নোরা বারক [মূল গল্প: দ্য ব্লু বিড]
অনুবাদঃ
প্রতীক কুমার মুখার্জি
।।
১ ।।
কালচে
গভীর জলের নিচ থেকে উঠে এল কুমীরটা। ছোটো
ছোটো ঘূর্ণির তলা দিয়ে, পাড়ের সোনালি সবুজ গোলগাল পাথরগুলোর দিকে সটান
ভেসে এল সে। বারো ফুটের চেয়েও লম্বা প্রাণীটার পেটের
ভিতর, হজমের সুবিধের জন্য গিলে ফেলা পাথরকুচির সঙ্গে পাক খাচ্ছিল একটা
ঝকঝকে রুপোর হার।
পাহাড়ের
উপরের জঙ্গল থেকে বিশাল কাঠের গুঁড়িগুলো ভাসিয়ে দেওয়া হয় এই খরস্রোতা ভারতীয় নদীর গতিপথে। সেগুলো
ভেসে এসে আড়াআড়িভাবে আটকে পড়ে এই পাথুরে অগভীর জায়গাটায়। অনেক
গুঁড়ি জমে গেলে কেউ না কেউ এসে বাঁশের লগি ঠেলে সেগুলো ছাড়িয়ে দেয় বা জোয়ারের সময়ে
জলের তোড়ে নাচতে নাচতে সেগুলো পুনরায় ভেসে যায় তাদের গন্তব্যে।
কুমীরটা
নিজেকে লুকোনোর কোনো চেষ্টা করে না। সে বিশ্রাম
নিতে এসেছে এই স্বচ্ছ কাচ-জলের রাজ্যে, জমে থাকা গুঁড়ির ভীড়ে,
ঢেউ খেলানো বালির চরে। নাক
আর চোখ জলের উপর উঁচিয়ে সে নির্মল বাতাসের সুঘ্রাণে মাতে। তার
শরীর ঘিরে বয়ে চলে রুপোলি জলের স্রোত - টিলা, ঘাস আর জঙ্গলকে সাক্ষী রেখে। দু’ধারের
জঙ্গল থেকে দুটো পায়ে চলা সরু পথ নেমে এসে মিশেছে জলে ভেজা, রোদে পোড়া সাদা পাথরগুলোতে, যার উপর ভীষণ মনোযোগে পোকা
ধরতে ব্যস্ত ছোটো ছোটো পাখির দল।
কালচে
বাদামী উপরিভাগ, আর পেটের দিকে হলদেটে সাদা চামড়ায় ঢাকা সুবিশাল
চেহারাটা নিষ্প্রাণ গুঁড়িগুলোর সঙ্গে মিশে নিস্পন্দভাবে অপেক্ষায় থাকতে পারে অনন্তকাল,
শিকারের আশায়। হিংস্রতা
ও আতঙ্কের প্রতিরূপ এই জলদানব, হাজার বছরের ইতিহাসে কালজয়ী এই সরীসৃপ,
যার লেজের অকল্পনীয় শক্তির আভাসটুকুও পাওয়া দুরূহ, মড়ার মতো পড়ে থাকে বালিয়াড়িতে। মাথার
প্রায় পুরোটাই জুড়ে থাকা মুখে লুকিয়ে থাকে এক অশুভ হাসি, যেখানে তার গলার তলাকার সবজেটে রঙ মিশেছে পেটের তলার হলুদে।
হয়তো
একশো বছর আগে, এরকম কোনো দিনেই সে ডিম ফুটে বেরিয়েছিল এরকমই
কোনো বালিয়াড়ির উপর, মাথা বার করে যা দেখেছিল তাতেই কামড় বসিয়েছিল
সেদিন থেকেই। সেদিন থেকেই
জলে নেমেছিল সে, শিকারের জন্য প্রস্তুত হয়ে – হিংস্রতাকে সম্বল করে। শিকারি
পাখি বা মাংসাশী মাছেদের, যাদের প্রিয় খাদ্য কুমীরছানা, হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে, খাবার জোগাড় করে গর্তে রেখে
পচাত সে। মিষ্টি জল আর প্রচুর পরিমাণে জমিয়ে রাখা
পচা খাবার খেয়েই সে আজ এই চেহারা নিয়েছে।
ইঞ্চিটাক
মোটা বর্মের মতো চামড়া আজ দুর্ভেদ্য। রাইফেলের
বুলেটও ফিরে যায় লজ্জায় – শুধু চোখ ও হাত-পায়ের নিচের অংশগুলো ছাড়া। নদীতে
অন্যান্য কুমীরদের সঙ্গেই থাকে সে, রোদ পোহায় লম্বা নাকের
ঘড়িয়ালদের সঙ্গেও – পাথরের উপর বা বালিয়াড়ির উপর, যতক্ষণ না গায়ে লেগে থাকা পাঁক শুকিয়ে ঝুরঝুরে হয়ে খসে পড়ে। অবশ্য
বিপদের বিন্দুমাত্র আভাসে সপাসপ জলে নেমে পড়ে এক লহমায়।
তাদের
খাদ্যতালিকায় প্রধানত মাছ, মাঝেমধ্যে জল খেতে আসা হরিণ, বানর, বালিহাঁস ইত্যাদি। কিন্তু
পোকাধরা কুকুর বা গরুর পচাগলা মড়াও বাদ দেয় না ওরা। কিছু
ক্ষেত্রে শ্মশান লাগোয়া নদী থেকে মানুষের আধপোড়া দেহ টেনে আনে ওরা।
তার
ঠিক পাশে জলের মধ্যে পাক খেয়ে বেড়াচ্ছিল একটা জিনিস। মূল্যবান
রত্ন নয়, কাচের বোতলের ভাঙা গলার অংশটুকু। জলের
মধ্যে সেটাকে দেখতে লাগছিল ঠিক যেন একটা নীলচে দামী পাথরের মতো।
।।
২ ।।
জঙ্গলের
ওধারের ছোট্ট গ্রামে নানা মানুষের কোলাহলের ভিতর, লালমাটির একটা
কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে এল একটা রোগা ছোটো মেয়ে। হাড়
জিরজিরে চেহারাটা ঢাকা একটা মেটে রঙের কাপড়ে, যেটা দু’ভাগে ছিঁড়ে সে
শাড়ি আর জামার কাজ চালাচ্ছে। তার
নাম সিবিয়া। সে তার খাবারের শেষ পর্যায়ে রয়েছে, কাঁচালঙ্কা ঘষা শুকনো রুটি আর গেঁজে ওঠা ঘি। ছোটো
সাজানো সাদা দাঁত দিয়ে শেষ হয়ে আসা খাবারটাও কামড়ে দু’ভাগ করে সে, যাতে আরেক গ্রাস খেতে পারে।
রুক্ষ
বাদামি চুল আর বড়ো বড়ো চোখের উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ বারো বছরের মেয়ে সিবিয়া। কষ্ট
সইবার বরাত নিয়েই যেন জন্ম হয়েছে তার, এই প্রখর শীতেও তার খালি
পা। বারো বছরের ছোট্ট জীবনকালে তার একমাত্র
সম্বল বলতে একটা কাপড়ের টুকরো। এক আনা
তো দূরের কথা, নয়া পয়সা, এমনকি এক পাই-এর
সাধ্য নেই তার, যা দিয়ে বাজারের এক চিলতে মনোহারী দোকানে ঢিপ
করে রাখা তারার মতো ঝকমকে কাচের পুঁতি, বা লাঠিতে ঝোলানো কাচের
চুড়ির সাধ মেটানো যায়।
শৌখিনতার
মানে সে কিছুটা জানে। বাবা মা ও ভাইদের
সঙ্গে জঙ্গল পেরিয়ে রেললাইন টপকে সে গ্রামের বাজারে যায় মাঝে মধ্যে। গায়ে
পোকাধরা আঁশটে গন্ধের কুকুর, বানরদের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে,
পান চেবানো অলস আড্ডা দেওয়া বা দরদস্তুরে ব্যস্ত গ্রামের লোকের ভিড়ে
ধাক্কা খেতে খেতে, গলায় ঘন্টা বাঁধা পবিত্র ষাঁড়ের ধুলোমাখা বিশাল
চেহারা সাবধানে পেরিয়ে যেত সিবিয়া।
মিষ্টির
দোকানের সামনে দাঁড়াতে ধুলো আর মাছি ভনভনে মধুমাখানো হরেক মিষ্টি তাকে স্থাণুবত করে
দিত। মিষ্টির অপূর্ব সুবাস নোংরা নর্দমা, সস্তার চুরুটের উগ্র কটু গন্ধ ছাপিয়ে তাকে মোহিত করে রাখত। বুনো
মধু বা গেঁজে যাওয়া আখের রস সে খেয়েছে বাড়িতে, কিন্তু রংবেরঙের এই মিষ্টিগুলো
তাকে পাগল করে দিত।
কাপড়ের
দোকানে স্তরে স্তরে সাজানো বাঘের মাথার ছাপমারা সুতির থান, মিল থেকে আনা আনকোরা নতুন কাপড়ের গন্ধ শোঁকার জন্য সে দিনভর সেখানে দাঁড়িয়ে
থাকতে পারে। এ তো কিছুই নয়, সাটিনের উপর রুপোলি সুতোর সূচিকর্ম, বারমিংহামের টিনের
রেকাবি, আয়নার টুকরো বসানো শাড়ি তাকে মন্ত্রমুগ্ধ
করে ফেলত। কাশ্মীরি শালওয়ালার জাদুপসরা বোঝাই গাড়ির
পিছনেও সে ছুট দিত সাহেবের বাংলোর দিকে, অন্যদের সঙ্গে। পশমের
কাপড়, যেগুলোর ভাঁজ খুললেই দুধের সরের মতো সেগুলো মাটিতে লুটিয়ে পড়ত,
ছোট্ট সিন্দুক বোঝাই দামি পাথর, আরো কত কী?
সবচেয়ে ভালো লাগত তার ছোট্ট রঙ্গিন বাক্সটা – যার
ডালা খুললেই তুড়ুক করে বেরিয়ে আসত এইটুকুন একটা উলে বোনা মুরগির ছানা! সিবিয়ার কাছে এ সব চমকের কোনো শেষ ছিল না।
কিন্তু
তার কপালে আজন্ম কাজ করে জীবন কাটানো ছাড়া কিছু লেখা নেই। হাঁটতে
শেখার সময় থেকে, ধান ঝাড়া, জ্বালানি সংগ্রহ
করা, ঘুঁটে দেওয়া, এমনকি রান্নাবান্না,
আগাছা তোলা, জল আনা, গবাদি
পশুর জন্য ঘাস কাটা ইত্যাদি কাজে সে পোক্ত হয়ে উঠেছে।
।।
৩ ।।
মা এবং
গ্রামের অন্যান্য মহিলাদের সঙ্গে নদীর পাশের নলখাগড়ার জঙ্গল থেকে কাগজ বানাবার ঘাস
কাটতে যেতে হত তাকে। কাটা শেষ হলে, সেগুলোকে গরুর গাড়ি বোঝাই করে রেললাইন পেরিয়ে মহাজনের কাছে বিক্রি করতে যেত
তারা, যে সেগুলোকে কাগজের কারখানায় পাঠাত। অবাক
হত সে – সারাদিন ধরে তারা খাটত, আর মহাজন আরামে মখমলের
কেদারায় বসে হুঁকো টেনে যেত।
সিবিয়ার
কষ্ট হলেও সে আমল দিত না, লাফাতে লাফাতে মায়ের পাশে পাশে চলত তার কাস্তে
ও খড় তোলার লোহার কাঁটা হাতে। কাজের
শেষে ফেরার সময় তার এই প্রাণশক্তি অবশ্যই অবশিষ্ট থাকত না, পিঠ বেঁকে যেত ভারী বোঝার ওজনে।
মহিলারা
অজানা কোনো ফুলের ঝোপ থেকে শক্ত লাল লাল বীজের মালা বানিয়ে পরে থাকত। চকচকে
লাল পুঁতির মতো বীজের একটা দিক কালচে, যেগুলো একবার বানালে
একটা বছর চোখ বুজে চালানো যায়, সেরকম একটা মালা সিবিয়াও বানাচ্ছে। সে ভাবে, মালা তৈরি হলে সেটাও তার গলায় ঝুমঝুমিয়ে বাজবে হাঁটার সময়! যদিও কাজটা সহজ নয়, কারণ শক্ত বীজগুলোকে ফুঁড়তে হত লোহার
ছুঁচ আগুনে লাল করে পুড়িয়ে। তাদের
ছুঁচটা এই করতে গিয়ে ভেঙ্গেছে, তাকে অপেক্ষা করতে হবে যতদিন না নতুন
ছুঁচ কেনার রেস্ত জোগাড় হয়।
কী মজা! সে অনেক অনেক মালা গাঁথবে – পায়ের মল, কানের ঝুমকো, নাকের নোলক, হাতের
চুড়ি, সব বানাবে সে, বাজারের দোকানে দেখা
সমস্ত জৌলুষ তার ছোট্ট শরীরে ধারণ করবে সিবিয়ারানি।
বকবক
করতে করতে মহিলার দল এগিয়ে চলেছে, পায়ে পায়ে তৈরি হওয়া সেই সরু জঙ্গুলে
পথ বেয়ে নদী অভিমুখে। রাস্তায়
তারা পেরোল যাযাবর সম্প্রদায় গুজরদের ঘাসের তৈরি তাঁবুর ছোট্ট উপনিবেশ, যারা তাদের পোষা গবাদি পশুদের বিচরণভূমির সমস্ত ঘাস শেষ না হওয়া অবধি সেই এলাকাতেই
থেকে যায়। যখন তাদের তৈরি ছানা, দুধ, বা শিকারের টোপ হিসেবে ব্যবহৃত এঁড়ে বাছুরের বিক্রিবাটা
কমে আসে, তখন তারা সেই এলাকা ছাড়ে নতুন আস্তানার খোঁজে। এছাড়াও
যখন জংলি চিতা বা বাঘের হানায় তাদের পোষ্যগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে, তখনও তারা পাততাড়ি গোটায় তড়িঘড়ি।
যেতে
যেতে গুজর প্রজাতির মহিলাদের ঠাহর করে সিবিয়া। তারা
পা চাপা পায়জামা পরে থাকে, রুপোর টাকা গলিয়ে বড়ো বড়ো কানের মাকড়ি পরে। একজনকে
দেখল সিবিয়া মোটা একটা বাঁশের লাঠি ঠুকে ঠুকে পিতলের কলসি পরীক্ষা করছে – শব্দতেই বুঝে নিচ্ছে সে কোন পাত্রটা জলে ভর্তি, আর কোনগুলোকে
আবার ভরে আনতে হবে নদী থেকে। তাদের
পরিবারের পুরুষরা কেউ এই সময়ে বাড়ি থাকে না, হয় তারা গরু চরাতে বেরিয়েছে,
নয় বাজারে গেছে তাদের পসরা বোঝাই করে। শুধু
দু-তিনটে বিশাল বপুর মোষ ভিজে কালো নাকে বাতাসের আঘ্রাণ নিতে নিতে জাবর কেটে চলেছে।
গুজররাও
জংলি প্রজাতির মানুষ, সিবিয়াদের মতোই, জঙ্গলেই
জন্ম ও বেড়ে ওঠা। হাজার হাজার
বছর ধরে, বনজঙ্গল ও পশুপাখিদের সঙ্গে বাঁচতে শিখেছে, খাবার সংগ্রহ করেছে, আর সেই দিয়ে আরও গবাদি পশু ও রুপোর
গয়নায় অর্থলগ্নী করেছে। তারা
যাযাবরও নয়, প্রস্তরযুগের মানুষও নয়, আবার চাষিও হয়ে উঠতে পারেনি সেভাবে।
।।
৪ ।।
চলতে
চলতে গাছপালার কালো ছায়ার মধ্যে দিয়ে সূর্যের আলো পড়ে ঝিকমিকিয়ে ওঠা নদীর জল দেখা গেল। তারা
এতটাই কাছে এসে পড়েছে, যে বয়ে চলা নদীর কুলকুল শব্দ তাদের কানে ধরা
দিল। জঙ্গল ফুঁড়ে তারা বেরিয়ে এল নদীর পাড়ে, ঠিক পাথরগুলোর পাশ থেকে।
এখনও
তাদের আড্ডা আর হাসির আওয়াজে জঙ্গলের নীরবতার ব্যাঘাত ঘটছে, আর সেভাবেই তারা পৌঁছে গেল নদীর জলের কাছে। হাঁটু
অবধি কাপড় তুলে, কাস্তে আর লোহার কাঁটা কাঁধে ঝুলিয়ে তারা পাথর
থেকে পাথরে লাফিয়ে অত্যন্ত অভ্যস্তভাবে নদী পেরোতে লাগল। তাদের
বকবক এই অবস্থাতেও বহাল, এবং নদীর শব্দ চাপা পড়ে গেল সেই কলকলানিতে।
কুমীর
শব্দে ভয় পায়। বিশ্রামরত সেই কুমীর এক চুলও নড়ল না, মহিলারাও নদী পার হয়ে গেল নিরাপদে। পার
হয়ে তাদের একটা খাড়া চড়াই উঠতে হয় নলখাগড়ার বনে পৌঁছোতে, তাই রোজকার মতো যে যেখান দিয়ে পারল, সেখান দিয়েই হাচোড়পাচোড়
করে তাদের গন্তব্যে এসে উঠে পড়ল।
এখন
তাদের পায়ের বেশ খানিকটা নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে নদীর চওড়া হতে থাকা খাত, স্ফটিক স্বচ্ছ
জল তোড়ে বয়ে যেতে যেতে তৈরি করছে অসংখ্য ছোটো ছোটো ঘূর্ণি, আর উজ্জ্বল মাছরাঙ্গারা
রঙের রামধনু বইয়ে দিচ্ছে সারা নদী জুড়ে। বিশালকায় কাছিমদের আর দশ কুড়ি কিলো ওজনের পেল্লায়
মহাশির মাছেদের আস্তানা এখানে। কুমিরদের
বাড়িও এখানেই। অন্য সময় তাদের দেখা যায় এখান থেকেই, সাদা পাথরের উপর শুয়ে রোদ
পোহাতে। কিন্তু এই মুহূর্তে তাদের একজনকেও এখানে দেখা যাচ্ছে না।
হাজার
যোজন দূর থেকে বনের ভিতর দিয়ে বয়ে আসা মিষ্টি বাতাস সিবিয়ার ঘর্মাক্ত শরীর জুড়িয়ে
দিচ্ছে এখন, ঘাস কাটতে কাটতে সে আড়চোখে নিচে তাকিয়ে নিজেকে আকাশে ওড়া পাখি ভাবে –
কল্পনার ডানায় ভর করে সে তার পাখির শরীর ভাসিয়ে নেমে পড়ে সেই পাথুরে বালিয়াড়িতে,
যা কখনও ছিল তার স্বপ্নের খেলাঘর।
জোয়ারের
সময়ে জল যেখানে উঠে পড়ে পাথরের গায়ে তার অহংকারের দাগ রেখে যায়, তার ঠিক উপরেই ছোটো
ছোটো গুহা আছে। সিবিয়া নদীর এঁটেল মাটি দিয়ে ছোটো ছোটো পাত্র বানিয়ে সেই
গুহাগুলোতে রেখে দেয় শুকোবার জন্য। যদি সেগুলোকে কোনোভাবে রঙ করা যেত, কত কী আকঁত
সে – হাতি, পাখি, গাছগাছালি!
মায়ের
রাগী স্বরের ডাকে তার চিন্তার জাল ছিঁড়ে যায় হঠাৎ! মায়ের কঠোর চাউনি তৎক্ষণাৎ তাকে
কাজে ফেরায়। সারাদিন পরে কাজের শেষে তাদের বাড়ি ফেরার পালা, রাতের খাবার বানাবার
পালা। পিঠের উপর ঘাসের পাহাড় চাপিয়ে, আবার তারা নদী পেরোতে উদ্যত হয়।
সিবিয়া
কিন্তু ইচ্ছে করেই একটু পিছিয়ে পড়ে। আরও
কিছুক্ষণ থেকে, তার সম্পত্তি ওই পাত্রগুলির সরেজমিনে তত্ত্বাবধান
সেরেই সে রওনা দেবে বাড়ির পথে।
মহিলারা
সারাদিনের খাটুনি, আর পিঠবোঝাই ওই ওজন থাকা সত্ত্বেও, দিব্যি বকবক করে পথ চলেছে। যারা
একেবারে সামনে আছে, তারা পিছনের মহিলাদের হাঁক পেড়ে নদী পার করতে
শুরু করে, এবং অচিরেই নিরাপদে নদী পার হয়ে সেই সরু পায়ে চলা পথ
ধরে মিশে যেতে থাকে সন্ধে নামতে থাকা ওপারের জঙ্গলের অন্ধকারে। আস্তে
আস্তে তাদের কন্ঠস্বর মিলিয়ে যেতে শুরু করল।
।।
৫ ।।
নীরবতা
আবার চারদিক গ্রাস করে নিল। পিঠবোঝাই
ঘাস নিয়ে পা মেপে মেপে সিবিয়া নেমে এল পাথরগুলোর কাছে। গোধূলির
মরে আসা আলোর গোলাপি আভায় আস্তে আস্তে ছায়াগুলো লম্বা হতে থাকে। সূর্য
পাটে যেতে জলের ভিতরটা আর আগের মতো দেখা যাচ্ছে না, তাই কোথায় জলের
শেষ আর কোথায় শুরু সেটাই আর বোঝা যায় না।
সিবিয়া
প্রথম পাথরে পা ফেলল। ইতিমধ্যেই তার
হাত, কাঁধ আর পিঠের অপুষ্ট পেশিগুলো যন্ত্রণায় টনটন করছে। কাস্তে
আর লোহার কাঁটা দুটো কাঁধের এতটাই কাছে ঝুলছে, সেই জায়গার চামড়ায় ঘষায়
জ্বলুনি শুরু হয়েছে, যদিও সে সেখানে মোটা করে কাপড়ের আস্তরণ দিয়ে
রেখেছে।
মাঝনদীতে
এসে সে তার কাঁধের বোঝা নামাল একটা বিশাল জগদ্দল পাথরের উপর বিশ্রাম নিতে। পাথরে
ভর দিয়ে হাঁপাতে লাগল তার ক্ষুদে শরীরটা।
ঠিক
সেই সময়েই এক গুজর মহিলা দুটো পিতলের কলসি নিয়ে জঙ্গলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। বালিবিহীন
পরিষ্কার জল পাওয়ার চেষ্টায় সে বালিয়াড়ি পেরিয়ে চটজলদি নেমে এল একেবারে পাথরগুলোর উপর।
কুমিরটা
যখন তাকে লক্ষ করে ঝাঁপ দিল তখন তাদের ভিতর দূরত্ব মাত্র কয়েক গজ! কালো কালির মতো জলের ভিতর থেকে লাফিয়ে উঠল বিশাল প্রাণীটা, তার সারা গা থেকে জলোচ্ছাসের ফোয়ারা, বিরাট চোয়ালের ভিতরে
সাজানো সারি সারি করাল দাঁতে সে কামড় বসাল মহিলার পায়ের গোছে।
মহিলার
আর্তনাদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে যোগ হল আরও দুটো আওয়াজ – কলসি দুটোর ধাতব
শব্দ পাথর থেকে পাথরে ছড়িয়ে পড়ল, এবং সেগুলো গড়াতে গড়াতে জলে
পড়ে হাবুডুবু খেতে খেতে ভেসে গেল।
সিবিয়ার
প্রথম অভিব্যক্তি – ঈশশশ, দু-দুটো পিতলের
কলসি চলে গেল! গুজর মহিলাটি প্রাণ বাঁচাবার তাগিদে সর্বশক্তি দিয়ে পিছোবার বিফল
চেষ্টা করল, কিন্তু মূর্তিমান শয়তানের দংশন আরও শক্ত হতে সে সজোরে আছড়ে পড়ল পাথরের
উপর। আর সেই মুহূর্তেই মরিয়া হয়ে একটি গুঁড়ি জাপটে
ধরল সে! গুঁড়িটা দুটো বিশাল পাথরে বেয়াড়াভাবে আটকে ছিল, সেটা আঁকড়ে ধরে ঝুলতে ঝুলতে
আর্তনাদ করতে লাগল সে, আর কুমীরটা তাকে জলে টানার চেষ্টায় মশগুল হয়ে তার লেজ
আছড়াতে থাকল প্রবল বিক্রমে। লেজের ঝাপটায় জলে আলোড়ন শুরু হল, আর ফিনকি দিয়ে বেরোনো
রক্ত চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
।।
৬ ।।
বিদ্যুৎ
ঝলকের মতো লাফিয়ে উঠল সিবিয়া! পাহাড়ি বুনো ছাগলের ক্ষিপ্রতায় পাথর থেকে পাথরে
লাফিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল ছোট্ট রোগা মেয়েটা। অন্য সময়ে
এই পাথরগুলো টপকাতে, বিশেষ করে নদীর মাঝ বরাবর, যেখানে মোটা কাচের মতো জল বয়ে চলে
দ্রুতলয়ে, খুব বেগ পেতে হত ওদের। কিন্তু
এখন যেন ডানায় ভর করে উড়ে এল সিবিয়া, কোথায় তার পা পড়ছে গরজেই আনল না সে, এক পলকে পৌঁছে
গেল মহিলার কাছে!
কুমীরটা
যেন মহিলার পা কামড়ে ধরে খড়কে কাঠির মতো এদিক ওদিক নাড়াচ্ছিল, আর সেই অশান্ত,
রক্তে রাঙা জলের ভিতর তার মুখে খেলা করছিল একটা বিশ্রী, কুটিল হাসি – সিবিয়ার মনে
হল। ওই অবস্থাতেই তার কুতকুতে চোখ ঘুরল মেয়েটার দিকে – স্রেফ লেজের এক বাড়িতেই সে
তাকে নিকেশ করে ফেলতে পারে!
সে
চেষ্টা করল! লেজের ঝাপটায় প্রায় বিশ ফুট ছিটকে উঠল জলস্তম্ভ, আর পড়ল ঠিক যেন রুপোলি
রশির মতো!
আবার
আক্রমণ শানাল সে! আঘাতের প্রকোপে বিশাল পাথরটাও নড়ে উঠল। সিবিয়া দমল না। এইসব ঘটনা
তাদের জঙ্গলের দৈনন্দিন জীবনে জঙ্গুলে ফণীমনসার অস্তিত্বের মতোই আকছার ঘটে থাকে।
সে মন দিয়ে সরীসৃপের চোখের দিকে তার লক্ষ্যস্থির করতে ব্যস্ত তখন!
গায়ের
সমস্ত শক্তি দিয়ে, তার লোহার কাঁটাটা গুঁজে দিল কুমীরের চোখের ভিতর। একটা কাঁটা
আমূল বিঁধে গেল চোখে, আরেকটা তার গালের রুক্ষ চামড়ায় ঘষা খেয়ে গেল সজোরে!
অসহ্য
যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠল কুমীরটা, ব্যথায় গুমরে উঠে সে অনেকটা উঠে এল জলের থেকে, এবং
তার নাকের উপরিভাগ প্রায় ধনুকের মতো বেঁকে গিয়ে লেজের কাছাকাছি চলে এল – পুরো
শরীরটা তারপর সজোরে আছড়ে পড়ল জলে। ছিটকে উঠল জল, আর সেই মুহূর্তেই, রক্তাক্ত ফেনার
মধ্যে হারিয়ে গেল তার কালান্তক চেহারাটা!
তার
মরণ অনিবার্য। এখনই নয়, কিন্তু তার মরার খবর অনেকদিন কারও সামনে আসবে না, যতদিন না
তার পেটে জমে ওঠা হাওয়া তাকে ভাসিয়ে তুলবে। তারপর তাকে হয়তো পাওয়া যাবে গুঁড়িগুলোর
মধ্যেই কোথাও – উলটো হয়ে ভেসে থাকবে তার দেহ, তার একটা চোখে ভর্তি পুঁজরক্ত নিয়ে!
প্রায়
সংজ্ঞাহীন মহিলাটিকে জড়িয়ে ধরে জলের কাছ থেকে টেনে তুলল সিবিয়া। বালি দিয়ে তার ক্ষতে
প্রলেপ দিয়ে, তার একমাত্র সম্পত্তি সেই কাপড়ের টুকরো দিয়ে বেঁধে ফেলল সে, তারপর
মহিলাকে ধরে ধরে পৌঁছে দিল গুজরদের উপনিবেশে, যেখানে দলের পুরুষেরা তার চিকিৎসার
ব্যবস্থায় ব্যস্ত হল।
।।
৭ ।।
ভর
সন্ধেবেলায় সিবিয়া আবার জঙ্গলে ঢুকল তার ঘাস, কাস্তে আর লোহার কাঁটা নিতে! তার
ভাগ্য ভালো, কাঁটাটা জলে চলে যায়নি কুমীরের সঙ্গে। নিচু
হয়ে সেটা তুলতে যেতেই, তার চোখে পড়ল জিনিসটা! একটা নীল পুঁতি! অবশ্য এখন, এই
সন্ধ্যাবেলায় তার রঙ সঠিকভাবে বোঝাই যাচ্ছে না – চাঁদের মতো লাগছে দেখতে ওটাকে,
জলের তলায় তার নিটোল গোল আকৃতি যেন স্রোতে টলায়মান! হাত বাড়িয়ে ওটা তুলতে যেতে
প্রথমবার ধোঁকা খেল সে, তারপর হাতটা আরও ডুবিয়ে তুলে আনল সেটা।
তার
ভিজে হাতের তালুতে সেই সাত রাজার ধন এক মানিক, এমনকি মালা গাঁথার জন্য ফুটোও করা
আছে তাতে, আর ভিতরে খেলা করে বেড়াচ্ছে কিছু সোনালি গুঁড়ো! সিবিয়া আনন্দে পাগল হয়ে
গেল!
কিছুক্ষণ
পরে সংবিৎ ফিরতে সে তার কাপড়ের ভিতর, পেটের কাছটাতে কষে বেঁধে ফেলল সেটাকে, যাতে
কোনোমতেই পুরোনো জ্যালজেলে কাপড় ছিঁড়ে সেটা পড়ে না যায়।
তারপর
নির্বিকারভাবে তার জিনিসপত্র উঠিয়ে সে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল। একটা দিন গেল যা হোক!
বালিয়াড়ি
পেরিয়ে তার শুকিয়ে আসা খালি পাগুলো যখন জঙ্গলে প্রবেশ করল, তখন ম্যালেরিয়ার মশারা তাদের
নেশা ধরানো গান শুরু করেছে গাছগাছালির ভিতর। এই রাস্তা
আর কোনোমতেই নিরাপদ নয় এই মুহূর্তে – এক বুড়ো, দাঁত ক্ষয়ে যাওয়া দাঁতাল মাকনা
হাতির এলাকা এটা! সিবিয়ার ওসব চিন্তাই নেই – সে নিজের ভাবনায় বিভোর হয়ে পথ চলেছে,
রাতের আকাশে তারার সমাগম তার চোখ এড়িয়ে যায়!
ফিরতি
পথে মায়ের সঙ্গে দেখা হল সিবিয়ার, রাগে চিন্তায় অগ্নিশর্মা। হাঁপাতে হাঁপাতে মা
বলল, ‘বাড়ি পৌঁছে খেয়াল করলাম তুই দলে নেই, তখন ভাবলাম তোর নিশ্চয়ই কিছু একটা
হয়েছে। কোথায় ছিলি এতক্ষণ?’
সিবিয়া
তার গল্পটা সংক্ষেপে বলেই বলল, ‘কিছু হয়েছে? হয়েছেই তো! এই দেখো, আমার হারের জন্য
আমি আমার নীল পুঁতি পেয়ে গেছি!’
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment