গল্প:: দয়ারামের দোলনা - বুম বোস


দয়ারামের দোলনা
বুম বোস

()

পুজোর লেখাগুলো দাদা মাস দেড়েক পরেই সব ডিটিপিতে পাঠাতে হবে, আর আপনি এখন বলছেন লেখা আসছে না আপনি লেখা না দিলে যে মারা পড়ব
ছেলেবেলাপত্রিকার সম্পাদক অনন্ত রায় বললেন কথাটি লেখক অনাদিশেখর সেনগুপ্ত গালে হাত দিয়ে আকাশ-পাতাল কী যেন একটা ভাবছিলেন, অনন্তবাবুর কথায় সংবিৎ ফিরল তাঁর তিনি টেবিলে রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরালেন সিগারেটে বারদুয়েক সুখটান দিয়ে বেশ উদাসী স্বরে বললেন, “না গো ভাই এবারটা আর হবে বলে মনে হচ্ছে না বেশ বড়োসড়ো একটা রাইটার্স ব্লক এসেছে ব্লক খুব সহজে যাওয়ার নয়
অনাদিশেখরের কথা শুনে অনন্তবাবুর তো মাথায় হাত পড়ে গেল অনাদিশেখর বিগত এগারো বছর ধরেছেলেবেলাপূজাবার্ষিকীতে অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস লেখেন সেই অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস বাচ্চা-বুড়ো সব একেবারে গোগ্রাসে গেলে এখন যদি অনাদিশেখর না লেখেন, তাঁর তো পত্রিকার বিক্রি কমে যাবে তাই তিনি প্রায় নাছোড়বান্ধা হয়ে লেখা চাইছেন ওঁর কাছে
অনাদিশেখর অভিজ্ঞ লেখক রাইটার্স ব্লক তাঁর আগেও এসেছে, তবে এমন শূন্য তাঁর আগে কখনও লাগেনি এবার হাজার চেষ্টা করেও একটা জুতসই প্লট তাঁর মাথায় কিছুতেই আসছে না এমন সব প্লট আসছে, যেগুলো হয় তিনিই আগে লিখে ফেলেছেন, নয়তো অন্য কেউ লিখে ফেলেছে
সহসম্পাদক শ্যামাপ্রসাদ বাড়ুজ্যে একটু দূরে বসে সবটা শুনছিলেন হঠাৎ অনাদিশেখরের সামনে এসে তিনি বললেন, “ক’দিন কোথাও ঘুরে আসুন না হাওয়া বদল হলে যদি লেখা আসে আমরাই না হয় ব্যবস্থা করে দিচ্ছি যাওয়ার
অনাদিশেখরের প্রস্তাবটা মন্দ লাগল না সত্যিই তো, অনেকদিন কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি কোথাও একটু বেড়িয়ে এলে হয়তো এই শূন্যতাটা কেটে যাবে
কথাটা মন্দ বলেননি, তবে যাব কোথায়?” অনাদিশেখর জিজ্ঞেস করলেন
আমার গ্রাম থেকে ঘুরে আসুন খুব নিরিবিলি জায়গা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেরও অভাব নেই কোনো গ্রামে আমার এক মামা থাকেন, তাকে বললেই থাকা খাওয়ার সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে,শ্যামাপ্রসাদ বললেন
অনাদিশেখর হাতের সিগারেটে শেষ কয়েকটি টান দিয়ে সেটিকে অ্যাশট্রেতে গুঁজে বললেন, “তাই ব্যবস্থা করুন তবে দেখি এই বেয়াড়া রাইটার্স ব্লকটা কাটানো যায় কিনা!

()

গ্রামটির নাম দত্তপুকুর জায়গাটির চারিপাশ বেশ শস্যশ্যামলা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সত্যিই কোনো অভাব নেই এখানে বিঘার পর বিঘা ধান আর সরষের খেত, চোখ যতদূর যায় ততদূর শুধু সবুজ আর সবুজ তাকালেই চোখ দুটো নিমেষে জুড়িয়ে যায়
বিকেলের ট্রেনে দত্তপুকুর পৌঁছোলেন অনাদিশেখর স্টেশনে নামতেই একটি অল্পবয়সি ছেলে ছুটে এল তাঁর দিকে ব্যাগপত্র সব কাঁধে তুলে নিয়ে ছেলেটি বলল, “আমি আপনার খুব ভক্ত স্যার আপনার প্রায় সব লেখাই পড়েছিছেলেবেলাপত্রিকার সাবস্ক্রিপশন নিয়েছি শুধুমাত্র আপনার লেখা পড়ব বলেএকটানা বলেই একগাল হাসল ছেলেটি তারপরআমার সঙ্গে আসুন স্যার...” বলেই হাঁটতে শুরু করল স্টেশনের গেটের দিকে মুখ করে৷ অনাদিশেখরও ছেলেটির পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করলেন
তোমার আমার লেখা ভালো লাগে?” অনাদিশেখর জিজ্ঞেস করলেন
খুব ভালো লাগে স্যার শুধু আমি নই, আমার স্কুলের সব বন্ধুরাও আপনার লেখা পড়তে ভীষণ ভালোবাসে৷
ছেলেটির কথা শুনে বেশ প্রসন্নই হলেন অনাদিশেখর এই অজপাড়াগাঁয় এসেও যে নিজের এক একনিষ্ঠ ভক্তের সঙ্গে আলাপ হয়ে যাবে তিনি আশা করেননি
তোমার নামটা তো বললে না ভাই?” অনাদিশেখর জিজ্ঞেস করলেন আবার
ছেলেটি আলতো হেসে বলে, “আজ্ঞে আমার নাম সৌম্যদীপ রায় দত্তপুকুর হাইস্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ি বলেই সে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক মাঝবয়সি রিকশাচালককে ডেকে বলে, “ বলাই কাকা, যাবে নাকি?”
লোকটি রিকশার পাশে দাঁড়িয়ে ধুঁকছিল গরমে সৌম্যদীপের ডাক শুনে সে রিকশা চালিয়ে এগিয়ে আসে ওঁদের দিকে রিকশাটি এসে থামতেই অনাদিশেখর উঠে পড়লেন রিকশায় সৌম্যদীপ উঠে বসল তাঁর পাশে৷ তারপর গ্রামের মেঠোপথ ধরে ওরা এগিয়ে চলল সামনের দিকে সকাল থেকে আজ সত্যিই খুব গরম ছিল, তবে বিকেল পড়তেই ফুরফুরে দক্ষিণের হাওয়া বইতে শুরু করেছে বিকেলের ফিকে হয়ে আসা রোদ্দুরে সবটা অপূর্ব সুন্দর লাগছে অনাদিশেখরের
‘এমন মনোরম পরিবেশে লেখা আসতে বাধ্য,’ মনে মনে ভাবলেন অনাদিশেখর ঠিক করলেন আজ রাত থেকেই উপন্যাসের খসড়াটা তৈরি করা শুরু করে দেবেন

()

আপনার আসতে কোনো অসুবিধে হয়নি তো?” রথীনবাবু জিজ্ঞেস করলেন রথীনবাবু অর্থাৎ রথীন রায় হলেন গিয়ে সহ সম্পাদক শ্যামাপ্রসাদবাবুর মামা এবং সৌম্যদীপের বাবা ওঁর কথা শুনে অনাদিশেখর হেসে বললেন, “না না, কোনো অসুবিধে হয়নি তাছাড়া সৌম্যদীপ যেভাবে স্টেশন থেকে যত্ন করে আমায় নিয়ে এল, তাতে কোনো অসুবিধে হওয়ার কথাও নয়
হ্যাঁ... আসলে আপনার লেখার খুব ভক্ত শ্যামা যেদিনই ফোন করে জানাল যে আপনি আসছেন এখানে, সেদিন থেকেই তার উৎসাহের কোনো কমতি নেই,বললেন রথীনবাবু
সৌম্যদীপদের বাড়িটি দোতলা অনাদিশেখর এবং রথীনবাবু বসে আছেন একতলায় বসার ঘরে বাড়িটি যে বেশ পুরোনো তা এটির বর্তমান অবস্থা এবং সাবেকি নকশা দেখেই বোঝা যায় অনাদিশেখর চারিদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন সবটা ইতিমধ্যেই তাঁর জন্য একটু চা-জলখাবারেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে, অনাদিশেখর সেগুলোরই সদ্ব্যবহার করছিলেন, তখনই ধুপধাপ শব্দ করে সৌম্যদীপ সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল একতলায় সে ঘরে ঢুকতেই রথীনবাবু বললেন, “দোতলায় আপনার থাকার ব্যবস্থা করেছি আপনার ঠিক পাশের ঘরটিই আমার ছেলের কোনো দরকার হলে নির্দ্বিধায় বলবেন ওকে যাই হোক, আপনি খাওয়াদাওয়া করে নিন, আপনাকে আপনার ঘরটা দেখিয়ে দেবে
অনাদিশেখর খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে, সৌম্যদীপের পিছু পিছু তাঁর থাকার ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলেন ঘরটি ছোটো হলেও ছিমছাম সাজানো আসবাব বলতে তেমন কিছু নেই থাকার মধ্যে রয়েছে একটা রিডিং টেবিল, একটা খাট আর একটা আলমারি ঘরে বেশ বড়ো একটা পশ্চিমখোলা জানলাও রয়েছে ঘরটি দেখে খুব পছন্দ হল অনাদিশেখরের৷ তিনি ব্যাগ থেকে ল্যাপটপটি বার করে রিডিং টেবিলে রাখলেন টেবিলের পাশেই একটা প্লাগ পয়েন্ট ছিল, পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে ঝটপট সেই প্লাগপয়েন্টে চার্জার কানেক্ট করে সেটি চার্জে বসিয়ে দিলেন তিনি
তাহলে স্যার আপনি বিশ্রাম করুন আমি আমার ঘরেই আছি, কোনো দরকার হলে বলবেনবলেই সৌম্যদীপ নিজের ঘরে চলে গেল
অনাদিশেখর একটা সিগারেট ধরিয়ে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন জানলা দিয়ে তাকালেই বিঘের পর বিঘে ধানের খেত খেতের ওপারে দিগন্তরেখা বেয়ে ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে শেষ বিকেলের টিমটিমে সূর্যটি

()

রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে অনাদিশেখর যখন নিজের ঘরে এলেন তখন ঘড়িতে সময় রাত ন’টা বেজে পঁয়ত্রিশ ঘরে ফিরেই জানলার সামনে গিয়ে একটি সিগারেট ধরালেন তিনি এখানে নাকি মশার ভীষণ উপদ্রব, তাই সৌম্যদীপ একটু আগে এসে একটি মশারি টাঙিয়ে দিয়ে গেছে
কলকাতায় রাত সাড়ে ন’টা মানে নেহাতই সন্ধে, তবে এখানে তা মোটেই নয় সৌম্যদীপের কথা অনুযায়ী আর এক ঘন্টার মধ্যেই নাকি গ্রামের বেশিরভাগ বাড়ির আলো নিভে যাবে তার কিছুক্ষণ পর কান পাতলে ঝিঁঝিঁপোকার শব্দ ছাড়া আর নাকি কিছু শোনা যাবে না খাওয়ার ঘরে ছেলেটির কথা শুনে প্রায় হো হো করে হেসে ফেলেছিলেন অনাদিশেখর
সিগারেট শেষ করে টেবিল থেকে ল্যাপটপটি নিয়ে মশারির ভেতর ঢুকে পড়লেন তিনি ল্যাপটপটি অন করে প্রথমেই রোজকার মতোই একটু সোস্যাল মিডিয়ার সাইটগুলো দেখে নিলেন অনাদিশেখর তারপর ইন্টারনেট অফ করে উপন্যাসটির খসড়া তৈরির কাজে লেগে পড়লেন কিন্তু বেশ কয়েক মিনিট ভাবার পরেও তেমন জোরদার প্লট তাঁর মাথায় এল না তিনি বসে বসে ভাবছিলেন যে ঠিক কী লেখা যায়, আর তখনই দরজায় আলতো টোকা পড়ল
স্যার আসব?” সৌম্যদীপের ডাকে চমক ভাঙল অনাদিশেখরের তিনি হেসে বললেন, “আরে এসো এসো...” বলেই তিনি মশারিটা তুলে ধরলেন সৌম্যদীপ টুক করে ঢুকে পড়ল মশারির ভিতর৷ সৌম্যদীপ ভিতরে ঢুকে বসতেই অনাদিশেখর বললেন, “তুমি আজ শুতে যাওনি এখনও, কী ব্যাপার?”
না, আসলে এখনও হাতে খানিকটা সময় আছে, তাই ভাবলাম আপনার সঙ্গে একটু দেখা করে যাই
বেশ করেছ আর শোনো আমায় বার বার স্যার বলে ডাকার দরকার নেই, কাকু বলে ডাকবে
আচ্ছা, তবে কাকুই বলব বাবা বলছিল আপনি একটা উপন্যাস লেখার জন্য এখানে এসেছেন...?”
হ্যাঁ তাই তো এসেছি, তবে জানি না কতদূর কী এগোতে পারব!”
শুরু করেছেন কিছু?”
এখনও কিছুই এগোয়নি, আপাতত একটা বেশ জমজমাট প্লট ভাবার চেষ্টা করছি
এখানকার জল-বাতাস খুব পরিষ্কার, কয়েকদিন থাকলেই দেখবেন আপনার মাথা খুলে যাবে
সৌম্যদীপের কথা শুনে মনে মনে বেশ খানিকটা আশ্বস্ত হলেন অনাদিশেখর তারপর ল্যাপটপটি বন্ধ করে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা সৌম্যদীপ, তোমাদের এখানে কোনো বিখ্যাত জায়গা আছে? মানে ঘোরার মতো? মানে কোনো রাজবাড়ি বা জমিদার বাড়ি কিংবা কোনো মন্দির?”
হ্যাঁ, গ্রামে বেশ বড়ো একটা মন্দির আছে, অনেকদিনের পুরোনো গ্রামের বাইরে জানি না, তবে গ্রামের মধ্যে সেটি বেশ বিখ্যাত আপনি বললে আমি আপনাকে একদিন নিয়ে যাব
আচ্ছা তাহলে ওই কথাই রইল একদিন সময় করে তুমি আর আমি মিলে মন্দিরটা গিয়ে দেখে আসব
অনাদিশেখরের কথায় ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায় সৌম্যদীপ, তারপর আবার বলে, “ওটা ছাড়া আরও একটি জায়গা রয়েছে, তবে সেটিকে বিখ্যাত না বলে কুখ্যাত বললেই বোধহয় ঠিক বলা হয়
কেন কুখ্যাত কেন?” অনাদিশেখর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন
আসলে ওটি একটি হানাবাড়ি তো, তাই...”
অ্যাঁ, বলো কী? ভূতুড়ে নাকি?”
গ্রামের লোকে তো তাই বলে কাকু আসলে বহুদিন আগে ওখানে নাকি দয়ারাম সান্যাল বলে একটি লোক থাকত সে নাকি বাড়ির ভেতর বাগানে দোলনায় দুলতে দুলতে হার্ট অ্যাটাক করে মারা যায় তারপর থেকেই নাকি ওই বাড়িটা অমন ভূতুড়ে হয়ে গেছে অনেকেই নাকি রাত-বিরেতে ওখানে দয়ারামকে ঘুরে বেড়াতে দেখেছেসৌম্যদীপ একটানা বলে থামল একটু তারপর আরও বলল, “দয়ারাম মারা যাওয়ার পর নাকি ওই বাড়িতে অনেকেই থাকতে এসেছিল, কিন্তু কেউ নাকি দুই-তিনদিনের বেশি টিকতে পারেনি
ইন্টারেস্টিং... বেশ ইন্টারেস্টিং তুমি যা বলছ তা যদি সত্যি হয়, তবে তো একবার জায়গাটি গিয়ে দেখতে হচ্ছে,অনাদিশেখর বললেন
আচ্ছা, আপনি বলবেন আমায় কবে যাবেন, আমি আপনাকে নিয়ে যাব,সৌম্যদীপ বলল
কথাবার্তা শেষ করে সৌম্যদীপ নিজের ঘরে চলে গেল অনাদিশেখরও বুঝলেন যে আজ আর লেখা খুব একটা এগোবে না, তাই তিনি ল্যাপটপটি গুছিয়ে রেখে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন সারাদিন পর ক্লান্তির চোটে সহজেই ঘুম নেমে এল তাঁর চোখে আর সেই ঘুমের মধ্যেই তিনি যেন দেখতে পেলেন তাঁকে নিজের সাজানো বাগানের মাঝে, তাঁর সাধের দোলনায় ধীরে ধীরে দুলছে সে নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ, নিথর হয়ে আরামে দোল খাচ্ছে দয়ারাম সান্যাল

()

দত্তপুকুরে পরের কয়েকটি দিন বেশ আরামেই কেটে গেল অনাদিশেখরের এর মধ্যেই একদিন সৌম্যদীপকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামের সেই বিখ্যাত কালীমন্দিরটিও দেখে এসেছেন তিনি একটা যুতসই উপন্যাস যাতে ভালোয় ভালোয় উতরে যায় সেই প্রার্থনা করে পুজোও দিয়েছেন মন্দিরে তবুও উপন্যাসটি নিয়ে তেমন একটা সুবিধা করতে পারেননি এখনও তাই উপন্যাস লেখা প্রায় শিকেয় তুলে ঘুরে বেড়িয়েই সময় কাটাচ্ছেন ইদানীং এই আজ যেমন তিনি ঠিক করেছেন দয়ারামের সেই হানাবাড়ি দেখতে যাবেন ভাবনা মতোই সৌম্যদীপকে সে কথা বলেও রেখেছেন অনাদিশেখর
কথামতোই সকালের জলখাবার খেয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে দয়ারামের হানাবাড়িটি সৌম্যদীপদের বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে৷ তবে ওরা ঠিক করল যে পায়ে হেঁটেই যাবে সেখানে
গ্রামের মেঠো পথ ধরে মিনিট কুড়ি হাঁটতেই ওরা পৌঁছে গেল সেই হানাবাড়ির সামনে অনেকখানি জায়গা জুড়ে তৈরি এই বাড়িটির বর্তমান অবস্থা জরাজীর্ণ হলেও এককালে যে বাড়িটি বেশ পেল্লাই ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই বাড়িটির চারপাশে গাছগাছালি, ঝোপঝাড়ের ভীড় জমেছে বিস্তর বাড়ির দেয়ালগুলোয় জায়গায় জায়গায় ফাটল ধরেছে চুন খসে গিয়ে দেয়ালের ইটগুলো কোনো এক পান চিবানো বুড়ির দাঁতের মতোই বেরিয়ে এসেছে সামনের দিকে দেয়ালের ফাটলগুলো দিয়ে বট-অশত্থের চারা গজিয়ে বড়ো হয়েছে বহুদিন এমন বাড়ির কথা অনাদিশেখর তাঁর লেখায় বহুবার লিখেছেন, তাই বাড়িটি দেখে খুব একটা অবাক হলেন না তিনি
ভেতরে যাবেন নাকি কাকু?” সৌম্যদীপ জিজ্ঞেস করল
সে কী! এতদূর পায়ে হেঁটে এলাম, আর ভেতরে যাব না!” বলেই অনাদিশেখর এগিয়ে গেলেন বাড়ির গেটের দিকে সৌম্যদীপও ওঁর পিছু পিছু হাঁটতে থাকে
ভগ্নপ্রায়, জং ধরা লোহার গেটটায় সজোরে একটি ঠেলা মারতেই সেটি একটি বিকট শব্দে খুলে গেল কাঠের তৈরি বাড়ির সদর দরজাটি ভেঙে পড়ে আছে নিচে তাই ভিতরে ঢুকতে তেমন একটা কসরত করতে হল না ওদের সদর পেরিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকতেই একরাশ মাকড়সার জাল চোখে-মুখে জড়িয়ে গেল অনাদিশেখরের তিনি হাত দিয়ে সেগুলি সরিয়ে আরও খানিকটা ভিতরের দিকে এগিয়ে গেলেন ভাঙা জানলাগুলো দিয়ে দিনের আলো বেশ ভালোমতোই প্রবেশ করছিল ঘরে আর সেই আলোতেই ঘরের চারিপাশ ভালো করে দেখলেন অনাদিশেখর আসবাবপত্র যা ছিল সবই প্রায় ভেঙেচুরে উইপোকার খাদ্যে পরিণত হয়েছে ঘরের দেয়ালে জায়গায় জায়গায় ভাঙা গর্ত চোখে পড়ল সেগুলি যে সাপ, ভাম, বেজি কিংবা ছুঁচোর বাসস্থান তা বলাই বাহুল্য ঘরটি ভালো করে দেখে নিয়ে ওঁরা বাড়ির পেছনের একফালি জমিতে গিয়ে দাঁড়ালেন এটি যে এককালে বাগান জাতীয় কিছু ছিল তা দেখেই বোঝা যায় জমিটির ঠিক মাঝখানে একটা জরাজীর্ণ, ভগ্নপ্রায় দোলনা ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে হাওয়ায় দুলছে ওটি দেখেই সৌম্যদীপের বলা গল্পটি এক নিমেষে চোখের সামনে ভেসে উঠল অনাদিশেখরের তিনি আড়চোখে তাকালেন সৌম্যদীপের দিকে
সৌম্যদীপ একটা বড়োসড়ো ঢোঁক গিলে বলল, “এটাই সেই দয়ারামের দোলনা
জায়গাটা দারুণ, বুঝলে এখানে একটা রাত আমি কাটাতে চাই, জাস্ট ফর অ্যাডভেঞ্চার কোনো অসুবিধে নেই তো?” অনাদিশেখর জিজ্ঞেস করলেন
সৌম্যদীপ অবাক হয়ে বলল, “কী বলছেন কাকু? এই বাড়িটার যে বিস্তর বদনাম রয়েছে তাছাড়া সাপখোপ কী না কী রয়েছে এখানে, আর আপনি বলছেন রাত কাটাবেন? বাবা শুনলে কিন্তু আমার ওপর খুব রাগ করবে,সৌম্যদীপ একটানা বলে থামল
অনাদিশেখর বললেন, “আহা তুমি কিচ্ছু চিন্তা কোরো না আমি সব সামলে নেববলেই মুচকি হাসলেন অনাদিশেখর, তারপর সৌম্যদীপের দিকে তাকিয়ে বললেন, “চলো ফেরা যাক এবার কাল রাতেই তো আবার আসতে হবে তার আগে সব জোগাড়যন্ত্র করে ফেলতে হবেবলেই তিনি গটগট করে হেঁটে সেদিনের মতো বেরিয়ে এলেন দয়ারামের হানাবাড়ি থেকে
সৌম্যদীপ শুনেছিল যে লেখকেরা নাকি কিঞ্চিৎ খামখেয়ালি প্রকৃতির হন, কিন্তু তার মানে যে এইরকম, তা সে কোনোদিন ভাবেনি

()

পরের দিন সন্ধে নাগাদ অনাদিশেখর চলে এলেন দয়ারামের সেই হানাবাড়িতে সৌম্যদীপ তাকে ছেড়ে দিয়ে গেল সেখানে সেও বায়না ধরেছিল তাঁর সঙ্গে এই হানাবাড়িতে রাত কাটাবে বলে, কিন্তু অনাদিশেখর তাকে সঙ্গে নেননি তিনি নিজে একা মানুষ, আগেপিছে কেউ নেই তাঁর তাই নিজের দায়িত্বে তিনি যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন কিন্তু অন্যের ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে কোনোরকম বিপদে তিনি ফেলতে চান না যদিও ভূত-প্রেত-পিশাচে তিনি বিশ্বাস করেন না, কিন্তু সাপখোপ তো থাকতেই পারে এই পোড়োবাড়িতে তাই সব ভেবেচিন্তেই তিনি সৌম্যদীপকে সঙ্গে না নেওয়ারই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যাই হোক, সৌম্যদীপকে সে রাতের মতো বিদায় জানিয়ে অনাদিশেখর দয়ারামের হানাবাড়িতে প্রবেশ করলেন বাড়ির একটি তুলনামূলক আস্ত ঘর বেছে নিয়ে, একটু ঝাড়পোঁছ করে একটা মাদুর পেতে বসলেন তিনি সঙ্গে করে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তিনি নিয়ে এসেছেন সাপখোপ দূরে রাখতে কার্বলিক অ্যাসিড, মশা তাড়াতে মশার ধূপ, একটা ইমার্জেন্সি লাইট আর কিছু শুকনো খাবার এনেছেন সৌম্যদীপের মা এক ফ্লাস্ক চা- পাঠিয়ে দিয়েছেন সঙ্গে সব মিলিয়ে একটি রাত কাটানোর জন্য যে বেশ এলাহি আয়োজন তা বলা যেতেই পারে
সব গোছগাছ করে নিয়ে বেশ আরাম করে বসলেন অনাদিশেখর প্রথমেই এক প্রস্থ চা সাবাড় করে মোবাইল ফোনে একটা ভালো -বুক খুলে পড়তে শুরু করলেন
এভাবেই বেশ খানিক্ষণ সময় কেটে গেল রাত ক্রমশ বেড়েই চলেছে, সময় যত এগোচ্ছে চারিদিক যেন ততই নিস্তব্ধ হয়ে উঠছে স্বাদ পরিবর্তন করতে অনাদিশেখর -বুক ছেড়ে কিছুক্ষণ ইউটিউবে মজার ভিডিও দেখলেন, গানও শুনলেন কিছুক্ষণ রাত আরেকটু বাড়তেই খিদে পেয়ে গেল তাঁর ব্যাগ থেকে কিছু শুকনো খাবার বের করে রাতের খাওয়াটা সেরে ফেললেন তিনি খাওয়া শেষ করে আবার সেই -বুকে মন দিলেন -বুকটি পড়তে পড়তে কখন যে চোখদুটো লেগে গিয়েছিল বুঝতে পারেননি তিনি হঠাৎ কীসের যেন একটা শব্দে হুড়মুড়িয়ে জেগে উঠলেন উঠে দেখলেন চারিদিক ঘুটঘুট করছে অন্ধকার ইমার্জেন্সি লাইটটা কোনো এক অজানা কারণে নিভে গেছে অনাদিশেখর বেশ কয়েকবার লাইটের সুইচটা অন-অফ করলেন, কিন্তু কোনো লাভ হল না জিনিসটা ফুল চার্জ দিয়ে তবেই নিয়ে এসেছিলেন অনাদিশেখর, তাহলে এটা এমন হুট করে নিভে গেল কেন বুঝতে পারলেন না তিনি কী করবেন সেটাই ভাবছিলেন অনাদিশেখর, এমন সময় হঠাৎ ঘরের মধ্যে একটা খস খস শব্দ পেলেন তিনি মনে হল কেউ যেন কাগজের উপর পেন দিয়ে কিছু লিখছেন অনাদিশেখর চট করে পকেট হাতড়ে তাঁর লাইটারটি বের করে জ্বালিয়ে চারিদিক দেখলেন, কিন্তু কই কিছুই দেখতে পেলেন না শব্দটাও আচমকা থেমে গেল দূরে একটা কুকুর কাতর স্বরে ডেকে উঠল বুকটা এক মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠল অনাদিশেখরের তিনি যতই ভয় না পাওয়ার চেষ্টা করুন না কেন, ভয় যে তাঁরও একটু একটু করছে সেটা তিনি ভালোই বুঝতে পারলেন যদিও সেই ভয়ের তেমন কোনো বহিঃপ্রকাশ তাঁর চোখেমুখে দেখা গেল না
লাইটারের আলোতেই মাদুরের উপর পড়ে থাকা নিজের মোবাইল ফোনটা দেখতে পেলেন অনাদিশেখর ঘুমের ঘোরে হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল হয়তো, সেটা তুলে নিয়ে মোবাইলের টর্চটি জ্বালালেন তিনি লাইটারটা পকেটে পুরে জিনিসপত্রগুলো গোছাতে শুরু করলেন অনাদিশেখর তিনি বুঝলেন যে ওই বাড়িতে থাকা আর ঠিক হবে না ভাবলেন সৌম্যদীপের বাবাকে একবার ফোন করবেন, কিন্তু মোবাইলে একটুও নেটওয়ার্ক ছিল না তাই একা একাই ফেরার তোড়জোড় করতে লাগলেন তিনি
গোছগাছ প্রায় শেষই হয়ে এসেছিল, এমন সময় বাড়ির পেছন থেকে একটা অদ্ভুত ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ কানে এল অনাদিশেখরের৷ শব্দ তিনি চেনেন, গতকাল সকালেই শুনেছিলেন তিনি এই শব্দ হাওয়ায় বাগানের দোলনাটা আবার দুলতে শুরু করেছে কী মনে হল, তিনি এক পা দু পা করে ঘর থেকে বাগানে বেরিয়ে এলেন বাগানে এসে দেখলেন দোলনা খুব জোরে দোল খাচ্ছে অনবরত এমনটা তো হাওয়ায় হয় না, দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেন বসে দোল খাচ্ছে ওটায় অনাদিশেখর হাঁটতে হাঁটতে দোলনার কাছে এগিয়ে গেলেন তারপর বাঁ হাতে দোলনাটা ধরে থামিয়ে দিলেন ওটাকে আর তখনই পেছনে সেই লেখার খস খস শব্দটি আবার শুনতে পেলেন তিনি, এক ঝটকায় পেছন ফিরে তাকালেন, কিন্তু কিছুই দেখতে পেলেন না আশ্বস্ত হয়ে আবার দোলনার দিকে মুখ ফেরাতেই ভয়ে একেবারে আঁতকে উঠলেন অনাদিশেখর বুকের কয়েকশো দামামা যেন একসঙ্গে বেজে উঠল তার তিনি দেখলেন একটা মাঝবয়সি লোক দোলনায় বসে আছেন, আর তাঁর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন
কী সুন্দর আরামে দোল খাচ্ছিলাম, দিলেন তো থামিয়ে...!” লোকটির কথা শুনে অনাদিশেখরের মাথাটা ঝিমঝিম করতে শুরু করল চারদি কেমন যে ঘুরতে লাগল আচমকাই চোখদুটো ক্রমশ ভারী হয়ে বুজে এল তাঁর ধপ করে একটি শব্দ করে অনাদিশেখর পড়ে গেলেন মাটিতে

()

বেশ কিছুক্ষণ অচৈতন্য হয়ে মাটিতে পড়েছিলেন অনাদিশেখর মাঝরাতে যখন ওঁর জ্ঞান ফিরল, মাথার ভেতর কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল তাঁর কয়েক মুহূর্তের জন্য কিছুই মনে করতে পারছিলেন না কিন্তু আচমকাই উঠোনের মাঝে ঝুলন্ত দোলনা এবং সেই দোলনায় বসে হাসিমুখে দোল খাওয়া লোকটিকে দেখতেই এক নিমেষে সবটা মনে পড়ে গেল অনাদিশেখরের তবে ভয়ের রেশটা তাঁর কিঞ্চিৎ প্রশমিত হয়েছে, তাই বুকে খানিকটা সাহস সঞ্চয় করে তিনি বললেন, “আপনিই কি দয়ারাম?”
অনাদিশেখরের প্রশ্ন শুনে লোকটার মুখটা কেমন ছুঁচোর মতো হয়ে গেল তিনি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ স্বরে উত্তর দিলেন, “অ্যাঁ... আপনিও দেখছি বাকিদের মতো একই ভুল করলেন! আমি দয়ারাম নই এই দোলনাটা দয়ারামের হলেও আমি মোটেও দয়ারাম নই, বুঝলেন?”
তাহলে আপনি কে?” অনাদিশেখর জিজ্ঞেস করলেন
আমি বিমল কুমার দয়ারামের বাল্যকালের বন্ধু দয়ারাম তো মরল গিয়ে হার্ট অ্যাটাকে, এক্কেবারে স্বাভাবিক মৃত্যু আমার সামনে দিয়েই ড্যাং ড্যাং করে ওপারে চলে গেল, আর এই অভাগা আমি এপারেই রয়ে গেলুম
আপনারটা কি স্বাভাবিক ছিল না?”
আরে না না, স্বাভাবিক হলে কি আর এখানে পচতুম নাকি, কবে পগার পা হয়ে যেতুম না!”
তাহলে আপনি কীভাবে?”
কীভাবে আবার, ওই দয়ারাম বাড়ি ডেকে খুন করল, টেঁসে গেলুম
বলেন কী! খুন?”
হ্যাঁ, ওই ওকে বেশ কিছু টাকা ধার দিয়েছিলুম আমি আসলে লেখালেখি করতাম, একটা বই মাঝে খুব চলল, হাতে টাকাপয়সাও বিস্তর এল তখনই দয়ারাম ধার চেয়ে বসল আমি ভাবলুম, ছোটোবেলার বন্ধু, বিপদে পড়েছে, যাই সাহায্য করি কিন্তু এক বছর কেটে গেলেও সে টাকা ফেরত দিলে না এদিকে আমারও একটু টাকার দরকার হয়ে পড়েছিল সেই সময় আমি তাই একটু তেড়েফুঁড়ে তাগাদা দিতে শুরু করলুম শেষে একদিন দয়ারাম বলল সে নাকি টাকার বন্দোবস্ত করেছে তার বাড়ি এসে যেন আমি নিয়ে যাই আমি চলে এলুম টাকা নিতে কলকাতা থেকে সে বললে রাতটা যেন থেকে পরের দিন ফিরি আমিও রাজি হয়ে গেলুম তারপর ঘুমের মধ্যেই.... জানেন এই দোলনার তলায় পুঁতে দিয়েছিল আমার লাশটা কেউ কোনোদিন জানতেও পারল না কিছু!”
“ছোটোবেলার বন্ধু এমন বিশ্বাসঘাতকতা করল?”
টাকাপয়সা বড়ো বাজে জিনিস অনাদিবাবু, সম্পর্কের সমীকরণগুলো এক মুহূর্তে বদলে দেয়
আপনি আমার নাম জানেন?”
এখন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কোনো কিছুই আমার অজানা নেই অনাদিবাবু
বিমল কুমারের কথা শুনে মনটা বড়ই বিষণ্ণ হয়ে গেল অনাদিশেখরের নিজের মৃত্যুর কথাও কেমন হেসে হেসে বলছেন ভূতেদের কি তবে অনুভূতি বলে কিছু থাকে না!
থাকে অনাদিবাবু থাকে তবে যে ঘটনার কথা আজ আপনাকে বললাম তা আজ থেকে বহুবছর আগের কথা তাই নিয়ে আর দুঃখ-কষ্ট হয় না
বিমল কুমারের কথা শুনে অবাক হয়ে হয়ে অনাদিশেখর বললেন, “আরে আপনি আমার মনের কথা বুঝলেন কী করে?”
ওই যে বললুম, এখন আর কোনো কিছুই আমার অজানা নেই আমি এও জানি যে আপনি গাঁয়ে এসেছেন নিজের রাইটার্স ব্লক কাটানোর জন্য এবং সে বিষয়ে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি, কিন্তু আপনাকেও আমার জন্য কিছু করতে হবে
কী করতে হবে?”
এই দোলনার তলায় আমার লাশটা পোঁতা আছে, মাটি খুঁড়ে একটু সেটা বের করে একটু জ্বালিয়ে দেবেন প্লিজ? আসলে সৎকার না হলে যে অনন্তকাল ধরে আমায় এই বাড়িতেই পচতে হবে
না না, কাজ আমার একার পক্ষে সম্ভবই না তাহলে দাঁড়ান আমি লোকজন ডেকে আনি...”
একদম না অনাদিবাবু লোকজন ডাকবেন না সে ক্ষেত্রে আবার থানা পুলিশ, ময়নাতদন্তআমার আর ওপারে যাওয়া হবে না আপনি প্লিজ একটু জ্বালিয়ে দিন ওটা, আমি নিজের ডায়রির হদিসটা আপনাকে বলে যাব ওতে আমার অপ্রকাশিত গল্প-উপন্যাসের খসড়া করা রয়েছে ওগুলো একটু দেখে নিলে আশা করছি আপনার রাইটার্স ব্লকটা কেটে যাবে
বিমল কুমারের এহেন কাকুতিমিনতি শুনে শেষমেশ রাজি হয়ে গেলেন অনাদিশেখর তাছাড়া বিমল কুমারের প্রস্তাবটাও খুব একটা মন্দ লাগল না
কিন্তু মাটি খুঁড়তে তো কোদাল লাগবে, তারপর আপনার অবশেষ জ্বালাতে পেট্রোল অথবা কেরোসিন... সে সব পাব কোথায়?” অনাদিশেখর জিজ্ঞেস করলেন
বিমল কুমার একগাল হেসে গদগদ হয়ে বললেন, “ নিয়ে চিন্তা করবেন না অনাদিবাবু, সে সব ব্যবস্থা আমি করে রেখেছি আপনি বাড়ির ভেতর ঢুকে বাঁ দিকে রান্নাঘরে চলে যান, ওখানে সব রাখা আছে
বিমল কুমারের কথামতো অনাদিশেখর রান্নাঘর থেকে কোদাল আর কেরোসিনের টিনটা নিয়ে এলেন তারপর জয় মা বলে শুরু করলেন মাটি খোঁড়া বিমল কুমার দোলনায় বসে দোল খেতে খেতে ব্যাপারটাকে সুপারভাইজ করছিলেন বেশ কিছুক্ষণ ওভাবে খোঁড়াখুঁড়ির পর হঠাৎ একটা সাদা হাড় দেখতে পেলেন অনাদিশেখর ওটা দেখেই ভয়ে আঁতকে উঠলেন তিনি কিন্তু তৎক্ষনাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে আবার খুঁড়তে শুরু করলেন তিনি অতঃপর একটি আস্ত কঙ্কাল কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তাঁর সামনে প্রকট হল
এই যে, এইটেই আমি দিন জ্বালিয়ে...” বিমল কুমার চিৎকার করে উঠলেন অনাদিশেখর আলতো ঘাড় নেড়ে কাঁপা কাঁপা হাতে কেরোসিনের টিনটা তুলে নিলেন তারপর টিন মধ্যস্থ কেরোসিনের প্রায় সবটাই ঢেলে দিলেন কঙ্কালটার ওপর
নিন এবার দেশলাইটা মারুন ঝটপট, আর দেরি করবেন না,বিমল কুমারের যেন আর তর সইছে না অনাদিশেখর বুঝলেন যে ঝামেলা যত তাড়াতাড়ি মেটানো যায় ততই মঙ্গল তিনি ঝটপট পকেট থেকে নিজের সাধের লাইটার বের করলেন তারপর সেটি জ্বালিয়ে ছুঁড়ে ফেললেন কেরোসিন-সিক্ত কঙ্কালটির ওপর এক নিমেষে সেটি দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল তাঁর চোখের সামনে সে দৃশ্য দেখে বিমল কুমার আনন্দে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন চিৎকার করে বললেন, “অনেক ধন্যবাদ অনাদিবাবু, আপনি আমায় মুক্তি দিলেনবিমল কুমারের কথা শেষ হতেই একটা উজ্জ্বল আলোক বলয় ঘিরে ধরল তাঁকে তিনি চিৎকার বললেন, “আমি চললাম অনাদিবাবু আমার ডায়রিটা ঘরের ভেতর যে কাঠের আলমারিটা রয়েছে তার মধ্যেই রাখা আছে৷ ওটা অবশ্যই নিয়ে যাবেন সঙ্গে আশা করছি আপনার উপকার হবেবিমল কুমারের গলার স্বর ক্রমশ মৃদু থেকে মৃদুতর হতে লাগল তাঁর কথাগুলো মিলিয়ে যেতেই দয়ারামের পরিত্যক্ত বাগানের সেই উজ্জ্বল আলো আচমকাই নিভে গেল সব শব্দ সব আলো এক নিমেষে ভোজবাজি মতোই মিলিয়ে গেল অনাদিশেখর কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন সেখানে, তারপর ধীরে ধীরে পা বাড়ালেন বাড়ির ভেতরের দিকে

()

মহালয়ার শুভ দিনে প্রকাশিত হলছেলেবেলাসাহিত্য পত্রিকার পূজাবার্ষিকী অনাদিশেখরের নতুন ভৌতিক উপন্যাসদয়ারামের দোলনারদৌলতে পূজাবার্ষিকীটি জটায়ুর ভাষায় হট কচুরির মতোই বিকোচ্ছে চারিদিকে অনাদিশেখর বিমল কুমারের ডায়রিটি পেয়েছিলেন বটে, তবে সে ডায়রির কোনো লেখাই তাঁর খুব একটা মনে ধরেনি তাই দত্তপুকুরে ঘটনাটিকে কেন্দ্র করেই তিনি লিখে ফেলেছেন এই উপন্যাসটি
সৌম্যদীপ আজ সকালেই হাতে পেয়েছে পূজাবার্ষিকীটি অনাদিশেখরের উপন্যাসটি সে প্রথমেই পড়ে ফেলেছে৷
দয়ারামের হানাবাড়ি নিয়ে উপন্যাসটি বেশ ভালোই জমিয়েছেন কাকু,’ মনে মনে ভাবল সৌম্যদীপ দয়ারামের সাহিত্যিক বন্ধু, খুন, কঙ্কাল... রহস্যের জালটা বেশ ভালোই বুনতে পারেন অনাদিশেখর সেনগুপ্ত প্রিয় লেখকের কল্পনা শক্তি আরও একবার মুগ্ধ করল তাকে
----------
ছবি – সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী

No comments:

Post a Comment