রূপকথা
জয়তী রায় মুনিয়া
কেউ যদি ভুবনডাঙ্গার তোতনকে না চিনে থাকেন, সে দোষ তাদের। বলে না? চোখ থাকতেও অন্ধ। আরে মশাই, তোতন হল ভুবনডাঙ্গার এক নম্বর বিচ্ছু ছেলে। মোটে বারো-তেরো বছর বয়স হবে। তা বয়স ধুয়ে কি জল খাব? ওই বয়সে সে সুপারম্যান, টারজান - এদের ঘোল খাইয়ে ছেড়ে দেবে। রাতদুপুরে চলে যাবে শ্মশানে, সুনসান মাঠে। ভয়? ও বস্তুটি তোতনকুমারের কুষ্ঠিতে লেখা নেই।
কেউ দেখি চোখ মিটমিট করে জিজ্ঞেস করে - বলি, ভুবনডাঙ্গা কোথায় বাপু? কোন নদীর ধারে? সেখানে আছেটা কী যে এত গপ্প ফেঁদে বসেছ? সবজান্তা লোকেদের নিয়ে এই হল সমস্যা!
তারা ঘাড় নেড়ে বলবে - গল্প তো এমনি জন্মায় না, তার কার্যকারণ তো থাকতে হবে।
কোথায় লেখা আছে এমন কথা? গল্পের কারণ তো বাপু, ঘরে বসেই জন্ম নিতে পারে, আর এই এলাকায় জল জঙ্গল দুষ্টু লোক মিষ্টি লোক কোনটা নেই! লক্ষ্মীনদী মধুমতি আছে, ঘন জঙ্গল আছে, আর কী কী আছে সে না হয় আমরা নিজেরা গিয়েই দেখে নেব।
* * *
তো, কথা হচ্ছিল তোতনকুমারের। লোকে কুকথা কইতে ছাড়বে কেন? বলি, তোর মা নেই। বাপ পাগল। পাতানো মাসি মেসো দখল নিল জমি বাড়ির। তবু, তোর চৈতন্য হয় না?
সারাদিন নালিশ শুনেও, ছেলের টোল পড়া গাল থেকে হাসি মোছে না। টানা চোখ দুটো থেকে জল ঝরে না। সে ইস্কুল যেতে পারে না বটে, কিন্তু, ভাগের দুটি বাতাসা দেবে পান্তাবুড়িকে। পুকুরধারে ছেঁড়া কাপড়ের তলায় ঘুমিয়ে থাকে থুত্থুরে, সাদা শনের মতো, চোখে না দেখা ওই বুড়ি।
আর, ওই যে হিরু গোয়ালার অন্ধ গরু? যাকে মাঠে বেঁধে রাখে হিরু, তার গলকম্বলে হাত বুলিয়ে দিয়ে আসে। আরও কত কী করে তোতনকুমার। রাস্তার পাশের বুড়ো বটগাছের গোড়ায়, ফেলে রাখা শুকনো ফুল পরিষ্কার করে। ওখানে আছে এক ন্যাড়া পাথর। সিঁদুর লেপে একশা করে ভগবান বানিয়ে ফুল-পাতায় ভর্তি করে রেখে দেবে। তা, দিনের মধ্যে সময় পেলেই কচি কচি দুটি হাতে বটের গোড়া পরিষ্কার করে নিকিয়ে দিয়ে আসবে তোতন। তার ভাই সাধন এ সমস্ত ভিখারী কাজে মোটে পাত্তা দেয় না। সে এখন রায়বাড়ির সম্পত্তির মালিকের ছেলে, কেমন বুক উঁচিয়ে, চুলে টেরি কেটে ইস্কুল যায়। গম্ভীর মুখ। ছেঁড়া গেঞ্জি, ঢলঢলে হাফপ্যান্ট পরা, তোতনকে সে চিনতে চায় না।
* * *
কেউ যদি বলে, ওরে ও পাগলা, সারাদিন আদাড়ে বাদাড়ে ঘুরিস যে বড়ো। ওই দেখ তোর ভাই, কেমন বাবুদের ছেলের মতো টেরি কেটে বইখাতা হাতে ইস্কুল যায়... ওরে তোর যে কিছু হল না রে।
তোতন ব্যস্ত হাত সামলে উত্তর দেবে - সাধন আমার ভাই। যাক না ইস্কুল। এত কাজ ফেলে কোথায় যাব আমি?
লোক অবাক। ভাই? সম্পত্তি দখল করে নিল যারা, তাদের ছেলে তোর ভাই? আর, কাজ কী করিস তুই, যত অ-কাজ।
তোতন বলবে - তাই বুঝি? তবে তোমার বাড়ির শিবের পুজোর ধুতরো ফুল এনে দিল কে? মৌচাক ভেঙে মধু ঝরাল কে? ওই দিন হরেন জ্যাঠার ওষুধ মধুমতির জল ঠেলে এনে দিল কে?
লোক তাড়াতাড়ি বলবে, থাক থাক। বেঁচে থাক। সত্যিই তো সেদিন অমন ডিঙি বেয়ে নদী না পেরুলে হারান জ্যাঠা প্রাণে বাঁচত না।
* * *
ইস্কুলে একেবারে যেত না যে তা তো নয়। কিন্তু, ফি মাসে, মাস্টার বলবে - ও তোতন, তোমার মাসি মাইনে তো দিল না বাপ। সে না দিক। তোমার বাবার খাতক ছিলাম এককালে। বই-টই আমি দেব। মাইনে লাগবে না। তুমি এসে পড়া করো। অঙ্কে এমন পরিষ্কার মাথা তো কারও নাই।
ক্লাসের মধ্যে বসে ছিল সাধন। মুখ ফুলিয়ে কোঁচা দুলিয়ে জুতো শানিয়ে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলে উঠল - এই ও মাস্টার। তোতনের মাইনে তুমি দেবে? দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা।
সারা ক্লাস জুড়ে থমথম অবস্থা। মাস্টার চুপ। কে কথা বলবে? কার ঘাড়ে ক’টা মাথা? সাধনের বাপ, যে কিনা তোতনের পাতানো মেসো, সে তো খুনে ডাকাত একটা।
মাস্টারের কাঁচুমাচু মুখ দেখে ভারি দুঃখ হয় তোতনের। ইস্কুল না গেলেই চুকে গেল ল্যাঠা। শীতের দুপুরের রোদ্দুর মাথায় করে কড়াইশুঁটি আর পালং খেতের পাশ দিয়ে যেতে যেতে তোতনকুমার ভাবে, একদিক দিয়ে ভালোই হল। গোয়াল ঘরের কোনায় বসে থাকা রুখু চুলের দুখি বাবা আর একলা থাকবে না।
* * *
সাধন যখন ঘোড়ার গাড়ি চেপে এদিক ওদিক যায়, সাতটা লোকের সেবা যত্নে দেমাকে পা পড়ে না মাটিতে, আবছা ছবি ঘিরে আসে... চেনা চেনা ছবি। বাড়ি ঘর গাড়ি ধন দৌলত। সোনার নুপূর ছমছম করে কচি ছেলের ছবি... দরাজ গলায় হেসে উঠে কোলে তুলে নেওয়া বাবা? তোতনের বছর তিনেক বয়সের সময় সরল সাধাসিধে রায়বাবুর বাড়ি উপস্থিত হল তার দূর সম্পর্কের শালী, তার বর পঞ্চানন আর এই এতটুকু ছেলে সাধন। এসেই দিদি-জামাইবাবুর হাতে পায়ে ধরে কী কান্না! কী কান্না!
- এড্ডু থাকতে দে বনডি। কুথায় যাই বল? রাক্ষুসে বান সব কেড়ে নিয়ে চলে গেল!
তা, না থাকতে দেবার কী আছে? থাকো। খাও। ইস্কুল যাও। ঘোড়েল লোক পঞ্চানন, এক লহমায় বুঝে গেল, এরা সরল। এদের ঠকানো খুব সোজা। এক্কেবারে জলের মতন।
তোতনের মায়ের কথা উঠলে আজও গাঁয়ের লোক জোড় হাত করে প্রণাম জানায় - সাক্ষাৎ মা দুগ্গা ছিলেন গো রায়গিন্নি। যেমন রূপ তেমন মন। লালপাড় শাড়ি, পায়ে আলতা, কালো চুলে লাল সিন্দুর, অঙ্গে ঝকমক গহনা... গাঁয়ের মানুষ সুখে তো মায়ের চোখে হাসি না হলে ছলছল করে।
আর রায়বাবু? গোলাভরা ধান, নদী পুকুর বিল ভরা মাছ, জঙ্গল হতে কাঠ... রায়বাবুর সিন্দুক ঝিমঝিম করে টাকা। সে টাকায় তৈরি হয় ইস্কুল। রাস্তা হয় পাকা, মধুমতির জলের ধারে পাথরের ঘাট হয়। ভুবনডাঙ্গা যেন এক টুকরো স্বর্গ। সেখানে মানুষ জন পাখ পাখালি গাছ গাছালি সব্বাই সুখী।
* * *
পঞ্চানন দুই দিনেই বুঝে গেল এটা হল বোকাদের দেশ। হ্যাঁ, ভালো মানুষদের কূট লোকেরা বোকা ভাবে। পঞ্চানন ফিসফিস করে বউকে বলল - সবার আগে তোর পাতানো বোনের ভবলীলা শেষ করতে হবে।
রাতের অন্ধকারে শুরু হল শলা। শিকড়-বাকড় বেটে-বুটে কী সব ওষুধ বানিয়ে অল্প অল্প মিশিয়ে মিশিয়ে দিতে লাগল খাবারে। অমন সোনার বরণ রায় গিন্নি শুকিয়ে যেতে লাগল। রায়বাবু দুর্বল হয়ে যেতে লাগলেন। মারি তো গন্ডার লুটি তো ভান্ডার - পাঁচ সাত বছরের মধ্যে পঞ্চা হয়ে উঠল হত্তা কত্তা। গাঁয়ের মাথা। জামাইবাবুকে ওষুধ খাইয়ে খাইয়ে ভোম বানিয়ে রেখে, দিদিটাকে তো মেরেই ফেলল। তোতনকেও কিছু করত। বাদ সাধল বাড়ির পুরোনো কিছু চাকর-বাকর। যদিও গুন্ডা ডাকাত পঞ্চানন তাতে ঘাবড়ে যাওয়ার পাত্র নয়। ততদিনে সে নিজের একটা সাংঘাতিক দল করে নিয়েছে। তাদের ভয়ঙ্কর মেজাজ, গুলি পাকানো দশাসই চেহারা, কথায় কথায় মানুষ খুন করতে পারে। গাঁয়ের নিরীহ লোকজন ভয় খেয়ে গেল।
* * *
ভুবনডাঙার জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে কম বন্ধু হয়নি তোতনের। হুতোম প্যাঁচা, বেজি, ফণা তোলা কেউটে, বনবিড়াল... এরা কখখনো অকারণে কামড়ায় না। পান্তাবুড়ি
লাঠি ঠক ঠক করে বলে - তুই জঙ্গলের গভীরে যা। ওখানে আছে পুরোনো ভাঙা দেউল। ওর মধ্যে এক গর্ত। তাতে আছে এক মণি। সেটা পেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
ধুর। পান্তাবুড়ির কথার কোনো দাম আছে না কি! ভুবনডাঙার জঙ্গলের এ মাথা ও মাথা চষে খেয়েছে তোতন, দেউল তো দূর, এক পাঁজা ইট নেই কোথাও। তবে কি এমনি করেই দিন যাবে ভালো ছেলেটার! সুখের মুখ দেখবে না কোনোদিন? আহা রে, মুখখানি শুকিয়ে এইটুকু হয়ে রয়েছে। গাছের তলায় শুয়ে ঘুমিয়ে আছে।
আজ তোতনের খাওয়া জোটেনি। জুটেছে প্রচণ্ড মার। দোষের মধ্যে সাধনের জামার ভিতর ছিল ছোট্ট নেংটি। সাধন তো লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে চেঁচিয়ে পা মচকে ফেলল। নাদুস নুদুস গাবলু সাধনের কান্না দেখে মাসি বেদম মারতে মারতে বলেছে, যত ইঁদুর বান্দর বন্ধু। আমার সোনার ছেলেটাকে জ্বালিয়ে মারলে গো।
তোতন শব্দ না করে মার খেয়েছে। সে জানে ওই গোয়ালঘরে চুপ করে বসে থাকা বাবার চোখে জল আসবে যদি তোতন কাঁদে। নাহ্। সে মরে যাবে তবু শব্দ করে কাঁদবে না!
আজ তোতনের করুণ অবস্থা দেখে, পুরো দলটার মধ্যে রাগ জেগে উঠল। না! এবার একটা কিছু করতেই হবে।
সবাই মিলে ঘন জঙ্গলে গোল হয়ে বসে মিটিং ডাকল। পেঁচা, ইঁদুর, বেজি, সাপ, ভূত - মায় গাছেরা পর্যন্ত - মরিয়া সব - আজ একটা বিহিত করতেই হবে। আজকের মিটিংয়ের নেতা হল কালুপেঁচা। সে গম্ভীর মুখে বলল - জঙ্গলের খবর যে যতটুকু জানো, বলে ফেল।
বিষধর বলল - পান্তাবুড়ির কথা মতো দেউল খুঁজতে বেরিয়ে কিছুই পাইনি। তবে বিরাট এক গভীর খাদ দেখেছি।
দুষ্টু নেংটি ল্যাজ তুলে বলল - আমি এক সুড়ঙ্গ দেখেছি।
গঙ্গা ভূত বলল - আমি শ্মশানে কালীমন্দিরের নিচে গর্তের মধ্যে ঘটি দেখেছি।
বোঝো ঠ্যালা! কে কোনদিকে যাবে এবার? উপায় বাতলে দিল প্রাচীন বটগাছ। বলল - সুড়ঙ্গ দিয়ে শুরু কর। ইচ্ছের জয় হউক।
অন্ধকার সুড়ঙ্গ। আগে আগে গঙ্গা ভূত। সে নিজেই আলেয়ার মতো জ্বলতে লাগল। তারপরে বনবিড়াল। তার ল্যাজ ধরে তোতন, তারপর একে একে সব। প্যাঁচা বসে রইল বটবৃক্ষের মাথায়। পঞ্চা খুনেকে বিশ্বাস নেই। একবার যদি টের পায়, তবে একেবারে কচ কচ কচাৎ। পেঁচা হল শ্রেষ্ঠ পাহারাদার। নিমেষে খবর পৌঁছে যাবে। এদিকে সুড়ঙ্গ যেন শেষ আর হয় না। এঁকে বেঁকে জলের ধার ঘেঁষে চলছে তো চলছেই। প্রাচীন বটবৃক্ষ হল মুনি-ঋষির মতো। প্রতিটি পাতায় পাতায় সত্য খেলা করে। সে যখন বলেছে, চলার শেষে ফল মিলবে, তখন মিলবেই। সত্যিই তাই। সুড়ঙ্গ গিয়ে উঠল, শ্মশানের কালীবাড়ির গর্ভগৃহে। অন্ধকার ভিজে ভিজে গর্ভগৃহ। কতকালের পুরোনো। লোক নেই অথচ ফুল চন্দনের সুবাসে চারিদিক মাতাল হয়ে আছে। ইতিউতি তাকায় সবাই। কোথায় সোনার ঘট!
কথায় বলে, প্রাপ্তির সময় এলে কেউ আর আটকে রাখতে পারে না। নজরে এল বটে ঘট। আর তাকে ঘিরে এক পদ্মগোখরো।
বাহিনী সহ তোতনকে দেখে, গোখরো নামিয়ে নিল ফণা। রাজপুত্র এসেছে। সে তো কেবল পাহারাদার।
ঘটির মধ্যে মণি। কী তার ছটা। কী তার আলো। কী তার তেজ। চোখ ধাঁধিয়ে যায়। যেই না মণি হাতে তুলে নিল তোতন, সমস্ত ভুবনডাঙ্গা যেন লুটিয়ে পড়ল তার পায়ে। পান্তাবুড়ি কোমর সোজা করে ধেই ধেই নেচে উঠল। নেংটি ইঁদুর লাফ দিয়ে ডাকাত পঞ্চুর কানে লেজ ঢুকিয়ে দিল। ইস্কুলের মাস্টার বেঞ্চির উপর দাঁড় করিয়ে দিল সাধনকে। গোটা গাঁয়ে হুল্লোড় পড়ে গেল। পাগল বাবাকে মণি ছোঁয়াতেই তিনি হুঙ্কার দিয়ে জেগে উঠলেন। সরলতার সুযোগ একবার নিতে পারে শয়তান - তারপর? কথায় বলে, চোরের বার বার গৃহস্থের একবার। মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে ভুবনডাঙার সীমানার বাইরে তাড়িয়ে দিয়ে শান্তিতে গুছিয়ে বসল সকলে।
সাধনকে রেখে দিল তোতন। যতই হোক, ভাই বলে কথা। ভালোমানুষদের এই এক সমস্যা, ভালো থেকে আরও ভালো হতে পারে, কিন্তু খারাপ হতে পারে না কিছুতে।
রূপকথা শেষ। বিজ্ঞজনেরা মাথা নাড়ছেন দেখা যাচ্ছে। গল্প হল কিনা, সে পরে বোঝা যাবে।
আমাদের কাজ এখানেই শেষ।
----------
ছবি - নচিকেতা মাহাত
No comments:
Post a Comment