গল্প:: ওল্ড ইজ গোল্ড শিল্ডের সেই ম্যাচ - দেবাদ্রি বসাক


ওল্ড ইজ গোল্ড শিল্ডের সেই ম্যাচ
দেবাদ্রি বসাক


কথায় বলে সব বড়ো ঝড়ের আগে প্রকৃতি শান্ত হয়ে যায় আমরা যে ঘটনাটির কথা বলতে চলেছি সেটাও শুরু হয়েছিল এক শান্ত রোদ-ঝলমল দিনে তখন আর কে জানত সেটার এরকম করুণ পরিসমাপ্তি হবে!
আমি আর আমার কয়েকজন বন্ধু মিলে একটা এন জি ও চালাই। আমরা অনেক সমাজসেবামূলক কাজকর্ম করে থাকলেও আমাদের মূল লক্ষ্য বয়স্ক মানুষদের দিকে। সেরকমই একটি প্রয়াস হল আমাদের একটি বৃদ্ধাশ্রম; নাম ‘ওল্ড ইজ গোল্ড’বাড়িতে একা থাকা বয়স্ক মানুষ - ছেলে বিদেশে থাকে – বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ কম – টাকা-পয়সার অভাবে ঘরবাড়ি ছাড়া মানুষজন - এরকম সবরকম মানুষ। এই বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দাদের জীবনে অনেক দুঃখ থাকলেও আমাদের এই আশ্রমের পরিবেশ এসব অনেকটাই ভুলিয়ে দিয়েছে। তাই এখানকার পরিবেশ চব্বিশ ঘন্টাই জমজমাট থাকে।
সেদিন অন্যান্য দিনের মতোই সকালের চায়ের আসর জমে উঠেছে। বেশ রৌদ্রোজ্জ্বল সুন্দর রঙিন একটা দিন। শিবচরণবাবু তার আরাম কেদারায় বসে একটি ইংরেজি নভেল পড়ছেন৷ হারেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ওরফে হারুখুড়ো বাগানের ফুল গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন হাঁ করে (কারণ জিজ্ঞেস করলে উনি বলেন সবুজের এসেন্সটুকু চোখ দিয়ে শুষে নিচ্ছি! তোমরা সব আজকালকার ছেলে-ছোকরা, তোমরা আর কী বুঝবে? সারাদিন তো স্মার্টফোনে মুখ গুঁজে পড়ে থাক)পণ্ডিত জনার্দন শাস্ত্রী মশাই একটা চক দিয়ে লাল রঙের মেঝেতে খালি ছক কাটছেন আর মুছে দিচ্ছেন। এখানে বলে রাখা ভালো যে উনি একসময় নামকরা জ্যোতিষী ছিলেন, বহু লোকের ভাগ্য ফিরিয়ে দিয়েছেন। অন্তত উনি তো তাই বলেন। শুধু ব্যস্ততার মধ্যে এটা দেখতে পারেননি যে নিজের ভাগ্যে কী আছে; তাই ছেলে ডাক্তার হওয়া সত্ত্বেও আজ এখানে ওনার ঠাঁই! বৃদ্ধ রামচরণবাবু চায়ে মেরি বিস্কুটটা ডুবিয়ে ডুবিয়ে একেবারে প্যাতপ্যাতে করে ফেলেছেন। তারকবাবু কাগজ পড়ছিলেন; খেলার পাতাটা পড়তে পড়তে হঠাৎ করে কাগজটা ভাঁজ করে প্রচণ্ড দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “না হে, কিছুই ভালো লাগছে না!”
এ কথা শুনে একসঙ্গে চার জন বলে উঠল, “অ্যাঁ!”
ব্যাপারটা গুরুতর। তারকবাবু আশ্রমের সবচেয়ে আমুদে মানুষ, তার যদি কোনো কিছুই ভালো না লাগে তাহলে কীভাবে চলবে? হারুখুড়ো বাগান দেখা থামিয়ে বললেন, “তোমার আবার কী হল তারক? এই তো বেশ শান্তিতেই আছি, ভালো না লাগার কারণটা কী?
ব্যাজার হয়ে তারকবাবু বললেন, “ভালো কীভাবে থাকি বলুন? জীবনটা শেষ হতে চলল, অথচ বলার মতো আজ অবধি কেউ কিছু করলাম? এই দেখুন মেসি ছেলেটা; সেদিনের ছেলে, এখন অবধি ছ’টা ব্যালন ডি’অর জিতে গেল আর আমরা! পঁচাত্তর বছর বয়স হল, একসময় মাঠ দাপিয়ে কত ফুটবল খেলেছি, অথচ কোনোদিন একটা আলপিনও জুটল না! জীবনে কী করলাম?
রামচরণবাবু চোখ গোল গোল করে শুনছিলেন। কিছু বলতে যাওয়ার আগেই চায়ে ভেজানো বিস্কুট-টা টুপ করে চায়ের মধ্যে পড়ে গেল। প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে তিনি বললেন, “প্রাইজটা বড়ো নয় তারক; প্যাশনটাই আসল। ওই ছেলেটা যখন ফুটবল খেলা শুরু করেছিল, নিশ্চয়ই এত বড়ো হবে ভেবে খেলেনি! নিজের ন্যাচারাল খেলাটা খেলেছে
“তা ঠিকই,” তারকবাবুর স্বীকারোক্তি, “কিন্তু তবু, একটা নতুন কিছু না করলে জীবনটা প্রচণ্ড একঘেয়ে লাগছে
শিবচরণবাবু যে বইটা পড়ছিলেন সেটা বন্ধ করে বললেন, “নতুন কিছু করতে চাও? তাহলে ফুটবলের কথাই যখন উঠল একটা ফুটবল ম্যাচই হোক না!”
এইবার সবাইকে চমকে উঠতে হলফুটবল ম্যাচ! এখানকার সদস্যদের গড় বয়স পঁয়ষট্টি। যদিও অধিকাংশেরই স্বাস্থ্য ভালো। হারুখুড়ো এখনও সকালে উঠেই ডন বৈঠক করেন। রামচরণবাবু একসময় খুব ভালো বক্সার ছিলেন। তাই সকলেই অবাক হলেও, না বলতে পারলেন না। একমাত্র জনার্দনবাবু প্রচণ্ড মাথা নেড়ে বললেন, “না না, একদম না! এসবের চিন্তাও কোরো না। এই বয়সে ছুটোছুটি করতে গিয়ে হাত-পা ভেঙে পড়ে থাকবে নাকি?
তারকবাবু মুখটাকে থেঁতলানো উচ্ছে সেদ্ধর মতো করে বললেন, “এই জ্যোতিষীটার কাজই হল সব ব্যাপারে বাগড়া দেওয়া। কেন? তোমার গ্রহ-নক্ষত্র কি আবার কোনো বিপদ সংকেত দিচ্ছে নাকি?
“এসবের জন্য গ্রহ-নক্ষত্রের বিচার করার দরকার নেই,” জনার্দনবাবুর গম্ভীর উত্তর, “এমনিই বলে দেওয়া যায়। এসব খেলাধূলা করার বয়স আমাদের আর নেই


কিন্তু জনার্দনবাবুর সাবধান বাণীও বাকিদেরকে আটকাতে পারল না। তাই ফুটবল খেলার ব্যবস্থা করার প্রস্তাবটা বৃদ্ধাশ্রম-এর ইনচার্জ, মানে আমি ও আমার বন্ধুদের কাছে পৌঁছল। ইতিমধ্যে আশ্রমের অন্যান্য সদস্যরাও এই ব্যাপারে জেনে গেছে এবং একমাত্র জনার্দনবাবু ছাড়া সকলেই খুব উৎসাহিত। তাদেরকে সিদ্ধান্ত থেকে অনেক অনুরোধ করে, ভয় দেখিয়েও বিন্দুমাত্র টলানো গেল না। অতএব মাঠ, মাইক, স্পিকার এবং কয়েকটা বেঞ্চ ভাড়া করা হলস্পেশাল অর্ডার দিয়ে একটা ট্রফিও বানানো হয়েছে ছোটো মতো। নাম দেওয়া হয়েছে ‘ওল্ড ইজ গোল্ড শিল্ড’খুবই লো-প্রোফাইল ম্যাচ! ধারাভাষ্য থেকে রেফারিং, সবই নিজেদের লোকেরাই করবে। আমরা কোনো জোয়ান ছেলেকে দিয়ে রেফারির কাজটা করাতে চেয়েছিলাম; কিন্তু হারুখুড়ো বললেন, “শোনো বাবা! তোমরা এখনকার ছেলে ছোকরা, কিন্তু আমরা এমন একটা জেনারেশনের মানুষ যেখানে ফুটবলটায় চটকদারি ছিল না, কিন্তু উন্মাদনা ছিল; আবেগ ছিল, তাই নিয়মকানুনগুলো আমরা যথেষ্ট ভালোভাবেই জানি। এবার দেখবে বুড়ো হাড়ে ভেলকি কাকে বলে!”
এসবের পর বাকি থাকল শুধু টিম সিলেকশন। জনার্দনবাবু আগেই বলে দিয়েছিলেন যে তিনি দর্শকাসনে থাকবেন। সবচেয়ে বয়স্ক দু’জন, বিপিনবিহারী মুখুজ্জে আর হীরালাল বাঁড়ুজ্যে - এরা বাই ডিফল্ট কমেন্টেটর হয়ে গেলেন। এমনিতেই বেশি বকবক করার জন্য দু’জনেরই সুনাম (বা দুর্নাম) আছে। এর ওপর বিপিনবাবু তীব্র ঘটি আর হীরালালবাবু কাঠবাঙাল, তাই একটা মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল-এর ফ্লেভার চলে আসার চান্স আছে।
ফিটনেস টেস্টে কয়েকজন সোজাসুজি রিজেক্টেড হলেন। বৃদ্ধ তারিণীবাবু বলে শট মারতে গিয়ে পাটা প্রচণ্ড জোরে চালিয়েই “উরি বাবা রে” বলে বসে পড়লেন! কোমরের পেশিতে টান লেগেছে। রামহরিবাবুর উৎসাহ ছিল প্রচুর, কিন্তু ওনার একটা হাঁপানির হালকা টান আছে। উনি অবশ্য বলেছিলেন, “আই উইল ফাইট টিল মাই লাস্ট ব্রিদ,” কিন্তু ওনাকে বোঝানো হয় যে উনি অলরেডি সেকেন্ড-লাস্ট ব্রিদে আছেন! তাই আর বেশি রিস্ক নিয়ে লাভ নেই। বাকি টিম সিলেকশন-এর ঘটনা লিখতে বসলে মহাভারত হয়ে যাবে; তাই বিস্তারিত না বলাই ভালোশেষমেশ ঠিক হল খেলা হবে তারক একাদশ আর রামচরণ একাদশ। ম্যাচের রেফারি হবেন হারুখুড়ো। অলরেডি উনি একটা হুইসেল জোগাড় করে ফেলেছেন এবং কারণে-অকারণে সেটা বাজিয়ে মাঠের বাইরেই লোকজনকে ফাউল দিচ্ছেন।


অবশেষে এল সেই বহু প্রতীক্ষিত দিন। রবিবার। আকাশ মেঘলা। আগের দিন একটু বৃষ্টি হয়ে গেছে। মাঠের ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে প্যাচপ্যাচে কাদা। জনার্দনবাবু একটু খুঁতখুঁত করছিলেন, “আজকের দিনটাই বাছলে তোমরা! আজ আবার অমাবস্যা! গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান ভালো নয়” কিন্তু সবার উৎসাহ এতটাই বেশি ছিল যে কেউ সে সবে আমল দিল না। যাই হোক, সকলে মাঠে ঢুকলমাঠের একধারে একটা বেঞ্চিতে মাইক হাতে কমেন্ট্রি করতে বসেছেন বিপিনবাবু আর হীরালালবাবু। তাদের পাশে জনার্দনবাবু বসেছেন, চোখে চশমা, হাতে কাগজ নিয়ে। গ্রহ-নক্ষত্রের জটিল হিসাব করে উনি প্রেডিক্ট করেছেন ম্যাচ ড্র হবে। এখন কীসের হিসাব উনি করছেন ভগবান জানেন। তাদের পেছনে অন্যান্য সদস্যরা (যারা খেলায় চান্স পায়নি) বসে আছে। আমরা অল্পবয়সিরা এক ধারে দাঁড়িয়ে দেখছি বিচিত্র দৃশ্য! মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে বাইশ জন মানুষ। তাদের কারও কারও বয়স পঁচাত্তর, কারও সত্তর। সবাই প্রচণ্ড উৎসাহে ওয়ার্ম-আপ করছেন। হারুখুড়ো এর মধ্যে গলায় হুইসেল ঝুলিয়ে প্রচণ্ড ছুটোছুটি করছেন। সবাই নিজের নিজের পজিশন নিয়ে নিলেন। একটা চিনচিনে আওয়াজ করে মাইক অন হলবিপিনবাবুর গলা শোনা গেল, “নমস্কার বন্ধুগণ! আজ এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত! পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম এক অভিনব ফুটবল ম্যাচের সাক্ষী হতে চলেছি আমরা। এই ম্যাচ প্রবীণ মানুষদের এক অবিস্মরণীয় ফুটবল ম্যাচ ‘ওল্ড ইজ গোল্ড শিল্ড’তোমার এই অভিনব উদ্যোগ দেখে কী মনে হয় হীরালাল?” “পৃথিবীর কথা তো জানি না, তবে আমাগো লোক্যালিটিতে এরকম খেলা আমি আগে দ্যাখি নাই! আমাগো দ্যাশে যখন সিলাম খেলাধুলো হগগলের রক্তে আছিল। কিন্তু বয়সটা চল্লিশ ছুঁইলেই একেবারে বেবাক দুর্বল হইয়্যা যাইত। সেদিক থিক্যা দেখলে সকল ভাইয়ের উৎসাহ সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। আর ইতিমধ্যে আমরা দেখতে পাইতাছি বটকৃষ্ণ বলের লগে দৌড় দিতাছে। কিন্তু নিজের গোলের দিকেই যায় ক্যান?” বটকৃষ্ণবাবু খেলার শুরুতেই ভুল করে নিজেদের গোলের দিকে দৌড় দিয়েছিলেন। আরেকটু হলেই সেমসাইড গোল করেছিলেন আর-কি! কমেন্ট্রি শুনে ভুল শুধরে নিজের দিক বদলে পাস দিলেন হরিদাসবাবুকে। বিপিনবাবু বললেন, “হরিদাস এগিয়ে যাচ্ছে বল নিয়ে। পাস বাড়াল প্যারীমোহনের দিকে। সুন্দর নিখুঁত স্কিল! যদিও আজকে এদের জার্সির কোনো রং নেই তবুও এটা আমাকে সবুজ-মেরুন দলের ডিসিপ্লিনড ফুটবলের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে!” হীরালালবাবু মুখ বেঁকিয়ে বললেন, “আরে ফালাইয়া দে তর সবুজ-মেরুন! এদের স্কিল হইল গিয়া আগুনের মতন! আর আগুন কখনও মেরুন রঙের দেখছস? আগুন তো মশাল থেইকাই বাইর হয়
“মশাল তো আর পরাধীন ভারতবর্ষের ব্রিটিশদের চোখে চোখ রেখে হারায়নি!”
“আরে তর তো এক্কেরে একই কথা! ভুইলা গেলি সেই পাঁচ গোল দিছিল তগো সবাইরে?
“সে সব শোধ করে দিয়েছে অনেক দিন হল, আগে আমাদের সমান ট্রফি পেয়ে দেখা!”
“আগে আমাগো সমান স্কিলফুল ফুটবল খেইলা দেখা
এবং ধীরে ধীরে কমেন্ট্রি সম্পূর্ণরূপে মাঠের খেলা ছাড়িয়ে মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল-এর প্রসঙ্গে চলে গেল এবং একটা সময় দু’জনের মধ্যে হাতাহাতি লাগার উপক্রম হল। অনেক কষ্টে সে সব আটকে তাদেরকে বলা হল কমেন্ট্রি মাঠের খেলাতেই সীমাবদ্ধ রাখতে।

ইতিমধ্যে কিছু ছোটোখাটো ঘটনা ঘটেছে। যেমন ফুটবলে শট মারতে গিয়ে রামচরণবাবু রেফারি হারুখুড়োকেই ল্যাং মেরে বসেছেন এবং হলুদ কার্ড দেখেছেন।
হরিদাসবাবু আরও দু’বার নিজের গোলের দিকে এগিয়ে গেছেন এবং কর্নার কিক-এ হেড দিতে গিয়ে দু’জন প্লেয়ারের মাথা ঠোকাঠুকি হয়ে গেছে।
এসব পর্যন্ত ঠিক ছিল, কিন্তু এরপর ঘটল প্রথম দুর্ঘটনাটা। বল নিয়ে রমাপদবাবু বিপক্ষের গোলের দিকে উঠছিলেন এবং সেই সময় একজন প্লেয়ার তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এর ফলে রামচরণবাবুর টিম একটা ফ্রি কিক পায়। সবাই লাইন দিয়ে দাঁড়ায়। বিপক্ষ টিমের রামচরণবাবু শট নিতে যাচ্ছেন। উনি প্রচণ্ড কায়দা করে বুট দিয়ে লাইন কেটে তারপর কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে দৌড়োতে শুরু করলেন এবং কিছুটা এগোতেই ঘটল সেই আকস্মিক দুর্ঘটনা! মাঠের মাঝখানে এক তাল কাদা পড়েছিল। তাতে পা পিছলে পাখির মতো উড়ে গিয়ে রামচরণবাবু পড়লেন আরেক তাল কাদার মধ্যে!
সবাই হাঁ হাঁ করে ছুটে এল। রামতারণবাবুর অবস্থা শোচনীয়! এক মুখ কাদা মেখে তিনি উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু তার আগেই আবার পা পিছলে সেই কাদাতেই থেবড়ে বসে পড়লেন। সবাই ধরাধরি করে তাকে দাঁড় করালে বোঝা গেল পা মচকেছে। অতএব রিটায়ার্ড হার্ট! টিমের ক্যাপটেন বেরিয়ে গেল! প্লেয়াররা সব স্তব্ধ। রামচরণবাবু মুখ থেকে থু থু করে কাদা ফেলে বললেন, “খেলা যেন বন্ধ না হয়! দশ জনেই খেলুক আমার টিম

অতএব খেলা চলতে থাকল একইভাবে। দুটো দলই প্রচুর সুযোগ নষ্ট করল গোলকিপার দু’জনকে বিশেষ কিছু চাপ নিতে হয়নি। প্লেয়াররা বল নিয়ে ওঠার আগেই অন্য দলের প্লেয়ার কেড়ে নিচ্ছে, কিন্তু তাতেও তারা বিশেষ সুবিধা করতে পারছে না। দু’জন কমেন্টেটর ইতিমধ্যে বাঙাল-ঘটির মধ্যে কাদের খাবার-দাবার বেশি ভালো সেই নিয়ে তর্কাতর্কি লাগিয়েছেন!
খুবই ধীর গতিতে খেলা চলছে। যাদের বয়স খুব বেশি তাদের দম ফুরিয়ে আসছে। ব্যাতিক্রম তারকবাবু। তিনি দৌড়ে যাচ্ছেন, লাফাচ্ছেন, ঝাঁপাচ্ছেন, কিন্তু বলে একবারও পা ঠেকাতে পারছেন না। তার অতিরিক্ত উৎসাহই কাল হল আর ম্যাচের চল্লিশ মিনিটে ঘটল একটি অসাধারণ ঘটনা! হরিদাসবাবু বল পেয়েছিলেন। হঠাৎ তিনি আবার ভুল করে নিজেদের দিকে এগোতে থাকলে তারকবাবু অনেকটা ছুটে বলের কাছাকাছি এগিয়ে এলেন। বিপক্ষের ডিফেন্ডার বেগতিক দেখে তারকবাবুকে সামান্য ধাক্কা মেরে দিয়েছিল। রেফারি হারু খুড়োর তা নজর এড়ায়নি। তিনি তাড়াতাড়ি দৌড়ে এসে বাঁশি বাজাতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু বাঁশি মাঝপথেই থেমে গেল এবং তারপর রেফারির চারপাশে একটা হুলুস্থুলু বেঁধে গেল। বুঝলাম কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। কাছে গিয়ে দেখলাম কাঁচুমাচু মুখে তারকবাবু দাঁড়িয়ে আছেন আর হারুখুড়ো বাচ্চাদের মতো তোতলিয়ে চেঁচাচ্ছেন, “হতচ্ছালা তালক। আমাল দাঁততা কোতায় পাতালি? খুঁদে দে হতবাগা!”
আমার ঘটনাটা বুঝে উঠতে একটু সময় লাগলতারপর ব্যাপারটা পরিস্কার হল। ডিফেন্ডার যখন তারকবাবুকে ধাক্কা মেরেছিল হারুখুড়ো দৌড়ে কাছাকাছি চলে আসেন এবং ফাউল দিতে যান। হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে বাঁশিতে ফুঁ দিতে গিয়ে তার বাঁধানো দাঁত মুখ থেকে খুলে বেরিয়ে আসে। এদিকে পায়ে অনেকক্ষণ বল না পেয়ে তারকবাবু তেতে ছিলেনই। বলটায় তিনি তাড়াতাড়ি শট মারতে যান, কিন্তু সেটা বলে না লেগে লাগে হারুখুড়োর উড়ন্ত দাঁত জোড়ায়; আর মোক্ষম সেই শটে সেটা এখন ত্রিভুবনের কোথায় পৌঁছেছে খোঁজে কার সাধ্যি! জনার্দনবাবু এক টিপ নস্যি নিয়ে বললেন, “এইটুকু সময়ের মধ্যেই দুটো দুর্ঘটনা! আমি তো বলেইছিলাম, আজ দিনটা ভালো নয়
কিন্তু তার কথা শোনার সময় এখন নেই। খেলা বন্ধ রেখে সবাই তখন হারুখুড়োর দাঁত খুঁজতে মাঠের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। যদিও বেশি সময় লাগল না। তারকবাবুর শটের গতিপথ ধরে কিছু দূরে কাদার মধ্যে অর্ধেকটা ডোবা অবস্থায় সেটাকে শান্তভাবে পড়ে থাকতে দেখা গেলসেটা দেখে হারুখুড়ো, তারকবাবুর দিকে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন; আর তারকবাবু বাসি মুড়ির মতো মিইয়ে গেলেন।
এখানে আমরা খেলা বন্ধ রাখার কথা বলেছিলাম, কিন্তু উনি বললেন, “আমাদেল জেনালেশন-তা কখনও পিথিয়ে আথে না। খেলা হবে। পুলোটা খেলে তবে থাড়বো (কাদামাখা দাঁত উনি মুখে তুলবেন না, তাই এখন ফোকলা অবস্থাতেই রেফারির কাজ করছেন)।
কিন্তু জনার্দনবাবুর ভবিষ্যৎবাণী ফলতে আর একটু বাকি ছিল।

এরপর কয়েকটা বিক্ষিপ্ত আছাড় খাওয়া ছাড়া বিশেষ কিছু হয়নি। দুটো প্রচণ্ড দুর্ঘটনার পর এগুলো এতই সাধারণ লাগল যে কেউ তেমন উত্তেজিত হল না।
খেলা প্রায় শেষের দিকে, কেউই এখনও কোনো গোল করতে পারেনি। ঠিক সেইসময় এল একটা রোমাঞ্চকর মুহূর্ত। ম্যাচের শেষ মুহূর্তে গোল করে দলকে জেতাতে শেষ চেষ্টা করতে চাইলেন রামচরণবাবুর দলের স্ট্রাইকার। বল নিয়ে বেশ কয়েকজনকে কাটিয়ে উঠে এসেছেন। কমেন্ট্রি বক্সে বিপিনবাবুর গলা শোনা গেল, “রামচরণবাবুর দলের আক্রমণাত্মক চেষ্টা। শেষ বাধাও পেরিয়েছে সফলভাবে! গোল হবে? কি, হবে না? হবে? কি, হবে না? গোল হল না আ-আ-আ-আঁক! জনার্দনবাবু! সামলে!” স্ট্রাইকার বেশ ভালো কাটিয়েও একদম শেষ মুহূর্তে তাড়াহুড়ো করে শট নিতে গিয়ে গোলপোস্টে মেরেছেন। গোল হল না ঠিক ছিল, কিন্তু বারে লেগে বলটা আবার গেল তারকবাবুর পায়ে। এবার অবশ্য তারকবাবু মাঠের বাইরে ক্লিয়ার করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু লক্ষ করেননি সেখানে অডিয়েন্স বসে আছে। তাই তিনি বল সোজা মেরেছেন সামনের সারিতে বসা জনার্দনবাবুর দিকে। ছুটে আসা বলটাকে দেখে আতঙ্কিত বিপিনবাবুর সাবধানবাণী শুনে হিসাবপত্র নিয়ে ব্যস্ত জনার্দনবাবু যখন মুখ তুলে তাকালেন তখন একটু দেরি হয়ে গেছে। তিনি একবার শুধু ‘আঁক’ করে একটা অদ্ভুত শব্দ করলেন আর বল সজোরে তাঁর মুখে লেগে অন্যদিকে ছিটকে গেল।
আমরা ছুটে আসতে আসতে দেখলাম জনার্দনবাবু আহত সৈনিকের মতো উলটে পড়লেন আর তার শরীরের ভারে তিনি যে বেঞ্চে বসেছিলেন সেটাও দু’জন কমেন্টেটর সমেত উলটে গেল।


খেলা তখনই শেষ হয়ে গিয়েছিল। ফল শূন্য-শূন্য। অনেক ঘন্টার সেবা-শুশ্রূষার পর জনার্দনবাবুর জ্ঞান ফিরল। তিনি খুব সম্ভবত আতঙ্কেই অজ্ঞান হয়ে গেছিলেন। বেঞ্চসমেত উলটে পড়লেও বিপিনবাবু ও হীরালালবাবুর কিছু হয়নি, শুধু দু’জনেই ধুতি পরে থাকায় ধুতির কাছা খুলে গেছিল। কিন্তু চোট লাগেনি।
জনার্দনবাবু একটু উঠে বসলেন, কিন্তু তারকবাবুকে ফুটবল হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার চোখে-মুখে একটা আতঙ্ক ফুটে উঠল।
ঘরে আমরা সকলেই ছিলাম। আমি বললাম, “বলেছিলাম তো! এই বয়সে এসে এত ধকল কি পোষায়? এখন এসব ইনজুরি সারাতে অনেকদিন লাগবে
“না হে ছোকরা!” হারুখুড়োর সাড়া পাওয়া গেল (সাবান দিয়ে ধুয়ে, টুথপেস্ট দিয়ে মেজে, দু’ঘণ্টা ডেটল জলে চুবিয়ে, আল্ট্রাভায়োলেট রে-এর নিচে কিছুক্ষণ রেখে তবেই তিনি দাঁত মুখে তুলেছেন) “কোনো ইনজুরি হয়নি। এসব সুযোগ জীবনে ক’বার আসে বল তো? আমরা তো কোনোদিন ভাবতেই পারিনি এই বয়সে মাঠে নামব! মনে হচ্ছে বয়সটা দশ বছর কমে গেল! এসব ছোটোখাটো আঘাত এসব আনন্দের কাছে কিছুই নয়। বুঝবে, বুঝবে, আমাদের বয়সে এসো, এসবের মর্ম বুঝবে
জনার্দনবাবু অনেকক্ষণ চুপ ছিলেন, এবার বলে উঠলেন, “তবে একটা ব্যাপার কিন্তু বলতেই হবে! আমার ভবিষ্যৎ বাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে। আমি বলেছিলাম খেলা ড্র হবে। ড্র হয়েছে!” তার চোখে-মুখে গর্ববোধ আর আনন্দের ঝিলিক।
“ভুল! খেলা ড্র হয়নি,” বললেন হারুখুড়ো, “আমাদের আজকের খেলাটা ছিল আসল বয়সের সঙ্গে মনের বয়সের আর আমরা যা খেলেছি তাতে মনের বয়স আমাদের আসল বয়সকে গুনে গুনে দশ গোলে হারিয়েছে। ঠিক কিনা?
সবাই বলল, “ঠিক! ঠিক! ঠিক!”
তারকবাবু এবার বললেন, “সত্যি! কী অসাধারণ বললেন হারুবাবু! এরকম নেক্সট বছরেও করতে হবে। নেক্সট বছর কেন? আমার তো আর তর সইছে না! কালকেই আবার মাঠে নামতে ইচ্ছে করছে, এবার অবশ্য জনার্দনবাবুকেও খেলতে হবে! কী জনার্দনবাবু? রাজি তো?
জনার্দনবাবু শিউরে উঠে দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে বললেন, “রক্ষা করো বাবা তারক!” এই বলে পাশ ফিরে শুলেন। দ্বিতীয়বারের জন্য অজ্ঞান হলেন বোধহয়!
_________
ছবি – সুজাতা চ্যাটার্জী

No comments:

Post a Comment