তিমিবাবু আর ডেনমার্কের ডেঞ্জার
দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী
দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী
ল্যাপটপ খুলে দেখি তিমিবাবুর মেইল
এসেছে। কত্তদিন পর। ফোনে যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। লিখেছেন -
‘অপরাজিতা,
আমি এখন ডেনমার্কে। আশা করি খুবই
খারাপ অবস্থায় আছ। ভারতের যা অবস্থা। (এভাবে কেউ চিঠি
শুরু করে? চোখ
উলটিয়ে বাকিটা পড়লাম) আমি এখন আসেন্স-এ। পিটার জেনসন-এর বাড়িতে। উনি একজন বিখ্যাত ফোটোগ্রাফার।
উনি একটা বিপদে পড়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তাই আসতেই হল। তুমি
তো জানো আমি কেমন পরোপকারী। তাই ভয়কে জয় করে চলেই গেলাম।
তুমি ভাবছ কী করে এই মুহূর্তে
গেলাম। সে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, বুঝলে কিনা। ওই ফটোগ্রাফার ওখানকার রাজপরিবারের
খুব কাছের মানুষ, তাই স্পেশাল ফ্লাইটের ব্যবস্থা হল। যাই
হোক, এখন আপাতত ওই ভদ্রলোকের বাড়িতেই কোয়ারেন্টাইন হয়ে রয়েছি। অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানা
ঘটছে এখানে। সে সব পরে বলব। একে
তোমরা আতঙ্কে রয়েছ, আর কেন আতঙ্ক বাড়াব?
ইতি,
তিমিরবরণ তলাপাত্র।’
লকডাউনের পরে তিমিবাবুর খোঁজ নিয়েছিলাম
এক-দু’বার। শুনলাম নাকি তার ভারী নাকাল অবস্থা। এমনিতেই সারাক্ষণ ব্যাক্টেরিয়া ভাইরাসের
ভয়ে ভয়ে থাকেন। তা আবার এ এক বিজাতীয় অচেনা ভাইরাস। তাই আজকাল ভয়ে ফোনও ধরছেন না। ফোনেও
কাশি শুনলে তার নার্ভাস ব্রেকডাউন হচ্ছে। তা এহেন তিমিবাবু নাকি স্পেশাল ফ্লাইটে ডেনমার্ক
চলে গেলেন। এরপর থেকে নিয়মিত ছবি আর মেইল পাঠাচ্ছেন। আমাদের এমনিতে কোনো অসুবিধে হচ্ছে
না। বুনো বাজার করে দিচ্ছে। ভূতেদের তো আর ভাইরাসের ভয় নেই। তবে মা সেই মাছের ঝোল ঝাল
বানিয়ে বুনোকে খাওয়াচ্ছে দু’বেলা।
আমাদের রান্নার দিদি সেও যে কী
সে কথা বলেছিলাম তো। কিন্তু মা তাকে ছুটি দিয়েছে। সবাই ছুটি পাচ্ছে ও একটু জ্যোৎস্নায়
গাছের মাথায় ঠ্যাং দুলিয়ে দুটো চ্যাঙ মাছ খাবে না? এমন নিরিবিলি
আর কখন পাবে?
একদিন পরেই স্যারের মেইল পেলাম।
স্যার মানে আমাদের গাইড, আমাদের পথপ্রদর্শক ভূততত্ত্ববিদ জে. জে, জানকী মোহন জোয়ারদার।
স্যার লিখেছেন,
‘কেমন আছ অপরাজিতা? তিমিরের মেইল
পেয়েছ নিশ্চয়ই। সে এখন ডেনমার্কে। এই পরিস্থিতির মধ্যে তিমিরকে পাঠাতে মন চাইছিল না।
কিন্তু সেই আমাকে বলল যে ঘরবন্দি থেকে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছে। ওখানে গিয়ে কী সাংঘাতিক
কাণ্ড বাঁধিয়েছে জান। ওখানে ওর কোভিড
টেস্ট করছিল যে ডাক্তার সে হসপিটালে ভর্তি। তিমির ওর চোখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিয়েছে। নাকের
মধ্যে সুড়সুড়ি লেগে নাকি এই প্রতিবর্ত ক্রিয়া। তিমির নিশ্চয়ই তোমাকে এসব কিছুই বলেনি।
যাই হোক, ওখানে কী ঘটছে না ঘটছে সেই বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ মেইল আমি ওকে পাঠাতে বলেছি।
তোমাকেও আমি সে সব পাঠাব। আগে এই মেইল-এর
সঙ্গে এটাচ করে একটা ছবি পাঠাচ্ছি। গোস্ট স্ক্যানারে ফেলে দেখো।
ভালো থেকো। তোমার মা ভালো আছেন
তো? আমার
পাঠানো অমৃতবারি সিরাপটা দিনে দু’বার খেয়ো।
ইতি,
জে. জে।’
এরপর কী কী ঘটল তিমিবাবুর জবানিতে
বলি। মেইলগুলো থেকে যা তথ্য পেলাম –
পিটার জেনসন যে একজন বিশ্ববিখ্যাত
ফটোগ্রাফার তা আমি আগে জানতাম না। ওঁর বাড়িটি যেন ফটোগ্রাফির সংগ্রহশালা। কোন দেশের
ছবি নেই সেখানে! এমনকী ভারতের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলেছেন। প্রাণের
ঝুঁকি নিয়ে বন্যার ছবি, ভূমিকম্পের ছবি, যুদ্ধের ছবি
সবই তোলার জন্য দিনের পর দিন ঘুরে বেড়িয়েছেন। হেন কোনও সেলিব্রিটি বা দেশনেতা নেই যে
ওঁকে দিয়ে ছবি তোলাতে চায় না। আমি তো ওঁর বাড়িতে ফটোগ্রাফি সংক্রান্ত বই পড়ে পড়ে বিশেষজ্ঞ
হয়ে গেছি এ ক’দিনে। তুমি চাইলে তোমারও ভালো এক-দু’খানা ছবি তুলে দিতে পারি। বিশেষ করে
ফেসবুকে যে সব অখাদ্য ছবি তুমি পোস্ট করো। যে কোনো খেঁদি, পেঁচি খারাপ
চেহারাও সুন্দর হয়ে যেতে পারে এই ছবির গুণে।
যাই হোক, ফটোগ্রাফি নিয়ে অনেক
লেকচার দিয়ে ফেললাম। আসল কথায় আসি। সম্প্রতি এই পিটার জেনসন সারাদিন ঘরের মধ্যে একা
একা বসে থাকেন। কোথাও বাইরে যান না। প্রথমে ভেবেছিলাম এই পরিস্থিতিতে এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু না, মূল
কারণটা একেবারেই আলাদা। ওঁর এই বিষাদগ্রস্ত হয়ে যাওয়ার একটা বড়ো কারণ আছে। বেশ কিছুদিন
হল উনি কোনো ছবিও তুলছেন না আর। এমনকি সাধের ক্যামেরাটা ছুঁয়েও দেখছেন না। আমি একটা
ছবি তুলে দেওয়ার আবদার জানাতে, বললেন, “তুমি কি মরতে
চাও?”
কথাটার মাথামুণ্ডু বুঝলাম না, হাঁ
করে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ।
একটু থেমে উনি বললেন, “ছবি তোলা
অনেকদিন হল বন্ধ করেছি, কারণ আমি যাদের ছবি তুলি তারাই কিছুদিন পরে...” বলে উনি আবার
চুপ করে গেলেন। বিমর্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “এরকম আগে
কখনও হয়নি। কী যে অভিশাপ লাগল। অথবা
আমিই হয়তো কোনো পাপ কাজ করেছি।”
- “এটা ঠিক কবে থেকে ঘটছে বলুন তো?”
- “তাও একবছর হতে চলল।”
- “যাদের ছবি তুলেছেন এবং যারা মারা গেছেন
তাদের ছবিগুলো কি আমি দেখতে পারি?”
পিটার জেনসন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
“ছবিগুলো আমি পুড়িয়েই দিতাম, কিন্তু কী মনে হল অনেকদিনের বন্ধু জে. জে-কে একবার ফোন
করলাম। অদ্ভুতুড়ে জিনিসপত্র নিয়েই তো ওর কারবার। জে. জে-র সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল একটা
এয়ারপোর্টে। কফি খেতে খেতে এদেশের ওদেশের অনেক গল্পগাছা করার পর জে. জে বলল, ‘এই ফ্লাইটটা
ধোরো না। ক্যানসেল করে দাও যাত্রা।’
“আমি কেন জানি না জে. জে-র কথায়
বিশ্বাস করে সেটাই করলাম। ফ্লাইটের কিছু হয়নি, কিন্তু বাড়িতে আমার একমাত্র মেয়ে, হঠাৎ গুরুতর
অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। আমার স্ত্রী চলে যাওয়ার পর আমি ছাড়া তো ওর কেউ ছিল না। এখনও
মেয়ে জামাইকে আমি খুব বেশি দূরে যেতে দিইনি। ওরা প্রায়ই দেখা করতে আসে।
“তা ওই ঘটনার পর থেকে আমি জে.
জে-কে খুব বিশ্বাস করি। তুমি ওর ছাত্র, তাই তোমাকে খুলে বললাম ব্যাপারটা। এটা জানাজানি
হয়ে গেলে খুবই খারাপ হবে।
“এস আমার সঙ্গে এই ঘরে ছবিগুলো
তোমার হাতে তুলে দিই।”
প্রায় আট-দশখানা ছবি দিলেন আমার
হাতে। সকলেই ওখানকার বেশ বড়ো বড়ো ব্যক্তিত্ব। নামী বিজনেসম্যান।
আমি ওঁকে নিজের মতো একা ছেড়ে আবার
নিজের ঘরে ফিরলাম। তারপর আমার গোস্ট স্ক্যানারের নীল আলোয় ছবিগুলো ফেলে দেখি তাজ্জব
ব্যাপার। বুঝলে কিনা! একটা নয় দুটো নয় প্রত্যেকটা ছবির ভেতর অনেকজন অশরীরী। যে আমি
একেবারেই ওদের ভয় পাই না, হঠাৎ করে দেখে আমার গায়ে কীরকম যেন কাঁটা দিল। আসলে
এখানে রাত্রিবেলার পরিবেশ এতো নিঝুম, কলকাতার মতো তো আর নয়।
আমি সেই ছবি কয়েকটা তোমাকেও পাঠিয়েছি।
ভালো করে দেখলে দেখতে পাবে, কী করে ওদের সংখ্যা এক দুই তিন চার করে বেড়েছে। মানে যে
মারা যাচ্ছে সে যোগ হচ্ছে ওই দলে। যে ছবিতে শুধুমাত্র একজন অশরীরী সন্দেহটা তার ওপরেই
গেল। এটা কে হতে পারে?
মিস্টার জেনসনকে ছবিগুলোর ব্যাখ্যা
দিতেই ওঁর চোখে মুখে একটা আতঙ্ক ফুটে উঠল। অস্ফুটে
বললেন, “প্যাট্রিক,
প্যাট্রিক!”
জিজ্ঞেস করলাম, “কে এই
প্যাট্রিক?”
“প্যাট্রিক ম্যাডসন। ওর নিজের
ছবি তোলবার খুব শখ ছিল। একসময় অনেক ধনী ছিল প্যাট্রিক। ওর জাহাজের ব্যাবসা ছিল। বিপথে
গিয়ে সবকিছু খুইয়ে ফেলল। আগে অনেক খরচ
করে নিজের ছবি তোলাত। যেখানে বেড়াতে
যেত সঙ্গে ফটোগ্রাফার নিয়ে যেত। ওর ছবি এখানকার বড়ো বড়ো ম্যাগাজিনে বেরোত। গরিব হয়ে
যাওয়ার পর একদিন আমার কাছে এসেছিল। কী যে
খারাপ চেহারা হয়েছিল ওর! উশকোখুশকো চুল, মুখময় না কামানো গোঁফদাড়ি, কোটরাগত চোখ।
আমাকে বার বার অনুরোধ করছিল ওর ছবি তুলে দিতে। আমি ভাবছিলাম ও হয়তো পাগল হয়ে গেছে।
“ও আমার বাড়ি বারে বারে চলে
আসত। বাগানে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকত। আমি
দরজা বন্ধ করে দিতাম। একদিন ওর আসা হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেল। খবর
পেলাম ও আর ইহজগতে নেই। একরকম হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু এখন দেখছি ও আমাকে পুরোপুরি
ছেড়ে যায়নি। হে ঈশ্বর!” বলে পিটার জেনসন মুখটা হাত দিয়ে ঢাকলেন।
আমি ওঁকে আশ্বস্ত করে বললাম,
“চিন্তা করবেন না। স্যারের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমরা এখানে প্যাট্রিককে ডাকব। ওর ছবিও
তোলা হবে। তবে আপনার এই সাধারণ ক্যামেরায় নয়। আলাদা ক্যামেরায়। শুধু একটা অনুরোধ, ওকে
দেখে ভয় পাবেন না। একেবারে স্বাভাবিক থাকবেন। যেন ও ঠিক আগের মতোই আছে।”
তারপর এরপরের অংশ হয়তো তুমি আন্দাজ
করতে পারছ, তাও বলি।
শুক্রবার মাঝরাতে অনেক ডাকাডাকির
পর প্যাট্রিক এল।
আমি তাকে বললাম, “মিস্টার জেনসন
তোমার একটা ছবি তুলতে চান।”
সে কর্কশ গলায় বলল, “এখন আর ছবি
তুলে কী হবে?
বেঁচে থাকতে তো তোলেনি।”
আমি দৃঢ় গলায় বললাম, “এটাই তো
আপনার শেষ ইচ্ছে, তাই না মিস্টার প্যাট্রিক?”
- “তুমি যে আমার নামটা ডাকছ, আ-আমার
খুব ভালো লাগছে। কেউ আমাকে আর ডাকে না এইভাবে। বহুদিন হল।”
- “হ্যাঁ মিস্টার প্যাট্রিক, একবার সামনে
আসুন। আমার কাছে আপনার ছবি তোলার যন্ত্র আছে।”
তারপর সেই ছায়ামূর্তি আস্তে আস্তে
ফুটে উঠল দেয়ালের গায়ে। আমি ফিসফিস করে মিস্টার জেনসনকে বললাম, “সুইচটা টিপুন মিস্টার
জেনসন।”
মিস্টার জেনসন দেখি কথা বলছেন
না। কাঠের মতো দড়াম করে পড়ে গেলেন। আর প্যাট্রিকের সেই অশরীরী ছায়া ঘূর্ণি তুলে ক্যামেরাটাকে
উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে ফেলল।
আমি তাড়াতাড়ি মিস্টার জেনসন-এর
চোখে মুখে জল দিলাম। ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলাম কোনোমতে। সকালে উনি একটু
সুস্থ বোধ করলেন মনে হল।
ওঁর জামাই এসেছিল দেখা করতে।
বড্ডো বেরসিক লোক, বুঝলে কিনা! ভূত প্রেত এসব শুনেই আমার ওপর চেঁচাতে লাগল। তা
যাই হোক, ক্যামেরাটা সব কিছু সয়েও অক্ষত এবং প্যাট্রিকের ছবিও একটা উঠেছিল। তোমাকে
পাঠালাম দেখে নিও। অবশ্য রাতে দেখো না। তুমি যা ভীতু!
তিমিবাবুর মেইল শেষ করে
স্যারকে ফোন করলাম।
স্যার সবটা শুনে বললেন, “সবই
ঠিক বলেছে তিমির, শুধু শেষটায় জল মিশিয়েছে। পিটারের জামাই সেই ডাক্তার যে ওর কোভিড
টেস্ট করতে গিয়ে চোখে খোঁচা খেয়েছিল। তিমির জানত না
আগে। তিমিরকে দেখে সে কেন রেগে গিয়েছিল বুঝতেই পারছ।”
_____
ছবিঃ প্রত্যয়ভাস্বর জানা
দ্বৈতা,তোমার গল্প পড়লাম । ডেনমার্কে গিয়ে করোনা আবহে তিমিবাবু যা যা করলেন, সবটাই গোগ্রাসে গিলবে খুদেরা...খুদেরাই বা বলছি কেন...আট থেকে আশি সকলেই গিলবে!তিমিবাবু আর অপরাজিতার কাহিনি তো আর তুমি এই প্রথম লিখছ না, অনেকগুলোই উপহার দিয়েছ আগে ! ভূত নিয়ে নতুন পরিবেশ-পরিস্থিতিতে দুর্দান্ত পরিবেশন করলে! মজার মধ্যে দিয়ে নির্মল হাস্যরস এনে তুমি ভূতের গল্পে যোগ করতে পেরেছ অভিনবত্ব । এজন্যে কুর্নিশ তোমাকে আর শুভেচ্ছা এক আকাশ।
ReplyDeleteখাসা গপ্পো!
ReplyDeleteGood one!
ReplyDelete