সকলেই তৃতীয় পাণ্ডব
অনন্যা দাশ
১
তোমরা ডপেলগ্যাঙ্গার মানে জানো? জানতেও পারো, আজকাল অনেকেই অনেক কিছু জানে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমি কিন্তু ডপেলগ্যাঙ্গার মানে জানতাম না। আমার যে জ্ঞান খুব বেশি তা অবশ্য নয়। ইংরেজিতেই হাবুডুবু খাই তার ওপর আবার জার্মান! নেট থেকে খুঁজে-টুজে দেখলাম আগে নাকি জার্মান উপকথায় বলা হত সমস্ত জীবিত মানুষের একটা অবিকল একরকম দ্বিতীয় আত্মা আছে। মানে ভূত নয় কিন্তু, জীবিত অবস্থাতেই থাকে, মনুষ্য সত্তার উলটোটা নাকি। ১৭৯৬-এ ইয়োহান পল রিখটার, যিনি জ্যঁ পল ছদ্মনামে লিখতেন, তিনিই ডপেলগ্যাঙ্গার শব্দটি তৈরি করেন ওই দ্বিতীয় আত্মাগুলোকে বোঝানোর জন্যে। ক্রমে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ডপেলগ্যাঙ্গারের মানে পালটে গিয়ে হয়ে যায় এমন একজন মানুষ যার কিনা তোমার সঙ্গে কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই বা আত্মীয়তা নেই কিন্তু তাকে অবিকল তোমার মতন দেখতে। তা সেলিব্রিটিদের এই রকম ডপেলগ্যাঙ্গার তো প্রায়ই দেখা যায়। এই পৃথিবীতে ৭০০ কোটি মানুষ আছে, হতেই পারে এদের মধ্যে কোনো দু’জনের তোমার আমার মতন একরকম মুখ হয়ে গেল। বিজ্ঞান বলে সেই সম্ভাবনা ১:১৩৫। কী জানি।
যাই হোক একটু বেশিই ভূমিকা করে ফেললাম মনে হয়। আসলে যে ঘটনাটা বলতে চলেছি তাতে ডপেলগ্যাঙ্গার কথাটা কয়েকবার আসবে, তাই আগে থেকেই সেটার মানে বলে দিলাম। প্রথম থেকেই বলি। ঘটনাটার সূত্রপাত ঠিক তিন মাস আগে। মা-বাবা তখন পাটনায় জেঠুর বাড়ি গেছেন। বাড়িতে আমি একা। আমি এম এ পাশ করে বসে রয়েছি। চাকরি খুঁজছি কিন্তু পাচ্ছি না। সেদিন শরীরটা একটু ম্যাজম্যাজ করছিল, তাই শ্যামাদিকে বলেছিলাম আমার জন্যে কয়েকটা রুটি করে দিতে। মাথাটা ভার ভার লাগছিল, তাই তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ার উপক্রম করছি, এমন সময় দরজায় বেল। ঘড়িতে দেখলাম দশটা বাজে। এখন আবার কে এল রে বাবা বলে দরজাটা অল্প ফাঁক করে দেখলাম এই রাতের বেলাতেও সানগ্লাস পরে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাথায় সাঁইবাবার মতন ঝাঁকড়া কোঁকড়া চুল।
সে আমাকে বলল, “আমি ভীষণ দরকারি একটা কাজে এসেছি। দরজা বন্ধ করবেন না! আমার কথাটা শুনে নিন, তাতে আপনারই লাভ হবে।”
অচেনা লোককে আমি সচরাচর বাড়িতে ঢুকতে দিই না। কেউই দেয় না আজকাল, কিন্তু ছেলেটার স্বরে এমন একটা কাকুতি-মিনতি ভাব ছিল যে আমি তাকে ঢুকতে দিলাম। আমি অল্প বিস্তর ক্যারাটে জানি। দরকার হলে না হয় ব্যবহার করা যাবে।
ছেলেটা ঘরে ঢুকে সোফায় বসে বলল, “ও সব আপনি-টাপনি বলে লাভ নেই, আমরা যখন ডপেলগ্যাঙ্গার তখন।”
আমি খাবি খেয়ে বললাম, “আমরা কী?”
“ডপেলগ্যাঙ্গার। আমাদের মধ্যে রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই কিন্তু আমাদের দেখতে এক রকম।”
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ছেলেটার দিকে তাকালাম। সে ততক্ষণে চোখের সানগ্লাসটা সরিয়ে ফেলেছে। তার চোখও দেখলাম আমার মতন কটা! আমার কটা চোখ সবাইকে খুব অবাক করে দেয় কারণ আমাদের বাড়িতে আর কারো ওই রকম চোখ নেই।
আমি বললাম, “কিন্তু কিন্তু …”
সেটা বলতে বলতে ছেলেটা ঝাঁকড়া চুলের উইগটা সরিয়ে ফেলল। হ্যাঁ, অনেকটাই আমার মতন দেখতে। একেবারে অবিকল নয়, মানে মা-বাবা গুলিয়ে ফেলবেন সেই রকম অবিকল নয়, কিন্তু বেশ মিল আছে।
ছেলেটা বলল, “আর সব চেয়ে বড়ো মিল হল এইটা!” বলে সে তার বাঁ হাতের আঙুলগুলো তুলে ধরল। আমার বাঁ হাতে ছ’টা আঙুল, এরও দেখলাম তাই!
আমি দেখে-টেখে বললাম, “হুঁ, সে সব তো বুঝলাম। তা হঠাৎ আমার খোঁজ কেন পড়ল। আমরা কি দুজনে মিলে রিয়ালিটি শো করতে যাব নাকি? আসল না নকল, একেবারে অবিকল জাতীয় কিছু?”
ছেলেটা ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বলল, “তোমাকে অনেক কষ্টে খুঁজে পেয়েছি আমি। তোমাকে আমার হয়ে একটা কাজ করে দিতে হবে। তার বিনিময়ে তোমাকে অনেকটা অর্থ দেব আমি।”
“মানে? কী কাজ? আর টাকাই বা কেন দেবে?”
ছেলেটা বলল, “সব বলছি। তার আগে একটু জল পাওয়া যাবে? অনেকটা পথ আসতে হয়েছে।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার নাম কী?”
“পার্থ, আমার নাম পার্থ। তোমাদের পাড়ার ঘন্টুই তোমার সন্ধান দিয়েছে আমাকে।”
আমি আকাশ থেকে পড়লাম, “ঘন্টু?”
“হ্যাঁ। আমি আর আমার বন্ধুরা কলেজে কলেজে গিয়ে আমার ছবিটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করছিলাম ওই রকম দেখতে কাউকে কেউ চেনে কিনা। তা ছবিটা দেখে ঘন্টু বলেছিল তোমার কথা।”
আমি রান্নাঘর থেকে ছেলেটার জন্যে এক গেলাস জল নিয়ে এলাম। এসে দেখলাম ছেলেটা কাচের আলমারিতে রাখা ফ্রেমে বাঁধানো আমাদের পরিবারের ছবিগুলো দেখছে।
“হুঁ, তা কী করতে হবে বলছিলে আমাকে?”
“তোমাকে আমার হয়ে একটা জায়গায় যেতে হবে। আসলে আমি একটা চাকরি পেয়েছি। কোম্পানিটা বেশ ভালো। কিন্তু ওদের শর্ত হচ্ছে প্রথম চার মাস ওদের ক্যাম্পাসে গিয়ে থাকতে হবে। সেখানেই ট্রেনিং হবে। পরের সপ্তায় জয়েনিং। এদিকে আমার বাবার খুব শরীর খারাপ। এই মাসের শেষে অপারেশানের ডেট দিয়েছে ডাক্তার। আমি ছাড়া আর কেউ নেই বাবাকে দেখার, মানে দিদি আছে কিন্তু সে থাকে চেন্নাইতে। সে এখানে আসতে পারবে না। তাই আমি বলছিলাম কি, দুটো মাস যদি তুমি সামলে দিতে পারো। মাইনে যা হবে তার অর্ধেক তোমাকে দিয়ে দেব এই দুটো মাস। তোমারও কিছু টাকা উপায় করা হয়ে যাবে আর আমার বাবাও সুস্থ হয়ে উঠবেন। আমি তখন বাবাকে চেন্নাইতে ছেড়ে এসে নিশ্চিন্তে কাজে যোগ দিতে পারব।”
আমি বললাম, “সেটা কোম্পানিকে বললে হয় না? এত জট পাকানোর কী দরকার?”
“আমি ওই কথা বললেই ওরা চাকরিটা অন্য কাউকে দিয়ে দেবে। ভালো চাকরি তো আর সহজে পাওয়া যায় না। তাছাড়া ওদের ট্রেনিং বছরে একবারই হয়। সারা বছর ধরে ওরা ছেলেমেয়েদের ইন্টারিভিউ নেয়। বাছাই করা কয়েকজনকে ডাকে, এই সময় ট্রেনিং করিয়ে বিভিন্ন ব্রাঞ্চে পাঠায়।”
“আমি যে তোমার চাকরিটা নিয়ে নেব না সেটার কী গ্যারান্টি আছে? কারণ ট্রেনিং তো আমিই করব!”
“তুমি যে খুব সৎ আর পরোপকারী মানুষ সেটা ঘন্টুই বলেছে। আমি জানি তুমি ওই রকম করবে না!”
“তা তোমার মাইনে কত? মানে তার অর্ধেক কত হবে?”
পার্থ যে অঙ্কটা বলল তাতে আমার ভিরমি লাগার জোগাড়। কী কাজ রে বাবা যে এত মাইনে?
পার্থ আমার মনের কথা বুঝতে পেরে বলল, “বলেছিলাম তো ভালো কোম্পানি। ট্রেনিংটা একটা ফর্মালিটি। পরে যা কাজ শেখাবে তা আমি অনায়াসেই শিখে নিতে পারব। মানুষ পারে না এমন কোনো কাজ থাকতেই পারে না! তা তুমি রাজি তো?”
আমি ভেবে দেখলাম। আমি তো বেকার, বাড়িতে বসে আছি। এর মধ্যে কোনো ইন্টারভিউয়েরও ডাক পাইনি, কোনো টিউশান পর্যন্ত নেই। সেখানে এতগুলো টাকা রোজগার করার সুযোগ ছাড়তে ইচ্ছে করল না। আমি তাই বললাম, “হ্যাঁ।”
পার্থ, ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলে বলল, “আমি আগামীকাল টিকিট ইত্যাদি সব নিয়ে আসব। কাল থেকে তুমি হবে পার্থ দেবনাথ। তোমার নিজের নামটা এই ক’দিনের জন্যে ভুলে গেলেই ভালো। আর অন্য কাউকে এটা নিয়ে না বললেই মঙ্গল। মানে বুঝতেই তো পারছ এটা কিছুটা অনৈতিক কাজ হচ্ছে, তাই যত কম লোকে জানতে পারে ততই ভালো। তোমার মা-বাবাকেও না বললেই ভালো। কাজে যাচ্ছ বলতে পারো কিন্তু কোথায়, কী কোম্পানি সব কিছু ভাসা ভাসা রাখলেই ভালো।”
আমি বললাম, “ঠিক আছে। বলব না কাউকে।”
সেদিন আমি সারা রাত ঘুমোতে পারলাম না। মনে হচ্ছিল এটাও তো এক ধরনের প্রতারণাই। আবার পরক্ষণেই মনে হচ্ছিল আমি তো একজনকে সাহায্য করছি। ওকে বাবার অপারেশানের জন্যে থাকার সুযোগ করে দিচ্ছি। সেটা তো ভালো কাজ। এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই সকাল হয়ে গেল আর তখনই আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
যখন ঘুম ভাঙল তখন দেখলাম সকাল দশটা বেজে গেছে। আরে শ্যামাদির তো চলে আসার কথা। ভাবতে ভাবতেই দরজায় বেল। দরজা খুলে দেখলাম শ্যামাদি।
ভিতরে ঢুকে আমার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে শ্যামাদি বলল, “এটা একজন দিয়ে গেল। বলল তোমাকে দিয়ে দিতে।”
“কে? কে দিল শ্যামাদি? তাকে কি আমার মতন দেখতে?”
“না, এক মাথা ঝাঁকড়া চুল। চোখে কালো চশমা, তোমার মতন তো মনে হল না বাপু!”
ও তার মানে পার্থ আবার ছদ্মবেশে এসেছিল। আমি খামটা খুলে দেখলাম। ট্রেনের টিকিট, হাতখরচের জন্যে কিছু টাকা আর পার্থ দেবনাথের ভোটার আই ডি কার্ড। কার্ডে ছবিটা আমারই মনে হচ্ছে।
সঙ্গে পার্থর লেখা একটা চিঠি। তাতে সে লিখেছে যে আমি যেন ভুল করেও সঙ্গে আমার আসল নামের কোনো কিছু না রাখি। কোনো ক্রেডিট কার্ড না, কিছু না। একটা যেন নতুন ফোন কিনে নিই যাতে কয়েকটা ভুয়ো নম্বর ছাড়া কিছু সেভ করা থাকবে না। দরকারি ফোন নম্বর সব মুখস্থ রাখতে হবে।
চিঠিটা পড়ে আমার আরও মনে হতে লাগল যে আমি ভুল করতে চলেছি। এমনিতেও আমি নিজের নামের কিছুই নিতাম না, কিন্তু এটা যেন বেশি বাড়াবাড়ি। কিন্তু ওই যে টাকার লোভ, সেটা বড়ো লোভ। ট্রেনের টিকিটের তারিখ দেখলাম পরের দিনের।
শ্যামাদিকে বললাম, “শ্যামাদি, আমি কয়েকদিনের জন্যে একটু বাইরে যাচ্ছি তাই তোমাকে ক’দিন আসতে হবে না। মা-বাবা পরের সোমবার এসে পড়বেন, তখন এসো।”
শ্যামাদি এক সপ্তাহের ছুটি পেয়ে খুব খুশি। বলল, “কোথায় যাচ্ছ?”
আমি শুধু বললাম, “কয়েকটা চাকরির ইন্টারিভিউ আছে, তাই কয়েকটা জায়গায় যাচ্ছি।”
“ও আচ্ছা, তা ভালো। তা দাদা-বউদি জানে তো?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ।” আগের দিন রাতে মা-বাবাকে ফোন করে এক ঝুড়ি মিথ্যে কথা বলেছি। শ্যামাদি কাজ সেরে চলে যেতেই বেরিয়ে পড়লাম। বিস্তর কাজ রয়েছে। গোছানো রয়েছে দু’মাসের জন্যে আর কম দামি একটা ফোন কিনতে হবে।
২
টিকিটটা বেনারস যাওয়ার ছিল। সাড়ে দশ ঘন্টার সফর। রাতের বেলা ট্রেনে চেপে বসলাম আর ঘুম থেকে উঠেই বেনারস।
মালপত্র ঠিকঠাক করে সামলে নিয়ে যখন গাড়ি থেকে নামলাম তখন সকাল আটটা বাজে। পার্থ তো চিঠিতে লিখেছিল যে কেউ নিতে আসবে। তাই আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। চারিদিকে ভিড়, ব্যস্ত স্টেশনে যেরকমটা হয়। কে নিতে আসবে তো জানি না। তাকে না খুঁজে পেলেই হয়েছে! এই সব ভাবছি, এমন সময় হঠাৎ শুনলাম কে একজন ডাকছে, “মিস্টার দেবনাথ? মিস্টার পার্থ দেবনাথ?” বলে।
এই খেয়েছে আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম ওটাই আমার নাম! আমি উর্দি পরা লোকটার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললাম, “আমিই পার্থ দেবনাথ। আপনি কি আমাকে নিতে এসেছেন?”
“হ্যাঁ, চলুন আমার সঙ্গে। মালপত্রগুলোর জন্যে একজন কুলিকে ডাকি দাঁড়ান।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার মালপত্র ট্রাঙ্কে তুলিয়ে নিয়ে আমাকে বড়োসড়ো গাড়িটাতে বসিয়ে ফেলল বসন্ত। সেটাই নাকি ওর নাম।
আমাকে বলল, “এখান থেকে অনেকটা যেতে হবে। আপনার নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে। আপনার জন্যে ব্রেকফাস্ট এনেছি।”
বলে কলা ডিম পাউরুটি অরেঞ্জ জুস বার করে একটা ট্রেতে করে আমাকে দিল। সত্যিই আমার খুব খিদে পেয়েছিল। গতকাল রাতে উত্তেজনায় তেমন খেতে পারিনি। গাড়ি চলতে লাগল কাশীর রাস্তা দিয়ে আর আমি জলখাবার খেতে লাগলাম। খাবারটা শেষ করার পরই আমার প্রচণ্ড ঘুম পেয়ে গেল। বুঝতে পারছিলাম খাবারে ঘুমের ওষুধ মেশানো ছিল, কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই, বড্ড দেরি হয়ে গেছে। তারপর কী হল আমি জানি না কারণ আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
৩
যখন ঘুম ভাঙল তখন দেখলাম আমি একটা ঘরে বন্দি। ঘরে কোনো জানালা নেই, সিলিংয়ে টিমটিমে একটা আলো জ্বলছে। ঘরে একটা মাত্র দরজা আর সেটা বন্ধ। আমাকে শক্ত করে একটা চেয়ারে বেঁধে রাখা হয়েছে। হাত, পা বাঁধা, মুখে টেপ দেওয়া। একটু ধাতস্থ হতেই বেশ চমক খেলাম যখন বুঝতে পারলাম যে ঘরে আমি একা নই। আরও দু’জন ছেলে রয়েছে ঘরে! তাদের একজনের এখনও জ্ঞান ফেরেনি, কিন্তু অন্যজন জেগে রয়েছে আর বড়ো বড়ো চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সেও চেয়ারের সঙ্গে বাঁধা। আমাদের তিনজনের তিনটে চেয়ার ছাড়া ঘরে আর কোনো আসবাবপত্র কিছু নেই। মুখে শক্ত করে টেপ আঁটা তাই কথাও বলা যাবে না। আমরা দু’জনে ফ্যালফ্যাল করে পরস্পরের দিকে চেয়ে রইলাম। একটু পরেই তৃতীয় ছেলেটার জ্ঞান ফিরল। সে আমাদের দু’জনকে দেখল। নিজের বাঁধা হাত-পাগুলোকে দেখল। তারপর বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করতে করতে চেয়ারটাকে সঙ্গে নিয়ে সারা ঘরময় লাফিয়ে বেড়াতে লাগল! আমি আর অন্য ছেলেটা হাঁ করে ওর কারবার দেখছিলাম। কী করতে চাইছে ছেলে? ও মা! মিনিট সাতেকের মধ্যেই সে নিজের হাতের বাঁধন আলগা করে ফেলল! হাতের বাঁধন খুলে যেতেই নিজের পায়ের বাঁধাটাও খুলে ফেলল সে। মুখের টেপটা চড়চড় করে ছাড়িয়ে উফ আফ করল, তারপর এসে আমাদের বাঁধন খুলে দিল।
দারুণ লাগছিল ছাড়া পেয়ে। আমাদের খুলে দিয়ে ছেলেটা বলল, “আমি অর্জুন শ্রীবাস্তব, পাটনা থেকে। আমাকে এরা চাকরির লোভ দেখিয়ে এখানে নিয়ে এসে কেন এখানে বেঁধে রেখেছিল জানি না। তোমরা কে?”
বড়ো চোখ ছেলেটা বলল, “আমি সব্যসাচী সেন। বাঙালি কিন্তু জয়পুরে থাকি। আমাকেও এরা চাকরির টোপ দিয়ে এনেছে।”
ওরা দু’জনেই আমার দিকে তাকাতে আমি পার্থ নামটা বললাম। অন্য নাম বলে লাভ নেই। সেটা তো আরও প্যাঁচালো ব্যাপার হয়ে যাবে। সে সবের মধ্যে এখন ঢুকতে গিয়ে লাভ নেই। আপাতত এখান থেকে রক্ষা পেলে হয়। কথা বলে দেখা গেল অর্জুন বাংলা জানে। ওর খুব প্রিয় বন্ধু এবং পাশের বাড়ির লোকজন বাঙালি বলে। তাই আমরা বাংলাতেই কথা বলতে লাগলাম। আমাদের সবার ফোন মানিব্যাগ ইত্যাদি ওরা নিয়ে নিয়েছে। সবারই একই রকম অবস্থা। গাড়িতে তুলে কিছু খেতে দেওয়া হয়েছে আর তারপরই কিছু মনে নেই। আমার মনে হল ওই আসল পার্থ বলে ছেলেটা হয়তো এদের ব্যাপারস্যাপার টের পেয়েছিল, তাই নিজে না এসে আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে।
অর্জুন হঠাৎ বলল, “আরে অদ্ভুত ব্যাপার তো! আমাদের তিন জনেরই কিন্তু বাঁ হাতে ছ’টা করে আঙুল আছে!”
সব্যসাচী বলল, “হুঁ! তাই তো দেখছি। তা তুমি ওই ভাবে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে বাঁধন খুলতে শিখলে কী ভাবে?”
অর্জুন হেসে বলল, “আমার কাকা একজন ম্যাজিশিয়ান। উনিই এই সব বাঁধন খোলার অনেক কারিকুরি আমাকে শিখিয়েছেন। ছোটোবেলায় অনেক সময়ই কাউকে পাওয়া না গেলে আমাকে ওঁর সহকারী হয়ে কাজ করতে হয়েছে। কিন্তু এবার আমাদের প্ল্যান কী? কী করব আমরা? ওরা কেন আমাদের এখানে এনেছে? কী উদ্দেশ্য? কেন আমাদের তিনজনের বাঁহাতে ছটা আঙুল? সেটা দেখেই কি ওরা আমাদের নিয়ে এসেছে চাকরি দেবে বলে?”
সব্যসাচী বলল, “চাকরি তো আর পাওয়া যাবে না সেটা বোঝাই যাচ্ছে। প্রাণ নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারলে বাঁচি! এদিকে আমাদের তিনজনের নামও অর্জুনের নামে, সেটাও ভারী অদ্ভুত!”
সেটাতে আমি আর কিছু বললাম না। ওরা তো ঠিকই অর্জুনের নামের ছেলে বেছেছিল কিন্তু সে-ই তো নিজের বদলে আমাকে পাঠিয়ে দিল।
যাই হোক, আমরা তিনজনে মিলে পরিকল্পনা করলাম যে একজন বা দু’জন যে কেউ আসুক আমরা তিনজন তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের কাবু করে ফেলব। সে তো আশা করবে যে আমরা বাঁধা রয়েছি তাই তত সতর্ক থাকবে না। ঘরে জানালা নেই। একমাত্র দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ আর বেশ শক্ত। চেয়ার দিয়ে মেরে মেরেও আমরা সেটাকে এক চুলও নড়াতে পারিনি। ক্লান্ত হয়ে আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম।
অর্জুন ঘরের বাল্বটা খুলে নিল চেয়ারে উঠে যাতে ওরা যখন ঢুকবে তখন যেন কিছু না দেখতে পায়। অন্ধকারটা আমাদের চোখ সওয়া হয়ে গেল। একটু পরেই বাইরে থেকে আওয়াজ পেলাম। আমরা টানটান হয়ে উঠে দাঁড়ালাম।
অচেনা একজন লোক এসে ঢুকল। আমরা তিনজন তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম অন্ধকারের মধ্যে। তাকে আমরা কাবু করে ফেললাম কিন্তু তার সঙ্গে যে এসেছিল সে পালিয়ে গেল। অর্জুন বলল, “ও আমাকে গাড়ি করে নিয়ে আসছিল। বলেছিল ওর নাম হেমন্ত।”
হেমন্তকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। শুরু হল আরেক অধ্যায়। আমরা তিনজন ঘরটা থেকে বেরিয়ে বুঝলাম ওটা একটা ছোটো আউটহাউস মতন। আশপাশে কিছু নেই। ছোটো বড়ো পাথরের ঢিবি, কয়েকটা গুহা মতন আর কিছু গাছপালা। কোনো বসতি নেই, কোন রাস্তাও দেখা যাচ্ছে না। অর্জুন বলল, “মনে হচ্ছে মধ্য প্রদেশের কোনো একটা জায়গা। প্রচুর হাঁটতে হবে।”
সব্য বলল, “ওরা তো হেঁটে আমাদের আনেনি। আমরা তো অজ্ঞান ছিলাম। আর হেমন্তও তো শহর থেকে এতটা হেঁটে আসেনি। গাড়ি আশপাশেই কোথাও লুকিয়ে রেখেছে ওরা। বাড়িও কাছেপিঠেই কোথাও হবে। আমাদের খুঁজে বার করতে হবে।”
আমারও মনে হল কথাটা ঠিক। গাড়ি কোথাও না কোথাও কাছেই আছে। আমাদের শুধু খুঁজে বার করতে হবে। কিন্তু কোনদিকে যাব তো কিছুই জানা নেই। আমরা তিনজন যা থাকে কপালে ভেবে একটা দিক বেছে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। ওরা ইচ্ছে করেই মনে হয় আমাদের পায়ের জুতো খুলে নিয়েছিল, ফলে হাঁটা বেশ কঠিন হয়ে পড়ছিল। পাথরগুলো ভেঙে পড়ছিল আমাদের পায়ের চাপে আর ফুটছিল। আমরা জামার টুকরো ছিঁড়ে পায়ে বেঁধে হাঁটতে লাগলাম। হঠাৎ একটা চাঁইয়ে পা দিয়ে এগোতে গিয়ে পড়ে গেল অর্জুন। পাথরে আঘাত লেগে মাথায় চোট পেল সে, রক্ত পড়তে লাগল। একটু পরেই সে জ্ঞান হারাল।
আমি আর সব্য ওকে পাঁজাকোলা করে পাশের একটা গুহাতে নিয়ে গেলাম। নিজেদের জামা ছিঁড়ে পট্টি বাঁধলাম ওর মাথায়।
আমি তখন সব্যকে বললাম, “ওর তো মনে হয় ডাক্তার লাগবে। গাড়ি একবার পেয়ে গেলে তো ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু গাড়ি পাওয়াটাই বড়ো ব্যাপার।”
সব্য বলল, “আমাদের একজনকে ওর সঙ্গে থাকতে হবে।”
আমি ভেবে বললাম, “হ্যাঁ।”
“অর্জুন? এই অর্জুন?” বলে ওকে ঝাঁকিয়ে ডাকতে সে চোখটা একটু খুলল।
সব্য বলল, “ওর মনে হয় কনকাশান হয়েছে। মাথায় জোর আঘাত পেয়েছে তো। ওকে বেশি নড়ানো ঠিক হবে না। আমিও আর হাঁটতে পারছি না। পা ছড়ে গেছে ভয়ানক রকম। তুই পারলে গাড়ি নিয়ে আয় নাহলে আমরা দু’জন এখানেই মরব।”
আমি বললাম, “কী বাজে কথা বলছিস! বাঁচলে তিনজনই বাঁচব না হলে সবাই মরব। এক যাত্রায় পৃথক ফল হবে না। অর্জুন না থাকলে আমরা তো এখনও চেয়ারে বাঁধা অবস্থাতেই পড়ে থাকতাম ওই আউটহাউসে, সেটা কী করে ভুলব?”
আমরা দু’জনে মিলে অর্জুনকে আরও একটু গুহার ভিতরের দিকে নিয়ে গিয়ে শোয়ালাম যাতে বাইরে থেকে দেখতে না পাওয়া যায়।
সব্যকে বললাম, “তুইও একটু বিশ্রাম নিয়ে নে। এর পর কী হবে তার ঠিক নেই।”
আমি যখন বেরিয়ে যাচ্ছি তখন অর্জুন অস্ফুট স্বরে হিন্দিতে বলল, “সাবধানে যাস বন্ধু!”
সত্যি এই কয়েক ঘন্টা একসঙ্গে থেকে আমরা এমন বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম যেন কত দিনের বন্ধুত্ব। ওদের ওখানে ফেলে আমার একা পালিয়ে যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। সেই রকমটা আমি কোনোদিনও করিনি আর করতে চাইও না।
আমি একা গুহা থেকে বেরিয়ে এগোতে লাগলাম। মনে হচ্ছিল আমিই যেন পৃথিবীতে একলা মানুষ! একটা বেশ উঁচু ঢিবি দেখতে পেলাম সামনে। ঢিবি নয়, যেন ছোটোখাটো পাহাড়ই। আমার মনে হল আমি যদি ওটার ওপরে উঠতে পারি তাহলে চারিদিকটা ভালো করে দেখতে পাব আর তখন আন্দাজ করতে পারব কোথায় কী আছে। সেই ভেবেই আমি উঠতে শুরু করলাম। ওঠাটা যতটা শক্ত ভেবেছিলাম ততটা শক্ত নয় দেখলাম। পাথরের খাঁজে পা ঢুকিয়ে হাত দিয়ে চেপে ধরে ইঞ্চি ইঞ্চি করে ওপরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। বেশিক্ষণ লাগল না একেবারে ওপরে উঠে যেতে। সেখানে দাঁড়িয়ে সত্যিই চারিদিকটা দেখা যাচ্ছিল। কিছুটা দূরে একটা বড়োসড়ো বাড়ি রয়েছে দেখতে পেলাম। আমার মন বলছিল আমাদের অপহরণের পিছনে ওই বাড়ির কারও হাত আছে।
হঠাৎ ‘দুম’ করে একটা শব্দ হল!
কেউ গুলি চালাচ্ছে! আমাকে দেখতে পেয়েছে কেউ! আমি পাথরের ওপর শুয়ে পড়ে গড়িয়ে গড়িয়ে যে দিক থেকে গুলিটা এসেছিল মনে হয়েছিল তার উলটোদিক দিয়ে নামতে লাগলাম।
আবার ‘দুম!” করে গুলির আওয়াজ।
ভয়ে ঘামছিলাম আমি। আমার মনে হল এই পাহাড়ের ওপরেই গুলি খেয়ে মরে যাব আমি। আর আমি মরে গেলে আহত অর্জুন আর সব্যর বাঁচার কোনো রাস্তাই থাকবে না।
তারপরই আমি দেখতে পেলাম আমার দিকে লক্ষ্য করে কে গুলি চালাচ্ছে! বসন্ত! যে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে! বন্দুক নিয়ে বসন্ত পাহাড়টায় উঠে আসছে। আমাকে গুলি করে মারবে সে! আমি দেখলাম, আমার কাছে একটাই অস্ত্র, পাথর! যেমন ভাবা তেমনই কাজ, আমি হাতে তোলা যায় এমন সাইজের পাথর তুলে তুলে বসন্তের দিকে ছুড়তে লাগলাম। বসন্তের নিশানা খুব একটা ভালো নয় বলতে হবে কারণ আমাকে মারতে পারল না সে। আর আমার ছোঁড়া তিনটে পাথরেই কাজ হল। বসন্ত মাথা ধরে বসে পড়ল আর তার হাত থেকে বন্দুকও পড়ে গেল। আমার ছোঁড়া পাথর ওর মাথায় লেগেছে। আমি ওর হাত থেকে পড়ে যাওয়া বন্দুকটা কুড়িয়ে নিলাম। বসন্ত মরেনি, কেবল অজ্ঞান হয়েছে। ওর পকেট হাতড়ে দেখলাম। না, কোনো ফোন নেই। এই ধ্যাড়ধ্যাড়ে গোবিন্দপুরে হয়তো কোনো সিগনালই থাকে না, তাই ফোন নিয়ে ঘুরে আর কী হবে? ওর পা থেকে জুতোগুলো খুলে নিলাম আমি, কিন্তু খুব একটা সুবিধা হল বলা যাবে না। বসন্তের পা খুব বড়ো। যাই হোক, কোনো রকমে জুতো জোড়া পায়ে পরে নিলাম। বসন্তকে এক গাদা পাথর চাপা দিয়ে পাহাড় থেকে নামতে লাগলাম। ওই বড়ো বাড়িটায় যেতে হবে আমাকে। সেখানেই রয়েছে আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর।
লুকিয়ে লুকিয়ে এ গাছ ও গাছের পিছন দিয়ে দিয়ে আমি যখন বড়ো বাড়িটার কাছে পৌঁছলাম তখন আমি হাঁপাচ্ছি। গাছের ডাল লেগে আমার হাত পা মুখ সব ছড়ে গেছে। ওই বড়ো জুতো পরে হাঁটাটাও একটা বিড়ম্বনা! কিন্তু আমার মনে হল যেন আমার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।
বড়ো বাড়িটার দরজা খোলা, কোনো পাহারা নেই। পাহারাদাররা মনে হয় সব আমাদের খুঁজতে ব্যস্ত। আমি ছায়ার সঙ্গে মিশে পা টিপে টিপে বাড়িটায় ঢুকে পড়লাম। সামনের বিশাল খোলা উঠোনে দেখলাম বড়োসড়ো যজ্ঞের আয়োজন হয়েছে। একজন জটাজূটধারী রক্তচক্ষু সাধুবাবা গোছের লোক যজ্ঞের আগুনে ঘি ঢেলে চলেছে আর কী সব মন্ত্র পড়ছে বিড় বিড় করে। তার পরনে লাল পোশাক। সামনে একজন ফরসা লম্বা লোক বসে রয়েছে। তার পাশে মনে হয় তার স্ত্রী আর মহিলার কোলে একটা বছর চারেকের ছেলে। বাচ্চাটা ঘুমোচ্ছে। তাদের জন্যেই যজ্ঞ হচ্ছে কি?
এরা কারা? আমাদের কেন ধরে এনেছে?
লাল পোশাকের সাধু হিন্দিতে বলল, “কী হল? এত দেরি লাগছে কেন? যজ্ঞের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে তো!”
ফরসা লোকটা বলল, “জানি না, বুঝতে পারছি না। হেমন্ত আর বসন্ত দু’জনকেই পাঠালাম তো ওদের আনতে। কেন যে এত দেরি করছে। জনার্দন? এই জনার্দন?”
ডাক শুনে একটা ষন্ডা মার্কা লোক ছুটে এল।
“জি সাহেব?”
“তুমি মনোজকে নিয়ে যাও তো। আমার মন বলছে কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে। আর শোনো, বন্দুকটা নিয়ে যাও।”
“বসন্ত তো একটা বন্দুক নিয়ে গেছে সাহেব,” জনার্দন বলে লোকটা বলল।
“ঠিক আছে, তোমরাও নিয়ে যাও। ওই তিনজনকে তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো। বলি দেওয়ার সময় পার হয়ে গেলে মুশকিল হবে!”
আমার মাথায় বাজ পড়ল। আমাদের তিনজনকে বলি দেওয়ার জন্যে এখানে আনা হয়েছিল! কী সর্বনাশ!
সাধুবাবা আরোগ্য নিয়ে কী সব বলতে বলতে বাচ্চাটার দিকে কী সব ছুঁড়ে দিচ্ছিল। আমার মনে হল বাচ্চাটা মনে হয় অসুস্থ। তারপর আরেকটা জিনিস দেখতে পেলাম। বাচ্চাটার বাঁহাতে ছ’টা আঙুল! তার মানে বাচ্চাটার কিছু একটা অসুখ করেছে। তাকে সারিয়ে তোলার জন্যে আমাদের তিনজনকে আনা হয়েছে বলি দেওয়া হবে বলে। ওই সাধুবাবার মাথায় বুদ্ধি এসেছে যে তিনজন জোয়ান বাঁহাতে ছ’টা আঙুলওয়ালা ছেলেকে নিয়ে এসে বলি দিলে বাচ্চাটা সেরে উঠবে আর বাচ্চাটার কুসংস্কারাচ্ছন্ন মা-বাবাও তার কথায় বিশ্বাস করেছে! আরে বাবা শহরে নিয়ে গিয়ে ভালো ডাক্তার দেখালে কাজ দিত! কিন্তু এবার? এবার আমি কী করব? উঠোনের একটা কোনায় একটা বড়ো আসবাবের পিছনে লুকিয়ে রয়েছি আমি। ফোন পেলে যে কাউকে ফোন করে বলব কোথায় আছি তাও তো বলা যাবে না। আমি তো জানিই না আমরা কোথায় আছি। এই পাহাড় জঙ্গলের মধ্যে এরা বাড়ি করেছে কেন কে জানে। কিন্তু গাড়ি যখন আছে তখন রাস্তাও থাকবে। কিন্তু সব্য আর অর্জুন যেখানে আছে সেখানে গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে না। অর্জুনকে নড়ানো যাবে না তাই আমাকেই কিছু করতে হবে। এখানে আর থেকে লাভ নেই। ধরা পড়লে বলি দিয়ে দেবে এরা!
আমি আবার পা টিপে টিপে বাইরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম।
বাইরে বেরিয়ে বাড়িটাকে একটা পাক মারতেই দেখতে পেলাম গাড়িটাকে। যে গাড়িটা করে বসন্ত আমাকে স্টেশন থেকে নিয়ে এসেছিল সেটাই! বসন্তের পকেট হাতড়ে সবচেয়ে দামি যে জিনিসটা আমি উদ্ধার করেছিলাম সেটা বার করে গাড়ির দরজা খুলে ঢুকে বসলাম। বসন্তর পকেট থেকে গাড়ির চাবিটা ভাগ্যিস নিয়েছিলাম। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম। ততক্ষণে জনার্দন আর মনোজ বেরিয়ে এসেছে। তারা আমাকে দেখে হই হই করে ছুটে এল। আমি প্রচণ্ড গতিতে গাড়িটাকে একেবারে সরাসরি ওদের দিকে চালিয়ে নিয়ে গেলাম। একেবারে সিনেমার মতন! ওরা নিজেদের বাঁচাতে পারলে বাঁচাক। এমনিতেই দু-একটা আরশোলা মরলে আমার কিছু যাবে আসবে না। আমার গতি দেখে তারা ভয়ে রাস্তা থেকে লাফ দিয়ে সরে গেল। পরক্ষণেই নিজেদের সামলে নিয়ে গুলি ছুড়তে লাগল। তা ছুড়বি ছোড়! তোদের মালিকের গাড়িটাই নষ্ট হবে! ভাগ্যিস গাড়ি চালানোটা জানা ছিল!
ওই গাড়ি নিয়েই আমি রাস্তায় উঠে গেলাম। তারপর প্রবল জোরে গাড়ি চালিয়ে রাস্তা দিয়ে সোজা চলতে লাগলাম যতক্ষণ না কোনো মানুষজন, দোকানপাট ইত্যাদি দেখতে পেলাম। গাড়ি থামিয়ে দোকানের লোকজনের কাছ থেকে পথনির্দেশ নিয়ে একেবারে পুলিশ স্টেশন। পরে পুলিশের সঙ্গে করে আবার ওই গুহার কাছে এসে অর্জুন আর সব্যকে নিয়ে গিয়েছিলাম। অর্জুনকে ওরা হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করেছিল।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, বড়ো বাড়িতে গিয়ে পুলিশ কাউকে দেখতে পায়নি। সাধুবাবা, অসুস্থ বাচ্চা ও তার মা-বাবা আর তাদের চেলাচামুন্ডা সবাই হাওয়া। এমনকি বসন্তকে যে আমি পাথর চাপা দিয়ে ফেলে এসেছিলাম সেও হাওয়া।
পুলিশদের কাছেই আমরা পরে পুরো ব্যাপারটা জেনেছিলাম। সত্যি ঘটনা, কিন্তু গল্পের মতন।
পুলিশের প্রধান যা বললেন তা হল, “ওই এলাকার এককালের জমিদার ছিলেন সূর্য প্রতাপ রঘুবীর। তাঁর ছিল দুই ছেলে। আদিত্য প্রতাপ আর দীনেশ প্রতাপ। সূর্য প্রতাপের নাকি এককালে খুব দাপট ছিল। সবাই ভয় করত তাঁকে, কিন্তু ছোটো ছেলে দীনেশ একটা অদ্ভুত অসুখে মারা যাওয়ার পর তিনি একদম অন্যরকম হয়ে যান। দীনেশ মারা যাওয়ার কিছুদিনের পরই সূর্য প্রতাপের স্ত্রী মানে দীনেশের মাও মারা যান। এর পর সূর্য প্রতাপ জ্যোতিষী, সাধু বাবা, কাপালিক, ওঝা, তাবিজ, কবজ, তন্ত্র মন্ত্র এই সব কিছু নিয়েই মেতে ছিলেন তাঁর বাকি জীবনটা। শেষের দিকে লোকে বলে নাকি সাধুবাবার খপ্পরে পড়েছিলেন তিনি। সেই সাধু যে আসলে কে, কোথা থেকে উদয় হয়েছিলেন কেউ জানে না। আমাদের পুলিশ মহলে আলোচনা হয়েছিল যে সে নাকি জেল থেকে ছাড়া পাওয়া বা পালিয়ে যাওয়া কোনো এক আসামী যে সাধু সেজে বসে আছে, কিন্তু কোনো প্রমাণের অভাবে তাকে ধরা যায়নি। সেই সাধুকেই নাকি নিজের কুলগুরু বানিয়ে ফেলেন সূর্য প্রতাপ। ওই জঙ্গলের মধ্যে বাড়িটা সাধুবাবার থাকার জন্যেই বানানো হয়েছিল। এমনিতে গ্রামে ওদের বড়ো বাড়ি আছে আর সাধুবাবাও বেশির ভাগ সময় সেখানেই থাকেন সবার সঙ্গে। লোকে জানে জঙ্গলের বাড়িটা অনেকদিন ধরে খালি পড়ে আছে। তবে লোকে ওদিকে খুব একটা যায়ও না। সবাই মনে করে সাধুবাবা তন্ত্র মন্ত্র ইত্যাদি করেন, তাই শাপ দিয়ে দিতে পারেন। এখানকার স্থানীয় মানুষ বড্ড কুসংস্কারে বিশ্বাসী। তা সাধারণ মানুষকেই বা দোষ দিই কী করে? আদিত্য প্রতাপ আর তাঁর স্ত্রীও তো ওই সব বুজরুকিতে বিশ্বাস করেন দেখা যাচ্ছে। সেই জন্যেই ছেলে অসুস্থ হতে ডাক্তার না দেখিয়ে ওষুধ না খাইয়ে বাড়িতে যজ্ঞ করা হচ্ছে। ওই ভণ্ড সাধুবাবাও যা মনে এসেছে ওদের বলেছেন আর ওরাও অন্ধের মতন তাই মেনে চলেছে। বাচ্চা ছেলেটার বাঁহাতে ছ’টা আঙুল আছে বলেই মনে হয় ওই বাবাজি বলেছিলেন যে যজ্ঞের সময় তিনজন ছ’টা আঙুলধারী ছেলেকে বলি দিতে হবে, তাহলেই বাচ্চাটা সেরে উঠবে! কী সাংঘাতিক! ছেলেটার নাম অর্জুন, তাই যে ছেলেগুলোকে বলি দেওয়া হবে তাদের নাম অর্জুন বা একই অর্থের হলে ভালো হয়! গাঁজাখুরির একশেষ! অঢেল টাকা, তাই কী করবে বুঝতে না পেরে ওই সব করছে। চারিদিকে লোক লাগিয়ে খোঁজখবর করে তোমাদের তিনজনকে ধরে আনিয়েছে। এখন গা ঢাকা দিয়েছে কোথাও, তবে কত দিন আর গা ঢাকা দিয়ে থাকবে? ঠিক লেজ ধরব একদিন আমরা!”
###
আমরা তিনজনেই এখন ভালো আছি। অর্জুন পুরোপুরি সেরে উঠেছে। আমাদের অপহরণের কেসটা মনে হয় শেষ পর্যন্ত ধামা চাপা পড়ে গেছে, কিন্তু আমরা হাল ছাড়িনি। আমরা চারজনে মিলে একটা এন জি ও সংস্থা খুলেছি। চারিদিকে ঘুরে ঘুরে কুসংস্কার বিরোধী কথা বলি। ও আচ্ছা, চারজন কে কে সেটাই তো বলা হয়নি। আমি, সব্য, অর্জুন আর পার্থ, মানে আমার সেই ডপেলগ্যাঙ্গার। সে এখন চুলের স্টাইলটা কিছুটা আলাদা করেছে, তাই তাকে আর অতটা আমার মতন দেখতে লাগে না। মিথ্যে কথা বলে আমাকে সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখে পাঠাবার জন্যে সে আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। সে কিছুটা খোঁজখবর নিয়ে বুঝতে পেরেছিল ওরা কী রকম লোকজন আর এটাও বুঝেছিল ঠিক নিজের মতন কাউকে না পাঠাতে পারলে ওরা ওকে ধরে বেঁধে নিয়ে যাবে এসে, তাই আমাকে লোভ দেখিয়ে পাঠিয়েছিল।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম, এখন আমরা চারজন বিভিন্ন জায়গায় জায়গায় গিয়ে সবাইকে আমাদের অভিজ্ঞতার কথা বলি। টিভিতেও বিভিন্ন চ্যানেল থেকে ডেকেছে আমাদের। আমাদের অভিজ্ঞতার কথা শুনে যদি দু-চারজন মানুষও কুসংস্কার ত্যাগ করে তাহলেই আমরা নিজেদের সফল মনে করি।
----------
ছবি - অতনু দেব
Khub valo laglo.. omekdin por erokom adventure porlam
ReplyDelete