ছাতিমপুরের ছায়াবাজি
সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
যেদিন বুড়ো বটতলায় নতুন
আস্তানা গাড়া সন্ন্যাসীর একমাত্র ঝোলাটা চুরি গেল, সেদিন থেকেই গোলমালটার শুরু। সন্ন্যাসী
এই ছাতিমপুরে এসেছিলেন খুব বেশিদিন হয়নি। ঐ গাছতলাতেই থাকতেন। পাড়ার লোকে দু-পাঁচটা
টাকা কী কলাটা মুলোটা প্রণাম করে ফেলে যেত সামনে, তিনি তুলে নিতেন পরে। তবে তাঁর
সঙ্গে একটা লাল শালুতে মোড়া ঝোলা বা থলে ছিল, অনেকেই দেখেছে। ওটা মুখের কাছে তুলে
নিয়ে মাঝে মাঝেই আপনমনে বিড়বিড় করে কথা বলতেও দেখা গেছে তাঁকে। কিন্তু ঐ ঝোলার উপর
যে কোনো চোরের নজর থাকতে পারে এ কথা কারও মাথাতেও আসেনি। জানতেও পারত না, যদি না সন্ন্যাসী
সেদিন ওটা খুঁজে না পেয়ে অমন দুর্বোধ্য ভাষায় চেঁচামেচি শুরু করতেন। লোকেরা একটু
আহা উঁহু করে যে যার কাজে চলে গেছিল। তারপর সন্ন্যাসী নিজেই কোথায় উধাও হলেন। আর
সেদিন থেকেই... আহ, কী হল সেটাই বলিনি এখনও তাই না? তাহলে বলি একটা একটা করে।
প্রথম ঘটনাটা সেভাবে কারও
নজরে পড়েনি। ছোটোদের ব্যাপার বলেই হয়তো। ক্লাস ফোরের
গুবলেকে তার মা যখন হাত ধরে টেনে বাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল সে তখন বায়নাক্কা
জুড়েছিল বন্ধুদের সঙ্গে গলির মধ্যে ক্রিকেট খেলার জন্য। পড়ন্ত বিকেলের আলোতে গলির
মধ্যে থাকা বাড়িগুলোর দেয়ালে গুবলে, তার মা আর তার ক্রিকেট খেলুড়ে বন্ধুদের ছায়া
পড়ছিল। হঠাৎ সবার অলক্ষেই গুবলের ছায়াটা তার মায়ের, মানে মা’র ছায়ার হাত ছেড়ে তার
বন্ধুদের দিকে ছুটে গেল। তারপর যে ছেলেটা ব্যাট করছিল তার ছায়ার হাত থেকে ব্যাটের
ছায়াটাকে ছিনিয়ে নিয়ে সেদিকে ছুটে আসা বলের ছায়াটাকে সপাটে মেরে দিল! বলের ছায়াটা
ছিটকে গিয়ে লাগল সোজা গুবলের মায়ের ছায়ার পিঠে! অমনি তার মা ‘ওরে বাবা রে’ বলে
চেঁচিয়ে উঠল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুবলের ছায়াটা যথাস্থানে ফিরে এল। কী হয়েছে কিছু
না বুঝতে পেরে রাগের চোটে গুবলেকেই দু’ঘা দিয়ে দিলেন তিনি। বেচারা কাঁদতে কাঁদতে
বলছিল, এসবে তার কোনো হাত-পা কিচ্ছু নেই। কিন্তু সে কথা শোনে কে? যাই হোক, ঘটনাটা
চাপা পড়ে গেল।
এরপর যা ঘটল তা আরও
উদ্বেগজনক, কিছুটা লজ্জাজনকও বটে। পাড়ার সুবোধ ঘোষাল বেশ গণ্যমান্য ব্যক্তি। বড়োলোক
মানুষ তিনি, মোসাহেবদের তোষামোদ বড়োই ভালোবাসেন। ফি সন্ধ্যায় তারা জুটেও যায় তাঁর
বাড়ির বৈঠকখানায়, খানাপিনাও হয় জোরদার। শুধু একটাই সমস্যা, সুবোধবাবু তাঁর এই
তাঁবেদারদের সামনে গান গাইতে বড়োই ভালোবাসেন। আর তিনি বিশ্বাস করেন গানটা তিনি
ভালোই গান। এই ভুল ধারণাটা কে তাঁর মাথায় প্রথম ঢুকিয়েছিল জানা নেই, তবে সেটাকে
উপড়ে ফেলার দুঃসাহস কোনো শ্রোতা দেখাতে পারেন না, পাছে তিনি সুবোধবাবুর বিরাগভাজন
হন আর সান্ধ্য বাসর থেকে তাঁকে বয়কট করা হয়! তা সেদিন সন্ধ্যাতেও গান শুরু হয়েছিল
তাঁর। বনেদি বাড়ির সেই বৈঠকখানায় বাহারি ঝাড়বাতির আলোয় গায়ক আর শ্রোতাদের ছায়ারা
বেখাপ্পা সুরের তালে কেঁপে কেঁপে উঠছিল দেয়ালে। তানপুরা বাগিয়ে ধরে সুবোধবাবু যখন
সাত সুরের বিলকুল বাইরের কোনো অতীন্দ্রিয় সুরের সাধনায় মত্ত, ঠিক তেমন সময়ে প্রায়
সবার নজর এড়িয়েই হারান মণ্ডলের ছায়াটা দেয়ালে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। পরক্ষণেই সেটা
এক ঝটকায় ছায়ার সুবোধবাবুর ছায়া-তানপুরা ছিনিয়ে নিয়ে সেটার তারগুলো পটাং করে উপড়ে
ফেলল! কী ভাবছ? ছায়ার মধ্যে আবার শব্দ কোত্থেকে এল? আরে ঐ শব্দটা আসল! সুবোধবাবুর
তানপুরার তার সত্যি সত্যিই ছিঁড়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। সুবোধ ঘোষাল তো পুরো ভ্যাবাচ্যাকা!
আর হারান মণ্ডল ব্যাপারটায় রীতিমতো ভয় পেয়ে গেল। সে মনে মনে এমনটাই করতে চেয়েছিল
বটে, কিন্তু বাস্তবে তো করেনি! আর সে যে করেনি সেটা সবাই দেখেছে। কিন্তু যেটা ঘটল
তাতে কোনোভাবে তার প্রতি সন্দেহ করবে না তো কেউ আবার? যাই হোক, সুবোধবাবু আচমকা
শরীর খারাপের দোহাই দিয়ে উঠে গেলেন। সেদিনের মতো সভা ভেঙে গেল।
কিন্তু ব্যাপারটা এখানেও শেষ
হল না। পাড়ার নেতা গুরুপদ সমাদ্দার পরদিন সন্ধ্যায় জলট্যাংকির মোড়ে একটা রাজনৈতিক পথসভায়
বক্তৃতা দিচ্ছিল। পিছনে বেশ বড়ো ব্যানার টাঙানো, তাতে
তার বড়ো একটা হাসিমুখের হাতজোড় করা ছবি। বড়ো বড়ো আলো লাগানো হয়েছে দু’পাশে। তাতে
গুরুপদর পিছনে তার একটা লম্বা ছায়া পড়েছে। সামনে জনা কুড়ি লোক। তার মধ্যে দলের
লোকও আছে, পথচলতি সাধারণ লোকও আছে। তাদের অনেকেই গুরুপদকে পছন্দ করে না। ভোটের আগে
এইসব সভায় সে যা যা বলে তার প্রায় কিছুই আর পরে করে না। কিন্তু তার প্রতাপে সে কথা
মুখ ফুটে তারা বলতে পারে না। এখনও বেশ হাসি হাসি মুখেই তারা ঐ ভাষণ শুনছিল। আর মনে
মনে তার মুণ্ডুপাত করছিল। আচমকা সভয়ে তারা এবং মঞ্চের সামনে থাকা সবাই দেখল পিছনে
গুরুপদর ছায়ার আশেপাশে আরও চার-পাঁচটা লোকের ছায়া জড়ো হচ্ছে। ছায়ার লোকগুলো বা
লোকের ছায়াগুলো জামার আস্তিন গুটোচ্ছে যেন গুরুপদকে আরেকটু হলেই ধোলাই দেবে।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল মঞ্চের সামনে বা আশেপাশে তো এমন কোনো লোককে দেখা
যাচ্ছে না! ছায়াগুলো যেন কিছুটা বিশু, দীনে, পঞ্চুদের মতোই, মানে ঐ বিক্ষুব্ধ
জনগণের একাংশ! কিন্তু তারা তো দিব্যি নিচে দাঁড়িয়ে। তাহলে ছায়ারা এমন বেগড়বাঁই
করছে কেন? কেউ বেশি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঐ ছায়াগুলো গুরুপদর ছায়াকে ধরে বেদম
পেটাতে শুরু করল। আর তখনই গুরুপদও মাইক ছেড়ে বাবা-গো মা-গো বলে চেঁচিয়ে উঠল। জনতার
মধ্যে একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। সভা ভণ্ডুল হতে বেশিক্ষণ লাগল না। ছায়ারাও সব চম্পট
দিল। কিন্তু লোকজন বেশ ঘাবড়ে গেল। কী হল এটা?
বুদ্ধিমান কেউ কেউ বলতে থাকল,
এ সব নির্ঘাত ঐ সাধুবাবার ঝোলা চুরির ফল। ওর মধ্যে সাধুর পোষা কোনো ভূত-প্রেত থাকা
অসম্ভব নয়। তারাই এসব ছায়াবাজির খেল দেখাচ্ছে না তো? যুক্তিবাদীরা অবশ্য এই সব
যুক্তি মানতে নারাজ। তাদের বক্তব্য এ কারও শয়তানি। কালপ্রিটকে ধরতে পারলেই রহস্যের
সমাধান হবে। যাই হোক, দু’পক্ষের বাগবিতণ্ডার মাঝে ঠিক হল, এই ছায়ার উৎপাত রুখতে
সন্ধ্যা থেকেই ছাতিমপুরে থানার সাহায্য নিয়ে কিছু পুলিশ বা নিরাপত্তারক্ষীর
ব্যবস্থা করতে হবে। তাই হল। দেয়ালে, ফুটপাথে সব জায়গায় পথচলতি মানুষের ছায়া
খুঁটিয়ে দেখার দায়িত্ব বর্তাল কয়েকজনের উপর। কোনো এদিক ওদিক দেখলেই সেই লোককে
পাকড়াও করা হবে। ছায়াকে তো আর ধরা যাবে না!
দু’দিন নিরুপদ্রবেই কাটল।
ছায়াও তাহলে মানুষকে ভয় পায়? তৃতীয় দিন সন্ধ্যার দিকে, বটতলার কাছেই একটা তেমাথার
মোড়ে দায়িত্বে থাকা রক্ষীটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্লান্তিতে হাই তুলছিল, তখন তার সামনে
দিয়ে যাচ্ছিল ম্যাজিশিয়ন বিপুল বসু। হাতে একটা বড়ো ট্রাভেল ব্যাগ। “কোথাও চললেন
নাকি বিপুল বাবু?” রক্ষীর প্রশ্নে একটু চমকে গিয়ে বিপুল বসু বললেন, “হ্যাঁ, মানে
ইয়ে, কলকাতায় একটা ম্যাজিক শো আছে কাল। তাই যাচ্ছি বাস ধরতে।”
এই বলে তিনি হাঁটার বেগ আরও
বাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু রক্ষীটির মনে একটু যেন সন্দেহ হল তাঁর হাবভাব দেখে। যেমনি
এসব ভাবা অমনি কী যে হল, ল্যাম্প পোস্টের টিমটিমে আলোয় রাস্তায় ঝিমিয়ে পড়ে থাকা
রক্ষীর ছায়াটা যেন চাঙ্গা হয়ে উঠে লাফ দিয়ে ম্যাজিশিয়নের ছায়ার ঘাড়ে চড়ে বসল। আর
সেই ছায়ার হাত থেকে বড়ো ব্যাগটা ছিনিয়ে নিল। এদিকে বিপুল বসুও ততক্ষণে তাঁর ছায়ার
মতোই আচমকা মুখ থুবড়ে পড়েছেন রাস্তাতেই, আর তাঁর হাত থেকে ছিটকে পড়া ব্যাগের ভিতর
থেকে উঁকি মারছে সেই লাল ঝোলাটা! সাধুবাবার ঝোলা! কী সাংঘাতিক! এই লোক চুরি
করেছিল! রক্ষীটি ততক্ষণে পকেটে থাকা বাঁশি বাজিয়ে চিৎকার করতে শুরু করেছে, “চোর
চোর। পাকড়ো পাকড়ো!” অথচ পাকড়ানো যে তারই কাজ সেটা ভয়ে বা উত্তেজনায় সে বেমালুম
ভুলে গেছে। আরও লোকজন আসার আগেই বটতলার দিকে একটা ঝুপ করে শব্দ হল। সেদিকে তাকিয়ে
রক্ষীটি দেখল, বটগাছের ভিতর থেকে লাফিয়ে নেমেছেন সাধুবাবা! তার মানে উনি এখানেই
লুকিয়ে ছিলেন! আর নেমেই সোজা তিনি চলে এসেছেন নিজের ঝোলাটা নিতে। বিপুল বসু প্রায়
অজ্ঞান হতে হতে গোঁ গোঁ করতে করতে তাঁর পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলছে, “আমায় মাপ করে দিন,
প্লিজ মাপ করে দিন। আপনার এই ঝোলার মধ্যে যে বিশেষ কিছু আছে সেটা আমি কয়েকদিন
আপনাকে আড়াল থেকে লক্ষ করেই বুঝেছিলাম। ম্যাজিক দেখাতে গিয়ে আপনার সত্যিকারের ঐ
জাদু ঝোলাটা কোনোভাবে কাজে লাগানো যায় কিনা সেটা দেখতেই আমি ওটা সরিয়েছিলাম একটু
হাতসাফাই করে। ওর মধ্যে যে জ্যান্ত ছায়াগুলো ছিল, সেগুলো নিয়ে স্টেজে খেলা দেখালে
চারদিকে সাড়া পড়ে যাবে, এই ভেবেই আমার লোভ হয়েছিল। কিন্তু আমি কিছুতেই এগুলোকে
নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছিলাম না, তাই আমার এক গুরু কলকাতায় থাকেন, তাঁর কাছে নিয়ে
যাচ্ছিলাম আজ। আপনি এটা ফিরিয়ে নিয়ে আমাকে মাপ করে দিন দয়া করে!’
সন্ন্যাসী একদৃষ্টে তাঁর দিকে
তাকিয়ে জবাব না দিয়ে মুচকি হেসে ঝোলাটা কাঁধে ফেলে হনহন করে চলতে শুরু করলেন।
ততক্ষণে চারপাশে আরও লোক জড়ো হয়েছে। তারা সবিস্ময়ে দেখল, সন্ন্যাসীর পিছু পিছু
তাঁর ছায়ার সঙ্গে আরও একটা ছায়া যাচ্ছে, সেটা হল জাদুকর বিপুল বসুর ছায়া! নিজের
পায়ের তলার থেকে ছায়া সরে যাচ্ছে টের পেয়ে আতঙ্কে হাউমাউ করে বিপুল বসু সাধুবাবার
পিছনে ছুটলেন। কিন্তু যতই জোরে ছুটুন, সন্ন্যাসী আরও বেগে পা চালিয়ে দূরে আরও দূরে
চলে যেতে থাকলেন। ছাতিমপুরের লোক অবাক হয়ে দেখল কাণ্ডটা। মানুষের পিছনে ছায়া নয়,
ছায়ার পিছু পিছু দৌড়ে যাচ্ছে একটা অসহায় লোক। তারা কেউ আর সেখানে ফিরে আসেনি।
ছায়াবাজিও বন্ধ হল, বলাই বাহুল্য। তোমরা কেউ কোথাও এমন কিছু দেখতে পেলে খবর দিও,
কেমন?
----------
ছবি - লেখক
No comments:
Post a Comment