বিনাশবাবুর স্বপ্নপূরণ
রাখী আঢ্য
গন্ডা গন্ডা
নিত্যনতুন
নামের
বাজারে মা-বাবা কেন যে বেছে বেছে তার এই নামটাই রেখেছিলেন সে নিয়ে আজও ধন্দ কাটেনি বিনাশবাবুর। এমনটা তো নয় যে তার জন্মের সময় বিশ্বব্যাপী আলোড়ন
তোলা এমন এক
নাশকতামূলক
ঘটনা
ঘটেছিল
যেটা
চিরস্মরণীয়
করে
তোলার
এর
চেয়ে
ভালো
উপায়
ছিল
না। নিদেনপক্ষে
একটা
ভয়ংকর
বন্যা
কিংবা
শুকনো
খটখটে
খরা।
এমনও
নয়
যে
সেবার হাড়
কাঁপানো
ভয়ানক ঠান্ডা
পড়েছিল
কলকাতায়। কিংবা
এটাও
তো
মনে
পড়ে
না
যে
ঠাকুমার
সিদ্ধপুরুষ
গুরুদেবের
ঐকান্তিক
ইচ্ছা
ছিল
তার
পরম
প্রিয়
শিষ্যার
বংশপ্রদীপটি
শুধু
নামমাহাত্ম্যেই
ইতিহাস
প্রসিদ্ধ
হোক। কিন্তু
তবুও
কেন
যে
বিনাশ
নাম
রাখা
হল
সেটাই
আশ্চর্যের। শুনলেই যেন
মনে
হয়
তৃতীয়
বিশ্বযুদ্ধ
জাতীয়
কিছু
একটা
ঘটতে
চলেছে। তবে সৌভাগ্যের
ব্যাপার
হোক
বা
দুর্ভাগ্যের,
বিনাশবাবুকে
এ নামের
বোঝা
খুব একটা
বেশি
দিন
বয়ে
বেড়াতে
হয়নি। স্কুলজীবন হোক
বা
কলেজে
অথবা
তারপর
চাকরিক্ষেত্র,
সব
জায়গাতেই
তিনি
পরিচিতি
পেয়েছেন
‘বিনে
কিপটে’
হিসাবে। তাতে
হয়তো
মাঝে
মাঝে
দু-একটা
ছোটোখাটো
কিছু
বিনাশমূলক
ঘটনা
ঘটেনি
বা
ঘটার
উপক্রম
হয়নি
তা
সঠিকভাবে
বলা
যায় না, তবে
পরিসংখ্যানগতভাবে
বিচার
করলে
এবং
ব্যাপারটা
গা
সয়ে
যাওয়ায়
তৃতীয়
বিশ্বযুদ্ধের
যে
আর
কোনো
সম্ভাবনা
নেই
সে
কথা
বলাই
বাহুল্য।
অবস্থানগতভাবে বিনাশবাবুর
পৈতৃক
বাসস্থান
হাওড়া-ঠাকুরপুকুর
লাইনে
বিনোদপুর
বাস
স্টপেজে
নেমে
বাঁদিক
ধরে
একটু
হেঁটে
দুই
নম্বর
চুকুরাম
লেনে
ঢুকে শেষ বাড়িটায়। ঠিকানা ভুল করে আগে পিছে দু-একটা বাস স্ট্যান্ডে নেমে পড়লেও অবশ্য দিশেহারা
হওয়ার
কোনো
প্রয়োজন
নেই। মধ্য
চল্লিশের
বেঁটেখাটো
এই
মানুষটি
নাম
মাহাত্ম্যে
এলাকায় অতি সুপরিচিত।
আর বাড়িটার সবথেকে
বড়ো
বিশেষত্ব
হল
পাড়ার
কেউই জীবদ্দশায়
বাড়িটায়
রং
হতে
দেখেনি। অবশ্য
এ ব্যাপারে
কথা
উঠলে
বিনাশবাবু
বলেন
যে
তিনি
ব্যবহারে
বিশ্বাস
করেন, পরিচর্যায়
নয়। তার মতে
ট্রামে
বাসে, গ্রামেগঞ্জে
কত
মানুষই
তো
হঠাৎ
হঠাৎ
পটল
তুলছে
কোনো
আগাম
নোটিশ
ছাড়াই। মানুষের জীবনেরই
কোনো
দাম
নেই
তা
যতই
পরিচর্যা
করা
হোক
না
কেন। আজ
মরলে
কাল
দু’দিন
হবে। সুতরাং
জাগতিক
বিষয়ের
প্রতি
সম্পূর্ণ মায়ামুক্ত
থাকাই
নাকি
সুখী
মানুষের
লক্ষণ।
চিন্তাভাবনার মতো
বিনাশবাবুর
জীবনযাত্রাও
বেশ
সাদাসিধা। সরকারি অফিসের
মেজ
বাবু। না আছে বিশেষ দায়, না অতিরিক্ত দায়িত্ব।
মাথাজোড়া অর্ধেকটা টাক
আর
চোখে
কালো
ফ্রেমের
চশমা। বাড়িতে
বউ
আর
এক
মেয়ের
ছোট্ট
সংসার। অফিস ফেরার
পথে
সন্ধ্যার
পর
বাজার
যাওয়াটা
তার
নিত্য
অভ্যাস। সে সময়
নাকি
ঠিক
প্রয়োজনের
জিনিসটাই
সঠিক
দামে
পাওয়া
যায়। যদিও এই
নিয়ে
সংসারে
বিনাশ-গিন্নির
অভিযোগের
অন্ত
নেই। কথায় কথায়
শুনিয়ে
দেয়
নেহাত
বাপের
বাড়িটা
কাছে
ছিল, তাই
মেয়েটা
দু’বেলা
মাছ
মাংস
খেয়ে
বাঁচছে। তবে এসবে
বিনাশবাবু
খুব
একটা
পাত্তা
দেন
না। তার মতে
জীবনে
সুস্থভাবে
বেঁচে
থাকার
জন্য
খাদ্যাভ্যাসের
নিয়ন্ত্রণ
অত্যন্ত
জরুরি। আর
তাছাড়া
এই
মাগ্যিগন্ডার
বাজারে
সংসারে
দু’পয়সা
বাঁচলে
ক্ষতিটাই
বা
কী! আরে বাবা
যা
থাকছে
সবই
তো
মেয়েই
পাবে
নাকি!
বোকা
গিন্নিকে
কে
বোঝায়
সে
কথা। শখের মধ্যে
শুধু
দুটো। এক, পাড়ার কালু
কুকুরটাকে
রোজ
রাত্রে
নিয়ম
করে
খেতে
দেওয়া
আর
সেও
কৃতজ্ঞতাবশত
প্রভুভক্তির
উদাহরণস্বরূপ
নিয়ম করে
রাত্রে
শুয়ে
থাকে
বাড়ির
বাইরের
চাতালে। বিনা
পয়সায়
এই
দারোয়ানের
ব্যবস্থাটা পাঁচ
বছর
আগেই
করে
ফেলেছেন
বিনাশবাবু।
আর তার
দ্বিতীয়
শখটা
হল লেখা। বিনাশবাবু লিখতে
বড়ো
ভালোবাসেন। তা সে
কবিতাই
হোক
বা
গল্প, রম্য
রচনাই
হোক
বা
প্রবন্ধ, উপন্যাসই
হোক
বা
গান, বিনাশবাবু
কলম
ধরলেই
লেখাগুলো
সার
বেঁধে
এমন
করে
বেরিয়ে
আসে
যেন
জল
দেখলেই
প্যাক
প্যাক
করতে
করতে
বেরিয়ে
আসছে
হাঁসের
দল। বাড়ির
বৈঠকখানায়
বড়ো
কাচের
আলমারিটা
বাবার
আমলেই
তৈরি। লেখাগুলো
সাল
তারিখ
অনুযায়ী
একটা
করে
মোটা
খাতায়
লিখে
সেগুলো
ক্রমিক
নম্বর
দিয়ে
পর পর
সাজিয়ে
রাখেন
সেই
আলমারিতেই। ভাবটা এমন
যে,
কেউ
দেখলে
ভাববে
তিনি
ব্যারিস্টার
হতে
হতে
লেখক
হয়ে
গেছেন। বিনাশবাবু স্বপ্ন
দেখেন
একদিন
না
একদিন
তার
এসব
লেখা
ছাপা
হবেই,
আর
সেদিন
মানুষ
বুঝবে
কত
বড়ো
সাহিত্যসম্পদ
থেকে
তারা
এতদিন
বঞ্চিত
ছিল। সেদিন তার
লেখা
স্থান
পাবে
একেবারে
কবিঠাকুরের
লেখার
পাশেই। হ্যাঁ,
এই
লেখার
বিষয়ে
তিনি
আদর্শ
মেনেছেন
রবীন্দ্রনাথকে। মাঝে মাঝে ভাবতে গিয়ে অবাক হয়ে যান যে ঐ মানুষটা চিরদিন
একটা
মাত্র
সাদা
ধুতি
পাঞ্জাবি
পরে
কোনোদিন
চুল
দাড়ি
না
কাটিয়ে
শুধু
লিখে
লিখেই
নোবেল
প্রাইজটা
কী
করে
পেয়ে গেলেন! যদিও
অবিনাশবাবু নিশ্চিত
যে
রবি
ঠাকুরও
চুল
দাড়ি
ছাঁটাতেন। তবে তার
হাতে
এ ব্যাপারে
সেরকম
কোনও
প্রমাণ
না
থাকায় ব্যাপারটায়
বিশেষ
আমল
দেননি। আর
তিনি নিজেও
ব্যক্তিজীবনে
বউ
মেয়ের
গঞ্জনার
ঠেলায় ত্রৈমাসিক নিয়মে
সেলুনে
গিয়ে
চুল
দাড়ি
ছাঁটিয়ে
আসেন। এই একটা
ব্যাপারে
যে
তিনি
রবি
ঠাকুরের
সমকক্ষ
হতে
পেরেছেন
তাতে
তিনি
বেজায়
খুশি। আর লেখার সংখ্যায়
সমানতালে
চললেও গুণগত মানে যে তাকে আরও উন্নতি করতে হবে তাতে অবশ্য বিনাশবাবুর কোনো সন্দেহ নেই।
এ হেন বিনাশবাবু
ভয়ানক
বিপদে
পড়লেন
যখন
অন্দরমহলে
প্রবল
দাবি
উঠল
দেশ
ভ্রমণের।
রবিবারের সকাল। সবে
জলখাবারটা
উদরস্থ করে প্রশস্ত মনে রকবাজির তাল করছিলেন বিনাশবাবু,
হঠাৎ পিছন থেকে
চিরপরিচিত
কণ্ঠস্বর,
“বলি
শুনছ?”
গৃহকর্ত্রীর চিরাচরিত
মধুমাখা
ভনিতা
না
শোনে
এমন
মানুষ
পৃথিবীতে
বিরল।
“হ্যাঁ, বলো,” কান
চুলকাতে
চুলকাতে বলির
পাঁঠার
মতো
মাথা
নাড়লেন
বিনাশবাবু।
“বলি মেয়ের হাফ
ইয়ারলি
পরীক্ষা
তো শেষ। পুজো
এসে
গেল।”
“হ্যাঁ, তো
এতে
অস্বাভাবিক
কী
আছে? গত বছর
পরীক্ষায়
পাশ
করে
মেয়ে
নতুন
ক্লাসে
উঠেছিল। তারপর
নতুন
বইপত্র
হয়েছে, স্কুলের
পরীক্ষা
হয়েছে, তার
রেজাল্ট
বেরোবে। তারপর নিয়ম
করে
অ্যানুয়াল। আবার
মেয়ে
পাস
করবে। যথারীতি আবার
নতুন
ক্লাসে
উঠবে
আর
আমার
নতুন
বইয়ের
জন্য
আবার
গ্যাঁট
গচ্চা
যাবে। এ
তো
স্বাভাবিক
নিয়ম। এতে আমার
বা
আমার
বাবার
তো
কোনো
অপরাধ
নেই,” বিনাশবাবুর গলা আমতা
আমতা
শোনাল।
“না, অপরাধ আর
কী?” গিন্নির
গলায়
উষ্মা, “অপরাধ
তো
আমার। সারা
জীবন
ঘরেই বসে
আছি। তা
বলি
দুনিয়াশুদ্ধু
লোক
এই
ছুটিতে
যেদিকে
দু’চোখ
যায়
বেরিয়ে
পড়ছে, আর
আমাদের
কি
এই চুকুরাম লেনের
বাইরে পা বাড়ালে পায়ে বাত হয় গো?”
থেকে থেকেই
দু-চার
লাইন
লেখা
সকাল
থেকে
উঁকিঝুঁকি
মারছিল
বিনাশবাবুর
মাথায়। গিন্নির
এই
অকাল
আবদারে
সেটা
যেন
কোথায়
হুশ
করে
উড়ে
গেল।
‘তা কয়দিন
তো
একটু
গান্ধারীর
অভিনয়
অভ্যাস
করলেই
পারো,’ মনে
মনে
বিড়বিড়
করলেন
বিনাশবাবু। যদিও
কথাটা
মুখ
ফুটে
বলতে
সাহস
করলেন
না। সত্যি বলতে কী বড়োলোকের ঘোরা রোগের
ব্যামো
বিনাশবাবুর
কোনো
কালেই
ছিল না। শেষবার
তারা
গিয়েছিলেন
দক্ষিণেশ্বর আর বেলুড়মঠ। তাও প্রায় নয় নয় করে বছর দশেক হতে চলল। এ ক্ষেত্রেও
বিনাশবাবু
রবি
ঠাকুরকে
নিজের
গুরুদেব
মানেন। ওই
যে
‘দেখা
হয়
নাই
চক্ষু
মেলিয়া...’। আরে বাবা
কলকাতায়
কি
দেখার
জিনিসের
অভাব
নাকি? ইতিহাস
চাই তো মিউজিয়াম,
গাছপালা জঙ্গল চাই তো বোটানিক্যাল গার্ডেন,
এ ছাড়াও রয়েছে নদী
মাঠ, শুধু
পাহাড়-পর্বতই
যা
নেই। নিদেনপক্ষে
বাবুঘাটে
গিয়ে
দাঁড়ালেও
প্রতিদিন
নতুন
নতুন
সূর্যাস্ত
দেখা
যায়। বিনি পয়সায়
প্রকৃতির
এই
অপরূপ
শোভাই
বা
ক’জনের
দেখার
সৌভাগ্য
হয়? এভাবেই এতগুলো
বছর
কোনোক্রমে
ঠেকিয়েছিলেন, কিন্তু এবার আর শেষরক্ষা করতে পারলেন না। অন্দরমহলে
আমরণ
অনশনটা
যখন
শুধুই
সময়ের
অপেক্ষা
তখন
ঠিক
হল
দীঘা। ষষ্ঠীর
দিন
সকাল
সকাল
ধর্মতলা
থেকে
বাস। অষ্টমীতে বেলাবেলি
ফিরে
এসে
মায়ের
পুষ্পাঞ্জলি
আর
সন্ধিপুজো। ওটা না
হলে
যে
আবার
পুজোটাই
মাটি।
অফিসের একটা
হলিডে
হোম
আছে
দীঘায়। সিজনের সময়, তাই
বেড়াতে
যাবার
সিদ্ধান্তটা
নিতে
বেশ
দেরিই
হয়ে
গেছে। তবু বড়োকর্তার
সুপারিশে কথাবার্তা বলে সেখানেই একটা ঘর বুক করে ফেললেন বিনাশবাবু। পঞ্চমীর রাত্রে কালু কুকুরটাকে ভালো করে খেতে দিয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বেশ করে বুঝিয়ে বললেন,
“দু’দিন একটু দেখিস
বাবা, প্রভুভক্তির
চরম
পরীক্ষা
তোর। দেখিস
যেন
বিমুখ
করিস
না। পুজোর দিনে
অবশ্য
তোর
খাওয়ার কোনো অসুবিধা হবে
না।” উত্তরে
কালু
অবশ্য
লেজ
নেড়ে
কী
বলল
সেটা
বিনাশবাবু ঠিক
বুঝতে
পারলেন
না। পরদিন
সকাল
হতেই
দুগ্গা
দুগ্গা
বলে
সপরিবারে
বাসে
চড়ে
বসলেন
বিনাশবাবু।
পটাই পাল লোকটা এমনিতে বেশ নির্বিবাদী।
একটেরে থাকতেই বেশি
ভালোবাসে। পাড়ায়
মেলামেশাও
একটু
কম। আসলে
হবে
নাই
বা
কেন? বেশি
মেলামেশা
করতে
গেলে
ঘুমাবে
কখন
আর
ভালো
করে
না
ঘুমালে
রাত্রে
কাজে
বেরোবে
কী
করে। না
না,
পটাই
কোনও
কল
সেন্টারে
কাজ
করে
না। কোনোরকমে মাধ্যমিক
পাস
করেই
তিন
পুরুষের
ব্যাবসায়
ঢুকে
পড়েছিল
পটাই। একবার
ডিকশনারি
দেখতে
গিয়ে দেখেছিল তাদের
ব্যাবসার
বেশ
একটা গালভরা নামও
আছে
– চৌর্যবৃত্তি।
তবে আজকাল ব্যাবসার
বাজার
বেশ
মন্দা। একে তো
ঘরে
ঘরে
নানা
ধরনের
সিকিউরিটি
গ্যাজেট,
তার
উপর
সে
সব
পার
করে
যদিও
বা
ঘরে
ঢোকা
গেল
তো
প্রাপ্তির
নামে ঢুঁ ঢুঁ। মানুষ আজকাল বিশেষ দামি কিছু বাড়িতে রাখতেই চায় না। তবে বিনাশবাবুর ব্যাপারটা
আলাদা। বিনাশবাবুর বাড়ির সম্পর্কে
কত
গল্পই
না
সে
শুনেছে। স্বভাবে
হাড়
কেপ্পন
হলে
কী
হবে, লোকটার
নাকি
বাক্সভর্তি
টাকায়
ছাতা
পড়ছে। অথচ
ব্যাংকের
দশ
হাত
দূর দিয়ে
চলে। বাড়ির
চারদিকে
পাঁচিলটাও
তেমন
মজবুত
নয়। দু-একবার
রাতের
বেলা
পাঁচিল
টপকে
ভেতরে
ঢোকার
চেষ্টা
যে
সে
করেনি
তা
নয়,
কিন্তু
বাদ সেধেছে
ওই
কালু
কুত্তাটা। আরে খাওয়ার
মধ্যে
তো
জোটে
আধছেঁড়া
একটা
রুটি
আর
দু’টুকরো
আলু। তাও যদি
মাঝে
মাঝে
মেনু
বদলাত। কিন্তু
হলে
কী
হবে, রাতবিরেতে
একটু
এদিক
ওদিক
দেখলেই
চেঁচিয়ে
পাড়া
মাথায়
করবে
কালু।
আজ কিন্তু
পটাইয়ের
বরাত
বেশ
ভালো। সকালবেলা
নরুর
দোকানে
চা
খেতে
খেতে
নিজের
চোখে
দেখেছে
বিনাশবাবুকে
সপরিবারে
বাক্স-প্যাঁটরা
নিয়ে
কোথায়
যেন
যেতে। খোঁজ
নিয়ে
জানল
তারা
নাকি
দীঘায়
বেড়াতে
যাচ্ছে, ফিরবে
দু’দিন
পর। পটাই
ঠিক
এই
সুযোগটারই
অপেক্ষায়
ছিল
এতদিন। একটা জব্বর
ভাতঘুম দেওয়ার
পর
সন্ধ্যাবেলা
উঠে
নিজের
যন্ত্রপাতিগুলো
থলি
থেকে
বার
করে
আর
একবার
ভালো
করে
পরখ
করে
নিল
পটাই। বাড়ি
তো
এমনিতেই
তালাবন্ধ। সুতরাং
বেশি
রাত
করবার
প্রয়োজন
নেই। আজ
ষষ্ঠী। সন্ধ্যা হতে
না
হতেই
পাড়ার
লোকজনও
সেজেগুজে
যে
যার
মতো
বেরিয়ে
পড়েছে
ঠাকুর
দেখতে। পিঠব্যাগে
যন্ত্রপাতিগুলো
নিয়ে
গলির
মোড়
পেরিয়ে
ধীর
পায়ে
বিনাশবাবুর
বাড়ির
সামনে
এসে
দাঁড়াল
পটাই। সাবধানে
চারদিকটা
একবার
দেখে
নিল। নাঃ, কালুটাকেও তো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। গেছে
হয়তো
এদিক-ওদিক
কোথাও
খাবারের
সন্ধানে। এই তো
সুবর্ণ
সুযোগ। পুরোনো
পাঁচিলের
ভাঙা
ইটের
খাঁজে
খাঁজে
পা রেখে খুব সহজেই ভেতরে ঢুকে পড়ল সে। দরজার তালা খোলাটা
তো
এবার
বাঁয়ে
হাত
কা
খেল।
দীঘায় দু’দিন সমুদ্রে স্নান করার
সময়
পাঁচ
গ্লাস
নুন
জল
আর
খরচের
ধাক্কায়
গুচ্ছের
খাবি
খেয়ে
শরীরে
যুদ্ধজয়ের
ক্লান্তি
নিয়ে
অষ্টমীর
সকালে
সপরিবারে
বিনাশবাবু
যখন
বাড়ি
ফিরলেন
তখন সবার
আগে
যে
অভ্যর্থনা
জানাল
সে
হল
কালু। বেশ
বোঝা
যাচ্ছিল
যে
দু’দিন
এর
ওর
বাড়ি
কালিয়া
কোপ্তা
খেয়ে
ওর
মুখ
পচে
গেছে। এবার
আবার
রুটি
আলুরদমে
ফিরে
আসাই
ভালো। বাইরের
মূল
দরজার
তালা
খুলে
ভেতরে
ঢুকতেই
চোখ
চড়কগাছ। বাড়িতে
ঢোকার
দরজার
তালাটা
ভাঙা। দৌড়ে
গিয়ে
দরজাটা
খুলে
ভেতরে
ঢুকেই
হাঁ
হাঁ
করে
উঠলেন
বিনাশবাবু। জিনিসপত্র চারিদিকে এলোমেলো ছড়ানো।
‘ওই জন্যেই বলেছিলাম
বাড়ি
খালি
রেখে
কোথাও
যাব না।’
ততক্ষণে
গিন্নির
চিৎকারে
দু-একজন
করে
প্রতিবেশী
জুটতে
শুরু
করে
দিয়েছে। ‘আঃ হাঃ তালাটা যে বড্ড পুরোনো গো... দেখ আলমারি
ঘেঁটে
সোনাদানা কিছু
যায়নি
তো...।’
প্রতিবেশীদের বাক্যবাণ
আর
কৌতূহলে
বিনাশবাবু
জর্জরিত
হয়ে
উঠলেন। তাড়াতাড়ি
ভেতরে
ঢুকে
চারিদিকে
একবার
চোখ
বোলাতেই
একটু
নিশ্চিন্ত
মনে
হল। নাঃ, মোটামুটি
সব
ঠিকই
আছে। বিশেষ
কিছুই
নিতে
পারেনি
চোরটা। আসলে
বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার মতো আছেটাই বা কী? কিছু সাধারণ
জিনিসপত্র, আর
রান্নাঘরের
জিনিসপত্র
বাদ
দিলে
থাকার
মধ্যে
তো
শুধু
একটা
পুরোনো
সাদাকালো
টিভি
আর
বৈঠকখানার
আলমারিতে বিনাশবাবুর এক গুচ্ছের লেখার খাতা। আরে খাতাগুলো কোথায় গেল? মাথায় যেন বজ্রাঘাত হল বিনাশবাবুর। আলমারির
দরজা
দু’হাট
করে
খোলা। ভেতরে কিছুই
নেই। খালি
তাকগুলো
যেন
দাঁত
মুখ
ভেংচাচ্ছে। আলমারির
দিকে
শূন্য
দৃষ্টিতে
তাকিয়ে
বিনাশবাবুর
বুকটা
খাঁ
খাঁ
করে
উঠল। সব নিয়ে
গেছে
চোরে।
তার
সারা
জীবনের
পরিশ্রম, তার
স্বপ্নের
চাবিকাঠি
সবগুলো
খাতা। রেখে
গেছে
শুধু
একটা
চিঠি। বেশ
সময়
নিয়েই
লিখেছে
চিঠিখানা। কলমটাও
পাশেই
পড়ে
রয়েছে, সেটাও
তো
তার। কাঁপা
কাঁপা
হাতে
চিঠিটা
তুলে
নিয়ে
পড়তে
শুরু
করলেন
বিনাশবাবু -
‘অনেক স্বপ্ন
নিয়ে
বাড়িতে
ঢুকেছিলাম। কিন্তু
ওই
কথায়
বলে না,
মানুষ
ভাবে
এক
আর
হয়
আরেক। ভগবান
না
চাইলে
যে কোনো স্বপ্নই
পূর্ণ
হয়
না। আপনার
নাম
শুনেছিলাম,
কিন্তু
এতটা
যে
নিরাশ
হতে
হবে
তা
ভাবিনি। কিছুই
তো
পেলাম
না
নিয়ে
যাওয়ার
মতো
আপনার
বাড়িতে। তাই
রাতের
পথখরচাটুকু
আর
তালাভাঙার
পারিশ্রমিক
বাবদ
এই
খাতাগুলো
নিয়ে
চললাম। না
না,
ভাববেন
না
যেন
ছাপাখানায়
দেব। এগুলো কলেজ
স্ট্রিটে
পুরোনো
বই-খাতার
দোকানে
বিক্রি
করে
যা
পাওয়া
যাবে
সেটাই
আমার
এ রাতের
পাওনা
বলে
মেনে
নেব। রান্নাঘরে
এক কৌটো
বিস্কুট
ছিল,
সেটাও
সঙ্গে
নিয়ে
যাচ্ছি। এর অর্ধেকটা আপনার
বাড়ির
সামনের
কুকুরটাকে
দিয়ে
দেব। খাতাগুলো
বেঁধে
নিয়ে
যাবার
জন্য
আপনার
বিছানার
তাপ্পিমারা
চাদরটাও
নিলাম।
দেখেই
বুঝেছি
যে
খাতাগুলো
আপনার
দীর্ঘদিনের
পরিশ্রমের
ফল। তাই
দুঃখ
করবেন
না। যদি
খুব
দরকার
মনে
করেন
তো সপ্তাহখানেক
পরে
একবার
কলেজ
স্ট্রিটে
ঢুঁ
মারতে
পারেন
আপনি। খাতাগুলো সেখান
থেকেই
ফেরত
পেয়ে
যাবেন।’
উদাস নয়ন ধীরে ধীরে আনন্দে চকচক করে
উঠল
বিনাশবাবুর। যাক বাবা,
খাতাগুলো
চুরি
হলেও
ফেরত
পাবার
একটা
উপায়
বলে
গেছে
চোরটা। বুকের
ভেতর
কোথাও
একটা
দুন্দুভি
বাজছে। দু’চোখ বন্ধ
করে
বিনাশবাবু
যেন
তার
খাতাগুলো
দেখতে
পাচ্ছেন। খাতাগুলো
পর
পর
সাজানো
রয়েছে
পুরোনো
বইয়ের
দোকানে। আর তার
পাশেই
একই
সারিতে
রঙচটা
লাল
মলাটের
উপর
সোনালি
অক্ষরে
লেখা যে
বইটা
জ্বলজ্বল
করছে
সেটা
আর
কিছু
নয়,
রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের
একখন্ড
রচনাবলী। একই সারিতে
বিনাশবাবু
আর
রবীন্দ্রনাথ। নাঃ, আর ভাবা
যাচ্ছে না। একটা
চোর
যে
তাঁর
স্বপ্নকে
এইভাবে
পূর্ণ
করতে
পারে
তা
ভাবতেও
পারেননি
তিনি। শুধু পড়াশোনাটা
হয়তো
ভালো
করে
করেনি
ব্যাটা। কমসে কম
পাঁচখানা
বানান
ভুল
আছে
চিঠিটায়। এই ভয়ঙ্কর
দুঃসময়ের
মধ্যেও
হেসে
ফেললেন
বিনাশবাবু।
_____
ছবিঃ সুজাতা ব্যানার্জী
প্রিয় রাখী,তোমার গল্পটা একটু আগে মন দিয়ে পড়ে ফেললাম। তুমি যে এমন উঁচু মানের গল্প লেখো, আমার জানাই ছিল না! তোমাকে স্নেহ করি বলে যে, মনরাখা কথা লিখছি, তা কিন্তু নয়। সত্যিই যেমন প্লট, তেমনই পরিবেশন! সাসপেন্স অটুট শেষ অবধি।
ReplyDeleteনবরস হল :- আদিরস, হাস্যরস, করুণরস,রৌদ্ররস, বীররস,অদ্ভুতরস, ভয়ানকরস, শান্তরস এবং বীভৎসরস ।
তোমার এগল্প হাস্যরস-আশ্রিত। আমি মনে করি, "হাস্যরস" নিয়ে লেখা সবচেয়ে কঠিন...বিশেষ করে এখন, যে সময়ে মানুষ ক্রমশ যন্ত্র নির্ভর হয়ে পড়তে পড়তে নিজেও প্রায় যন্ত্র হয়ে গেছে। তুমি যে পাঠকবৃন্দকে এত সুন্দর একটা হাসির গল্প উপহার দিলে, সেজন্যে তোমাকে কুর্নিশ! চেষ্টা করেও আমি কোনো ত্রুটি ধরতে পারলাম না রাখী এবং এজন্যে আমি আনন্দিত।