পরিবউ
দেবজ্যোতি
ভট্টাচার্য
অনেক কাল আগে পৃথিবীর
বুকে আওতারাঙ্গী দেশে ছিল এক রাজপুত্র। তার নাম ছিল তাওহাকি। তাওহাকি ছিল যেমন জোয়ান, তেমনই সুন্দর দেখতে। আর তেমনই ছিল তার
সাহস। আর সেইজন্য দেশে দেশে তার নাম ছড়িয়েছিল। নাম ছড়াতে ছড়াতে একদিন শেষে মাটির
দুনিয়া ছাড়িয়ে আকাশপরিদের দেশ আকাশগঞ্জেও গিয়ে পৌঁছল তার রূপগুণের কথা। শুনে হাপাই নামে এক আকাশপরি ভাবল, “এমন রূপেগুণে সেরা ভীষণ বীরপুরুষ কি
সত্যিই আছে নাকি মাটির দুনিয়ায়? বিশ্বাস হয় না যে! যাই গিয়ে দেখে আসি।”
তারপর তো এক
গ্রীষ্মের সকালে সেই
আকাশপরি আকাশ বেয়ে এসে পৃথিবীর মাটিতে নামল। তারপর অদৃশ্য হয়ে উড়ে গেল আওতারাঙ্গী
দেশে।
সেখানে গিয়ে
আড়াল থেকে তাওহাকিকে দেখে পরি তো মুগ্ধ। দু’চোখ ভরে দেখে আর মনে মনে ভাবে, “আহা মরি মরি। লোকে যা
বলে এই কুমার দেখি তার চাইতেও রূপবান, তার চাইতেও অনেকগুণ সাহসী!” এই বলে সে আর
থাকতে না পেরে, অদৃশ্য হবার মন্ত্রটন্ত্র ভুলে গিয়ে, হাসি হাসি মুখে রাজপুত্রের
একেবারে সামনে এসে হাজির।
তারপর তো রোজ
সকালে আকাশপরি তার আকাশগঞ্জের আকাশবাড়ি ছেড়ে এসে হাজির হয় রাজপুত্রের কাছে। দু’জন মিলে প্রাসাদে,
অরণ্যে, পাহাড়ে ঘুরে ঘুরে সারাটা দিন কত হাসি, কত খেলা, কত গান। এমনি করে চলতে
চলতে একদিন শেষে আকাশপরি আর রাজপুত্রের বিয়ে হয়ে গেল। পরি তার আকাশের বাড়ি চিরকালের জন্য ছেড়ে চলে এল
মাটির পৃথিবীতে তার রাজপুত্রের ঘরকন্না করতে।
তবে কিনা এমন
কাণ্ড এর আগে কস্মিনকালেও হয়নি কখনও। আকাশের পরি মাটির মানুষকে বিয়ে করেছে এমন কথা কে আর কবে শুনেছে
বলো? আকাশপরির দেশের আর সব পরিরা তাই এই খবরটা পেয়ে রেগে আগুন। বলে, আকাশগঞ্জের মেয়ে
আমাদের, মাটির বুকে তার থাকা বারণ। তাকে ফিরে আসতেই হবে আকাশবাড়িতে।
খবর গেল
পৃথিবীতে। শুনে রাজপুত্রের পরিবউ বলে, “কক্ষনো না। আমি আমার রাজপুত্রকে ছেড়ে কিছুতেই আকাশে
যাব না।”
শুনে
আকাশগঞ্জের পরিরা ঠিক করল, আসতে না চাইলে জোর করেই ফিরিয়ে আনতে হবে পরিবউকে। তারপর একদিন
তারা দল বেঁধে আকাশ বেয়ে ঝাঁপিয়ে এল পৃথিবীর বুকে। তারপর রাজপুত্রের প্রাসাদে এসে পরিবউয়ের হাত ধরে টান
দিল।
পরিবউ ভীষণ লড়াই করল।
রাজপুত্র তাওহাকি তার বউকে প্রাণপণে চেপে ধরে রইল। লড়াই দিল আকাশপরিদের বাহিনীর সঙ্গে।
কিন্তু বেচারারা দু’জন মিলে একলা একলা অতজন আকাশপরির সঙ্গে পারবে কেন? খানিক লড়াইয়ের পর তাওহাকিকে ধাক্কা
মেরে ফেলে দিয়ে তারা তাদের মেয়েকে বন্দি করে উড়াল দিল আকাশগঞ্জের দিকে। যেতে যেতে
ধমক দিয়ে বলল, “আকাশপরিদের জায়গা হল আকাশগঞ্জ। আর কক্ষনো, কোনোদিন তুই ফিরে যেতে পারবি না মাটির
দুনিয়ায়।”
শুনে পরিবউ চোখের জলে ভেসে
আকাশ থেকে ডাক দিয়ে বলে, “ও তাওহাকি, তাহলে তুমি আমার সঙ্গে আকাশগঞ্জে থাকতে এসো
গো। নইলে আমি একলা একলা কেমন করে...”
মাটির বুকে,
আকাশের দিকে দু’হাত ছড়িয়ে ধরে
তাওহাকি আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। আস্তে আস্তে তার পরিবউয়ের ডাক বাতাসের শব্দের সঙ্গে মিশে মিলিয়ে
যাচ্ছিল। বেচারা তাওহাকি কেমন করে সে ডাকে সাড়া দেবে আর! সে তো মাটির পৃথিবীর
মানুষ। আকাশে তো আর সে উড়তে জানে না!
পরিবউকে হারিয়ে তাওহাকির
দুঃখের জীবন শুরু হল এবারে। প্রাসাদ ছেড়ে, দেশঘর ছেড়ে সে ফকির হয়ে দেশে দেশে ঘোরে।
আর পথ খোঁজে, কেমন করে আকাশগঞ্জে যাওয়া যায়। একবার ঈগল পাখিদের গিয়ে বলল, “আমায়
আকাশ পেরিয়ে পরিদের দেশ আকাশগঞ্জে পৌঁছে দেবে?” শুনে ঈগলরা মাথা নেড়ে বলল, “অত উঁচুতে আমরা
উড়তে পারি না যে! দেখো গিয়ে যদি আকাশছোঁয়া কোনো পাহাড়ে-টাহাড়ে চড়ে সে দেশের নাগাল পাও।”
শুনে রাজপুত্র
চলল পাহাড় থেকে পাহাড়ে। কিন্তু একের পর এক আকাশছোঁয়া পাহাড়ের মাথায় উঠেও সে
আকাশগঞ্জের নাগাল আর পায় না।
একদিন, এমনই
এক পাহাড়ের গা বেয়ে চলেছে তাওহাকি, এমন সময় হঠাৎ দেখে পাহাড়ের ঢালে এক বুড়ি
দাঁড়িয়ে আছে। ভারী থুত্থুরে বুড়ি সে। তার হাতে একটা সরু লতা ধরা।
“কে গো তুমি
বুড়িমা?” তাওহাকি জিজ্ঞাসা করল।
শুনে সে বলল,
“আমি হলাম বুড়িঠাকুমা।”
“তা
বুড়িঠাকুমা তুমি এই বিজন দেশে একলা একলা দাঁড়িয়ে কেন?”
শুনে বুড়ি
বলে, “এই লতাটা দ্যাখ!”
তাওহাকি দেখল,
বুড়ির হাত বেয়ে লতাটা খাড়া
ওপরদিকে উঠে গিয়ে আকাশের গায়ে মিলিয়ে গেছে। সে প্রশ্ন করল, “লতা কোথায় যায় গো?”
বুড়ি মিটমিট
করে হেসে বলল, “যায় আকাশ পেরিয়ে।”
“কেন? কেন?”
বুড়ি এইবার তাওহাকির
দিকে ধারালো চোখে তাকাল, “আকাশ পেরিয়ে আছে আকাশগঞ্জ দেশ। যদি কোনো মানুষের ছেলে
সেই আকাশগঞ্জে যেতে চায় তো এই লতা বেয়ে সে সেই দেশে যেতেই পারে। তবে মুশকিল আছে।”
“কী মুশকিল?”
“মুশকিল হল, লতা তো তার ভার বইবে দিব্যি, কিন্তু সে-ছেলেকে
বেজায় সাহসী হতেই হবে। নইলে অনেক উঁচুতে উঠে একবার যদি সে নীচের দিকে তাকায় তাহলেই
ভয় পেয়ে মাটিতে আছাড় খেয়ে শতখান হয়ে যাবে।”
শুনে তাওহাকিকে
আর পায় কে! সাহসে সে দুনিয়ার সেরা। তার কেবল মনে হচ্ছিল, তার কথা ভেবেই তার পরিবউই নিশ্চয় বুড়িকে লতার সিঁড়ি নিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। এগিয়ে এসে
সে বলে, “আমি যাব বুড়িঠাকুমা।”
তার সাহস দেখে
বুড়ি ভারী খুশি হল। কিন্তু তবু তাকে সাবধান করে দিয়ে বলে, “লতাটা বড্ড সরু রে নাতি। একবার হাত ফসকেছে কি প্রাণে বাঁচবি না মোটে। পাহাড়চুড়োয়
আছড়ে পড়ে...”
“আমি ভয় পাব
না,” তাওহাকি বলে উঠল, “বড্ড ভালোবাসি যে আমার পরিবউকে। আমায় যেতেই হবে আকাশগঞ্জে তার কাছে।”
বুড়ি খুশি হয়ে
বলে, “বেশ বেশ। আমি তোকে একটা মন্ত্রও শিখিয়ে দিই তাহলে। লতা চড়তে চড়তে কখনও কাহিল হয়ে পড়লে মন্ত্রটা সুর করে গাইবি,
দেখবি ফের গায়ে জোর এসেছে। আবার তেমন দরকার হলে এই মন্ত্র পড়ে নিজের রূপও বদলে
নিতে পারবি তুই।”
এই বলে, বার
বার গেয়ে গেয়ে অভ্যাস করিয়ে করিয়ে তাওহাকিকে সে সুরেলা মন্ত্রটা শিখিয়ে দিল। তারপর
তাকে বিদায় দিয়ে বলল, “এইবারে রওনা দে তুই বীর ছেলে। বুকে সাহস রাখবি, কক্ষনো পেছন
ঘুরে চাইবি না, আর কাহিল হলেই মন্ত্রটা গাইবি।”
তাওহাকি তো লতা বাইতে শুরু করল। লতা তার ভারে এদিক দোলে ওদিক দোলে, রাজপুত্র ভয়
পায় না। কেবল ফিনফিনে লতা বেয়ে তরতরিয়ে উঠে
যায়। দেখতে দেখতে ছোটো পাহাড়ের চুড়ো পেরিয়ে, মেজো পাহাড়ের চুড়ো পেরিয়ে বড়ো বড়ো পর্বতরাজাদের
চুড়োও পেরিয়ে গেল সে। এবারে এল মেঘের দেশ। পায়ের নীচে মাটির পৃথিবী চোখে পড়ে না
আর।
এত উঁচুতে এসে
লতা যদি ছিঁড়ে যায়? কী
হবে তাহলে? কিন্তু তাওহাকি সে সব কথা মনেও আনে না। সে জানে, কিছুতেই হতে পারে না
এমনটা। কিছুতেই না। মাথার ওপরে আকাশগঞ্জে তার পরিবউ তার অপেক্ষায় আছে যে! তাকে তো পৌঁছোতেই
হবে সেখানে!
মেঘের দেশে
ভারী শীত। শীতে তাওহাকির নিঃশ্বাসে বরফ, হাত-পা জমে কাঠ। গায়ের জোর ফুরিয়ে আসছিল তার।
অবশ আঙুল এই বুঝি ছেড়ে যায় লতা থেকে!
ঠিক তক্ষুনি
তার মনে পড়ে গেল বুড়ির শেখানো মন্ত্রগানের কথা। আকাশগঞ্জের তলায় ছড়িয়ে থাকা নির্জন
মহাকাশের বুকে দুলতে দুলতে গলা চড়িয়ে প্রাণপণে সে গেয়ে উঠল সেই গান। আর সেই সুরের ছোঁয়ায় একটু একটু করে তার শরীর জুড়ে ফিরে এল শক্তির জোয়ার।
এইবারে ফের তরতর করে
বহুদূর উঠে গিয়ে তাওহাকি পৌঁছে গেল আকাশগঞ্জের দশ রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে নীচের
রাজ্যের সীমানায়। সে রাজ্যের মাটি ফুঁড়ে ওপরদিকে মাথা বাড়াল সে। অমনি ওপর থেকে তার
দিকে ছুটে এল জলের ধারা। তারপর তাকে পেরিয়ে ঝরে পড়তে লাগল পৃথিবীর দিকে।
জল ছাড়িয়ে ওপরের বাতাসে মাথা
তুলল তাওহাকি। দেখে সে মাথা জাগিয়েছে আকাশগঞ্জের
একটা পরিঝিলের মাঝখানে। ঝিলের জল
তারই বানানো গর্ত বেয়ে ধেয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর দিকে। আর ঝিলের ভেতর দল বেঁধে স্নান করছে আকাশপরির দল।
“এত জল পৃথিবীতে ঝরে
পড়লে তো বন্যা হবে সেখানে!” তাওহাকি ভাবল। কিন্তু তখন তার সে সব ভেবে নষ্ট করবার
সময় নেই। ঝিলের জলে স্নান করতে থাকা আকাশপরিদের দিকে তাকাবারও সময় নেই। সে জানে আকাশগঞ্জের
এই এক নম্বর রাজ্যে তার পরিবউ থাকে না।
তাই সে ঝিলের জলে মাথা
জাগিয়ে চারদিকে একনজর দেখে নিয়েই ফের লতা ধরে তরতরিয়ে উঠতে শুরু করল ওপরদিকে।
আকাশগঞ্জের দু’নম্বর
রাজ্যে পৌঁছে তার সঙ্গে বিরাট এক সাপ-মাছের দেখা। তার পেছনে শয়ে শয়ে খুদে সাপ-মাছ।
তাওহাকি তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁক দিল, “কে রে তুই?”
“আমি হলাম ইল মাছদের
সম্রাট। আমি চলেছি জলের খোঁজে,” মাছ জবাব দিল। তারপর জিজ্ঞেস করল, “তা হ্যাঁ গো
পৃথিবীর ছেলে, এদিকে তো জল-টলের বড়ো অভাব। পৃথিবীর হাল কেমন? জল-টল আছে তো?”
“উফ। ভীষণ জল সেখানে,” জবাব দিল তাওহাকি, “আসলে এক নম্বর
রাজ্য ফুঁড়ে ওঠবার সময় সেখানকার একখানা পরিঝিলের নীচে ফুটো করে দিয়েছি কিনা!”
“হুম। তবে তো দেখছি
পৃথিবীতে গেলেই ভালো হয়,” ইল-সম্রাট বলে উঠল, “চল রে আমার ছেলেপুলেরা, সবাই মিলে
তবে সেখানেই যাই।”
এই বলে সে তার
ছেলেপুলেদের নিয়ে এক নম্বর রাজ্যে নেমে গিয়ে সেখানে ঝিলের ফুটো দিয়ে সটান পৃথিবীতে
নেমে গেল। ঠাঁই নিল তার হাজারো নদীনালা খালবিলে। সেই থেকে পৃথিবীতে ইলমাছের বাস।
আর তারা কখনও আকাশগঞ্জে ফিরে যায়নি।
আকাশগঞ্জের তিন নম্বর
রাজ্যে উঠে এসে তাওহাকির সঙ্গে এক বিরাট পাখির দেখা। তার নাম পুলাকি। সে তার লম্বা
গলাটা বাড়িয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “এ কী? এ কী? পৃথিবীর মানুষ দেখি! তা যাস
কোথা?”
“চলেছি আকাশগঞ্জের চার
নম্বর রাজ্যে,” তাওহাকি জবাব হাঁকল।
“তা বেশ, তা বেশ। তা, পৃথিবীর হালচাল কেমন
রে?”
“বেজায় ভেজা। বান
ডেকেছে।”
“অ্যাঁ! বলিস কী রে? কী আনন্দ! কী আনন্দ!”
বলে ক্যাঁ ক্যাঁ করে উঠল পাখি। এমনটাই তো আমার চাই। আকাশগঞ্জটা ভারী বিচ্ছিরি
বুঝলি? একটাও জলা নেই, বিল নেই। আমি তবে পৃথিবীতেই চলে যাই। তা বল দেখি, তুই যে
এ-চত্বরে পা দিয়েছিস, সে-খবর পরিরা জানে?”
“উঁহু, জানাতে চাইও না,” তাওহাকি বলল।
“হুম। ভালো। তাহলে আমি
তাদের খবরটা দিয়ে দি!” এই বলে বদমাশ পাখিটা ঘাড় উঁচিয়ে ঠোঁট খুলল চার নম্বর
রাজ্যের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু ডাকটা দেবার আগেই তাওহাকি লাফ দিয়ে এগিয়ে এসে তার
ঠোঁটদুটো প্রাণপণে চেপে ধরেছে।
পুলাকি যত মুখ ছাড়াবার
জন্য ছটফট করে, ততই তাওহাকি আরও শক্ত করে চেপে ধরে তার নাকের ফুটোগুলো অবধি বন্ধ করে দেয়। চাপের চোটে পাখির
লম্বা ঠোঁট হয়ে গেল টকটকে
লাল। শেষে পুলাকিকে খাবি খেতে দেখে তাওহাকির খানিক দয়া হল। বলে, “কথা দে, ঠোঁট
ছেড়ে দিলে চুপচাপ থাকবি?”
পুলাকি রাজি হয়ে ঘাড়
নাড়তে তাওহাকি তার ঠোঁট ছেড়ে দিল। সেই থেকে পুলাকির ঠোঁটের রঙ লাল। তার ছানাপোনা, তাদের ছানাপোনা সবার ঠোঁটই লাল হয়ে
গেছে সেই থেকে। যাই হোক, তাওহাকির হাত থেকে ছাড়া পেয়ে পুলাকিও ইল সম্রাটের পথ ধরে
আকাশগঞ্জ ছেড়ে পৃথিবীতে নেমে গিয়ে বাসা করল।
এবারে তাওহাকি উঠে এল
আকাশগঞ্জের চার নম্বর রাজ্যে। এইখানে এসে লতা শেষ হয়ে গেল। তাওহাকি বুঝল, তার মানে
এইখানেই তার পরিবউয়ের বাড়ি। চারদিকে
তাকিয়ে দেখল সে একবার। কী যে সুন্দর সেই দেশ! যেদিকে তাকাও সবুজ বন। তার গাছপালারা
ফুলে ফুলে ছাওয়া। বনের ফাঁকে ফাঁকে নদীর স্রোত দেখা যায়।
সেই স্রোতের দিকে খেয়াল
করতে করতেই হঠাৎ তাওহাকি কাদের যেন গলার আওয়াজ শুনতে পেল। আস্তে আস্তে বনের ভেতর
হামাগুড়ি দিয়ে সে চলল শব্দগুলোর দিকে কান খাড়া রেখে। খানিক বাদে নদীর কাছাকাছি
পৌঁছে সে দেখে সেখানে একদল পরি মিলে একটা নৌকো বানাচ্ছে। পরিগুলোকে দেখেই তাওহাকির ভীষণ রাগ হয়ে গেল। এদের সে চেনে। এই দলটাই তার পরিবউকে ডাকাতি করে নিয়ে
গিয়েছিল।
‘এদের পিছু পিছু যাই বরং। তাহলে হয়তো পরিবউয়ের দেখা মিলে যাবে,’ তাওহাকি ভাবল। কিন্তু তার পরেই তার ভয় হল, টের
পেলে যদি পরিরা তাকে পৃথিবীতে ছুঁড়ে
ফেলে দেয়?
এইসব ভেবে-টেবে তাওহাকি ভারী সাবধানে জঙ্গলের
আড়ালে লুকিয়ে পড়ে সেই মন্ত্রগানটা ফের একবার গাইল। ওমা! গান শেষ হতে না হতেই দেখা
গেল তার চেহারা বদলে গেছে একেবারে। কোথায় সেই শক্তিশালী সুন্দর রাজপুত্র? তার
জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে এক কদাকার বিচ্ছিরি বুড়ো। তাকে রাজপুত্র তাওহাকি বলে চিনবে এমন
সাধ্যি নেই কারও।
এইবার সে আস্তে আস্তে
হেঁটে পরিদের কাছে এগিয়ে গেল।
তাকে দেখে একজন পরি বলে, “দ্যাখ দ্যাখ, একটা বুড়ো। এ এখানে এল কোত্থেকে?”
“এসে পড়েছে তো ভালোই
হয়েছে,” আরেক পরি জবাব দিল, “একে খাটিয়ে
নেয়া যাবে। এই, আমাদের কুড়ুলগুলো ওর হাতে দে দেখি! বাড়ি অবধি বয়ে নিয়ে চলুক আমাদের সঙ্গে!”
কুড়ুলের ভারে কুঁজো হয়ে
বুড়ো চলে পরিদের পিছু পিছু তাদের
বাড়ির দিকে। যেতে যেতে তাওহাকি ভাবে, “আহা রে। আমার রাজ্যের লোক যদি তাদের
রাজপুত্তুরের এমন দুর্দশা দেখত!”
কিন্তু পরক্ষণেই সে-সব
ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে সে। সে চলেছে তার পরিবউকে উদ্ধার করতে। তার জন্য এমন যে কোনো কাজ
করতে সে রাজি।
এইসব সাতপাঁচ ভাবতে
ভাবতেই হঠাৎ তাওহাকির মাথায় একটা বুদ্ধি এল। সে থেমে দাঁড়িয়ে পড়ে পরিদের বলে, “তোমরা বরং
এগিয়ে যাও। আমি বুড়ো মানুষ। আস্তে আস্তে আসছি তোমাদের পিছু পিছু।”
শুনে পরির দল তো হাসতে হাসতে গান
গাইতে গাইতে সামনে এগিয়ে গেল। তাওহাকিও ওমনি আবার নিজের পুরোনো রূপে ফিরে গিয়ে এক
ছুটে নদীর ধারে সেই নৌকোর কাছে। সেটা তখনও পুরো তৈরি হতে ঢের বাকি। তাওহাকি তখন ভীষণ
তাড়াতাড়ি নৌকোর একটা ধার পুরো তৈরি করে পালিশ-টালিশ করে ফেলল। করে আর ভাবে, “এদের চাইতে আমার
হাতের কাজ অনেক ভালো।”
কাজ শেষ করে ফের সে ছুট
লাগাল বনের পথ বেয়ে। তারপর পরিদের কাছাকাছি পৌঁছে ফের বুড়োর রূপ ধরে কুড়ুলের বোঝা বয়ে কুঁজো হয়ে চলল তাদের
বাড়ির দিকে।
বাড়ি পৌঁছে তাওহাকি দেখে
সামনেই তার পরিবউ। উঠোনের এক কোণে ভারী মনখারাপ করে বসে আছে।
কোনোকিছুতেই আগ্রহ নেই যেন তার কোনো। তাওহাকিকে আসতে দেখে ঘুরেও তাকাল না সে তার
দিকে। তবে তাওহাকি তক্ষুনি পরিবউকে নিজের পরিচয় দিতে রাজি নয়। “আগে নৌকোটা গড়া শেষ করি, তারপর...” এই ভেবে
সে নিজেকে বুড়োর ছদ্মবেশে লুকিয়েই রাখল তার পরিবউয়ের থেকে।
পরদিন ভোর হতে না হতে
ফের বুড়োর ছদ্মবেশে থাকা তাওহাকির কাঁধে কুড়ুলের বোঝা চাপিয়ে পরিরা চলল নদীর দিকে। নৌকোর
কাছে পৌঁছে পরিরা তো অবাক। “কে রে
আমাদের নৌকোটাকে রাতারাতি এমন অর্ধেক গড়ে দিল?” এই বলে তারা একে অন্যের মুখের দিকে চাইল।
কিন্তু এমন আশ্চর্য কাজটা কে করেছে সে কথা কেউই বলতে পারল না। শেষমেষ পরিরা আর কী করে? ফের সবাই
মিলে লেগে পড়ল নৌকোর বাকি কাজ শেষ করবার কাজে। সারাটা দিন ধরে চলল কাঠ কাটা, তক্তা
বানানো আর নৌকোর গায়ে সে সব লাগাবার কাজ।
সারাদিনে কাজ এগোল
সামান্যই। তারপর সন্ধে এলে বাড়ি ফেরার পথে তাওহাকি ফের আগের দিনের মতো কায়দা করল। পরদিন সকালে পরিরা এসে দেখে নৌকোর
অন্যপাশের কাজও রাতারাতি যেন জাদুমন্ত্রে সারা হয়ে গেছে। এবারে আর শুধু অল্প কিছু
কাজকর্মই বাকি তার।
এবারেও পরিরা কেউ কিছু বুঝতে পারল
না। পেছন পেছন কুড়ুল বয়ে নিয়ে আসা বুড়োটাই যে আসলে সব কিছু করেছে সে তাদের মনেও এল
না। তখন সবাই মিলে তারা এই নিয়ে অনেক যুক্তি করে ঠিক করল, সেদিন রাতে নৌকোর কাছে
তাদের একটা দল জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে দেখবে কে আসে রাতের বেলা তাদের নৌকো বানিয়ে
দিতে। তাওহাকিও তো ঠিক সেটাই চায়! সেদিন তাই যেই না সন্ধে হল, তাওহাকি আবার তার বুড়োর ছদ্মবেশ
ছেড়ে নিজের আসল চেহারা ধরে চলে এল নদীর ধারে নৌকোর কাছে।
যেই না সে কাজ করতে শুরু
করা অমনি পরিরা সবাই জঙ্গল থেকে
বেরিয়ে এসে ঘিরে ধরল তাকে। বলল, “এইবার তোমার দেখা পেয়েছি গো ছেলে। তুমিই তবে
লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের নৌকোটা এমন সুন্দর করে গড়েছ।”
যেই না এই কথা বলা অমনি তাওহাকি তাদের দিকে ঘুরে
তাকিয়েছে আর পরিরাও তাকে চিনে ফেলেছে। তাওহাকিও
আর সেখানে দাঁড়ায়নি। সিধে ছুট দিয়েছে তার পরিবউয়ের বাড়ির দিকে। অমনি পরিদের দলও ছুটেছে তার পিছু পিছু। ছুটতে ছুটতেই
তাদের একদল বলে, “ওটা পৃথিবীর মানুষ। এক্ষুনি ওকে পৃথিবীতে তাড়িয়ে দাও।” আবার আরেক
দল বলে, “না না, ওকে বরং এখানেই রেখে দিই এসো। ওর থেকে আমরা নৌকো গড়ার কায়দা শিখব,
আর তার বদলে ওকে আকাশপরি বানিয়ে দেব। তাহলে ওর বউটারও দুঃখ যাবে।”
এইসব বলতে বলতেই তাওহাকির
পেছন পেছন ছুটতে ছুটতে তারা এসে পৌঁছেছে তার পরিবউয়ের বাড়ির উঠোনে।
তাওহাকিকে দেখতে পেয়েই পরিবউয়ের মুখে হাসি চোখে
জল। দু’জন দু’জনের হাত ধরে সে যে কী ভীষণ সুখে
দাঁড়িয়ে রইল তারা সেই উঠোনে কী বলব। আর সেই দেখে অতি বড়ো নিষ্ঠুর পরিটারও মন ভিজে গেল। তখন
সব পরিরাই একসঙ্গে বলল, তাওহাকি
এখানেই থেকে যাক। কেউ আর তাকে ফেরৎ পাঠাবার কথা বলল না।
তারপর তো পরিরা তাওহাকিকেও আকাশপরি বানিয়ে দিল। আকাশপরিরা অমর। কোনো অসুখ, কোনো
কষ্ট তাদের ছুঁতে পারে না।
তাওহাকি আজও তার পরিবউয়ের সঙ্গে আকাশগঞ্জের
বাড়িতে সুখেশান্তিতে থাকে। এখন তার ভারী শক্তি। এতই শক্তি তার যে, যখন সে তার আকাশ
বাড়িতে হেঁটে বেড়ায় তখন পৃথিবীর আকাশ ছাদে সেই চলাফেরার গুমগুম শব্দ ওঠে। মানুষ
তাকে বলে বাজের গর্জন। আর যখন সে আনন্দে তার দুটো হাত দোলায়, তখন তা থেকে
বিদ্যুতের আলো বেরিয়ে আকাশ ঝলমল করে ওঠে।
-----------------------
অনুবাদকের কথা - আওতারাঙ্গী হল গিয়ে
আমরা যাকে নিউজিল্যান্ড বলে জানি সেই দেশের নাম। সেখানকার পুরোনো বাসিন্দা মাওরিদের
দেশে তাওহাকি একজন বিরাট নায়ক। প্রতিটি আলাদা আলাদা উপজাতির মধ্যে তাওহাকিকে নিয়ে
আলাদা আলাদা গল্প আছে। প্রত্যেকটা গল্পই সমান উত্তেজনায় টানটান আর মজার। তার মধ্যে
একখানা গল্প তোমাদের শোনালাম। পরে কখনও তাওহাকির আরও গল্প শোনাব’খন।
----------
শীর্ষচিত্র - অতনু দেব; গল্পের মধ্যের ছবি - দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
No comments:
Post a Comment