গল্প:: পেইন্টিং - সহেলী চট্টোপাধ্যায়


পেইন্টিং
সহেলী চট্টোপাধ্যায়

বাড়িটা প্রথমবার দেখেই বেশ ভালো লেগে গেল রনের। কলেজ থেকে একটু দূরে হলেও অসুবিধা কিছু নেই। একটা বাস ধরে নিলেই হবে। শহর থেকে একটু দূরে হলেও জায়গাটা বেশ সুন্দর। ব্যালকনি থেকে কেমন সুন্দর পাহাড় দেখা যায়! রন অবশ্য জানে এটা পাহাড় নয়, টিলা। বাড়ির সামনেই ঝাঁকড়া কৃষ্ণচূড়া গাছটাও বড়ো সুন্দর। রন, যার পুরোনাম রণজয় চ্যাটার্জি, সে এখানে কলেজে পড়াতে এসেছে। তার সাবজেক্ট ইংলিশ। কিন্তু কলেজের কাছে সে বাড়ি পেল না। এই বাড়িটা তার বাবার ব্যাঙ্কের এক কলিগ সুজয় কাকু ঠিক করে দিয়েছেন। সুজয় কাকুরই বাড়ি আসলে। এখন তিনি কলকাতায় থাকেন। নিজের বাড়িতে মাঝে মাঝে যান দেখভাল করতে। সুজয় কাকু, স্ত্রী রীতা কাকিমা আর মেয়ে রিয়াকে নিয়ে মাঝে মাঝে এখানে আসেন। রনেদের বালিগঞ্জের বাড়িতেও অনেকবার এসেছেন। রনের বাবা শুভঙ্কর বাবু রিটায়ার করলেও সুজয় কাকুর এখনও চাকরি আছে। সুজয়কাকু নিজের দাদার মতোই ভক্তিশ্রদ্ধা করেন। রনের মা হোমমেকার।  কলকাতা থেকে এতদূরে তার জব হবে রন কল্পনাও করতে পারেনি। রনের খুব মন খারাপ লাগলেও এখন তার ভালোই লাগছে। রন নিজে ভাত বসাতে পারে। সামান্য রান্নাবান্নাও পারে।

দিনগুলো বেশ সুন্দর কেটে যাচ্ছিল। সকালে চা খেয়েই কলেজ চলে যেত, কারণ ওর মর্ণিং কলেজ। ব্রেকফাস্ট এবং লাঞ্চ সে ক্যান্টিনে সেরে নিত। ফিরতে ফিরতে সেই আড়াইটে। কোনো কোনো দিন একটা। ঘরে ফিরে সে একটু ঘুমিয়ে নিত। সন্ধের সময় রান্না করত, বা কখনও অর্ডার দিত। বই পড়ত। ফেসবুক করত। বা কখনও নিজের পড়াশোনা করতএখানে কয়েকটা টিউশনির সন্ধান পেয়েছিল, কিন্তু ওর আর ভালো লাগত না। তাই সেই কাজে আর জড়ায়নি। নিজের জন্যও একটু সময়ে দরকার আছে। শুক্রবার কলেজ করে অনেক সময় বাড়ি চলে যেত। আবার সোমবার ফিরত। এইভাবেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল বেশ।
বাড়িটা দোতলা। রন থাকে একতলায়। ওপরের ঘরগুলো তালা বন্ধই থাকে। এখানে একজন ভদ্রলোক, যাকে সুজয় কাকু ঠিক করেছেন, সেই শঙ্কর কাকু মাঝে মাঝে বাড়িটা পরিষ্কার করে যায় দু-একজন কাজের লোক নিয়ে। আজ রবিবার। শঙ্কর কাকু দুজন লোক নিয়ে এসে ওপরের ঘরদোর পরিষ্কার করাচ্ছিল। রন বাড়ি যায়নি। সে মাঝে মাঝে ভাবে বাড়িটার একটা অংশে সুজয় কাকু অনায়াসে ভাড়াটে বসাতে পারেন। কেন যে বসাননি কে জানে! শঙ্কর কাকুরা ওপরটা তালা দিয়ে চলে গেল।
রন দুপুরে নিজের রান্না করা ডিমের ডালনা আর ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। দুপুর আড়াইটে এখন। বিশ্রাম না নিয়ে সে ওপরে এলতখনই সে খেয়াল করল যে একটা ঘরের তালা খোলা। শঙ্কর কাকু নিশ্চয় তালা লাগাতে ভুলে গেছেন। একটু ইতস্ততঃ করে সে ঢুকে পড়ল। ঘরে ঢুকেই কিন্তু ওর চোখ ধাঁধিয়ে গেল। অসাধারণ সব পেন্টিং ঝুলছে দেয়ালে। অনেক পুরোনো আমলের ছবি। ছবি বা পেইন্টিং সম্পর্কে রনের তেমন ধ্যানধারণা না থাকলেও সে বুঝতে পারল এগুলো বেশ দামিএকটা পেইন্টিং ওর খুব ভালো লাগল। এক কোণে ছবিটা পড়ে ছিল। একটা বাড়ি, সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছে অরেঞ্জ ফুল এসেছে। বাড়িটা বেশ চেনা লাগছে। কিছুক্ষণ ভাবার পরই ও বুঝতে পারল এটা এই বাড়িরই পেইন্টিং। রন ছবিটা সঙ্গে করে নিচে নিজের ঘরে নিয়ে এল ছবিটা দেয়ালে টাঙাতে গিয়ে দেখল ছবির পেছনে কোনোরকম কিছু নেই যা দিয়ে ছবিটা দেয়ালে লাগাতে পারে। ও নিজের পড়ার টেবিলেই ছবিটা রেখে দিল। ওটা দিব্যি পড়ার টেবিলে ধরে গেল। এখন ওর বাড়ির সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছটায় বেশ ফুল ধরেছে। এখন মার্চ মাস। এইসব ফুলেরই সময়। ভাগ্যিস আজ বাড়ি যাইনি, তাই তো ছবিটা পেলাম,’ মনে মনে ভাবতে লাগল রনএর আগে কখনও সে কারোর জিনিস না বলে নেয়নি। কিন্তু ছবিটা দেখে যে কী হল! সুজয় কাকুর থেকে সে কিনেই নেবে। কাকু তার থেকে দাম নেবেন না সম্ভবত। এই বাড়ির টাকাও নিতে চাননি। কিন্তু রনের বাবা অনেক করে বলাতে সামান্য কিছু নিতে রাজি হয়েছেন। ফোনে সুজয় কাকুকে ধরল সুজয়, কিন্তু পেইন্টিং-এর কথা সে তুলতেই পারল না। মনে হল কেউ যেন তার মুখ চেপে ধরছে! ওদিকে সুজয় কাকুও অনর্গল কথা বলে চলেছেন। রন কিছু বলার সু্যোগও পেল না। যাই হোক, পরে একদিন বললেও হবে।
কেটে গেল আরও এক সপ্তাহ। রন একদিন বাড়ি থেকে ঘুরে গেল। এক সোমবার শেষ রাতে মেঘের গর্জনে ঘুম ভেঙে গেল রনের। কালবৈশাখী উঠবে লিখেছিল কাগজেজানলা বন্ধ করতে গিয়ে পেইন্টিং-এর দিকে নজর পড়ল রনের। আর তখনই সে শিউরে উঠল। মনে হচ্ছে পেইন্টিং-এর মধ্যেও ঝড় উঠেছে। ছবির মধ্যে ওই কৃষ্ণচূড়া গাছের ডালপালা প্রবল হাওয়ায় কেমন যেন দুলছে মনে হচ্ছে। ফুলগুলো বাতাসে দোল খাচ্ছে। বৃষ্টি পড়ছে মুষলধারে। বাড়ির সামনে ছোটো একটা নদী বইছে। পেইন্টিং-এর মধ্যে এটা কীভাবে সম্ভব হল! রন চেয়ারে বসে দেখতে লাগল। আর দেখতে দেখতে সে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙল যখন, তখন প্রায় সাতটা। বৃষ্টি কমে গেছে। পেইন্টিং ঝলমল করে হাসছে। কোথাও বৃষ্টি বা ঝড়ের চিহ্নমাত্র নেই। রামধনু দেখা যাচ্ছে। এটা তো আগে দেখেনি রন। হয়তো আগেও ছিল, রনের নজর এড়িয়ে গেছে। রনের মনে হল সব ঠিক আছে। সে ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখেছে। রন একটু দেরিতেই কলেজ গেল। সারাদিনে সে পেইন্টিং-এর কথা ভুলেই গেল। আবার বাড়ি ফিরে খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়ে পড়ল। রনের ঘুমটা ভেঙে গেল একটা মৃদু অথচ চাপা গর্জনে। আবার মেঘ ডাকছে। পায়ের দিকের জানলাটা বন্ধ করতে গিয়ে ও দেখল বাইরে চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। তাহলে মেঘে ডাক কোথা থেকে আসছে! রন পেইন্টিং-এর দিকে তাকাল। মেঘ ওই পেইন্টিং-এর মধ্যেই ডাকছে। গুরু গুরু। ওই তো বিদ্যু চমকালযত অবিশ্বাস্যই শোনাক, ব্যাপারটা সত্যি। কৃষ্ণচূড়ার ডালপালা দুলতে শুরু করেছে! রন সব কিছুই দেখছে। যেন টিভি চলছে! এবার বৃষ্টি নেমে গেল! ঝিরঝির থেকে মুষলধারে শুরু হয়ে গেল বৃষ্টি। রন বুঝতে পারল এই পেইন্টিং-এ কিছু অলৌকিকত্ব আছে। কালই সে ছবিটা ওই ছবির ঘরেই রেখে আসবে! বৃষ্টি দেখতে দেখতে রন এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল। পরের দিন রন ভেবেছিল ছবিটা সেই ছবির ঘরেই রেখে আসবে। কিন্তু অনেক খুঁজেও সেই ঘরটা ও পেল না। একটা দরজা তো খুললই না। বাইরে থেকে সিল করা। রনের মনে হচ্ছিল, এটাই সেই ঘর যেখান থেকে ও ছবিটা পেয়েছিল। কিন্তু কোন জাদুতে ঘরটা এরকম বন্ধ হয়ে গেল সেটা ও বুঝতে পারল না।
রনের আজ কলেজ যেতে ইচ্ছাও করছে না। রন আস্তে আস্তে বদলে যেতে থাকে। সব সময় পেইন্টিং-এর দিকেই ওর তাকিয়ে বসে থাকতে ভালো লাগে। কলেজ ঠিক মতো যায় না। বাড়িও খুব কম যায়। কারোর সঙ্গে মিশতেও ওর ভালো লাগে না। পেইন্টিং-এ মাঝে মাঝে দেখা যায় বৃষ্টি পড়ছে। রামধনু উঠেছে। সামনের রাস্তা দিয়ে মেয়েরা কাঁখে কলসি নিয়ে জল আনতে যাচ্ছে। মানুষগুলোর মুভমেন্ট বেশ দেখার মতো ব্যাপার। কৃষ্ণচূড়ার ডালে একটা নীল রঙের পাখি এসে বসে। একটা কাঠবেড়ালিও খুব খেলা করে পাখিটার সঙ্গে। রন ছুটে বারান্দায় যায়। সব সময় অবশ্য বাইরের দৃশ্য আর ছবির দৃশ্য মেলে না। এই ছবি কে এঁকেছে! পেইন্টিং-এ শুধু একটা এস এস আছে। কে এই এস এস!
একদিন রন কলেজ থেকে ফেরার সময় দেখল বারান্দার রেলিং ধরে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। রন আজকাল অবাক হয় না। অনেক আশ্চর্য ঘটনা এই বাড়ির মধ্যে সে দেখেছে। তারপর থেকে ঘন ঘনই সে দেখতে পেত সেই ভদ্রলোককে। মুখে কোনো কথা নেই। শুধু একগাল হাসি। গাল ভর্তি দাড়ি। মাথায় রুক্ষ চুল। কপালে একটা রক্তচন্দনের ফোঁটা। গলায় রুদ্রাক্ষে মালা। পরনে লাল কাপড়। এই কি এস এস? দেখা দিয়েই তো মিলিয়ে যায়। কীভাবে বুঝবে রন!

রনের মা-বাবা ওকে নিতে এসেছেনমা খুব কাঁদছেন। বাবা বলছেন, কী হাল করেছিস! একগাল দাড়ি কেন! তুই তো দাড়ি হলেই কেটে ফেলতিস!
সুজয় কাকুও এসেছেন। রন কিছুতেই যাবে না। সারা রাস্তা রনের মা সুজয় কাকুকে অনেক কথা শুনিয়েছেন। এই বাড়িতে আমার ছেলেকে রাখা তোমাদের উচিত হয়নি। সুজয় কাকু অনেকবার বলেছেন, কিন্তু এই বাড়ি তো হানাবাড়ি নয়। একজন পেইন্টার-এর কাছ থেকে আমার দাদু এই বাড়ি কেনেন। সেই পেইন্টার তন্ত্র সাধনা করত। নিজের আঁকা ছবির সঙ্গে তন্ত্রকে মিশিয়ে অনেক অনবদ্য সৃষ্টি করেছেন। ব্যস এইটুকুই। এটা খুব সাধারণ একটা বাড়ি। আর কোনো গল্প নেই রন মুচকি হাসে। সে কিছুতেই এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না। দরকার হলে কিনে নেবে বাড়িটা।
----------
ছবি – শুভশ্রী দাস

No comments:

Post a Comment