কুহু ডাকা ডাকাত
অঙ্কন মুখোপাধ্যায়
“পদ্মা পাড়ের নীলগঞ্জের নাম এখন আর কেউই বিশেষ জানেন না। আর জানবেনই বা কী করে, যে সময়ের কথা বলতে বসেছি সেই সময়কালটা আমরা পেরিয়ে
এসেছি অনেক যুগ আগেই। আর ওই
নীলগঞ্জের অন্তিম অস্তিত্বটাও বোধহয় আজ বিলুপ্ত হতে বসেছে মা পদ্মার গর্ভে।”
এই পর্যন্ত বলে ধীরেনবাবু থামলেন।
ধীরেনবাবু আমার সামনের ফ্ল্যাটের একজন বহু পুরোনো বাসিন্দা।
প্রতি সন্ধ্যায় আমার ফ্ল্যাটের সান্ধ্য আসরে অ্যাপার্টমেন্টের আরও দু’জনের মতো ধীরেনবাবুও আসেন সময় কাটাতে। বয়সের দিক দিয়ে উনি আমার পিতৃস্থানীয়। সম্পূর্ণ নাম ধীরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। পুলিশের
উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন উনি। রিটায়ার করার পর বালিগঞ্জ সার্কুলার
রোডের এই অ্যাপার্টমেন্টের একটা ফ্ল্যাটেই বর্তমানে থাকেন নিঃসন্তান দম্পতি।
সন্ধ্যার সময় আমার ফ্ল্যাটেই বসে প্রতি সন্ধ্যার আডডা। আজকে কথায় কথায় ওনার কর্মজীবনের নানান ঘটনাবহুল স্মৃতিকথা বলতে গিয়েই
উঠে এল ওনার জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর একটি ঘটনা, যে ঘটনা নাকি ওনার জীবনেও এনে দিয়েছিল আশ্চর্যকর এক অমূল পরিবর্তন! উনি নিজেই বললেন, “এ ঘটনা
আমার জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা বলতে পার, তবে এই ঘটনার কারণে আমি আমার
জীবনের অতি মূল্যবান সম্পদের অধিকারী হয়েছি এতে কোনো সন্দেহ নেই। তোমরা শুনলে
হয়তো অবাক হবে, সেই অতি মূল্যবান সম্পদটির...”
একটু থেমে গিয়ে কী যেন ভেবে নিয়ে বললেন, “না থাক,
গল্পটাই তোমাদের প্রথম থেকে বলি বরং আগে।” চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে, সামনের
টেবিলে কাপটা নামিয়ে রেখে ধীরেনবাবু শুরু করলেন।
“মূল ঘটনা থেকে ডিপার্টমেন্টের বিভিন্ন খুঁটিনাটি কর্মপরিকল্পনা
আর বেশ কিছু অবাঞ্ছিত মেদ বাদ দিয়ে, যেমনভাবে গল্পের আকারে শুরু করেছিলাম, তেমনভাবেই আমি সবটা তুলে ধরছি তোমাদের কাছে।
তাতে তোমাদের বুঝতে খানিক সুবিধেই হবে। শোনো...
পদ্মাপাড়ের ওই নীলগঞ্জে সে সময় কুহু ডাকাত নামের একটি ডাকাত দলের
বাড়বাড়ন্তে আশেপাশের গ্ৰামজীবন অতি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। খুন, রাহাজানি, লুটতরাজ নীলগঞ্জের নিত্য ঘটনা হয়ে উঠেছিল তখন।
বলতে গেলে সারা নীলগঞ্জ এলাকা জুড়ে চরম অরাজকতা সৃষ্টি
করেছিল ওই কুহু ডাকাতের দল। দিনেমানে
যে এলাকা থাকত শান্ত সরল আর পাঁচটা অঞ্চলের মতো, সূর্য ডুবলেই বদলে যেত তার চেহারা। যার মূল কারণ ছিল ওই কুহু ডাকা ডাকাত! শোনা যায়, অদ্ভুত এক ভয়ংকর কুকি
দিতে দিতে ডাকাতি করতে যেত ডাকাত দল। সেই
কুকির ডাকে প্রাণ কাঁপত সকলের, এমনই
ভয়ানক সেই কুকির ডাক! দূর দূর থেকে কুকি আওয়াজ
শুনেই ঘরের ভিতর থেকে ভয়ে দোর আঁটত সকলে। যেন কুকি
নয়, এক পাল বন্য শৃগাল জঙ্গল ছেড়ে শিকারের খোঁজে বেরিয়েছে এক পেট খিদে নিয়ে!
তাদের সেই পেট পেট খিদে না মেটা অবধি ডাকাতরা শান্ত হবে না। ওদের ওই বিশেষ ভয়ংকর
কুকির কারণেই বোধহয় নাম হয়েছিল কুহু ডাকা ডাকাত! প্রায় প্রতি মাসেই এক একটা
ভয়ংকর অমাবস্যার রাতে কোনো না কোনো গৃহস্থের বাড়িতে কুহু ডাকাতের দল হানা দিয়ে ছারখার করে দিত গৃহস্থালির
সব কিছু। হাতের কাছে যা পেত লুঠ করত। আর ডাকাতির
সময় কেউ বাধা দিতে এলে করত খুন। খড়্গ দিয়ে গলা এক কোপে কেটে, কিংবা
শাণিত তলোয়ারের ঘায়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিত বাধাদানকারীর শরীর।
কুহু ডাকাতদের হাত থেকে কেউ রেহাই পেত না। সেই ভয়েই
এলাকাবাসীর শান্তিতে রাত কাটানো হয়ে উঠেছিল একপ্রকার দুর্বিষহ।
তবে গ্ৰামের কোনো গরিব মানুষের বাড়িতে কোনোদিন কুহু
ডাকা ডাকাতরা ডাকাতি করতে গেছে তা শোনা যায়নি।
ওদের মূল লক্ষ্যই ছিল জমিদার, জোতদার, আড়তদারদের মতন বিত্তবান ব্যক্তিবর্গ। কিন্তু শত চেষ্টার পরেও সেই কুহু ডাকা ডাকাতের দলকে কখনও বাগে আনতে পারেনি ওই সকল জমিদার, আড়তদারেরা। অদ্ভুতভাবেই এই ধনপতিদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রতিবারই বিফলে যেত। পুলিশও নাজেহাল হয়ে পড়েছিল কুহু ডাকা ডাকাতদের দৌরাত্ম্যে।
এর একটা বড়ো কারণ
অনুমান করা যায়, কুহু ডাকা ডাকাতরা অঞ্চলের গরিব মানুষের সমর্থন পেত। বাগদি, হাড়ি, ডোম, গরিব
মুসলমান জাতির অনেক সাহসী লোকের নাকি অসাধু জোট ছিল ওই কুহু ডাকা ডাকাত দলের
সঙ্গে। তবে ওই ডাকাত দলের সর্দার যে কে, সেই আসল মাথাটির খোঁজ কোনোভাবেই জানতে
পারা যেত না। শোনা যেত, বামুন
জাতির কোনো এক বুদ্ধিধর নাকি গোপনে থেকে পরিচালনা করত গোটা দলটাকে। পুলিশের কাছে এত খবর থাকা সত্ত্বেও যখন বারে বারে ডাকাতি হচ্ছিল, তখন পুলিশের উপর মহলে জোরালো অভিযোগ যাচ্ছিল অঞ্চলের
ধনপতিদের কাছ থেকে। তারপর পুলিশের উপর মহল বিশেষ নজর দিতে এক প্রকার বাধ্যই হল এই
নীলগঞ্জের উপর। পুলিশের দিক থেকে শুরু হল
নতুনভাবে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে কুহু ডাকা ডাকাত দমনের বিশেষ উদ্যোগ। তবে দমন নীতির সবটাই চলল অত্যন্ত গোপনে। পূর্বে বারংবার বিফল হওয়ার কারণে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছিল
পুলিশের দিক থেকে।
কাছারিবাড়িতে দশরথী ঘটক পা দিতেই রায়মঙ্গল বটব্যাল মুখ থেকে আলবোলার নলটা
নামিয়ে রেখে বলল, “আরে ভীমরতি ঘটক যে।
এসো এসো...”
রায়মঙ্গল বটব্যালের কথা শুনে কাছারির বাকি সকলে হেসে উঠল একবার।
“অজ্ঞে ভীমরতি না কর্তামশাই। কতবার বলেছি আপনাকে দ-শ-র-থী.... দশরথী ঘটক,” দশরথীর উপর একটু বেশি জোর দিয়ে বলল সে, তারপর ভিতরে ঢুকে এসে প্রণামের ভঙ্গিতে দু’হাত মাথায় ঠেকাল দশরথী ঘটক। আলবোলার
নলে গুড়গুড় শব্দে বারদুয়েক টান দিয়ে খানিক তাচ্ছিল্যের সুরেই রায়মঙ্গল
বটব্যাল বলল, “বল, কী খবর এনেছ?”
“আজ্ঞে এবারে একেবারে সুপাত্র জোগাড় করেছি কর্তা।”
“তোমার সুপাত্রদের আমার ভালো করেই জানা আছে ভীমরতি ঘটক। এতদিনেও আমার মেয়ের উপযুক্ত একটি সঠিক পাত্র জোগাড় করতে পারলে না। রঞ্জা আমার একমাত্র মেয়ে। এত বড়ো বংশের একমাত্র উত্তরাধিকারী। ভাই
সুমঙ্গল বাউন্ডুলেপনা করে কাটিয়ে দিল সারা জীবনটা। বিয়ে-থা পর্যন্ত করল না... তাই তো আমাদের ইচ্ছে রঞ্জার যে স্বামী হবে তাকে
এই নীলগঞ্জেই রেখে দেব ঘরজামাই করে। কতবার বলেছি সে কথা তোমাকে... তবু একটা
উপযুক্ত পাত্রের খোঁজ তুমি দিতে পারলে না। সাধে কি
তোমাকে ভীমরতি ঘটক বলি আমি... হুঁ।”
“না না কর্তা, এবারে একেবারে আপনার মনমতো পাত্র এনেছি। আপনি যেমন চাইছেন একেবারে
তাই।”
“পেলে কোথায়?”
“আজ্ঞে কলকেতায় বাড়ি পাত্রের।”
“কলকেতা? সে তো অনেক দূর!”
“আজ্ঞে বাড়ি বলতে মামার বাড়ি। ছোটোবেলায় মা-বাপ হারিয়েছে কিনা, তাই। শুনেছি
পাবনার দিকেই কোন গ্ৰামে বাড়ি ছিল... তারপর
মা-বাপ মরতে মামার বাড়িতে উঠে যায়।”
“আঃ,” আবার
একটু থেমে নল মুখে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে রায়মঙ্গল বলল, “তা জাতের হবে তো, নাকি? শুনেছি কলকেতা এক মেলেচ্ছ নগরী। ওখানে জাত-বেজাতের মানামানির কোনো বালাই
নেই। ওখানে কুকুর শিয়াল মানুষ সব এক ভাগাড়ে খায়।
দ্যাখো, আবার
আমার জাত খোয়াওনি বাবা।”
“তাহলে আর কী ঘটকালি করলাম কর্তা এতদিনে। আপনাদের কি আমি জাত মারতে পারি? ওসব নিয়ে ভাববেন না একদম, পাত্রের মামা
তিন বেলা জপ-আহ্নিক করা সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ। বাড়িতে
প্রতিষ্ঠিত রাধামাধবের অষ্টধাতুর বিগ্ৰহ আছে। নিজের হাতে তাঁর পুজো না করে জলস্পর্শ পর্যন্ত করেন না তিনি।”
“সে না হয় হল, কিন্তু পাত্রটির কি তেমনি
মতি?”
“শাস্ত্রেই আছে কর্তা ‘নরানাং
মাতুলক্রম’... সে
ব্যাপারে চিন্তা করতে হবে না আপনাকে।”
“আমার সব শর্তের কথা তাদের বলেছ তো? ঘরজামাই থাকার ব্যাপারে তাদের কী মত?”
“ওখানেই তো সুবিধা কর্তা। পাত্র মামার সঙ্গে পুজো-আর্চা নিয়েই থাকে, নিজের
বলতে কিছুই নেই তার... মামার
সংসারের গলগ্ৰহ।”
“মানে পাত্রটি একটি অকালকুষ্মাণ্ড?”
“আজ্ঞে, আপনার যে তেমনি ফরমায়েশ কর্তা...”
“বাঁচাও, বাঁচাও রায়মঙ্গল বাঁচাও!” ঠিক এই সময় প্রায় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে রায়মঙ্গল বটব্যালের
কাছারিবাড়িতে ঢুকল নকুড় আড়তদার। সদরের বড়ো বাজারে নকুড়বাবুর ধান চালের আড়ত আছে। কত ধানে কত চাল হয় তার মোটা
হিসেব কষতে এই নকুড়বাবুর জুড়ি মেলা ভার। সেই বারো
ঘাটের জল খাওয়া নকুড় আড়তদারের এমন নাজেহাল অবস্থা দেখে কাছারির সকলে হতভম্ব হয়ে পড়ল। কেউ বলল, “নকুড়বাবু, বস দিকি আগে একটু স্থিতিয়ে।” কেউ বলল, “ঠান্ডা জল আনাই, আগে শীতল হও।” কেউ বা
বলল, “পাখার বাতাস করি দাঁড়াও।”
সবার শেষে রায়মঙ্গল বলল, “কী হয়েছে নকুড়? তোমার এমন হাল কেন?” নকুড় আড়তদার পাখার বাতাসে বসে, ঠান্ডা জল
কোনোরকমে গলায় ঢেলে আবার সেই আগের মতোই কেঁদে উঠল, “আমাকে
বাঁচাও রায়মঙ্গল, আমাকে বাঁচাও...”
“আরে আরে কী মুশকিল! বলবে তো নাকি, কী ব্যাপার
আগে বলো?”
“একখানা চিঠি রায়মঙ্গল। আমার প্রাণ কেড়েছে।”
“চিঠি! কার চিঠি?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করল রায়মঙ্গল।
ঢোঁক গিলে কোনোরকমে নকুড় বলল, “ওই রাত কোকিলদের চিঠি এসেছে
রায়মঙ্গল আমার কাছে। আমি মরে
যাব, আমাকে বাঁচাও...”
“কুহু ডাকা ডাকাত?”
রায়মঙ্গলের কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল নকুড় আড়তদার।
“দেখি চিঠিখানা। আছে সঙ্গে?”
নকুড় সঙ্গে করে আনা কোমরে গোঁজা ফালি
কাগজটা এগিয়ে দিল রায়মঙ্গলের দিকে। রায়মঙ্গলের
মতো কাছারির বাকি সকলের মুখও থমথমে। হাতের
নলটা পাশে নামিয়ে রেখে ফালি কাগজে লেখা চিঠিটা পড়তে লাগল রায়মঙ্গল। চিঠি না বলে চিরকুট বলা ভালো।
বাবু নকুড় সামন্ত,
ভুয়ো হিসেব কষে অনেক তো গরিব মানুষ ঠকালে, ভুয়ো রশিদের জোরে গরিবের পেটের চাল নিজের পেটে পুরলে। এবার বাটখারাগুলো সোজা করে একটু
সঠিক হিসেব মেলাও। সামনের অমাবস্যায় আমরা
তোমার বাড়িতে আসছি, এতদিনের সব উলটো হিসেব
সোজা করতে। তৈরি হয়ে থেকো নকুড়বাবু।
ইতি
কুহু হু হু হা...
চিঠি পড়া শেষ হলে গম্ভীর গলায় রায়মঙ্গল জিজ্ঞেস করল, “অমাবস্যাটা কবে?”
দশরথী ঘটকের হাতে পঞ্জিকা থাকে সবসময়। সে চটপট পঞ্জিকা উলটেপালটে দেখে বলল, “অমাবস্যা যে দেখছি নকুড়বাবুর একেবারে ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে কর্তা। আজ বৃহস্পতিবার, কাল
শুক্রবার, পরশু শনিবার সন্ধ্যা ৭।৩৬ মিনিট গতে অমাবস্যা পড়ছে।”
দশরথী ঘটকের দিক থেকে চোখ সরিয়ে রায়মঙ্গলের উপর ফেলে নকুড়বাবু প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “রায়মঙ্গল, এখন উপায়?”
“উপায় আর কী,
মহাভোজের আয়োজন করো নিশিকুটুম্বদের জন্য। তোমরা তো আর আমার কথা
শুনবে না, কতবার বলেছি, নকুড় পাল্লা বড় বেশি ভারী করে ফেলছ হে। একটু
সামলে। শুনেছ তখন?”
“রায়মঙ্গল!”
“তাছাড়া কী বলি বল, ধনের থেকে তোমার প্রাণটা যে আগে।
থানার দারোগাগুলো সব হয়েছে অকম্মা। এত চিঠি, এত কিছু
বন্দোবস্ত সব বিফলে যাচ্ছে একটার পর একটা... বলে কিনা উপর মহল থেকে এবার জবরদস্ত
ব্যবস্থা হচ্ছে। ডাকাত ধরা পড়বেই, যত সব।”
“কর্তা, তাহলে আপনার সুপাত্রর কি...?” দশরথী ঘটক কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তাকে পাত্তা না দিয়েই রায়মঙ্গল হাঁক ছাড়ল, “ওহে সুমঙ্গল?”
কাছারিবাড়ির পাশ দিয়ে রায়মঙ্গলের ভাই সুমঙ্গল হেঁটে ভিতর বাড়ি থেকে
বাইরে যাচ্ছিল এইসময় ছিপ হাতে করে মাছ ধরতে। দাদার ডাক শুনে ঘুরে কাছারিবাড়ির মধ্যে ঢুকে এল সুমঙ্গল। রায়মঙ্গলের সামনে এসে বলল, “আমাকে
ডাকছিলে দাদা?”
“চললি কোথায়?”
“এই যে কাঁধে ছিপ আর এই যে হাতে পিঁপড়ের ডিমের চার।
চললাম পদ্মায়। আর কিছু বলার থাকলে বলে ফেল দাদা, ওদিকে অপেক্ষা করে আছে সবাই আমার জন্য।”
“সব মানে, ওই ছোটোলোকগুলো? তোকে না কতবার বলেছি ওই সব ছোটোলোকদের সঙ্গে বাউণ্ডুলেপনা না করে কাছারিতে বস...”
দৃঢ় স্বরে বলল সুমঙ্গল, “ওদের ছোটোলোক কারা করেছে দাদা?” পরমুহূর্তেই আগের মতো নরম গলায় বলল, “এই সব কাছারি-টাছারি, জমিদারি
আমার ভালো লাগে না দাদা একটুও। এই সব আমার কাজ নয়। তুমিই
বরং দেখ দাদা যেমন দেখছ, আমি যাই মাছ ধরিতে। কী বলেন নকুড়বাবু?”
“মানে? মা... মাছ?” নকুড় আড়তদার আমতা আমতা করে সুমঙ্গলের
কাব্যিক কথা শুনে।
“হ্যাঁ মাছ, বড়ো বড়ো সব মাছ ধরার ব্যবস্থাই যে করছি। এই দেখুন না ছিপ, চার সব তৈরি। ওদিকে ওরাও তৈরি। এখন শুধু মাছ ধরার অপেক্ষা।”
তারপরই শিষ দিতে দিতে চলে গেল সুমঙ্গল।
“রায়মঙ্গল, কী বলে গেল তোমার ভাইটি?”
“ওর কথা কে ধরে, পাগল একটা। ঘরের
খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো ওর কাজ।”
“কিন্তু এখন আমি কী করব রায়মঙ্গল?”
“শোনো নকুড়,
ধন গেলে ধন আবার আসবে, কিন্তু প্রাণ গেলে যে সব যাবে... তাই যা বললাম সেটাই করো। ওদের সঙ্গে লড়তে যাওয়া একপ্রকার মুর্খামি। কমলাবাটির শেখর হালদারের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই তোমাদের, ব্যাটাদের সঙ্গে ক্ষমতা দেখাতে গিয়ে শেষে প্রাণটা দিতে হল। তুমিও কি তাই চাও?”
“হ্যাঁ, পরদিন বাড়ির পিছনের একটা গাছে
শেখর হালদারের ঝুলন্ত মৃতদেহ পাওয়া গেছিল। ডাকাতরা
মেরে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিয়ে গেছিল।” পাশ থেকে একজন বলল রায়মঙ্গলের কথা শুনে।
“অরাজকতার কাল, তাই বলছি নকুড়, সাবধানে কাজ করো।”
রায়মঙ্গলের কথা শুনে বাকি সকলের যেন হতোদ্যম অবস্থা।
প্রাণ যাওয়ার কথা উঠতেই নকুড় আড়তদার গুটিয়ে গেছে ভয়ে।
“আচ্ছা বেশ!” বলে উঠে পড়ল নকুড় আড়তদার তখনকার মতো, কিন্তু অত
সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার মানুষ নকুড় আড়তদার নয়।
তার বাইরে এক, ভিতরে আর এক। সারাজীবনের সঞ্চয় কিনা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ডাকাতের হাতে তুলে দেবে! মনে মনে ভাবল, ‘কিছু ব্যবস্থা করতেই হবে।’ কিন্তু মুখে বলল, “তবে তাই
হোক। আমি এখন আসি রায়মঙ্গল, বুঝলে।”
নকুড় আড়তদার হলেও ওর নিজের পোষা লাঠিয়াল বাহিনী ছিল। দশজন লাঠিয়াল সবসময় নকুড়ের বাড়ির
সামনের খামারে বন্ বন্ করে লাঠি কাঁপাত বাতাসে। সেই দশজন লাঠিয়াল যখন একসঙ্গে লাঠি
হাতে কসরত করত, তখন হাজার ভ্রমরের গুঞ্জন উঠত নকুড় আড়তদারের খামার বাড়ি থেকে। আর ছিল
দু’জন মারাঠা বরকন্দাজ। সব সময় বন্দুক ঘাড়ে পাহারা দিত নকুড় আড়তদারের বাড়ির সদরে বসে।
রায়মঙ্গলের কাছারি থেকে ফিরে নকুড় আড়তদার নিজের পালঙ্কে শুয়ে শুয়ে ভাবছিল।
দুপুরের রোদ জানালা গলে এসে পড়েছে নকুড় আড়তদারের পায়ের কাছে। রোজ দুপুরে
খাওয়ার পর একটা লম্বা ভাতঘুম দেওয়া অভ্যাস হলেও আজ আর চিন্তায় চিন্তায় ঘুম আসছিল
না কিছুতেই। এই সময় দরজায় এসে দাঁড়াল বাবলা
লাঠিয়াল।
“কর্তা আমারে স্মরণ করেছেন? নন্দুর মা খবর দিল।”
বালিশের উপর ঠেস দিয়ে উঠে বসল নকুর, “বলি তোরা কী করতে আছিস শুনি?”
“কেন কর্তা?”
“বাড়িতে যে এত বড়ো অঘটন
ঘটতে চলেছে, সে খবর রেখেছিস কিছু?”
“অঘটন!”
এরপর নকুড় কুহু ডাকাতের চিঠি আসা থেকে
রায়মঙ্গলের সাবধানবার্তা কিছু কিছু বলল বাবলা লাঠিয়ালকে। সব কিছু শুনতে শুনতে বাবলা
লাঠিয়ালের শরীর ফুলতে লাগল রাগে। সাপের মতো ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস পড়তে লাগল ওর মোটা নাক দিয়ে।
“তোদের কি বাতাসের সঙ্গে লাঠি
খেলার জন্য পুষছি বাবলা? তোরা থাকতে শেষে আমার সব কিছু কি ওই ডাকাতের হাতে তুলে
দিতে হবে?”
“এ কী বলছেন কর্তা! আপনি আমাদের মনিব, আপনার
খেয়ে লাঠিতে হাত দিই।
ভাববেন না কর্তা। আমরা আছি দশজন। দশদিক থেকে এ বাড়ি ঘিরে রাখব। দেখি ওই
কুহু ডাকা ডাকাত আমাদের ডিঙিয়ে কী করে
ঢোকে এই বাড়িতে।”
“দারোগায় আমার বিশ্বাস নেই।
রায়মঙ্গল বললে ওদের ওপর মহল থেকে নাকি মস্ত ব্যবস্থা করছে ডাকাত ধরার, সব ভাঁওতা।
ওই তো এক টিংটিঙে সনাতন দারোগা আর তার দুটো তালপাতার সেপাই। কুহু ডাকাতের দল ওদের কানে একবার কুকি দিলে প্রাণত্যাগ করবে, ওরা কিনা নেবে ব্যবস্থা! ছো ছো! তোরাই আমার বল এখন। দেখিস বাবলা, তোরা আমার নুন খাচ্ছিস। নুনের মান রাখিস বাবা। ওই রায়মঙ্গলকেও দেখিয়ে দিতে চাই আমার ক্ষমতাখানা।
তুমি এই নীলগঞ্জের জমিদারের বংশধর হতে পার, তবে আমিও
তোমার চেয়ে কোনো অংশে কম না।”
ধীরেনবাবুকে থামিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তার মানে রায়মঙ্গলকে ছাপিয়ে যাওয়ার একটা সুপ্ত বাসনা নকুড় আড়তদারের মধ্যে আগে থেকেই ছিল
বলছেন?”
ধীরেনবাবু বললেন, “হ্যাঁ,
আসলে গ্ৰামবাঙলার মানুষকে আমরা যতটা সহজ সরল ভাবি বাস্তবে কিন্তু তেমনটি হয় না। গ্ৰামের
মানুষের মধ্যেও একটা ভয়ানক রেষারেষি আছে। সংকীর্ণতা, কুসংস্কার সেখানের মানুষকে
মহামারির মতন মেরে রেখেছে দীর্ঘদিন ধরে।
আর এই ঘটনা যে সময়ের তখন তো এইসবের মোক্ষম কাল বলা চলে।
নকুড় আড়তদার কালোবাজারি করে ধনে অনেক উপরে উঠলেও, মানের দিক থেকে রায়মঙ্গলের নিচেতেই
ছিল তার অবস্থান।”
“তাই সে রায়মঙ্গলের সাবধানবাণীর পরেও
কুহু ডাকা ডাকাত দলের সঙ্গে মোকাবিলা করতে প্রস্তুতি
নিচ্ছিল, যাতে কুহু ডাকাতকে কোনোভাবে ধরে
নীলগঞ্জের মানুষকে দেখিয়ে দিতে পারে ক্ষমতা আর বুদ্ধিতে সে জমিদারের থেকে ছোটো নয়। তাই তো?”
পাশের ফ্ল্যাটের ডাঃ সুবীর ভৌমিক বললেন।
“একদম ঠিক বলেছ সুবীর,” চায়ের
কাপে চুমুক দিলেন ধীরেনবাবু।
আমি বললাম, “তাহলে
বাবলা লাঠিয়ালই কি ওর লাঠি বাহিনী নিয়ে পরাস্ত করেছিল শেষ পর্যন্ত ওই ভয়ংকর
কুহু ডাকা ডাকাতদের?”
ধীরেনবাবু বললেন, “বাবলা
লাঠিয়ালের মনে সাহস আর শরীরে জোর দুটোই ছিল খুব বেশি। লড়েছিল শেষ পর্যন্ত কুহু ডাকাতদের সঙ্গে। যাকে বলে মরণপণ লড়াই।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। লাঠির আঘাতে মাথা ভেঙে গিয়েছিল ওর। আর বাবলা
লাঠিয়াল মরতেই কুহু ডাকা ডাকাত বন্যার জলের মতো ঢুকে পড়েছিল নকুড় আড়তদারের বাড়িতে। সদরের বরকন্দাজ দুটোকে আগেই ঘায়েল করেছিল। তাই কুহু ডাকাতদের সামনে আর কোনো বাধাই রইল না। লুটপাট করে শেষ করে দিয়েছিল সমুদয় জিনিস।”
“আর নকুড় আড়তদার, তার কী হল?”
ডাঃ সুবীর ভৌমিক জিজ্ঞেস করলেন আবার।
“ওই শেখর হালদারের যা হয়েছিল, বাড়ির সামনের জাম গাছে নকুড় আড়তদারের ঝুলন্ত দেহ দেখেছিল পরের
দিন সকালে এলাকাবাসী।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম এবার, “তারপর কী ঘটেছিল?”
ধীরেনবাবু আবার বলতে শুরু করলেন আগের মতো...
নকুড় আড়তদারের অমন ভয়ংকর পরিণতির পর নীলগঞ্জ কিছুদিনের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে রইল এক
আশঙ্কাকে বুকে নিয়ে। নীলগঞ্জ থানার সনাতন
দারোগা ক’দিন খানিক ছোটাছুটি, রিপোর্ট
লেখালেখি আর হাঁকডাক করে নিজের ভুঁড়ি কমানো ছাড়া আর বিশেষ কিছুই করতে পারলেন না।
তারপর দিন গেল, সপ্তাহ গেল, কয়েকটি মাসও পেরিয়ে গেল কোনোরকমে। তারপর এক সময় আশঙ্কায় নিমজ্জিত নীলগঞ্জ কিছুটা প্রাণ ফিরে পেল জমিদার
বাড়িতে বহুদিন পর আবার রোশনচৌকি
বসতে। দশরথী ঘটকের আনা মেলেচ্ছ নগরী
কলকেতার সেই অকালকুষ্মাণ্ড সুপাত্রটির সঙ্গেই রায়মঙ্গল বিয়ে দিলেন তার একমাত্র কন্যা রঞ্জার।
পদ্মা বেয়ে বড়ো বড়ো নৌকা চেপে কত অতিথি-অভ্যাগত এল, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে
থাকা কুটুম্বরা এল গরুর গাড়ি চেপে, এল
রায়মঙ্গলের পরিচিত দেশ বিদেশের কত গুণীজন। আর এল সুমঙ্গলের নিমন্ত্রিত পাঁচ গ্ৰামের গরিব মানুষ। রায়মঙ্গলের আপত্তি
থাকলেও সুমঙ্গলের জেদের কাছে তাকে হার মানতে হল শেষে।
“কেন দাদা? এত মানুষ আসছে ওরাই বা বাদ
থাকবে কেন? এককালে ওরাই তো আমাদের প্রজা ছিল।
এখন না হয় সেই সব পাট চুকেবুকে গেছে অনেকখানি। কিন্তু একমাত্র মেয়ের বিয়েতে ওদের আশীর্বাদটা নেবে না? আর বিয়ে মানেই তো সকলকে নিয়ে আনন্দ।
সেই আনন্দ থেকে তোমার এই কাছের মানুষগুলোকে বাদ দেবে
দাদা?”
“ছোটকা তো ঠিক বলেছে বাবা,
তুমি আর না কোরো না।”
রঞ্জা বলেছিল সুমঙ্গলের হাত ধরে।
“বেশ! যা ভালো হয় কর তোরা। কিন্তু বাড়ির ভিতরে যেন ছোটোলোকগুলো না ঢোকে। সব মান্যিগণ্যি লোকজন আসবে, তাদের সামনে আমার মানটা অন্তত বজায় রেখো।”
আর কথা বাড়ায়নি সুমঙ্গল। রায়মঙ্গল দেখেছিল উপর দিকটা, আর সুমঙ্গলের নজর ছিল নিচের দিকে। গ্ৰামের মানুষ পাত পেড়ে খেয়ে
গেল তিন দিন ধরে। কোনো কোনো প্রচীন বৃদ্ধা
আশির্বাদ করল কাঁপা কাঁপা শীর্ণকায় দুই বাহু তুলে, “তোমার মঙ্গল হোক বাবা। ভগবান তোমার মঙ্গল করুন।”
“আরে আরে বলছ কী বুড়িমা। এসব কি আমি করেছি নাকি গো, তোমাদের জন্য
এই সব ব্যবস্থা করেছেন তোমাদের জমিদার মশাই, মানে আমার দাদা রায়মঙ্গল বটব্যাল। দাদা
নিজেই আসতেন তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে, নেহাত ওদিকে
বিয়ের অনেক কাজ... আর কিছু লাগলে বলো বুড়িমা। কোনো লজ্জা করবে না একদম।”
মিহির ছেলেটিকে যতটা অপদার্থ মনে হয়েছিল, ততটা সে নয়। রায়মঙ্গল এমন একটি পাত্রই
রঞ্জার জন্য খুঁজছিল। যত দিন যেতে লাগল বাড়ির
সকলে একটু একটু করে বুঝতে পারল রায়মঙ্গল কোনো ভুল হাতে মেয়ে দেয়নি। মানুষ চেনার চোখ রায়মঙ্গলের চিরদিনই আছে।
রায়মঙ্গলও ক্রমে ক্রমে বুঝল, তার জামাতাটি একটু মুখচোরা
স্বভাবের হলেও, তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় সে প্রতি
কাজে দিচ্ছে। এই বংশের উপযুক্ত উত্তরসূরী
হওয়ার গুণ রয়েছে মিহিরের মধ্যে। ছোটোবেলায় মা-বাবাকে হারানোর কারণেই হয়তো ও একটু বেশি মুখচোরা হয়ে
উঠেছে। তা হলেও, মিহির ছেলেটি বেশ ভালো। কাছারিবাড়িতে নিত্যদিনের মতো বসে খাতাপত্র দেখছিল রায়মঙ্গল, ফাঁকে ফাঁকে
আলবোলার নলে দিচ্ছিল টান। পাশে নায়েব গোবিন্দপদ
দাঁড়িয়ে ছিল।
“হরিণডাঙ্গায় আমাদের এস্টেটের জমি নিয়ে চৌধুরীদের যে গোল বেঁধেছিল তার...”
“আজ্ঞে, হরিণডাঙ্গা এস্টেটের ঝামেলাটা মিটে গেছে কর্তা।”
রায়মঙ্গলের কথা শেষ হওয়ার আগেই পাশ থেকে বলে উঠল
নায়েব গোবিন্দপদ। রায়মঙ্গল আড়চোখে তার দিকে
তাকিয়ে বলল, “কীভাবে মিটল?”
“আজ্ঞে মিহিরবাবুই গত সপ্তাহে হরিণডাঙ্গায় গিয়ে সবটা মিটিয়ে এসেছেন।”
নায়েবের কথায় আর উত্তর না দিয়ে পাতা উলটে দিল রায়মঙ্গল। “গতবারের
ঝড়ে আমাদের যে দুটো নৌকার ক্ষতি হয়েছিল সেগুলো তো এখনও মেরামত করা হয়নি। রঞ্জার বিয়ের সময় কুমুদ আলির কাছে নৌকা ভাড়া নিয়ে কাজ চালানো হয়েছে। এবার ও দুটো মেরামতের ব্যবস্থা করতে হবে, কুমুদ
আলিকে খবর দাও।”
“আজ্ঞে কর্তা, তার আর দরকার নেই।
মিহিরবাবু আগেই ওগুলোর জন্য কুমুদ আলিকে বলে দিয়েছেন, কাজও শুরু হয়ে গেছে।”
এবার সরু দৃষ্টিতে নায়েবের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল রায়মঙ্গল। তারপর কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলল, “মিহিরকে
একবার খবর দাও তো গোবিন্দপদ।”
“উনি তো বাড়িতে নেই, বেরিয়েছেন।”
“কোথায় গেছে, জানো কিছু?”
“তা তো বলেননি। তবে মাঝে মাঝেই কোথায় যেন বেরিয়ে যান। জিজ্ঞেস করলে বলেন, গ্ৰাম দেখতে
গেছিলাম।”
“গ্ৰাম দেখতে! গ্ৰামে আবার নতুন করে দেখার কী আছে?”
“শহরের মানুষ তো, গ্ৰামের ধুলোকেও সোনা মনে করেন।”
“ঠিক আছে। এলে বোলো আমার সঙ্গে
দেখা করতে একবার।”
পদ্মা থেকে বেরোনো একটি খাল বয়ে গেছে পূর্ব দিকে, যেদিকে শুরু হচ্ছে গুমছাগাছার জঙ্গল। গুমছাগাছা নীলগঞ্জের পূর্ব সীমানা। তারপর শুরু হচ্ছে মানিকগঞ্জ। নীলগঞ্জ আর মানিকগঞ্জকে ভাগ করে রেখেছে গুমছাগাছার নিবিড় অরণ্যের প্রাচীন
গাছগাছালির দঙ্গল। পদ্মা থেকে যে খাল বয়ে
গেছে মানিকগঞ্জের দিকে সেই খালেরই এক গোপন স্থানে এই অরণ্যের অনেক গভীরে রয়েছে পাষাণী
কালীর মন্দির। মন্দির বলতে, অতি
বৃদ্ধ এক বটবৃক্ষ মাত্র। বহু ঝুরি, ডাল, পাতা বিস্তৃত সেই বটগাছের ছায়াতলের অন্ধকারাচ্ছন্ন
মাটির বেদির উপর পোঁতা মোটা কালো নোড়াটিই পূজিত হন পাষাণী কালী হিসেবে। আর পুজো
করে কুহু ডাকা ডাকাত দলের সেই বুদ্ধিধর ব্রাহ্মণ সর্দারটি। সাধারণ মানুষ তাই ভয়ে পা রাখে না গুমছাগাছা জঙ্গলের দিকে। প্রাণের মায়া যে সকলেরই সমান, তা সে গরিব হোক আর বড়োলোক। কিন্তু রায়মঙ্গল
বটব্যালের জামাইটির কী প্রাণের কোনো মায়া নেই? সে কীসের টানে এমন খাঁ খাঁ দুপুরে নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো গিয়েছিল
গুমছাগাছার ভয়ংকর ওই জঙ্গলের দিকে? ওখানে যাওয়ার কী ছিল তার অভিসন্ধি, তা কেউ জানে না। নদীর
খাল ধরে ফিরে আসার পথেই দেখা হয়ে গেল রঞ্জার ছোটকা সুমঙ্গলের সঙ্গে। হাতে একটা খাঁচা। তাতে ধরা রয়েছে বেশ বড়ো আকারের কালো রঙের একটা কোকিল। সঙ্গে আরও দুটো গ্ৰাম্য লোক। সুমঙ্গল
আর মিহির, দু’জনেই দু’জনকে হঠাৎ দেখে যে খুব অবাক হয়েছে, তা দু’জনের চোখের চাহনিতেই বেশ স্পষ্টভাবে
ফুটে উঠেছে।
“এ কী ছোটোকাকু! এত পাখি থাকতে শেষে ওই কোকিলখানা শিকার করলেন বুঝি?” মিহিরই প্রথম কথা বলল নীরবতা ভেঙে।
“তা পাখি ধরাও একধরনের শিকার বই-কি।
আর কোকিল আমার খুব প্রিয়। ছোটো থেকেই কোকিল পুষি। তোমার আর রঞ্জার বিয়ের সময় কোন এক ফাঁকে আমার আগের কোকিলটা উড়ে গেছে। তাই নতুন একটা.... কিন্তু তুমি ওদিকে গিয়েছিলে কোথায় মিহির?”
“কাজকর্ম বলতে বিশেষ কিছু তো নেই, তাই ঘুরতে ঘুরতে গিয়েছিলাম ওই জঙ্গলের দিকে।”
“গুমছাগাছার জঙ্গলে ঘুরতে গিয়েছিলে? সর্বনাশ!”
“হ্যাঁ, কেন ছোটোকাকু?”
“করেছ কী! ওই
জঙ্গলে আবার মানুষ যায় নাকি! শোনোনি
ও জঙ্গলে কাদের বাস?”
“কাদের বাস ছোটোকাকু?”
সুমঙ্গল একবার পাশের লোক দুটোর দিকে তাকিয়ে নিয়ে নিচু স্বরে বলল, “কুহু ডাকাতদের শক্ত ঘাঁটি ও জঙ্গল! বড়ো ভয়ংকর
ওরা। আর তুমি কিনা...! চলো চলো বাড়ি চলো শিগগিরই।”
“শুনেছিলাম একটা মন্দির আছে জঙ্গলের মধ্যে। কিন্তু...!”
“দেখতে পাওনি তো? দেখতে পাওয়া যায় না, কোনো এক গোপন স্থানে রয়েছে
ডাকাতদের সে মন্দির। হদিস
পাওয়া মুশকিল। চলো এবার।”
তারপর পাশের লোক দুটোকে বিদেয় দিয়ে মিহিরকে আর সঙ্গের সেই খাঁচাবন্দি
কোকিলটাকে নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল সুমঙ্গল। খালের দু’পাড় দিয়ে উঁচু রাস্তা।
দু’ধারের
সবুজ মাঠ দিগন্তে গিয়ে মিশেছে। দূরে
দূরে দেখা যায় ছোটো ছোটো বাড়ি-ঘর নিশ্চুপভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে শীতল গাছের ছায়ায়। আর পিছনে ফেলে আসা গুমছাগাছার নিবিড় অরণ্য।
“আচ্ছা ছোটোকাকু, এই নীলগঞ্জের কুহু ডাকা
ডাকাতরা কি খুব ভয়ংকর?”
“সবাই তো বলে।”
“সবাই বলতে?”
“জমিদার, আড়তদার, ব্যাবসাদারদের মতো বড়োলোক
শ্রেণীর মানুষেরা।”
“আর গরিব মানুষেরা?”
“ওরা তো জমিদারদেরও ভয় পায়, ব্যাবসাদারেরাও ওদের ঠকায়... কী আর বলবে ওরা!”
“তা বটে।” আবার
নিশ্চুপ হয়ে পাশাপাশি হাঁটতে থাকে দু’জনে।
“আপনার কী ধারণা?”
“কীসের ব্যাপারে?”
“ওই কুহু ডাকা ডাকাত দলের ব্যাপারে আপনার ধারণাটা কী?”
সুমঙ্গল থমকে দাঁড়িয়ে তাকাল মিহিরের চোখের দিকে। কিছুক্ষণ দেখে আবার হাঁটতে শুরু করল, “আমার একটাই ধারণা –
‘কর্মানুযায়ী ফল লাভ’।
যে যেমন কর্ম করবে, তাকে তেমন ফল পেতে হবে। হিসেব কষে কষে।”
কিছুদূর যাওয়ার পর বাঁধের রাস্তা ছেড়ে ওরা নেমে গেল গ্ৰামের পথের দিকে। আরও কিছুদূর গিয়ে গোকুল দিঘি। গোকুল দিঘির ওপারে গাছের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে জমিদার বাড়ির একেবারে
মাথায় অবস্থিত বহু পুরোনো অচল হয়ে পড়ে থাকা বড়ো ঘড়িটা।
‘কুহুউ... কুহুউ... কুহুউ...’
ডাকটা অনেকক্ষণ ধরে কানে আসছিল মিহিরের। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল বোধহয় স্বপ্ন। কিন্তু না, স্বপ্ন নয়। সত্যিই ডাকটা ভেসে বেড়াচ্ছে এই মাঝরাতে। এবার ঘুম ভেঙে মিহির উঠে বসল
বিছানায়। ঘরের বাতিটা অনেক আগেই নিভে গেছে।
কিন্তু জানালা দিয়ে বাইরের চাঁদের আলো এসে ঘরটাকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে ডুবে যেতে
দেয়নি। মিহির খোলা জানালা দিয়ে
বাইরে তাকাল। তারপর উঠে গিয়ে দাঁড়াল জানালার
পাশে। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কাঁধে রঞ্জার হাতের স্পর্শ পেয়ে ঘুরে দাঁড়াল
মিহির।
“কী হল ঘুমোওনি যে?”
“এত রাতে কোকিল কোথায় ডাকে বল তো রঞ্জা? তুমি শোনোনি?”
“শুনব না কেন। সেই ছোটো থেকেই শুনছি।”
“ছোটো থেকে শুনছ! মানে?”
“মানে সবটাই ছোটকার শখ। যে পাখি কেউ সচরাচর পোষে না, সেই
বসন্তের কোকিলকে পুষে রাখা সারা বছরের জন্য। এ তারই ডাক। তাই গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ সব কালেই এ বাড়িতে
বসন্তের কোকিল ডাকে। আর কতবার যে খোলা খাঁচার
সু্যোগ নিয়ে পালিয়ে যায়, তার ঠিক নেই। বার বার পালায় আর ছোটকা জঙ্গল থেকে আবার নতুন কোকিল ধরে আনে। ও পাখি যে পোষ মানে না...”
রঞ্জার কথা শুনে মিহিরের মনে পড়ে গেল ছোটোকাকুর হাতে দেখা সকালের সেই খাঁচাবন্দি কোকিলটার কথা। রঞ্জা বলে চলেছে, “এই তো আমাদের বিয়ের সময় আগের কোকিলটা উড়ে গেছিল, তাই
বোধহয় আবার একটা নতুন কোকিলের আগমন ঘটেছে। তোমাকে একটু সহ্য করতে হবে বাপু এই রাত-কোকিলের ডাক। ক’দিন যাক, দেখবে আমাদের মতো তোমারও অভ্যাস
হয়ে গেছে। নাও শুয়ে পড় এবার। আমার ঘুম পাচ্ছে খুব।”
“হুম।”
'কুহুউ... কুহুউ... কুহুউ...'
ডাকটা শুনতে শুনতেই মিহির গিয়ে শুয়ে পড়ল নিজের বিছানায়।
এইভাবে বেশ কয়েকটি দিন ও রাত পার হয়ে গেল পদ্মাপারের নীলগঞ্জে। এর মাঝেই মিহিরকে একবার যেতে হয়েছিল কলকাতায় মামার বাড়িতে। চিঠি এসেছিল মামার বাড়ি
থেকে মামার শরীর খারাপের খবর নিয়ে। এতদিন
মামার কাছে মানুষ হয়েছে সে, তারও যে একটা দায়িত্ব কর্তব্য আছে মামার বাড়ির প্রতি, সেখানকার মানুষজনের প্রতি। তাই
রঞ্জার বাবাও আপত্তি করেনি। এ কথায়
রাজি হয়ে যায়। সঙ্গে কিছু লোক পাঠানোর কথাও
বলেছিল জামাইয়ের সুবিধার্থে রায়মঙ্গল বটব্যাল। কিন্তু মিহিরের তাতে আপত্তি। সে একাই যেমন গিয়েছিল কলকাতায়, তেমনই সেখানে এক সপ্তাহ কাটিয়ে একাই
ফিরে এসেছে আবার নীলগঞ্জে।
আমার স্ত্রী নীলিমা রান্নাঘর থেকে সবার জন্য আরও এক কাপ করে চা বানিয়ে নিয়ে এসে রাখল টেবিলে। তারপর আমার পাশে বসে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা
মেসোমশাই, কুহু ডাকা ডাকাত দলের কী হল? ওরা যেন
নিশ্চুপ হয়ে গেল হঠাৎ করেই?”
ধীরেনবাবু নীলিমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আসলে দ্যাখো মা, ওরা ডাকাতি করত নিজেদের প্রয়োজনে।
যখন অর্থের বা কিছুর প্রয়োজন পড়ত তখনই ওরা ডাকাতি করতে
যেত। আর এক-একটা ডাকাতি করে ওদের এক-দেড় মাস
চলে যেত। তারপর আবার ভাণ্ডারে টান পড়লে ডাকাতি করত। ডাকাত হলেও, অহেতুক প্রয়োজন ছাড়া ওরা কারও অনিষ্ট করত না। তাছাড়া...”
“তাছাড়া কী?”
“অপরাধীর পিছনে পুলিশ যেমন চর লাগায়, তেমন ওদেরও তো চর থাকে। ওদেরও খবরাখবর নেওয়ার গুপ্তচর ঘুরে বেড়ায় চারিদিকে। ওরা কোনোভাবে জানতে পেরেছিল নীলগঞ্জের ওপর পুলিশের উপর মহলের বিশেষ নজর পড়েছে। ফাঁদ পেতে ওদের ধরার গোপন পরিকল্পনা করেছে পুলিশের উপর মহল।
তাই কিছুদিনের জন্য একটু গা ঢাকা দিয়েছিল ওরা।
কিন্তু তারপর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেই, আবার যে-কে-সেই অবস্থা। শোনো তারপর...” ধীরেনবাবু
আবার আগের মতো বলতে শুরু করলেন ঘটনাটা...
কাকাশ্বশুর সুমঙ্গলের পোষা রাত-কোকিলের
ডাকের সঙ্গে এখন কিছুটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে
মিহির। কোকিলের ডাকে ঘুম ভেঙে গেলেও আর উঠে পড়ে না মিহির। বিছানায়
শুয়েই ভেসে আসা কোকিলের ডাকটা শুনতে শুনতে এক সময় আবার ঘুমিয়ে পড়ে। একদিন সকালে কাছারিতে বসেছিল রায়মঙ্গল বটব্যাল জামাই মিহিরকে সঙ্গে নিয়ে। নায়েব গোবিন্দপদ তখনও আসেনি। মিহির একটা জাবদা খাতা খুলে কিছু হিসেব বুঝিয়ে দিচ্ছিল শ্বশুরমশাই
রায়মঙ্গল বটব্যালকে। রায়মঙ্গল বটব্যাল শুধু শুনছিল
আর আলবোলা থেকে তামুক টানছিল একবার করে। বেশ কিছুক্ষণ কাটার পর হন্তদন্ত হয়ে এসেই
খবরটা দিল নায়েব গোবিন্দপদ, “শুনেছেন
কর্তা, পাশের গ্ৰামের মধু সিকদারের
বাড়িতে কাল রাতে ডাকাত পড়েছিল!”
“কুহু ডাকা ডাকাতের দল?” মিহির
জিজ্ঞেস করল কৌতূহলী হয়ে।
“তাছাড়া আর এ অঞ্চলে কারা আছে বলুন। কোনো গেরস্তকে শান্তি দিলে না গো বজ্জাতগুলো।
একেবারে অরাজক করে
ছেড়েছে।”
“প্রাণহানি করে গেছে কারও?”
রায়মঙ্গল বলল।
“না কর্তা, মধু সিকদার বোকামি করেনি
বাকিদের মতো। ডাকাতদের হাতে সব কিছু তুলে দিয়ে নিজের আর পরিবারের প্রাণ বাঁচিয়েছে মধু
সিকদার।”
“যাক, মধু সিকদারকে ভগবান রক্ষা করেছেন
বলতে হবে তাহলে।”
“কিন্তু কর্তা, নিয়ে গেছে উজাড় করে। একেবারে
ছারখার করে দিয়েছে সব কিছু।”
গুমছাগাছার জঙ্গলের গুপ্ত স্থানে পাষাণ কালী মন্দিরের সামনে ডাকাতির মাল
ভাগবাটোয়ারা করা হচ্ছে। মায়ের বেদির কাছে বসে আছে
কুহু ডাকা ডাকাত দলের সেই বুদ্ধিধর ব্রাহ্মণ সর্দারটি। তার দৃষ্টি মা পাষাণ কালীর
উপর ন্যস্ত হয়ে রয়েছে দীর্ঘক্ষণ। কিন্তু
তার মাথার মধ্যে আনাগোনা করছে নানান চিন্তার মেঘ। সেখানে সুচিন্তা আর দুশ্চিন্তা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে বার বার।
“সর্দার?” নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা শেষ করে লটাই নামের একজন সাগরেদ এসে ডাকল
সর্দারকে। কিন্তু সর্দারের কোনো ভাবান্তর
নেই তাতে, সেও যেন ওই মা পাষাণ কালীর মতোই পাষাণ মূর্তি এক। লটাই আগের থেকে আর একটু
জোরে ডাকল এবার, “সর্দার?”
দ্বিতীয়বারের ডাকে সাড়া পাওয়া গেল সর্দারের, জলদগম্ভীর কন্ঠে ধীরে ধীরে সে বলল, “হয়ে
গেছে তোদের?”
“হ্যাঁ সর্দার।”
“কারও কোনো কম পড়েনি তো? সবাইকার ভাগ
সমান সমান হয়েছে তো রে লটাই?”
“কী বলছেন সর্দার! মা পাষাণ কালী আর আপনার দয়ায়
কখনও কম পড়েছে আমাদের। আর ভাগাভাগি, সবার জন্য সমান...”
“হ্যাঁ কেউ কম নয়, কেউ বেশিও নয়। সবাই সমান। এক মুঠো পেলেও সমান, আবার হাজার
পেলেও সমান।”
“কিন্তু আপনার বেলায় কেন এই এক নিয়ম খাটবে না সর্দার?”
সর্দারটি একবার চোখ তুলে তাকাল লটাই-এর দিকে। বাকি ডাকাতরাও এবার এসে
দাঁড়াল পায়ে পায়ে। লটাই মুখ নামিয়ে নিয়ে ভয়ে ভয়ে বলল, “না সর্দার, আমরা সবাই ভাগ নেব, কেবল আপনি কিছু নেবেন না, এটা আমাদের ভালো লাগে না... আমাদেরও
তো ইচ্ছে করে, আপনাকে সর্দারের মতো মাথায় করে
রাখি...”
“ধূর পাগল, আমার আবার অভাব কী?” সর্দারটি হাত জোড় করে
মাথায় ঠেকিয়ে মা পাষাণ কালীর উদ্দেশে প্রণাম
করে বলল, “মায়ের কৃপায় দু’বেলা ভাত-ডাল যে ঠিক জুটে যায় আমার। দরকার যে তোদের, আমার নয়।
তোদের জন্যই যে এত কিছু করা।”
“তবু...”
লটাই আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, বাম হাত তুলে
তাকে থামিয়ে দিয়ে সর্দার বলল, “নিয়মরক্ষার্থে
যে ষোলো আনা আমি নিয়ে থাকি প্রতিটা ডাকাতির পর, সেটাই আমার পাওনা। মায়েরও এমনই ইচ্ছে। বললাম না, দরকার যে তোদের বেশি, আমার নয়। এ বিষয়ে আর কোনো কথা নয় লটাই।
কাজের কথা থাকলে কিছু বল।”
লটাই আর কিছু বলল না। হাত জোড় করে পিছিয়ে গেল সে। এবার এগিয়ে এল সুকুর মিয়া। শৃগালের
মতো চতুর চাহনি তার দুই চোখে। বটের ঝুরির মতো নেমে এসেছে মাথার
পাকানো চুল। গা তার কালো আলখাল্লা দিয়ে আগাগোড়া ঢাকা।
আর কাঁধের সঙ্গে বাঁধা
আছে একখানা একতারা। এই একতারাতে সুর তুলে যখন এক
গ্ৰাম থেকে আর এক গ্ৰামে সুকুর মিয়া ভিক্ষে করে বেড়ায়, তখন কে বলবে এই
নিরীহ লোকটা কুহু ডাকা ডাকাত দলের একজন ভয়ংকর ডাকাত সদস্য! দিনের বেলায় ভিক্ষে করে বেড়ায় আর রাত নামলেই তার
অন্য এক রূপ! দিনে যে হাতে একতারায় সুর ভাঁজে, সেই হাতই রাতের অন্ধকারে তুলে নেয় অস্ত্র!
“সর্দার।”
“বলো সুকুর মিয়া, কী নতুন
খবর আছে?”
“শুনেছেন সর্দার, নীলগঞ্জ থানার
সনাতন দারোগার নাকি বদলি হয়ে গেছে।”
সকলেই বেশ অবাক হয়ে তাকাল সুকুর মিয়ার দিকে। একজন বলল, “কই এমন কিছু তো শুনিনি!” একজন বলল, “কবে হল বদলি?” লটাই বলল, “কিন্তু নীলগঞ্জ থানার সনাতন দারোগা তো এখনও আছে।
রোজই যে দেখি বহাল তবিয়তে সাইকেল গাড়িতে চেপে টহল মেরে
বেড়াচ্ছেন। তবে?” সর্দার কিন্তু কিছু বলল না। শুধু সুকুর মিয়ার দিকে তাকাল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে।
সুকুর মিয়া বলল, “সর্দার, আমি তো ফকির সেজে ঘুরে বেড়াই চারিদিকে। লোকে আমায় সন্দেহ করে না। উলটে আমার গান শুনে ভালোবাসে। গল্প করে, সুখ-দুঃখের নানান কথা কয়। কত জানা, অজানা, না-জানার
কথা উঠে আসে ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে। কখনও কি ভুল খবর এনেছি সর্দার? আপনি
বলেন?”
“খবরটা কী বলো সুকুর মিয়া।”
“ওই যে বললাম, নীলগঞ্জ থানার সনাতন দারোগা বদলি
হয়েছে। তার জায়গায় উপর মহল থেকে এক
শক্ত দারোগা আসার খবর আছে। কিন্তু সনাতন দারোগা যে কেন এখনও আগের মতোই রয়েছে তা বুঝতে পারছি না। আর
সেই নতুন দারোগাটারই বা কী হল, কবে সে আসবে তাও জানতে পারিনি অনেক করেও। তবে আমাদের ধরার জন্যই যে কোনো ফাঁদ
পাতা হচ্ছে ভিতরে ভিতরে তা আন্দাজ করতে পারছি সর্দার...”
সুকুর মিয়া কথা থামালে বাকিরা সর্দারের দিকে তাকাল।
সর্দারটি মা পাষাণ কালীর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “মা গো মা! সবই তোমার ইচ্ছা।” এই বলে তাকাল বাকিদের দিকে, “কোদালির
জমিদার অখিল মুখার্জী, শিমলমারির সুতো
ব্যবসায়ী ভবেশ রায়, কমলাবাটির শেখর হালদার, নকুড় আড়তদারের মতো আরও দুর্মতি ব্যক্তিরা
যা কর্ম করেছিল তার শাস্তি ওরা পেয়েছে। আমরা
শাস্তি দিয়েছি। কিন্তু আমাদের বিচারটাও যে বাকি
আছে রে সুকুর মিয়া। সে হিসেবে দেখতে
গেলে আমরাও যে অন্যায় করছি প্রতিনিয়ত। আমাদেরও
যে এর ফল ভোগ করতে হবে। শাস্ত্র বলে, কর্মানুযায়ী ফল লাভ। তা থেকে কারও ছাড়ন নেই, আমাদেরও না...!
“এমনভাবে বলো নি সর্দার, মনে খুব লাগে।”
“হ্যাঁ সর্দার, এমন কথা বলো নি আর। আসলে ধর্মের কথা আমাদের মতো ডাকাতদের খুব পীড়ে দেয়।”
“তুমি ছিলে বলে ছেলে-বউকে খেতে
দিতে পারি দু’বেলা। না হলে আর আছে কী আমাদের! তুমি বামুনের ছেলে হয়ে আমাদের জন্য এ পথে নেমেছ...”
“আমি কিছু নই রে, সবই মা’র ইচ্ছে। মা যা করান আমরা তাই করি। ভালোও করি, আবার মন্দও।
বল সব - জয় মা পাষাণ কালীমা’র জয়...”
সর্দারের কথামতো সকলে একসঙ্গে বলে উঠল, “জয় মা পাষাণ কালীমার জয়... জয় মা
পাষাণ কালীমার জয়...”
“সুকুর মিয়া একটা গান শোনাবি না? গ্ৰামে গ্ৰামে ঘুরে নিরীহ পাখি-পশু, কত অচেনা মানুষজনকে তুই গান
শোনাস, আর আমরা হলাম অপরাধী?”
সর্দারটির অনুরোধ শুনে সুকুর মিয়া বলে, “এ কী বলছেন সর্দার! আদেশ করুন, অদেশ।”
এই বলে সুকুর মিয়া আঙুল ছোঁয়াল তার একতারায়...
“দেখো রে, মন সাগরে আছে যে এক মনের আপনজন
(শোনো রে) ধরতে যদি পাও রে তারে
হবে মহাজন।
মানিক রতন হরেক রকম, রতন খোঁজো খাঁটি
হৃদয় রতন মিললে পরে দেখবে সবই মাটি।
খোঁজো রে, মন সাগরে অরূপ হৃদয় ধন
ধরতে যদি পাও রে তারে হবে মহাজন।
দেখো রে, মন সাগরে আছে যে এক মনের
আপনজন।”
‘কুহু হু হু... কুহু হু হু...’
একদিন রাতে মিহিরের ঘুমটা আবার ভেঙে গেল ছোটোকাকুর পোষা কোকিলের ডাকে। বিছানায়
শুয়েই এপাশ ওপাশ করছিল মিহির। ঘরটা খুব
অন্ধকার। আলো নেই, খোলা জানালার বাইরে চাঁদও ওঠেনি আজ। পাশে
রঞ্জা অকাতরে ঘুমাচ্ছে। কিছু একটা অস্বস্তি হচ্ছে
মিহিরের। কীসের কারণে এই অস্বস্তিবোধ বুঝতে পারছে না। উঠে বসল বিছানায়। কিছুক্ষণ চুপ
করে বসে থেকে বিছানার পাশে রাখা কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে নিয়ে খেল কিছুটা। আবার শুয়ে পড়ল বিছানায়। কোকিলটা
কিন্তু তখনও ডেকে চলেছে। ‘কুহু হু হু... কুহু হু হু... কুহু হু হু... কুহু হু হু...’ তারপর
কখন যে মিহির ঘুমিয়ে গেল নিজেই জানে না। ঘুম ভাঙল একেবারে ভোরে। কানে এল একটা সুন্দর গানের
সুর। কেউ গান করতে করতে চলেছে এই
ভোরবেলায় শিশিরভেজা নরম ঘাস মাড়িয়ে মাড়িয়ে।
চোখ বুজেই মিহির শুনতে থাকল গানটা...
দেখো রে, মন সাগরে আছে যে এক মনের
আপনজন
ধরতে যদি পাও রে তারে হবে মহাজন।
“রঞ্জা, কে গান গায় গো এই ভোরে?”
মিহির জিজ্ঞেস করল গানটা ধীরে ধীরে ভোরের ঠান্ডা বাতাসের
মতো ভেসে দূরে চলে যেতে শুরু করলে।
“ও তো ফকির মিয়া।”
“ফকির মিয়া?”
“ফকির মিয়া গান গেয়ে ভিক্ষে করে বেড়ায়।
পাশের গ্ৰামে বাড়ি ছিল লোকটার।”
“ছিল মানে? এখন আর নেই?” মাথার
বালিশটা কোলের উপর রেখে উঠে বসল মিহির।
“না। ছোটকার কাছে শুনেছি, পাশের
গ্ৰামের মধু সিকদার নাকি ওর সব কিছু দখল
করে নিয়েছিল বছর খানেক আগে। বাড়ি ঘর সব। কী একটা ঝামেলা হয়েছিল তাই নিয়েই আর-কি।”
“মধু সিকদার কে?”
“আরে, ভুলে গেলে এরই মধ্যে। গত মাসে পাশের গ্ৰামে যার বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল-না, সেই মধু সিকদার।”
মিহির বসে রইল রঞ্জার চোখের দিকে তাকিয়ে। কোনো কথা নেই মুখে।
গত মাসের ঘটনার আবার পুনরাবৃত্তি ঘটল রায়মঙ্গলের কাছারিবাড়িতে সকাল হতেই।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেদিনের মতো খবরটা নিয়ে এল নায়েব গোবিন্দপদ।
“শুনেছেন কর্তা কাণ্ডটা? আব্দুর খানকেও যে বাকিদের মতো গাছে ঝুলিয়ে দিয়ে গেছে
গত রাতে কুহু ডাকা ডাকাতরা!”
রায়মঙ্গল বটব্যাল মুখ তুলে তাকাল। মিহিরের কপালজোড়া চিন্তার ভাঁজ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গত রাতের
সেই অস্বস্তিটা আবার যেন ঘিরে ধরল মিহিরকে। কিছু
একটা খটকা যেন গলায় এসে বিঁধতে লাগল মিহিরের। যা ওর খাওয়া, ঘুম, কাজ সব
ভুলিয়ে দিল।
ধীরেনবাবু থামলেন। “এবার ওঠা যাক, অনেক গল্পগাছা হল।
কী বল?”
“মানে? গল্পটা শেষ করবেন না?”
“ঠিকই তো। এমন অসম্পূর্ণ অবস্থায় আমাদের ভাসিয়ে রেখে উঠে যাবেন?” নীলিমা বলল।
“গল্পটা শেষ করে যান মেসোমশাই। রহস্যটাই তো উন্মোচন করলেন না।”
“শেষ হয়ে গেছে। সব রহস্যেরও সমাধান হয়ে গেছে।
তোমরা ধরতে পারোনি।”
“মানে?” আমরা সবাই হতভম্বের মতো তাকালাম
ওনার দিকে।
“মানে, মিহিরের মনের ওই দুশ্চিন্তা, সকল অস্বস্তি কুহু ডাকা ডাকাতদের রহস্যটাকে উন্মোচনের
দিকে নিয়ে যায়। মিহির বুঝতে পারে ওর অস্বস্তির আসল কারণ ওই কোকিলের ডাকটা। প্রতি রাতে কোকিলের ডাকের সঙ্গে, ডাকাতি হওয়া রাতের কোকিলের ডাকের পার্থক্য ঘটে যেত। প্রথম প্রথম বুঝতে না পারলেও পরের দিকে বুঝতে পেরেছিল মিহির।
সেই সব বিশেষ রাতের বিশেষ ডাকটা ডাকত কোকিল নয়, কুহু
ডাকা ডাকাত দলের সেই বুদ্ধিধর ব্রাহ্মণ সর্দারটি। সেটা শোনার জন্য এরপর থেকে রাত
জেগে অপেক্ষা করে থাকত মিহির। যেদিনই
ওই ডাকের সুর বদলে যেত, সেদিনই ডাকাতি হত নীলগঞ্জের কোথাও না কোথাও। এমনভাবে
পর্যবেক্ষণ করতে করতেই মিহির একদিন পৌঁছে যায় কুহু ডাকা ডাকাত দলের সেই বুদ্ধিধর
ব্রাহ্মণ সর্দারটি কাছে।”
“কী বলছেন কী?”
“হ্যাঁ, আসলে রঞ্জার ছোটোকাকুই ছিল সেই কুহু ডাকা ডাকাত দলের বুদ্ধিধর ব্রাহ্মণ সর্দার।
বিশেষ বিশেষ রাতে কোকিলের ডাক ডেকে বাকিদের খবরাখবর
দেওয়া-নেওয়া চলত। তাই এত পাখি থাকতে কোকিল পোষা হয়েছিল, যাতে কেউ না সন্দেহ করে। কিন্তু
পুলিশের উপর মহল যে ফাঁদ পেতে পাখি ধরতে ছদ্মবেশী অফিসারকে পাঠিয়েছিল তা কেউ
বুঝতে পারেনি। এবার বলো তো কে ছিল সেই ছদ্মবেশী অফিসার? দেখি তোমাদের মগজের জোর?”
আমাদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন ধীরেনবাবু।
আমরা কেউ কিছু বলার আগেই আমার স্ত্রী নীলিমা সবাইকে অবাক
করে বলে উঠল, “মিহির।”
“বাঃ, একদম ঠিক বলেছ মা। মিহির নাম নিয়ে ওই অফিসারটি সমস্ত ইনফর্মেশন জোগাড় করে দীর্ঘদিন ধরে। আর
মাঝে মাঝে দরকার হলেই মামার শরীর খারাপের দোহাই দিয়ে চলে আসত কলকাতার হেড অফিসে। কাজটা
যেমন দীর্ঘমেয়াদী তেমনি আশঙ্কারও। ডাকাতের সঙ্গে থেকে তাদের ধীরে ধীরে ফাঁদে ফেলা। রঞ্জার ছোটোকাকু ধরা পড়ার পর সবটাই স্বীকার
করে নিয়েছিলেন মিহির নামের ছদ্মবেশী অফিসারটির কাছে। এমন কি সারাজীবনের অপরাধ মাথায়
নিয়ে জেলে যেতেও কোনোরকম আপত্তি করেননি।”
রায়মঙ্গলের কাছারিবাড়িতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে সেইদিন। বাড়ির দাস-দাসী থেকে পোষা কুকুর বিড়াল গরু
পর্যন্ত কেঁদেছিল যে যেখানে ছিল। কোমরে
দড়ি বাঁধা অবস্থায় সুমঙ্গল বসেছিল দাদার পায়ের কাছে। রায়মঙ্গলের মুখ রক্তশূন্য
হয়ে গেছিল।
“আপনিও তো জানতেন না ছোটোকাকুর এই
ব্যাপারটা?” মিহির নামক ছদ্মবেশী অফিসারটি জিজ্ঞেস
করল রায়মঙ্গলকে। রায়মঙ্গল একবার শুধু মুখ
তুলে তাকাল ছদ্মবেশী জামাইটির দিকে। কথা বলার সমস্ত শক্তি হারিয়ে গেছে তার।
“আপনার কাছে কুহু ডাকা ডাকাত দলের পাঠানো অনেক চিঠিই আসত। সেই সব চিঠির হাতের লেখা দেখেই আপনি বহু আগে আন্দাজ করেছিলেন সবটা। শুধু ভাইয়ের মুখ চেয়ে আর বংশের কথা ভেবে কিছু বলতে পারেননি।”
মাথা নামিয়ে নিল রায়মঙ্গল।
“আপনি কিছু বলবেন ছোটোকাকু?”
ধীরে ধীরে মাথা তুলল সুমঙ্গল। তারপর
দাদার দিকে একবার চেয়ে তাকাল পিছনে
দাঁড়ানো প্রিয় ভাইঝির দিকে। কেঁদেকেটে
লক্ষ্মীমন্ত মুখ মলিন হয়ে গেছে রঞ্জার। সারা রাত
ধরে যে বুকফাটা কান্না বয়ে গেছে গাল বেয়ে, তা এখন মরা নদীর মতো শুকিয়ে গেছে।
“আমার কিছু বলার নেই। যেমন কর্ম করেছি, তার শাস্তি যে পেতেই হত। আজ নয়তো কাল। না হলে, মা পাষাণ কালী মিথ্যে
হয়ে যাবেন যে। শুধু একটা অনুরোধ তোমার কাছে...”
“বলুন?”
“আমার রঞ্জাকে তুমি ভুল বুঝো না। আমার
শাস্তি তুমি এই নিরীহ মেয়েটাকে দিও না বাবা।”
“ও সব নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। যেমনভাবেই বিয়ে হোক আর যে কারণেই হোক, রঞ্জা এখন আমার স্ত্রী, আর সারাজীবন তাই থাকবে,
সম্পূর্ণ মর্যাদা নিয়ে। চলুন
এবার, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
“আর একটা কথা।”
“বলুন?”
“ওরা গ্ৰামের সব গরিব মানুষ। ওদের কোনো দোষ নেই, যা করেছে সব আমার বুদ্ধিতেই। ওদেরকে...”
“বুঝেছি।”
আরও একবার কেঁদে উঠল গোটা বটব্যাল
বাড়ি থেকে সারা নীলগঞ্জ।
হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ধীরেনবাবু বললেন, “এবার কিন্তু সত্যি সত্যিই উঠতে হবে। ন’টা বাজতে চলল, ওদিকে তোমাদের মাসিমা আবার আমার জন্য অপেক্ষা করছে।”
“একটা কথা জানতে চাই। এই ঘটনা
যদি সম্পূর্ণ সত্যি হয়ে থাকেও...”
আমাকে থামিয়ে দিয়ে ধীরেনবাবু বললেন, “সম্পূর্ণ সত্যি, আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত কোথাও কোনো খাদ নেই।”
“তাই না হয় মানলাম, কিন্তু
এই ঘটনার সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা কোথায় মেসোমশাই?”
ধীরেনবাবুর ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল। বললেন, “সেটা আমি বলব না, এটুকু রহস্য না হয় রহস্যই থাক।
আর না, ওদিকে তোমাদের মাসিমা অপেক্ষা করছে। এবার উঠি।”
ধীরেনবাবু, পাশের ফ্ল্যাটের ডাঃ সুবীর
ভৌমিক আর ওনার স্ত্রী অলকা ভৌমিক একে একে উঠে চলে গেলেন নিজের নিজের ফ্ল্যাটে। আমি উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ফিরে এলাম। নীলিমা তখনও বসে বসে যেন কী একটা ভেবে চলেছে লক্স কাটা চুলের মধ্যে আঙুল
পাকাতে পাকাতে।
“কী হল নীলিমা, এত কী ভাবছ?”
“আচ্ছা, মাসিমার নামটা যেন কী?”
“মিসেস র্...!” নামটা
উচ্চারণ করতে গিয়েই চমকে উঠলাম আমি। কাঁপা কাঁপা
গলায় বললাম, “ত্... তা...তার মানে...?”
নীলিমা বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
----------
ছবি - জয়িতা বিশ্বাস
খুব ভালো লাগলো।
ReplyDeleteThanks
Deleteখুব সুন্দর গল্পটি!
ReplyDelete