আমার ছোটোবেলা:: পুজোর স্মৃতি: নীলরঙা ফুল প্যান্ট - রাজীবকুমার সাহা

পুজোর স্মৃতি

নীলরঙা ফুল প্যান্ট
রাজীবকুমার সাহা

ষষ্ঠীর রাত মা তিন ভাইবোনকে খাইয়ে-দাইয়ে বাবার ভাত আগলে বসে ঢুলছে বাবার ইলেকট্রিক অফিসের চাকরি, কখন ছাড়া পাবে কিচ্ছু ঠিক নেই পুজোর কটা দিন অফিসই বাড়িঘর, কখন কোথায় লাইনে ফল্ট হয় পুজোর লোডে লজঝরে ট্রান্সফরমার সব হেঁপো রোগীর মতো শ্বাস টানছে, যে-কোনো মুহূর্তে দেহ রাখতে পারে তক্ষুনি চোখের পলকে শুরু হয়ে যাবে যুদ্ধকালীন তৎপরতা সুতরাং সৈনিকেরা অতন্দ্র
এদিকে এক ফোঁটা ঘুম নেই আমার চোখেও বিছানায় শুয়ে প্রহর গুনে চলেছি, ‘দরজা খোলোবলে কখন বাবা হাঁক দেয় ভাই আর বোন একপাশে ঘুমিয়ে কাদা তাদের জেগে থাকার গরজ নেই মোটেও পুজোর জামা ওদের আগেই এসে গিয়েছে আটকেছে কেবল আমারটা বাবার বাঁধা দর্জি দশ হাতে মেশিন চালিয়েও কূলকিনারা পাচ্ছে নাকর্তা, হপ্তাখানেকের মধ্যেই পাইয়া যাইবেন - বলে আজ ষষ্ঠীর রাতও কাবার হয়ে যাচ্ছে চোখ ফেটে জল আসছে আমার বায়না ধরে দিন পনেরো আগে সাগর নীল-রঙা কাপড় কিনে প্যান্টের মাপ দিয়ে এসেছি বাবার সঙ্গে গিয়ে জীবনের প্রথম ফুল প্যান্ট -সাত বছর বয়স তখন তবে পায়ে লম্বা মাপ দিয়ে ফিরেই স্বপ্ন বুনতে বসেছি পরলে কেমন লাগবে, পকেট কটা থাকবে, কোন পকেটে কী রাখা যায় ইত্যাদি কাটছাঁট বা ডিজাইন নিয়ে মাথা ঘামানোর বয়স তখনও হয়নি টানা কতদিন পরার পর ধোয়ার জন্যে মাকে দেব, উঠোনের কড়া রোদ্দুরে শুকোনো উচিত হবে না বারান্দার তারে, ভেবে ভেবে মাথা খারাপ পকেটে আঁটবে এমন সাধের খোলামকুচির মনে মনে লিস্ট বানিয়ে চলেছি, ক্ষণে ক্ষণে এ-পকেট থেকে ও-পকেটে চালান করছি, মনোমতো না হলে বাতিল করে দিয়ে নতুন লিস্ট বানাচ্ছি মাটির হাঁড়ি টুকরোর দাগ্গি, সিগারেটের প্যাকেটের দু-পিঠ ছিঁড়ে টাকা, মার্বেল, ঝিনুক-খোলার পেট চেঁছে গর্ত করে আম ছোলানোর যন্তর, ভাঙা চুম্বকের টুকরো, কাদামাটি রোদে শুকিয়ে গুলতির গুলি, আরও কত কী হাবিজাবি দিন যায়, রাত কাটে ষষ্ঠীর দিন আর নাগালে আসে না গতদিন বাবা একটু রেগে যাওয়ায় দর্জিকাকু কাউন্টারে চাপড় মেরে কথা দিয়েছে, “আকাশ ভাইঙা পড়লেও ষষ্ঠীর দিন সইন্ধ্যার সময় প্যান্ট আপনে পাইবেনই দাদা অফিস থেইক্যা বাড়ি যাওয়ার সময় লইয়া যাইয়েন, প্যাক কইরা রাখুম
সুতরাং আজ বাবা বাড়ি ফিরতে যতক্ষণ সময়, প্যান্ট আমার হাতে অথচ নটা বাজল, দশটা বাজল, কিন্তু কই, বাবা তো এল না! ঘরের পেছনে রাস্তা, সেদিকে শুধু ঝিঁঝিঁর ডাক, মানুষের সাড়াশব্দ নেই কোনো বুকটা মুচড়ে মুচড়ে কান্না ঠেলে ওঠে কেবল মা উঠে এসে অনর্থক এটা ওটা গোছাচ্ছে বটে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বেশ চঞ্চল হয়ে উঠেছে টের পাচ্ছি আমার মুখে ভুলেও তাকাচ্ছে না একবার অভিমানটা জেঁকে বসল আরও
বায়না শুরু করেছিলাম পুজোর মাসখানেক আগে থাকতেই জানি, একশো বার অন্তত জমা না করলে সে বিল পাস হবে না পুজোয় এবার ফুল প্যান্ট বানিয়ে দিতে বললেই ধমক উড়ে আসে, ‘খুব লায়েক হয়েছ, না? যা আসবার সে ভেবেচিন্তেই আসবে, যেমন দরকার এ নিয়ে আর যেন কোনো কথা না শুনি
তবে সে ধমকে পাত্তা দেয় কে? এক-আধদিন চুপচাপ, তারপর আবার ঘ্যানরঘ্যানর, ফুল প্যান্ট চাই, আর কিচ্ছু লাগবে না সঙ্গে সময়ে অসময়ে টলটলে চোখের জল শেষে একসময় দেখা গেল মচকে এসেছে দু’জনেই, কিন্তু ভাঙছে না মা নিমরাজি তো বাবা গররাজি তারপর বাবা একদিন-বা মোটামুটি রাজি হলেও মা শুনি অ্যাবাউট টার্ন হয়ে বলে, ‘না, তুমি ঠিকই বলেছ এ বয়সে ফুল প্যান্ট! চ্যাংড়াটার মতো দেখাবে প্যান্টেরই দরকার নেই এ বছর সঙ্গে নিয়ে গিয়ে জামা আর জুতোর মাপ দিয়ে এসো সুযোগ করে এর মধ্যে
তবে তেমন করে চেষ্টা করলে নাকি পঙ্গুও পাহাড় ডিঙোতে পারে আমিও পারলাম পুজোর দিন পনেরো বাকি থাকতে ফুল প্যান্টেরই মাপ দিয়ে এলাম কিন্তু যার জন্যে এত কষ্ট, এই যুদ্ধজয়, সে কোথা? আদৌ পুজোর আগে আসবে কি না কে জানে অষ্টমীর রাতেও শুনেছি দর্জিদের মেশিন চলে অবিরাম
ও বাবা, সাড়ে এগারোটা! কী যে করে এতক্ষণ ছাই, বুঝি না কাজ আছে বেশ কথা, তা বলে সাইকেলটা নিয়ে দু-মুঠো খেয়ে যেতে কতক্ষণ লাগে?”
মার গজগজানির মধ্যেই কঠোর এক সিদ্ধান্ত নিলাম এবার পুজোয় আমি ঠাকুর দেখতেই যাব না যে যায় যাক, সারারাত ক্যাপ-বন্দুক ফাটাক, আমি ঘর থেকে নড়ছি না মা মাথায় হাত বুলিয়ে যতই বাবু সোনা করুক, আমি যাব না তো যাবই না লাগবে না আমার প্যান্ট, যাও নিঃশব্দে হিক্কা তুলতে তুলতে বালিশ ভিজিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না
হঠাৎ চোখ খুলে গেল মাথার চুলে কর্কশ অথচ প্রিয় হাতটার ছোঁয়ায় বাবা! কখন বাড়ি ফিরে খেয়েদেয়ে এখন পান চিবোচ্ছে আমার পাশে বসে বিরাট গোঁফের আড়ালে ঠোঁট-টেপা হাসি এক লাফে উঠে বসে হাত পাতলাম, “কই, দাও!”
মুহূর্তমাত্র দেরি না করে বাবাও খবরের কাগজে মোড়া সে সাতরাজার ধন তুলে দিল আমার হাতে বুকের ভেতরটা যে কী করছিল তখন জানি না দুঃখ ব্যাখ্যা করা যতটা সহজ, সুখ ততটাই কঠিন বেড়ালের চেয়েও বেশি ক্ষিপ্রতায় প্যাকেটটা যখন আঁচড়ে ছিঁড়ে ফেলছি, মা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “তো নবাবপুত্তুর ঠাকুর দেখতে যাবেন তো এবার? নাকি সিদ্ধান্ত পালটায়নি এখনও?”
আমি হাঁ করে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করলাম, “আরে! তুমি সেটা জানলে কী করে?”
আস্তে আস্তে, ভাই উঠে যাবে তখন কান্না সামলিও সারারাত বসে বসে ঘুমের ঘোরে বিড়বিড় করছিলে এতটুকু ছেলে, তেজ দেখ!”
ধুস, ওসব কথায় কান দেয় কে? মায়েরা ওরকম বলেই সে-কথায় মনোযোগ না দিয়ে গদগদ হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “বাবা, পরব? একবার?”
কেজো গলায় উত্তর এল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, পরে দেখ ঠিকঠাক আছে কি না ব্যাটারা যা এলোপাথাড়ি হাত চালাচ্ছে দেখলাম কোনো অলটার দরকার হলে সকালেই দিয়ে যাব অফিস যাবার পথে
এক লাফে খাট থেকে নেমে পাশের ঘরে দৌড়ে গিয়ে চোখের পলকেই প্যান্ট আমার কোমরে এঁটে গেছে সলজ্জ মুখে এসে দাঁড়ালাম মা-বাবার সামনে বাবা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আমার কোমর ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ফল্ট খুঁজে চলেছে মার মুখে কপট গাম্ভীর্য চোখে গোপন প্রশ্রয়, না তৃপ্তির আলো ঠিক ঠাহর হয় না
না, কোনো অসুবিধে নেই মাও এবারে মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করছে যে লাগছে বাপু মন্দ নয় অকপট জিজ্ঞেস করলাম, “মা, সেই যে বলছিলে, চ্যাংড়ার মতো লাগছে না তো আবার?”
এবারে হেসে উঠল মা বাবাও বলল, “নে, খোল এবারে শুয়ে পড়, রাত অনেক হয়েছে
এক মুহূর্ত থমকে থেকেই ককিয়ে উঠলাম, “আজ রাতটা থাক না! এমনিতেও তো রাত বেশি নেই বললে সেই তো ভোরে উঠেই আবার…”
এ কী কথা! নতুন প্যান্ট, পরেই ঘুমোবি? খোল শিগগির বলছি আহ্লাদ!”
উঁহু, সে-রাতে মার বকাঝকা, বাবার চোখ পাকানো সব হার মেনেছিল আমার জেদের কাছে পেয়ে যখন গিয়েছি একবার, তখন মার খেলেও ওটা আর খুলছি না খুলিওনি পরেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আবার চোখ বুজে আসার আগে টের পেলাম কেমন শিরশিরে একটা হাওয়া আসছে যেন কোত্থেকে সে হাওয়ায় শিউলির তাজা গন্ধ, হালকা কুয়াশার স্পর্শ আশ্চর্য, এতক্ষণ একটুও টের পাইনি ওসব!

সপ্তমীর ভোর ভেবে রাখা সময়ের চেয়ে একটু দেরি হয়ে গেল উঠতে কোনোমতে হাতমুখ ধুয়েই একদৌড়ে পাড়ার প্যান্ডেলে বেলতলি শারদোৎসব কমিটি এ গাঁয়ের সবচাইতে প্রাচীন পুজো পরনে নতুন প্যান্ট, বার বার চোখ চলে যাচ্ছে কোমর বেয়ে পায়ের দিকে দিনের নতুন আলোয় তার যেন নতুন রূপ খুলেছে মায়া-মমতা বেড়ে দ্বিগুণ আহা, এ প্যান্ট আমি সারাজীবন পরে থাকতে পারি প্যান্ডেলের কাজ তখনও শেষ হয়নি দেখলাম ওদিকে সাতটা নাগাদ পুরোহিত বসে যাবেন পুজোয় সাগরেদ সহ অপেক্ষায় আছেন হাঁকডাক, দৌড়োদৌড়ি এবারে বাঁশ-বেতের নকশা করা কাজ হচ্ছে কাজটা সামলাতে এতটা সময় নেবে ভাবতে পারেনি কেউ প্রতিমাও এসেছে গভীর রাতে পথে একমুঠো ঝরা শিউলি কুড়িয়ে বাড়ি ফিরে এলাম আবার বেরোব সকাল সকাল স্নান শেষে খাওয়ার ফাঁকে

না, পুজোর চারদিন এ প্যান্ট আমি ধুতে দিইনি মাকে কিছুতেই না পায়ের দিকে চাপড়া চাপড়া ধুলোর দাগ, পেছনে আবছা ময়লা, পকেটের ধারগুলো কালচে হয়ে উঠেছে, নবমী আসতে আসতে আর নাকি তাকানোই যাচ্ছিল না প্যান্টের দিকে আমি জানি, মার এসব বাড়াবাড়ি আমি ছেলেমানুষ, ভিড়ে ধাক্কা খেয়ে পথের পাশে একটু আধটু ছিটকে পড়তেই পারি সঙ্গে সঙ্গে উঠেই তো ঝেড়ে নিয়েছি আচ্ছা করে আর বন্দুকের ক্যাপগুলো রাখবটা কোথায়? পকেটেই তো! নইলে বার বার বের করে ফাটাতে অসুবিধে হয় না? তাতে পকেটের ধারগুলো একটু কালচে হলই-বা দেখছে কে? এই মা-টা না, কিচ্ছু বোঝে না

দুর্গাপুজো গেল লক্ষ্মীপুজো গেল কালীপুজোও গেল এবারে ভাইফোঁটাতে পিসির বাড়ি চলেছি সবাই মিলে সবার পরনে পুজোর নতুন পোশাক বাজার পেরিয়ে নদী, তাতে দরমা পাতা বাঁশের সাঁকো পার হয়ে গিয়ে গাড়ি একটাই বাস সে গিয়েছে ট্রিপে বটের ছায়ায় বেঞ্চি পাতা তাতে বসে অপেক্ষা বাস এলে উঠব তারপর অনন্তকাল অপেক্ষা শেষে প্যাসেঞ্জার ভর্তি হয়ে ছাদ অবধি ঠেলে উঠলে তবে ছাড়বে
বাবা দেখি কখন একটু দূরে মুদি দোকানে দাঁড়িয়ে কথা বলছে পায়ে পায়ে হাজির হলাম সেখানে বাবার হাতে সিগারেট ধরায়নি তখনও দোকানির সঙ্গে সুখদুঃখের আলাপ চলছে বাবা একবার তাকাল আমার দিকে, কিছু বলল না মুখ গোটানো ডালের বস্তার ওপর ঘোড়ামার্কা দেশলাইটা পড়ে ভূতগ্রস্তের মতন কখন তুলে নিয়ে কাঠি বের করে অপটু হাতে ফস করে জ্বালিয়ে বসেছি নিজেই ঠিক মনে করতে পারি না এখন জ্বালানোর মুহূর্তে ডানহাতের একটা আঙুল ছিল ঠিক বারুদটা ছুঁয়ে ব্যস, আর যায় কোথা জোর এক চিৎকার দিয়ে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে ততক্ষণে কাঠিটা ছিটকে গিয়ে উরু থেকে হাঁটুর ওপর পর্যন্ত প্যান্টটা পুড়িয়ে দিয়েছে অনেকটা ভাগ্যিস উরুতে লাগেনি হতভম্ব দোকানি প্রথমে আঙুলে জল ঢালল, নুন দিল, শেষে ছিপি করে এনে পুরোনো মধু লাগাল তখন গিয়ে বীভৎস জ্বলুনিটা ঠান্ডা হল খানিকটা পোড়া জায়গাটা সাদা হয়ে গেল
আঙুল সামলে প্যান্টে নজর যেতেই চোখ ভরে এল জলে তারপর অঝোরে কান্না মা ঘোমটা মাথায় এদিকপানেই তাকিয়ে আছে উদগ্রীব হয়ে
জবর একখানা মার খাওয়ার আশঙ্কায় ভয়ে ভয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে দেখি থমথম করছে মুখ রুমাল বের করে আমার উরু পেঁচিয়ে গিঁট বাঁধতে বাঁধতে বিড়বিড় করছে, “এ কাপড়ের থানটা আর আছে কি না কে জানে পুজোর বাজার
আজ এত বছর পরও সেই নীল প্যান্টটা স্পষ্ট চোখে ভাসে রোদ্দুরে শুকোতে দেওয়া উঠোনের তারে স্টিলের হুক দুটো ঝিলিক মেরে যায়
----------
ছবি - আন্তর্জাল

2 comments:

  1. শেষটায় বুক মুচড়ে উঠল। মধ্যবিত্তের মূল্যবোধই ছিল আলাদা

    ReplyDelete
  2. এঃ হে, পুড়িয়ে ফেললে অমন সুন্দর প্যান্টটা। বেশ লিখেছো।

    ReplyDelete