো।”
গোপাল
এসেছে চা নিয়ে, পিছনে অশোক।
“আহ, বড়োদের কথার মাঝে আবার কথা বলে,” ধমকাল
গোপাল, কিছু মনে করবেন না বাবুরা, ও আসলে...”
“কেন
ওকে বকছিস গোপাল, ওই তো একমাত্র দেখাশোনা করে এই বাগানটার, ও বলবে না তো কে বলবে?”
“ওই
গাছটা কী গাছ তুমি জান?”
প্রমথেশবাবু
জিজ্ঞাসা করলেন অশোককে। অশোক মুখ তুলে বলল, “জানি তো, ও হল পুরাণের গাছ। আর কোত্থাও পাবে না ওই গাছ।
দাদু নিজে হাতে ওকে খাওয়াতেন। আমি দেখতুম। ও আমায় খুব ভালোবাসত।”
“হুম,
ঠিক আছে, তুমি এখন এসো অশোক।”
এমন সময়
বীরেনের ফোনটা বেজে উঠল। কানে দিয়ে মিনিট খানেক কথা বলেই ফোন রাখল। তারপর
প্রমথেশবাবু আর আমাকে ডেকে নিয়ে গেল বাইরে।
“ইন্টেল
আছে প্রমথেশবাবু। আজ রাতেই লাল্টুরা অ্যাকশনে নামবে। বাড়ি খালি করিয়ে দেব
কিনা ভাবছি। কিন্তু...”
“খুব
ভালো খবর!” প্রমথেশবাবুর এ হেন মন্তব্যে থমকে গেল বীরেন।
“কি
বলছেন প্রমথেশবাবু!”
কথাটা
বলেই আবার নিজের খোলসে ঢুকে গেছেন ভদ্রলোক। শান্ত, গম্ভীর স্বরে বললেন, “শুনুন,
বাড়ি খালি করতে হবে না। আর আপনাদের সঙ্গে আমরাও আজ থাকব এখানে। কয়েকটা কথা বলব
আমি, ভিতরে আসুন।”
।। ৪।।
রাত
সাড়ে এগারোটা বাজে। ন’টার মধ্যেই খাওয়াদাওয়া সেরে আমরা চলে এসেছিলাম মল্লিকা ভবনে।
কমলা দেবীর অশৌচের সময়ে তাঁর ওপর আর কিছু চাপাতে চাইনি কেউই। কিন্তু শত চেষ্টাতেও
কিছুতেই ওনাকে ঘুম পাড়ানো যায়নি। শোবার ঘরে জেগে বসে আছেন কমলা দেবী। গোপালকে বলা
হয়েছে ওনার পাশে থাকতে। আর অশোককে বলা হয়েছে কাছাকাছি থাকতে, কিছু দেখলেই খবর
দেবে। বাগানের নিম গাছটার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছি আমি, আমার দু’হাত দূরের ছাতিম গাছের
কাছে প্রমথেশবাবু আর বীরেনও আছে কাছাকাছি ফোর্স নিয়ে। তবে প্রমথেশবাবু না বললে ওরা
অ্যাকটিভ হবে না। জানি না কী ঘটতে চলেছে, তবে একটা আশ্চর্য জিনিস লক্ষ করলাম। এই
গ্রামীণ এলাকায়, সারা বাগানে একটাও শব্দ নেই। না ঝিঁঝির, না অন্যকিছুর। একটা মশা
পর্যন্ত নেই এই শেষ বর্ষার সময়ে। পঞ্চমীর মরা চাঁদের আলোয় এই পিনড্রপ সাইলেন্স,
অপার্থিব এক পরিবেশ তৈরি করেছে। ব্যাপারটা মনে হতেই প্রমথেশবাবুর দিকে তাকালাম,
ওনাকে ফিসফিসিয়ে ডাকতে যাব, ঠিক তখনই দেখি উনি মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বললেন। আমার
ষষ্ঠেন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল। একটা শব্দ, খুব আবছা, তাও পাচ্ছি, হিস হিস হিস...
একটানা বোধহয়। বোধহয় বলছি তার কারণ, প্রমথেশবাবু আমাদের সকলকে নয়েজ ক্যানসেলিং
হেডফোন পরিয়ে রেখেছেন, আমি, বীরেন থেকে শুরু করে ফোর্সের প্রত্যেকটি লোককে। কারণটা বলেননি, তবে ওনার বলা কথা ফেলার মতো দুঃসাহস আমার
নেই, বীরেনও কী বুঝে জানি না, কথাটা মেনেই নিয়েছে। এছাড়াও ওনার সঙ্গে রয়েছে একটা
অদ্ভুত জিনিস। একটা মশাল, জ্বলছে না সেটা যদিও। সেটার প্রয়োজনও জানা নেই।
কানে
হেডফোন, তাও শব্দটা কানে আসছে আর একটা ঝিমভাব টের পাচ্ছি। এমন সময় একটা ভয়ঙ্কর
দৃশ্য দেখে সব ঘোর কেটে গেল। বাগানে তিন-চারটে লোক ঢুকে পড়েছে, কোথা দিয়ে জানি না।
প্রত্যেকেই আর্মড। কিন্তু কী হল, জোর পায়ে এগিয়ে আসতে আসতেই তারা চারজনেই যেন কেমন
হয়ে গেল, এলিয়ে পড়েছে হাত-পা, চলাটা টলোমলো। কিন্তু তার থেকেও ভয়ানক একটা জিনিস
দেখলাম তাদের পিছনে। একটা ছায়া শরীর, সেই ছায়া ক্রমশ এগিয়ে আসছে ওদের পিছন থেকে,
আরও কাছে, লোকগুলোর আরও আরও কাছাকাছি সেটা আসতেই আঁতকে উঠলাম আমি। না ছায়াটা কোনো
মানুষের নয়। প্রায় ফুট দশেক লম্বা ছায়াটার মাথায় যেন কোকড়ানো চুলগুলো সাপের ফণার
মতোই হিসহিসিয়ে উঠছে। ঘন কৃষ্ণবর্ণ চাঁদের আবছায়ায় আরও ঘোর। ইতিভা! চলমান ইতিভা!
কোনোমতে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার ডান দিকে তাকালাম, যেখানে গাছটার থাকার কথা। কী আশ্চর্য!
মৃত গাছ তো তার জায়গাতেই রয়েছে! তাহলে? ভাবনার অবকাশ পেলাম না। ভয়ঙ্কর এক আর্তনাদ।
মায়া ইতিভা তার মাথার জীবন্ত শাখার সাহায্যে পেঁচিয়ে ধরেছে চার গুণ্ডার গলা, এক
সঙ্গে, দেখলাম আম গাছটার আড়াল থেকে দু’জন সাদা পোশাকের পুলিস, হাঁ করে তাকিয়ে আছে
এই চলমান অশরীরী উদ্ভিদের দিকে। কী করবে জানে না তারা। এমন সময় হঠাৎ আলোকিত হয়ে উঠল গোটা
বাগান। মশাল, প্রমথেশবাবু মশাল জ্বেলেছেন, আর, আর আগুন ধরিয়ে দিচ্ছেন ইতিভা গাছটার
মৃত শরীরে। এরপর যা দেখলাম, তা ভুলব না সারা জীবনেও। আগুন
লাগাবার সঙ্গে সঙ্গে মায়া ইতিভার শাখা, বা ফণা যাই বলা হোক না কেন, শিথিল হয়ে এল।
ধীরে ধীরে বাষ্পের মতো মিলিয়ে গেল সেই মায়া শরীর, আমাদের চোখের সামনেই। এক দিকে
দাউদাউ করে জ্বলছে মৃত গাছ, অন্য দিকে চারটি মানুষের আর্তনাদ। এর মধ্যে হঠাৎ
তীরবেগে কেউ একটা ছুটে এসে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই দাউদাউ আগুনের মধ্যে, মরেই যেত
হয়তো, যদি না প্রমথেশবাবু থাকতেন। এক ঝটকায় ছেলেটিকে সরিয়ে আনলেন আগুনের কাছ থেকে।
অশোক। অঝোরে কাঁদছে ছেলেটা। প্রমথেশবাবু সঙ্কেত বাঁশি বাজিয়ে দিয়েছেন এর মধ্যেই।
বীরেন আর ওর সঙ্গীরা এসে পাকড়াও করল সবাইকেই। দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন কমলা দেবী আর
গোপালও। অশোককে সঙ্গে নিয়ে বসার ঘরে ঢুকলাম সবাই। বাগানেই দাঁড়িয়ে ফোর্সকে যাবতীয়
নির্দেশ দিয়ে ঘরে এসে বসল বীরেনও। গোপালকে কফির অর্ডার দিয়ে প্রমথেশবাবুকে ঘিরে
বসলাম সবাই।
“এবার
বলুন প্রমথেশবাবু, সবটা বলুন প্লিজ,” কমলা দেবীর কণ্ঠে অনুরোধ ঝরে পড়ল। রাত প্রায়
তিনটে। চারটে উদ্বিগ্ন, উত্তেজিত মুখ তাকিয়ে আছে প্রমথেশ চ্যাটার্জী নামের আশ্চর্য
মানুষটার দিকে, যারা একটু আগেই সাক্ষী হয়েছে এক অভূতপূর্ব ঘটনার। গোপালের আনা
কফিতে চুমুক দিয়ে শুরু করলেন প্রমথেশবাবু।
“আমি
কিন্তু শুরুতে রহস্যের টানে এখানে আসিনি। অরুণেশ যখন আমাকে ফোন করে, তখন ও এই
গাছটার কথা না জেনেই আমাকে গাছটার নামটা বলে, যদিও নামটা ও ভুল বলেছিল। বীরেনও
নামটার সঠিক উচ্চারণ জানেন না। কিন্তু এই ঘরে একজন সেটা জানে। সে বলবে কী?”
তীক্ষ্ণ
চোখে অশোকের দিকে তাকালেন প্রমথেশবাবু; মুখ তুলে তাকাল অশোক, চোখের কোলে এখনও চিকচিক
করছে জল।
“ইয়াতেভিও।”
আমরা
অবাক চোখে অশোকের দিকে তাকালাম। প্রমথেশবাবু আবার শুরু করলেন -
“ঠিক,
ইয়াতেভিও গাছটা আমাজন অববাহিকার উদ্ভিদজগত সম্পর্কে অনেকগুলি মিথের একটি। এই গাছ
এক বিশেষ ধরণের হিসহিস শব্দ করে, যেটা শুনতে অনেকটা ইয়াতেভিও শব্দবন্ধের মতো।
স্প্যানিশে এর অর্থ I see You, অর্থাৎ ‘আমি
তোমাকে দেখছি’। হ্যাঁ, এই গাছটার কথা
শুনেই আমি ছুটে আসি, কারণ উচ্চারণ ভুল হলেও বাগানে অ্যাসিড ঢেলে পোড়ানো এই গাছটার
বর্ণনা দিয়েছিল অরুণেশ, বীরেনের কাছ থেকে শুনেই। আসলে এত অদ্ভুত দেখতে গাছটাকে যে
সবার মাঝে দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই ও। আমি বিজনবাবুর পেপার পড়েছি নেচার পত্রিকায়, আমি
অনুমান করেছিলাম এই গাছের সন্ধান তাঁর পক্ষেই সম্ভব। আর এখানে এসে আপনাদের থেকে সব
শুনে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল অরুণেশের বাড়িতেই। শুধু দেখার
ছিল গাছটা, তাই যেটুকু সন্দেহ ছিল সেটুকুও দূর হল এখানে এসে।”
“কিন্তু
প্রমথেশবাবু, এই ঘটনাগুলো কীভাবে ঘটছিল সেটা বুঝতে পারলাম না!”
“বলছি,
কমলা দেবী। গাছের যে প্রাণ আছে সে কথা আমরা সবাই জানি। জগদীশ বোসের ক্রেশকোগ্রাফ
যন্ত্র আমাদের দেখিয়েছে, কীভাবে উদ্ভিদ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে প্রতিক্রিয়া করে। শুধু
তাই নয়, এসব ক্ষেত্রে গাছের ছোট্ট ছোট্ট টিসুও মুভমেন্ট করে, অর্থাৎ নড়েচড়ে, এটাও
তিনি দেখিয়েছিলেন। কিন্তু সাধারণভাবে আমরা সরাসরি কোনো গাছকে এভাবে স্থানান্তরিত
হতে দেখি না। গাছের ডালপালা কিন্তু তাদের মতো করে বাড়ে। তাদের এই সরণটাও একধরণের
মুভমেন্ট কিন্তু।
এবার
আসি আমাদের আলোচ্য ইয়াতেভিও গাছের কথায়। এই গাছের অস্তিত্ব সম্পর্কে বহু সন্দেহ
ছিল এবং আছে। এ গাছ যে থাকতে পারে সেটাই অনেকে জানেন না। যারা জানেন এবং মানেন
তারাও এ গাছ কখনও দেখেননি। আফ্রিকার আমাজন অরণ্যের দুর্গম অঞ্চল এর বাসস্থান, এর
খাদ্য আমিষ। অর্থাৎ এটি একটি কার্নিভোরাস গাছ, যা মাংস খায়। মিথ অনুসারে এরা
মানুষের মাংস সব থেকে বেশি পছন্দ করে। আমাজন অববাহিকার বাণ্টু উপজাতিরা একে পুজো
করে এখনও, এবং প্রসাদের জন্য মানুষ বলি হয় সেখানে। বিজনবাবু কোনোভাবে এই গাছটি
পেয়ে থাকবেন, সেটি যে আমাদের জল হাওয়ায় বেঁচেছে এবং রীতিমতো তার অস্তিত্ব জানান
দিয়েছে, সে এক আশ্চর্য ঘটনা বটে। আমি তখনই বুঝেছিলাম যে এ গাছের সম্বন্ধে যদি কেউ সবটা
জানে তাহলে সেটা অশোক, কারণ খেয়াল না করেই
ও একটা কথা বলেছিল আমাদের, দাদু খাওয়াতেন গাছটাকে। এরকম কথা চট করে কেউ বলে না, গাছের সম্পর্কে অন্তত। আর এ কথা যে বাইরে উনি চাউর
করবেন না সে তো নিশ্চিত। তাহলে পাড়া প্রতিবেশি থেকে
শুরু করে মিডিয়া অবধি অতিষ্ঠ করে তুলবে আপনাদের জীবন। এবার আসি একটা অন্য
প্রসঙ্গে। গাছের প্রাণ আছে এ কথা আমরা সবাই মানি। যখন অরুণেশ রুরুর দ্বারা
আক্রান্ত হয়ে আমার কাছে ফালুটে ছুটে গিয়েছিল, তখন আমি ওদের এই কথাটা বলেছিলাম, অরুণেশের
মনে থাকবে হয়তো।”
আমার
মনে ছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম উনি কী বলতে চাইছেন। এটা আমি ‘রুরু’ গল্পে লিখেওছি।
“আপনি
animism এর কথা বলছেন তো প্রমথেশবাবু?”
“হ্যাঁ,
আফ্রিকার আমাজনের কিছু আদিম উপজাতির বিশ্বাস এটা। এর মূল কথা হল এই
যে প্রত্যেকটি প্রাণীর একটি আত্মা আছে, তা সে গাছ হোক, বা পশু বা পাখি। Animism কথাটা এসেছে ল্যাটিন শব্দ anima থেকে, যার
অর্থ জীবন। এখন, গাছের প্রাণ থাকলে
তার আত্মাও থাকবে। এই বিষয়টা থেকে এটা পরিষ্কার যে গাছকে জড় বলে তারা স্বীকার
করেনি, কিন্তু সেটা বই পড়ে বা তত্ত্ব জেনে নয়। আদিম আমাজনের অধিবাসীরা পড়েছে বুক
অফ লাইফ, জীবনের সেই বই পড়েই তারা জেনেছে গাছপালার জীবন্ত হয়ে থাকার কথা। শুধু তাই
নয়, এখানে যা ঘটেছে তাতে গাছের অনুভবের বিষয়টিও ধরা পড়েছে। গাছটিকে যখন হত্যা,
হ্যাঁ, হত্যাই বলব আমি, করা হয়, তখন তার মনে তার অনুভবে, নিজের পিতৃপ্রতিম
বিজনবাবুর মৃত্যুর কষ্ট বর্তমান ছিল। হ্যাঁ, গাছও ভালোবাসতে পারে। শুধু তার প্রকাশ
ভিন্ন, তার ভাষা, তার মাধ্যম ভিন্ন বলে আমরা তাকে চিনতে পারি না। আর আমাদের চেনার
বাইরে যে এই রহস্যময় পৃথিবীর অনেক কিছুই রয়ে গেছে তার যুগান্তকারী প্রমাণ আজ রাতেই
আমরা পেয়েছি। গাছটি কার্নিভোরাস হলেও মুভমেন্টের ক্ষমতা তার কিন্তু জীবিত অবস্থায়
ছিল না। মৃত্যু তাকে সেই বন্ধন থেকে মুক্তি দিল। এই বাড়ির প্রতি তার ভালোবাসার
প্রমাণ দেবার সুযোগ সে পেল তখন, যখন এই বাড়ি বেহাত হবার একটা সম্ভাবনা দেখা দিল। যে
বা যারা সে চেষ্টা করল, তাদেরকে ও নিজের মতো করে শাস্তি দিল।”
“কিন্তু
ও তো একজনকেই মেরেছে, বাকিদের তো...”
“হ্যাঁ,
এখানেও আদিম সমাজের ন্যায়ের রীতিই মেনেছে সে, শুধুমাত্র নিজের হত্যাকারীকে সে
মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে, বাকিদের শুধু ভয় দেখিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। এমন অবস্থা করেছে, যাতে
তারা এই বাড়ি আর আক্রমণ করতে না পারে। মানুষের মতো অহেতুক হিংসায় কোনো প্রাণী বা
উদ্ভিদই বোধহয় বিশ্বাস করে না। কিন্তু তাকে যদি সহ্যের শেষ সীমায় ঠেলে দেওয়া হয়
তখন সেও বাধ্য হয় হিংস্র হয়ে উঠতে। তাই আজ যখন বুঝলাম যে ও এই বাকি চারজনকে শুধু
আহত করে ক্ষান্ত হবে না, তখন ওর পার্থিব দেহকাণ্ড জ্বালিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনো
উপায় ছিল না। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি ওকে মুক্তি দেওয়াই আমার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল।
ঐ গুণ্ডাগুলিকে বাঁচানো নয়, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে দুটি কাজই সুসম্পন্ন হয়েছে। ন্যায়
জয়ী হয়েছে, প্রতিহিংসা নয়, এটিই ভারতীয় রীতি। যে রীতি আজ আমরা বিস্মৃত হয়েছি। আপনি
নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন কমলা দেবী, আর ওরা এ বাড়িতে হামলা করতে আসবে না। আর বীরেন তো
রইলই, কেস কোর্টে উঠলে কোনো না কোনোভাবে লাল্টুকে জড়িয়ে নেওয়া যাবেই। তবে একটা কথা
বলি, বিজনবাবুর বিদেশবাসী ছেলের অভাব পূর্ণ করতে পারে এই ছেলেটি। ঐ গাছটিকে, এই বাগানকে বিজনবাবুর পর যদি আর কেউ ভালোবেসে
থাকে তো সে এই অশোক, বিজনবাবুর পর অশোকই ছিল ওর প্রকৃত অভিভাবক। কী খেতে দিতে ওকে
রোজ?”
শেষ প্রশ্নটা
বলা বাহুল্য অশোককে করা।
“একটা
করে ছাগল।”
“কী
করে খেত একটু বলো।”
“মাথার
উপরের দিকে একটা ফাঁপামতো জায়গা ছিল, সেই জায়গা দিয়েই ওর শাখাপ্রশাখা দিয়ে ধরে
খাবার চালান হত।”
“একটা
প্রশ্ন প্রমথেশবাবু, আপনি আমাদের নয়েজ ক্যানসেলিং হেডফোন কেন পরতে বলেছিলেন?”
বীরেনের প্রশ্নটা আমার মাথাতেও ঘুরছিল।
“কারণ
ঐ হিসহিস শব্দ, ঐ শব্দের সাহায্যে ও মানুষকে সাময়িকভাবে জ্ঞানহীন করে দিতে পারত,
যে কারণে আপনার কোনো লোক কোনো সময়ই আসল ব্যাপারটা ধরতে পারেনি, ঘটনার সময় বাগানে
উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও।”
“আপনাকে
যে কী বলে ধন্যবাদ জানাব, জানি না প্রমথেশবাবু, আমি তো ভাবতেই পারছি না, এরকম
অসম্ভব ঘটনা...” কেঁপে গেল কমলা দেবীর গলা, “এত বড়ো উপকারী বন্ধুকে হারালাম
আমরা... এ ক্ষতির কোনো সীমা নেই...” কমলা দেবীর চোখে জল।
“ঠিক,
সীমা নেই, আর পূরণ করাও যাবে না কোনোদিন, কিন্তু, বাঁচার নিজস্ব রাস্তা জীবনকে
বেছে নিতেই হয়, আমাদেরও নিতে হবে। আর সেটা কিন্তু ইয়াতেভিও-ও নিয়েছে। কী, খবরটা
আমি দেব, না তুমি দেবে, অশোক?”
এতক্ষণে
ছেলেটার মুখে একটু হাসি দেখা গেল। “ক’দিন আগেই দেখেছি, পুরোনো গাছটার থেকে ডান পাশে
একটু দূরে একটা নতুন চারা বেরিয়েছে। আমার প্রথমে সন্দেহ ছিল, কিন্তু মাথার কাছের
ওই আঁকড়িগুলো বেড়ে উঠতে দেখে বুঝতে পারি। পিঁপড়ে, কেন্নো ধরে দি ওকে।” হাসি ফুটল
এবার, কমলা দেবীর মুখেও।
“আমি
দেখেছিলাম কাল এসেই। আপনি ভাববেন না কমলা দেবী, আপনার এই বাড়ির উত্তরসূরি আর রক্ষাকর্তা
গচ্ছিত রইল আপনার কাছেই, যে ন্যায়ের জয়ের প্রতিভূ, প্রতিহিংসার নয়।”
বাইরে
বেরিয়ে দেখলাম, ভোরের আলো সবে ফুটছে, কাল রাতের দুর্ঘটনার চিহ্নমাত্র নেই সে ভোরের
আলোয়। সকলে গেলাম ছোট্ট ইয়াতেভিওকে দেখতে, ইঞ্চি দশেকের কালচে সবুজ আঁকড়ির মতো
কাণ্ডগুলো হাওয়ায় দুলছে। বিদায় জানালাম সবাইকে। দরজা থেকে বেরিয়ে গেটের কাছে এলেন
কমলা দেবী সমেত সকলেই। উজ্জ্বল শারদপ্রাতে আমাদের গাড়ি ছুটল কলকাতা অভিমুখে, পিছনে
তাকিয়ে দেখলাম অশোক শক্ত করে ধরে আছে কমলা দেবীর হাত।
_____
ছবিঃ
সুকান্ত মণ্ডল
এই গল্পটি শুধু গল্প নয় বর্তমান সমাজের এক ভয়ংকর সমস্যার ছবি । খুব সুন্দর ভাবে তা ফুটিয়ে তুলেছ দিদি । অনেক ধন্যবাদ ।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ ভাই
ReplyDelete