শব সাধনা
পুষ্পেন মণ্ডল
“কী ব্যাপার! আজকে তিনটে হিরে
হঠাৎ এখানে?”
হরিপদদার
কথার কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলাম আমরা। নেহাত উনি
বয়েসে অনেকটাই বড়ো, তাই যথেষ্ট সমীহ
করে চলি। আমাদের গড়নন্দনপুর হাই স্কুলের ঘণ্টাবাদক
কাম সর্বঘটের কাঁঠালি কলা। এলাকার
গাধা আর ছাগলগুলো যে আজকের দিনে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র এবং
কেউকেটা হয়েছে, তারা সবাই নাকি ওনার হাত গলে বেরিয়েছে। এমনটাই
ওনার ধারণা। সন্ধেবেলায় আমরা বসেছিলাম শ্মশান কালী
মন্দিরের চাতালে। গঙ্গার দিক থেকে জলো হাওয়া আসছে হু হু
করে। পাশেই একটা প্রাচীন বট গাছ। জটাজূটধারী
এক সন্ন্যাসী যেন গভীর ধ্যানে মগ্ন। সেটা থেকে মাঝে মধ্যে টুপ টাপ করে খসে পড়ছে
লাল বটফল। মাথার পিছন দিকে জ্বলছে একটা টিমটিমে বাল্ব। মনটা
আজকে আমাদের খুব খারাপ। স্কুলে আজ টেস্ট
পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। আমরা
তিন জনেই কোনো রকমে গড়িয়ে পাশ করেছি। স্যারেদের
বকুনি সামলে বাড়ি ঢুকতেই উত্তম মধ্যম খেলাম। সেটা হজম না হওয়ায়
আপাতত সবাই মিলে ঠিক করেছি বাড়িতে আর থাকা চলবে না। সাধু
হয়ে যাব। একটা ভালো গুরু পেলে তন্ত্রবিদ্যাটা শিখে
ফেলব। তারপর আর চিন্তা নেই। শ্মশান কালীর সামনে সেই বিষয়েই আলোচনা চলছে। এমন সময়ে হরিপদদার আগমন।
হরিপদদা
শেষ পর্যন্ত কোনো প্রত্যুত্তর না পেয়ে
আবার খোঁচালেন, “আচ্ছা, তোদের
মনোহর চক্কোত্তির কথা মনে আছে?” আমি জিজ্ঞেস
করলাম, “কোন মনোহর চক্কোত্তি!” উত্তরটা শুনে ওনার মুখ কাঁচা তেঁতুলের টক খাওয়ার মতো কুঁচকে
গেল। বুচাই সেই সময়ে মাথা চুলকে বলল, “সেই গণৎকার, যিনি অভিরামপুরে
থাকতেন?”
চায়ের
ভাঁড়ে একটা চুমুক দিয়ে ঘাড় নেড়ে গম্ভীর গলায় হরিপদদা উত্তর দিলেন, “হুম!”
“তিনি তো অনেকদিন হল নিরুদ্দেশ শুনেছি,” পাশ থেকে জবাব দিল বিশু।
“ইদানীং আবার ফিরে এসেছেন।”
“তাই নাকি? কিন্তু আমাদের তো চোখে পড়েনি।”
বুচাই একটু আগ বাড়িয়ে বলল, “কোথায় পাব তাঁকে? আমরা একটা ভালো গুরু খুঁজছি।”
"গুরু পাওয়া কী অতই সহজ?" হরিপদদা সিমেন্টের চাতালে সোজা হয়ে যোগাসনে বসলেন, “শিবানন্দ ঘোষের বাড়িতে সেবার খুব ধুমধাম করে রক্ষাকালী পুজো
করেছিল। তোরা তখন বেশ ছোটো। গোটা পাড়াকে নেমন্তন্ন করেছিল। সারা
রাত পুজো চলল। শেষ প্রহরে, তখন
সবাই ঝিমোচ্ছে, আচমকা চক্কোত্তি মশাইয়ের আগমন। এক হাত লম্বা চুল, দাড়ি, কপালে
লাল তিলক, গায়েও টকটকে লাল সিল্কের আলখাল্লা। আমি
মনে মনে ভাবলাম, জ্যোতিষ চর্চার পাশাপাশি তন্ত্র সাধনাও
শুরু করলেন নাকি? তা আমার মনের কথা কী করে বুঝলেন কে জানে! বিড় বিড় করে বললেন, ‘ঘটে
নাড়া অনেক দিন হল বেঁধে রেখেছি। শুধু
জবা ফুলটা রাখতে বাকি।’ এ কথার মাথামুণ্ডু
কিছুই বুঝলাম না। ‘জয় মা…, জয় মা’ বলতে বলতে তিনি হনহন
করে এগিয়ে গেলেন বড়ো কালী ঠাকুরের মূর্তির সামনে। হাঁটু
মুড়ে চোখ বন্ধ করে হাত জড়ো করে বসে চেঁচিয়ে উঠলেন ‘জয়
মা কালী’! তারপর কিছুক্ষণ স্ট্যাচু হয়ে থাকার পর
সটান শুয়ে পড়লেন। পূজারিও ঘাবড়ে গিয়ে ততক্ষণে মন্ত্র আওড়ানো
বন্ধ করেছেন। বাকি বাড়ির লোক, যাঁরা তখনও অনেক কষ্টে জেগে ছিলেন, তাঁদেরও
চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেছে। কারণ এ তল্লাটে
চক্কোত্তি গণৎকারকে চেনেন না এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তাঁর ভবিষ্যৎবাণী আকছার ফলে যায়। যাকে যা বিধান দেন, মিলে যায় হুবহু। এমন
মহান মানুষ কালী ঠাকুরের সামনে মাথা উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন। মাথা
আর তোলেন না। লোক জমা হয়ে গেছে চারপাশে। চক্কোত্তি
গুণিন আর নড়ছেন না।”
“তারপর?” আমার মুখ দিয়ে
কথাটা বেরোল আগ্রহের চোটে।
হরিপদদা
বলে চলল, “আমিই প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম
প্রথম। ভাবলাম, ভদ্রলোক
কি দেহ রাখলেন নাকি! কিন্তু না, পাশে
বসে হাতের নাড়ি ধরে দেখি পালস ঠিকই আছে। হঠাৎ
ধড়পড়িয়ে উঠে যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব করে আর একবার হুঙ্কার ছাড়লেন, জয় মা তারা! তারপর জোড় হাত
কপালে ঠেকিয়ে পুজোর ঘটের উপর একটা জবা ফুল ছুঁড়ে দিয়ে পিছন ফিরে হাঁটা দিলেন।” সেই সঙ্গে হরিপদদাও চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে খালি ভাঁড়টি
ছুড়ে দিলেন নদীর দিকে। তারপর পকেট হাতড়ে
প্লাস্টিক প্যাকেট থেকে একটা ছোটো বিড়ি বের করে দেশলাই দিয়ে ধরিয়ে একরাশ কড়া গন্ধযুক্ত
ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “সেই দিনের পর থেকে গণৎকার মশাইকে আর কেউ
দেখেনি। এতদিন পর, হঠাৎ
দেখা দিলেন আমাকে।”
বিশু
বিরক্ত হয়ে বলল, “কী হয়েছে ব্যাপারটা খুলে বলবেন?”
“সেদিন রাতে শুতে একটু দেরি হয়েছিল বুঝলি। ঘড়ি
তো দেখিনি। তবে যতদূর মনে হচ্ছে দুটো-আড়াইটা তো বাজবেই। আসলে একটা পুরোনো বই পেয়েছিলাম লাইব্রেরি থেকে। ‘মহাশ্মশানে শব সাধনা’ - মানে মৃতদেহের উপর বসে সাধনার এ টু
জেড। আমি ক’দিন ধরেই এই নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছি।”
“কেন?” আমরা জানতে চাইলাম।
“কেন আবার! ভূত ভবিষ্যৎ সব জানা যাবে।
কার চাকরি কবে হবে, কে পরীক্ষায় কত নম্বর পাবে, কে কখন মারা যাবে? সব কিছু। এই ব্যাপারটা আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল। একবার চোখ বন্ধ করে ভাব! চারিদিকে অন্ধকার। শোঁ শোঁ করে হাওয়া বইছে। কেউ কোথাও নেই। নিশাচর পাখির ডাক মাঝে মাঝে কানে আসছে শুধু। সেখানে একা বসে আছিস, একটি মৃতদেহের উপর। মৃতদেহটা পচা-গলা হলে
চলবে না। একেবারে টাটকা মৃতদেহ চাই। মৃতদেহের উপরে বসে কত রকম উপাচার পালন করতে হবে, তার সমস্ত খুঁটিনাটি লেখা আছে ওই বইটিতে। কী কী উপকরণ লাগবে, কোন মন্ত্র কোন সময় পাঠ করতে হবে, মৃতদেহের শরীরে কী কী চিহ্ন থাকতে হবে, ইত্যাদি।
সেদিন যখন বইটি রেখে মাঝরাতে শুতে গেলাম, দেখি কিছুতেই ঘুম আসছে না। অনেক কষ্টে এপাশ-ওপাশ করতে করতে ঘুমটা যাও এল, হঠাৎ মনে হল বাইরে থেকে কার যেন গলা
পাচ্ছি, ‘ও হরিপদ, হরিপদ, একবার বাইরে এসো তো ভাই।’ এত রাতে কে ডাকে! গলাটা চেনা চেনা মনে হচ্ছে! আমি হাঁক দিলাম, ‘কে এত রাতে?’
‘আমি মনোহর চক্রবর্তী। আরে বাবা দরজাটা একবার খোলো।’
দরজা খুলে দেখি বড়ো জটাধারী ছাইভষ্ম মাখা এক সাধু
দাঁড়িয়ে আছেন। চক্কোত্তি মশাইয়ের সঙ্গে
মুখের একটা মিল আছে বটে। কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে
আমি সাহস করে তাঁকে ঘরে ঢোকাতে পারলাম না। তিনি আবার বললেন, ‘এতদিন পরে দেখা হচ্ছে বলে
চিনতে পারছ না বুঝি! নাকি রাতের অন্ধকারে এসেছি বলে ভয় পাচ্ছ?’
আমি বললাম, ‘আজ্ঞে তা নয়, আপনি তো দীর্ঘদিন নিরুদ্দেশ।’
‘হ্যাঁ, সে অনেক কথা। তোমাকে কী যে বলি! একটা মহা বিপদে পড়ে এসেছি এখানে।’
ভাবলাম, বিপদ! এবার না টাকাপয়সা চেয়ে বসেন। যাই হোক, আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী বিপদের কথা বলছেন
আপনি?’
তিনি হেসে উত্তর দিলেন, ‘এতদিন পরে তোমার দরজায় এসে দাঁড়িয়েছি, ভিতরে আসতে বলবে না?’
আমি ঘরের ভিতরে ডেকে তাঁকে একটা চেয়ারে বসতে দিলাম। জল গড়িয়ে দিতে খেয়ে
একটু শ্বাস ছেড়ে বসলেন। বিছানার পাশেই রাখা ছিল শব সাধনার বইটা। সেটা হাতে নিয়ে
বললেন, ‘যে কথা বলতে এসেছি ভালো
করে শোনো। শুনলাম তুমি নাকি তন্ত্রবিদ্যা শেখার জন্য উঠে
পড়ে লেগেছ? বই পড়ে এ জিনিস রপ্ত করা
যায় না। এর জন্য প্রথম যেটা লাগে, সেটা হল একজন উপযুক্ত গুরু। আমি নিজে পরখ করে
দেখেছি, দশ বছরের গভীর সাধনা আমার। দেশ-বিদেশে এমন কোনো ছোটো-বড়ো শ্মশান নেই, যেখানে আমি রাত কাটাইনি।’
তিনি বলে চললেন, ‘গভীর রাতে যখন কানের কাছে প্রেতাত্মা আর পিশাচ
পিশাচিনীরা ফিসফিস করে কথা বলে, তখন কেমন লাগে তুমি জানো? ভয়ে তোমার শরীর ঠকঠক করে কাঁপছে, তুমি চিৎকার করতে চাইছ, কিন্তু করতে পারছ না, গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না। যেন গলার মধ্যে কেউ হাত ঢুকিয়ে বসে আছে।’ হঠাৎ তিনি হাত দুটো জড়ো করে বললেন, ‘আমাকে মুক্তি দাও হরিপদ। তুমিই পারবে।’
আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ‘কী হয়েছে খুলে বলুন।’
তিনি বলতে লাগলেন, ‘কয়েক বছর আগের কথা, তখন আমি এক তামিল সন্ন্যাসী জানকীরমণ স্বামীর সঙ্গে
ভারতের দক্ষিণ প্রান্তে এক মহাশ্মশানে রাত কাটাচ্ছি। জায়গাটা গ্রাম থেকে অনেকটা
দূরে। একটা নদীর তীরে। প্রায়ই দেখতাম অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের আধপোড়া দেহ ভেসে আসছে নদীর জলে। কোথা থেকে যে আসত আর কেনই বা আসত তা কোনোদিন জানতে পারিনি। জানকীকে জিজ্ঞাসা
করলাম একদিন। সে বলল - এই নদী আসছে এক আদিবাসী গ্রামের মধ্যে দিয়ে। সেখানে
অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা মারা গেলে পোড়ায় না। ওরা ভাবে মৃতদেহগুলি পরে আবার বেঁচে
উঠতে পারে। তাই মুখে আগুন ছুঁয়ে শরীরটা নদীতে ভাসিয়ে দেয় ভেলায় করে। সেগুলোই এই
শ্মশানের গায়ে এসে ঠেকে। অনেক সময় শরীরগুলি
জলের প্রাণীরা খেয়েও ফেলে।
‘যাই হোক, একদিন কী হল, একটা তরুণ যুবকের শরীর ভেসে এল। সারা শরীরে একটুও খুঁত নেই, পেশীবহুল শরীর, গায়ের রং চাপা, কোঁকড়ানো চুল। জলের ধারে এসে উপুড় হয়ে
শুয়ে আছে। যেন মনে হচ্ছে ডাকলে এখুনি সে উঠে দাঁড়িয়ে কথা বলবে। আমরা তাকে টেনে
তুললাম। শরীরটা থেকে যেন সবে বেরিয়ে গেছে প্রাণটা। আর কোনো বিকার নেই। জানকী জানাল, ঐ শরীরটা নাকি শব সাধনার জন্য একেবারে উপযুক্ত। আমরা তোড়জোড় শুরু করলাম। বিধিনিষেধ মেনে সমস্ত
উপাচার সম্পন্ন করা হল। সংগ্রহ করা হল যত রকমের
উপাদান প্রয়োজন। আকস্মিকভাবে সেদিনই ছিল অমাবস্যা। উপর থেকে
কেউ যেন আমাদের সব রকম সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল।
‘সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু জানকী হঠাৎ করে
অসুস্থ হয়ে পড়ল সন্ধ্যার মুখে। ধুম জ্বর এল কাঁপ দিয়ে। তাকে ধরে রাখতে পারছি না
একা। ঘোরের মধ্যে ভুলভাল বকছে। সব কথার মানেও বুঝতে পারছি না আমি। আমার কাছে কিছু
আয়ুর্বেদিক ওষুধ ছিল। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হল না। শেষে কোনো উপায় না দেখে, কাঁধে করে তাকে আমি দিয়ে এলাম দুই
মাইল দূরে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।
‘রাত্রিবেলা ফিরে আবার বসলাম সেই কাজে। একা বড়ো অসহায় লাগছিল। কিন্তু সেই দিনটাতে যদি আমি ব্যর্থ হই, তবে ঐ সুযোগ আবার কবে
আসবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। মনের মধ্যে অনেকটা সাহস
সঞ্চয় করে ধুনির আগুন জ্বাললাম। তারপর সেই মৃত অল্পবয়সি ছেলেটির শরীরের উপরে বসে
শুরু করলাম জোরে জোরে মন্ত্রোচ্চারণ। সামনে প্রজ্বলিত ধুনি। মাঝে মাঝে তাতে ঘি তেল দিচ্ছি। দপ করে জ্বলে
উঠছে। সারাদিনের ধকল আর ক্রমাগত মন্ত্রোচ্চারণের ফলে
ক্লান্তি গ্রাস করছিল। কতক্ষণ সময় মাঝখানে কেটেছে, সে খেয়াল নেই। হঠাৎ মনে হল নিচের শরীরটা কাঁপতে
শুরু করেছে। আশ্চর্য! মৃত শরীর কাঁপবে কেন? হয়তো আমারই মনের ভুল! এই ভেবে আবার চোখ বন্ধ করে নিজের মনকে শান্ত
করার চেষ্টা করলাম। আবার কিছুক্ষণ মন্ত্র পড়ার পর বুকটা হঠাৎ ধড়ফড়
করতে শুরু করল। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি। আচমকা মুখ ফিরিয়ে মৃতদেহের মুখের দিকে
তাকাতেই গা হিম হয়ে গেল। সে বড়ো বড়ো চোখ করে
চেয়ে আছে আমার দিকে। চোখের পাতা দুটো খোলা। কিন্তু আমি যখন শব সাধনায় বসে ছিলাম তখন তো মৃতদেহের চোখের পাতাগুলি বন্ধ
ছিল।
‘এরকম কিছু কিছু ঘটনা যে ঘটতে পারে, সে বিষয়ে সাবধান করে দিয়েছিল
জানকী। যে শবের উপরে বসে সাধনা করা হয় তার আত্মা সেই মৃতদেহটিকে ছেড়ে যেতে চায় না
কিছুতেই। জানকী সাবধান করেছিল, তোমাকে সাধনাতে সিদ্ধিলাভ করতে দেবে না সে কিছুতেই। চেষ্টা করবে সবরকমভাবে
ব্যর্থ করার। মানসিক শক্তি দিয়ে তোমাকে সেটা সামলাতে হবে। যাই হোক, আমি আবার শুরু করলাম
মন্ত্র জপা। যতই আমার নিচে কিংবা চারপাশে অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা ঘটুক না কেন, আমি দাঁতে দাঁত চেপে বসে
জোরে জোরে মন্ত্র আউড়ে গেলাম। ক্রমশ ভোর হয়ে আসছিল। চারিদিকে আলো ফুটছিল ধীরে ধীরে। একবার লাল সূর্যের দেখা পেলেই আমার শব সাধনা
পূর্ণ হবে।
‘হঠাৎ মনে হল আমার নাম ধরে কেউ ডাকছে। আওয়াজটা আসছে আমার ঠিক পাশ থেকে। এ তো জানকীর
গলা। আমার খুব চেনা! তাকে কয়েক ঘণ্টা আগে আমি নিজে কাঁধে করে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করে দিয়ে
এসেছি। তবে কি সে সুস্থ হয়ে ফিরে এল! চোখ খুলে তাকালাম। ‘মনোহর… মনোহর… শুনতে পাচ্ছ? আমি জানকী বলছি...’ চমকে উঠে আমি তাকালাম
মৃতদেহটার মুখের দিকে। কথাগুলি সেই বলছে! ‘পালাও… পালাও… মনোহর... তুমি পালাও।
নইলে মরবে…’
‘কথাটা শোনার পর আমার কী
যে হল! মৃতদেহটা থেকে লাফ দিয়ে নেমে প্রাণভয়ে দৌড় দিলাম। মাঠ ঘাট পেরিয়ে
ঘণ্টাদুয়েক পরে থামলাম গ্রামে এসে। তিন দিন জ্ঞান
ছিল না। পরে শুনলাম সেই দিন ভোর রাতে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মারা গিয়েছিল জানকী। তারপর
থেকে আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছি। সারাদিন ভালো থাকি। রাত হলেই কারা যেন কানের কাছে এসে
ফিসফিস করে।
‘বহুদিন পরে দেশে ফিরে
প্রথম আমার তোমার কথাই মনে পড়ল। হরিপদ তুমি আমাকে বড়ো ভালোবাসতে। আমি জানি তুমি
তন্ত্রবিদ্যা শেখার জন্য সব কিছু করতে পারো। নদীর ধারে, শ্মশান কালীর মন্দিরের পাশের মাঠে আমি আছি। নিম গাছটার নিচে। এসো কাল রাতে। কালকে অমাবস্যা। আমি সমস্ত ব্যবস্থা করে রাখব। তোমাকে দীক্ষা দিয়ে আমি মুক্তি চাই।’ এই বলে তিনি হন্তদন্ত
হয়ে চলে গেলেন।
সেই রাতে আর ঘুম হল না। শুধু মনে হচ্ছে, এই সর্বনেশে বিদ্যা না শেখাই ভালো। ভয় হতে লাগল, এই বিদ্যা নেওয়ার পরে, আমার কী হবে তাই বা কে জানে? আবার মনে হল, এ বিদ্যা শিখতে পারলে
আমি ভূত ভবিষ্যৎ সব জানতে পারব। মারণ উচাটন তখন আমার হাতের নস্যি! রাত দশটার পর থেকেই মনে
হল কে যেন আমাকে ডাকছে। আয়… আয়…! নিজের উপরে আমার
কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। নেশাগ্রস্ত রোগীদের মতো আমি বেরিয়ে পড়লাম। হাঁটতে শুরু করলাম
অন্ধকারে।
তোরা মাঝ রাত্রে এসেছিস কোনোদিন এখানে? এলে দেখবি শ্মশানের পাশে
ফাঁকা মাঠের মাঝখানে ঐ যে মহানিম গাছটা আছে, ওটা যেন গাছ নয়, অনেক অতৃপ্ত আত্মা একসঙ্গে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে
আছে আকাশের দিকে হাত তুলে। বলছে আমাদের মুক্তি দাও। অন্ধকারের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে
কিছু চোখ। তারা জীবিত প্রাণী না মৃত, সে বোধবুদ্ধি আর থাকবে না। শবযাত্রীদের জন্য যে ঘরটা করা আছে, সেখানে গিয়ে
যখন পৌঁছলাম, দেখি একটা ধুনি জ্বলছে
পাশে। মাঠের চারপাশটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। কেউ কোথাও নেই। আমি গিয়ে ধুনির পাশে
বসলাম। ধুনিতে দুটো শুকনো কাঠ দিতে জ্বলে উঠল জোরে। কিছুক্ষণ
অপেক্ষা করার পর দেখি একজন অন্ধকার ফুঁড়ে আসছেন। কাছে আসতে ধুনির আলোয় বুঝলাম চক্কোত্তি মশাই
ঘাড়ে করে কালো কাপড় মোড়া কিছু একটা নিয়ে এসে মাটিতে রাখলেন। আমার দিকে ফিরে
হেসে বললেন, ‘এই যে তোর জন্য অনেক
খুঁজে নিয়ে এলাম। একদম টাটকা। তুই এক কাজ কর, শবের উপরে বসে যেরকম মন্ত্র তোকে শিখিয়ে দিচ্ছি, যতক্ষণ না সূর্য ওঠে ততক্ষণ
উচ্চারণ করতে থাক। যত যাই হোক, পৃথিবী এদিক থেকে ওদিক হয়ে গেলেও তুই কিন্তু
সূর্য ওঠার আগে চোখ খুলবি না। আর মন্ত্র উচ্চারণ বন্ধ
করবি না। মনে থাকবে?’ আমি মাথা নাড়লাম।
‘বেশ, এখানে বস। এর উপরে।’ আমি উঠে বসলাম মৃত শরীরটার উপর। সত্যিই যেন হালকা গরম গরম লাগছে। তবে কি সদ্য মারা গেছে! মৃতদেহের মুখটা দেখতে
পাচ্ছি না। কারণ মুখের উপরে একটা কালো কাপড় বেঁধে
রেখেছেন চক্কোত্তি মশাই। জিজ্ঞেস করতে বললেন, ‘তোকে তো আমার গল্পটা
বলেছি। মুখের কাপড় সরিয়ে দিলে
বিভিন্ন রকম অঙ্গভঙ্গি করতে পারে। তোর সাধনাতে ব্যাঘাত
ঘটবে। ঐ জন্য আমি মুখের কাপড়টা সরাইনি। নে এবার
শুরু করে দে। আমি আরও কিছু উপাচার সেরে তোর সঙ্গে একেবারে
ভোরবেলায় দেখা করব।’
আমি শুরু করে দিলাম। মন্ত্র মুখস্থই ছিল। বারংবার একই মন্ত্র
উচ্চারণ করে চলেছি। মাঝে দু-একবার শিয়ালের ডাক কানে এসেছিল। আর হঠাৎ করে নিম গাছের ডালে একটা প্যাঁচার বিকট চিৎকার। এছাড়া আর কিছুই সেদিন ঘটেনি আমার সঙ্গে। ভোরের সূর্য ওঠার পর আমার
মন্ত্রোচ্চারণ যখন বন্ধ করলাম, চারপাশটা আলোয় ভরে গেছে। তারপরে খেয়াল হল, যে
শবের উপরে আমি বসেছিলাম সেই শরীরটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কেউ যেন তার সমস্ত রক্ত টেনে বের করে নিয়েছে। তবে খুব চেনা চেনা লাগল হাতের
আঙুলগুলো, হাতে বাঁধা রুদ্রাক্ষের
মালাটাও খুব চেনা! কী একটা মনে হল। হঠাৎ করে এক ঝটকায় মুখের কাপড়টা সরিয়ে দিতেই হৃদপিণ্ডটা
যেন লাফিয়ে উঠে এল গলার কাছে। চমকে উঠলাম! শরীরটা তো চক্কোত্তি মশাইয়ের! কিন্তু এ কী করে সম্ভব?
সেখান থেকে পড়িমড়ি করে দৌড়োতে দৌড়োতে কোনোরকমে বাড়িতে এসে ঢুকলাম। হাঁপাতে হাঁপাতে এক ঘড়া জল পান করলাম ক্যোঁৎ ক্যোঁৎ করে। বেশ কিছুদিন হল আমি নিজের মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুভূতি পাচ্ছি।”
“কীরকম?”
“কোনো কিছু দুর্ঘটনা ঘটার আগেই যেন আমি দিব্য
চক্ষুতে দেখতে পাচ্ছি। হয়তো চোখের সামনে কোনো
ব্যক্তি মারা গেল, মারা যাওয়ার পরে সে যেন আমার সামনে দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে। তার আত্মাটাকে আমি দেখতে পাচ্ছি। তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারছি।”
গল্পটা শুনে আমাদের তিনজনেরই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে
গেছে। ঘেঁষাঘেঁষি করে বসেছি তখন। শ্মশান কালী মন্দির থেকে নিজেদের বাড়ি ফিরব কী
করে, সেটা ভেবেই কালঘাম
ছুটছে।
“এক কাজ কর, তোরা কাল বাদে পরশু, অমাবস্যার দিন
রাত্রি দুটোর সময়ে চলে আয় এখানে। ঐ মাঠে শবযাত্রীদের ঘরের পাশে আমি সব ব্যবস্থা
করে রাখব। একটা টাটকা লাশের দরকার। সে ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করিস না।”
আমরা তিনজনে সেই যে পড়িমরি করে দৌড় দিলাম। আর
পিছন ফিরে তাকাইনি। তন্ত্রবিদ্যা শিখে আর কাজ নেই আমাদের! তার থেকে বাড়ির লোকের
পিটুনি অনেক ভালো।
----------
ছবি - সৌম্য প্রামাণিক
No comments:
Post a Comment