নন্দিনী আর শিবার জন্য
প্রদীপকুমার বিশ্বাস
পুব পাহাড়ের ক্যাম্প গুটিয়ে, নতুন ক্যাম্পে যাবার পথে, বিদায়বেলায় আমাদের
বন্ধুদের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাতে গিয়ে বেশ দেরি হয়ে গেছিল। সেই দেরির কারণে আরও কিছু দেরি হয়ে
যায়।
শেষটায় ‘লোভে পাপ আর পাপে…’ সেইরকম কিছু একটা চরম পরিণতি যে একসঙ্গে
আমাদের পুরো দলটার জন্য হতে পারত, তা ভাবলে বহু বছর পরেও আজও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সত্যি সেই বিকেলে সময়মতো
নন্দিনী আর শিবা না এসে পৌঁছালে আমাদেরকে কেউ আর প্রাণে বাঁচাতে পারত না।
সেই সময়টা আমরা ছত্রিশগড়ের গভীর অরণ্যে টাংস্টেন আর এমারেল্ডের অনুসন্ধান
করছিলাম।
বিশাল এই অরণ্যের বুক চিরে তাকে সমান সমান দু’ভাগে ভাগ করে এগিয়ে চলেছে
উপল ব্যথিত খরস্রোত বুকে নিয়ে পাহাড়ি নদী। এই নদীর পশ্চিম পাড়ের কাছে মেঘা পাহাড়ের সব ক’টি
নমুনাতেই বেশ ভালো মাত্রায় টাংস্টেন আর তার কাছের কুঁজোচুড়ো পাহাড়ে এমারেল্ডের উপস্থিতি
ধরা পড়ল।
আমরা এবার স্থির করলাম যে আমাদের ক্যাম্প নদীর পূর্ব পাড়ের পাহাড় থেকে মেঘা পাহাড়ে
নিয়ে গেলে কাজের সুবিধে হবে।
অন্য সব জায়গার মতো এখানেও আমি এবং আমার সহচরেরা ক্যাম্প শিফটিং-এর শেষ
দিনে নতুন ক্যাম্পে যাওয়া স্থির করলাম। সকালেই সব টুকিটাকি জিনিস, টেন্ট, ভি স্যাট এন্টেনা আর ওয়্যারলেস সেট ট্রেলর
জিপে আর সহচর মংলুর বাড়ি থেকে আনা মোষের গাড়িতে জেনারেটর আর পাম্প সেট নিয়ে নতুন
ক্যাম্পের দিকে রওয়ানা হয়ে গেল। আমরা যে যার ঘোড়ার পিঠে চড়ে পুব পাহাড়ের পশ্চিম ঢাল হয়ে নতুন ক্যাম্পে
যাব।
পশ্চিম ঢালে সার্ভে টিমের কিছু স্টেশনে গাছের মগডালে ফ্ল্যাগ লাগাবার কাজ তখনও
বাকি।
মেঘা পাহাড় আর কুঁজোচুড়ো পাহাড়ে যে মূল্যবান খনিজগুলি পাওয়া গেছে তার
সার্ভে করতে গেলে প্রথমে এই ফ্ল্যাগগুলো দেখেই কাজ শুরু হবে।
অরণ্যের এই গভীর এলাকায় নানারকম পশুপাখি এবং শ্বাপদ আছে। সবচাইতে ভয়ঙ্কর হচ্ছে
গাছের ডালে ঝুলতে থাকা পাইথন, ঘাসবনের শঙ্খচূড়, জংলি শুয়োর, কুকুর, হায়েনা।
এই পাহাড়শ্রেণির তরাই অঞ্চলে বাঘের দেখাও মেলে। একবার
এখান থেকে কাজ শেষে একটা অনাহারে থাকা বনবিড়ালির বাচ্চাকে ঘোড়ার পিঠে তুলে আনি। বাচ্চাটা আমাদের
ক্যাম্পে থেকে, দুধ খেয়ে বেশ সজীব চঞ্চল হয়ে উঠল। আমি ওর নাম রাখলাম নন্দিনী।
আমাদের স্থানীয় পথ প্রদর্শকেরা, তাদের পরব উপলক্ষে এক হপ্তা কাজে আসেনি। কাজে ফিরে এসেই তাদের
নেতা মংলু, বিড়াল ছানাটাকে দেখে শিউরে উঠে আমায় বলে, “সাহেব, এটা বনবিড়ালের বাচ্চা
নয়।
বাঘিনির বাচ্চা, তবে এও বাঘিনি। আমি এটাকে এখুনি পূর্ণাপানির ধারে ছেড়ে আসছি।”
নন্দিনীকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেও আমরা কিন্তু তার পুরো খেয়াল রাখলাম। সে যাতে অনাহারে না থাকে
আমরা তার ব্যবস্থা করলাম। উত্তর ঢালে খনিজের নমুনা নেবার কিছু ভারী যন্ত্র
নামাবার জন্য একটা গাছে যে কপিকল লাগানো ছিল তাতে দড়ি বাঁধাই ছিল। প্রতি বিকেলে সেই কপিকল
দিয়ে একটা বড়ো দুধের বোতল দড়ি দিয়ে নামিয়ে, ‘নন্দিনী’ বলে চিৎকার করে ডাকলে, ঘাসবন থেকে জন্টি রোডসের মতো
লাফ দিয়ে বোতলটা ধরে নিত নন্দিনী। কয়েক মাস পরে আর এসবের দরকার হয়নি। তখন সে নিজেই হরিণ ধরে খায়, তবুও
আমরা নন্দিনী বলে ডাকলেই ও ঘাসবন থেকে গর্জন করে সাড়া দেবে। এই সময় এক ঝড়ের পরদিন আমরা এক
বাজপাখিকে পাই মুমূর্ষু অবস্থায়। আমরা সবাই মিলে বাজপাখিটিকে সুস্থ করে তুলি আর তার নাম দিই শিবা। সেই থেকে ও আমাদের কাছে
আছে।
আমাদের ইঙ্গিত ইশারা ও বোঝে, ওর কিছুটা আমরা বুঝি। আমাদের কাছে থাকবার কিছুদিন পরেই শুরু
হয়ে গেল ওর এক নতুন খেলা। আমরা ‘নন্দিনী’ বলে ডাকলেই ও সিধা ঘাসবনের দিকে
উড়ে গিয়ে নন্দিনীর কাছে পৌঁছে যেত। দু’জনের মধ্যে দারুণ ভাব। আমাদের ইশারায় ও কয়েকবার উড়ে গিয়ে আমাদের পাঠানো কাঁচা মাংস নন্দিনীর
কাছে পৌঁছে এসেছে।
আমরা পরে এই জিনিসটাই কাজে লাগাই এখান থেকে দূরের লোহাপাহাড় বেস ক্যাম্পে
যোগাযোগের জন্য।
এইরকম জায়গায় পায়ে হেঁটে কাজ করা শুধু সময়সাপেক্ষ নয়, বেশ বিপদজনকও বটে। ঘোড়ার
পিঠে, পাহাড়ের দুর্গম চড়াই বা ঢালে কিংবা জঙ্গলের গাছের ফাঁক দিয়ে গলে অনায়াসেই
এগিয়ে যাওয়া যায়।
ঘোড়ার খুরের আওয়াজ পেলেই শঙ্খচুড় থেকে শুরু করে সব ভয়ংকর প্রাণী একে সমীহ
করে দূরে সরে যায়।
পুব পাহাড়ের পশ্চিম ঢালের কাজটা যতটা
তাড়াতাড়ি সেরে ফেলা যাবে ভেবেছিলাম সেটা হল না। প্রতিটি
সার্ভে স্টেশনের একদম কাছের গাছের মগডালে উঠে ফ্ল্যাগ লাগাতে আর সেগুলি
থিয়োডোলাইটে লিপিবদ্ধ করতে বেশ সময় লাগছিল।
অরণ্যের এই বিশাল এলাকাটি প্রাক্তন মহারাজের শিকার ক্ষেত্র বলে এখানে
সযতনে পেয়ারা, নাশপাতি, বাতাবি, কলা ইত্যাদি ফলের গাছ এক সময়ে প্রচুর লাগানো
হয়েছিল।
পুরো জঙ্গলে এইরকম বিশাল ফলের প্রাকৃতিক বাগান আর নেই।
সেদিন এক জায়গার কাজ সেরে গাছের মাথায় চড়ে লাল পতাকা লাগিয়ে অন্য জায়গাতে
যাবার পথে, সার্ভের লোকেরা ফলের গাছ দেখলেই তা থেকে বেছে বেছে পাকা ফল তুলে নিয়ে
তাদের ব্যাগ বোঝাই করছিল।
জঙ্গলে সব প্রাণীই হিংস্র নয়। এই জঙ্গলের কপি বাহিনী, একপাল চিতল হরিণ আর অনেক পাখি - এদের সবার সঙ্গে
আমাদের বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল।
গাছের মগডালে থাকা বাঁদরবাহিনী বহুবার জংলি কুকুরের দলের আর ভালুকের আসার
খবর আমাদেরকে ইশারা করে জানিয়ে দিয়ে আমাদের প্রাণ বাঁচিয়েছে। পুবের পাহাড়ে কাজের শুরুতেই দেখা হয়ে
যেত সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে থাকা চিতলের একটা দলের সঙ্গে। আমরা কাজ না শুরু করা অবধি ওরা অবাক
বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে দেখত আমাদেরকে। কিন্তু সেদিনের সেই বিদায়বেলায় এদের কাউকেই দেখতে পেলাম না। এমন
কী যে যে দোয়েল, ময়না, টিয়া, হরিয়াল আমাদের সঙ্গে সর্বদা ঘুর ঘুর করত, টিফিনের
ফলের টুকরো খেত সেদিন তারাও আমাদেরকে দেখল, কিন্তু পাত্তা দিল না। মনে হল যেন এরা সবাই
বলছে, ‘যাচ্ছ, যাও তোমরা ছাড়া কি আমাদের কিছু আটকে থাকবে?’
পুবের পাহাড়ের পশ্চিম ঢালের শেষ সীমারেখায় এসে আমরা সবাই থমকে দাঁড়ালাম। এইখানের ট্রানগুলেসন (trangulation)
স্টেশনের ওপরে লাল ফ্ল্যাগ আর গাছের মাথায় দু’প্রান্তের লাল ফ্ল্যাগ টাঙিয়ে দিলেই
পুব পাহাড়ের কাজ শেষ। এখান থেকে দেখা যাচ্ছে মানুষ সমান উঁচু ঘাসবন। এটা
পার হলেই শুরু হয়ে যায় পাহাড়ি নদী।
সার্ভে টিম সবেমাত্র তাদের থিওডোলাইটের শক্তিশালী টেলিস্কোপের সেটিং ঠিক
করে একটু আগে বসানো ফ্ল্যাগগুলোকে দেখবার জন্য অনেকগুলো উচ্চশক্তির বাইনোকুলার বার
করেছে।
আমার বাইনোকুলারে এবং ওদের অভিজ্ঞ চোখে প্রায় একই সঙ্গে দেখা গেল যে
ঘাস বনের পূর্বদিকে একটা ঝড় ঢেউয়ের মতো ওঠানামা করতে করতে আমাদের থেকে হাত-তিনেক
দূরে লম্বা গাছগুলোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
আমি শঙ্কিত হলেও দেখি আমার সঙ্গীদের মুখে চাপা আনন্দ। তবে
কি ওরা এখানে ক্যাম্পের কোনও টিমের আসার জন্য অপেক্ষা করছিল? ওরা কারা তা এক লহমার
মধ্যে দেখা গেল।
ঘাসবন থেকে জোরে লাফ দিয়ে যারা গাছের ডালে-ডালে উড়ে এসে জুড়ে বসল, তারা
হল এক বড়ো বাঁদর বাহিনী। সার্ভে টিমের উল্লাস দেখে মনে হচ্ছিল, দু’দল প্রাণের বন্ধুর যেন
বহুদিন পরে দেখা হল। এইবার বুঝলাম একটা বড়ো হ্যাভারস্যাক ভর্তি
জঙ্গলের কলা, পেয়ারা, বাতাবি আর নাসপাতিগুলো ওরা কাউকে না দিয়ে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে
কেন!
ওরা প্রত্যেকে নিজের নিজের হ্যাভারস্যাক খুলে জঙ্গলের কলা, লেবু, বাতাবি,
নাসপাতি হনুমান বাহিনীর দিকে ছুড়ে মারতেই কপিবাহিনী জন্টি রোডসকে লজ্জা দিয়ে
সেগুলো অনায়াসে ক্যাচ ধরে ফেলছিল। ফলগুলো উদরস্থ করবার পর তারা গাছ থেকে মাটিতে নেমে এসে সাম্বা আর সালসা
মিশিয়ে একটা জম্পেশ সমবেত নাচ দেখাল। কিন্তু পুব দিক থেকে ধুলোর ঝড় তুলে কারা যেন আসছে? এক লহমার মধ্যে পুরো
কপিবাহিনী গাছে চড়ে গেল। কারা আসছে ধুলোর ঝড় তুলে? চিতার একটা দল কি আসছে তাদের চিরশত্রুদের আসার
খবর টের পেয়ে?
একটু পরেই আমাদের আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করে এল একপাল চিতল হরিণ বা চিতল
এক্সপ্রেস।
গাছের ওপর কপিবাহিনী দেখতেই থেমে গেল তারা। আমাদের থেকে পাওয়া ফলগুলো থেকে ওরা
কিছু বাঁচিয়ে রেখেছিল চিতল হরিণ বন্ধুদের জন্য। সেগুলো ছুঁড়ে ছুঁড়ে এগিয়ে দিয়ে
আপ্যায়ন করল আর ওরাও সানন্দে লাফিয়ে সেগুলো গ্রহণ করল। আমরাও বেশ কতগুলো পাকা পেয়ারা
চিতলদের দিকে ছুঁড়ে দিলাম। কপিবাহিনী সেই দেখে আনন্দে কিচ-কিচ করে উঠল।
সবার পরে পৌঁছাল একজোড়া চিতল দম্পতি। তাদের দিকে পেয়ারা ছুঁড়তেই ডুয়েট নাচের
ভঙ্গিতে দু’জনেই অনেকটা উঁচুতে একসঙ্গে লাফিয়ে সেগুলো কামড়ে ধরল। এই দেখে আমরা সবাই দু’দলের
দিকেই সবার ব্যাগ থেকে কুড়িয়ে-বাড়িয়ে বাকি ফলগুলোও ছুঁড়ে দিতে থাকলাম। এবার শুরু হয়ে গেল হরির
লুঠের মতো মাটিতে গড়িয়ে পড়া ফলগুলো কুড়োবার বা সোজা মুখে ফেলে দেবার ফ্রেন্ডলি
ম্যাচ।
এর মাঝে দু’পক্ষের যৌথ নাচও হচ্ছিল। বাঁদরেরা দু’পায়ে হেলে-দুলে আবার কখনও
বা ডিগবাজি খেয়ে আর হরিণেরা সামনের দু’পা জোড়া দিয়ে আকাশের দিকে তুলে পেছনের পায়ের
খুরে ভর দিয়ে দু’ধারে হেলে-দুলে তাদের নাচ দেখাল। কিছু পরে অন্য এক তালে স্প্রিং-এর মতো
লাফ দিয়ে শরীরকে হাওয়ায় সামান্য ভাসিয়ে দিয়ে ডান দিক থেকে বাঁ দিকে হেলে আর এক
ধরনের নাচ দেখাল।
হঠাৎ করে কী হল, রেফারি যেমন খেলা শেষের বাঁশি বাজায়, সেইভাবে হনুমান
দলপতি মুখে একটা অদ্ভুত সুরে হিপ-হাপ করল। মুহূর্তের মধ্যে মাঠ ফাঁকা করে দু’দলই বিদায়
নিল।
হরিণের দল ঘাস বনের ফাঁকে শুঁড়িরাস্তায় দৌড়াতে-দৌড়াতে আর কপি-বাহিনীও সেইদিকে গেল,
তবে আকাশ পথে গাছের শাখায়-শাখায় দোল খেতে-খেতে। তবে হ্যাঁ, যাবার আগে কপি-বাহিনীর
পক্ষে বীর হনুমান, আমাদের সবাইকে মাথা নিচু করে তাঁর দু’হাত বাড়িয়ে দিল। কিছুক্ষণ সেই অবস্থায়
থেকে তারপর রীতিমতো ট্রাফিক পুলিসের ভঙ্গিতে হাতের ইশারা করে নিজের দলের সদস্যদের
তাকে অনুসরণ করতে বলল। এসব কে এদের শেখাল কে জানে? এ জিনিস আমি তো নয়ই, বহু বছর বনে-জঙ্গলে জরিপের
কাজে ঘোরা সার্ভে টিমের কেউ দেখেনি। তবে এইসব দেখতে গিয়ে আমাদের বেশ দেরি হয়ে গেল।
গাছের ছায়াতে বসে সঙ্গীদের খাবার বার করতে বলে খেয়াল
হল আমাদের দলের বাজপাখি শিবার কথা। দুপুরের এই খাবার সময়ে শিবা কখনও আমার কাছ ছাড়া হয় না। আকাশের দিকে তাকিয়ে বেশ
কয়েকবার ওকে ডাক দিয়েও সাড়া পেলাম না। জঙ্গলের পশু পাখিদের নিজেদের মধ্যে ‘এলাকা’ নিয়ে একটা পারস্পরিক বোঝাপড়া
আছে।
পুব পাহাড়ের বন্যেরা পশ্চিম ঢালের ঘাসবনের বাইরে যাবে না আর নদীতটের পশ্চিম পাড়
থেকে পুব দিকে মেঘাপাহাড় ছাড়িয়ে পুরো জায়গাটা বনশুয়োর, জংলি কুকুর আর হাতিদের বিচরণ
ক্ষেত্র।
তরাই থেকে আসা বাঘিনি নন্দিনী হয়তো এই কারণেই পাহাড়ি নদী পার করে পশ্চিম পাড়ের
জঙ্গলে শিকারের সন্ধানে যায়নি।
পাহাড়ি নদীতে সাঁকো নেই। বনবিভাগের
বানানো জঙ্গলের রাস্তা অনেক ঘুরপথে পাহাড়ি নদীর কাছে এসে শেষ হয়েছে। আমাদের চাইতে অনেক আগে
বেরিয়েও আমাদের জিনিসপত্র নিয়ে মোষের গাড়িটি কিছুক্ষণ আগেই পাহাড়ি নদীর কাছে এসে
পৌঁছেছে।
দুপুর তখন গড়াবার মুখে। মংলু বলে তার লোকজন দুপুরের খাবার জোগাড় প্রায় করে এনেছে।
পাহাড়ি নদীতে মাছ যেমন প্রচুর তেমনি তাদের ধরা
খুব সহজ।
মোষের গাড়িতে থাকা মংলুর লোকজন প্রচুর মাছ ধরেছে আর সেগুলো কেন্দুপাতার মতো একরকম
পাতাতে মুড়ে আগুনে পুড়িয়ে একদম তৈরি রেখেছে। শুধু ভাত তৈরি হবার দেরি। আমরা ততক্ষণে নদীতে স্নান সেরে নিতে
পারি।
কিন্তু আমার সঙ্গীরা ভাত বানাতে নিষেধ করে আমাকে একটা অন্য দিকে ইশারা করল।
পাহাড়ি নদীর উর্বর মাটিতে আলুর মতো দেখতে কিন্তু
এক একটা প্রকান্ড সাইজের একরকম সবজি হয়। আগুনে সামান্য সময় পুড়লেই মাখনের চাইতেও
সুস্বাদু এই আহার, আর মাছের পাতাপোড়া খেলে মন আর পেট ভরে যায়।
আমার সাথীরা একটু দূরে সেই সবজির একটা ছোটো স্তূপ
দেখতে পেয়েছে।
মনে হচ্ছে কেউ যেন অনেকগুলো এইরকম আলু তুলে রেখেছে ঢের করে। আমরা কেউ খেয়াল করলাম না যে এই
আলুগুলো মাটি থেকে আর কেউ নিজের ধারালো নখ দিয়ে খুঁড়ে বের করেছে আহারের জন্য। সেটা জানা গেল একটু পরেই।
এক বনশুয়োর এগুলো খুঁড়ে রেখে গেছিল তার অভুক্ত সন্তানদের জন্য। সে তার ছানাপোনাদের নিয়ে
এদিকেই আসছিল।
আলুপোড়ার গন্ধ পেয়ে সে সদলে তাড়া করে এল।
চোখের পলক ফেলবার আগে আমার সঙ্গী সাথিরা গাছে
তরতর করে চড়ে গেল।
আমি সেই গতিতে গাছে চড়তে পারব না আন্দাজ করে মংলু আমাকে প্রায় কাঁধে নিয়ে একটা
গাছের মগডালে উঠে যায়। আর সেইসময় কোথা থেকে একপাল বুনো কুকুর ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই বুনো শুয়ারের
পরিবারের ওপর।
জঙ্গলে আমার দেখা সব চাইতে হিংস্র আর বেপরোয়া হল এই বুনো কুকুর। এরা আমাদেরকেও আক্রমণ
করতে ছাড়ল না।
দু’জন সাথি একটা বেঁটে গাছে চড়েছিল। কুকুরদের একটা দল
বনশুয়োরদের ফালা ফালা করতে থাকল, আর ওদের মধ্যে কিছু সদস্য সেই বেঁটে গাছে ঝাঁপ
দেবার তাল করতেই পর পর কয়েকটা হাতি তাড়ানো পটকা ফাটানো হল। কিছু পটকা থেকে শুকনো ঝোপে আগুন
লাগাতেই রণে ভঙ্গ দিয়ে পালায় তারা। পুরো ব্যাপারটা এত দ্রুতবেগে ঘটে গেল যে আমরা কয়েকজন একদম চোখের সামনে
অল্পের জন্য নিশ্চিত মৃত্যুকে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে যেতে দেখে কিছুক্ষণ বেশ হতভম্ব
হয়ে রইলাম।
পেটেও আগুন জ্বলছিল, এই সব অবস্থায় কী কারণে
জানি না খিদে বেশ বেশিই পায়। খেতে খেতে আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলাম যে এখন আমাদের নতুন
ক্যাম্পে যাওয়া ছাড়া আর অন্য কোনো উপায় নেই কেন না পুরোনো ক্যাম্পে এখন চারপাশের
বেড়াটুকুও নেই।
মংলু বলছে যে এই জংলি কুকুরের দল সহজে হার মানবার পাত্র নয়। হতেই
পারে যে ওরা এইবার আরও বড়ো দল নিয়ে নদীর অন্য পারে আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছে। আমাদের যে করেই হোক নতুন
ক্যাম্পে একটা খবর পাঠাতে হবে। ওই ক্যাম্পে এখন ত্রিশ-চল্লিশজন লোক আছে, তার বেশিরভাগ আর্মি রিটায়ার্ড
লোক।
তারা তো খবর শুনেই দৌড়ে চলে আসবে। অন্য দিকে মংলু বলছে তার দলেও আর্মি রিটায়ার্ড লোক এমন তিন-চারজন আছে
যাদের কাছে জংলি কুকুরের পালকে টপকে নতুন ক্যাম্পে গিয়ে খবর দিয়ে সবাইকে এইখানে
নিয়ে আসা কোনো ব্যাপারই নয়। এদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধের অন্ধকার নামতে ঘন্টাখানেক মাত্র বাকি। যা কিছু করতে হবে এর
মধ্যে।
এইসময় আমরা কয়েকজন বাইনোকুলারে দেখতে পেলাম যে এক পাল জংলি কুকুর নদীর অন্য পারের
ঝোপগুলোতে লুকিয়ে আছে। মংলুর কথাটা তাহলে ঠিক।
এখন দরকার খবর পৌঁছানোর এই কাজটা বিদ্যুৎগতিতে
সেরে ফেলা।
আর সেই কাজ একজনই করতে পারে। আমি গলা উঁচিয়ে খুব জোরে ডাক দিলাম, “শিবা, শি….বা, শি….বা”। তৃতীয়বারের পর এবার মুখ
দিয়ে বেরিয়ে গেল, “নন্দিনী, ন… ন্দি… নী”। কয়েক মুহূর্তের নীরবতাকে খান খান করে ভেঙে দিয়ে
এবার দূরে কোথাও মেঘ গর্জনের মতো শোনা যায় বাঘের পিলে চমকানো আওয়াজ। এ আওয়াজ আমার চেনা,
একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে আমি আবার ডাকলাম “নন্দিনী।” আমি এবং আমার কয়েকজন অন্তরঙ্গ সহচর
যারা নন্দিনীকে তার শৈশব থেকে জানে, আমরা সবাইকে হাত তুলে ইশারায় ভয় না পেতে
অনুরোধ করলাম।
নন্দিনী কিন্তু আমাদের থেকে অনেক দূরে কয়েকটা গাছের আড়ালে এসে দাঁড়িয়ে
গেল।
আমরা সবাই দেখলাম, শিবা নন্দিনীর পিঠে আর সেখান থেকে উড়ে এসে নামল যথারীতি আমার
কাঁধে।
শিবা উড়ে এল বটে কিন্তু কেমন জানি সে রকম সাবলীল নয়। এবার
লক্ষ করে দেখি তার ডানায় আর শরীরে কয়েক জায়গায় বেশ গভীর চোট। পুব পাহাড়ে একটা গোঁয়ার শঙ্খচূড় আছে। তার সঙ্গে লড়তে গিয়ে
ব্যাপারটা চোটের ওপর দিয়ে গেছে, শঙ্খচূড়টা ভাগ্যিস বিষ ঢালবার মওকা পায়নি। দুটো কোডেড অর্ডার চিট
লিখলাম, একটাতে আমরা কোথায় আর কী অবস্থায় আটকে পড়েছি জানিয়ে, অন্যটা সদ্য নিযুক্ত
মেডিক্যাল অফিসারকে - অবিলম্বে যেন শিবার চোটের চিকিৎসা শুরু করে দেওয়া হয় এই
মর্মে।
অর্ডার চিট দুটো ওর দুই পায়ে আলাদা আলাদা করে বেঁধে দিয়ে গলায় আর্জেন্ট ট্যাগ
লাগিয়ে দেওয়া হল।
আমার কাঁধে চড়ে বা ওয়্যারলেস বিকল হলে শিবা বহুবার মেঘাপাহাড় ক্যাম্প সাইট
নির্মাণের সময় সেখানে গিয়ে “মেইল” দিয়ে এসেছে। তাকে
একটু ইশারা করে নতুন ক্যাম্পের দিকটা বুঝিয়ে দিতেই সে চোখের নিমেষে সেদিকে চলে গেল। মিনিট
খানেক পরেই জিপিএস ট্র্যাকিং-এ বোঝা গেল যে সে পৌঁছে গেছে। এদিকে আমাদের নন্দিনী নদীতটে গিয়ে
বেশ কয়েকবার চিৎকার করে হুমকি দিয়ে এসেছে। নদীতটের পশ্চিম পাড়ের ঝোপগুলোতে থাকা জংলি
কুকুর, নেকড়ে আর হায়েনাদের কিন্তু তারপর আমাদের বাইনোকুলারে আর দেখা যায়নি।
সূর্যাস্ত হবার আগেই নতুন ক্যাম্পের সিকিউরিটি
স্টাফেরা আমাদের নিরাপদে এসকর্ট করে পৌঁছে দিয়েছে। ক্যাম্প শিফটিং কমপ্লিট রিপোর্টের
মেসেজ কর্পোরেট অফিসে পৌঁছাবার পর নির্ধারিত সময়েই ক্যাম্পের উদ্বোধনের ফিতে কেটে ‘ডি
এফ ও’ সঞ্জয় সিং আমার দিকে চেয়ে বললেন, “তাহলে পথে আপনাদের দেরি হতে গিয়েও হয়নি।” আমরা সবাই মনে মনে
বললাম, “সেটা শুধু নন্দিনী আর শিবার জন্য।”
_____
ছবিঃ সুকান্ত মণ্ডল
No comments:
Post a Comment