নিপুণ
ও
দরিয়া-কি-নুর
ঋতা
বসু
মল্লিকবাড়ির
শ্যাওলা
ধরা
উঠোনটা
পা
টিপে
টিপে
পেরিয়ে
গেল
নিপুণ। ক’দিন আগেই
ওখানে
একটা
রাম
আছাড়
খেয়েছে। এখনও মাথার
পেছনের
আলুটা
মেলায়নি। নিপুণের আর একটা
আলুর
ইচ্ছে
আপাতত
নেই। রাজেনদাদুকে কাছেপিঠে
দেখা
যাচ্ছে
না। একটার পর একটা
শ্যাওলা
ধরা
থাম
ঘিরে
রেখেছে
বিরাট
চাতালটা। সেখানে দশটা
কোঁকড়া
চুলের
পাথরের
বাচ্চা
ছেলে
একটা
হাত
উঁচু
করে
মশালদানি
ধরে
রেখেছে। ওরা গায়ে
জামা
পরেনি
কেন
জিজ্ঞেস
করাতে
রাজেনদাদু
বলেছিল,
“ওরা
দেবদূত
কিনা,
তাই
ওদের
জামা
পরতে
মানা।
ছোটোবেলায়
ওরা
প্রতিদিন
সন্ধেবেলা
জ্যান্ত
হয়ে
উঠত।
নিজের
চোখে
দেখেছি। ভাগ্যে থাকলে
তুইও
দেখতে
পাবি।”
নিপুণ
তাই
প্রতিদিন
ওদের
হাত
নাড়ে। ওদের মধ্যে
দিয়ে
এঁকেবেঁকে
ছোটাছুটি
করে। কবে কী হয় বলা যায় না।
চাতালের
একধারে
বারোটা
সিঁড়ি
উঠলে
পর
নাটমন্দির। এখন নাটমন্দির
খালি। পুজোর আগে মল্লিকবাড়ির
জ্ঞাতিগুষ্টি
যে
যেখানে
আছে
সব
আসবে। রাজেনদাদু বলে,
“আত্মীয়
না
ছাই। শত্রুর চেয়েও
বেশি।”
প্রতিমা
বসবে
আর
ক’দিন
পরেই। পুজোর চারদিন
খুব
ধুমধাম। তবে নিপুণ
রাজেনদাদুর
মুখে
খাওয়াদাওয়া
নিয়ে
যা
সব
আশ্চর্য
গল্প
শুনেছে
তার
ধারেকাছেও
কিছু
হয়
না
এখন। সবার জন্য
একরকম
প্রসাদ। একটা কলাকে
চার
টুকরো
করলে
যত
বড়ো
হয়
সেরকম
একটা
টুকরো
থাকে। তবু এই টুকরোটাই
সবথেকে বড়ো। বাকিগুলো, মানে
শসা
পেয়ারা
আপেল,
ঠিক
যেন
পটাটো
চিপসের
ঠোঙার
তলায়
পড়ে
থাকা
ঝুরো আলুভাজা।
নিপুণরা
একেবারেই
বড়োলোক
নয়,
কিন্তু
নিপুণের
মা
কোনোদিন
এমন
পাতলা
ঝিরিঝিরি
ফল
কাটে না। ফলের সঙ্গে
থাকে
একটা
নারকেল
নাড়ু। সেটাই নিপুণের
কাছে
সবথেকে
বড়ো
আকর্ষণ। ছোটো একটা
শালপাতার
বাটির
মাঝখানে
বসে
থাকে
সে
রাজার
মতো। বাটিটা এত হালকা
যে
হাতের
মধ্যেই
লতপত
করে
উড়ে
যেতে
চায়। নিপুণ নাড়ুটা
খেয়ে
বাটিটা
গেটের
ধারে
শিউচরণের
ছাগলদের
সামনে
ফেলে
দেয়। সাদা কালো,
কালো
সাদা
খয়েরি
ছোপ -
যে
পায়
বাটিটা,
খেয়ে
শিং
আর
দাড়ি
নেড়ে
নিপুণকে
থ্যাঙ্ক
ইউ
বলে।
পুজোর
ক’টা
দিন
বাদ
দিয়ে
মল্লিকবাড়িতে
রাজেনদাদু, শিউচরণ,
পাঁচটা
ছাগল
আর
অনেকটা
সময়
টিপু - এরাই
থাকে। ওঃ, পায়রাগুলোর
কথা
তো
বলাই
হল
না। ওরা কতজন
নিপুণ
আজ
পর্যন্ত
ঠিকঠাক
জানে
না। যতবার গুনেছে
আলাদা
সংখ্যা
বেরিয়েছে। কখনও তেইশ,
কখনও
সাতচল্লিশ। কখনও আবার
একশো
ছাড়িয়ে
গেছে। মাঝে মাঝে
রাজেনদাদুর
কথাই
ঠিক
মনে
হয়। দাদু বলে,
“এই
বাড়িটার
মধ্যে
একটা
গোপন
জাদু
আছে। ওসব জিনিস
সবার
জন্য
নয়। এই যেমন
তুই
আজ
দেখলি
সাতাশ,
কাল
সেটা
একশো
ছাড়িয়ে
গেল।
বল
দেখি
তুই
মালি
হয়
সে
কেমন
করে? শিউচরণকে
জিজ্ঞেস
কর, ও
বলবে -
জাদুটোনা। বহুদিনের লোক কিনা, কিছু
কিছু
ব্যাপার
ওরও
দেখা।”
এই
বলে
রাজেনদাদু
তার
মাঠের
মতো
বিশাল
ঘরের
যেদিকটায়
একদম
অন্ধকার
সেদিকে
চলে
যায়। নিপুণের ওদিকটায়
যেতে
ভয়
করে,
তবু
সে
চেঁচিয়ে
বলে,
“আমি
হয়তো
গুনতে
ভুল
করেছি। ওরা এমন ঝটপট
করছিল। নিশ্চয়ই এক পায়রা
চার বার
গুনেছি।”
“তোর
ভুল
হয়নি,
সেদিন
সত্যি
একশোর
বেশি
ছিল। বছরে একদিন
এ বাড়ির
আদিপুরুষের
আমল
থেকে
যত
পায়রা
জন্মেছে
মরেছে
সব
জ্যান্ত
হয়ে
ওঠে। এসব কি সবাই
দেখতে
পায়?
তোর
চোখ
আর
মনটা
আলাদা
বলে
দেখতে
পাস। যেদিন থেকে
লোভ
ঢুকবে,
সব
ভ্যানিশ
হয়ে
যাবে।
পুজোর
চারদিন
এ বাড়ির
যত
জ্ঞাতিগুষ্টি
আসে,
একজনও
দেখেছে
কিনা
জিজ্ঞেস
কর... দেখেনি। লোভ দূর করে বাড়িটাকে
ভালোবাসতে
হয়,
বুঝলি
নিপুণ, এমনি
এমনি
এসব
অশরীরী
বস্তু
দেখা
যায়
না।”
নিপুণ
হাঁ
করে
শোনে
রাজেনদাদুর
কথা। তার সারা
গায়ে
কাঁটা
দিয়ে
ওঠে। নিজের মনেই
দশবার
বলে,
‘লোভ
নয়।
একদম
লোভ
নয়।’
নিপুণের
মা
হাসপাতালের
নার্স। স্কুলের পর দু’নম্বর
বাক্সের
টিফিনটা
নিপুণ
মল্লিকবাড়িতে
বসেই
খায়। ইচ্ছে হলে বইখাতা
খোলে,
না
হলে
রাজেনদাদুর
টেকো
মাথায়
মিছিমিছি
পাকা চুল
খোঁজে। বদলে দাদু
দারুণ
সব
গল্প
বলে। ম্যাজিক দেখায়।
নিপুণের
মা
প্রত্যেক
পুজোয়
দাদুকে
ধুতি
আর
মিষ্টি
দিয়ে
প্রণাম
করে
বলে, “কাকা,
আপনার
ঋণ
শোধ
হবার
নয়। কী যে নিশ্চিন্তে
থাকি
আপনার
কাছে
এই
হাবা
ছেলেটাকে
রেখে। একা হাতে
এই
ছেলে
মানুষ
করা
কত
শক্ত
বোঝেনই
তো।”
“তোমার
ছেলে
মোটেই
হাবা
নয়। ও মানুষের
মতো
মানুষ
হয়েই
জন্মেছে। তুমি মিছিমিছি
চিন্তা
করছ। ওর চোখ মন সাধারণের
থেকে
আলাদা
আর
মনে
কাদা
নেই
বলে
তোমরা
সহজেই
হাবা
বলে
দাও,”
দাদুর
গলা
খুব
গম্ভীর।
নিপুণের
সামনেই
সবাই
ওকে
হাবা
বলে। ভাবে নিপুণ
কিছু
বোঝে
না। দাদু কিন্তু
বলে, “বুদ্ধিমান
লোকেরাই
সবার
কাছে
বোকা
সেজে
থাকে, আর
সময়মতো
যেটা
ঠিক
বলে
মনে
করে
সেটাই
করে।”
যতই
রাজেনদাদু
বলুক
না
কেন,
অতিরিক্ত
লোভই
এ বাড়ির
সর্বনাশের
মূল। নিপুণ কিন্তু
লোভ
হবার
মতো
জিনিস
হাজার
খুঁজেও
পায়নি। তবে সে ঠিক করেছে
এবার
অঞ্জলি
দেবার
সময়
চোখ
পিটপিট
করে
প্রসাদের
থালার
দিকে
আর
তাকাবে
না। কোন নাড়ুটা
বড়ো
সেটা
মাপবার
চেষ্টা
করবে
না।
ঠাকুরের
খাবার
আগে
লোভ
দেওয়া
উচিত
না।
আজ
একতলা
একেবারে
শুনশান। শিউচরণ আর তার ছাগলগুলো
গেল
কোথায়? বিকেলে
তো
তারা
উঠোনে
গলার
ঘণ্টা
বাজিয়ে
ঘুরে
বেড়ায়। নিপুণ উঠোন
পেরিয়ে
দোতলার
সিঁড়িতে
পা
দিল। রাজেনদাদুর ঘর থেকে
কথা
কাটাকাটির
শব্দ
ভেসে
আসছে, “কোন
সাহসে
তুমি
শিউচরণকে
বার
করে
দিলে? আমি
দুটি
ঘণ্টা
ছিলাম
না,
তার
মধ্যে
এই
কাণ্ড?”
“বাড়িটা
কি
ছাগল
চরার
মাঠ?
মাত্র
কয়েক বছরে
কী
হাল
হয়েছে
বাড়িটার?”
“তোমার
যদি
সত্যি
মমতা
থাকত
তাহলে
রিপেয়ার
করে
রক্ষা
করার
কথা
ভাবতে। প্রোমোটারের ফাঁদে
পা
দিতে
না। আমি যে ক’দিন
আছি
কিছু
হবে
না। আর না থাকলেও
তোমার
অন্তত
সুবিধে
হবে
না। এটা হেরিটেজ
প্রপার্টি। তোমাকে যারা
বুদ্ধি
দিচ্ছে
তারা
আশা করি
এটাও
জানে
হেরিটেজ
প্রপার্টি
নিয়ে
গোলমাল
করলে
তুমিই
বিপদে
পড়বে। আমার বিশ্বাসের
সুযোগ
নিয়ে
অনেক
কিছু
সরিয়েছ। আর সুবিধে
হবে
না।”
“তুমি
কিন্তু
খুব
ভুল
করছ।”
দাদু
তার
উত্তরে
বলল, “তুমি
এখন
বিদেয়
হও। আমি ছাগলগুলোকে
ধরে
আনি। সকাল সন্ধে
ওদের
দুধ
খাই। সেইজন্য তোমাদের
মতো
বিচ্ছুদের
এখনও
শায়েস্তা
করার
ক্ষমতা
রাখি। বুড়ো হাড়ের
ভেলকি
দেখনি
এখনও।”
এতটা
শুনে
নিপুণ
নিশ্চিন্ত
হয়ে
বারান্দার
সিংহাসনের
মতো
চেয়ারটায়
পা
তুলে
বসে
দু’নম্বর
টিফিন
বাটিটা
খুলে
বসল। এক নম্বরটা স্কুলেই
খাওয়া
হয়ে
যায়। সামনে দিয়ে
হন হন
করে
যে
লোকটা
গেল
তাকে
নিপুণের
চেনা
চেনা
লাগছিল,
কিন্তু
কোথায়
দেখেছে
মনে
করতে
পারল
না। একটু পরে দাদু
বেরোল
ঘর
থেকে। নিপুণকে দেখে
ভারি
খুশি
হয়ে
বলল, “ভালো
হয়েছে
তুই
এসে
গেছিস -
চুপটি
করে
বসে
থাক। আমি গিয়ে
শিউচরণ
আর
ওর
ছাগলগুলোকে
ধরে
আনি। উটকো উৎপাতের
চোটে
শান্তিতে
থাকার
জো
নেই।”
গজগজ
করতে
করতে
দাদু
এগিয়ে
গেল
আর
কিছুক্ষণের
মধ্যেই
নিচের
উঠোনে
ছাগলগুলোর
গলার
ঘণ্টার
টুং
টাং
আওয়াজ
শোনা
গেল।
এরপর
দেখ
দেখ
করে
বর্ষার
কালো
আর
ছাই
রঙে
মেশা
মেঘগুলো
এলোমেলো
হয়ে
কোথায়
পালাল
আর
সাদা
নীল
রঙের
ছোপ
ছোপ
তুলোয়
আকাশটা
ভরে
গেল। এইরকম আকাশ
আঁকতে
টিপুর
এত
ভালো
লাগে
যে
নীল
রঙটা
ক্ষয়ে
এইটুকু
হয়ে
গেছে। মাকে বলে লাভ নেই।
বলবে,
“একটা
রঙের
জন্য
এক বাক্স
নতুন
রঙ
কেনার
মানেই
হয় না।”
নিপুণ
না
বলতেই
রাজেনদাদু
একটা
লম্বা
বাক্স
থেকে
কাগজে
মোড়ানো
নীল
রঙের
গুঁড়ো
বার
করে
বলল, “এই
দিয়ে
তুই
যদি
আকাশ
রঙ
করিস
তাহলে
সত্যি
সত্যি
এক ঝাঁক
টিয়া
উড়ে
আসবে।”
“তাহলে
সত্যি
চাঁদ
সূর্যও
উঠবে
আমার
ড্রয়িং
খাতায়?”
“উঠতে
পারে,” দাদু
বলল
টাকে
হাত
বোলাতে
বোলাতে।
টিয়ার
ঝাঁকটা
মন্দ
হত
না,
কিন্তু
ড্রয়িং
খাতায়
চাঁদ
সূর্যর
ব্যাপারটা
টিপুর
ঠিক
পছন্দ
হল
না। শেষে সব পুড়ে-টুড়ে
একশা
হবে। দরকার নেই।
নীল
গুঁড়ো
ভরা
কাগজের
পুঁটলিটা
ছাদের
আলসের
গায়ে
বড়ো
পাথরের
পরির
খাঁজে
লুকিয়ে
রেখে
দিল
নিপুণ। বুড়োদাদু বলেছে,
এটা
নাকি
জাদুগুঁড়ো। এখানেই থাক সবার
চোখের
আড়ালে।
পুজোর
ক’দিন
আগে
থেকেই
মাটির
দুর্গাপ্রতিমা
এসে
গেল। এ বাড়ির
এটাই
নিয়ম। কাঠামোটা আসে কুমোরটুলি
থেকে। সাজানো হয় বাড়িতে।
ষষ্ঠীতে
বোধনের
আগে
সোনার
গয়না
আর
জরির
কাজ
করা
শাড়ি
আসে
নাটমন্ডপে, সারা
বছর সেগুলো কোথায় থাকে
কে
জানে? দাদু
বলেছে,
মা
দুর্গার
শাড়িটা
সোনার
তার
দিয়ে
বোনা। সেজন্য কখনও
কালো
হয়
না।
ঝলমলে
পাথর
বসানো
সীতাহারটা
পরিয়ে
দেবার
পর
মা
দুর্গাকে
এত
সুন্দর
লাগে
যে
নিপুণের
দেখে
দেখে
আশ
মেটে
না।
সে
কথা
রাজেনদাদুকে
বলার
পর
দাদু
নিশ্বাস
ফেলে
বলেছিল,
“তুই
দেখিস
জগজ্জননীকে
আর
অন্যরা
দেখে
সোনার
বাজার
দর। যতসব চোর লোভী
অকালকুষ্মাণ্ড।”
নিপুণ
জিজ্ঞেস
করেছিল, “দুষ্টু
লোকেরা
যদি
কেড়ে
নেয়,
তুমি
আটকাবে
কী
করে?
তুমি
বুড়ো,
আমি
বাচ্চা
আর
শিউচরণ
ভীতু। ছাগলের বদলে
কুকুর
থাকলেও
একটা
কথা
ছিল।”
দাদু
রহস্যময়
হেসে
বলেছিল, “এ
বাড়ি
থেকে
কেউ
একটা
জিনিস
সরাবার
চেষ্টা
করে
দেখুক
তো...”
“কোথায়
রাখ
এত
দামি
জিনিস?”
দাদু
তখন
ঘরের
ভেতরের
অন্ধকারটার
দিকে
তাকিয়ে
বলল, “আমি
কিছু
করি
না। ওরাই ঠিক করে রেখে
দেয়।”
টিপুর
গা-টা
শিরশির
করে
গলা
শুকিয়ে
কাঠ
হয়ে
গেছিল।
পরদিন
স্কুলে
কোনো
পড়া
পারেনি। অনবরত এটাই
ভেবেছে,
ওরা
কারা? পুজোর
ক’টা
দিন
বাদ
দিয়ে
সে, রাজেনদাদু,
শিউচরণ
আর
ছাগলগুলো
ছাড়া
কেউ
থাকে
না
এত বড়ো
বাড়িটায়।
সারাদিন
দেউড়ি
খোলা
থাকে। যার খুশি
সে
ঢুকতে
বেরোতে
পারলেও
কেন
জানি
না
কেউ
ঢোকে
না
মল্লিকবাড়িতে।
টিফিনের
সময়
এক
নম্বর
টিফিন বাক্সটা
শেষ
করে
মল্লিকবাড়ির
গেটের
সামনে
ছাগলগুলোর
যে
ছবিটা
এঁকেছিল
কাল
সেটা
রঙ
করছে
একমনে,
রঞ্জু
কাঁধের
পাশ
দিয়ে
উঁকি
মেরে
বলল,
“আবার
তুই
ওই
বাড়িটার
ছবি
আঁকছিস?
একেই
ওটা
একটা
ভূতুড়ে
বাড়ি। তার ওপর তুই কী সব জুড়ে-টুড়ে
আরও
ভূতুড়ে
করে
তুলিস।”
নিপুণ
আশ্চর্য
হয়ে
বলে,
“কিছু
জুড়িনি
তো? যা
দেখি
তাই
আঁকি।”
“এইরকম
দেখতে
থাম,
তার
নিচে
এই
লোকটা,
এগুলো
তো
কখনও
দেখিনি।”
নিপুণ
হেসে
বলে, “তুই
কি
বোকা
শিউচরণকে
চিনতে
পারছিস
না?”
রঞ্জু
কীরকম
ভয়
ভয়
মুখ
করে
তাকিয়ে
থেকে
বলল, “শিউচরণকে
বুঝি
এরকম
দেখতে?”
পিকলু
ওদের
কথা
শুনছিল
দাঁড়িয়ে।
বলল,
“এটা
তো
শিউচরণই। টিকিটা অত লম্বা
আর
নাকটা
বাঁকিয়ে
দিয়েছে
বলে
চিনতে
পারছিস
না।
কিন্তু
শিউচরণ
অত
রেগে
আছে
কেন?
চোখ
দিয়ে
যেন
আগুন
ঝরছে। দেখে ভয় লাগে।”
ওরা
যে
কী
দেখে
নিপুণ
বুঝতে
পারে
না। সে তো যেমন
দেখে
তেমনই
আঁকে।
যাই
হোক,
এখন
স্কুলের
পর
নিপুণের
পুরো
সময়টা
কাটছে
নাটমন্দিরের
চত্বরে। একটু একটু
করে
কেমন
সেজে
উঠছে
মাটির
প্রতিমা।
বাঁশ
আর
খড়
দিয়ে
বানানো
ন্যাড়া
ঠাকুর
রোজ
যেন
নিপুণের
দিকে
তাকিয়ে
মুচকি
হেসে
বলে -
কেমন
দেখাচ্ছে
আমাকে
বল
দেখি?
প্রতিবার
ঠাকুর
সাজায়
সনাতন
কাকা। সঙ্গে দু-চারজন
সাঙ্গোপাঙ্গো
থাকে।
এবার
পুজোর
আগে
মারাত্মক
একটা
দুর্ঘটনায়
সনাতন
কাকা
নাকি
প্রায়
মরতে
বসেছিল।
তার
বদলে
তার
ভাই
নরহরি
এসেছে।
সে
সনাতন
কাকার
মতো
চুপচাপ
নয়। যতক্ষণ কাজ করে ততক্ষণ
মুখ
চলে।
এই
ক’দিনে
নিপুণ
কত কিছু
যে
জানল
আর
শুনল। যদিও রাজেনদাদু
বলে,
“নরহরি
হল
বকধার্মিক। চান্স পেলেই
তোকে
গিলে
খাবে। ওর কথা বেশি
শুনিস
না।”
পুজোর
ছুটি
শুরু
হবার
আগের
দিন
নিপুণ
বাড়ি
ফেরার
সময়
নরহরির
সঙ্গে
মল্লিকবাড়ির
সেই
লোকটাকে একসঙ্গে
কোল্ড
ড্রিঙ্ক
খেতে
দেখল
দূর
থেকে। সে এত অবাক
হল
যে
বলার
নয়।
রাজেনদাদু
সব
শুনে
গম্ভীর
হয়ে
বলল, “এবার
আমাদেরও
একটু
সাবধান
থাকতে
হবে,
বুঝলি।”
ঠাকুরের
চক্ষুদানের
দিন
নিপুণ
উত্তেজিত
সকাল
থেকেই। পেটব্যথার ছুতো
করে
আজ
সে
স্কুলে
যায়নি।
শাড়ি
গয়না
দিয়ে
প্রতিমা
সাজানো
হয়ে
গেছে। চারদিকে ভিড় করে আছে পুজোর
সময়
যারা
আসে
সেই
সব
জ্ঞাতিগুষ্টির
দল। সেই লোকটা
দাঁড়িয়ে
আছে
দোতলার
বারান্দায়
একলা।
দাদু
নিপুণকে
হাত
ধরে
একদম
সামনে
পাশে
বসিয়ে
রেখেছে
বলে
তার
স্কুল
কামাই
সার্থক
হল।
কপালের
ওপর
তৃতীয়
নয়ন
আঁকা
হলে
পর
দাদু
বাক্স
থেকে
একটা
নীলচে
আলো
বেরোনো
পাথর
বার
করে
দিল
আর
পুরোহিতমশাই
সেটা
মা দুর্গার
কপালের
ওপর
আটকে
দিল।
সঙ্গে
সঙ্গে
চারপাশ
যেন
আলো
হয়ে
গেল। তারপর দাদু
নিপুণকে
বলল, “চল,
আমাকে
ঘরে
দিয়ে
আয়।”
নিপুণ
যেতে
যেতে
জিজ্ঞেস
করল,
“দাদু,
কোনোবার
তো
ওই
পাথরটা
লাগাও না।
এবার
কেন
দিলে?”
“ওর
নাম
নদীর
আলো –
দরিয়া-কি-নুর।”
টানা
বারান্দার
সাদা
কালো
চৌখুপি
মেঝেতে
লম্বা
ছায়া
ফেলে
দাদু
আর
নিপুণ
হাঁটছে।
লোকজন
কথাবার্তা
অনেকটা
দূরে
সরে
গেছে।
ক্রমশ
তারা
অন্ধকারের
দিকে
এগিয়ে
যাচ্ছে। নিপুণ কোনোদিন
এতক্ষণ
থাকে
না
মল্লিকবাড়িতে। তার এক ছুটে
পালাতে
ইচ্ছে
করছিল, কিন্তু
দাদু
হাতটা
এত
শক্ত
করে
ধরে
রেখেছে
যে
সে
দাদুর
টানে
সামনে
এগিয়ে
যাচ্ছিল। হঠাৎ সামনে
সেই
লোকটা। দাদু সেই লোকটাকে
শুনিয়ে
বলল,
“বারো
বছর
বাদে
বাদে
মায়ের
ত্রিনয়নের
জ্যোতি
ফিরে
আসে। আমরা এটা বিশ্বাস
করি
বলে
আমাদের
বংশে
এই
নিয়ম
চালু
আছে। নদীর আলো সবার
জন্য
নয়।
এমনিতে
এই
মণি
খুব
পবিত্র।
কু’নজর
দিলেই
কিন্তু
মৃত্যু।”
লোকটা
রাগে
গরগর
করতে
করতে
চাপা
গলায়
বলল, “অশিক্ষিত
ছোটোলোকদের
সঙ্গে
থাকতে
থাকতে
আপনার
মাথা
খারাপ
হয়ে
গেছে। এরাই একদিন
আপনার
সর্বনাশ
করবে, আমার
কথা
মিলিয়ে
নেবেন।” এই
বলে
নিপুণের
দিকে
একটা
জ্বলন্ত
দৃষ্টি
ছুঁড়ে
লোকটা
হন
হন
করে
চলে
গেল।
নিপুণ
এতক্ষণে
সুযোগ
পেয়ে
জিজ্ঞেস
করল, “নদীর
আলো
কী
দাদু?”
“কোহিনুরের
নাম
শুনেছিস
তো?
পৃথিবীবিখ্যাত
রত্ন।
কোহি-নুর
মানে
কী
বল তো?
পর্বতের
আলো। ওরই জোড়া
এই
রত্ন
– দরিয়া-কি-নুর। তার মানে
নদীর
আলো। ওটা কিন্তু
শুধুই
দামি
একটা
পাথর
নয়,
ওর
সাংঘাতিক
ক্ষমতা। কেউ লোভের
হাত
দিয়ে
ওকে
ছুঁলেই
সর্বনাশ।”
নিপুণ
শুকনো
গলায়
বলল, “এবার
আমি
যাই
দাদু?
অনেক
রাত
হল।”
সেদিন
সারা রাত
ঘুমন্ত
নিপুণকে
ঘিরে
রইল
এক
উজ্জ্বল
নীল
আলো। পুজোর চারটে
দিন
নিপুণ
কোনোদিকে
মন
দিতে
পারল
না।
এমনকি
অত
সাধের
নারকেল
নাড়ুও
খেল
অন্যমনস্ক
হয়ে। অন্যান্যবারের
মতো
দুর্গার
হাতের
অস্ত্রশস্ত্র, অসুর, সিংহ, কার্তিকের
হাতের
তির-ধনুক
কিছুই
আর
মন
টানছে না।
দুর্গাপ্রতিমার
কপাল
ঘিরে
নীল
একটা
স্নিগ্ধ
আলো
তার
মন
ভরিয়ে
রেখেছে।
বাড়িময়
লোকজন
গমগম
করছে
বলে
নিপুণ
বেশিটা
সময়
শিউচরনের
ছাগলগুলোর
সঙ্গে
ছাদেই
কাটায়।
দশমীর
দিন
ঠাকুর
বিসর্জনের
আগে
সবাই
প্রতিমাকে
মিষ্টিমুখ
করাচ্ছে।
পায়ে
হাত
দিয়ে
প্রণাম
করে
পরস্পরকে
সিঁদুর
পরাচ্ছে। নরহরি প্রতিমার
সামনে
দাঁড়িয়ে
সবাইকে
সাহায্য
করছে। মণ্ডপে বেজায়
ভিড় ঠেলাঠেলি। সবাই শেষবারের
মতো
দুর্গাপ্রতিমাকে
ছুঁয়ে
যা
যা
চাইবার
চেয়ে
নিচ্ছে।
নিপুণের
মনে
আছে,
সে
নিচু
হয়ে
পা
ছুঁয়ে
কিছু
চাইবার
আগেই
পায়ের
ফাঁকে
নীল
একটা
আলো
দেখে
তার
আর
প্রণাম
করা
হল
না। সে নীল আলোটা
হাতের
মধ্যে
পুরে
ভিড়
কাটিয়ে
বাইরে
এসে
সোজা
হয়ে
দাঁড়াতেই
সেই
লোকটার
মুখোমুখি।
লোকটা
তার
দিকে
চোখ
সরু
করে
তাকিয়ে
আছে। নিপুণের বুকটা
ঢিবঢিব
করে
উঠল।
সে
এদিক
ওদিক
তাকিয়ে
রাজেনদাদুকে
খুঁজল। দাদু বোধহয়
প্রতিমা
বিসর্জনের
ব্যাপার
নিয়ে
ব্যস্ত
হয়ে
আছে। এদিকে লোকটা
ক্রমশই
নিপুণের
কাছে
এগিয়ে
আসছে।
এখন
ইচ্ছে
করলেই
নিপুণকে
হাত
বাড়িয়ে
ধরতে
পারবে।
নিপুণ
ঘাড়
ঘুরিয়ে
মায়ের
ত্রিনয়ন
দেখারও
সময়
পেল
না -
তিরের
মতো
ছুটল
ছাদের
দিকে।
পাথরের
পরির
গায়ে
ঠেস
দিয়ে
বসে
হাঁপাতে
হাঁপাতে
হাতের
মুঠোটা
খুলল। নিপুণকে দেখে
দাড়ি
নেড়ে
দলের
লিডার
সাদা
ছাগলটা
কাছে
এসে
আহ্লাদের
চোটে
নিপুণের
মাথায়
দাড়ি
ঘষে
দিল।
সেই
সময়ে
সে
লোকটাকে
ছাদের
দরজা
দিয়ে
ঢুকতে
দেখল। নিপুণের কাছে
এসে
ভয়ঙ্কর
গলায়
বলল, “কোথায়
পালাবি?
যেটা
পেয়েছিস
ভালো
চাস
তো
দিয়ে
দে
এখনই।”
ঠিক
তখনই
ছাগলটার
দাড়ি
নাড়ার
চোটে
পাথরের
খাঁজ
থেকে
নীল
গুঁড়ো
খসে
পড়ল
ছাগলটার
গায়ে। দেখতে দেখতে
ওটা
বড়ো
হয়ে
উঠল
চোখের
সামনে। নিপুণ চোখ কচলে
দেখে,
একটা
ডানাওলা
বিরাট
পক্ষীরাজ
ঘোড়া
লোকটার
বুকে
সামনের
দু-পা
দিয়ে
জোরে
একটা
লাথি
মেরে
বিরাট
ডানা
ছড়িয়ে
উড়তে
উড়তে
মিলিয়ে
গেল
আকাশের
অন্ধকারে।
নিপুণও
আর
এক
মুহূর্ত
দেরি
না
করে
অজ্ঞান
হয়ে
পড়ে
থাকা
লোকটাকে
ডিঙিয়ে
তিরের
মতো
ছুট
দিল
নিচের
দিকে।
রাজেনদাদু
দাঁড়িয়ে
ছিল
মণ্ডপের
সামনে। নিপুণকে দেখে
এক
বকুনি, “কোথায়
থাকিস?
এখনই
প্রতিমা
যাবে। আমি তোকে
খুঁজছি
তখন
থেকে।”
নিপুণ
হড়বড়
করে
ঘটনাটা
বলতে
গিয়ে
দেখে,
তার
হাত
শূন্য। কখন তার হাত থেকে
পাথরটা
পড়ে
গেছে
সে
নিজেই
জানে
না।
রাজেনদাদু
কেমন
রহস্যময়
হেসে
বলল, “ভালো
করে
মায়ের
মুখের
দিকে
তাকিয়ে
শেষবারের
মতো
প্রণাম
কর।”
নিপুণ
তাকিয়ে
দেখে,
প্রতিমাও
হাসছে
তার
দিকে
তাকিয়ে,
আর
তার
কপালের
মাঝখানে
জ্বলজ্বল
করছে
নদীর
আলো।
----------
ছবি – স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়
No comments:
Post a Comment