গল্প:: অতীনের বন্ধু ভুলো ও হুলো - মঞ্জিলা চক্রবর্তী


অতীনের বন্ধু ভুলো  হুলো

মঞ্জিলা চক্রবর্তী

ব্যস্ত বাজারের মধ্যেই অতীনদের দোতলা বাড়ি একতলাতে তার বাবার বইয়ের দোকান বাড়ির ডান পাশে সরু পথচলতি গলিপথ গলির মাথায় শর্মা কাকুর ছোটো একটা মনোহারি দোকান বাড়ির বাঁপাশে রাস্তার উলটো দিকেও সার বেঁধে নানান দোকানপাট রয়েছে
“অন্তু... অন্তু... খেতে আয়, অতীনের মা ডাকছেন ছেলেকে বাড়ির লোক তাকে নামেই ডাকে অন্তুর দু’চোখ তখন জানালার ফাঁক দিয়ে শুনশান রাস্তায় সমস্ত দোকান বাজার বন্ধ, একটি জনপ্রাণীও নেই! তার দশ বছরের জীবনে এমন চিত্র সে প্রথম দেখছে
করোনা নামক এক ভয়ংকর দৈত্যের হাত থেকে বাঁচতে নাকি সবাইকে ঘরে থাকতে হবে! বাইরে বেরোলেই আক্রমণ করবে সে তাই তো আজ থেকে সারা দেশের মানুষ গৃহবন্দি
“কী করছিস রে... শিগগির নিচে আয়, মা আবারও হাঁক পাড়েন বিরক্তির সুরে আর দেরি না করে অন্তু নিচে যায় খেতে
খেতে বসে সে একটু অবাক হয়! তার খাওয়ার সময় দুই মূর্তি মানে হুলো ভুলো সামনে হাজির থাকে সবসময় সে খেতে খেতে একবার হুলোর দিকে এঁটোকাঁটা ছুড়ে দিত, আরেকবার ভুলোর দিকে কিন্তু আজ ভুলো কোথায় গেল?
হুলো হল অন্তুর মায়ের লাল রঙের পোষা বেড়াল আর ভুলো হল তার আদরের ধবধবে সাদা রঙের কুকুর সে একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে ভুলোকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনেছিল তখন সে ছিল একরত্তি কুকুরছানা, তবে তাকে দেখে মোটেই রাস্তার কুকুর বলে মনে হবে না
অন্তু খেতে খেতে মাকে প্রশ্নটা করেই ফেলল, “ভুলোকে দেখছি না তো?
মা বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলেন, “কী জানি বাপু, আজ থেকে কাজের মাসি আসা বন্ধ, সে খবর কি তোমরা বাপ-বেটা রাখো? কাজের জ্বালায় পাগল হচ্ছি, আমি রাখব এখন হুলো ভুলোর খবর!
সে নীরবে খেয়ে উঠে গেল, সব এঁটোকাঁটা গেল হুলোর পেটে
অন্তু প্রথমে সব ঘরদোরগুলো ভালো করে দেখল
নাহ্, কোথাও নেই
তাছাড়া রাস্তা থেকে তুলে এনেছিল বলে তার মা ভুলোকে কিছুতেই ঘরে ঢুকতে দিতেন না তবুও সে মাঝে মধ্যে চুপি চুপি তার পিছু পিছু উপরে উঠে যেত “ভুলো, মা আসছে...,” বললেই সে বিপদ বুঝে দৌড়ে নিচে পালাত
এবার সে সদর দরজা থেকে বাইরে মুখ বাড়াল এদিক ওদিক দেখল, খাঁ খাঁ পথঘাট... জনমানবশূন্য পৃথিবী তার কাছে একেবারে অচেনা নিরাশ হয়ে ফিরে এল সে!
সেদিন রাতের খাবার সময়ও ভুলোকে দেখা গেল না সে ভেবেই পেল না, ভুলো কোথায় গেল? আচ্ছা কেউ কি ওকে ধরে নিয়ে গেল!
তার পরদিনও না এমন করে তিন-তিনটে দিন কেটে গেল সে চিন্তিত হয়ে বাবাকে অনুরোধ করল, “একটু খুঁজে দেখবে বাবা, ভুলো কোথায় গেল?
শুনে ওর বাবা বললেন, “দেখছিস তো রাস্তাঘাট কেমন জনমানবহীন তাছাড়া এখন লোকের বাড়ি যাওয়া যাবে না রে, এখন বাড়ির বাইরে বেরোনো নিষেধ এই অবস্থায় কোথায় খুঁজি বল দেখি?
অন্তু নিঃশব্দে নিজের ঘরে ফিরে গেল ভুলোর কথা খুব মনে হতে থাকল বাজার যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে তার স্কুল ভুলো নিত্যদিন তার পিছু পিছু স্কুলের গেট পর্যন্ত যেত আবার স্কুল থেকে ফিরলে ভুলো সামনের দু’পা দিয়ে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত... জিভ দিয়ে আদর করে গা-হাত চেটে দিত ঘন ঘন লেজ নেড়ে বলতে চাইত যেন, ‘ও তুমি ফিরেছ... তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম তো বন্ধু!
স্কুল থেকে ফিরে সে বাড়ির উঠোনে ভুলোর সঙ্গে বল নিয়ে খেলত বলটা দূরে ছুড়ে দিয়ে তাকে নিয়ে আসতে বলত, ‘যা... ভুলো... যা... সে তখন দিব্যি বলটাকে দাঁত দিয়ে চেপে নিয়ে আসত এসব কথা ভাবতে ভাবতে তার চোখে জল চলে এল তুই কোথায় হারিয়ে গেলি রে ভুলো?
চতুর্থ দিন দুপুরে খাওয়ার সময় একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল অন্তু মনমরা হয়ে একটা করে দানা মুখে তুলছিল আর বেশিরভাগ খাবার ছুঁড়ে দিচ্ছিল হুলোর দিকে হুলো কিন্তু একটা খাবারেও মুখ দিচ্ছিল না, উলটে ‘ম্যাও... ম্যাও...’ করে ডেকেই যাচ্ছিল অন্তু তার এমন আচরণ দেখে মাকে বলল, “দেখ, হুলোটার আবার কী হল! খাচ্ছে না কেন?
মা বিরক্ত হয়ে বললেন, “এ- অসময়ে লোকের হাতে কাজ নেই, সব বন্ধ, লোকজন খাবার পাচ্ছে না আর তোদের সব খাবারে রুচি নেই বাপু!
হুলোকে খাবার দেওয়ার পর ভুলোকে খাবার দিত সে হুলো নিজেরটা তাড়াতাড়ি সাবাড় করে ভুলোর খাবারে ভাগ বসাত ভুলো দাঁত বের করে ঘ্যাঁক করে কামড়াতে গেলে তবেই সে সরে যেত হুলোটা বরাবরই হ্যাংলা, কিন্তু খাবার পেয়েও খাচ্ছে না এ তো অবাক কাণ্ড!
যাই হোক, অন্তু পরীক্ষা করবার জন্য হুলোর দিকে মাছসহ একটা কাঁটা ছুঁড়ে দিল নাহ্, সে খেল না
আবারও তার মুখের দিকে তাকিয়ে ‘ম্যাও... ম্যাও...’ করে ডাকতে থাকল সে তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠে হুলোর কাছে গিয়ে ওর গায়ে হাত বুলিয়ে দিল কী বলতে চাইছে তা বোঝার চেষ্টা করল
তারপর হুলো ‘ম্যাও... ম্যাও... করে সদর দরজার দিকে এগিয়ে পেছন ফিরে তার দিকে তাকাল সেও এগিয়ে গেল দরজার দিকে হুলো এবারও একইভাবে রাস্তায় কিছুটা এগিয়ে গেল সে এতক্ষণে বুঝতে পারল হুলো তাকে কোথাও একটা নিয়ে যেতে চাইছে
অন্তু হুলোকে অনুসরণ করে গিয়ে দাঁড়াল শর্মা কাকুর দোকানের সামনে সে ভাবল, ‘এখানে কী আছে? চারপাশে তো শুধু বন্ধ দোকান সে ফেরত আসতেই যাচ্ছিল, এমন সময় হুলো আবার ডাক ছেড়ে ‘ম্যাও... ম্যাও...’ করে ডেকে উঠল ঠিক তখনই দোকানের ভেতর থেকে কুঁই কুঁই শব্দ বেরিয়ে এল, সঙ্গে সঙ্গে ভৌ... ভৌ... ডাক
অন্তু প্রচণ্ড উত্তেজনায় তৎক্ষনাৎ নিচু হয়ে দোকানের কাঠের পাল্লার নিচে ছোট্ট ভাঙা অংশ দিয়ে ভেতরে চোখ রাখল, কিন্তু সেখানে শুধুই কালো অন্ধকার দেখল সে তবু ভুলো যে ভেতরেই আছে তা বুঝতে তার কোনো অসুবিধা হল না
কিন্তু সে ভেতরে ঢুকল কেমন করে? দোকানের সামনে দুটো ইয়া বড়ো বড়ো তালা ঝোলানো যে অন্তু ভেতরে হাতটা একটু ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, “আহা... ভুলো রে, এই জন্যই তোকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না! ভুলোও তৎক্ষনাৎ তার হাতটা চেটে দিল
তারপর সে দৌড়ে বাড়িতে গেল মা-বাবাকে ঘটনাটা জানাল তার বাবা শুনে বললেন, “শর্মা তো সেদিনই সকালে দোকান বন্ধ করে দেশে চলে গেল যাবার সময় বলে গেল - দাদা দেখিয়েগা, মুলুক যা রাহা হুঁ কিন্তু ভেতরে ঢুকল কেমন করে?
অন্তু এখন বেশ বুঝতে পারল ভুলো দোকানের ভেতরে ঢুকল কেমন করে! সে যখনই শর্মা কাকুর দোকানে যেত ভুলোও তার পিছু নিত আর চিপস্, চকোলেটের সঙ্গে ফ্রী স্টিকার, খেলনাগুলো দেখার জন্য প্রায়ই দোকানের মধ্যে ঢুকে যেত সঙ্গে ভুলোও তাতে শর্মা কাকু রাগারাগি করে বলতেন, ‘আরে... রাম রাম রাম... ভাগ ইঁয়াসে যেদিন থেকে ভুলোকে দেখা যাচ্ছে না সেদিন সকালে শর্মা কাকুর দোকানে কী যেন একটা আনতে গিয়েছিল মনে পড়েছে, মা বলেছিল, ‘তাড়াতাড়ি যা, শর্মা দোকান বন্ধ করে দেশে চলে যাবে...’ কিন্তু ভুলো ওর পিছু নিয়েছিল কিনা তা তো দেখেনি!
সে তাড়াতাড়ি বাবাকে বলল, “তুমি যেমন করেই হোক ভুলোকে বাইরে বের করো বাবা!
বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন, “কীভাবে বের করব? আমি কি পরের দোকানের তালা ভাঙব? এই গৃহবন্দির বাজারে লোকে চোর-ডাকাত বলবে আমায়!
সে অসহায়ভাবে মায়ের দিকে তাকাল! মা বললেন, “চল, আমি দেখছি কী করা যায়
তিনদিন ধরে বেচারা কিছু খায়নি ওর জন্য বাটিতে খাবার জল নিয়ে সে মায়ের পিছু পিছু দোকানের দিকে এগোল
কাঠের দরজার নিচে ভাঙা অংশ দিয়ে অতি কষ্টে বাটিটা ঠেলে দিল ভেতরে নিঃশব্দে ভুলো খাবারগুলো খেয়ে নিল জল পেয়ে চোক্ চোক্ করে খেল তিনদিন পর সে প্রাণে একটু বল পেল কাঠের পাল্লার বাইরে শুধু তার অস্তিত্ব টের পাওয়া গেল, চোখে দেখা গেল না!
অন্তু হুলোকে সঙ্গে নিয়ে নিরাশ বদনে ফিরে এল হুলোর তখনও খাওয়া হয়নি পড়ে থাকা খাবারগুলো খেতে খেতে সে বন্ধু ভুলোর কথা ভাবতে থাকল ভুলোকে যখন অন্তুদা বাড়ি নিয়ে এল তখন খুব রাগ হয়েছিল তার সে তাকে সহ্যই করতে পারত না প্রথম প্রথম দু’জনের সম্পর্ক ছিল একেবারে সাপে নেউলের
তারপর ধীরে ধীরে দু’জনের ভাব হল ভুলো ছোটো হলেও তার অনেক অত্যাচার সহ্য করত দুপুরের খাবার পর যখনই ভুলো একটু ঘুমাত, হুলো গিয়ে তখনই তার লেজ ধরে টানত... যতক্ষণ না সে বিরক্ত হয়ে তাকে ঘ্যাঁক করে কামড়াতে আসত তারপর রাজ্যের সব জায়গা ছেড়ে সে ঠিক ভুলোর গায়ের সঙ্গে ঠেস দিয়ে ঘুমাবে খাবার সময়ও অনেক ক্ষেত্রে ভুলো তার ভাগ ছেড়ে দিত, কারণ সে জানত খাবার দাবারে হুলোর দুর্বলতার কথা সেই ভালো মানুষ ভুলোটার খবর দেওয়ার পরও অন্তুদা তাকে বাইরে বের করতে পারল না কেন - তা তার বিড়াল বুদ্ধিতে কিছুতেই ঠাউর করতে পারল না! তবে তার আজকে বেশ লেগেছে, অন্তুদা তাকে আজ সোনাটা পুশিটা করে আদর করে দিয়েছে অন্য সময় কেবল তাকে দূর ছাই করে!
যাই হোক, দিনের পর দিন গৃহবন্দি দশায় কাটতে থাকল করোনা দৈত্যের দাপটে মানুষ আরও ভীত সন্ত্রস্ত হল! অন্তুর বাবা অনেকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেন, কিন্তু যেখানে মানুষের প্রাণ সংশয় সেখানে কারোরই সাহায্য পেলেন না অন্তু দুবেলা বাটিতে করে খাবার জল খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখল তার প্রিয় ভুলোকে
এইভাবে বন্ধ দোকান ঘরের মধ্যে ভুলোর একমাস কেটে গেল সেদিন অন্তু মনমরা হয়ে জানালার ধারে বসেছিল দেখে রাস্তায় পুলিশ কাকুরা টহল দিচ্ছেন, রাস্তায় অযথা লোকজনকে ঘোরাঘুরি করতে দেখলে মেরে বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছেন সেই সময় সে দৌড়ে গেল এক পুলিশ কাকুর কাছে ছোটো মানুষটা মুখোশ পরা মুখে হাঁপাতে হাঁপাতে গিয়ে পুলিশ কাকুকে জানাল তার বন্ধু ভুলোর সমস্ত ঘটনা তিনি তো শুনে হতবাক, “টানা এক মাস এক অবলা প্রাণী বন্ধ দোকানের মধ্যে রয়েছে এ তো অমানবিক একটা ব্যাপার!
তারপর পুলিশ কাকুরা মিলে শর্মা কাকুর দোকানের তালা ভেঙে ভুলোকে বাইরে বের করে আনলেন অন্তুর বাবার কাছ থেকে নতুন তালা নিয়ে দোকান বন্ধ করে দিয়ে তারা চলে গেলেন
টানা এক মাস অন্ধকারে থাকার পর ভুলো জগতের আলোর মুখ দেখল বন্ধুর দিকে তাকিয়ে সে মুখে কুঁই কুঁই শব্দে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল, ‘তুমিই তো আমাকে বাঁচিয়েছ - ধন্যবাদ বন্ধু! ঘন ঘন লেজ নেড়ে তার গায়ে ঘেঁষে আনন্দ প্রকাশ করতে থাকল অন্তু মাটিতে উবু হয়ে বসে ভুলোর গলা জড়িয়ে ধরল, সে যে তার প্রিয় বন্ধুকে বাঁচাতে পেরেছে তা যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না, আনন্দে তার চোখে জল চলে এল! ভুলো তাকে জিভ দিয়ে চেটে আদর করে বোঝাতে চাইল, ‘এই তো আমি তোমার সঙ্গেই আছি বন্ধু! সেই সময় ‘ম্যাও... ম্যাও...’ করতে করতে হুলোটাও সেখানে জুটল ভুলো হুলোকেও আদর করে একবার তার নাক চেটে দিল হুলো ভুলোর খবরটা না দিলে অন্তু তো জানতেই পারত না যে ভুলো কোথায় আছে তারপর তিন বন্ধু আনন্দে প্রায় নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরল
----------
ছবি - শ্রীময়ী

3 comments:

  1. দারুন লাগল

    ReplyDelete
  2. বাঃ। বেশ গল্প!

    ReplyDelete
  3. সুন্দর গল্প,ছোটদের ভালো লাগবে।

    ReplyDelete