কণ্ঠস্বর
রাজা ভট্টাচার্য
অনেএএক দিনের পুরোনো এক গল্প শুনবে?
সে... মানে যাকে বলে মেলাই দিনের পুরোনো গল্প।
তখন আমি হইনি, আমার মা হয়নি, আমার দাদু— মানে
মাতামহ তখন ছোকরা ছিলেন— সেই প্রাচীনকালের গল্প।
তা ধর আজ থেকে পঁচাশি বছর আগের কথা!
বোঝো! কম দিন! পঁচাশি বছর!!
শোনো তবে৷ কিন্তু আমি বললে সে গল্প শুনে তোমাদের জুত হবে কি?
ঝকঝকে আলোর নিচে, চকচকে চার দেয়ালের মধ্যে বসে
এমন গল্প শুনে তার সবটুকু মজা তোমরা টেরই পাবে না! কেন বলো দেখি?
কারণ চল্লিশ বছর আগে আমি এই গল্প শুনেছিলাম সেইখানে বসে,
যেখানে এসব গল্প একেবারে জ্যান্ত হয়ে ওঠে।
আমার মামাবাড়িটা ছিল মস্ত। বিশাল
জমির উপরে প্রকাণ্ড বাড়ি, তাকে ঘিরে বাগান।
পিছনে একটা বিশালতর আমবাগান, সেখানে দিনেমানে অন্ধকার জমে থাকত; শেয়াল ডাকত যখন-তখন, রাতে সেই ঝুপসি অন্ধকারে জ্বলত-নিভত জোনাকির ঝাঁক। কাজেই,
মামাবাড়ির পিছনের গোল বারান্দায় যখন দাদু গল্প শোনাতে বসত তার ছয় নাতি-নাতনিদের— তখন গল্প আর নিছক গল্প থাকত না।
ভয় আর নিছক বিলাসিতা থাকত না। ফাঁকা
খাওয়ার ঘরটুকু পেরিয়ে মাঝের আলো-জ্বলা ঘরটায়
গিয়ে পড়লে আমি দম ফেলতাম, ঘাম মুছতাম।
উফফ! তাকেই বলে ভয়।
কিন্তু কোন্ ভালো জিনিসটাই বা টেকসই হয়,
বলো? কিচ্ছুটি নয়! বাদামঢালাই
আর নেই, ঝালমটর আর পাওয়া যায় না, গোল্ড
স্পট কবেই অদৃশ্য হয়েছে। সেই
পথ ধরেই উবে গেছে সেই সব তারা-জ্বলা রাত,
জোনাক-জ্বলা আমের বন, গল্প-বলার সন্ধ্যা, আর মস্ত সতরঞ্জি বিছিয়ে দেওয়া বারান্দা৷
সবচাইতে বড়ো কথা কী বলো দেখি?
গল্প বলার লোকগুলোও যে একদিন সতরঞ্জি গুছিয়ে টুকটুক করে হাঁটা দেবে,
আর মোটেই ফিরবে না— সেই কথাটা যে সেদিন হিসেবের
মধ্যেই ছিল না মোটে!
যাক সে সব কথা। শোনো
তবে। দাদুর গল্পটাই আজ নিজের গল্প
বলে চালিয়ে দিই৷ ঠিক তেমনি করে লিখি বরং, যেমন করে বলত দাদু!
এই দাদুর গল্প হল শুরু—
আমার তখন পনেরো বছর বয়েস, বুঝলে দাদুভাই! তার মানে, ধরো—
পঞ্চাশ বছর আগের কথা। তখনও
দেশভাগ হয়নি। আমাদের বাড়ি ছিল খুলনা জেলার
ঠাকুরপুরে। ছোটোখাটো জমিদার বলতে পারো,
যদিও অমন জমিদার সেকালে সব গাঁয়েই এক ঘর করে থাকত।
তবে কী, ছোটো হলেও,
এক ধরনের সম্মান ছিল— এই পর্যন্ত।
ওই বয়েসের সব ছেলে যা করে— আমিও তখন অল্পস্বল্প পড়াশুনো আর এন্তার খেলাধুলো করে বেড়াচ্ছি।
তখনও দেশগাঁয়ে ক্রিকেট খেলা চালু হয়নি। আমাদের
আসল খেলা ছিল ফুটবল। সে যে কী উৎসাহ ছিল আমাদের,
আজ তোমরা ভাবতে পারবে না। বড়ো
ম্যাচের আগে গোটা এলাকার ঘুম উড়ে যেত।
তখন গরমের ছুটি চলছে৷ আমি দুপুরে ঘুমোতে পারতাম না;
সারাদিন পুকুরের পাড়ে বসে বন্ধুদের সঙ্গে গল্পগুজব করে আর আম-কাঁঠালের শ্রাদ্ধ করে সময় কাটাচ্ছি। এমন
সময় চৌধুরী-বাড়ির দীনেশ খবর নিয়ে
এল, নমাজগড়ের ছেলেরা নাকি আমাদের ফুটবল খেলায় চ্যালেঞ্জ করে পাঠিয়েছে।
এসব ঘটনা তখন খুব ঘটত। সব
গ্রামে তো স্কুল থাকত না, চার-পাঁচটা গ্রাম মিলিয়ে একটা স্কুল। সেই
সূত্রেই অতগুলো গাঁয়ের ছেলের নিত্যি নিত্যি দেখা-সাক্ষাৎ ঘটত, বন্ধুত্ব হত, আবার
ঝগড়াঝাঁটিও হত বিলক্ষণ। লম্বা
ছুটিছাটায় এক গাঁয়ের ছেলেপুলে অন্য গ্রামকে এমন চ্যালেঞ্জ হামেশাই ছুঁড়ে দিত।
তাই নিয়েই বেঁধে যেত রইরই কাণ্ড,
দিনকতক গাঁ-গঞ্জ একেবারে গরম হয়ে থাকত উত্তেজনায়।
বলাই বাহুল্য, চ্যালেঞ্জ হাতে-গরম অ্যাকসেপ্টেড হল।
দূতের মুখে বলে পাঠানো হল— পরের রবিবারই ঠাকুরপুর গাঁয়ের ফুটবল টিম দুপুর নাগাদ পৌঁছে যাবে নমাজগড়ে।
খেলা হবে বিকেল তিনটে থেকে। সত্তর
মিনিটের ম্যাচ। রেফারি হবেন অমলেশবাবু;
আমাদের স্কুলের গেমস্-টিচার।
নিরপেক্ষতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। আমাদের
মধ্যেও সাড়া পড়ে গেল; প্র্যাকটিস বাড়িয়ে দেওয়া
হল, ভোরে উঠে দৌড় শুরু হল।
নমাজগড় আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় দু’ঘন্টার হাঁটা-পথ। ঠিক
হল— অন্য প্লেয়াররা সকালের জলখাবার খেয়েই রওনা দেবে,
যাতে দুপুরের মধ্যে পৌঁছে যেতে পারে। আমি
যাব ঘোড়ায়। তিনটে ঘোড়া ছিল আমাদের।
দূরে কোথাও যেতে হলে সেকালে এরাই ছিল বাহন।
তা আমি অশ্বারূঢ় হয়ে ছুটব বলে ঘন্টাখানেক পরে বেরোব।
প্রায় একইসঙ্গে পৌঁছে যাব সকলে।
পরের রবিবার যথাসময়ে রওনা দিলাম একাই। তখন
জৈষ্ঠ্যমাস। ভয়ানক গরম!
তার উপর পথের বারো আনাই একেবারে খাঁ খাঁ মাঠ।
এখনকার দিনে ভাবাই মুশকিল— তখন দু’খানা গ্রামের মাঝে কী বিশাল বিশাল মাঠ ছিল!
চাষবাস হত না সে সব মাঠে, ঘেষো-জমিতে লোক-চলাচলের ক্ষীণ চিহ্ন আঁকা থাকত শুধু।
ধু ধু প্রান্তরের সুদূর প্রান্তসীমায় আবছা দেখা যেত অন্য কোনো
গ্রামের ধূসর আবছা বনান্তরেখা। আমরা
আঙুল দেখিয়ে বলতাম, “ওওওই হল পুবপাড়া, বুঝলি রাখাল!” রাখালরাজ আমাদের মধ্যে সবচাইতে ছোটো, গুপ্তবাবু কবিরাজ
ছিলেন— তাঁরই নাতি। সে
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে বলত, “গাঁ কোথা গো? সবই তো ফাঁকা দেখছি!” আমরা পাকা ছোঁড়ারা হো হো করে হেসে উঠতাম বটে, কিন্তু
সত্যিই সেইসব ধু ধু মাঠের মধ্যে পথ হারালে আর রক্ষে ছিল না!
তা আমার অবিশ্যি পথ হারানোর প্রশ্ন নেই। বহুবার
আমি এবং আমার ঘোড়া— বাবু— দু’জনেই যাতায়াত করেছি এই মাঠ দিয়ে। তিনখানা
গাঁ আছে আশুদি-র মাঠের তিনদিকে;
সব গাঁয়েই বন্ধুবান্ধব আছে কিছু-না-কিছু৷ আগে মেজদার সঙ্গে ঘন ঘন যাওয়া হত। এখন
বড়ো হয়ে গেছি, এক ঘোড়ায় উঠতে পারিনে,
তাই আর যাওয়া হয় না আগের মতো। তবে
দিক ভুল হবে না।
আমার গ্রামের প্লেয়াররা সব নমাজগড়ের বাইরে একটা আমবাগানে বসে জিরোচ্ছিল।
এতটা পথ হেঁটে এসেছে, চাট্টিখানি কথা? আমাকে ঘোড়ায় চড়ে আসতে দেখে তারা উঠে
পড়ল। গ্রামে একসঙ্গেই ঢুকলাম সবাই৷
ঢুকে কিন্তু ঘটাপটা দেখে একটু ঘাবড়েই গেলাম।
মাঠে ম্যারাপ বাঁধা হয়েছে, চোঙা ফোঁকা হচ্ছে, নিশেন উড়ছে হাওয়ায়— সে এক কাণ্ড বটে! কথিত আছে, প্রতাপাদিত্যর
বাড়াবাড়িতে চটে গিয়ে মুঘলরা যখন যশোর আক্রমণ করতে এসেছিল, তাদের
সৈন্যরা নাকি এখানে এসে নমাজ পড়েছিল; তাই গাঁয়ের এমন নাম হয়েছে।
এতখানি পথ কুচকাওয়াজ করার পথে তারা একটিবার মাত্র নমাজ পড়েছিল—
শুনলে প্রত্যয় হয় না। সে
যাক, এখানকার জমিদারবাড়িতে আমাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা
হয়েছে৷ দুপুরে মাংস-ভাত বেশি খেলে দেহ ভারি হয়, খেলা যায় না ঠিকমতো। চোখের
ইশারায় বন্ধুদের বারণ করতে লাগলাম প্রাণপণে, তারা শুনল না৷ বলি ছাড়া মাংস খাওয়া যেত না বলে তখনকার দিনে গ্রামদেশে মাংস-ভাত ছিল মহাভোজ! কে ছাড়বে? তবে
একটা দৃশ্য দেখে ভয় কেটে গেল৷ আমাদের প্লেয়ারদের দ্বিগুণ মাংস-ভাত খাচ্ছে নমাজগড়ের ছেলেরাই, একেবারে প্রাণ হাতে নিয়ে
খেয়ে যাচ্ছে তারা। যাক—
নিশ্চিন্দি।
খেয়ে উঠেই ড্রেস পরে রেডি হতে হল;
তিনটে প্রায় বাজে, আর অমলেশবাবু সময়ের ব্যাপারে
বেজায় খুঁতখুঁতে।
খেলা হল কোনোরকমে। দেখা
গেল, পেট ভরে মাংস-ভাত খেয়ে ওই
চাঁদিফাটা গরমের মধ্যে কোনো পক্ষের খেলোয়াড়দেরই দৌড়োনোর বিশেষ উৎসাহ নেই।
ফার্স্ট হাফ তো পায়চারি করেই কাটিয়ে দিল সবাই।
দর্শকদের দুয়ো খেয়ে সেকেন্ড হাফে তবু খানিক দৌড়োদৌড়ি হল,
গোলও হল দু’খানা। এক-এক গোলে ম্যাচ ড্র হয়ে গেল। শেষে
মাঠেই বসে প্রকাণ্ড একটা কাঁঠাল ভেঙে দু’দলের খেলোয়াড়েরা একসঙ্গে পেটপুজো করছে দেখে দর্শকেরা ছ্যা ছ্যা করতে করতে চলে
গেল৷
সোয়া পাঁচটা নাগাদ আমাদের গাঁয়ের ছেলেরা রওনা দিয়ে দিল।
আমি গিয়ে বসলাম নরেশদের বাড়িতে। সে
আমার দূর সম্পর্কের পিসতুতো ভাইও বটে, আবার পড়েও একই ইস্কুলে। দেখা
হত রোজই, এখন স্কুল বন্ধ বলে দেখা হয়নি দিনকয়েক।
বসে গল্পগুজব করে, মিষ্টিমুখ সেরে যখন বেরোলাম— সন্ধে হয়ে এসেছে।
শুক্লপক্ষ, পুব আকাশ লালচে
হয়ে উঠেছে। আমি ঘোড়া নিয়ে রওনা দিলাম নিশ্চিন্তে।
চেনা পথ, দেখতে দেখতে
পৌঁছে যাব।
নমাজগড়ের সীমা ছাড়িয়ে আশাদির মাঠে পড়লাম যখন,
তখন রাঙা চাঁদ উঠেছে দিগন্ত আলো করে৷ ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে।
বাবুর লাগাম ছেড়ে দিয়ে আরাম করে বসলাম। ঘোড়াও
দুলকিচালে ধীরেসুস্থে চলতে লাগল; বুঝতে পেরেছে—
আমার তাড়া নেই।
চারিদিকে খোলা মাঠ, কোথাও কোথাও বনঝোপ, আশশ্যাওড়ার গাছের নিচে অন্ধকারে শেয়ালের
নড়াচড়া— আর কিছু নেই। চাঁদের
আলোয় সবকিছুই রহস্যময় আর মধুর দেখায়। মনে
হতে থাকে— এই যাওয়াটাই সত্যি, কোথাও
যে পৌঁছতেই হবে— এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি।
পনেরো বছর বয়েসের ছেলেপুলে আজ বাচ্চা বলেই ধরি আমরা,
তখন ওই বয়েসে সবাই রীতিমতো সেয়ানা হয়ে যেত।
মেয়েদের তো এর আগেই বিয়ে হয়ে যেত প্রত্যেকের।
দিন যে বদলে গেল— এ যে কতখানি ভালো হয়েছে— তা তোমাদের মা-মাসি-পিসিরা বুঝতে পারবেন না এখন আর।
কিন্তু সমস্যা এল অপ্রত্যাশিত পথে। আধঘন্টা
পর থেকেই বুঝতে পারলাম, সাঙ্ঘাতিক তেষ্টা পেয়েছে।
গরম গিয়েছে সারাদিন, তার উপর খেলেছি, মিষ্টি খেয়েছি কষে! তখন তো জল নিয়ে চলাচলের উপায় ছিল না, বোতলের সৃষ্টি হয়নি
তখনও।
আরও খানিক চলার পর বুঝলাম, তেষ্টা সামলানো
যাচ্ছে না৷ গলা শুকিয়ে কাঠ, পেট গোলাচ্ছে রীতিমতো!
নাঃ! এইভাবে এতটা পথ যাওয়া
অসম্ভব। আরও অন্তত আধা ঘন্টার পথ বাকি।
মহা মুশকিল হল দেখছি!
হঠাৎ মনে পড়ল, এখান থেকে সোজাপথে না-গিয়ে যদি ডাইনে মিনিট দশেক একটু
জোরকদমে ঘোড়া চালানো যায়, তাহলে দত্তপাড়ায় পৌঁছোনো যায়।
আমাদের এই অঞ্চলে এমনিতেই লোকালয়গুলো একটু ছাড়া-ছাড়া,
বিচ্ছিন্ন। দূরে
দূরে গ্রাম দশ-বারোখানি। দত্তপাড়া তার মধ্যেও আরেকটু
একটেরে ধরনের। তার আশেপাশে একটি বলতে জনবসতি
নেই; পিছনে পদ্মবিল— তার এপার-ওপার দেখা যায় না। ফলে
পথচলতি মানুষ যে হুট করে গ্রামে এসে পড়বে— এমন প্রশ্নই নেই।
তো এই দত্তপাড়ার বীরেশ দত্ত পড়ত আমাদের সঙ্গে একই কেলাসে।
রাজপুত্তুরের মতো চেহারা তার; ইয়া লম্বাচওড়া দেহ, টিকোলো নাক, টকটকে রঙ। ক্লাস ফোর অবধি আমরা পাঠশালের
মেঝেতে পাশাপাশি চাটাই পেতে বসতাম; লোকজন বলত— বন্ধু নয়, দুই ভাই ছিল
বুঝি গতজন্মে। তারপর ফাইভে উঠে আমাদের সেকশন
আলাদা হল, সেভেনের পর দত্ত চলে গেল খুলনার বড়ো ইশকুলে।
সেও আজ দু’বছর আগের কথা।
তারপরেও অবিশ্যি আমি বারকয়েক এসেছি ওদের বাড়িতে৷ ছোটোর মধ্যে বেশ
পয়পরিস্কার গাঁ, মূলত জেলেদের বাস বলে
এখানে-ওখানে জাল মেলে দেওয়া থাকে রোদে।
একটা বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে ঢুকতে হয় ওদের গাঁয়ে,
সেখান থেকে সোজা রাস্তা চলে গেছে দত্তদের মস্ত পাকা দালান পর্যন্ত।
চেনা রাস্তা। গিয়ে
জল খেয়ে, খানিক জিরিয়ে ফের ঘোড়ায় চড়ব; সাড়ে-আটটার মধ্যে ঢুকে যাব ঠাকুরপুরে।
যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। ঘোড়ার
মুখ ঘুরিয়ে দিলাম ডানদিকে৷ একটা আবছা রেখা আঁকা ছিল ঘাসের উপর দিয়ে,
ওইটুকুই ভরসা। কিন্তু
কয়েক মিনিটের মধ্যে সেটুকুও ঘন ঘাসের মধ্যে অদৃশ্য হল। আন্দাজে
এগোতে লাগলাম।
ভুল পথে যে আসিনি, তা অবিশ্যি মিনিট পাঁচেক পরেই বুঝলাম। দূর
থেকে সেই বাঁশের সাঁকোটা দেখা গেল। ওইটে
পার হলেই দত্তপাড়া।
এমন সময় হঠাৎ বাবু কেমন বিগড়ে বসল। সে
আর এগোতে চায় না, কেবলই মাথা নিচু করে
পা ঠুকতে লাগল মাটিতে৷ পেটে গোড়ালির চাপ দিয়ে তাকে ঠেলাঠেলি করা গেল, সে গ্রাহ্য করলে না। মনে
হল, কিছুতে ভয় পেয়েছে৷ সামনে সাপখোপ থাকলে ঘোড়া এমন
করে শুনেছি, দেখিনি কখনও৷ আর তখন মস্ত চাঁদ উঠেছে, প্রায় দিনের আলোর মতোই জ্যোৎস্না ফুটেছে। সব
পরিস্কার দেখা যাচ্ছে৷ কোথায় সাপ?
বাধ্য হয়ে নেমে পড়লাম। লাগাম
ধরে তাকে টেনে আনতে গেলাম, তাতেও তার প্রবল আপত্তি,
পারলে আমাকেই টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় পিছনের দিকে।
কোনোক্রমে তাকে জোরজার করে সাঁকোটা পর্যন্ত নিয়ে এসে গলার দড়িটা
বেঁধে দিলাম বাঁশের খুঁটির সঙ্গে, সে ছটফট করতে
লাগল।
এমন কিছু ঘটলে এমনিতেই কেমন যেন অসোয়াস্তি হতে থাকে।
তার উপর সাঁকোটা দেখে মন আরও দমে গেল। বহুকাল
বোধহয় সেটার যত্ন-আত্তি করে না কেউ।
নিচের খালটাও মরে এসেছে। সাঁকোয়
পা দিতেই বেজায় বিচ্ছিরিভাবে মচমচ শব্দ করতে লাগল। বাবু
দেখি রীতিমতো লাফালাফি করতে শুরু করেছে।
সেদিকে আর না-তাকিয়ে সাবধানে সাঁকো পার হয়ে অপর পারে এলাম। এখান
থেকে দত্তপাড়া দু’মিনিটের পথ।
হাঁটা শুরু করার পরেই সেই অসোয়াস্তির ভাবটা বাড়তে লাগল।
মনে হতে লাগল, যেন আমার ভিতর থেকে কেউ আমাকে পিছনবাগে টানছে, বলে চলেছে, “ওদিকে যেও না৷ বিপদ! বিপদ!!”
আমি হাইস্কুলে পড়া ছেলে, সাইন্স পড়ি। বাদলার
অন্ধকার রাত-বিরেতে কই মাছ ধরতে যাই
ধানের খেতের লাগোয়া বাঁশের বনে৷ নিজেকে ঠেলে নিয়ে চললাম নিজেই৷ ভয় অমনি পেলেই হল?
দত্তদের গ্রামে ঢুকতেই একটা পুরোনো মন্দির পড়ে৷ খাসা টেরাকোটার
কাজ ছিল তাতে, উঁচু মাথাটা বেশ দূর
থেকে দেখা যেত গাছপালার উপর দিয়ে। সেইটে
আজ দেখতে পেলাম না। মনটা কু গাইতে লাগল—
ভুল করে অন্য কোথাও চলে এলাম না তো!
আরেকটু এগোতে সেই মন্দিরটা চোখে পড়ল। ভেঙেচুরে
পড়ে আছে রাস্তার পাশে।
হল কী!
পা থেমে আসছিল ক্রমে। গ্রামে
ঢুকে পড়লাম এবার। হতশ্রী,
লক্ষ্মীছাড়া গ্রাম যেন। দু’পাশে
পোড়ো বাড়ি, পোড়ো নাটমন্দির, ভাঙা তুলসীমঞ্চ।
এক-একটা বাড়ি ভেঙেচুরে রাস্তার
উপর এসে পড়েছে; টালির চাল ছড়িয়ে রয়েছে কাঁচা রাস্তার উপরে৷ ডিঙিয়ে
যেতে হচ্ছে। একটি আলোর রেখা নেই কোথাও।
যেন মন্ত্রবলে গাঁয়ের সমস্ত লোক রাতারাতি উধাও হয়ে গিয়েছে সব ফেলে
রেখে। আশ্চর্য!
এবার আমার বুক দুরদুর করতে লাগল। এই
অভিশপ্ত পুরী থেকে এক ছুটে পালিয়ে যাওয়ার একটা নির্লজ্জ ইচ্ছে বুকের মধ্যে হাঁকপাঁক
করছে, মনে হচ্ছে— বাবুর ইচ্ছে
মেনে নিয়ে চলে গেলেই বুঝি ভালো হত। পরক্ষণেই
আফসে উঠছে রোখ— আমার মতো ডাকাবুকো ছেলেও
কিনা শেষে ভয় পেয়ে যাবে? পালিয়ে যাবে? ছি!
আর তাছাড়া বীরেশ আমার ক্লাস ওয়ানের বন্ধু।
এই সবকিছু দেখার পর তার খবর না-নিয়ে ফিরে যাবই বা কোন্ মুখে?
এগোলাম পায়ে পায়ে। রাস্তায়
ঝুঁকে পড়েছে গাছের ডাল। অন্ধকার।
চাঁদের আলোটুকুও আমার সঙ্গ ত্যাগ করছে এবার।
নিজের পায়ের শব্দটাই প্রচণ্ড জোরে কানে বাজছে।
এইবার দেখা দিল দত্তদের প্রকাণ্ড বাড়িটা। কালো
একটা পাহাড়ের মতো সেটা দাঁড়িয়ে আছে আকাশ আড়াল করে।
কাছে গেলাম। হাঁটু
কাঁপছে অল্প অল্প। হাতটাও কাঁপছে,
গেট খুলতে গিয়ে বুঝলাম।
যত্নের বাগান পড়ে আছে কাঁটাঝোপ আর গজাড়ের জঙ্গলে ঢেকে।
ডানদিকে আস্তাবল। ফাঁকা।
ঘোড়া নেই। দূরে
ওদের ঠাকুরদালানে এই সময় সন্ধ্যারতি হওয়ার কথা৷ কেউ নেই। প্রদীপ
জ্বলেনি।
সামনে বিশাল বারান্দা। সিঁড়িতে
আর বারান্দায় শুকনো পাতা। পা ফেলতেই মচমচ শব্দ হচ্ছে।
বারান্দায় উঠতেই গায়ে কাঁটা দিল স্পষ্ট। এমন
বিজন নৈঃশব্দ্য কখনও বুঝিনি এর আগে৷ পিছন ফিরে তাকালাম একবার। পোড়ো
বাগানে আবছা চাঁদের আলোর ফিনিক দিচ্ছে, তারই খানিক এসে পড়েছে নোংরা, ধুলো আর পাখির ময়লায় ভরা
বারান্দায়।
প্রকাণ্ড সদর দরজাটা বন্ধ।
বন্ধ? কই, দেখি?
ঠেলতেই অস্বাভাবিক জোরালো একটা ক্যাঁচ শব্দে খুলে গেল দরজাটা৷
মনের সবটুকু জোর এক করে উঁকি দিলাম।
ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দরজা
দিয়ে এক ফালি চাঁদের আলো এইবার পড়ল মেঝেতে৷ এই আলোয় কিছু দেখা যায় না,
উলটে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। ভুরু
কুঁচকে তাকালাম।
কেউ নেই। বিশাল
হলঘরটায় একদা এন্তার আড্ডা মেরেছি বীরেশের সঙ্গে। মাঝখানে
একটা সাহেবি কায়দার সোফাসেট ছিল। আছে!
বাঁপাশ দিয়ে ঘোরানো সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়৷ সেটাও দেখা যাচ্ছে৷ আর বাকি
সব আবছা অন্ধকারে ডুবে আছে।
আমার নার্ভগুলো ততক্ষণে সহ্যের শেষ সীমা ছাড়িয়ে বোধহয় অবশ হয়ে
গিয়েছিল। সাহস করে ডেকেই বসলাম, “দত্ত বাড়িতে আছ নাকি হে? দত্ত?
বলি কোথায় গেলে সবাই?”
হঠাৎ, স্পষ্ট মনে হল, ভিতর থেকে অসম্ভব জোরে অথচ খসখসে গলায় কে যেন হেঁকে উঠল, “কে? কে ওখানে?”
আমার বুকের ভেতরটা লাফিয়ে উঠল! এই তো,
মানুষের কণ্ঠস্বর! আছে, আছে
লোকজন! মানুষ আছে!!
আমি এবার বেশ গলা তুলে বললাম, “আজ্ঞে আমি ঠাকুরপুরের চাটুজ্যেদের বাড়ির জহর! জহরলাল!
এই পথে যাচ্ছিলাম, তা বড়ো জলতেষ্টা পেয়েছে বলে…”
এই পর্যন্ত বলার পরেই আমার চোখে পড়ল, দোতলায় ওঠার
সিঁড়িটা যেখানে ওপরের তলায় পৌঁছেছে, ঠিক তার নিচের ঘন অন্ধকারের
মধ্যে যেন কী একটা… অথবা কে একটা নড়েচড়ে উঠল— যেন যুগযুগান্তরের অনন্ত নিদ্রা ত্যাগ করে উঠে আসছে পাতালগুহা থেকে সদ্য-ছাড়া-পাওয়া প্রেত!
তারপর, আমার বিস্ফারিত চোখের সামনে সেই দোতলা
থেকে নিচের হলঘরের আবছা আলোর দিকে নেমে আসতে লাগল দুটো পা৷ প্রকাণ্ড, রোমশ, ধুতি-পরা পা! এত বড়ো যে, দোতলার বারান্দা থেকে তা অনায়াসে পৌঁছে গেল
হলঘরের মেঝে পর্যন্ত!
যার পা এত বড়ো, সে নিজে কত বড়ো? কে এই অবিশ্বাস্য মহাকায় দানব?
আমার চোখের সামনে সেই পা এসে একতলার মেঝে স্পর্শ করল।
মনে হল, গোটা বাড়িটাই
যেন কেঁপে উঠল সেই পদভারে!
আর নয়! এক মুহূর্ত দেরি না-করে পিছন ফিরে দৌড়োতে শুরু করলাম আমি। উন্মাদের
মতো দৌড়! বারান্দা পেরিয়ে, সিঁড়ি
বেয়ে নেমে, দু’পাশের ভেঙে-পড়ে-থাকা পরিত্যক্ত বাড়ির মধ্য দিয়ে দৌড়োতে লাগলাম প্রাণপণে—
যেন এই গ্রামের বাইরে বেরিয়ে যাওয়াটাই শুধু আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে!
দরদর করে ঘাম হচ্ছিল আমার, সর্বশরীর কাঁপছে।
শুধু তারই মধ্যে ভেসে আসছে এক অপার্থিব অশরীরী কণ্ঠস্বর—
দুটো প্রকাণ্ড পাথরকে যদি অমিত বলশালী কোনো মানুষ দু’হাতে নিয়ে ঘষতে থাকেন— তেমন শব্দ ভেসে আসছে দূর থেকে, “শোনো! যেও না! গেরস্ত বাড়িতে জল চাইলে না-খেয়ে যেতে নেই! গেরস্তের অকল্যাণ হয় যে! শোনো! চলে যেও না!!”
দূরাগত সেই কণ্ঠস্বরের থেকে উন্মাদের মতো পালাতে লাগলাম আমি।
ওই সেই মন্দির! পোড়ো মন্দিরে এবার ঘন্টা বেজে উঠেছে। অতল
অন্ধকার মথিত করে বেজে চলেছে ঘন্টা— ঢং ঢং ঢং…! কে বাজায় এই বিজন অন্ধকারে? চাঁদ ঢেকে যাচ্ছে ধূলিঝড়ে! নাকি মেঘ করে আসছে অকালে অকস্মাৎ?
বিদ্যুদ্বেগে নড়বড়ে সাঁকো পার হতে হতেই দেখলাম,
সামনের দু’পা আকাশে তুলে লাফিয়ে উঠছে বাবু!
এক মুহূর্ত দেরি না-করে তার দড়ি খুলে দিয়ে আমি
লাফিয়ে উঠলাম তার পিঠে; আর সেই বিশাল মাঠ ভেদ করে যেন উল্কার
গতিতে ধেয়ে চলল সেই ভীত পশুটি— শত আতঙ্কের মধ্যেও যে আমাকে ফেলে
পালায়নি। আমাদের পিছনে পিছনে আকাশ-পাতাল শিউরে দিয়ে ভেসে আসতে লাগল সেই ভয়ানক কণ্ঠস্বর— “শোনো! জল না-খেয়ে যেতে নেই যে! যেও না, শুনে
যাও!!”
আধঘন্টার পথ পনেরো মিনিটে পাড়ি দিয়ে আমরা যখন বাড়িতে পৌঁছলাম,
তখন আমার সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপছে, চোখে অন্ধকার
দেখছি। বাইরের পাইকদের হাতে বাবুকে
ছেড়ে দিয়ে দেউড়ি পেরিয়ে অন্দরে ঢুকেই দেখি, মেজদা নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে বড়দার ঘরের দিকে যাচ্ছে, হাতে একটা মোটা বই। নিশ্চয়ই
পড়তে গিয়ে আটকে গেছে কোথাও!
আমি উঠোন থেকেই ডেকে উঠলাম, “মেজদা!”
আমার গলায় এমন একটা কিছু ছিল, মেজদা এক লাফে
বারান্দা থেকে নেমে এল কাছে৷ পরক্ষণেই আমার ঘর্মাক্ত শরীর আর ফ্যাকাশে মুখ দেখে আঁতকে
উঠে বলল, “কী হয়েছে রে? তোকে এরকম দেখাচ্ছে কেন?”
আমি কাঁপা গলায় বললাম, “দত্তদের কোনো খবর জানো? সেই বীরেশ— পড়ত আমার সঙ্গে?”
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে মেজদা বলল, “তোকে বলিনি ইচ্ছে করেই... গত
বর্ষায়, কলেরা ঢুকেছিল ওদের গ্রামে।
এক রাতে ওদের বাড়ির চারজন মারা যায়। গোটা
গ্রামটাই... শেষের দিকে দাহ করারও কেউ ছিল না… এ কী রে... হল কী তোর? ও মা!
বড়দা!!”
অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ার আগে এটুকুই শুনেছিলাম আমি!
----------
ছবি - রাজা আক্তার
No comments:
Post a Comment